alt

সাময়িকী

বাংলা কবিতার প্রকৃত পরহেজগার

আল মাকসুদ

: বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১

শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) কবি শামসুর রাহমান

বাংলা কবিতায় প্রাগ্রসরবোধ আমদানি করেন মাইকেল। সহসা চেতনার বহির্গমনের সঙ্গে অন্তর্জাত বহ্নি এসে আধুনিক বাংলা কবিতার এপিঠ-ওপিঠকে করে তোলে মানবিক দর্শনানুসন্ধানের নব দর্পণ। কবিতার শরীরে জ্বলে ওঠে সময় ও প্রচল প্রতিবেশ ছাপিয়ে ভিন্ন কিছু। কবি এবং কবিতা উভয়ই হয়ে ওঠে মর্ত্যচারী। কবিতা স্বর্গমর্ত্যব্যাপীও হতে পারে। কিন্তু মূল বিষয় ভূমিলগ্ন মর্ত্যচারী মানুষকে স্পর্শ করা। মাইকেল সেই কাজটিকে সার্থকমণ্ডিত করেন- এটাই মাইকেলের বিশেষ কৃতিত্ব। বাংলা কবিতা তারপর থেকে মানুষের কবিতা। দেবদেবীর নয়। গতিমান সময়ের সঙ্গে অতঃপর কবিতা এগিয়েছে বহুদূর- কতদূর কেউ জানে না। কী পুবে, কী পশ্চিমে কারো কাছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। আধুনিক বাংলা কবিতার লক্ষণীয় মানসভূমি তিরিশের দশক। তিরিশের আগল ভাঙতে পারেননি চল্লিশের কাব্য-পুরোহিতরা। পঞ্চাশ সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নির্মাণকলায় শক্তির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। তখন বোদলেয়ারিয় এলিটিজমে আক্রান্ত বাংলাভাষী অসংখ্য কবি। সামনে-পেছনে সটান দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। হোমাগ্নিটা জ্বালিয়েছিলেন তিনিই- কবিতা পত্রিকা দিয়ে। কবিতা পত্রিকার উদ্দীপিত সহযাত্রী হিশেবে চলিষ্ণু তখন চতুরঙ্গ, পূর্বাশা’র মতো পত্রিকা। কবিতা কী রকম চাই- প্রশ্ন উঠেছিলো হয়তো; কিন্তু পাঠক ততোদিনে কবিতার স্বাদ পেয়ে গেছেন। নতুন কড়কড়ে স্বাদ। ওখান থেকে কেউ আর বের হতে চায়নি। স্রোতধারা একই, কেবল বদল হলো স্রোতবাঁক। সময়টা ছিলো শুধুই কবিতার। এপারে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক- ওপারে বিনয় মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিতার বাঁশি বাজালেন; নির্মিত হলো নতুন শব্দের সিম্ফনি। এটা কোনো কোয়েনসিডেন্স নয়- একেবারে অনিবার্য পরিণাম বাংলা কবিতার। বহুমাত্রিক কবিতার স্বাদগন্ধে বিভোর এমন সময় বাংলা কবিতায় আর আসেনি। কবিতা কেমন হবে? কিংবা কবিতার মানদণ্ড? কে-ই বা করবে কবিতার মানদণ্ড নির্বাচন? এবংবিধ প্রশ্ন ছিলো হরহামেশা। কবিতার মানদণ্ড অবশ্যই আপেক্ষিক। কিন্তু সময়ই চিহ্নিত করে দেয় কিছু বিষয়, বিচিত্র-জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত মীমাংসা হয় না; তবে সৃষ্টি-স্বকীয়তা যে উৎসমুখের ইঙ্গিত করে তাকে উপেক্ষা করা যায় না। বাগড়াও দেয়া যায় না তাতে। সেটি বোধ হয় উচিতও নয়। ঔজ্জ্বল্যের যে দেমাক- তাতে রঙের চেয়ে রূপের জৌলুস থাকে। মূলত রূপটাই প্রধান। সেরকম কাব্যরূপ মুগ্ধ পরহেজগার কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। যাত্রাটা পঞ্চাশের। স্থিতি ও স্মৃতি চিরকালের। কারণ সম্ভবত পরহেজগারিতা। কবির বয়ান :

নিরন্তর কাব্য সাধনায় বাংলা কবিতা নতুন নতুন কাব্যপঙ্ক্তির সমাহারে ঋদ্ধ হয়েছে। সমস্ত অন্ধকারের গ্লানি মুছে দিয়ে বাংলা কবিতার যে জয়যাত্রা ঘটেছিলো পঞ্চাশে- সেই জয়যাত্রার সামনের সারিতে থেকে গেছেন কবি শামসুর রাহমান

...] জীবনের আর যে ক্ষেত্রেই হোক, এ ক্ষেত্রে আমি পারতপক্ষে কোনও ফাঁকি কিংবা কোনওরকম ওপর চালাকিকে প্রশ্রয় দিই নি; প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃত পরহেজগারের মতো নিবেদিত চিত্ত থাকতে সচেষ্ট রয়েছি। সত্যিকারের সাফল্য এসেছে কি-না, বলতে পারব না তবে আমার সাধনায় কোনও ফাঁকি নেই। (কালের ধুলোয় লেখা, ২০০৭, পৃ. ২২৪)।

