alt

সাময়িকী

হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ওবায়েদ আকাশ, কাজী রাফি, খন্দকার মুনতাসীর মামুন

: বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

ওবায়েদ আকাশ : আপনার উপন্যাস সম্পর্কে আপনি বলছেন আপনার তিনটি উপন্যাস। কেউ কেউ বলেন, আপনার উপন্যাস একটাই। আগুনপাখি। এ জায়গায় দ্বন্দ্বটা আসলে কোথায়?

হাসান আজিজুল হক : আমার কোন দ্বন্দ্ব নেই। যে যা মনে হয় তাই বলুক। আমি উপন্যাস লিখতে চেয়েছি ছোটবেলা থেকেই। আর শুরুও করেছিলাম ‘শামুক’ দিয়ে।

ও. আ. : আমাদের সাহিত্যচর্চা কবিতা দিয়ে শুরু। উনিশ শতকে প্রথম বাংলা গদ্যের আবির্ভাব হলো এবং আপনারা সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন। আমাদের যে বাংলা কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা সেগুলো কিন্তু আমরা ইউরোপীয় ছাঁচে লিখছি। আমাদের মধ্যযুগের যে ধারাটা সেটা কিন্তু আর নেই। এখন আপনারা যারা কথাসাহিত্য চর্চা করছেন, এরকম কোনো মৌলিক জায়গা আমাদের জন্য যেমন লালন, হাছন- এধরনের কোন জায়গায় আপনাদের কাজ করার সুযোগ ছিল বা আছে?

হা. আ. হ. : দুই বাংলারই উনিশ শতকটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। উনিশ শতক আমাদের পশ্চিমের দরজাটা এমনভাবে খুলে দিয়েছে যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। ঐ যে একটা গান আছে না, সব ক’টা জানালা খুলে দাও না। আমি বারবার বলি শুধু জানালা খোলার কথা বলছে কেন? দরজা খোলার কথা বলে না কেন? আমি বলি, শুধু জানলা-দরজা নয়, গোটা বিশ্বই খুলে দাও। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য যে আমাদের বাংলা সাহিত্য থেকে উন্নত সাহিত্য- এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। শেক্সপিয়ারের কথা আলাদা, একজন ডিকেন্স, একজন থ্যাকারে, একজন জর্জ ইলিয়ট, কবিদের মধ্যে একজন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, ইয়েটস, শেলি, বায়রন, অস্কার ওয়াইল্ড। এই তো! কাজেই আমাদের সাহিত্য একেবারেই কম নয়, এর সত্যিকারের গুরুত্ব দিতেই হবে।

ও. আ. : এমন কোনো জায়গা আছে কি যেখানে আপনি কাজ করেননি বা কাজ করতে চান?

হা. আ. হ. : আছে। একসময় কুমিল্লা এলাকায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকাকে কেন্দ্র করে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেটা একটা কাহিনি। বিরজাবালা বলে এক নারী, যার পাঁচ সন্তানসহ তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঐ ঘটনা নিয়েই আমি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি।

ও. আ. : তরুণদের কিছু বই আপনি পড়েন। সম্ভাবনার জায়গাটা আসলে কোথায় দেখতে পান?

হা. আ. হ. : সম্ভাবনা তো অসাধারণ! সারা বিশ্ব খোলা তো! স্পেসিফিক করে বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারবো যে, ওদের পরিপূর্ণতা তখনই, যখন ওরা ভাবতে পারবে যে, বাংলা আমার দেশ, মানুষ আমার স্বজন। ‘বাংলা আমার দেশ’ শুধু এই কথাটা বললে দেশের প্রতি মায়াটা প্রকাশ পায়, শুধু মাটির মায়া না, প্রকৃতির প্রতি মায়া, মানুষের প্রতি মায়া। আমাদের তরুণরা মনে করলেও করতে পারে যে, বুড়োদের কথা শুনিস না। আর দরকার নেই। হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় আমি বুড়োদের মতো কথা বলছি না। কারণ আধুনিকতম যে, তার সঙ্গে আমি পরিচয় রাখার চেষ্টা করি, এবং মূল্যায়ন করারও চেষ্টা করি। সেজন্য আমার কাছে মনে হয় আমাদের সাহিত্য ভীষণভাবে প্রাদেশিকতায় আবদ্ধ। চোখটা খুলতেই হবে। দিক মাত্র চারটি নয়, দিক হলো দিশাহীন। বাতাসটাকে যদি ঢুকতে না দাও তাহলে কী করে হবে?

ও. আ. : লেখকদের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখা যায় যে, লেখালেখি একবার শুরু করলে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা থেকে লেখকরা বের হতে পারেন না। লেখক সত্তাটা তাদের ভেতরে কাজ করতেই থাকে। কখনও লিখতে পারেন, কখনও পারেন না, কেউ হয়ত সারাজীবন লেখেন, কেউ আবার ছেড়ে দেন, কিন্তু ঐ লেখকসত্তা সবার ভেতরেই জাগরূক থাকে। লেখকের এই শক্তির উৎসটা কোথায়?

হা. আ. হ. : এর উত্তরে আমি বলবো, নো আনসার। বলতে পারেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা? জানি না। এটা কি কারোর ভেতরের একটা প্রবণতা? মানুষ তো কোনোরকম প্রবণতা নিয়ে জন্মায় না, তাই না! পুরনো দার্শনিকেরা ধরেছে ভাল যে, মানুষের দেহের ভেতরে সবটাই আছে, এবং তাদের স্থান নির্দেশ করে দেয়া আছে। ভাবাবেগ বাদ দিয়ে মূল সত্যটা হলো, কেবলমাত্র বুদ্ধিই একমাত্র জিনিস যেটা মস্তক থেকেই আসে। তবে মানুষের ভেতরে যে উচ্চতর প্রবৃত্তি আছে সেগুলো যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যাবে না। বুদ্ধি হলে অনেক কিছুই মনে হবে, যেমন আমি দিচ্ছি, এতে আমার লাভ কী হবে, ওর লাভ কী হবে। আবার দয়া কারো এত বেশি যে সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে। তাদের নামও আমরা জানি, যেমন হাজী মোহম্মদ মহসীন। দানশীল মানুষ। জঞ্জাল বলে মনে করতেন নিজের অর্থসম্পদকে। বাড়িতে চোর ধরা পড়েছে, তাকে বলছেন তিনি, ‘জঞ্জাল যা আছে ঘরে, নিয়ে যাও দূর করে, যেথা খুশি নিয়ে যাও ভাই’ এই তো! এগুলোই তো আমার কাছে বার বার মনে হয়। প্রবৃত্তির তাড়নাতেই লেখক সত্তার জন্ম। তবে সেটা সবার মধ্যে নেই। কবি জীবনানন্দ দাশের একটা কথা আছে না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

কাজী রাফি : রুশ মনোবিজ্ঞানী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ বলেছিলেন, কবি-শিল্পী হন তাঁরাই, যাঁদের ভেতর প্রথম সাংকেতিক তন্ত্রের প্রাধান্য থাকে। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, কবি, লেখক বা শিল্পীদের ভ্রƒণ যখন মায়ের গর্ভে গঠিত হচ্ছে, তাঁদের স্নায়ুতেই সাংকেতিক আবহ থাকছে। অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কে বাস্তবের প্রত্যক্ষ প্রতিফল ঘটে, তীব্র ও তীক্ষè ইন্দ্রিয়ানুভূতির অধিকারী যারা, তারাই কবি বা শিল্পী হন। যে কোনো পরিবেশ এবং পরিস্থিতির প্রতি এঁরা অনেক বেশি সংবেদনশীল। আপনি এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখছেন।

হা. আ. হ. : দেখো, সুইচ অন করলে আলো জ্বলে, সুইচ অফ করলে আলো নেভে। কার্যকারণ কিছু আছে কি? আছে। কাকটা উড়ে গেল, সাথে সাথে একটা তাল টুপ করে পড়ল, সেখানে কার্যকারণ আছে? নেই। কোনোটা আছে, কোনোটা নেই, তাই না! মায়ের পেটের ভ্রƒণ পরীক্ষা করে কী করে উনি প্রমাণ করলেন যে, ব্রেন সেলটা আগে জন্মায়? আমি মনে করি, এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোনো যুক্তি খাটে না, এটা সম্পূর্ণই প্রকৃতিগত বিষয়।

ও. আ. : লেখক হিসেবে আপনার এই যে অব্যাহত যাত্রা, যেখানে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, বিরতি নেই; আমরা জানতে চাই, আপনি নিজে কি কখনও টের পেয়েছেন, এই যুক্ত থাকার পেছনে কোন অদৃশ্য টান আছে?

