alt

সাময়িকী

মোড়া

মোহিত কামাল

: বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

অহন কী করুম ক

হাতে মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে রোদচশমার ভেতর থেকে গরম চোখে তাকিয়ে মহাজন রহিমুদ্দিন এক পা এগিয়ে ধানবিক্রেতা কৃষক জমির আলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেজিপ্রতি ১২ টাকা পাবে। হিসাব করে যা আছে সব মেপে দাও।’

মহাজনের কথা শুনে জ্যৈষ্ঠের খররোদে পোড়া দেহ থেকে ঘামঝরা বন্ধ হয়ে গেল। ধানের দরপতনের আলমত দেখে জমির আলির বোধের মধ্যে আকস্মিক শুরু হয়ে গেল কালবৈশাখীর তাণ্ডব। ঘূর্ণি উঠল মস্তিষ্কে। চিন্তনধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। রহিমুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল সেখানে আর মানবচোখ বসে নেই, সেই চক্ষুকোঠরে আসন নিয়েছে শকুনচোখ। কিছুক্ষণ বোধশূন্য তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুঝল প্রকৃতির বৈরিতার চেয়েও মানুষের অমানবিক বাছ-বিচার আরও বেশি ভয়াবহ, আরও বেশি দানবীয় প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করে। ধানের দরের এ প্রতিকূল ছোবলে গরমে পোড়া তামাটে ত্বকের স্তর ভেদ করে দেহে ঢুকে গেল বিষ। বিষদহনে তৃষ্ণা জেগে উঠল। পানি পানের ইচ্ছা হলো প্রকট। তীক্ষ্ণ যাতনা নিয়ে এবার তাকাল রহিমুদ্দিনের হাতে ধরা বোতলের দিকে। কী আশ্চর্য! পানির দিকে তাকিয়েও পানি খাওয়ার ইচ্ছা জাগল না! এক বোতল পানির দাম কত? এমন প্রশ্নই ঝটিত উদয় হলো মনে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, ‘২৫ টাকা!’ এক লিটার পানির দাম মাত্র ২৫ টাকা অর্থাৎ ২ কেজি ধান বেচে এক লিটার পানিও কেনা যাবে না। প্রবল বেগে উষ্ণ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক ফেটে। ভেতরের তীব্র ক্রন্দনধ্বনি বাতাসের বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে গেল রহিমুদ্দিনের সামনে। সেই বাতাসও স্পর্শ করল না মহাজনকে। আরও কঠোর অবস্থানে দাঁড়িয়ে বলল, ‘১২ টাকা দরে একমণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ৪৮০ টাকা। মনপ্রতি ত্রিশ টাকা ব্যয় হবে পরিবহনের বাড়তি খরচ আর সড়কের সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের চাঁদা মেটানোর জন্য। সর্বসাকল্যে পাবে মনপ্রতি ৪৫০ টাকা।’

মহাজনের নতুন শব্দবাণে আঘাত খেয়ে এবার কোমর ভেঙে গেল জমির আলির। সোজা অবস্থায় দাঁড়ানো থেকে আচমকা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মাটিতে। নিজের হাতের দিকে চোখ গেল তার। হাতের তালুতে বসে থাকা গাছের ছাল উঠে যাওয়া দাগের মতো শ্রমের কঠোর চিহ্নের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল প্রতিটি ধানের পেছনে জড়িয়ে আছে রক্তধোয়া মমতা। পানির চেয়েও কম মূল্যে ধানক্রেতার প্রস্তাব-ভঙ্গিটাকে মনে হলো রক্তচোষা আক্রমণ। এ আক্রমণ প্রতিহত করে উঠে দাঁড়াতে হবে, বুঝেও উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেল না সে। হাড়ভাঙা শ্রমে সোনা ফলানো ফসলের বোঝা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরল তাকে। বোরো ধান চাষে মণপ্রতি উৎপাদনব্যয় প্রায় ৭০০-৭৫০ টাকা। আবার কোনও এলাকায় খরচ ৮৫০ টাকারও বেশি। অথচ তারা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ৪৫০-৪৮০ টাকায়। কী অবিচার! কী অবিচার! বিক্ষোভে ফেটে পড়ল কৃষক জমির আলির অন্তর্জগৎ। কেজিপ্রতি ২২ টাকা দরে ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। আশায় বুক বেঁধেছিল নিজে, অন্যান্য প্রান্তিক কৃষকরাও চাষে উৎসাহ পেয়েছিল। অথচ সরকারি ঘোষণার কোনও জোরালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই ফাঁকে রহিমুদ্দিনের মতো মধ্যস্বত্বভোগী জোতদাররা ফুলেফেঁপে উঠছে আর মুনাফার দড়িতে কৃষকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে ফাঁস! দরের ফাঁস ঝুলন্ত গলায় চেপে ধরার আগেই আকস্মিক ফুঁসে উঠল নিরীহ কৃষক জমির আলি। চিৎকার করে ডাকল একটু দূরে ধানের বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুসাকে। ডাক শুনে কাছে দৌড়ে এসে মুসা প্রশ্ন করল, ‘কী হইছে, জমির?’

‘ধান বেচুম না।। রাস্তায় ছড়াইয়া দিমু সব ধান। তোরা আ’, হগলে একলগে আ’!’

‘ক্যান কী হইছে?’

‘মহাজন কী কয় হুনছ নাই? হে কয়...?’

জমিরকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা। সে বলল, ‘হুনলাম সব কথা। হের কাছে ধান বেচুম না। বেবাকরে খবর দিয়ুম। দরকার হইলে নদীতে ভাসায়ে দিমু ধানের বস্তা!’ জমির আলির ভেতরে আগুনঝরা ক্ষোভ ঘৃণায় বদলে গেল, বসা অবস্থা থেকে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে ঘৃণা আর ক্ষোভের উদ্গীরণ ঘটাল একসঙ্গে- মাটিতে থুতু ছিটিয়ে চিৎকার করে আশেপাশে অন্যান্য কৃষকদের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘রাস্তায় ধান ছিটায়ে দে হগলে, গাড়ি আটকা। রাস্তা বন্ধ কইরা দে।’