কবির এ বক্তব্য সোজাসাপ্টা; বাকচাতুরির অহেতুক বিনয় নেই। সর্বাংশে সত্য। কবিতার পরহেজগারিতা তাঁর অতুল্য। সচেতনতা, বিচ্ছিন্নতা আবার নাগরিকবোধের সংলগ্নতা তাঁকে নিবিড় নিবিষ্ট করে তুলেছে কবিতা চর্চা যেমন থামতে পারেননি, তেমনি থামাতেও পারেনি তাঁকে কোনোকিছু। পলিটিক্যাল কনসেপ্ট নিয়ে লেখা সে-সময়ে তাঁর মতো আর কেউ ছিলেন না। ‘আসাদের শার্ট’ শুধু কবিতা নয়; অবিকল্প স্লোগান। এবং শুদ্ধ রাজনীতিও। কিন্তু তিনি কখনোই রাজনীতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন না; যেমন ছিলেন তাঁর বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)। হাসান হাফিজুর রহমান রাজনীতিতাড়িত বাসনা থেকে যখন উচ্চারণ করেন- ‘...সাম্য আজো সোনার হরিণ,/ গণ-অধিকার এ ওর ভয়ে ভীষণ অস্থির।/ কারো কাছে মুক্তির ছাড়পত্র নেই, হয়তো কোথাও/ মনুষ্যত্ব নেই বলে’...(আমার আনুগত্য), তখন এখানে রাজনীতি জ্বলে ওঠে। কিন্তু ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় রাজনীতি জ্বলে ওঠে না, মানুষ জেগে ওঠে মুক্তির আকাক্সক্ষায়। রাজনীতি ও জন-আকাক্সক্ষার প্রায়োগিক মৌলিক পার্থক্যটা মূলত এখানেই। অথবা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রফিক আজাদ-এর ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় যে আর্থ-সামাজিক রাজনীতি আছে- এরূপ উচ্চারণভঙ্গিতে লক্ষ করা যায় সুকান্তধর্মী মনোযোগ। এটিও শামসুর রাহমানের কাব্যশীলনবোধে স্বেচ্ছানির্বাসিত। যা এসেছে তা মৃদু শাসনের ভঙ্গিতে। ব্যক্তিক বুনিয়াদি রক্ষায় অতি সচেতনতা হয়তো এর কারণ। এবং লেখা অনাবশ্যক- সেখানেও পরিবর্তনের সুর আছে- তবে প্রবল ধ্বনি নেই। এটি নেই মানে- সচেতনভাবেই নেই। কারণ তাঁর স্বভাবের ভেতরে প্রকৃতিগতভাবেই এক ধরনের শুদ্ধবাদী নম্রতা ছিলো- যেটি তাঁর কবিতা লেখার অন্তঃপ্রেরণা। নিপাট পরহেজগারিতার জন্যেই তাঁর কবিতা চর্চায় কোনো ছেদ পড়েনি। বিরামহীন এবাদতের মতো কবির চর্চামগ্নতা ঈর্ষণীয়। তিনিই বলতে পেরেছেন ‘কবিতাই আমার ভালো লাগতো। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতাই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম’। আর কবিতায় যা দিতে চেয়েছিলেন তার স্বীকারোক্তি এমন-‘জীবন বা পৃথিবীর তথাকথিত কদর্যের মধ্যেও যে সৌন্দর্য আছে, আমি সেটা দেখাতে চেয়েছিলাম’। কবিতার আদিগন্ত দিগ¦লয় উন্মোচিত হয়ে উঠছিলো তাঁর সময়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এবং তখন কবিরাই শুধু জেগে ওঠেননি, পাঠকের অন্তর্বৃত্তে কবিতাও জাগিয়েছিলো নেশা নেশা ঘ্রাণ। নেশাজাগানিয়া ঘ্রাণের শীলিত অনুশীলন-ঐশ্বর্যের কবিতাস্রষ্টাদের মাঝে শামসুর রাহমান স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত একজন।

নাগরিক কবির বিশেষ অভিধা ছিলো তাঁর। নগর ঢাকার আলোবাতাসে নাগরিক না হয়ে উপায়ও হয়তো ছিলো না। যেমন নগর কলকাতা নাগরিক করে তুলেছিলো সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) এবং বুদ্ধদেব বসুকে। বলা নিষ্প্রয়োজন- প্রস্তুতিহীন, তড়িঘড়ি কোনো যাত্রার নাম নাগরিকযাত্রা নয় বলেই এখানকার কাব্যভাষা হয়ে ওঠে অধিকতর পরিশীলিত, পরিপাটি ও বুদ্ধিদীপ্ত। বাংলা কবিতায় পশ্চিমা ইনটেলেকচুয়ালিটির প্রভাববলয় থেকেই এই নাগরিকবোধের জন্ম। এ মেজাজটাকে সার্বরাষ্ট্রিক পরিশীলনও বলা যায়। অভিন্ন কথা- কিন্তু স্বতন্ত্র মূল্যায়ন সতীর্থ কবি হাসান হাফিজুর রহমান-এর-

