alt

সাময়িকী

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ০৭

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

: বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’

‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’- এই গানটি কাজী নজরুল ইসলাম দেশমাতৃকার নানাবিধ রূপ বর্ণনায় রচনা করেছেন। ফলে এর চিত্ররূপ নিবিড়-গভীর মাধুর্যতায় রূপায়িত হয়েছে। ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’- এই পঙ্ক্তিটিতে কবি তাঁর স্বদেশের মাটিকে আত্মঘোষণায় সোনার চেয়ে খাঁটি বলে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ দেশের কাদা-মাটি-জলের, ফুল ও ফসলের বিচিত্র সমাবেশের প্রতিপাদ্যে মনের তৃষ্ণা এবং পেটের ক্ষুধা মিটানোর পাশাপাশি দেহের পুষ্টির জন্য মাতৃদুগ্ধের উৎস হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তারই প্রসাদ পেতে জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মন্দির বা প্রার্থনালয় এক তীর্থস্থান হিসেবে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ধন্য হয়ে উঠেছে। আবার এদেশেরই ধলার পরে কত মনি-মানিক্যের ছড়াছড়ি-গড়াগড়ি যা সোনার চেয়েও অধিক মূল্যবান বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে এর রূপ-লাবণ্য বিশে^ বিরল বলে বিশ^চিত্তের সচকিত ঘুম ভাঙায়, যাকে কবি জাগরণের চেতনাদীপ্ত, জিয়ন-কাঠির স্পর্শ বলেও অনুভব করেছেন। একইসঙ্গে এদেশের কাদা-মাটিসহ তার ব্যাপ্ত জীবনের ধারায় ঐতিহ্য-বৈচিত্র্যের সমাবেশ এমনই নিপুণ ও সযতেœ পরিপাটি থেকে ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়িয়ে এ নিখিল বিশে^ সভ্যের দীপাধার হিসেবেও গণ্য হয়ে উঠেছে। স্বদেশ প্রেম থেকে বিশ^প্রেমের উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে গানটির পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে।

কবি এ গানটিতে মগ্ন দেশপ্রেমিক। তাঁর এ মগ্নতা যেন বিশ^জনীন রূপ পায় গানটির বাণী ও সুরে। এখানে স্বীয় মাতৃভূমিকে ‘তীর্থস্থান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার, আন্দোলিত হওয়ার, জাগরিত হওয়ার যেন এক বীজমন্ত্র রয়েছে গানটিতে। ফলে ‘খাম্বাজ মিশ্র’ রাগের মধুর ও মায়াময় সুরে রচিত, কাব্যালঙ্কারে সজ্জিত বাণী সংবলিত এ গানটিতে একটি চিত্রকল্পসমৃদ্ধ গান হয়ে উঠেছে। কারণ, মায়াময় সুর ও বাণী কেবল দেশের সৌন্দর্যই নয়, মাতৃস্তুতিই নয়, তা যেন মায়ের প্রতি সবার যে ঋণ তাও স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশমাতৃকার প্রতি কবির আবেগ, ভালোবাসা, শ্রোতার মনকে সুরের মধ্য দিয়ে আন্দোলিত করে, প্রাণিত করে, শ্রোতাকে বিষয়াতীত ভালোবাসা ও মমতায় ভরে তোলে।

রবীন্দনাথের সুরেও দেশমাতৃকার প্রতি একই ভাব ধরা দেয়- ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা/তোমাতে বিশ^ময়ীর, তোমাতে বিশ^মায়ের আঁচল পাতা/তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে/তুমি মিলেছ মোর প্রাণের মনে/তোমার ঐ শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা’- যদিও প্রকাশভঙ্গি আলাদা কিন্তু দু’জনের মূলসুর ‘দেশমাতার প্রতি ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন’। নজরুলের সকল প্রেমের গান তা সে দেশপ্রেম হোক, মানবপ্রেম হোক কিংবা বিরহ- সব অনুভব যেন নিবিড়-গভীর আত্মিক ব্যঞ্জনায় সিক্ত। তাঁর দেশপ্রেম-ভাবনা অনন্ত, অসীম মায়াময়, যা এ গানটির পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিধৃত।

