alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ৯

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

: বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

একটি প্রাসঙ্গিক ব্যাপার, যদিও এই স্মৃতিচারণের সাথে সরাসরি জড়িত কোনো বিষয় নয় তবুও উল্লেখ না করে পারছি না, আর সেটি হলো মুদ্রণ প্রমাদ। প্রায় প্রতিটি কিস্তিতেই দু’চারটি কিম্বা তার অধিক মুদ্রণ প্রমাদ রয়েই যাচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশে মুদ্রণ প্রমাদ বা “টাইপো”-র সাথে আমরা কমবেশি সমঝোতা করেই চলি, কিন্তু আমি ভেবে দেখেছি এই প্রমাদের অধিকাংশই ঘটে কম্পুটারে বাংলা কম্পোজের প্রযুক্তিগত অসঙ্গতির কারণে। এক কম্পুটারে বাংলা কিছু টাইপ করে অন্য কোনো কম্পুটারে তা স্থানান্তিরত করলেই অনেক কিছু ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়- বিশেষ করে যুক্তাক্ষর এবং যদি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা কোনো শব্দ থেকে থাকে। এর আরও একটি অন্যতম কারণ আমি আমার কম্পুটার/ল্যাপটপে অভ্র ব্যবহার করি, যেটি আমার জন্য ব্যবহার-বান্ধব, কিন্তু যখন অন্য কাউকে ওটা মেইল করি অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ঠিক থাকে না। সাথে অবশ্য “পিডিএফ” কপিও পাঠাই, কিন্তু সেটা মুদ্রণের জন্য ব্যবহার করা যায় না, মুদ্রণের জন্য “ফরম্যাটিং” করতে হয়, এবং সেটি শুধু ওয়ার্ড ফাইলে করাই সম্ভব। অবশ্য একথাও স্বীকার করি, আমি বাংলা বানানে বড়ই দুর্বল- আর সবটাই মুদ্রণ প্রমাদের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করাটা বোধ হয় ন্যায্য হবে না।

যাই হোক, গত কিস্তির শেষ বাক্যটি ছিল ‘তবে হলের আখ্যান এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।’ আর এই ‘আরও আছে’ থেকেই শুরু করি আজ।

আমার সময়ে যেসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আবাসিক সংস্পর্শ পেয়েছিলাম তাদের কথা বলি এবার- যদিও বলতে বাধা নেই দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পার করে- ষাট বছর- স্মৃতি কতটা প্রখর ও নির্ভরযোগ্য আছে আমি নিশ্চিত নই।

বয়োজ্যেষ্ঠদের ভেতর যাদের কথা মনে পড়ছে তাঁরা হলেন ড. আকবর আলি খান, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (যতদূর মনে পড়ে উনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপন করেছেন), আইয়ুব কাদরী, সাইফুল ইসলাম খান, তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী এবং এমন আরও অনেক যারা জাতীয় ভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব। আমরা তো জানি ড. আকবর আলি খান-এর মতো জ্ঞানী, শিক্ষিত, রুচিবান এবং সুনাগরিক বাংলাদেশে খুব কমই জন্মেছে। তিনি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়েও বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান এক ইতিহাস; বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি একাধিক উচ্চপদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এসব তথ্য উইকিপিডিয়া-তে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু যেটা নেই সেটা বলি।

সলিমুল্লাহ হলে উনিও ঈস্ট হাউসে (তখন এবং সম্ভবত এখনও দুটি উইং-এর নামকরণ ছিল ইস্ট এবং ওয়েস্ট হাউস) থাকতেন- আমিও থাকতাম। আগেই বলেছি দুটি হাউসের মাঝখানে বেশ বড়সড় বর্গাকৃতি বাগানসহ লন ছিল। এই লনে আমরা অনেক সময়েই ছুটির দিনে (রবিবারে) সকালে-বিশেষ করে শীতকালের রোদ পোহাবার জন্য- এবং অন্যান্যদিনে বিকেলে আড্ডা দিতাম। সেই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম আকবর আলি খান গম্ভীর পাইচারি করতেন বিকেলে। আমি উনাকে যতটা দেখেছি বাইরে থেকে তাতে মনে হয়েছে উনি অত্যন্ত গম্ভীর এবং “সেরিয়াস” ধরনের মানুষ। কিন্তু পরে উনার বক্তৃতা, আলোচনা এবং সর্বোপরি তার লেখা গ্রন্থ বিশেষ করে চাবিকাঠির খোঁজে নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, পুরানো সেই দিনের কথা, অন্ধকারের উৎস হতে- এমন কিছু বই পড়ে মনে হয়েছে প্রায় চার হাজার বছর আগে ইউরেপিডিস তার সাহসী নারী চরিত্র মেডিয়াকে দিয়ে যে কথা বলিয়েছেন তা চিরসত্য: ‘মানুষকে চোখ দিয়ে দেখাটা আসল দেখা নয়। একজনকে ভালভাবে না জেনে শুধু চোখের দেখাতে বিচার করলে কেবল ভুলই হয় না, তার প্রতি অবিচারও করা হয়।’