“স্বাভাবিকভাবেই মেজাজে তিনি আরবান। ট্রেডিশনের বেলাতে শামসুর রাহমান একই সঙ্গে দেশজ ও আন্তর্জাতিক সম্পদ ব্যবহার করেছেন- বিশেষ করে এ-ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের প্রতিই ঝোঁক বেশী। সিম্বলের ব্যবহারে দেশী বিদেশী পৌরাণিক ও সামাজিক উপকরণ একাধারে কাজে লাগিয়েছেন। এখানে তাঁর দৃষ্টিকোণ বৈদগ্ধ্যের। উপমা, চিত্রকল্প, উপকরণ, ঐতিহ্য ও প্রতীক সন্নিবেশে এই স্বাধীকার সঞ্চারণ থেকে এ কথা মনে করা সম্ভব যে, শিল্প-ধারণায় বিশেষ এক প্রবণতা থাকলেও তাঁর আত্মগঠনের তাগিদে ও আত্মপ্রকাশের তাড়নায় তিনি নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ করেন নি। নিজের চলাচলে এই স্বাধীনতা ও মুক্তির অক্ষুণœতাই তাঁর কাব্যের সজীবতার অন্যতম কারণ এবং তাঁর সম্মুখগতির মূল প্রেরণাও এটাই।” (আধুনিক কবি ও কবিতা, ১৯৯৩, পৃ. ৩১৩)।

অপ্রাপ্তির খাতায় শামসুর রাহমানের নাম নেই। তিনি অবাধ এবং প্রাপ্তিপুষ্ট একজন কবি। নিরন্তর কাব্য সাধনায় বাংলা কবিতা নতুন নতুন কাব্যপঙ্ক্তির সমাহারে ঋদ্ধ হয়েছে। সমস্ত অন্ধকারের গ্লানি মুছে দিয়ে বাংলা কবিতার যে জয়যাত্রা ঘটেছিলো পঞ্চাশে- সেই জয়যাত্রার সামনের সারিতে থেকে গেছেন কবি শামসুর রাহমান। কীভাবে? প্রশ্নটা নেহাত সঙ্গত; তাই এর উত্তরও থাকা বাঞ্ছনীয়। বোধের লড়াইটা কবির একান্ত হলেও তার সর্বজনীন রূপ অনেকটাই খাপমুক্ত হয়ে ওঠে খুব দ্রুত। সেখানে উত্তর পাওয়া যায়। কিংবা থাকে ছড়িয়েছিটিয়ে। ‘[...] তুচ্ছ মেনেছি খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের হার।/ অস্ত্র আমার নেই কিছু শুধু গান নিয়ে আমি/ সংসার রুখে দাঁড়ালে কঠিন প্রান্তরে নামি;/ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি তবুও মরিনি থাবার/ প্রহরে এখনো; সোনালি-চিকন সূর্য-হাসির, গ্রন্থ-আভার/ পৃথিবীতে রোজ নতুন বোধের গাঢ় রূপাভাস,/ বাঁচার উল্লাস’ (যুদ্ধ)। কিংবা ‘[...] কিন্তু কী জানেন, অদৃষ্টের ফেরে নই অনবোলা,/ তাই বেলা অবেলায় আতকা মুখ থেকে ফেটে পড়ে/ কথা, মানে কোদালকে কোদাল বলেই/ বেজায় নাড়িয়ে দিই তল্পিতল্পা উদ্বেল বাজারে’। (সেই একই দোষ)। উদ্ভিন্ন ভাবনার মশাল-জ্বালা কবির এই গতিপথ। সমুখে ছিলো সমূহ বিপদ। খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসে ১৯৬৯ এবং বছরতিনেক পরেই রক্তাক্ত ১৯৭১। পাল্টে যায় কবিতা প্রথাগত ডিকশন। ‘[...] রাজপথ নিদাঘের বেশ্যালয়, স্তব্ধতা সঙিন হয়ে বুকে/ গেঁথে যায়; একটি কি দুটি/ লোক ইতস্তত/ প্রফুল্ল বাতাসে ওড়া কাগজের মতো ভাসমান...’। (হরতাল)। কিংবা ‘সামাজিক বিকারের কুকুরগুলোকে কোন রাঙা/ মাংস দিয়ে রাখো শান্ত করে?/ কী করে প্রখর দীপ জ্বালছ মশালে,/ এ বিস্ময় ঠোকরায় এখনো আমাকে’। (ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা)।

সবল তীক্ষ্ণ দৃঢ়তায় কবি যে স্বপ্নের স্বাধীনতাকে অবলোকন করেছিলেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অনেক আগেই- সেখানে জমে থাকা কবির আত্মগরিমা পাঠকের বিস্ময়কে জাগিয়ে রাখে উচ্চারিত স্বপ্নের অন্তঃস্থিত পঙ্ক্তিমালার জন্যেই- ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/ এই বাঙলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’। (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)। কবির ইনটিউশন অভাবিত সত্যের দ্বার খুলে দেয়। একজন মহৎ কবির অনুস্যূত চেতনা ভবিষ্যতের দ্রষ্টব্যজ্ঞান- এটি মানতে তখন দ্বিধা তৈরি হয় না। এসেছিলো নতুন নিশান উড়িয়ে, সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে এবং ‘সেই তেজি তরুণ যার পদভারে/ একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-’ এই একজন কীভাবে লক্ষ তেজি তরুণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে অবলীলায়- তা পেয়ে যাই কবির মুগ্ধ উচ্চারণে। বিপুল প্রত্যাশার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কষ্ট, যদি সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে হয় নিজেদেরই কারণে- তখন কবি সুস্থির মূর্তিতে সাহসী দৃপ্ততায় উচ্চারণ করেন- ‘আমাকে যেতই হবে যদি, তবে আমি/ যিশুর মতন নগ্নপদে চ’লে যেত চাই। কাঁধে/ ক্রুশকাঠে থাকতেই হবে কিংবা কাঁটার মুকুট/ মাথায় পরতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা না’ (নো এক্সিট)।

পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বন্দি মানুষের ক্রন্দন, গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করা দুঃসময় আর জনজীবনের নিত্যকার মিছিলের গান তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে দারুণভাবে- উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ (১৯৮২), দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে (১৯৮৬), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮), ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি (২০০২) ইত্যাদি কবিতাগ্রন্থে। প্রতিনিয়ত বাঁক বদলের ভেতর দিয়েই কবিকে এগিয়ে যেত হয়। কখনো রাজনীতি, কখনো সমাজ, কখনো গোটা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে কবির কবিতার বদল ঘটে। বদলের সীমানায় যে সব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে তাঁর ধার ও ভার উভয়ই কঠিন, দুর্বহ কিন্তু উপকারী নিঃসন্দেহে একটি সুষম সমাজ বিনির্মাণ ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার সঙ্গে অন্বিত সুশীল মানুষের জন্য। একজন কবি যে রুদ্ধদ্বার খুলে উদার সমাজের আকাক্সক্ষী হয়ে ওঠেন- সেখানে ক্রমবিবর্তন না ঘটলে অপূর্ণ থেকে যায় সবকিছু। শামসুর রাহমান রাষ্ট্র ও সমাজের বিকল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, হয়তো আপসও করেছেন কখনো কখনো কিন্তু এই নিয়ে তাঁর উন্মুক্ত উদার কনফেশানও আছে। ফলে কবিতায় তিনি নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পেরেছেন; কেননা কবিতাই তাঁর শেষ পুঁজি ওইসব নেতিবাচক সময়ের মোকাবেলা করার জন্য। শুরুতেই বলেছি তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন, রাজনৈতিক সমর্থনও ছিলো কোনো দলের প্রতি হয়তো নীরবে-সরবে; কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না কখনো। তারপরও রাজনৈতিক কবিতায় সম্ভবত তাঁর মতো সফল কবি বাংলাদেশের কবিতায় দ্বিতীয়জন নেই।

প্রবহমান শিল্পচৈতন্যের আঙিনায় কবিতার নামই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। কবিতা চিত্রশিল্পের অনুরূপ কখনোসখনো। প্রজ্ঞানন্দন অন্তর্দৃষ্টির মধ্য দিয়ে কবিতাশিল্পের জন্ম। এখানে তারল্য প্রবেশ করতে পারে। করেও খানিকটা- তার কারণ মৌলিক সারাৎসারটুকুকে উন্মুক্ত করবার জন্যেই-অন্য কোনো আপাতদৃষ্ট লক্ষ্য নেই। কবিতা কবিতাই। শামসুর রাহমান সেই কবিতার চর্চা করেছেন- যা প্রকৃতার্থে সবসময় কবিতা হয়ে উঠেছে। এ কারণেই এ কথা বলার সাহস ও প্রতীতি তাঁর ভেতরে ছিলো- ‘প্রকৃত পরহেজগারের মতো নিবেদিত চিত্ত থাকতে সচেষ্ট রয়েছি’। তাৎক্ষণিক স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে আবার নিভে যাওয়া নয়- বরং ধীরে ধীরে জ্বলে চিরকাল অব্দি আলো দিয়ে যাওয়া, আলোকিত হয়ে ওঠাই ছিলো শামসুর রাহমানের কাব্যসাধনার অনতিক্রম্য সংবিত্তি।

ছবি

দোজখের ঘাম

ছবি

‘ব্যাস’ সম্পর্কে কিছু অনিবার্য কথা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

সমর সেন : কেন প্রাসঙ্গিক

ছবি

কবিতার রাজপুত্র

ছবি

অস্কার ওয়াইল্ড : সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিত রূপকার