ঠামুরি অঙ্গের এ গানটিতে তিনি ‘খাম্বাজ মিশ্র’ রাগের ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত মায়াময় মাধুর্যতায়। এটিতে খাম্বাজের ১২ টি স্বরই ব্যবহার করেছেন নানাভাবে। ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’- এ অংশটুকু খাম্বাজের রূপে বোঁধেছেন, ‘এ দেশেরই মাটি জলে/এই দেশেরই ফুলে ফলে’- এখানে তিনি ‘দেশ’ রাগের কিঞ্চিত ছোঁয়াও এনেছেন গানটির ভাব-মাধুর্য প্রকাশের প্রয়াসে।

কবি এ গানটিতে মগ্ন দেশপ্রেমিক। তাঁর এ মগ্নতা যেন বিশ^জনীন রূপ পায় গানটির বাণী ও সুরে। এখানে স্বীয় মাতৃভূমিকে ‘তীর্থস্থান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন

গানটিতে তিনি লোকজ মাটির সুরে অত্যন্ত সুকৌশলে, নান্দনিকতায় ব্যবহার করেছেন। ফলে আমাদের দেশের বাউল, কীর্তন, পালা, মুর্শিদী, মারফতিসহ অন্যান্য চিরায়ত লোকসংগীতের সুরও নজরুল ব্যবহার করেছেন আধুনিক কাঠামো বা ফরম্যাট এনে। নজরুল এই জায়গাটিতে স্বতন্ত্র। ফলে সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই এ সুর পায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং এ সুর হয়ে ওঠে আধুনিক। ‘এই মায়েরই প্রসাদ পেতে/মন্দিরে এর এঁটো খেতে/তীর্থ ক’রে ধন্য হতে আসে কত জাতি’- এখানে বাউল সুরের ব্যবহার পাওয়া গিয়েছে। বাউলিয়ানার একটা স্টাইল অনুভূত হচ্ছে এবং জয়জয়ন্তী ‘দেশ’ রাগের ছোঁয়ায় তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘বিশে^ সবার ঘুম ভাঙালে এই দেশেরই জিয়ন কাঠি’- এখানে ‘কফি’র কিছুটা স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে অর্থাৎ ‘কাফি’র কোমল স্বর (জ্ঞ ণ) এখানে সংযুক্ত হয়েছে। নজরুল শৈশবেই বেদ, পুরাণসহ অন্যান্য মিথ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেন এবং যাত্রাগান ও পালাগান থেকেও লোকজ সংগীতের সুরগুলো আত্মস্থ করেন। রাগ-রাগিণীর আওতায় এ সমস্ত লোকজ সুরকে কাব্য মিশ্রিত বাণীর সংযোগে তিনি আধুনিক ভাবধারায় প্রতিষ্ঠা করেন। শৈশবের যাত্রা-পালাগানই তাঁর সংগীতের ভিত্তি হিসেবে পরবর্তী সময়ে সংগীত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’

‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’- এটি কাজী নজরুল ইসলামের দেশমাতৃকাকে নিয়ে রচিত একটি সংগীত। গানটিতে নজরুল লোকজ সুর ও মাটির সুর নিয়ে পল্লিজননীর ছবি এঁকেছেন শব্দ এবং কাব্যবিন্যাসের মাধুর্যতায়। দেশের প্রতি অনুরাগ, প্রকৃতির প্রতি আকুলতা প্রতি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উৎসারিত। গানের বাণী আধুনিক, বাণীর বিন্যাসও আধুনিক এমনকি সুরও আধুনিক কিন্তু আধুনিক আঙ্গিকের এই গানে তিনি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন লোকজ সুর-মিলিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মাটি থেকে উঠে আসা সংগীতশৈলী কীর্তনের সুর। ‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’- এখানে তিনি নমস্যরূপে বিচিত্র বাংলাদেশের ঐশ^র্যের রূপ বর্ণনা করেছেন। জীবনানন্দ দাশ একইভাবে দেশমাতৃকতার রূপ বর্ণনায় লিখেছেন-