হাড়ভাঙা পরিশ্রমী জমির আলিকে অনেক আগে থেকেই চেনে মহাজন রহিমুদ্দিন। নিরীহ, নতজানু, আলাভোলা ধরনের এ কৃষকের ভেতর থেকে ক্ষোভ আর ঘৃণার উদ্গীরণ হতে দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। আরও হতবাক হলো অন্য চাষিদের আকস্মিক গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধতা দেখে। এ এলাকায় কৃষকদের কোনও নেতা ছিল না। নিরীহ কৃষকরা নানা নির্যাতন নিপীড়ন মুখ বুজে সয়ে গেছে দিনের পর দিন। ভেতরে লালিত হতাশা ধীরে ধীরে জমতে জমতে পাহাড়সম হয়েছে। এতদিন অটল পাহাড় সব ঝড়ঝাপটা বুক পেতে হজম করে এলেও, এ মুহূর্তে নিজের আচরণের কারণে টলে গেছে কঠিন পাহাড়তল, বুঝতে পেরে একছুটে পালাতে চেষ্টা করল রহিমুদ্দিন।

মুসা ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল রহিমুদ্দিনের পায়ের দিকে। সেও কখনও কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে বলে কেউ বলতে পারবে না। বরং সবসময় ভয়ে কাবু থাকত রহিমুদ্দিনের মতো অন্যান্য জোতদারের সামনে। আচমকা কী ঘটল নিজেও টের পেল না। নিজের ভেতর কী পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে ছিল বুঝতে পারেনি এতদিন। এই শক্তি আর শ্রম ঢেলে তাদের মতো কৃষকরা নিমগ্ন হয়ে চাষ করে কেবল, সেই শ্রমে সোনা ফলে, মাঠে মাঠে দোলা ওঠে সোনালি শস্যের, উঠোনগুলো পাহাড়সম ধানের স্তূপে ভরে ওঠে, কৃষাণীর মুখে হাসি ফোটে- এই ধারার বাইরের জীবনচিত্র জানা ছিল না তাদের।

হঠাৎ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে মুসা দাঁড়াল জমির আলির পাশে। বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস এখনও থামেনি। ক্রোধের কারণে দেহের উত্তাপ রোদের উত্তাপকেও ছাপিয়ে গেছে। সেই উত্তাপ নিয়ে জমিরের উদ্দেশে মুসা বলল, ‘অহন কী করুম, ক।’

এরি মধ্যে অন্যান্য কৃষকরাও ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সবাই বলল, ‘হ’ জমির ক। অহন কী করুম ক।’ সমস্বরে সবাই জমিরের নির্দেশ পালনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।

স্বামীর হতাশা স্পর্শ করল না জোহরা বেগমকে। এবার এ জীবনে যা করেনি তাই করল সে। স্বামীরে ধমক দিয়ে বলল, ‘ওডেন, মোড়ায় বহেন। ভুখানাঙ্গা দরিদ্র চাষাদের নেতা হইছেন আপনি। হেই সম্মান তো আঁ’র মাথার মুকুট। এই মুকুটরে কি মাটিতে রাখবার পারি? ওডেন, বইয়েন মোড়ায়।’

দুই ॥ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আগমন

দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় বক্স করে খবর ছাপা হয়েছে- ‘তবুু হাসি নেই কৃষকের মুখে।’ একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে জমির আলির প্রতিবাদের খবর। কৃষকরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না ধান বিক্রি করে, সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহের সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রামে গ্রামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধানের চাতালসমূহ- খবরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে জমির আলিদের থানা প্রশাসনে।

মাছ ধরার জাল নিয়ে খাল পাড়ের দিকে যাচ্ছিল জমির। এমন সময় দেখল বাড়ির দিকে ছুটে আসছে মুসা। তার পেছনে আইল বেয়ে হেঁটে আসছেন একদল মানুষ। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তাদের গ্রামের মানুষ মনে হলো না। কিছুটা চিন্তিত হয়ে জাল মাটিতে রেখে সে তাকিয়ে রইল ছুটে আসতে থাকা মুসার দিকে।

কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মুসা বলল, ‘টিএনও স্যার’!, ‘টিনও স্যার’! আর ওসিও আইবার লাগছে। তোর লগে কথা কইবার চায়!’

‘কী কথা? আঁর লগে কী কথা, মুসা?’ ভয় আর বিস্ময়মাখা প্রশ্ন বেরিয়ে এল জমিরের কণ্ঠ থেকে।

‘আমরা তো কুনু দোষ করি নাই, ন্যায্য দর চাইছি, ঠিক দাম চাওয়া তো কুনু দোষ না। কী কয় হেরা দেহি।’

বাড়ির পুকুরপাড়ে ঝাকড়া বাদাম গাছের পশ্চিম পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইল জমির আর মুসা। পূব দিগন্তে সূর্যের নরম রোদ আটকে যাচ্ছে বাদাম গাছের ছড়ানো পাতায়। রোদছায়ার আদুরে ছোঁয়াও কমাতে পারল না তাদের উদ্বেগ। বিস্ময় নিয়ে দুজনে দেখল টিএনতাকে। ওসির দলবহর দেখে আশপাশের বাড়ি থেকে বালকবয়সি থেকে শুরু করে বয়স্করাও বেরিয়ে আসছে বাইরে। দেখতে দেখতে উৎসুক গ্রামবাসী ঘিরে ফেলেছে আগত থানা প্রশাসনের ছোট দলটিকে।

আচমকা ভয়ে জ্বলে-ওঠা শিখার দহনে পুড়ে গেল ভয়। জেগে ওঠা কৃষকদের বুকের চিতা আপন বুকে পুরে নিয়ে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জমির আলি।

নিরপরাধ, নিরীহ জীবনের শেকড় ছিঁড়ে ক্ষিপ্র সূর্যের তেজ চোখে ধারণ করে প্রশাসনের আগত কর্মকর্তাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানাল জমির।

টিএনও সাহেব এগিয়ে এসে স্বউদ্যোগী হয়ে জমিরের হাত টেনে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। এ ধরনের আদব-কায়দায় অনভ্যস্ত জমির প্রথমে কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেলেও নির্বাহী কর্মকর্তার মধুর ব্যবহারে বিগলিত হয়ে সালাম জানিয়ে জিগ্যেস করল, ‘স্যার আমরা কি কুনু অপরাধ কইরা ফালাইছি?’