ছবি

কথা কম কাজ বেশি

ছবি

সম্পাদনার পেশাদারিত্ব ও আবুল হাসনাত

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অর্বাচীন নোঙর

ছবি

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

tab

সাময়িকী

বাংলা কবিতার প্রকৃত পরহেজগার

আল মাকসুদ

শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬) কবি শামসুর রাহমান

বুধবার, ১৭ নভেম্বর ২০২১

বাংলা কবিতায় প্রাগ্রসরবোধ আমদানি করেন মাইকেল। সহসা চেতনার বহির্গমনের সঙ্গে অন্তর্জাত বহ্নি এসে আধুনিক বাংলা কবিতার এপিঠ-ওপিঠকে করে তোলে মানবিক দর্শনানুসন্ধানের নব দর্পণ। কবিতার শরীরে জ্বলে ওঠে সময় ও প্রচল প্রতিবেশ ছাপিয়ে ভিন্ন কিছু। কবি এবং কবিতা উভয়ই হয়ে ওঠে মর্ত্যচারী। কবিতা স্বর্গমর্ত্যব্যাপীও হতে পারে। কিন্তু মূল বিষয় ভূমিলগ্ন মর্ত্যচারী মানুষকে স্পর্শ করা। মাইকেল সেই কাজটিকে সার্থকমণ্ডিত করেন- এটাই মাইকেলের বিশেষ কৃতিত্ব। বাংলা কবিতা তারপর থেকে মানুষের কবিতা। দেবদেবীর নয়। গতিমান সময়ের সঙ্গে অতঃপর কবিতা এগিয়েছে বহুদূর- কতদূর কেউ জানে না। কী পুবে, কী পশ্চিমে কারো কাছে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান নেই। আধুনিক বাংলা কবিতার লক্ষণীয় মানসভূমি তিরিশের দশক। তিরিশের আগল ভাঙতে পারেননি চল্লিশের কাব্য-পুরোহিতরা। পঞ্চাশ সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নির্মাণকলায় শক্তির ঔজ্জ্বল্য নিয়ে প্রতিস্থাপিত হয়। তখন বোদলেয়ারিয় এলিটিজমে আক্রান্ত বাংলাভাষী অসংখ্য কবি। সামনে-পেছনে সটান দাঁড়িয়ে বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। হোমাগ্নিটা জ্বালিয়েছিলেন তিনিই- কবিতা পত্রিকা দিয়ে। কবিতা পত্রিকার উদ্দীপিত সহযাত্রী হিশেবে চলিষ্ণু তখন চতুরঙ্গ, পূর্বাশা’র মতো পত্রিকা। কবিতা কী রকম চাই- প্রশ্ন উঠেছিলো হয়তো; কিন্তু পাঠক ততোদিনে কবিতার স্বাদ পেয়ে গেছেন। নতুন কড়কড়ে স্বাদ। ওখান থেকে কেউ আর বের হতে চায়নি। স্রোতধারা একই, কেবল বদল হলো স্রোতবাঁক। সময়টা ছিলো শুধুই কবিতার। এপারে শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, সৈয়দ শামসুল হক- ওপারে বিনয় মজুমদার, নীরেন্দ্রনাথ, শঙ্খ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ কবিতার বাঁশি বাজালেন; নির্মিত হলো নতুন শব্দের সিম্ফনি। এটা কোনো কোয়েনসিডেন্স নয়- একেবারে অনিবার্য পরিণাম বাংলা কবিতার। বহুমাত্রিক কবিতার স্বাদগন্ধে বিভোর এমন সময় বাংলা কবিতায় আর আসেনি। কবিতা কেমন হবে? কিংবা কবিতার মানদণ্ড? কে-ই বা করবে কবিতার মানদণ্ড নির্বাচন? এবংবিধ প্রশ্ন ছিলো হরহামেশা। কবিতার মানদণ্ড অবশ্যই আপেক্ষিক। কিন্তু সময়ই চিহ্নিত করে দেয় কিছু বিষয়, বিচিত্র-জিজ্ঞাসার চূড়ান্ত মীমাংসা হয় না; তবে সৃষ্টি-স্বকীয়তা যে উৎসমুখের ইঙ্গিত করে তাকে উপেক্ষা করা যায় না। বাগড়াও দেয়া যায় না তাতে। সেটি বোধ হয় উচিতও নয়। ঔজ্জ্বল্যের যে দেমাক- তাতে রঙের চেয়ে রূপের জৌলুস থাকে। মূলত রূপটাই প্রধান। সেরকম কাব্যরূপ মুগ্ধ পরহেজগার কবি শামসুর রাহমান (১৯২৯-২০০৬)। যাত্রাটা পঞ্চাশের। স্থিতি ও স্মৃতি চিরকালের। কারণ সম্ভবত পরহেজগারিতা। কবির বয়ান :

নিরন্তর কাব্য সাধনায় বাংলা কবিতা নতুন নতুন কাব্যপঙ্ক্তির সমাহারে ঋদ্ধ হয়েছে। সমস্ত অন্ধকারের গ্লানি মুছে দিয়ে বাংলা কবিতার যে জয়যাত্রা ঘটেছিলো পঞ্চাশে- সেই জয়যাত্রার সামনের সারিতে থেকে গেছেন কবি শামসুর রাহমান

...] জীবনের আর যে ক্ষেত্রেই হোক, এ ক্ষেত্রে আমি পারতপক্ষে কোনও ফাঁকি কিংবা কোনওরকম ওপর চালাকিকে প্রশ্রয় দিই নি; প্রতিটি মুহূর্তে প্রকৃত পরহেজগারের মতো নিবেদিত চিত্ত থাকতে সচেষ্ট রয়েছি। সত্যিকারের সাফল্য এসেছে কি-না, বলতে পারব না তবে আমার সাধনায় কোনও ফাঁকি নেই। (কালের ধুলোয় লেখা, ২০০৭, পৃ. ২২৪)।