হা. আ. হ. : আমি কোনো রহস্যময় কারণের কথা জানি না। অন্তত আমার কাছে এর কোনো প্রমাণ নেই। যা কিছু করেছি বা পেয়েছি, সব মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি। হ্যাঁ, আমি কল্পনাপ্রবণ মানুষ ছিলাম। তবে আকাশকুসুম কল্পনা আমি ছোটবেলা থেকেই করিনি। বন্ধুবান্ধব দুয়েকজন যারা ছিল, তারা মূলত আমার কথা শুনত। মানে আমার কথা শুনতে চাইত। অর্থাৎ আমি গল্প বলে যাই, কথা বলে যাই- সেটাই তারা মন দিয়ে শুনত। সমরেশ নামে আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলত, গল্প বল। বানিয়ে বানিয়ে কত গল্প করতাম ওর সঙ্গে, সে খুব এনজয় করত। লেখালেখিও সেই ক্লাস সিক্স থেকে শুরু। একটা শিকার কাহিনি লেখা হলো। কাঁচা বয়স তখন, সম্পূর্ণ আন্দাজে লিখেছিলাম, কোনো মানে হয় না সে লেখার। লেখাটির নাম দিয়েছিলাম ‘কী হলো না’।

আমার সম্পূর্ণ মেশামেশি ছিল হিন্দু পাড়ার হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে। শৈশব কেটেছেও হিন্দু পাড়ায়, মুসলিম পাড়ায় নয় কেন? মুসলিম ছেলেদের কেউই তখন পাঠশালায় যেত না, দুয়েকজন হয়ত যেত, তারপর ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়ে আর যেত না। এরকম গ্রামেই বড় হয়েছি আমি। সেখানে বড়জোর হাডুডু খেলার সময়েই মুসলমান ছেলেদের পেতাম। কিন্তু কাটাতাম হিন্দু পাড়ায়।

আবার একা আপন মনে কী কারণে যে আমি মাঠে চলে যেতাম, বট-অশ্বত্থের ছায়ায় গিয়ে বসতাম। তার নিচে হয়ত শুকিয়ে গেছে, এমন কোনো পুকুর। দেখতাম পুকুর শুকোচ্ছে আর মাছগুলো মরছে। একসময় দেখা যেত, শত শত মাছ ঐ শুকনো মাটিতে পড়ে রয়েছে। এই রকম খোলা, মুক্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত।

ও. আ. : আপনি বলেছেন যে, দেশ ভাগের যন্ত্রণা আমার নেই। এবং আপনি বলেছেন যে, আপনার সমস্ত লেখা মাটি থেকে আসা। মানে সাবলীলভাবে বা সহজাতভাবে আসা। আমার জিজ্ঞাসা, আপনার যে আগুনপাখি উপন্যাস, সেখানে ’৪৭-এর দেশভাগ আছে, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ আছে। তাছাড়া আপনার দেশভাগের গল্পগুলোতেও তো দেশভাগের যন্ত্রণার কথা আছে। এগুলো কি তবে আরোপিত?

হা. আ. হ. : আমি দেশভাগে ব্যক্তিগতভাবে এফেক্টেড হইনি। কিন্তু চোখগুলো তো খোলা ছিল। দেখতে তো পাচ্ছি। শেয়ালদা ইস্টিশনে যেয়ে দেখতে পাচ্ছি অসহায় পরিবারগুলো কীভাবে মাটিতে পড়ে রয়েছে, শিশু পড়ে রয়েছে, এক জায়গায় শিশু মারা যাচ্ছে, এগুলো তো স্বচক্ষে দেখেছি। আমাদের গ্রাম পর্যন্ত ঢেউ যায়নি, এটুকু বলতে পারি। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আমি আমার গ্রাম ছাড়িনি। কারণ, সে ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িকতা আমাদের গ্রামে ছিল না।

আমার বাবা খুব উদ্যমী মানুষ ছিলেন। চমৎকার তাঁর ব্যবহার, চুপচাপ থাকতেন। দশটা গাঁয়ের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে পছন্দ করত, তাঁকেই ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান করেছিল, একটানা পনেরো-বিশ বছর ধরে। বাবার সেই স্বভাব খানিকটা আমি পেয়েছি। বাবাকে দেখেছি নিজের ব্যাপার-স্যাপার দেখছেনই না, এমনকি বাড়ির কোনো কিছুতেই তাঁর মন ছিল না। কিন্তু কোথায় আগুন লেগেছে, অন্য গ্রাম থেকে বাঁশ খড় এসব যোগাড় করা সব কিছুই যেন বাবার কাজ, বাবা এসব করে বেড়াচ্ছেন।

উন্মুক্ত প্রান্তর এবং আমার বাবার আমাকে ছেড়ে দেওয়া- এসবই আমার বেড়ে ওঠার রসদ জুগিয়েছে। আমার বাবা কিন্তু আমাকে মারাত্মক শাসন করতেন। মিথ্যা কথা বলেছি শুনলে সত্যি উনি আমার পিঠে দাগ বসিয়ে দিতেন পিটিয়ে। আর একটা বিষয়ে কেন এত রাগ করতেন জানি না, নতুন জামাকাপড়ে কোনো ফলের কষ লাগালে তিনি আমাকে প্রহার করতেন। এবং পেটানোর পর নিজেই আবার সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন। সেখানেও মার। বলতেন, চোখ বন্ধ করে থাক। সাবান এসে মুখের ওপরে পড়ত। চোখ বন্ধ করে থাকলে আমার কেমন হাপুচুপু লাগত। তখন আমি চোখটা খুলে ফেলতাম আর সঙ্গে সঙ্গে ঠাঁই করে এক চড়: ‘বললাম চোখ বন্ধ কর’। তো এইভাবে বাবা মানুষ করেছেন। কিন্তু মিথ্যা কথা বলতে দেননি কোনোদিন। আবার আমার স্বাধীনতায় বাধাও দেননি কোনোদিন। ‘যেখানে খুশি যা’। খবরই রাখতেন না। আমাদের বাড়িতে কেউ কারো খবর রাখত না। ৪০ জন লোকের কে খবর রাখবে? আমার এক ফুপু ছিলেন সর্বেসর্বা। যা বলতেন ফুপু। আমরাও কিছু হলে ফুপু, মা নয়, ফুপু।

ও. আ. : আপনি যখন ওই জন্মভূমি ছেড়ে আসলেন, এই বেদনা কি আপনাকে তাড়িত বা পীড়িত করেছে?