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর

রূপ খুঁজিতে যাই না আর

অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো

পাতাটির নিচে বসে আছে।

পঞ্চম পঙক্তিতে ‘গ্রীষ্মে নাচে বামা কালবোশেখি ঝড়ে’ এখানে গ্রীষ্ম প্রকৃতিকে তিনি নারীরূপে দেখিয়েছেন তাঁর পরিবর্তনগুলো। বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুতে কী কী রূপবৈচিত্র্য ধারণ করে তারই মধুর বর্ণনা রয়েছে এতে। ‘গ্রীষ্মে যে উচ্ছল তরুণীর মতো কালবোশেখি বাতাস এলো চুলে নাচে (গ্রীষ্মে নাচে বামা কালবোশেখি ঝড়ে), বর্ষার আবেগ কাতর নারী (সহসা বরষাতে কাদিয়া ভেঙ্গে পড়ে), শরতে শেফালি ফুলের সঙ্গে যেন তার সৌন্দর্যকে ভাগাভাগি করে (শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে), হেমন্তে হলুদ আঁচল পরা সে নারী সকালের শিশিরে পা ভিজিয়ে যেন মাঠে মাঠে হাঁটে, পাতা ঝরার খেলায় শীত পার করে সে আবার ফাগুনের সাজ পরে বসন্তে ফুল-বধূরূপে তার নারী জীবনের পূর্ণতা লাভ করে’। ঋতুর বৈচিত্র্যসমূহ নারীর রূপের অনেকগুলো চিত্র দীর্ঘ তুলনার মাধ্যমে প্রকাশ করে গানটির শেষ চারটি চরণে এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে/যে রস যে সুধা নাহি ভূম-লে/এই মায়েরি বুকে হেসে খেলে সুখে/ঘুমাবো এই বুকে স্বপ্নাতুর’- আবার তাকে মায়ের আসনে বসিয়ে সর্বোচ্চ সম্মান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পুরো গানটির বাণীভাগজুড়েই রয়েছে উপমাচিত্র, এক নারী রূপ বাংলাদেশের চিত্র। ফলে গানটির বাণী ও সুর আলাদাভাবেও চিত্রকল্প নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। শ্রোতা যখন আমাদের বাউল কীর্তনের সুরকে কাব্যমিশ্রিত বাণীর সংযোগে গানটি শোনে তখন তার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে অনাবিল সৌন্দর্যময় এক মাতৃরূপী বাংলাদেশের চিত্র। গানটিতে আরও বিশেষভাবে লক্ষণীয় এর কোমল মধুর শব্দবিন্যাস। যেমন- বাংলাদেশের ‘দ’ ধ্বনি মনোরমের ‘র’ একরকম প্রাচুর্য গানের সাংগীতিক সুর মাধুর্যতাকে ফুটিয়ে তোলে এবং শ্রোতার মনে চিরস্থায়ী আসন করে নেয়। (চলবে)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ০৭

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

বৃহস্পতিবার, ১৭ আগস্ট ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’

‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’- এই গানটি কাজী নজরুল ইসলাম দেশমাতৃকার নানাবিধ রূপ বর্ণনায় রচনা করেছেন। ফলে এর চিত্ররূপ নিবিড়-গভীর মাধুর্যতায় রূপায়িত হয়েছে। ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি/আমার দেশের মাটি’- এই পঙ্ক্তিটিতে কবি তাঁর স্বদেশের মাটিকে আত্মঘোষণায় সোনার চেয়ে খাঁটি বলে সকলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ দেশের কাদা-মাটি-জলের, ফুল ও ফসলের বিচিত্র সমাবেশের প্রতিপাদ্যে মনের তৃষ্ণা এবং পেটের ক্ষুধা মিটানোর পাশাপাশি দেহের পুষ্টির জন্য মাতৃদুগ্ধের উৎস হিসেবেও অভিহিত করেছেন। তারই প্রসাদ পেতে জাতি-গোষ্ঠী নির্বিশেষে মন্দির বা প্রার্থনালয় এক তীর্থস্থান হিসেবে অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে ধন্য হয়ে উঠেছে। আবার এদেশেরই ধলার পরে কত মনি-মানিক্যের ছড়াছড়ি-গড়াগড়ি যা সোনার চেয়েও অধিক মূল্যবান বলে অভিহিত করেছেন। অন্যদিকে এর রূপ-লাবণ্য বিশে^ বিরল বলে বিশ^চিত্তের সচকিত ঘুম ভাঙায়, যাকে কবি জাগরণের চেতনাদীপ্ত, জিয়ন-কাঠির স্পর্শ বলেও অনুভব করেছেন। একইসঙ্গে এদেশের কাদা-মাটিসহ তার ব্যাপ্ত জীবনের ধারায় ঐতিহ্য-বৈচিত্র্যের সমাবেশ এমনই নিপুণ ও সযতেœ পরিপাটি থেকে ভৌগোলিক অবস্থান ছাড়িয়ে এ নিখিল বিশে^ সভ্যের দীপাধার হিসেবেও গণ্য হয়ে উঠেছে। স্বদেশ প্রেম থেকে বিশ^প্রেমের উচ্চারণ ধ্বনিত হয়েছে গানটির পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে।

কবি এ গানটিতে মগ্ন দেশপ্রেমিক। তাঁর এ মগ্নতা যেন বিশ^জনীন রূপ পায় গানটির বাণী ও সুরে। এখানে স্বীয় মাতৃভূমিকে ‘তীর্থস্থান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হওয়ার, আন্দোলিত হওয়ার, জাগরিত হওয়ার যেন এক বীজমন্ত্র রয়েছে গানটিতে। ফলে ‘খাম্বাজ মিশ্র’ রাগের মধুর ও মায়াময় সুরে রচিত, কাব্যালঙ্কারে সজ্জিত বাণী সংবলিত এ গানটিতে একটি চিত্রকল্পসমৃদ্ধ গান হয়ে উঠেছে। কারণ, মায়াময় সুর ও বাণী কেবল দেশের সৌন্দর্যই নয়, মাতৃস্তুতিই নয়, তা যেন মায়ের প্রতি সবার যে ঋণ তাও স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশমাতৃকার প্রতি কবির আবেগ, ভালোবাসা, শ্রোতার মনকে সুরের মধ্য দিয়ে আন্দোলিত করে, প্রাণিত করে, শ্রোতাকে বিষয়াতীত ভালোবাসা ও মমতায় ভরে তোলে।

রবীন্দনাথের সুরেও দেশমাতৃকার প্রতি একই ভাব ধরা দেয়- ‘ও আমার দেশের মাটি, তোমার পরে ঠেকাই মাথা/তোমাতে বিশ^ময়ীর, তোমাতে বিশ^মায়ের আঁচল পাতা/তুমি মিশেছ মোর দেহের সনে/তুমি মিলেছ মোর প্রাণের মনে/তোমার ঐ শ্যামলবরণ কোমল মূর্তি মর্মে গাঁথা’- যদিও প্রকাশভঙ্গি আলাদা কিন্তু দু’জনের মূলসুর ‘দেশমাতার প্রতি ভালোবাসার অর্ঘ্য নিবেদন’। নজরুলের সকল প্রেমের গান তা সে দেশপ্রেম হোক, মানবপ্রেম হোক কিংবা বিরহ- সব অনুভব যেন নিবিড়-গভীর আত্মিক ব্যঞ্জনায় সিক্ত। তাঁর দেশপ্রেম-ভাবনা অনন্ত, অসীম মায়াময়, যা এ গানটির পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে বিধৃত।

