কবীর হোসেন
কবি জসীম উদ্দীন বাংলার পল্লীকবি। বাংলার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে ঘুরে পল্লীর সুখ-দুঃখ যেভাবে তিনি তার কবিতায় অঙ্কন করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা বিরল-বিস্ময়। রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব বলয়ে জসীম উদদীন একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন। মাত্র বিএ পড়ার সময়ই কবি জসীম উদ্দীনের লেখা ‘কবর’ কবিতাটি ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেন কবি জসীমউদদীন। সময়টা ছিল বাংলার শিল্পসাহিত্যের স্বর্ণযুগ। কেননা তার মাত্র চার বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) ও ফরিদপুরের কাছের জেলা বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি)। কেবল রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তাদের প্রধানত অগ্রজ ((১৮৬১-১৯৪১)। এখানে আরও স্মরণীয় যে নজরুল ও জসীম উদ্দীন মারা যান একই বছর। জসীম উদ্দীন ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ও নজরুল ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট।
ব্ইয়ের সূত্র ধরে আমি আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে কী কখনো সাপে কেটেছিল? তখন স্বীকার করেন আসমানী। কিন্তু সাদাসিদে বর্ণপরিচয়হীন আসমানীর সব উত্তরই ছিল হ্যাঁ বা না পর্যন্ত সীমিত
গ্রাম বাংলার পটভূমিতে লেখা কবি জসীম উদ্দীনের ‘আসমানী’ ‘পল্লী জননী’ ‘নিমন্ত্রণ’ এই কবিতাগুলো আশি ও নব্বই দশকেও আমাদের শ্রেণিকক্ষে তুমুল পড়ানো হতো। ওই কবিতাগুলো পড়ে চোখের জল আটকে রাখা ছিল কঠিন। ইদানীং সেসব কবিতা সিলেবাস থেকে উঠে গেছে, যা পড়ে শিশুদের মনে গরিব মানুষ ও গ্রামজীবনের প্রতি টান অনুভব হতে পারে। বরং অর্থহীন দ্যোতনাই হয়ে উঠেছে এখন পাঠের বিষয়, যা চিত্তবিনোদনের বাহন হলেও চিত্ত তৈরিতে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না। বিশেষত আটষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে যে কবিতা তার মূল ভিত্তিপ্রস্থর জসীম উদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশের মতো কবিদের হাতেই।
এই লেখার মূল উপজীব্য পল্লীকবির আসমানী। আসমানী তার অপর অপর হাসু, রুপাই, সাজু এইসব বিখ্যাত চরিত্রের একটি। প্রাথমিক পাঠ্যসূচিতে একসময় কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ‘আসমানী’র দেশব্যাপী একটি পরিচিত ছিল। পল্লীকবি আসমানীকে এতটাই ভালবেসেছিলেন যে তাকে নিয়ে শুধু একটা কবিতা নয়, গোটা একটি শিশুতোষ বই-ই লিখেছিলেন ‘আসমানীর কবি ভাই’ নামে। বাস্তবেই আসমানীর যে চিত্র জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন জীবন সায়াহ্নেও যখন তার বয়স প্রায় আশি বছর তখনও আমি আসমানীকে দেখে তার অবিকল চিত্র খুঁজে পেয়েছিলাম।
আসমানীর খোঁজে আমি বেসরকারী সংগঠন ‘নারীপক্ষ’র হয়ে ফরিদপুর সদরের ইষাণ গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে যাই ২০০৬ সালের দিকে। আসমানীর বাড়ি রসুলপুর পড়েছিলাম কবিতায়। কিন্তু রসুলপুরের চায়ের দোকানদার, স্কুলের শিক্ষক কেউই তাকে চিনতে পারল না। অথচ সেই শিক্ষকও আসমানী কবিতাটি হয়তো পড়িয়েছেন ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের। চায়ের দোকানীও পড়েছেন তার শৈশবে তাদের গ্রামের মেয়ে আসমানীকে নিয়ে লেখা কবিতা। শেষমেশ ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের দপ্তরে গেলে তিনি চৌকিদার দিয়ে আমাকে আসমানীর বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
রসুলপুর আসমানীর নিজের বাড়ি নয়। এটি তার নানা বাড়ি। ছোট্ট বেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের সাথে নানা বাড়িতে আশ্রয় হয়েছিল আসমানীর। রসুলপুরে জসীম উদ্দীনের এক ভাই বিয়ে করেছিলেন। সে সুবাদে কবি ওই গ্রামে যেতেন। ওই গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে পল্লীকবির সখ্য গড়ে উঠেছিল তখন। ওই গ্রামে কবি সাময়িক একটি ঘরও তুলেছিলেন। সে ঘর তৈরি করে দিয়েছিল গ্রামের ছেলেমেয়েরা। আসমানী সে ঘরে নানান ছবি এঁকে দিয়েছিল। ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে তার উল্লেখ আছে। কবি এমনই শিশু প্রিয় ছিলেন।
আসমানীর বাবা আংশু মল্লিক ছিলেন খুবই গরিব। ছিটেফোঁটাও জমিজিরাত ছিল না তার। জসীম উদ্দীনের লেখায় পড়েছিলাম গ্রামের কচুরিপানার পুকুরের জল খেয়ে আসমানীর বাবা কলেরায় মারা যায়। সেসময় তারা গ্রামের ওই একই পুকুরের পানি খেয়ে নানা রোগে মানুষ মারা গেলেও রোগ জীবানু জলে বাস করতে পারে তা তারা বিশ্বাস করতো না তারা। ভাবত আটকা পুকুরে কীভাবে রোগ জীবানু আসে?
‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে আসমানীর বাবা কলেরায় মারা যাওয়ার কথা থাকলেও আসমানীর ভাইবোনও যে কলেরায় মারা গিয়েছিল তা জানা ছিল না। আসমানী সে কথা আমাকে শুনিয়েছিলেন। আসমানী আমাকে তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শৈশবে কলেরায় একই সঙ্গে তার চার ভাইবোন মারা যায়। জীবিত ছিলেন কেবল আসমানী ও তার এক বোন। তখন সেই বোনের স্বামী আসমানীর বেঁচে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছিল না। আসমানীর কথায় ‘বলে হগলি মরি গেল এই ডা রইল কিবার লাই?’ আসমানীকে সে একটা গরুর মাড় খাওয়া পাত্র যা স্থানীয় ভাষায় চারি হিসেবে পরিচিত তার মধ্যে ফেলে রেখেছিল। ভাগ্যের জোড়ে সেবার বেঁচে যায় আসমানী।
রসুলপুর গ্রামটি ছিল অদ্ভুত। সে গ্রামে পীরের নির্দেশে তার পুকুরে মাছের খাবার দেওয়া হলে তা জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে ভাবা হতো। অথচ অনাহারী আসমানীর পেটে কেউ খাবার তুলে দিতেন না। জসীম উদ্দীন ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে পাওয়া যায় একবার আসমানীকে সাপে কেটেছিল। তখন কবি সে গ্রামে উপস্থিত হলে গ্রামবাসীর মিথ্যে নির্ভর ওঝার ঝাড়ফুক থেকে তিনি মেয়েটিকে বাঁচাতে পেরেছিলেন।
ব্ইয়ের সূত্র ধরে আমি আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে কী কখনো সাপে কেটেছিল? তখন স্বীকার করে আসমানী। কিন্তু সাদাসিদে বর্ণপরিচয়হীন আসমানীর সব উত্তরই ছিল হ্যাঁ বা না পর্যন্ত সীমিত। মানুষকে প্ররোচিত করা বা মোহিত করার কোনরকম প্রবঞ্চনা তার শৈশবে যেমন ছিল না বৃদ্ধাবস্থাতেও তার কোনো পরিবর্তন হতে দেখেনি আমি।
কবি জসীম উদ্দীন আসমানীকে নিয়ে ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘আদিল মাতববরের বাড়িতে গিয়া তাহার বৈঠকখানায় বসিলাম। আসমানীকে আমার পাশে বসিতে বলিলাম। কিন্তু আসমানী সেই ধোপদূরস্ত বিছানার উপরে কিছুতেই বসিতে রাজি হইল না। সে আমর পাশে দাঁড়াইয়া রহিল’।
আমি আসমানীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কবি জসীম উদ্দীন যে আপনাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন তা কি আপনি জানতেন? তিনি হ্যাঁ বোধক উত্তর দেন। ভাল লেগেছিল কিনা জানতে চাইলেও জানায় ‘ভাল লেগেছিল’। আমি তখন প্রশ্ন ঘুরিয়ে এর কাহিনীটা জানতে চাইলাম। তখন আসমানী জানালো, কবি একদিন তার জন্য এক গ্লাস জল আনতে বলেই জল আনার ফাঁকে এই কবিতাটি লিখে ফেলেন। কাহিনীটি জেনে সত্যিই আশ্চর্য হলাম আমি। ভাবলাম এভাবেই তো হয়। দেখা গেল আসমানীকে নিয়ে একটি লাইন তার মনে এলো, আর বাকি লাইনগুলো সম্পন্ন করতে একা হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল কবির। সেজন্যই জল আনতে বলা।