হা. আ. হ. : না না। কক্ষনো না। তুমি আগুনপাখি পড়ে দেখবে। আমারই মা তাঁর দেবরদের বলছেন, হ্যাঁ গো, ভাগ হয়েছে, এত যে লাফাচ্ছ, কি তোমরা যাবে? তারা ঠিক সাঁওতালদের মতো বলে দিল, আরে পাকিস্তান হয়েছে মুসলমানদের জন্য, তাই বলে আমরা কি দেশ ছাড়ব? ঐ যে সাঁওতালদের একটা গল্প আছে না; খ্রিস্টান হওয়ার পরে সাঁওতালদের যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে তোমরা আবার পরব পূজা করছ কেন? তোমরা-না খ্রিস্টান হয়েছ? সাঁওতালরা বলল, খেরেস্টান হয়েছি তো কী হয়েছে, তাই বলে কি ধর্ম ছাড়ব নাকি? তো আমাদেরও ঠিক এরকমই হয়েছিল। ধর্ম তো ছাড়তে পারি না। ঐ তো ঘুরে ঘুরে বেড়ানো, আর কী!

আমাদের শৈশব কেটেছে ঘুরে ঘুরে। খালি ঘুরে বেড়ানো। আর কোথায় কী আছে? সেদিনগুলোর কথা ভাবলেই মনে পড়ে বৈঁচি সংগ্রহের কথা। দুটো তিনটা বীজ আছে। মিষ্টি খেতে, এত বড় বড় হয়। ওটা আমাদের ওখানেই হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্তের প্রথম খ-েও বৈঁচির কথা আছে। তবে শুধু বৈঁচি নয়, কোথায় কী খাওয়া যায় সেখানেই আমাদের ঝোঁক ছিল। যেখানে যা-ই পাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুড়ছি, ভাবখানা এই যে, খেয়ে দেখি না কেন কী হয়! তো সেই জন্য সাপের মুখে পড়া। বনকুলের ঝোঁপে ঢুকতে পারবো না, মাটি ফেলে ফেলে সিঁড়ি বানিয়ে কাছে গিয়ে দেখি সেখানে একটা চন্দ্রবোড়া সাপ গুটিয়ে বসে আছে। তো এই রকম এত মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণেই মনে হয় আমার মানসিক গঠনটা খুব খোলামেলা হয়েছে।

কা. রা. : পৃথিবীর বড় বড় যে লেখকআছেন, ভিএস নাইপল কিংবা সালমান রুশদি, তাঁদের লেখাগুলোতে দেশকে ফিরে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা এসেছে। স্মৃতির জায়গাটাকে ছেড়ে আসাটা বড় কষ্টের। ঐ যে উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা যাচ্ছে না- এই যন্ত্রণা কি আপনার লেখায় আশ্রয় নেয় কখনও?

ও. আ. : এর সঙ্গে আমি একটু যোগ করতে চাই। যেমন ঈদে যদি আমি বাড়িতে না যাই, মন অস্থির হয়ে যায়। মনে হয় সেই যে ছেলেবেলায় আমরা ঈদের দিন সকালবেলা লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করে খিচুড়ি সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যেতাম, আত্মীয়-স্বজন আসত, সেই টানেই কিন্তু আমি গ্রামে যাই বা গ্রাম আমাকে টানে। এই যে মানসিক টান যে আমি আমার জন্মভূমির কাছে যাবো, অন্য কোনো কিছুই কিন্তু আমাকে সেই সুখ দিতে পারে নাই। সে ধরনের দুঃখবোধ বা কোনো অনুভূতি কি আপনার মধ্যে কাজ করে না!

হা. আ. হ. : আমার খুব মনে পড়ে আমাদের মাটির তৈরি বিশাল রাজপ্রাসাদের কথা। আমার বাবার শখ ছিল, সবচেয়ে ভাল বাড়ি বানাবেন, ইট-পাথর দিয়ে না; পারবেনও না, করবেনও না। মাটির বাড়িই বানাবেন তিনি। তো আমাদের এমন একটা সুন্দর মাটির বাড়ি হলো, যার নিচে পর পর দুটো ঘর। মাঝখানে সিঁড়ি ওপরে ওঠার। আবার ওপাশে দুটো ঘর পর পর। আবার ওপরে একটা বারান্দা। বাইরে একটা চওড়া বারান্দা। ওটা পাকা করা হয়েছিল। ওপরের একটা ঘরে, সেটা যে কী নিভৃতে আমার আশ্রম ছিল, কেউ বকাবকি করলে, রাগ করলে, যা-ই হোক না কেন, আমি দ্রুত-পায়ে উঠে ঐ ঘরটায় গিয়ে উত্তর আর পশ্চিমের জানালা খুলে দিতাম। পশ্চিমের জানলায় পুরো দুমাইল মাঠ দেখা যাচ্ছে, এবং রেলস্টেশনের লালরঙ করা টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। তাতে রোদ ঝকমক ঝকমক করছে। একটা নির্বোধ ছেলে চুপ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এর বাইরে আরও কিছু স্মৃতির বিষয় ছিল যেগুলো এখনও মনের ভেতর স্থির হয়ে আছে, তবে তা নিয়ে তেমন স্মৃতিকাতরতা নেই।

ও. আ. : এই যে আপনার সব কিছুই মাটি থেকে আসা, এটা কি কারো সঙ্গে মেলানো, মানে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে কারো সঙ্গে সংযোগ নাকি এটা দেখতে দেখতে। আমি যতদূর জানি, বড় লেখকদের কাজ হচ্ছে তাদের শৈশবকে খুঁড়ে তোলা, তাঁর সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে তুলে ধরা, মানে সেই ধরনের কোনো পূর্ব ধারণা কি আপনার মধ্যে কাজ করেছে?

হা. আ. হ. : না, এটা আমার একেবারেই নিজস্ব ভাবনা। এটা নিয়ে ভাবব বা আত্মজীবনী লিখব, এমন কিছু চিন্তা আমার মধ্যে কখনও আসেনি।

ও. আ. : আপনি এ মুহূর্তে আমাদের দেশের শীর্ষ কথাসাহিত্যিক, জীবিতদের মধ্যে। এখন মারিও ভার্গাস ইয়োসা বা মার্কেস কিংবা ওরহান কামুক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক মানের লেখকের উপন্যাসে দেখা যায়, হয়তো সেখানে আছে সুইডেনের নায়ক বা আফগানিস্তানের নায়িকা। কিংবা আমেরিকার নায়ক, সাথে পোল্যান্ডের নায়িকা। এই যে টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর মধ্যে সারা পৃথিবীর মিথ আমরা পাই, সেই ব্যাপারটা বাংলা সাহিত্যে অনুপস্থিত, সেটা কী কারণে বলে মনে করেন?

হা. আ. হ. : হ্যাঁ ঠিক বলেছ। একেবারেই অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের হাওয়া আগেও ছিল না, এখনও নেই বাংলা সাহিত্যে। এর অন্যতম কারণ, ইংরেজি জানার সীমাবদ্ধতা। তরুণ যারা, তারা এখনও তেমনভাবে ইংরেজি শিখছে না। এজন্য অনুবাদ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

কা. রা. : আমি আমার উপন্যাসে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু তা প্রচারিত হয়নি। বাস্তবতা হলো পাঠক একেবারেই কমছে আমাদের দেশে। পাঠকের মননের কাছে গিয়ে সে যে জিনিসটা পছন্দ করে, সেই বইগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু লেখকের কাজ তো তাঁর মননশীলতাকে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে আসা। দেখা যাচ্ছে যে, লেখক যে আন্তর্জাতিক পটভূমির ওপর কাজ করছেন, সেগুলো কিন্তু ছড়িয়ে পড়েনি। তাহলে লেখকের দোষ কোথায় বা লেখক এক্ষেত্রে কী করবে?