আমি ভুল করেছিলাম। উনাকে আমার ঐ অপরিণত বয়সে হলের লনে প্রতিদিন গম্ভীর পাইচারি করতে দেখে একবার আমি আমার এক ‘ব্যাচমেট’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা, এই যে ভদ্রলোক প্রতিদিন গম্ভীরভাবে সক্রেটিস-এর মতো পায়চারি করেন, ইনি আসলে কে, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করেন?” উত্তরে বন্ধু যা বলেছিলো তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম, “উনি হলেন আকবর আলি খান, ইতিহাসের সেরা ছাত্র। অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবেন নির্ঘাত। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগিতাতে প্রথম হয়েছেন।” এই হলেন আকবর আলি খান যিনি ২০০৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আমি হলে সেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়েনা; তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি একাধিকবার। অবশ্য উনাকে আমি দু’তিনবার বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘মিট’ করেছি। যদিও আমি বেশকিছু সময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছি, উনার সাথে আমার সাক্ষাৎ তার অনেক পরে যখন আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ-এর ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করতাম। তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বেশ কয়েকবার কলেজের ইংরেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল- সম্ভবত ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার আগের সম্পর্কের কারণে। তো এমন দু’তিনটি প্রশিক্ষণ কর্মশালাতে আমার সাথে ড. ফরাসউদ্দিন-এর পরিচয় হয়, এবং তখনই জেনেছিলাম উনি সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছিলেন। ড. ফরাসউদ্দিন একজন নিপাট, অমায়িক ভদ্রলোক। আমি উনার অনেক ছোট- উনি যে বছর অর্থনীতিতে এম. এ. করেছেন আমি সেই বছর ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হই। ঐ কর্মশালাগুলোতে (উনিও অর্থনীতির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে যেতেন) চা পান, এবং দুপুরের খাবারের ব্রেকে আমার সাথে যতবার উনার দেখা হয়েছে উনি বন্ধুর মতো আলাপচারিতা করেছেন। আমরা তো জানি উনি ১৯৭৩-৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব, ১৯৯৮-২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবেই শুধু কাজ করেননি, দীর্ঘদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য (১৯৯৫-৯৮) হিসেবেও কাজ করেছেন।

আইয়ুব কাদরী সম্মন্ধে আমি আগের কিস্তিতে কিছুটা লিখেছি। শুধু এটুকু বলি, উনি যখন সচিব ছিলেন (সঠিক সালটা মনে নেই) উনার ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে আমার ছোট শ্যালক নিযুক্ত ছিল- যে বর্তমানে নিজেই বাংলাদেশ সরকারের সিভিল অ্যাভিয়েশনের সচিব পদে অধিষ্ঠিত- সে সময়ে আইয়ুব কাদরী-পুত্র নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আমার ছাত্র বিধায় উনি আমাকে বেশ সম্মান করতেন।

সাইফুল ইসলাম খান, ইস্ট হাউসের দোতালাতে থাকতেন। উনি ইংরেজিতেই পড়তেন যদিও আমার দুবছরের বড় ছিলেন। লম্বা ছিপছিপে সাইফুল ইসলাম খান কবিতা লিখতেন হায়াৎ সাইফ নামে। উনার পিতা মোসলেম উদ্দিন খান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। উনার সাথে প্রথম ঘনিষ্ঠতা সাদুল্লাহ-র, পরে আমার সাথে। দারুণ আমুদে মানুষ ছিলেন- প্রচুর জোক বলতে পারতেন যার অধিকাংশই যৌন বিষয়াদি সম্মন্ধীয়- রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান উনি প্যারোডি করেছিলেন- যা ঐ বয়সে শুনে- জোক এবং প্যারোডি- যারপরনাই মজা পেতাম। উনি ছোট-বড় সবার সাথে সহজে মিশতে পারতেন, যাকে ইংরেজিতে বলা যায়—ধ ঢ়ষবধংধহঃ ঢ়বৎংড়হধষরঃু— তিনি ছিলেন ঠিক তাই। হায়াৎ সাইফ নামে বাংলা কবিতা লেখাতে তার বেশ খ্যাতি ছিল তখনই। পত্র-পত্রিকাতে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো, যদিও ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন- বিখ্যাত বাঙালি ইংরেজ বা ইংরেজ বাঙালি, আমাদের ইংরেজি বিভাগ প্রধান- হায়াৎ সাইফ-এর এই কবিতা লেখা এবং খ্যাতি কখনই ভাল চোখে দেখেননি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। যদিও সাইফুল ইসলাম খান ট্যক্সেশন সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন, কবিতা চর্চা থেকে বিরত হননি কখনও এবং ২০১৮ সালে ভাষা ও সাহিত্যে তিনি একুশে পদক পান।