‘না। অপরাধ করবেন কেন? ন্যায্য দাবির কথা বলেছেন। আমাদের ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে আমরা অভিবাদন জানাতে এসেছি।’

বিরুদ্ধ হাওয়ার ঝাপটা খেল না গ্রামবাসী। অনুকূল বাতাসের জ্যোতির্ময় পরশ পেয়ে কী বলতে হবে, কী করতে হবে না বুঝে সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছুটা সময় নিয়ে, একদমে মুসা ছুট দিল পুকুর পাড়ের ডাবগাছের দিকে। তর তর করে সে উঠে গেল গাছে। এক ঝাড়ে মোট ৬টি ডাব ঝাড়সহ কেটে দ্রুত দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিল নিচে। একদল লেগে গেল ডাব কাটার কাজে।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে ডাব তুলে দিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তার পাশে দাঁড়িয়ে জমির আলি বিনীতভাবে এবার বলল, ‘আমরা গরিব চাষারা এনজিও আর মহাজন গো কাছ থে’ রিন লইয়ারে ধান চাষ করি। আশা মিটে না আমাগো। এক বিঘা জমিনে ধানের চারা লাগানো শুরুকরণের পর থে’ কাটা-মাড়াই আর জমিনের মালিক গো বর্গা দেওন পর্যন্ত খরচ হয় প্রায় ১৪ হাজার টেহা। আর আমাগো ঘামঝরা কাজের বদলায় বিঘাপ্রতি ধান ওডে ১৪-২০ মণ। আমরা বাঁচার পথ পামু যদি ধানের দর মণপ্রতি এক হাজার টাকা ধরা হয়। সরকার যেন হেই ব্যবস্থা লয়। তা নাওলে বউবাচ্চা লই বাঁচার পারমু না আমরা।’

টিএনও সাহেব জমির আলির কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, ‘আমরা শাসক নই, আপনাদের সেবক। জমির আলি যা বললেন অবশ্যই মাঠ প্রশাসন থেকে সেই কথা আমরা খাদ্যমন্ত্রণালয়ে তুলে ধরব। আশা করি আপনারা নিরাশ হবেন না। তবে অনুরোধ থাকবে কথায় কথায় হতাশ হয়ে এ এলাকার মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে বন্ধ করে দেবেন না।’

মুসা এবার বুক উঁচিয়ে বলল, ‘কেবল উপরে উপরে কথা কইলে আমাগো পেটে ভাত জুটব না। সরকারের ঠিক করা দামে যেন ধান বেচতে পারি, হের দিকে নজর রাখতে হইব আপনাগো। সরকার দাম ঠিক কইরা দিলে হেই দর দিতে চায় না মহাজনরা।’

‘হ।’ ঠিক কথা কইছে মুসা। বর্গাচাষিগো কষ্টের শ্রমে ধানের ফলন ভালা হইছে। ন্যায্য দর না পাইলে আগাম বছর ধান চাষে আমাগো তেজ থাকব না। তহন ক্ষতি হইব দেশের, সরকারের।’ বলল জমির আলি।

এবার ওসি বাহ্বা দিলেন কৃষকদের। জমির আলির সঙ্গে হাত মেলালেন। তার ডান বাহুতে তিনবার চাপড় মেরে বললেন, জমির আলির মতো যোগ্য নেতা থাকতে আপনাদের ভয় নেই। সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। নিশ্চয় তা লাঘব হবে।’

অল্প বয়সি এক ছোকরা, অশিক্ষিত সে, নিজের নামটিও দস্তখত দিতে জানে না, এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাগো পেডে তিনবেলা ভাত জুটব তো?’

কঠিন প্রশ্ন। সহজ কথা আর সহজ রইল না। টিএনও সাহেব বাক্ হারিয়ে ফেললেন। ওসি সাহেব মিনমিনে গলায় বললেন, ‘জুটবে। তোমাদের শ্রমই তোমাদের ঘরে ভাত জোটাবে।’

তিন ॥ নতুন আশার আলো

জোহরা বেগমের দীনহীন ঘর আকস্মিক বদলে গেছে বাতিঘরে। সুবাতাস বইছে। স্বস্তি আর প্রশান্তির একটা ঢেউ আন্দোলিত করছে তার মন। শীর্ণ ঘরে নতুন আশার সূর্য জাগছে, আকাক্সক্ষার বীজ রোপিত হচ্ছে- নতুন শস্যদানায় ভরে উঠবে উঠোন, ধানমাড়ানি সংগীতে ভরে থাকবে জোছনারাত। অভাব দূর হবে, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারবে- শিক্ষার আলোবঞ্চিত জোহরা বেগমের অন্তরধ্বনি থেকে এমনি ভাবনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। দুদিন ধরে মগ্ন হয়ে সে বেত দিয়ে বানিয়ে চলেছে একটা মোড়া। বেতের শলার একেকটা প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলছে সে জমির আলিকে। ভালোবাসার মানুষটা কীভাবে যেন গ্রামের নেতা বনে গেছে। সবাই সম্মান করছে। সেও স্বামীকে তুলে রাখতে চায় চোখের মণিতে। গুনগুন করে গান গাইছে, গানের তালে হাতের বুননে হৃদয়ের উত্তাপ ঢেলে দিচ্ছে। কঠোর শ্রমের বিনিময়ে দুদিনের চেষ্টায় অবশেষে সে বানিয়ে ফেলেছে মোড়াটি। মহিমার বীজ নতুন করে রোপিত হয়ে গেছে হৃদয়ের খরাভূমে, নিজেও টের পেল না জোহরা।

ঘরের উঠোনে নেমে আইলপথের দিগন্তসীমার দিকে তাকিয়ে জোহারা বুঝল জমির আলি আসছে। স্বপ্নপোড়া চোখ স্ফীত হয়ে উঠল আনন্দজোয়ারে, অনুভবের প্রশ্রয়ে একবার ছুটে গেল সামনে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। নিজ হাতে বানানো নতুন মোড়াটি চকির তলে ঠেলে রেখে ফিরে এল আবার। দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে দেখল প্রিয় স্বামীর হাত শূন্য, হাতে কোনও পোঁটলা নেই। অথচ ফেরার পথে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে আসার কথা, ধান বিক্রি হওয়ার কথা। তবে কি কোনও কারণে বিক্রি করতে পারেনি আজ? না পারুক, কাল নিশ্চয় পারবে- এমনি তাজা চিন্তা বুকে পুরে সে সহজেই সামাল দিল বুকজুড়ে আঁকড়ে ধরা হতাশার চাপ। কাছে আসতেই জোহরা ছুটে গেল স্বামীর কাছে।