কবির এ বক্তব্য সোজাসাপ্টা; বাকচাতুরির অহেতুক বিনয় নেই। সর্বাংশে সত্য। কবিতার পরহেজগারিতা তাঁর অতুল্য। সচেতনতা, বিচ্ছিন্নতা আবার নাগরিকবোধের সংলগ্নতা তাঁকে নিবিড় নিবিষ্ট করে তুলেছে কবিতা চর্চা যেমন থামতে পারেননি, তেমনি থামাতেও পারেনি তাঁকে কোনোকিছু। পলিটিক্যাল কনসেপ্ট নিয়ে লেখা সে-সময়ে তাঁর মতো আর কেউ ছিলেন না। ‘আসাদের শার্ট’ শুধু কবিতা নয়; অবিকল্প স্লোগান। এবং শুদ্ধ রাজনীতিও। কিন্তু তিনি কখনোই রাজনীতি ঘনিষ্ঠ ছিলেন না; যেমন ছিলেন তাঁর বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান (১৯৩২-১৯৮৩)। হাসান হাফিজুর রহমান রাজনীতিতাড়িত বাসনা থেকে যখন উচ্চারণ করেন- ‘...সাম্য আজো সোনার হরিণ,/ গণ-অধিকার এ ওর ভয়ে ভীষণ অস্থির।/ কারো কাছে মুক্তির ছাড়পত্র নেই, হয়তো কোথাও/ মনুষ্যত্ব নেই বলে’...(আমার আনুগত্য), তখন এখানে রাজনীতি জ্বলে ওঠে। কিন্তু ‘আসাদের শার্ট’ কবিতায় রাজনীতি জ্বলে ওঠে না, মানুষ জেগে ওঠে মুক্তির আকাক্সক্ষায়। রাজনীতি ও জন-আকাক্সক্ষার প্রায়োগিক মৌলিক পার্থক্যটা মূলত এখানেই। অথবা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে রফিক আজাদ-এর ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতায় যে আর্থ-সামাজিক রাজনীতি আছে- এরূপ উচ্চারণভঙ্গিতে লক্ষ করা যায় সুকান্তধর্মী মনোযোগ। এটিও শামসুর রাহমানের কাব্যশীলনবোধে স্বেচ্ছানির্বাসিত। যা এসেছে তা মৃদু শাসনের ভঙ্গিতে। ব্যক্তিক বুনিয়াদি রক্ষায় অতি সচেতনতা হয়তো এর কারণ। এবং লেখা অনাবশ্যক- সেখানেও পরিবর্তনের সুর আছে- তবে প্রবল ধ্বনি নেই। এটি নেই মানে- সচেতনভাবেই নেই। কারণ তাঁর স্বভাবের ভেতরে প্রকৃতিগতভাবেই এক ধরনের শুদ্ধবাদী নম্রতা ছিলো- যেটি তাঁর কবিতা লেখার অন্তঃপ্রেরণা। নিপাট পরহেজগারিতার জন্যেই তাঁর কবিতা চর্চায় কোনো ছেদ পড়েনি। বিরামহীন এবাদতের মতো কবির চর্চামগ্নতা ঈর্ষণীয়। তিনিই বলতে পেরেছেন ‘কবিতাই আমার ভালো লাগতো। সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতাই আমার প্রথম ও শেষ প্রেম’। আর কবিতায় যা দিতে চেয়েছিলেন তার স্বীকারোক্তি এমন-‘জীবন বা পৃথিবীর তথাকথিত কদর্যের মধ্যেও যে সৌন্দর্য আছে, আমি সেটা দেখাতে চেয়েছিলাম’। কবিতার আদিগন্ত দিগ¦লয় উন্মোচিত হয়ে উঠছিলো তাঁর সময়ে অবিশ্বাস্য দ্রুততায়। এবং তখন কবিরাই শুধু জেগে ওঠেননি, পাঠকের অন্তর্বৃত্তে কবিতাও জাগিয়েছিলো নেশা নেশা ঘ্রাণ। নেশাজাগানিয়া ঘ্রাণের শীলিত অনুশীলন-ঐশ্বর্যের কবিতাস্রষ্টাদের মাঝে শামসুর রাহমান স্বাতন্ত্র্যচিহ্নিত একজন।

নাগরিক কবির বিশেষ অভিধা ছিলো তাঁর। নগর ঢাকার আলোবাতাসে নাগরিক না হয়ে উপায়ও হয়তো ছিলো না। যেমন নগর কলকাতা নাগরিক করে তুলেছিলো সুধীন্দ্রনাথ দত্ত (১৯০১-১৯৬০) এবং বুদ্ধদেব বসুকে। বলা নিষ্প্রয়োজন- প্রস্তুতিহীন, তড়িঘড়ি কোনো যাত্রার নাম নাগরিকযাত্রা নয় বলেই এখানকার কাব্যভাষা হয়ে ওঠে অধিকতর পরিশীলিত, পরিপাটি ও বুদ্ধিদীপ্ত। বাংলা কবিতায় পশ্চিমা ইনটেলেকচুয়ালিটির প্রভাববলয় থেকেই এই নাগরিকবোধের জন্ম। এ মেজাজটাকে সার্বরাষ্ট্রিক পরিশীলনও বলা যায়। অভিন্ন কথা- কিন্তু স্বতন্ত্র মূল্যায়ন সতীর্থ কবি হাসান হাফিজুর রহমান-এর-