সাইফুল ইসলাম খান বা হায়াৎ সাইফ সম্মন্ধে আরও একটু কিছু বলা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ১৯৭২ সালে আমার বিয়ের পর আমি জানতে পারি সাইফুল ইসলাম খান-এর সাথে যে মহিলার বিয়ে হয়েছে সেই মহিলা আমার স্ত্রীর স্কুল-কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সেই বন্ধুত্বের বন্ধন এখনও অটুট আছে। তাদের এই বন্ধুত্বের কারণে আমাদের দুই পরিবারের ভেতর বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি ২০১৯ সালে সাইফুল ইসলাম খান ইহলোক ত্যাগ করেন।

তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী সম্মন্ধে আগেই লিখেছি- উনি নওগাঁ কে ডি স্কুলে আমার বড় ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। আমার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে দ্রুত আবাস পাবার ব্যাপারে উনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হবার পর ব্যস্ততার কারণে তাঁর সেসব শৈশব এবং ছাত্রজীবন স্মৃতি মনে আছে কিনা জানি না। উনি অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র ছিলেন, তবে সলিমুল্লাহ হলে থাকাকালে কী কারণে যেন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন করতেন, এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ১৯৭১ সালে যখন চুয়াডাঙ্গার মহাকুমা কর্মকর্তা ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেন। তাঁর এই ‘মেটামরফসিস’ আমাকে চমৎকৃত করেছে, গর্বিত করেছে।

তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর সাথে আরও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে আমার মনে পড়ছে। তিনি হলেন আব্দুল্লাহ- যার পুরো নাম আমি মনে করতে পারছি না। উনিও তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর সহপাঠি ছিলেন অর্থনীতি বিভাগে। আব্দুল্লাহ ছিলেন, শুনেছি, বিখ্যাত অভিনেতা, সুবর্ণা মুস্তাফার পিতা গোলাম মুস্তাফার ভ্রাতা। আব্দুল্লাহ ছিলেন আসাধারণ পড়ুয়া, শিল্প-সাহিত্য সচেতন মানুষ। উনি আমাদের হলের শিল্পসংস্কৃতি সপ্তাহে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন- উনাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বই হাতে দেখতাম। ফলে তাঁর চোখে মোটা লেন্সের চশমা লাগানো থাকতো এবং উনি বই পড়তেন চোখের এক ইঞ্চি দূর থেকে এবং ফাঁকেফাঁকে বইটি নাক দিয়ে শুঁকতেন। আমরা এটা দেখে বলাবলি করতাম আব্দুল্লাহ ভাই নাক দিয়ে শুঁকেই বলে দিতে পারতেন কোন বই উনার পড়া আর কোনটা পড়া নয়। আমার মনে আছে ১৯৬২ সালে নোবেল বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক-এর বিখ্যাত উপন্যাস- যে উপন্যাস ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড ও পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল এবং তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো, সেই দ্যা গ্রেইপস অফ রথ উপন্যাসটি হাতে করে ঐভাবে নাকে শুঁকে হলময় পড়ে বেড়াতেন। পরে উনার মুখে সাহিত্য নিয়ে অনেক বক্তৃতা আমি শুনে ভাবতাম উনি কেন অর্থনীতি পড়ছেন, উনার আসলে সাহিত্য পড়াটাই ঠিক ছিল। আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে জেনেছি উনি অর্থনীতিতে বিদেশে (সম্ভবত যুক্তরাজ্যে) কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে বিদেশেই স্থায়ী হয়েছেন। সত্যমিথ্যা জানি না।

আমি জানি আমি আরও অনেক মহান মানুষের কথা মনে করতে পারছি না। কিন্তু কথা দিচ্ছি যখনি মনে পড়বে আমি তা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করবো। এবার হলের আরও কিছু কথা ভুলে যাবার আগেই বলে ফেলি।