ধুলোমাখা জমিরের বিবর্ণ মুখ দেখে কুড়োলের কোপ খেল চোখ। তবু আগত সচ্ছলতার স্বপ্নছায়া হারিয়ে গেল না চোখ থেকে। কোনও প্রশ্ন না করে স্বামীর উদ্দেশে সে বলল, ‘হাতমুখ ধুইয়া আহেন। দুপুরের ভাত রাঁধি রাইখছি, আহেন। আঁই ভাত বারি দি থালায়।’ কোনও শব্দ করল না জমির আলি। নতুনভাবে জেগে ওঠা স্ত্রীর আদুরে আহ্বান ফেলতে পারল না সে। এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে।

হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে জমির আলি নতুনভাবে দেখল জোহরা বেগমকে। মলিন মুখের ত্বক ফুঁড়ে চকচক করে বেরোচ্ছে স্বপ্ন-আলো, ফলবতী স্ত্রীর শস্যভা-ারের উপচে-পড়া শস্যকণার প্রতিও চোখ গেল তার। তবু আনন্দিত হলো না জমির আলির চোখ। বিষাদের মলিন বিলাপ বেরোতে লাগল নেতৃত্বের গুণে অর্জিত সম্মানের নড়বড়ে খুঁটি থেকে। কথবার্তায় তাই বেরোল না মমতার সংগীত। দ্রোহী শব্দের মতো কঠিন আওয়াজ বেরোল জমির আলির মুখ থেকে- ‘এত খুশি খুশি লাগছে কেন তোমারে?’

কথার ধরন জোহরার মনের নরম ভূমিতে আঘাত হানলেও সচেতন স্তর স্পর্শ করল না সেই শব্দের আড়ালের ক্ষোভ। উচ্ছ্বাস কিছুটা দমে গেলেও জোহরা আত্মমগ্ন অবস্থান থেকে কাজ করে গেল রোবটের মতো। চকির তল থেকে সদ্যবোনা শেষ করা বেতের মোড়াটি বের করে স্বামীর উদ্দেশে বলল, ‘বহেন। এহানে বহেন।’

মোড়া দেখে আকস্মিকই দ্রোহীমনের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসল জোছনা, নতুন আশার চুম্বন বসিয়ে দিল তা নিজের হৃৎপিণ্ডে। সমালোচনা না করে ধমক না দিয়ে শীতল গলায় জমির আলি বলল, ‘মোড়ায় বসতে হবে কেন?’

জোহরা বেগম একবার মাত্র চোখ তুলে তাকাল স্বামীর দিকে। এভাবে বিয়ের পর কখনও চোখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী কথা বলেছে বলে মনে পড়ল না। চোখের মধ্যে থেকে ছুটে এল নতুন আকাক্সক্ষার আলো। সেই বিভা কি ছুঁয়ে গেল জমির আলির চোখ?

পোষমানা পাখির মতো অনেকটা উড়ে গিয়ে বসল সে মোড়ায়।

চোখের পলকে জোহরা বেগম বসে পড়ল জমির আলির পায়ের কাছে। কদমবুচি করে তাকাল স্বামীর দিকে।

‘কী কী করছ জোহরা?’

‘কিচ্ছু না। আমাগো গ্রামের নেতারে একবার পা ছুঁইয়া সালাম করলাম আর কি!’

সঙ্গে সঙ্গে মোড়া থেকে নেমে গেল জমির আলি। মাটিতে আসন গেড়ে বসে বলল, ‘না বেবাক ভুয়া। আমি কুনু নেতা না। আমাগো ধোঁকা দিচ্ছে বড় বড় কর্তাবাবুরা। মহাজনরা আমাগো ন্যায্য দর দিবার চায় না। আইজও ফিইরা আইছি আমরা। হেগো যুক্তি হইল ভারত থুন চাইল আমদানির কারণে আমাগো দেশের চাইলের চাহিদা কইমা গ্যাছে। চাতাল মালিকদের গুদামভরা চাইল বেচন হয় না। চাতাল আর মিল মালিকরা নাহি ক্ষতির শিকার হইছে। আমাগো কথা কি আর ভাবব তারা? ভাববো যাগো মাথায় তেল আছে তাগো কথা। এহানে আইসা খালি খালি বুজ দিয়া গেছে আমাগো।’

স্বামীর হতাশা স্পর্শ করল না জোহরা বেগমকে। এবার এ জীবনে যা করেনি তাই করল সে। স্বামীরে ধমক দিয়ে বলল, ‘ওডেন, মোড়ায় বহেন। ভুখানাঙ্গা দরিদ্র চাষাদের নেতা হইছেন আপনি। হেই সম্মান তো আঁ’র মাথার মুকুট। এই মুকুটরে কি মাটিতে রাখবার পারি? ওডেন, বইয়েন মোড়ায়।’

স্ত্রীর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রোবটের মতো মোড়ায় উঠে বসল নতুন নেতা। মনে মনে ভাবল চাষাগো ভুয়া নেতা হইলেও তো বউয়ের চোখে আসল নেতা হবার পারছি। শক্ত করে মোড়ায় বসে নতুন নেতা প্রশাসনের কর্তবাবুদের দুমুখী নীতির গিঁট খুলে দ্রোহ আর ঘৃণার আগুন নিভিয়ে বুকে মমতার নতুন শস্যবীজ রোপণ করে আশায় বুক বেঁধে বউয়ের জন্য অধিষ্ঠিত হলো সত্যিকার নেতার আসনে, জীবনের নতুন মোড়ায়।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

মোড়া

মোহিত কামাল

বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

অহন কী করুম ক

হাতে মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে রোদচশমার ভেতর থেকে গরম চোখে তাকিয়ে মহাজন রহিমুদ্দিন এক পা এগিয়ে ধানবিক্রেতা কৃষক জমির আলির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বলল, ‘কেজিপ্রতি ১২ টাকা পাবে। হিসাব করে যা আছে সব মেপে দাও।’