“স্বাভাবিকভাবেই মেজাজে তিনি আরবান। ট্রেডিশনের বেলাতে শামসুর রাহমান একই সঙ্গে দেশজ ও আন্তর্জাতিক সম্পদ ব্যবহার করেছেন- বিশেষ করে এ-ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ঐতিহ্যের প্রতিই ঝোঁক বেশী। সিম্বলের ব্যবহারে দেশী বিদেশী পৌরাণিক ও সামাজিক উপকরণ একাধারে কাজে লাগিয়েছেন। এখানে তাঁর দৃষ্টিকোণ বৈদগ্ধ্যের। উপমা, চিত্রকল্প, উপকরণ, ঐতিহ্য ও প্রতীক সন্নিবেশে এই স্বাধীকার সঞ্চারণ থেকে এ কথা মনে করা সম্ভব যে, শিল্প-ধারণায় বিশেষ এক প্রবণতা থাকলেও তাঁর আত্মগঠনের তাগিদে ও আত্মপ্রকাশের তাড়নায় তিনি নিজেকে কোনো নির্দিষ্ট ছকে আবদ্ধ করেন নি। নিজের চলাচলে এই স্বাধীনতা ও মুক্তির অক্ষুণœতাই তাঁর কাব্যের সজীবতার অন্যতম কারণ এবং তাঁর সম্মুখগতির মূল প্রেরণাও এটাই।” (আধুনিক কবি ও কবিতা, ১৯৯৩, পৃ. ৩১৩)।

অপ্রাপ্তির খাতায় শামসুর রাহমানের নাম নেই। তিনি অবাধ এবং প্রাপ্তিপুষ্ট একজন কবি। নিরন্তর কাব্য সাধনায় বাংলা কবিতা নতুন নতুন কাব্যপঙ্ক্তির সমাহারে ঋদ্ধ হয়েছে। সমস্ত অন্ধকারের গ্লানি মুছে দিয়ে বাংলা কবিতার যে জয়যাত্রা ঘটেছিলো পঞ্চাশে- সেই জয়যাত্রার সামনের সারিতে থেকে গেছেন কবি শামসুর রাহমান। কীভাবে? প্রশ্নটা নেহাত সঙ্গত; তাই এর উত্তরও থাকা বাঞ্ছনীয়। বোধের লড়াইটা কবির একান্ত হলেও তার সর্বজনীন রূপ অনেকটাই খাপমুক্ত হয়ে ওঠে খুব দ্রুত। সেখানে উত্তর পাওয়া যায়। কিংবা থাকে ছড়িয়েছিটিয়ে। ‘[...] তুচ্ছ মেনেছি খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের হার।/ অস্ত্র আমার নেই কিছু শুধু গান নিয়ে আমি/ সংসার রুখে দাঁড়ালে কঠিন প্রান্তরে নামি;/ যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি তবুও মরিনি থাবার/ প্রহরে এখনো; সোনালি-চিকন সূর্য-হাসির, গ্রন্থ-আভার/ পৃথিবীতে রোজ নতুন বোধের গাঢ় রূপাভাস,/ বাঁচার উল্লাস’ (যুদ্ধ)। কিংবা ‘[...] কিন্তু কী জানেন, অদৃষ্টের ফেরে নই অনবোলা,/ তাই বেলা অবেলায় আতকা মুখ থেকে ফেটে পড়ে/ কথা, মানে কোদালকে কোদাল বলেই/ বেজায় নাড়িয়ে দিই তল্পিতল্পা উদ্বেল বাজারে’। (সেই একই দোষ)। উদ্ভিন্ন ভাবনার মশাল-জ্বালা কবির এই গতিপথ। সমুখে ছিলো সমূহ বিপদ। খুব দ্রুত ঘনিয়ে আসে ১৯৬৯ এবং বছরতিনেক পরেই রক্তাক্ত ১৯৭১। পাল্টে যায় কবিতা প্রথাগত ডিকশন। ‘[...] রাজপথ নিদাঘের বেশ্যালয়, স্তব্ধতা সঙিন হয়ে বুকে/ গেঁথে যায়; একটি কি দুটি/ লোক ইতস্তত/ প্রফুল্ল বাতাসে ওড়া কাগজের মতো ভাসমান...’। (হরতাল)। কিংবা ‘সামাজিক বিকারের কুকুরগুলোকে কোন রাঙা/ মাংস দিয়ে রাখো শান্ত করে?/ কী করে প্রখর দীপ জ্বালছ মশালে,/ এ বিস্ময় ঠোকরায় এখনো আমাকে’। (ঐকান্তিক শ্রেণীহীনা)।