হা. আ. হ. : আমার পরামর্শ হচ্ছে এই যে, এসব ভেবে লাভ নেই। তুমি কলম-কাগজ নিয়ে বস। যা মন চায় দেখ। দেখ, তোমার মনের মধ্যে কী আছে? ফাঁপা যদি হয় তবে ঢব ঢব করে আওয়াজ হবে। আর ফাঁপা যদি না হয় তাহলে সলিড শব্দ বেরিয়ে আসবে। কাজেই আমার ঐ হাহাকার নেই। সেটা হলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে পারতাম না। তিনি তো আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়েননি। তারাশঙ্কর তো একেবারেই পড়েননি। বিভূতিভূষণের সাহিত্য পড়ে কী মনে হয়? টিপিক্যাল বাংলা সাহিত্য? সে মান কি বিশ্বমানের চাইতে খুব নিচে? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে কি এই আন্তর্জাতিকতা আছে? তোমাদের কি মনে হয় না, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বিশ্বের অনন্য একটি সাহিত্যকর্ম। এটায় নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। অথচ এর অনুবাদ কেউ করেনি। এর অনুবাদ হয়ও না। কারণ ইংরেজি ভাষার সাথে বাংলার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এ কারণে আমাদের সাহিত্য ইংরেজিতে ভাল অনুবাদ করা যায় না। যাই হোক, কী সে কী হতো সেসব ভেবে লাভ নেই। আমার পুকুরে যদি এক হাঁটু জল থাকে তবে সেই পুকুরেই সাঁতার কাটি। আর যদি ডুবে গিয়েই সাঁতার কাটতে হয় তবে আরও একটু দূরে যাবো। কিন্তু আমার পুকুরেই আমি যাব, তোমার পুকুরে আমি সাঁতার কাটতে যাবো না।

ও. আ. : ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করি। যেমন ‘ইউলিসিস’কে বিংশ শতাব্দির সেরা উপন্যাস মনে করে আন্তর্জাতিক মহল, সেটা কিন্তু শুধু ডাবলিন শহরটার একদিনের ঘটনা নিয়ে লেখা। তিনি লেখক হিসেবে নিজের ভূখ-কে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি একই দেশের অন্য কোনো লেখক যখন আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আসছেন, সেটাকে তো আমরা খারাপভাবে দেখতে পারি না। এতে তো পাঠকের দরজা আরও খুলে যাচ্ছে। আমরা যদি সেটুকু পারি তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের তো ক্ষতির কিছু নাই। সেই চেষ্টাটা আমাদের কেন নেই?

হা. আ. হ. : কতগুলো জায়গাতেই আমি আল্লায় বিশ্বাস করি। কেন হয় না, আল্লায় জানে। আচ্ছা দেখুক না দেখুক, বিদেশি লেখাগুলো বাংলাতেও তো চমৎকার অনুবাদ হয়েছে। এমন অনেক আছে। এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর কত সুন্দর অনুবাদ করেছেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। থ্রি কমরেডস-এর অনুবাদ আছে। ওয়ার অ্যান্ড পিস-এরও অনুবাদ আছে। আছে তো! সেগুলো তো পড়তে হবে।

কা. রা. : আমার ধারণা যেটা, অর্থাৎ ওবায়েদ আকাশের প্রশ্নের উত্তরে আমি যেটা মনে করছি যে, আমাদের দেশে এই বিদেশি চরিত্র নিয়ে বা বিদেশকে নিয়ে কাজ করার একটা ঝুঁকি, খুব সম্ভবত লেখকরা মনে করেন।

হা. আ. হ. : অর্থাৎ দেখছি, ভাবছি। এবং শেষে বলছে আমি এর মধ্যে যাবো না। তাই তো! এটা কি তুমি মনে কর যে আমাদের দেশের লেখক-সমাজের মধ্যে এসব আছে? তাহলে এত ক্ষুদ্র জায়গাতে লেখে কেন? তারা নিজেরা যখন লেখে, তখন তাদের পটভূমি, তাদের লেখার বিষয় এত লিমিটেড কেন বল? লিমিটেড হওয়া তো উচিৎ না। তা হয়েছে কেন? তাঁর মানে এসব তারা পড়লেও তার দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়নি, কিছুই হয়নি। আমার তো মনে হয় লেখাপড়ার মানও নিচের দিকে নেমে গেছে। আগে যেমন ম্যাট্রিক পাস করেও ইংরেজি লিখতে-বলতে দুটোই শিখতো। এখন ইংরেজিতে এমএ পাস করলেও ঝর ঝর করে ইংরেজি লিখতে পারে না।

খন্দকার মুনতাসীর মামুন :আমার কাছে প্রশ্নটা সেখানেই যে, গভীরতাটা নেই কেন? লেখকের ভেতরে সেই গভীরতাটা নেই কেন? প্রকৃতির গুঞ্জনে, বৃষ্টির শব্দে এখনও তো সেই গভীরতা আছে, মানুষের ভেতরে সেটা হারিয়ে যাচ্ছে কেন?

হা. আ. হ. : কেন? বাংলা সাহিত্যেই বঙ্কিম কিংবা রবীন্দ্রনাথের মতো এখন কি কেউ আছেন? রোহিণীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করার চেষ্টাটা কই? কিংবা দেবী চৌধুরাণীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করার আগ্রহ? ঐ চরিত্রগুলো গড়ে উঠেছিল তিলে তিলে, একেবারে মানস গঠন। মানে এমন করে চরিত্রগুলোকে তৈরি করা হয়েছিল যেন আমরা বাস্তবে তাদের দেখতে পাচ্ছি। কৃষ্ণকান্তের উইল, শ্রীকান্ত। রোহিণীর কথা বলা যায়, যে মেয়েটি সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। তাঁকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হলো। আমরা যে কতটা আধুনিক হতে পারি, সেটা বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখেও বোঝা যায়। অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের মতো আমরা হতে পারি। বঙ্কিমচন্দ্র নিয়েছেন, তার মনের গড়নটার মধ্যে ওসব যেত না। কেননা, তার কৃষ্ণকান্তের উইল বা আরও অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যেও এসব স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি ভারতবর্ষের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু লোকটা অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে গোটা বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করতে অন্তত আমাদের তো কোনো আপত্তি নেই। পৃথিবী নিক না নিক। সেভাবে তার অনুবাদ হোক বা না হোক। কিন্তু আমরা তো জানি। আমরা তো শেক্সপিয়ারও পড়েছি, হোমারও পড়েছি, ইলিয়াডও পড়েছি। আবার একালের লেখক যারা ইয়েটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- এসব কবি বা আমেরিকান কবি- সব তো পড়েছি। তাতে কি মনে হয় যে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ আছে?

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

হাসান আজিজুল হকের সাক্ষাৎকার

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : ওবায়েদ আকাশ, কাজী রাফি, খন্দকার মুনতাসীর মামুন

বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

ওবায়েদ আকাশ : আপনার উপন্যাস সম্পর্কে আপনি বলছেন আপনার তিনটি উপন্যাস। কেউ কেউ বলেন, আপনার উপন্যাস একটাই। আগুনপাখি। এ জায়গায় দ্বন্দ্বটা আসলে কোথায়?

হাসান আজিজুল হক : আমার কোন দ্বন্দ্ব নেই। যে যা মনে হয় তাই বলুক। আমি উপন্যাস লিখতে চেয়েছি ছোটবেলা থেকেই। আর শুরুও করেছিলাম ‘শামুক’ দিয়ে।

ও. আ. : আমাদের সাহিত্যচর্চা কবিতা দিয়ে শুরু। উনিশ শতকে প্রথম বাংলা গদ্যের আবির্ভাব হলো এবং আপনারা সেই ধারাবাহিকতা রক্ষা করছেন। আমাদের যে বাংলা কবিতা, আধুনিক বাংলা কবিতা সেগুলো কিন্তু আমরা ইউরোপীয় ছাঁচে লিখছি। আমাদের মধ্যযুগের যে ধারাটা সেটা কিন্তু আর নেই। এখন আপনারা যারা কথাসাহিত্য চর্চা করছেন, এরকম কোনো মৌলিক জায়গা আমাদের জন্য যেমন লালন, হাছন- এধরনের কোন জায়গায় আপনাদের কাজ করার সুযোগ ছিল বা আছে?