প্রথমেই মনে পড়ছে হলের সেই দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ সুপুরুষ নাজু-র কথা, নাজু ছিলো আমাদের মুসলিম হলের সার্বক্ষণিক প্রহরী। এমন ঐচিত্য চরিত্রের প্রহরী আমার এই সাতাত্তুর বছর বয়সের জীবনে যে আর দেখিনি তা হলফ করে বলতে পারি। এই মানুষটি বাঙালি ছিল না- পাঠান বংশোদ্ভূত- বহুদিন বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) থাকার কারণে উর্দু-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতো, কুর্তা-পাজামা পরতো, অনেক সময় মাথায় পাগড়ি বাঁধতো। এই পাগড়ি বিষয়টি তার ‘স্পেসালিটি’ ছিলো। প্রায়ই দেখতাব হলের সামনে খোলা বারান্দাতে বসে সে বিভিন্ন রঙের পাগড়ি বানাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম হলের কোনো প্রাক্তন ছাত্রের বিয়ের পাগড়ি বানানো হচ্ছে। পাগড়িগুলো এত সুদর্শন ও রঙিন হতো বলার নয়। ভেবে রেখেছিলাম আমিও আমার বিয়ের সময় অমন পাগড়ি বানিয়ে নেবো নাজুর কাছ থেকে। কিন্তু আমি বিয়ে করেছি ১৯৭২-এ, যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে নয় মাস যুদ্ধের পর। নাজু তখন জীবিত না মৃত, অথবা পলাতক, আমার জানা ছিল না। নাজুকে আমি সারা জীবনেও ভুলবো না।

ডাইনিং হলে একজন বিশ কি বাইশ বছরের তরুণ আমাদের (অন্যান্য আরও অনেকের সাথে) খাবার পরিবেশন করতো যার নাম ছিল সুরুজ, অন্তত আমরা তাকে সেই নামেই চিনতাম। এই তরুণও এক স্মৃতি আমার জীবনে। সুরুজ অমানুষিক কাজ করতো সকাল সন্ধ্যা, সেই বেলা বারোটা থেকে রাত দশ/এগারোটা পর্যন্ত- দিন বারোটার আগে রান্নাঘর, ডাইনিং ঘর, খাবার টেবিল ইত্যাদি পরিষ্কার এবং প্রস্তুত তো ছিলোই। কিন্তু সুরুজের মুখে সদাই একটুকরো হাসি লেগেই থাকতো। আমরা যারা বেলা করে খেতাম সুরুজকে বলে রাখতাম সেই মুরগির চ্যাপ্টা রান আমাদের জন্য সরিয়ে রাখতে। অনেক সময়ই ও সেটা করতে পারতো না- যার কারণ আগের কিস্তিতে বলেছি। তখন ও অনেক সময়ই বুদ্ধি দিতো ডিমভাজি করে দেবার। ডিম কাছাকাছি কোনও দোকান বা সামনে হলের ক্যান্টিন থেকে কিনে আনতো আমরা পয়সা দিলে, আর ও সুন্দর করে অনেক পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে দিত। ভাতের সাথে সেই তরল পোকাপড়া ডাল মাখিয়ে ডিমভাজি খেতে অমৃত লাগতো।

আর একজন ছিল সিদ্দিক। নোয়াখালি বাড়ি- সে শত চেষ্টা করেও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতো না- নোয়াখালির টান থেকেই যেতো তাঁর সাথে ইংরেজি শব্দ বা বাক্যের মিশেল। সিদ্দিক-এর একটা লক্কড়-ঝক্কড় সাইকেল ছিলো যার পেছনে একটা বেশ বড়সড় কেরিয়ার ছিলো। এই কেরিয়ারে করে সে পাহাড়সম স্তূপাকারে বিভিন্ন বই, পত্রিকা, ম্যগাজিন নিয়ে হলেহলে ঘুরতো ফেরি করার জন্য। বিশেষ করে রবিবার ছুটির দিনে।