মহাজনের কথা শুনে জ্যৈষ্ঠের খররোদে পোড়া দেহ থেকে ঘামঝরা বন্ধ হয়ে গেল। ধানের দরপতনের আলমত দেখে জমির আলির বোধের মধ্যে আকস্মিক শুরু হয়ে গেল কালবৈশাখীর তাণ্ডব। ঘূর্ণি উঠল মস্তিষ্কে। চিন্তনধুলোয় আচ্ছন্ন হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। রহিমুদ্দিনের চোখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝল সেখানে আর মানবচোখ বসে নেই, সেই চক্ষুকোঠরে আসন নিয়েছে শকুনচোখ। কিছুক্ষণ বোধশূন্য তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ বুঝল প্রকৃতির বৈরিতার চেয়েও মানুষের অমানবিক বাছ-বিচার আরও বেশি ভয়াবহ, আরও বেশি দানবীয় প্রতিকূল অবস্থা তৈরি করে। ধানের দরের এ প্রতিকূল ছোবলে গরমে পোড়া তামাটে ত্বকের স্তর ভেদ করে দেহে ঢুকে গেল বিষ। বিষদহনে তৃষ্ণা জেগে উঠল। পানি পানের ইচ্ছা হলো প্রকট। তীক্ষ্ণ যাতনা নিয়ে এবার তাকাল রহিমুদ্দিনের হাতে ধরা বোতলের দিকে। কী আশ্চর্য! পানির দিকে তাকিয়েও পানি খাওয়ার ইচ্ছা জাগল না! এক বোতল পানির দাম কত? এমন প্রশ্নই ঝটিত উদয় হলো মনে। আর সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ে গেল, ‘২৫ টাকা!’ এক লিটার পানির দাম মাত্র ২৫ টাকা অর্থাৎ ২ কেজি ধান বেচে এক লিটার পানিও কেনা যাবে না। প্রবল বেগে উষ্ণ নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল বুক ফেটে। ভেতরের তীব্র ক্রন্দনধ্বনি বাতাসের বর্জ্য হিসেবে ছড়িয়ে গেল রহিমুদ্দিনের সামনে। সেই বাতাসও স্পর্শ করল না মহাজনকে। আরও কঠোর অবস্থানে দাঁড়িয়ে বলল, ‘১২ টাকা দরে একমণ ধানের মূল্য দাঁড়ায় ৪৮০ টাকা। মনপ্রতি ত্রিশ টাকা ব্যয় হবে পরিবহনের বাড়তি খরচ আর সড়কের সন্ত্রাসী চাঁদাবাজদের চাঁদা মেটানোর জন্য। সর্বসাকল্যে পাবে মনপ্রতি ৪৫০ টাকা।’

মহাজনের নতুন শব্দবাণে আঘাত খেয়ে এবার কোমর ভেঙে গেল জমির আলির। সোজা অবস্থায় দাঁড়ানো থেকে আচমকা হাঁটু ভেঙে বসে পড়ল মাটিতে। নিজের হাতের দিকে চোখ গেল তার। হাতের তালুতে বসে থাকা গাছের ছাল উঠে যাওয়া দাগের মতো শ্রমের কঠোর চিহ্নের দিকে তাকিয়ে অনুভব করল প্রতিটি ধানের পেছনে জড়িয়ে আছে রক্তধোয়া মমতা। পানির চেয়েও কম মূল্যে ধানক্রেতার প্রস্তাব-ভঙ্গিটাকে মনে হলো রক্তচোষা আক্রমণ। এ আক্রমণ প্রতিহত করে উঠে দাঁড়াতে হবে, বুঝেও উঠে দাঁড়ানোর শক্তি পেল না সে। হাড়ভাঙা শ্রমে সোনা ফলানো ফসলের বোঝা জগদ্দল পাথরের মতো চেপে ধরল তাকে। বোরো ধান চাষে মণপ্রতি উৎপাদনব্যয় প্রায় ৭০০-৭৫০ টাকা। আবার কোনও এলাকায় খরচ ৮৫০ টাকারও বেশি। অথচ তারা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছে ৪৫০-৪৮০ টাকায়। কী অবিচার! কী অবিচার! বিক্ষোভে ফেটে পড়ল কৃষক জমির আলির অন্তর্জগৎ। কেজিপ্রতি ২২ টাকা দরে ধান কেনার ঘোষণা দিয়েছিল সরকার। আশায় বুক বেঁধেছিল নিজে, অন্যান্য প্রান্তিক কৃষকরাও চাষে উৎসাহ পেয়েছিল। অথচ সরকারি ঘোষণার কোনও জোরালো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এই ফাঁকে রহিমুদ্দিনের মতো মধ্যস্বত্বভোগী জোতদাররা ফুলেফেঁপে উঠছে আর মুনাফার দড়িতে কৃষকের গলায় ঝুলিয়ে দিয়েছে ফাঁস! দরের ফাঁস ঝুলন্ত গলায় চেপে ধরার আগেই আকস্মিক ফুঁসে উঠল নিরীহ কৃষক জমির আলি। চিৎকার করে ডাকল একটু দূরে ধানের বস্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মুসাকে। ডাক শুনে কাছে দৌড়ে এসে মুসা প্রশ্ন করল, ‘কী হইছে, জমির?’

‘ধান বেচুম না।। রাস্তায় ছড়াইয়া দিমু সব ধান। তোরা আ’, হগলে একলগে আ’!’

‘ক্যান কী হইছে?’

‘মহাজন কী কয় হুনছ নাই? হে কয়...?’

জমিরকে কথা শেষ করতে দিল না মুসা। সে বলল, ‘হুনলাম সব কথা। হের কাছে ধান বেচুম না। বেবাকরে খবর দিয়ুম। দরকার হইলে নদীতে ভাসায়ে দিমু ধানের বস্তা!’ জমির আলির ভেতরে আগুনঝরা ক্ষোভ ঘৃণায় বদলে গেল, বসা অবস্থা থেকে এক ঝটকায় দাঁড়িয়ে ঘৃণা আর ক্ষোভের উদ্গীরণ ঘটাল একসঙ্গে- মাটিতে থুতু ছিটিয়ে চিৎকার করে আশেপাশে অন্যান্য কৃষকদের উদ্দেশে বলতে লাগল, ‘রাস্তায় ধান ছিটায়ে দে হগলে, গাড়ি আটকা। রাস্তা বন্ধ কইরা দে।’

হাড়ভাঙা পরিশ্রমী জমির আলিকে অনেক আগে থেকেই চেনে মহাজন রহিমুদ্দিন। নিরীহ, নতজানু, আলাভোলা ধরনের এ কৃষকের ভেতর থেকে ক্ষোভ আর ঘৃণার উদ্গীরণ হতে দেখে হতবাক হয়ে গেল সে। আরও হতবাক হলো অন্য চাষিদের আকস্মিক গড়ে ওঠা সংঘবদ্ধতা দেখে। এ এলাকায় কৃষকদের কোনও নেতা ছিল না। নিরীহ কৃষকরা নানা নির্যাতন নিপীড়ন মুখ বুজে সয়ে গেছে দিনের পর দিন। ভেতরে লালিত হতাশা ধীরে ধীরে জমতে জমতে পাহাড়সম হয়েছে। এতদিন অটল পাহাড় সব ঝড়ঝাপটা বুক পেতে হজম করে এলেও, এ মুহূর্তে নিজের আচরণের কারণে টলে গেছে কঠিন পাহাড়তল, বুঝতে পেরে একছুটে পালাতে চেষ্টা করল রহিমুদ্দিন।