এভাবেই কবি জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন ‘আসমানী’ নামের এই বিখ্যাত কবিতা:
‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি।
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়ে নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।’
‘আসমানী’ কবিতাটি কবির ‘এক পযসার বাঁশি’ গ্রন্থে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। আসমানী ২০১২ সালে মারা যায়। কিন্তু আসমানী পল্লী কবির এমন এক চরিত্র যার কোনো মৃত্যু নেই।
কবীর হোসেন
শনিবার, ১৯ আগস্ট ২০২৩
কবি জসীম উদ্দীন বাংলার পল্লীকবি। বাংলার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে ঘুরে পল্লীর সুখ-দুঃখ যেভাবে তিনি তার কবিতায় অঙ্কন করেছেন, বাংলা সাহিত্যে তা বিরল-বিস্ময়। রবীন্দ্র নজরুল প্রভাব বলয়ে জসীম উদদীন একটি স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করতে পেরেছিলেন। মাত্র বিএ পড়ার সময়ই কবি জসীম উদ্দীনের লেখা ‘কবর’ কবিতাটি ড. দীনেশ চন্দ্র সেনের উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
ফরিদপুরের তাম্বুলখানা গ্রামে ১৯০৩ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেন কবি জসীমউদদীন। সময়টা ছিল বাংলার শিল্পসাহিত্যের স্বর্ণযুগ। কেননা তার মাত্র চার বছর আগে জন্ম নিয়েছিলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯ সালের ২৪ মে) ও ফরিদপুরের কাছের জেলা বরিশালে কবি জীবনানন্দ দাশ (১৮৯৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি)। কেবল রবীন্দ্রনাথই ছিলেন তাদের প্রধানত অগ্রজ ((১৮৬১-১৯৪১)। এখানে আরও স্মরণীয় যে নজরুল ও জসীম উদ্দীন মারা যান একই বছর। জসীম উদ্দীন ১৯৭৬ সালের ১৩ মার্চ ও নজরুল ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট।
ব্ইয়ের সূত্র ধরে আমি আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে কী কখনো সাপে কেটেছিল? তখন স্বীকার করেন আসমানী। কিন্তু সাদাসিদে বর্ণপরিচয়হীন আসমানীর সব উত্তরই ছিল হ্যাঁ বা না পর্যন্ত সীমিত
গ্রাম বাংলার পটভূমিতে লেখা কবি জসীম উদ্দীনের ‘আসমানী’ ‘পল্লী জননী’ ‘নিমন্ত্রণ’ এই কবিতাগুলো আশি ও নব্বই দশকেও আমাদের শ্রেণিকক্ষে তুমুল পড়ানো হতো। ওই কবিতাগুলো পড়ে চোখের জল আটকে রাখা ছিল কঠিন। ইদানীং সেসব কবিতা সিলেবাস থেকে উঠে গেছে, যা পড়ে শিশুদের মনে গরিব মানুষ ও গ্রামজীবনের প্রতি টান অনুভব হতে পারে। বরং অর্থহীন দ্যোতনাই হয়ে উঠেছে এখন পাঠের বিষয়, যা চিত্তবিনোদনের বাহন হলেও চিত্ত তৈরিতে সেভাবে প্রভাব ফেলতে পারছে না। বিশেষত আটষট্টি হাজার গ্রামের প্রতিনিধিত্ব করে যে কবিতা তার মূল ভিত্তিপ্রস্থর জসীম উদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশের মতো কবিদের হাতেই।