সিদ্দিক খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিলো। ও জানতো আমাদের মতো উঠতি বয়সী তরুণদের যৌন বিষয়ের কৌতূহল কতোটা তীব্র হতে পারে, বিশেষ করে আমাদের‘ট্যাবু’ আক্রান্ত সমাজে। ফলে ও যেমন ভাল ভাল ইংরেজি বাংলা উপন্যাস, প্রবন্ধের বই (তার কাছ থেকে কেনা বার্ট্রান্ড রাসেল-এর চার খণ্ডের আত্মজীবনী এবং সমার সেট মম-এর রচনা সমগ্র আমার শেলফে এখনও দেখতে পাচ্ছি), পত্রিকা, ম্যাগাজিন আনতো তেমনি ছোট চটি বাংলা ‘পোর্ণ’-ও আনতো। আমরা অবশ্য বাংলা চটিপোর্ণ পড়ে হতাশ হয়ে ইংরেজি কিছু উপন্যাস সংগ্রহ করতে শুরু করি- যার ভেতর ছিলো ‘ঋধহহু ঐরষষ’ (গবসড়রৎং ড়ভ ধ ডড়সধহ ড়ভ চষবধংঁৎব), ‘অভঃবৎ গরফহরমযঃ ঝপযড়ষধৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধহপবৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধঢ়ৎরপড়ৎহ’ জাতীয় রগরগে উপন্যাসের প্রতি। এরই সাথে ছিল বাংলাতে প্রকাশিত একটি মাসিক যৌনশিক্ষা পত্রিকা “নরনারী”। এ পত্রিকাটি আসলে যৌনশিক্ষার জন্য অনেক দিক দিয়েই ভাল ছিলো যদিও আমরা সেই সময় এটিকে ‘পোর্ণ’- বলে কিনতাম এবং পড়তাম। এই পত্রিকাটি নিয়ে মোহাম্মদ জমীর আলী এবং হায়াত হোসেন-এর ভেতর এক ধরনের ঠা-াযুদ্ধ প্রায়ই লেগে থাকতো। না, জমীর আলী এ পত্রিকা আপাতদৃষ্টে পড়তো না- আপাতদৃষ্টে বলছি কারণ আমার অভিজ্ঞতা বলে ‘আপাতদৃষ্টে’ অনেককেই ভাজামাছ উল্টে খেতে জানে না বা স্বাত্ত্বিক মনে হলেও সময়ে ও পরিস্থিতিতে গোপনে তারা অনেক কিছুই করতে সক্ষম। সে অভিজ্ঞতা এই হল থেকেই প্রাপ্ত।

আমি সিদ্দিকের কাছ থেকে অনেক বই কিনেছি যা, আগেই বলেছি, এখনও আমার বইয়ের সেলফে রাখা আছে। তবে ‘ঋধহহু ঐরষষ’ (গবসড়রৎং ড়ভ ধ ডড়সধহ ড়ভ চষবধংঁৎব), ‘অভঃবৎ গরফহরমযঃ ঝপযড়ষধৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধহপবৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধঢ়ৎরপড়ৎহ’ জাতীয় বইগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে কারণ আমরা যারা হলে থাকতাম তাদের মধ্যে যারা এমন বই একটি কিনতো সেটি একজনের পর একজন পড়ার জন্য নিতো এবং হাত ফিরে ফিরে শেষ পর্যন্ত কার কাছে পৌঁছাতো তার কোনো হদিস থাকতো না। আমাদের যুগে এটিই ছিল আমাদের উঠতি যৌনচেতনার খোরাক, যদিও পরিস্থিতি আগের চাইতে উন্নত হয়েছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে আমরা প্রথম চষধুনড়ু পত্রিকার হদিস পাই, এবং এরপর স্টিল ছবিতে রতিকর্ম দেখার সুযোগ হয়। পোর্ণ চলচ্চিত্র তো আরও অনেক পরের কথা।

সিদ্দিক-এর কি হয়েছে আমি জানি না। শুনেছি মারা গেছে- কীভাবে তাও জানি না। কিন্তু তার কাছ থেকে কেনা বইগুলো যখন দেখি তখন প্রকৃতই স্মৃতিবিধূর হই, চোখ অশ্রুসজল হয়।