মুসা ছুটে গিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে একদলা থুতু ছিটিয়ে দিল রহিমুদ্দিনের পায়ের দিকে। সেও কখনও কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছে বলে কেউ বলতে পারবে না। বরং সবসময় ভয়ে কাবু থাকত রহিমুদ্দিনের মতো অন্যান্য জোতদারের সামনে। আচমকা কী ঘটল নিজেও টের পেল না। নিজের ভেতর কী পরিমাণ শক্তি লুকিয়ে ছিল বুঝতে পারেনি এতদিন। এই শক্তি আর শ্রম ঢেলে তাদের মতো কৃষকরা নিমগ্ন হয়ে চাষ করে কেবল, সেই শ্রমে সোনা ফলে, মাঠে মাঠে দোলা ওঠে সোনালি শস্যের, উঠোনগুলো পাহাড়সম ধানের স্তূপে ভরে ওঠে, কৃষাণীর মুখে হাসি ফোটে- এই ধারার বাইরের জীবনচিত্র জানা ছিল না তাদের।

হঠাৎ নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে মুসা দাঁড়াল জমির আলির পাশে। বড় বড় শ্বাস-প্রশ্বাস এখনও থামেনি। ক্রোধের কারণে দেহের উত্তাপ রোদের উত্তাপকেও ছাপিয়ে গেছে। সেই উত্তাপ নিয়ে জমিরের উদ্দেশে মুসা বলল, ‘অহন কী করুম, ক।’

এরি মধ্যে অন্যান্য কৃষকরাও ওদের পাশে দাঁড়িয়েছে। সবাই বলল, ‘হ’ জমির ক। অহন কী করুম ক।’ সমস্বরে সবাই জমিরের নির্দেশ পালনের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল।

স্বামীর হতাশা স্পর্শ করল না জোহরা বেগমকে। এবার এ জীবনে যা করেনি তাই করল সে। স্বামীরে ধমক দিয়ে বলল, ‘ওডেন, মোড়ায় বহেন। ভুখানাঙ্গা দরিদ্র চাষাদের নেতা হইছেন আপনি। হেই সম্মান তো আঁ’র মাথার মুকুট। এই মুকুটরে কি মাটিতে রাখবার পারি? ওডেন, বইয়েন মোড়ায়।’

দুই ॥ মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের আগমন

দেশের শীর্ষস্থানীয় পত্রিকায় বক্স করে খবর ছাপা হয়েছে- ‘তবুু হাসি নেই কৃষকের মুখে।’ একই সঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে জমির আলির প্রতিবাদের খবর। কৃষকরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারছে না ধান বিক্রি করে, সরকারি মূল্যে ধান সংগ্রহের সুবিধাও পাওয়া যাচ্ছে না, গ্রামে গ্রামে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধানের চাতালসমূহ- খবরে তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে জমির আলিদের থানা প্রশাসনে।

মাছ ধরার জাল নিয়ে খাল পাড়ের দিকে যাচ্ছিল জমির। এমন সময় দেখল বাড়ির দিকে ছুটে আসছে মুসা। তার পেছনে আইল বেয়ে হেঁটে আসছেন একদল মানুষ। পোশাক-পরিচ্ছদ দেখে তাদের গ্রামের মানুষ মনে হলো না। কিছুটা চিন্তিত হয়ে জাল মাটিতে রেখে সে তাকিয়ে রইল ছুটে আসতে থাকা মুসার দিকে।

কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে মুসা বলল, ‘টিএনও স্যার’!, ‘টিনও স্যার’! আর ওসিও আইবার লাগছে। তোর লগে কথা কইবার চায়!’

‘কী কথা? আঁর লগে কী কথা, মুসা?’ ভয় আর বিস্ময়মাখা প্রশ্ন বেরিয়ে এল জমিরের কণ্ঠ থেকে।

‘আমরা তো কুনু দোষ করি নাই, ন্যায্য দর চাইছি, ঠিক দাম চাওয়া তো কুনু দোষ না। কী কয় হেরা দেহি।’

বাড়ির পুকুরপাড়ে ঝাকড়া বাদাম গাছের পশ্চিম পাশে ছায়ায় দাঁড়িয়ে রইল জমির আর মুসা। পূব দিগন্তে সূর্যের নরম রোদ আটকে যাচ্ছে বাদাম গাছের ছড়ানো পাতায়। রোদছায়ার আদুরে ছোঁয়াও কমাতে পারল না তাদের উদ্বেগ। বিস্ময় নিয়ে দুজনে দেখল টিএনতাকে। ওসির দলবহর দেখে আশপাশের বাড়ি থেকে বালকবয়সি থেকে শুরু করে বয়স্করাও বেরিয়ে আসছে বাইরে। দেখতে দেখতে উৎসুক গ্রামবাসী ঘিরে ফেলেছে আগত থানা প্রশাসনের ছোট দলটিকে।

আচমকা ভয়ে জ্বলে-ওঠা শিখার দহনে পুড়ে গেল ভয়। জেগে ওঠা কৃষকদের বুকের চিতা আপন বুকে পুরে নিয়ে বুক ফুলিয়ে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে রইল জমির আলি।

নিরপরাধ, নিরীহ জীবনের শেকড় ছিঁড়ে ক্ষিপ্র সূর্যের তেজ চোখে ধারণ করে প্রশাসনের আগত কর্মকর্তাদের দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে সাদর সম্ভাষণ জানাল জমির।

টিএনও সাহেব এগিয়ে এসে স্বউদ্যোগী হয়ে জমিরের হাত টেনে নিয়ে হ্যান্ডশেক করলেন। এ ধরনের আদব-কায়দায় অনভ্যস্ত জমির প্রথমে কিছুটা নার্ভাস হয়ে গেলেও নির্বাহী কর্মকর্তার মধুর ব্যবহারে বিগলিত হয়ে সালাম জানিয়ে জিগ্যেস করল, ‘স্যার আমরা কি কুনু অপরাধ কইরা ফালাইছি?’