ঠামুরি অঙ্গের এ গানটিতে তিনি ‘খাম্বাজ মিশ্র’ রাগের ব্যবহার করেছেন অত্যন্ত মায়াময় মাধুর্যতায়। এটিতে খাম্বাজের ১২ টি স্বরই ব্যবহার করেছেন নানাভাবে। ‘ও ভাই খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি আমার দেশের মাটি’- এ অংশটুকু খাম্বাজের রূপে বোঁধেছেন, ‘এ দেশেরই মাটি জলে/এই দেশেরই ফুলে ফলে’- এখানে তিনি ‘দেশ’ রাগের কিঞ্চিত ছোঁয়াও এনেছেন গানটির ভাব-মাধুর্য প্রকাশের প্রয়াসে।

কবি এ গানটিতে মগ্ন দেশপ্রেমিক। তাঁর এ মগ্নতা যেন বিশ^জনীন রূপ পায় গানটির বাণী ও সুরে। এখানে স্বীয় মাতৃভূমিকে ‘তীর্থস্থান’ হিসেবে অভিহিত করেছেন

গানটিতে তিনি লোকজ মাটির সুরে অত্যন্ত সুকৌশলে, নান্দনিকতায় ব্যবহার করেছেন। ফলে আমাদের দেশের বাউল, কীর্তন, পালা, মুর্শিদী, মারফতিসহ অন্যান্য চিরায়ত লোকসংগীতের সুরও নজরুল ব্যবহার করেছেন আধুনিক কাঠামো বা ফরম্যাট এনে। নজরুল এই জায়গাটিতে স্বতন্ত্র। ফলে সকল শ্রেণির মানুষের কাছেই এ সুর পায় ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা এবং এ সুর হয়ে ওঠে আধুনিক। ‘এই মায়েরই প্রসাদ পেতে/মন্দিরে এর এঁটো খেতে/তীর্থ ক’রে ধন্য হতে আসে কত জাতি’- এখানে বাউল সুরের ব্যবহার পাওয়া গিয়েছে। বাউলিয়ানার একটা স্টাইল অনুভূত হচ্ছে এবং জয়জয়ন্তী ‘দেশ’ রাগের ছোঁয়ায় তা মূর্ত হয়ে উঠেছে। ‘বিশে^ সবার ঘুম ভাঙালে এই দেশেরই জিয়ন কাঠি’- এখানে ‘কফি’র কিছুটা স্পর্শ পাওয়া যাচ্ছে অর্থাৎ ‘কাফি’র কোমল স্বর (জ্ঞ ণ) এখানে সংযুক্ত হয়েছে। নজরুল শৈশবেই বেদ, পুরাণসহ অন্যান্য মিথ সম্পর্কিত জ্ঞান অর্জন করেন এবং যাত্রাগান ও পালাগান থেকেও লোকজ সংগীতের সুরগুলো আত্মস্থ করেন। রাগ-রাগিণীর আওতায় এ সমস্ত লোকজ সুরকে কাব্য মিশ্রিত বাণীর সংযোগে তিনি আধুনিক ভাবধারায় প্রতিষ্ঠা করেন। শৈশবের যাত্রা-পালাগানই তাঁর সংগীতের ভিত্তি হিসেবে পরবর্তী সময়ে সংগীত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে।

‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’

‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’- এটি কাজী নজরুল ইসলামের দেশমাতৃকাকে নিয়ে রচিত একটি সংগীত। গানটিতে নজরুল লোকজ সুর ও মাটির সুর নিয়ে পল্লিজননীর ছবি এঁকেছেন শব্দ এবং কাব্যবিন্যাসের মাধুর্যতায়। দেশের প্রতি অনুরাগ, প্রকৃতির প্রতি আকুলতা প্রতি পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে উৎসারিত। গানের বাণী আধুনিক, বাণীর বিন্যাসও আধুনিক এমনকি সুরও আধুনিক কিন্তু আধুনিক আঙ্গিকের এই গানে তিনি সচেতনভাবে ব্যবহার করেছেন লোকজ সুর-মিলিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের মাটি থেকে উঠে আসা সংগীতশৈলী কীর্তনের সুর। ‘নমঃ নমঃ নমো/বাংলাদেশ মম/চির-মনোরম চির মধুর’- এখানে তিনি নমস্যরূপে বিচিত্র বাংলাদেশের ঐশ^র্যের রূপ বর্ণনা করেছেন। জীবনানন্দ দাশ একইভাবে দেশমাতৃকতার রূপ বর্ণনায় লিখেছেন-

বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর

রূপ খুঁজিতে যাই না আর

অন্ধকারে জেগে উঠে ডুমুরের গাছে

চেয়ে দেখি ছাতার মতন বড়ো

পাতাটির নিচে বসে আছে।

পঞ্চম পঙক্তিতে ‘গ্রীষ্মে নাচে বামা কালবোশেখি ঝড়ে’ এখানে গ্রীষ্ম প্রকৃতিকে তিনি নারীরূপে দেখিয়েছেন তাঁর পরিবর্তনগুলো। বাংলাদেশের প্রতিটি ঋতুতে কী কী রূপবৈচিত্র্য ধারণ করে তারই মধুর বর্ণনা রয়েছে এতে। ‘গ্রীষ্মে যে উচ্ছল তরুণীর মতো কালবোশেখি বাতাস এলো চুলে নাচে (গ্রীষ্মে নাচে বামা কালবোশেখি ঝড়ে), বর্ষার আবেগ কাতর নারী (সহসা বরষাতে কাদিয়া ভেঙ্গে পড়ে), শরতে শেফালি ফুলের সঙ্গে যেন তার সৌন্দর্যকে ভাগাভাগি করে (শরতে হেসে চলে শেফালিকা-তলে), হেমন্তে হলুদ আঁচল পরা সে নারী সকালের শিশিরে পা ভিজিয়ে যেন মাঠে মাঠে হাঁটে, পাতা ঝরার খেলায় শীত পার করে সে আবার ফাগুনের সাজ পরে বসন্তে ফুল-বধূরূপে তার নারী জীবনের পূর্ণতা লাভ করে’। ঋতুর বৈচিত্র্যসমূহ নারীর রূপের অনেকগুলো চিত্র দীর্ঘ তুলনার মাধ্যমে প্রকাশ করে গানটির শেষ চারটি চরণে এই দেশের মাটি জল ও ফুলে ফলে/যে রস যে সুধা নাহি ভূম-লে/এই মায়েরি বুকে হেসে খেলে সুখে/ঘুমাবো এই বুকে স্বপ্নাতুর’- আবার তাকে মায়ের আসনে বসিয়ে সর্বোচ্চ সম্মান শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।

পুরো গানটির বাণীভাগজুড়েই রয়েছে উপমাচিত্র, এক নারী রূপ বাংলাদেশের চিত্র। ফলে গানটির বাণী ও সুর আলাদাভাবেও চিত্রকল্প নির্মাণে সক্ষম হয়েছে। শ্রোতা যখন আমাদের বাউল কীর্তনের সুরকে কাব্যমিশ্রিত বাণীর সংযোগে গানটি শোনে তখন তার মনশ্চক্ষে ভেসে ওঠে অনাবিল সৌন্দর্যময় এক মাতৃরূপী বাংলাদেশের চিত্র। গানটিতে আরও বিশেষভাবে লক্ষণীয় এর কোমল মধুর শব্দবিন্যাস। যেমন- বাংলাদেশের ‘দ’ ধ্বনি মনোরমের ‘র’ একরকম প্রাচুর্য গানের সাংগীতিক সুর মাধুর্যতাকে ফুটিয়ে তোলে এবং শ্রোতার মনে চিরস্থায়ী আসন করে নেয়। (চলবে)

back to top