আরও একজন যার কথা ভুলবার নয়, যার সাথে আমাদের হল আবাসিকদের সকলেরই নিজেদের প্রয়োজনেই সখ্য ছিল। নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ও ছিলো অবাঙালি- বলা যায় বিহারি। বাচ্চা ছেলে- বারো/চৌদ্দ বছরের হবে- আমাদের জুতো কালি করতে আসতো। রুমের সামনে এসে চেঁচাতো: পালিশ, জুতা পালিশ! বিশেষ করে রবিবার, ছুটির দিন ভোরসকালে। ছেলেটা ভীষণ স্মার্ট ছিল। সম্ভবত ওর সাথে ওর এক ছোট ভাইও মাঝেমধ্যে আসতো। দুজনই ভীষণ কৃষ্ণবর্ণ এবং কৃশকায়। আমরা ওকে খুব বেশি হলে দু’আনা দিতাম, ও খুশি হতো কিন্তু বলতো: আপনাদের জুতা কালি করে লাভ নাই। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম: তাহলে এখানে আসিস ক্যান? উত্তরে একগাল হেসে বলেছিল: আপনাদের এখানে আসতে খুব ভাল লাগে, আপনারা যে পড়াশোনা করেন। একজন সম্পূর্ণ আনপড় বাচ্চাছেলের কাছ থেকে একথা শুনে আমি এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজের রূপ দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম বৈ কি! ছেলেটা আর একদিন একটা গল্প বলেছিলো যে গল্পটা আমি এখনও আমার ক্লাসে বলি ঈড়সসঁহরপধঃরাব ঝশরষষ-এর উদাহরণ হিসেবে। ও বলেছিলো প্রতি বিকেলে ও ন্যু মার্কেটে জুতা পালিশ করতে যায়, বিশেষ করে বিদেশি খদ্দের ধরারা জন্যে। আমি জানতে চাইলাম ও তো ইংরেজি জানে না তাহলে কীভাবে খদ্দের ধরে। ও বললো খুব সোজা। আমি ওদের কাছে যেয়ে বলি: শু শেইন, শু শেইন? ওরা বলে, হা মাস, হা মাস? আমি তখন দুই আঙ্গুল দেখায়ে বলি রুপিস। অর্থাৎ দুই টাকা। ব্যাস এভাবেই কম্যুনিকেশন সম্পূর্ণ। জীবিকার অন্বেষণে কী অসাধারণ পড়সসঁহরপধঃরাব ংশরষষ!

মুসলিম হলের কেচ্ছা আরও আছে- বিশেষ করে আমার সহপাঠী ও ব্যাচমেটদের নিয়ে। সেটা আগামী কিস্তিতে আবার বর্ণিত হবে। তবে নাজু, সুরুজ, সিদ্দিক আর ঐ জুতা পালিশ করা বিহারি ছেলেটা আমার স্মৃতির অতল তলে কখনোই সমাহিত যাবে না- সদা জাগরুক থাকবে। আমি জানি না তারা কোথায়- ইহকালে না পরকালে- কিন্তু তারা যেখানেই থাকুক আমি মনেপ্রাণে চাই তারা ভাল থাকুক কারণ তারা প্রত্যেকে আমার হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতোই আমার ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে- জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে। ২০১৭ সালে প্রয়াত রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়াভতোশেঙ্কুর ঠিক এমনই বক্তব্য সম্বলিত একটি কবিতার ক’টি চরণ মনে উঠে আসছে: আমি শুধু অত্যুজ্জ্বল ফ্রেমে বাঁধা মানুষদের/কাছ থেকেই আমার শিক্ষা নিই নি,/বিবর্ণ পরিচয়হীন মানুষরাও/আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।/... তোমাদেরকে আমার কিছুই শেখাবার নেই।/তোমাদের কাছেই শিখতে চাই আমি। (“আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো”; কবিতাটি আবদুস সেলিম কর্তৃক অনূদিত)।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ৯

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

বুধবার, ২৩ আগস্ট ২০২৩

(পূর্ব প্রকাশের পর)

একটি প্রাসঙ্গিক ব্যাপার, যদিও এই স্মৃতিচারণের সাথে সরাসরি জড়িত কোনো বিষয় নয় তবুও উল্লেখ না করে পারছি না, আর সেটি হলো মুদ্রণ প্রমাদ। প্রায় প্রতিটি কিস্তিতেই দু’চারটি কিম্বা তার অধিক মুদ্রণ প্রমাদ রয়েই যাচ্ছে। অবশ্য বাংলাদেশে মুদ্রণ প্রমাদ বা “টাইপো”-র সাথে আমরা কমবেশি সমঝোতা করেই চলি, কিন্তু আমি ভেবে দেখেছি এই প্রমাদের অধিকাংশই ঘটে কম্পুটারে বাংলা কম্পোজের প্রযুক্তিগত অসঙ্গতির কারণে। এক কম্পুটারে বাংলা কিছু টাইপ করে অন্য কোনো কম্পুটারে তা স্থানান্তিরত করলেই অনেক কিছু ভেঙেচুরে একাকার হয়ে যায়- বিশেষ করে যুক্তাক্ষর এবং যদি বাংলার পাশাপাশি ইংরেজিতে লেখা কোনো শব্দ থেকে থাকে। এর আরও একটি অন্যতম কারণ আমি আমার কম্পুটার/ল্যাপটপে অভ্র ব্যবহার করি, যেটি আমার জন্য ব্যবহার-বান্ধব, কিন্তু যখন অন্য কাউকে ওটা মেইল করি অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ঠিক থাকে না। সাথে অবশ্য “পিডিএফ” কপিও পাঠাই, কিন্তু সেটা মুদ্রণের জন্য ব্যবহার করা যায় না, মুদ্রণের জন্য “ফরম্যাটিং” করতে হয়, এবং সেটি শুধু ওয়ার্ড ফাইলে করাই সম্ভব। অবশ্য একথাও স্বীকার করি, আমি বাংলা বানানে বড়ই দুর্বল- আর সবটাই মুদ্রণ প্রমাদের ঘাড়ে চাপাবার চেষ্টা করাটা বোধ হয় ন্যায্য হবে না।