হা. আ. হ. : দুই বাংলারই উনিশ শতকটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট। উনিশ শতক আমাদের পশ্চিমের দরজাটা এমনভাবে খুলে দিয়েছে যার প্রভাব কাটিয়ে ওঠা মুশকিল। ঐ যে একটা গান আছে না, সব ক’টা জানালা খুলে দাও না। আমি বারবার বলি শুধু জানালা খোলার কথা বলছে কেন? দরজা খোলার কথা বলে না কেন? আমি বলি, শুধু জানলা-দরজা নয়, গোটা বিশ্বই খুলে দাও। অবশ্য ইংরেজি সাহিত্য যে আমাদের বাংলা সাহিত্য থেকে উন্নত সাহিত্য- এটা জোর দিয়ে বলা যায় না। শেক্সপিয়ারের কথা আলাদা, একজন ডিকেন্স, একজন থ্যাকারে, একজন জর্জ ইলিয়ট, কবিদের মধ্যে একজন ওয়ার্ডসওয়ার্থ, কিটস, ইয়েটস, শেলি, বায়রন, অস্কার ওয়াইল্ড। এই তো! কাজেই আমাদের সাহিত্য একেবারেই কম নয়, এর সত্যিকারের গুরুত্ব দিতেই হবে।

ও. আ. : এমন কোনো জায়গা আছে কি যেখানে আপনি কাজ করেননি বা কাজ করতে চান?

হা. আ. হ. : আছে। একসময় কুমিল্লা এলাকায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকাকে কেন্দ্র করে একটা উপন্যাস লিখতে শুরু করেছিলাম। সেটা একটা কাহিনি। বিরজাবালা বলে এক নারী, যার পাঁচ সন্তানসহ তাকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঐ ঘটনা নিয়েই আমি একটা উপন্যাস লেখার চেষ্টা করছি।

ও. আ. : তরুণদের কিছু বই আপনি পড়েন। সম্ভাবনার জায়গাটা আসলে কোথায় দেখতে পান?

হা. আ. হ. : সম্ভাবনা তো অসাধারণ! সারা বিশ্ব খোলা তো! স্পেসিফিক করে বলতে পারবো না। তবে এটুকু বলতে পারবো যে, ওদের পরিপূর্ণতা তখনই, যখন ওরা ভাবতে পারবে যে, বাংলা আমার দেশ, মানুষ আমার স্বজন। ‘বাংলা আমার দেশ’ শুধু এই কথাটা বললে দেশের প্রতি মায়াটা প্রকাশ পায়, শুধু মাটির মায়া না, প্রকৃতির প্রতি মায়া, মানুষের প্রতি মায়া। আমাদের তরুণরা মনে করলেও করতে পারে যে, বুড়োদের কথা শুনিস না। আর দরকার নেই। হতে পারে। কিন্তু আমার মনে হয় আমি বুড়োদের মতো কথা বলছি না। কারণ আধুনিকতম যে, তার সঙ্গে আমি পরিচয় রাখার চেষ্টা করি, এবং মূল্যায়ন করারও চেষ্টা করি। সেজন্য আমার কাছে মনে হয় আমাদের সাহিত্য ভীষণভাবে প্রাদেশিকতায় আবদ্ধ। চোখটা খুলতেই হবে। দিক মাত্র চারটি নয়, দিক হলো দিশাহীন। বাতাসটাকে যদি ঢুকতে না দাও তাহলে কী করে হবে?

ও. আ. : লেখকদের মধ্যে একটা ব্যাপার দেখা যায় যে, লেখালেখি একবার শুরু করলে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এটা থেকে লেখকরা বের হতে পারেন না। লেখক সত্তাটা তাদের ভেতরে কাজ করতেই থাকে। কখনও লিখতে পারেন, কখনও পারেন না, কেউ হয়ত সারাজীবন লেখেন, কেউ আবার ছেড়ে দেন, কিন্তু ঐ লেখকসত্তা সবার ভেতরেই জাগরূক থাকে। লেখকের এই শক্তির উৎসটা কোথায়?

হা. আ. হ. : এর উত্তরে আমি বলবো, নো আনসার। বলতে পারেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা? জানি না। এটা কি কারোর ভেতরের একটা প্রবণতা? মানুষ তো কোনোরকম প্রবণতা নিয়ে জন্মায় না, তাই না! পুরনো দার্শনিকেরা ধরেছে ভাল যে, মানুষের দেহের ভেতরে সবটাই আছে, এবং তাদের স্থান নির্দেশ করে দেয়া আছে। ভাবাবেগ বাদ দিয়ে মূল সত্যটা হলো, কেবলমাত্র বুদ্ধিই একমাত্র জিনিস যেটা মস্তক থেকেই আসে। তবে মানুষের ভেতরে যে উচ্চতর প্রবৃত্তি আছে সেগুলো যুক্তি বা বুদ্ধি দিয়ে বিচার করা যাবে না। বুদ্ধি হলে অনেক কিছুই মনে হবে, যেমন আমি দিচ্ছি, এতে আমার লাভ কী হবে, ওর লাভ কী হবে। আবার দয়া কারো এত বেশি যে সর্বস্ব দিয়ে দিতে পারে। তাদের নামও আমরা জানি, যেমন হাজী মোহম্মদ মহসীন। দানশীল মানুষ। জঞ্জাল বলে মনে করতেন নিজের অর্থসম্পদকে। বাড়িতে চোর ধরা পড়েছে, তাকে বলছেন তিনি, ‘জঞ্জাল যা আছে ঘরে, নিয়ে যাও দূর করে, যেথা খুশি নিয়ে যাও ভাই’ এই তো! এগুলোই তো আমার কাছে বার বার মনে হয়। প্রবৃত্তির তাড়নাতেই লেখক সত্তার জন্ম। তবে সেটা সবার মধ্যে নেই। কবি জীবনানন্দ দাশের একটা কথা আছে না, ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি’।

কাজী রাফি : রুশ মনোবিজ্ঞানী ইভান পেত্রোভিচ পাভলভ বলেছিলেন, কবি-শিল্পী হন তাঁরাই, যাঁদের ভেতর প্রথম সাংকেতিক তন্ত্রের প্রাধান্য থাকে। তিনি তাঁর গবেষণায় দেখেছেন, কবি, লেখক বা শিল্পীদের ভ্রƒণ যখন মায়ের গর্ভে গঠিত হচ্ছে, তাঁদের স্নায়ুতেই সাংকেতিক আবহ থাকছে। অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কে বাস্তবের প্রত্যক্ষ প্রতিফল ঘটে, তীব্র ও তীক্ষè ইন্দ্রিয়ানুভূতির অধিকারী যারা, তারাই কবি বা শিল্পী হন। যে কোনো পরিবেশ এবং পরিস্থিতির প্রতি এঁরা অনেক বেশি সংবেদনশীল। আপনি এই ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখছেন।

হা. আ. হ. : দেখো, সুইচ অন করলে আলো জ্বলে, সুইচ অফ করলে আলো নেভে। কার্যকারণ কিছু আছে কি? আছে। কাকটা উড়ে গেল, সাথে সাথে একটা তাল টুপ করে পড়ল, সেখানে কার্যকারণ আছে? নেই। কোনোটা আছে, কোনোটা নেই, তাই না! মায়ের পেটের ভ্রƒণ পরীক্ষা করে কী করে উনি প্রমাণ করলেন যে, ব্রেন সেলটা আগে জন্মায়? আমি মনে করি, এক্ষেত্রে বিজ্ঞানের কোনো যুক্তি খাটে না, এটা সম্পূর্ণই প্রকৃতিগত বিষয়।

ও. আ. : লেখক হিসেবে আপনার এই যে অব্যাহত যাত্রা, যেখানে কোনো বিচ্ছিন্নতা নেই, বিরতি নেই; আমরা জানতে চাই, আপনি নিজে কি কখনও টের পেয়েছেন, এই যুক্ত থাকার পেছনে কোন অদৃশ্য টান আছে?