এই লেখার মূল উপজীব্য পল্লীকবির আসমানী। আসমানী তার অপর অপর হাসু, রুপাই, সাজু এইসব বিখ্যাত চরিত্রের একটি। প্রাথমিক পাঠ্যসূচিতে একসময় কবিতাটি অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় ‘আসমানী’র দেশব্যাপী একটি পরিচিত ছিল। পল্লীকবি আসমানীকে এতটাই ভালবেসেছিলেন যে তাকে নিয়ে শুধু একটা কবিতা নয়, গোটা একটি শিশুতোষ বই-ই লিখেছিলেন ‘আসমানীর কবি ভাই’ নামে। বাস্তবেই আসমানীর যে চিত্র জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন জীবন সায়াহ্নেও যখন তার বয়স প্রায় আশি বছর তখনও আমি আসমানীকে দেখে তার অবিকল চিত্র খুঁজে পেয়েছিলাম।
আসমানীর খোঁজে আমি বেসরকারী সংগঠন ‘নারীপক্ষ’র হয়ে ফরিদপুর সদরের ইষাণ গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামে যাই ২০০৬ সালের দিকে। আসমানীর বাড়ি রসুলপুর পড়েছিলাম কবিতায়। কিন্তু রসুলপুরের চায়ের দোকানদার, স্কুলের শিক্ষক কেউই তাকে চিনতে পারল না। অথচ সেই শিক্ষকও আসমানী কবিতাটি হয়তো পড়িয়েছেন ক্লাসের ছাত্র-ছাত্রীদের। চায়ের দোকানীও পড়েছেন তার শৈশবে তাদের গ্রামের মেয়ে আসমানীকে নিয়ে লেখা কবিতা। শেষমেশ ইউনিয়ন পরিষদের সচিবের দপ্তরে গেলে তিনি চৌকিদার দিয়ে আমাকে আসমানীর বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করলেন।
রসুলপুর আসমানীর নিজের বাড়ি নয়। এটি তার নানা বাড়ি। ছোট্ট বেলায় বাবাকে হারিয়ে মায়ের সাথে নানা বাড়িতে আশ্রয় হয়েছিল আসমানীর। রসুলপুরে জসীম উদ্দীনের এক ভাই বিয়ে করেছিলেন। সে সুবাদে কবি ওই গ্রামে যেতেন। ওই গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে পল্লীকবির সখ্য গড়ে উঠেছিল তখন। ওই গ্রামে কবি সাময়িক একটি ঘরও তুলেছিলেন। সে ঘর তৈরি করে দিয়েছিল গ্রামের ছেলেমেয়েরা। আসমানী সে ঘরে নানান ছবি এঁকে দিয়েছিল। ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে তার উল্লেখ আছে। কবি এমনই শিশু প্রিয় ছিলেন।
আসমানীর বাবা আংশু মল্লিক ছিলেন খুবই গরিব। ছিটেফোঁটাও জমিজিরাত ছিল না তার। জসীম উদ্দীনের লেখায় পড়েছিলাম গ্রামের কচুরিপানার পুকুরের জল খেয়ে আসমানীর বাবা কলেরায় মারা যায়। সেসময় তারা গ্রামের ওই একই পুকুরের পানি খেয়ে নানা রোগে মানুষ মারা গেলেও রোগ জীবানু জলে বাস করতে পারে তা তারা বিশ্বাস করতো না তারা। ভাবত আটকা পুকুরে কীভাবে রোগ জীবানু আসে?
‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে আসমানীর বাবা কলেরায় মারা যাওয়ার কথা থাকলেও আসমানীর ভাইবোনও যে কলেরায় মারা গিয়েছিল তা জানা ছিল না। আসমানী সে কথা আমাকে শুনিয়েছিলেন। আসমানী আমাকে তার সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, শৈশবে কলেরায় একই সঙ্গে তার চার ভাইবোন মারা যায়। জীবিত ছিলেন কেবল আসমানী ও তার এক বোন। তখন সেই বোনের স্বামী আসমানীর বেঁচে যাওয়াকে মেনে নিতে পারছিল না। আসমানীর কথায় ‘বলে হগলি মরি গেল এই ডা রইল কিবার লাই?’ আসমানীকে সে একটা গরুর মাড় খাওয়া পাত্র যা স্থানীয় ভাষায় চারি হিসেবে পরিচিত তার মধ্যে ফেলে রেখেছিল। ভাগ্যের জোড়ে সেবার বেঁচে যায় আসমানী।
রসুলপুর গ্রামটি ছিল অদ্ভুত। সে গ্রামে পীরের নির্দেশে তার পুকুরে মাছের খাবার দেওয়া হলে তা জান্নাতে যাওয়ার রাস্তা হিসেবে ভাবা হতো। অথচ অনাহারী আসমানীর পেটে কেউ খাবার তুলে দিতেন না। জসীম উদ্দীন ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে পাওয়া যায় একবার আসমানীকে সাপে কেটেছিল। তখন কবি সে গ্রামে উপস্থিত হলে গ্রামবাসীর মিথ্যে নির্ভর ওঝার ঝাড়ফুক থেকে তিনি মেয়েটিকে বাঁচাতে পেরেছিলেন।
ব্ইয়ের সূত্র ধরে আমি আমি আসমানীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে কী কখনো সাপে কেটেছিল? তখন স্বীকার করে আসমানী। কিন্তু সাদাসিদে বর্ণপরিচয়হীন আসমানীর সব উত্তরই ছিল হ্যাঁ বা না পর্যন্ত সীমিত। মানুষকে প্ররোচিত করা বা মোহিত করার কোনরকম প্রবঞ্চনা তার শৈশবে যেমন ছিল না বৃদ্ধাবস্থাতেও তার কোনো পরিবর্তন হতে দেখেনি আমি।
কবি জসীম উদ্দীন আসমানীকে নিয়ে ‘আসমানীর কবি ভাই’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘আদিল মাতববরের বাড়িতে গিয়া তাহার বৈঠকখানায় বসিলাম। আসমানীকে আমার পাশে বসিতে বলিলাম। কিন্তু আসমানী সেই ধোপদূরস্ত বিছানার উপরে কিছুতেই বসিতে রাজি হইল না। সে আমর পাশে দাঁড়াইয়া রহিল’।
আমি আসমানীর কাছে জানতে চেয়েছিলাম কবি জসীম উদ্দীন যে আপনাকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন তা কি আপনি জানতেন? তিনি হ্যাঁ বোধক উত্তর দেন। ভাল লেগেছিল কিনা জানতে চাইলেও জানায় ‘ভাল লেগেছিল’। আমি তখন প্রশ্ন ঘুরিয়ে এর কাহিনীটা জানতে চাইলাম। তখন আসমানী জানালো, কবি একদিন তার জন্য এক গ্লাস জল আনতে বলেই জল আনার ফাঁকে এই কবিতাটি লিখে ফেলেন। কাহিনীটি জেনে সত্যিই আশ্চর্য হলাম আমি। ভাবলাম এভাবেই তো হয়। দেখা গেল আসমানীকে নিয়ে একটি লাইন তার মনে এলো, আর বাকি লাইনগুলো সম্পন্ন করতে একা হওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল কবির। সেজন্যই জল আনতে বলা।
এভাবেই কবি জসীম উদ্দীন লিখেছিলেন ‘আসমানী’ নামের এই বিখ্যাত কবিতা:
‘আসমানীরে দেখতে যদি তোমরা সবে চাও,
রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও।
বাড়ি তো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি,
একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি।
একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে,
তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে।
পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়,
সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার।
মিষ্টি তাহার মুখটি হতে হাসির প্রদীপ-রাশি
থাপড়েতে নিবিয়ে দেছে দারুণ অভাব আসি।
পরনে তার শতেক তালির শতেক ছেঁড়া বাস,
সোনালি তার গা বরণের করছে উপহাস।
ভোমর-কালো চোখ দুটিতে নাই কৌতুক-হাসি,
সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়া অশ্রু রাশি রাশি।
বাঁশির মতো সুরটি গলায় ক্ষয় হল তাই কেঁদে,
হয় নি সুযোগ লয় যে সে-সুর গানের সুরে বেঁধে।
আসমানীদের বাড়ির ধারে পদ্ম-পুকুর ভরে
ব্যাঙের ছানা শ্যাওলা-পানা কিল্-বিল্-বিল করে।
ম্যালেরিয়ার মশক সেথা বিষ গুলিছে জলে,
সেই জলেতে রান্না-খাওয়া আসমানীদের চলে।
পেটটি তাহার দুলছে পিলেয়ে নিতুই যে জ্বর তার,
বৈদ্য ডেকে ওষুধ করে পয়সা নাহি আর।’
‘আসমানী’ কবিতাটি কবির ‘এক পযসার বাঁশি’ গ্রন্থে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়। আসমানী ২০১২ সালে মারা যায়। কিন্তু আসমানী পল্লী কবির এমন এক চরিত্র যার কোনো মৃত্যু নেই।