‘না। অপরাধ করবেন কেন? ন্যায্য দাবির কথা বলেছেন। আমাদের ব্যর্থতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, আপনাকে আমরা অভিবাদন জানাতে এসেছি।’

বিরুদ্ধ হাওয়ার ঝাপটা খেল না গ্রামবাসী। অনুকূল বাতাসের জ্যোতির্ময় পরশ পেয়ে কী বলতে হবে, কী করতে হবে না বুঝে সবাই স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছুটা সময় নিয়ে, একদমে মুসা ছুট দিল পুকুর পাড়ের ডাবগাছের দিকে। তর তর করে সে উঠে গেল গাছে। এক ঝাড়ে মোট ৬টি ডাব ঝাড়সহ কেটে দ্রুত দড়ি বেঁধে ঝুলিয়ে দিল নিচে। একদল লেগে গেল ডাব কাটার কাজে।

প্রশাসনের কর্মকর্তাদের হাতে ডাব তুলে দিয়ে নির্বাহী কর্মকর্তার পাশে দাঁড়িয়ে জমির আলি বিনীতভাবে এবার বলল, ‘আমরা গরিব চাষারা এনজিও আর মহাজন গো কাছ থে’ রিন লইয়ারে ধান চাষ করি। আশা মিটে না আমাগো। এক বিঘা জমিনে ধানের চারা লাগানো শুরুকরণের পর থে’ কাটা-মাড়াই আর জমিনের মালিক গো বর্গা দেওন পর্যন্ত খরচ হয় প্রায় ১৪ হাজার টেহা। আর আমাগো ঘামঝরা কাজের বদলায় বিঘাপ্রতি ধান ওডে ১৪-২০ মণ। আমরা বাঁচার পথ পামু যদি ধানের দর মণপ্রতি এক হাজার টাকা ধরা হয়। সরকার যেন হেই ব্যবস্থা লয়। তা নাওলে বউবাচ্চা লই বাঁচার পারমু না আমরা।’

টিএনও সাহেব জমির আলির কথা মন দিয়ে শুনে বললেন, ‘আমরা শাসক নই, আপনাদের সেবক। জমির আলি যা বললেন অবশ্যই মাঠ প্রশাসন থেকে সেই কথা আমরা খাদ্যমন্ত্রণালয়ে তুলে ধরব। আশা করি আপনারা নিরাশ হবেন না। তবে অনুরোধ থাকবে কথায় কথায় হতাশ হয়ে এ এলাকার মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া হাইওয়ে বন্ধ করে দেবেন না।’

মুসা এবার বুক উঁচিয়ে বলল, ‘কেবল উপরে উপরে কথা কইলে আমাগো পেটে ভাত জুটব না। সরকারের ঠিক করা দামে যেন ধান বেচতে পারি, হের দিকে নজর রাখতে হইব আপনাগো। সরকার দাম ঠিক কইরা দিলে হেই দর দিতে চায় না মহাজনরা।’

‘হ।’ ঠিক কথা কইছে মুসা। বর্গাচাষিগো কষ্টের শ্রমে ধানের ফলন ভালা হইছে। ন্যায্য দর না পাইলে আগাম বছর ধান চাষে আমাগো তেজ থাকব না। তহন ক্ষতি হইব দেশের, সরকারের।’ বলল জমির আলি।

এবার ওসি বাহ্বা দিলেন কৃষকদের। জমির আলির সঙ্গে হাত মেলালেন। তার ডান বাহুতে তিনবার চাপড় মেরে বললেন, জমির আলির মতো যোগ্য নেতা থাকতে আপনাদের ভয় নেই। সমস্যার কথা আমরা শুনেছি। নিশ্চয় তা লাঘব হবে।’

অল্প বয়সি এক ছোকরা, অশিক্ষিত সে, নিজের নামটিও দস্তখত দিতে জানে না, এক পা এগিয়ে এসে বলল, ‘আমাগো পেডে তিনবেলা ভাত জুটব তো?’

কঠিন প্রশ্ন। সহজ কথা আর সহজ রইল না। টিএনও সাহেব বাক্ হারিয়ে ফেললেন। ওসি সাহেব মিনমিনে গলায় বললেন, ‘জুটবে। তোমাদের শ্রমই তোমাদের ঘরে ভাত জোটাবে।’

তিন ॥ নতুন আশার আলো

জোহরা বেগমের দীনহীন ঘর আকস্মিক বদলে গেছে বাতিঘরে। সুবাতাস বইছে। স্বস্তি আর প্রশান্তির একটা ঢেউ আন্দোলিত করছে তার মন। শীর্ণ ঘরে নতুন আশার সূর্য জাগছে, আকাক্সক্ষার বীজ রোপিত হচ্ছে- নতুন শস্যদানায় ভরে উঠবে উঠোন, ধানমাড়ানি সংগীতে ভরে থাকবে জোছনারাত। অভাব দূর হবে, সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারবে- শিক্ষার আলোবঞ্চিত জোহরা বেগমের অন্তরধ্বনি থেকে এমনি ভাবনা ছড়িয়ে যাচ্ছে। দুদিন ধরে মগ্ন হয়ে সে বেত দিয়ে বানিয়ে চলেছে একটা মোড়া। বেতের শলার একেকটা প্যাঁচে জড়িয়ে ফেলছে সে জমির আলিকে। ভালোবাসার মানুষটা কীভাবে যেন গ্রামের নেতা বনে গেছে। সবাই সম্মান করছে। সেও স্বামীকে তুলে রাখতে চায় চোখের মণিতে। গুনগুন করে গান গাইছে, গানের তালে হাতের বুননে হৃদয়ের উত্তাপ ঢেলে দিচ্ছে। কঠোর শ্রমের বিনিময়ে দুদিনের চেষ্টায় অবশেষে সে বানিয়ে ফেলেছে মোড়াটি। মহিমার বীজ নতুন করে রোপিত হয়ে গেছে হৃদয়ের খরাভূমে, নিজেও টের পেল না জোহরা।