হা. আ. হ. : আমি কোনো রহস্যময় কারণের কথা জানি না। অন্তত আমার কাছে এর কোনো প্রমাণ নেই। যা কিছু করেছি বা পেয়েছি, সব মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়েছি। হ্যাঁ, আমি কল্পনাপ্রবণ মানুষ ছিলাম। তবে আকাশকুসুম কল্পনা আমি ছোটবেলা থেকেই করিনি। বন্ধুবান্ধব দুয়েকজন যারা ছিল, তারা মূলত আমার কথা শুনত। মানে আমার কথা শুনতে চাইত। অর্থাৎ আমি গল্প বলে যাই, কথা বলে যাই- সেটাই তারা মন দিয়ে শুনত। সমরেশ নামে আমার এক বন্ধু ছিল, আমার সঙ্গে দেখা হলেই বলত, গল্প বল। বানিয়ে বানিয়ে কত গল্প করতাম ওর সঙ্গে, সে খুব এনজয় করত। লেখালেখিও সেই ক্লাস সিক্স থেকে শুরু। একটা শিকার কাহিনি লেখা হলো। কাঁচা বয়স তখন, সম্পূর্ণ আন্দাজে লিখেছিলাম, কোনো মানে হয় না সে লেখার। লেখাটির নাম দিয়েছিলাম ‘কী হলো না’।

আমার সম্পূর্ণ মেশামেশি ছিল হিন্দু পাড়ার হিন্দু ছেলেদের সঙ্গে। শৈশব কেটেছেও হিন্দু পাড়ায়, মুসলিম পাড়ায় নয় কেন? মুসলিম ছেলেদের কেউই তখন পাঠশালায় যেত না, দুয়েকজন হয়ত যেত, তারপর ক্লাস থ্রী পর্যন্ত পড়ে আর যেত না। এরকম গ্রামেই বড় হয়েছি আমি। সেখানে বড়জোর হাডুডু খেলার সময়েই মুসলমান ছেলেদের পেতাম। কিন্তু কাটাতাম হিন্দু পাড়ায়।

আবার একা আপন মনে কী কারণে যে আমি মাঠে চলে যেতাম, বট-অশ্বত্থের ছায়ায় গিয়ে বসতাম। তার নিচে হয়ত শুকিয়ে গেছে, এমন কোনো পুকুর। দেখতাম পুকুর শুকোচ্ছে আর মাছগুলো মরছে। একসময় দেখা যেত, শত শত মাছ ঐ শুকনো মাটিতে পড়ে রয়েছে। এই রকম খোলা, মুক্ত পৃথিবীতে ঘুরে বেড়াতে ভাল লাগত।

ও. আ. : আপনি বলেছেন যে, দেশ ভাগের যন্ত্রণা আমার নেই। এবং আপনি বলেছেন যে, আপনার সমস্ত লেখা মাটি থেকে আসা। মানে সাবলীলভাবে বা সহজাতভাবে আসা। আমার জিজ্ঞাসা, আপনার যে আগুনপাখি উপন্যাস, সেখানে ’৪৭-এর দেশভাগ আছে, ৪৩-এর দুর্ভিক্ষ আছে। তাছাড়া আপনার দেশভাগের গল্পগুলোতেও তো দেশভাগের যন্ত্রণার কথা আছে। এগুলো কি তবে আরোপিত?

হা. আ. হ. : আমি দেশভাগে ব্যক্তিগতভাবে এফেক্টেড হইনি। কিন্তু চোখগুলো তো খোলা ছিল। দেখতে তো পাচ্ছি। শেয়ালদা ইস্টিশনে যেয়ে দেখতে পাচ্ছি অসহায় পরিবারগুলো কীভাবে মাটিতে পড়ে রয়েছে, শিশু পড়ে রয়েছে, এক জায়গায় শিশু মারা যাচ্ছে, এগুলো তো স্বচক্ষে দেখেছি। আমাদের গ্রাম পর্যন্ত ঢেউ যায়নি, এটুকু বলতে পারি। সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে আমি আমার গ্রাম ছাড়িনি। কারণ, সে ধরনের কোনো সাম্প্রদায়িকতা আমাদের গ্রামে ছিল না।

আমার বাবা খুব উদ্যমী মানুষ ছিলেন। চমৎকার তাঁর ব্যবহার, চুপচাপ থাকতেন। দশটা গাঁয়ের হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে তাঁকে পছন্দ করত, তাঁকেই ইউনিয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান করেছিল, একটানা পনেরো-বিশ বছর ধরে। বাবার সেই স্বভাব খানিকটা আমি পেয়েছি। বাবাকে দেখেছি নিজের ব্যাপার-স্যাপার দেখছেনই না, এমনকি বাড়ির কোনো কিছুতেই তাঁর মন ছিল না। কিন্তু কোথায় আগুন লেগেছে, অন্য গ্রাম থেকে বাঁশ খড় এসব যোগাড় করা সব কিছুই যেন বাবার কাজ, বাবা এসব করে বেড়াচ্ছেন।

উন্মুক্ত প্রান্তর এবং আমার বাবার আমাকে ছেড়ে দেওয়া- এসবই আমার বেড়ে ওঠার রসদ জুগিয়েছে। আমার বাবা কিন্তু আমাকে মারাত্মক শাসন করতেন। মিথ্যা কথা বলেছি শুনলে সত্যি উনি আমার পিঠে দাগ বসিয়ে দিতেন পিটিয়ে। আর একটা বিষয়ে কেন এত রাগ করতেন জানি না, নতুন জামাকাপড়ে কোনো ফলের কষ লাগালে তিনি আমাকে প্রহার করতেন। এবং পেটানোর পর নিজেই আবার সাবান দিয়ে স্নান করিয়ে দিতেন। সেখানেও মার। বলতেন, চোখ বন্ধ করে থাক। সাবান এসে মুখের ওপরে পড়ত। চোখ বন্ধ করে থাকলে আমার কেমন হাপুচুপু লাগত। তখন আমি চোখটা খুলে ফেলতাম আর সঙ্গে সঙ্গে ঠাঁই করে এক চড়: ‘বললাম চোখ বন্ধ কর’। তো এইভাবে বাবা মানুষ করেছেন। কিন্তু মিথ্যা কথা বলতে দেননি কোনোদিন। আবার আমার স্বাধীনতায় বাধাও দেননি কোনোদিন। ‘যেখানে খুশি যা’। খবরই রাখতেন না। আমাদের বাড়িতে কেউ কারো খবর রাখত না। ৪০ জন লোকের কে খবর রাখবে? আমার এক ফুপু ছিলেন সর্বেসর্বা। যা বলতেন ফুপু। আমরাও কিছু হলে ফুপু, মা নয়, ফুপু।

ও. আ. : আপনি যখন ওই জন্মভূমি ছেড়ে আসলেন, এই বেদনা কি আপনাকে তাড়িত বা পীড়িত করেছে?