যাই হোক, গত কিস্তির শেষ বাক্যটি ছিল ‘তবে হলের আখ্যান এখানেই শেষ নয়, আরও আছে।’ আর এই ‘আরও আছে’ থেকেই শুরু করি আজ।

আমার সময়ে যেসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের সাথে আমি সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আবাসিক সংস্পর্শ পেয়েছিলাম তাদের কথা বলি এবার- যদিও বলতে বাধা নেই দীর্ঘ অর্ধশতাব্দীরও বেশি সময় পার করে- ষাট বছর- স্মৃতি কতটা প্রখর ও নির্ভরযোগ্য আছে আমি নিশ্চিত নই।

বয়োজ্যেষ্ঠদের ভেতর যাদের কথা মনে পড়ছে তাঁরা হলেন ড. আকবর আলি খান, ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন (যতদূর মনে পড়ে উনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা সমাপন করেছেন), আইয়ুব কাদরী, সাইফুল ইসলাম খান, তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী এবং এমন আরও অনেক যারা জাতীয় ভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব। আমরা তো জানি ড. আকবর আলি খান-এর মতো জ্ঞানী, শিক্ষিত, রুচিবান এবং সুনাগরিক বাংলাদেশে খুব কমই জন্মেছে। তিনি ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন কিন্তু পরবর্তীকালে অর্থনীতিতে পিএইচডি করেছেন। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সদস্য হয়েও বঙ্গবন্ধুর ডাকে ১৯৭১ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন; মুক্তিযুদ্ধে তাঁর অবদান এক ইতিহাস; বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর তিনি একাধিক উচ্চপদের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। এসব তথ্য উইকিপিডিয়া-তে লিপিবদ্ধ আছে, কিন্তু যেটা নেই সেটা বলি।

সলিমুল্লাহ হলে উনিও ঈস্ট হাউসে (তখন এবং সম্ভবত এখনও দুটি উইং-এর নামকরণ ছিল ইস্ট এবং ওয়েস্ট হাউস) থাকতেন- আমিও থাকতাম। আগেই বলেছি দুটি হাউসের মাঝখানে বেশ বড়সড় বর্গাকৃতি বাগানসহ লন ছিল। এই লনে আমরা অনেক সময়েই ছুটির দিনে (রবিবারে) সকালে-বিশেষ করে শীতকালের রোদ পোহাবার জন্য- এবং অন্যান্যদিনে বিকেলে আড্ডা দিতাম। সেই সময়ে প্রায় প্রতিদিনই দেখতাম আকবর আলি খান গম্ভীর পাইচারি করতেন বিকেলে। আমি উনাকে যতটা দেখেছি বাইরে থেকে তাতে মনে হয়েছে উনি অত্যন্ত গম্ভীর এবং “সেরিয়াস” ধরনের মানুষ। কিন্তু পরে উনার বক্তৃতা, আলোচনা এবং সর্বোপরি তার লেখা গ্রন্থ বিশেষ করে চাবিকাঠির খোঁজে নতুন আলোকে জীবনানন্দের ‘বনলতা সেন’, পুরানো সেই দিনের কথা, অন্ধকারের উৎস হতে- এমন কিছু বই পড়ে মনে হয়েছে প্রায় চার হাজার বছর আগে ইউরেপিডিস তার সাহসী নারী চরিত্র মেডিয়াকে দিয়ে যে কথা বলিয়েছেন তা চিরসত্য: ‘মানুষকে চোখ দিয়ে দেখাটা আসল দেখা নয়। একজনকে ভালভাবে না জেনে শুধু চোখের দেখাতে বিচার করলে কেবল ভুলই হয় না, তার প্রতি অবিচারও করা হয়।’

আমি ভুল করেছিলাম। উনাকে আমার ঐ অপরিণত বয়সে হলের লনে প্রতিদিন গম্ভীর পাইচারি করতে দেখে একবার আমি আমার এক ‘ব্যাচমেট’কে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আচ্ছা, এই যে ভদ্রলোক প্রতিদিন গম্ভীরভাবে সক্রেটিস-এর মতো পায়চারি করেন, ইনি আসলে কে, কোন বিষয়ে পড়াশোনা করেন?” উত্তরে বন্ধু যা বলেছিলো তাতে আমার আক্কেল গুড়ুম, “উনি হলেন আকবর আলি খান, ইতিহাসের সেরা ছাত্র। অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবেন নির্ঘাত। সম্প্রতি একটি আন্তর্জাতিক রচনা প্রতিযোগিতাতে প্রথম হয়েছেন।” এই হলেন আকবর আলি খান যিনি ২০০৬ সালে বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন।