ঘরের উঠোনে নেমে আইলপথের দিগন্তসীমার দিকে তাকিয়ে জোহারা বুঝল জমির আলি আসছে। স্বপ্নপোড়া চোখ স্ফীত হয়ে উঠল আনন্দজোয়ারে, অনুভবের প্রশ্রয়ে একবার ছুটে গেল সামনে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে আবার ঢুকে গেল ঘরের ভেতর। নিজ হাতে বানানো নতুন মোড়াটি চকির তলে ঠেলে রেখে ফিরে এল আবার। দূরে দৃষ্টি ছুড়ে দিয়ে দেখল প্রিয় স্বামীর হাত শূন্য, হাতে কোনও পোঁটলা নেই। অথচ ফেরার পথে রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে আসার কথা, ধান বিক্রি হওয়ার কথা। তবে কি কোনও কারণে বিক্রি করতে পারেনি আজ? না পারুক, কাল নিশ্চয় পারবে- এমনি তাজা চিন্তা বুকে পুরে সে সহজেই সামাল দিল বুকজুড়ে আঁকড়ে ধরা হতাশার চাপ। কাছে আসতেই জোহরা ছুটে গেল স্বামীর কাছে।

ধুলোমাখা জমিরের বিবর্ণ মুখ দেখে কুড়োলের কোপ খেল চোখ। তবু আগত সচ্ছলতার স্বপ্নছায়া হারিয়ে গেল না চোখ থেকে। কোনও প্রশ্ন না করে স্বামীর উদ্দেশে সে বলল, ‘হাতমুখ ধুইয়া আহেন। দুপুরের ভাত রাঁধি রাইখছি, আহেন। আঁই ভাত বারি দি থালায়।’ কোনও শব্দ করল না জমির আলি। নতুনভাবে জেগে ওঠা স্ত্রীর আদুরে আহ্বান ফেলতে পারল না সে। এগিয়ে গেল পুকুরের দিকে।

হাত-মুখ ধুয়ে ঘরে ঢুকে জমির আলি নতুনভাবে দেখল জোহরা বেগমকে। মলিন মুখের ত্বক ফুঁড়ে চকচক করে বেরোচ্ছে স্বপ্ন-আলো, ফলবতী স্ত্রীর শস্যভা-ারের উপচে-পড়া শস্যকণার প্রতিও চোখ গেল তার। তবু আনন্দিত হলো না জমির আলির চোখ। বিষাদের মলিন বিলাপ বেরোতে লাগল নেতৃত্বের গুণে অর্জিত সম্মানের নড়বড়ে খুঁটি থেকে। কথবার্তায় তাই বেরোল না মমতার সংগীত। দ্রোহী শব্দের মতো কঠিন আওয়াজ বেরোল জমির আলির মুখ থেকে- ‘এত খুশি খুশি লাগছে কেন তোমারে?’

কথার ধরন জোহরার মনের নরম ভূমিতে আঘাত হানলেও সচেতন স্তর স্পর্শ করল না সেই শব্দের আড়ালের ক্ষোভ। উচ্ছ্বাস কিছুটা দমে গেলেও জোহরা আত্মমগ্ন অবস্থান থেকে কাজ করে গেল রোবটের মতো। চকির তল থেকে সদ্যবোনা শেষ করা বেতের মোড়াটি বের করে স্বামীর উদ্দেশে বলল, ‘বহেন। এহানে বহেন।’

মোড়া দেখে আকস্মিকই দ্রোহীমনের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসল জোছনা, নতুন আশার চুম্বন বসিয়ে দিল তা নিজের হৃৎপিণ্ডে। সমালোচনা না করে ধমক না দিয়ে শীতল গলায় জমির আলি বলল, ‘মোড়ায় বসতে হবে কেন?’

জোহরা বেগম একবার মাত্র চোখ তুলে তাকাল স্বামীর দিকে। এভাবে বিয়ের পর কখনও চোখের দিকে তাকিয়ে স্ত্রী কথা বলেছে বলে মনে পড়ল না। চোখের মধ্যে থেকে ছুটে এল নতুন আকাক্সক্ষার আলো। সেই বিভা কি ছুঁয়ে গেল জমির আলির চোখ?

পোষমানা পাখির মতো অনেকটা উড়ে গিয়ে বসল সে মোড়ায়।

চোখের পলকে জোহরা বেগম বসে পড়ল জমির আলির পায়ের কাছে। কদমবুচি করে তাকাল স্বামীর দিকে।

‘কী কী করছ জোহরা?’

‘কিচ্ছু না। আমাগো গ্রামের নেতারে একবার পা ছুঁইয়া সালাম করলাম আর কি!’

সঙ্গে সঙ্গে মোড়া থেকে নেমে গেল জমির আলি। মাটিতে আসন গেড়ে বসে বলল, ‘না বেবাক ভুয়া। আমি কুনু নেতা না। আমাগো ধোঁকা দিচ্ছে বড় বড় কর্তাবাবুরা। মহাজনরা আমাগো ন্যায্য দর দিবার চায় না। আইজও ফিইরা আইছি আমরা। হেগো যুক্তি হইল ভারত থুন চাইল আমদানির কারণে আমাগো দেশের চাইলের চাহিদা কইমা গ্যাছে। চাতাল মালিকদের গুদামভরা চাইল বেচন হয় না। চাতাল আর মিল মালিকরা নাহি ক্ষতির শিকার হইছে। আমাগো কথা কি আর ভাবব তারা? ভাববো যাগো মাথায় তেল আছে তাগো কথা। এহানে আইসা খালি খালি বুজ দিয়া গেছে আমাগো।’

স্বামীর হতাশা স্পর্শ করল না জোহরা বেগমকে। এবার এ জীবনে যা করেনি তাই করল সে। স্বামীরে ধমক দিয়ে বলল, ‘ওডেন, মোড়ায় বহেন। ভুখানাঙ্গা দরিদ্র চাষাদের নেতা হইছেন আপনি। হেই সম্মান তো আঁ’র মাথার মুকুট। এই মুকুটরে কি মাটিতে রাখবার পারি? ওডেন, বইয়েন মোড়ায়।’

স্ত্রীর মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রোবটের মতো মোড়ায় উঠে বসল নতুন নেতা। মনে মনে ভাবল চাষাগো ভুয়া নেতা হইলেও তো বউয়ের চোখে আসল নেতা হবার পারছি। শক্ত করে মোড়ায় বসে নতুন নেতা প্রশাসনের কর্তবাবুদের দুমুখী নীতির গিঁট খুলে দ্রোহ আর ঘৃণার আগুন নিভিয়ে বুকে মমতার নতুন শস্যবীজ রোপণ করে আশায় বুক বেঁধে বউয়ের জন্য অধিষ্ঠিত হলো সত্যিকার নেতার আসনে, জীবনের নতুন মোড়ায়।

back to top