হা. আ. হ. : না না। কক্ষনো না। তুমি আগুনপাখি পড়ে দেখবে। আমারই মা তাঁর দেবরদের বলছেন, হ্যাঁ গো, ভাগ হয়েছে, এত যে লাফাচ্ছ, কি তোমরা যাবে? তারা ঠিক সাঁওতালদের মতো বলে দিল, আরে পাকিস্তান হয়েছে মুসলমানদের জন্য, তাই বলে আমরা কি দেশ ছাড়ব? ঐ যে সাঁওতালদের একটা গল্প আছে না; খ্রিস্টান হওয়ার পরে সাঁওতালদের যখন জিজ্ঞেস করা হলো যে তোমরা আবার পরব পূজা করছ কেন? তোমরা-না খ্রিস্টান হয়েছ? সাঁওতালরা বলল, খেরেস্টান হয়েছি তো কী হয়েছে, তাই বলে কি ধর্ম ছাড়ব নাকি? তো আমাদেরও ঠিক এরকমই হয়েছিল। ধর্ম তো ছাড়তে পারি না। ঐ তো ঘুরে ঘুরে বেড়ানো, আর কী!

আমাদের শৈশব কেটেছে ঘুরে ঘুরে। খালি ঘুরে বেড়ানো। আর কোথায় কী আছে? সেদিনগুলোর কথা ভাবলেই মনে পড়ে বৈঁচি সংগ্রহের কথা। দুটো তিনটা বীজ আছে। মিষ্টি খেতে, এত বড় বড় হয়। ওটা আমাদের ওখানেই হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রীকান্তের প্রথম খ-েও বৈঁচির কথা আছে। তবে শুধু বৈঁচি নয়, কোথায় কী খাওয়া যায় সেখানেই আমাদের ঝোঁক ছিল। যেখানে যা-ই পাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে মুখে পুড়ছি, ভাবখানা এই যে, খেয়ে দেখি না কেন কী হয়! তো সেই জন্য সাপের মুখে পড়া। বনকুলের ঝোঁপে ঢুকতে পারবো না, মাটি ফেলে ফেলে সিঁড়ি বানিয়ে কাছে গিয়ে দেখি সেখানে একটা চন্দ্রবোড়া সাপ গুটিয়ে বসে আছে। তো এই রকম এত মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর কারণেই মনে হয় আমার মানসিক গঠনটা খুব খোলামেলা হয়েছে।

কা. রা. : পৃথিবীর বড় বড় যে লেখকআছেন, ভিএস নাইপল কিংবা সালমান রুশদি, তাঁদের লেখাগুলোতে দেশকে ফিরে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা এসেছে। স্মৃতির জায়গাটাকে ছেড়ে আসাটা বড় কষ্টের। ঐ যে উন্মুক্ত প্রান্তর দেখা যাচ্ছে না- এই যন্ত্রণা কি আপনার লেখায় আশ্রয় নেয় কখনও?

ও. আ. : এর সঙ্গে আমি একটু যোগ করতে চাই। যেমন ঈদে যদি আমি বাড়িতে না যাই, মন অস্থির হয়ে যায়। মনে হয় সেই যে ছেলেবেলায় আমরা ঈদের দিন সকালবেলা লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করে খিচুড়ি সেমাই খেয়ে নামাজ পড়তে যেতাম, আত্মীয়-স্বজন আসত, সেই টানেই কিন্তু আমি গ্রামে যাই বা গ্রাম আমাকে টানে। এই যে মানসিক টান যে আমি আমার জন্মভূমির কাছে যাবো, অন্য কোনো কিছুই কিন্তু আমাকে সেই সুখ দিতে পারে নাই। সে ধরনের দুঃখবোধ বা কোনো অনুভূতি কি আপনার মধ্যে কাজ করে না!

হা. আ. হ. : আমার খুব মনে পড়ে আমাদের মাটির তৈরি বিশাল রাজপ্রাসাদের কথা। আমার বাবার শখ ছিল, সবচেয়ে ভাল বাড়ি বানাবেন, ইট-পাথর দিয়ে না; পারবেনও না, করবেনও না। মাটির বাড়িই বানাবেন তিনি। তো আমাদের এমন একটা সুন্দর মাটির বাড়ি হলো, যার নিচে পর পর দুটো ঘর। মাঝখানে সিঁড়ি ওপরে ওঠার। আবার ওপাশে দুটো ঘর পর পর। আবার ওপরে একটা বারান্দা। বাইরে একটা চওড়া বারান্দা। ওটা পাকা করা হয়েছিল। ওপরের একটা ঘরে, সেটা যে কী নিভৃতে আমার আশ্রম ছিল, কেউ বকাবকি করলে, রাগ করলে, যা-ই হোক না কেন, আমি দ্রুত-পায়ে উঠে ঐ ঘরটায় গিয়ে উত্তর আর পশ্চিমের জানালা খুলে দিতাম। পশ্চিমের জানলায় পুরো দুমাইল মাঠ দেখা যাচ্ছে, এবং রেলস্টেশনের লালরঙ করা টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। তাতে রোদ ঝকমক ঝকমক করছে। একটা নির্বোধ ছেলে চুপ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতাম। এর বাইরে আরও কিছু স্মৃতির বিষয় ছিল যেগুলো এখনও মনের ভেতর স্থির হয়ে আছে, তবে তা নিয়ে তেমন স্মৃতিকাতরতা নেই।

ও. আ. : এই যে আপনার সব কিছুই মাটি থেকে আসা, এটা কি কারো সঙ্গে মেলানো, মানে আপনার পাঠ অভিজ্ঞতা থেকে কারো সঙ্গে সংযোগ নাকি এটা দেখতে দেখতে। আমি যতদূর জানি, বড় লেখকদের কাজ হচ্ছে তাদের শৈশবকে খুঁড়ে তোলা, তাঁর সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে তুলে ধরা, মানে সেই ধরনের কোনো পূর্ব ধারণা কি আপনার মধ্যে কাজ করেছে?

হা. আ. হ. : না, এটা আমার একেবারেই নিজস্ব ভাবনা। এটা নিয়ে ভাবব বা আত্মজীবনী লিখব, এমন কিছু চিন্তা আমার মধ্যে কখনও আসেনি।

ও. আ. : আপনি এ মুহূর্তে আমাদের দেশের শীর্ষ কথাসাহিত্যিক, জীবিতদের মধ্যে। এখন মারিও ভার্গাস ইয়োসা বা মার্কেস কিংবা ওরহান কামুক বা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক মানের লেখকের উপন্যাসে দেখা যায়, হয়তো সেখানে আছে সুইডেনের নায়ক বা আফগানিস্তানের নায়িকা। কিংবা আমেরিকার নায়ক, সাথে পোল্যান্ডের নায়িকা। এই যে টি এস এলিয়টের ‘ওয়েস্ট ল্যান্ড’-এর মধ্যে সারা পৃথিবীর মিথ আমরা পাই, সেই ব্যাপারটা বাংলা সাহিত্যে অনুপস্থিত, সেটা কী কারণে বলে মনে করেন?

হা. আ. হ. : হ্যাঁ ঠিক বলেছ। একেবারেই অনুপস্থিত। আন্তর্জাতিক সাহিত্যের হাওয়া আগেও ছিল না, এখনও নেই বাংলা সাহিত্যে। এর অন্যতম কারণ, ইংরেজি জানার সীমাবদ্ধতা। তরুণ যারা, তারা এখনও তেমনভাবে ইংরেজি শিখছে না। এজন্য অনুবাদ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

কা. রা. : আমি আমার উপন্যাসে এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করেছি। কিন্তু তা প্রচারিত হয়নি। বাস্তবতা হলো পাঠক একেবারেই কমছে আমাদের দেশে। পাঠকের মননের কাছে গিয়ে সে যে জিনিসটা পছন্দ করে, সেই বইগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। কিন্তু লেখকের কাজ তো তাঁর মননশীলতাকে আরও উন্নত স্তরে নিয়ে আসা। দেখা যাচ্ছে যে, লেখক যে আন্তর্জাতিক পটভূমির ওপর কাজ করছেন, সেগুলো কিন্তু ছড়িয়ে পড়েনি। তাহলে লেখকের দোষ কোথায় বা লেখক এক্ষেত্রে কী করবে?