সবল তীক্ষ্ণ দৃঢ়তায় কবি যে স্বপ্নের স্বাধীনতাকে অবলোকন করেছিলেন স্বাধীনতাপ্রাপ্তির অনেক আগেই- সেখানে জমে থাকা কবির আত্মগরিমা পাঠকের বিস্ময়কে জাগিয়ে রাখে উচ্চারিত স্বপ্নের অন্তঃস্থিত পঙ্ক্তিমালার জন্যেই- ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে জ্বলন্ত/ ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে,/ নতুন নিশান উড়িয়ে, দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/ এই বাঙলায়/ তোমাকে আসতেই হবে, হে স্বাধীনতা’। (তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা)। কবির ইনটিউশন অভাবিত সত্যের দ্বার খুলে দেয়। একজন মহৎ কবির অনুস্যূত চেতনা ভবিষ্যতের দ্রষ্টব্যজ্ঞান- এটি মানতে তখন দ্বিধা তৈরি হয় না। এসেছিলো নতুন নিশান উড়িয়ে, সমস্ত পৃথিবীকে জানিয়ে এবং ‘সেই তেজি তরুণ যার পদভারে/ একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে-’ এই একজন কীভাবে লক্ষ তেজি তরুণের প্রতিনিধিত্ব করতে পারে অবলীলায়- তা পেয়ে যাই কবির মুগ্ধ উচ্চারণে। বিপুল প্রত্যাশার অন্তরালে লুকিয়ে থাকে কষ্ট, যদি সে প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হতে হয় নিজেদেরই কারণে- তখন কবি সুস্থির মূর্তিতে সাহসী দৃপ্ততায় উচ্চারণ করেন- ‘আমাকে যেতই হবে যদি, তবে আমি/ যিশুর মতন নগ্নপদে চ’লে যেত চাই। কাঁধে/ ক্রুশকাঠে থাকতেই হবে কিংবা কাঁটার মুকুট/ মাথায় পরতে হবে, এটা কোনো কাজের কথা না’ (নো এক্সিট)।

পঁচাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বন্দি মানুষের ক্রন্দন, গণতন্ত্রের শ্বাসরোধ করা দুঃসময় আর জনজীবনের নিত্যকার মিছিলের গান তাঁর কবিতার অনুষঙ্গ হয়েছে দারুণভাবে- উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ (১৯৮২), দেশদ্রোহী হতে ইচ্ছে করে (১৯৮৬), বুক তার বাংলাদেশের হৃদয় (১৯৮৮), ভগ্নস্তূপে গোলাপের হাসি (২০০২) ইত্যাদি কবিতাগ্রন্থে। প্রতিনিয়ত বাঁক বদলের ভেতর দিয়েই কবিকে এগিয়ে যেত হয়। কখনো রাজনীতি, কখনো সমাজ, কখনো গোটা রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে কবির কবিতার বদল ঘটে। বদলের সীমানায় যে সব শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটে তাঁর ধার ও ভার উভয়ই কঠিন, দুর্বহ কিন্তু উপকারী নিঃসন্দেহে একটি সুষম সমাজ বিনির্মাণ ও রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার সঙ্গে অন্বিত সুশীল মানুষের জন্য। একজন কবি যে রুদ্ধদ্বার খুলে উদার সমাজের আকাক্সক্ষী হয়ে ওঠেন- সেখানে ক্রমবিবর্তন না ঘটলে অপূর্ণ থেকে যায় সবকিছু। শামসুর রাহমান রাষ্ট্র ও সমাজের বিকল অবস্থার সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন, হয়তো আপসও করেছেন কখনো কখনো কিন্তু এই নিয়ে তাঁর উন্মুক্ত উদার কনফেশানও আছে। ফলে কবিতায় তিনি নিরবচ্ছিন্ন থাকতে পেরেছেন; কেননা কবিতাই তাঁর শেষ পুঁজি ওইসব নেতিবাচক সময়ের মোকাবেলা করার জন্য। শুরুতেই বলেছি তিনি রাজনীতি সচেতন ছিলেন, রাজনৈতিক সমর্থনও ছিলো কোনো দলের প্রতি হয়তো নীরবে-সরবে; কিন্তু রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন না কখনো। তারপরও রাজনৈতিক কবিতায় সম্ভবত তাঁর মতো সফল কবি বাংলাদেশের কবিতায় দ্বিতীয়জন নেই।

প্রবহমান শিল্পচৈতন্যের আঙিনায় কবিতার নামই সর্বাগ্রে উচ্চারিত হয়। কবিতা চিত্রশিল্পের অনুরূপ কখনোসখনো। প্রজ্ঞানন্দন অন্তর্দৃষ্টির মধ্য দিয়ে কবিতাশিল্পের জন্ম। এখানে তারল্য প্রবেশ করতে পারে। করেও খানিকটা- তার কারণ মৌলিক সারাৎসারটুকুকে উন্মুক্ত করবার জন্যেই-অন্য কোনো আপাতদৃষ্ট লক্ষ্য নেই। কবিতা কবিতাই। শামসুর রাহমান সেই কবিতার চর্চা করেছেন- যা প্রকৃতার্থে সবসময় কবিতা হয়ে উঠেছে। এ কারণেই এ কথা বলার সাহস ও প্রতীতি তাঁর ভেতরে ছিলো- ‘প্রকৃত পরহেজগারের মতো নিবেদিত চিত্ত থাকতে সচেষ্ট রয়েছি’। তাৎক্ষণিক স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে আবার নিভে যাওয়া নয়- বরং ধীরে ধীরে জ্বলে চিরকাল অব্দি আলো দিয়ে যাওয়া, আলোকিত হয়ে ওঠাই ছিলো শামসুর রাহমানের কাব্যসাধনার অনতিক্রম্য সংবিত্তি।

back to top