হা. আ. হ. : আমার পরামর্শ হচ্ছে এই যে, এসব ভেবে লাভ নেই। তুমি কলম-কাগজ নিয়ে বস। যা মন চায় দেখ। দেখ, তোমার মনের মধ্যে কী আছে? ফাঁপা যদি হয় তবে ঢব ঢব করে আওয়াজ হবে। আর ফাঁপা যদি না হয় তাহলে সলিড শব্দ বেরিয়ে আসবে। কাজেই আমার ঐ হাহাকার নেই। সেটা হলে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় পড়তে পারতাম না। তিনি তো আন্তর্জাতিক সাহিত্য পড়েননি। তারাশঙ্কর তো একেবারেই পড়েননি। বিভূতিভূষণের সাহিত্য পড়ে কী মনে হয়? টিপিক্যাল বাংলা সাহিত্য? সে মান কি বিশ্বমানের চাইতে খুব নিচে? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসে কি এই আন্তর্জাতিকতা আছে? তোমাদের কি মনে হয় না, ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ বিশ্বের অনন্য একটি সাহিত্যকর্ম। এটায় নোবেল পুরস্কার না পাওয়ার তো কোনো কারণ নেই। অথচ এর অনুবাদ কেউ করেনি। এর অনুবাদ হয়ও না। কারণ ইংরেজি ভাষার সাথে বাংলার একটা মৌলিক পার্থক্য আছে। এ কারণে আমাদের সাহিত্য ইংরেজিতে ভাল অনুবাদ করা যায় না। যাই হোক, কী সে কী হতো সেসব ভেবে লাভ নেই। আমার পুকুরে যদি এক হাঁটু জল থাকে তবে সেই পুকুরেই সাঁতার কাটি। আর যদি ডুবে গিয়েই সাঁতার কাটতে হয় তবে আরও একটু দূরে যাবো। কিন্তু আমার পুকুরেই আমি যাব, তোমার পুকুরে আমি সাঁতার কাটতে যাবো না।

ও. আ. : ব্যাপারটা আর একটু পরিষ্কার করি। যেমন ‘ইউলিসিস’কে বিংশ শতাব্দির সেরা উপন্যাস মনে করে আন্তর্জাতিক মহল, সেটা কিন্তু শুধু ডাবলিন শহরটার একদিনের ঘটনা নিয়ে লেখা। তিনি লেখক হিসেবে নিজের ভূখ-কে তুলে ধরেছেন। পাশাপাশি একই দেশের অন্য কোনো লেখক যখন আন্তর্জাতিকতা নিয়ে আসছেন, সেটাকে তো আমরা খারাপভাবে দেখতে পারি না। এতে তো পাঠকের দরজা আরও খুলে যাচ্ছে। আমরা যদি সেটুকু পারি তাহলে সেক্ষেত্রে আমাদের তো ক্ষতির কিছু নাই। সেই চেষ্টাটা আমাদের কেন নেই?

হা. আ. হ. : কতগুলো জায়গাতেই আমি আল্লায় বিশ্বাস করি। কেন হয় না, আল্লায় জানে। আচ্ছা দেখুক না দেখুক, বিদেশি লেখাগুলো বাংলাতেও তো চমৎকার অনুবাদ হয়েছে। এমন অনেক আছে। এরিক মারিয়া রেমার্কের ‘অল কোয়ায়েট অন দি ওয়েস্টার্ন ফ্রন্ট’-এর কত সুন্দর অনুবাদ করেছেন মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়। থ্রি কমরেডস-এর অনুবাদ আছে। ওয়ার অ্যান্ড পিস-এরও অনুবাদ আছে। আছে তো! সেগুলো তো পড়তে হবে।

কা. রা. : আমার ধারণা যেটা, অর্থাৎ ওবায়েদ আকাশের প্রশ্নের উত্তরে আমি যেটা মনে করছি যে, আমাদের দেশে এই বিদেশি চরিত্র নিয়ে বা বিদেশকে নিয়ে কাজ করার একটা ঝুঁকি, খুব সম্ভবত লেখকরা মনে করেন।

হা. আ. হ. : অর্থাৎ দেখছি, ভাবছি। এবং শেষে বলছে আমি এর মধ্যে যাবো না। তাই তো! এটা কি তুমি মনে কর যে আমাদের দেশের লেখক-সমাজের মধ্যে এসব আছে? তাহলে এত ক্ষুদ্র জায়গাতে লেখে কেন? তারা নিজেরা যখন লেখে, তখন তাদের পটভূমি, তাদের লেখার বিষয় এত লিমিটেড কেন বল? লিমিটেড হওয়া তো উচিৎ না। তা হয়েছে কেন? তাঁর মানে এসব তারা পড়লেও তার দ্বারা তারা প্রভাবিত হয়নি, কিছুই হয়নি। আমার তো মনে হয় লেখাপড়ার মানও নিচের দিকে নেমে গেছে। আগে যেমন ম্যাট্রিক পাস করেও ইংরেজি লিখতে-বলতে দুটোই শিখতো। এখন ইংরেজিতে এমএ পাস করলেও ঝর ঝর করে ইংরেজি লিখতে পারে না।

খন্দকার মুনতাসীর মামুন :আমার কাছে প্রশ্নটা সেখানেই যে, গভীরতাটা নেই কেন? লেখকের ভেতরে সেই গভীরতাটা নেই কেন? প্রকৃতির গুঞ্জনে, বৃষ্টির শব্দে এখনও তো সেই গভীরতা আছে, মানুষের ভেতরে সেটা হারিয়ে যাচ্ছে কেন?

হা. আ. হ. : কেন? বাংলা সাহিত্যেই বঙ্কিম কিংবা রবীন্দ্রনাথের মতো এখন কি কেউ আছেন? রোহিণীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করার চেষ্টাটা কই? কিংবা দেবী চৌধুরাণীর মতো চরিত্র সৃষ্টি করার আগ্রহ? ঐ চরিত্রগুলো গড়ে উঠেছিল তিলে তিলে, একেবারে মানস গঠন। মানে এমন করে চরিত্রগুলোকে তৈরি করা হয়েছিল যেন আমরা বাস্তবে তাদের দেখতে পাচ্ছি। কৃষ্ণকান্তের উইল, শ্রীকান্ত। রোহিণীর কথা বলা যায়, যে মেয়েটি সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে গেল। তাঁকে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করতে হলো। আমরা যে কতটা আধুনিক হতে পারি, সেটা বঙ্কিমচন্দ্রকে দেখেও বোঝা যায়। অর্থাৎ বঙ্কিমচন্দ্রের মতো আমরা হতে পারি। বঙ্কিমচন্দ্র নিয়েছেন, তার মনের গড়নটার মধ্যে ওসব যেত না। কেননা, তার কৃষ্ণকান্তের উইল বা আরও অন্যান্য উপন্যাসের মধ্যেও এসব স্পষ্ট বোঝা যায়। তিনি ভারতবর্ষের মধ্যে থাকতে চেয়েছেন। কিন্তু লোকটা অসম্ভব প্রতিভাবান ছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে গোটা বিশ্বসাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করতে অন্তত আমাদের তো কোনো আপত্তি নেই। পৃথিবী নিক না নিক। সেভাবে তার অনুবাদ হোক বা না হোক। কিন্তু আমরা তো জানি। আমরা তো শেক্সপিয়ারও পড়েছি, হোমারও পড়েছি, ইলিয়াডও পড়েছি। আবার একালের লেখক যারা ইয়েটস, ওয়ার্ডসওয়ার্থ- এসব কবি বা আমেরিকান কবি- সব তো পড়েছি। তাতে কি মনে হয় যে আমাদের লজ্জিত হওয়ার কোনো কারণ আছে?

back to top