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে আমি হলে সেভাবে দেখেছি বলে মনে পড়েনা; তবে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি একাধিকবার। অবশ্য উনাকে আমি দু’তিনবার বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে, ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘মিট’ করেছি। যদিও আমি বেশকিছু সময় উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা শিক্ষাদান উপদেষ্টা হিসাবে কাজ করেছি, উনার সাথে আমার সাক্ষাৎ তার অনেক পরে যখন আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নর্থ সাউথ-এর ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা করতাম। তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে বেশ কয়েকবার কলেজের ইংরেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষক হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল- সম্ভবত ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে আমার আগের সম্পর্কের কারণে। তো এমন দু’তিনটি প্রশিক্ষণ কর্মশালাতে আমার সাথে ড. ফরাসউদ্দিন-এর পরিচয় হয়, এবং তখনই জেনেছিলাম উনি সলিমুল্লাহ হলের আবাসিক ছিলেন। ড. ফরাসউদ্দিন একজন নিপাট, অমায়িক ভদ্রলোক। আমি উনার অনেক ছোট- উনি যে বছর অর্থনীতিতে এম. এ. করেছেন আমি সেই বছর ইংরেজি অনার্সে ভর্তি হই। ঐ কর্মশালাগুলোতে (উনিও অর্থনীতির শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ক্লাস নিতে যেতেন) চা পান, এবং দুপুরের খাবারের ব্রেকে আমার সাথে যতবার উনার দেখা হয়েছে উনি বন্ধুর মতো আলাপচারিতা করেছেন। আমরা তো জানি উনি ১৯৭৩-৭৫ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সচিব, ১৯৯৮-২০০১ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবেই শুধু কাজ করেননি, দীর্ঘদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য (১৯৯৫-৯৮) হিসেবেও কাজ করেছেন।

আইয়ুব কাদরী সম্মন্ধে আমি আগের কিস্তিতে কিছুটা লিখেছি। শুধু এটুকু বলি, উনি যখন সচিব ছিলেন (সঠিক সালটা মনে নেই) উনার ব্যক্তিগত সচিব হিসাবে আমার ছোট শ্যালক নিযুক্ত ছিল- যে বর্তমানে নিজেই বাংলাদেশ সরকারের সিভিল অ্যাভিয়েশনের সচিব পদে অধিষ্ঠিত- সে সময়ে আইয়ুব কাদরী-পুত্র নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে আমার ছাত্র বিধায় উনি আমাকে বেশ সম্মান করতেন।

সাইফুল ইসলাম খান, ইস্ট হাউসের দোতালাতে থাকতেন। উনি ইংরেজিতেই পড়তেন যদিও আমার দুবছরের বড় ছিলেন। লম্বা ছিপছিপে সাইফুল ইসলাম খান কবিতা লিখতেন হায়াৎ সাইফ নামে। উনার পিতা মোসলেম উদ্দিন খান ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার। উনার সাথে প্রথম ঘনিষ্ঠতা সাদুল্লাহ-র, পরে আমার সাথে। দারুণ আমুদে মানুষ ছিলেন- প্রচুর জোক বলতে পারতেন যার অধিকাংশই যৌন বিষয়াদি সম্মন্ধীয়- রবীন্দ্রনাথের বেশ কিছু গান উনি প্যারোডি করেছিলেন- যা ঐ বয়সে শুনে- জোক এবং প্যারোডি- যারপরনাই মজা পেতাম। উনি ছোট-বড় সবার সাথে সহজে মিশতে পারতেন, যাকে ইংরেজিতে বলা যায়—ধ ঢ়ষবধংধহঃ ঢ়বৎংড়হধষরঃু— তিনি ছিলেন ঠিক তাই। হায়াৎ সাইফ নামে বাংলা কবিতা লেখাতে তার বেশ খ্যাতি ছিল তখনই। পত্র-পত্রিকাতে তার কবিতা নিয়মিত প্রকাশিত হতো, যদিও ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন- বিখ্যাত বাঙালি ইংরেজ বা ইংরেজ বাঙালি, আমাদের ইংরেজি বিভাগ প্রধান- হায়াৎ সাইফ-এর এই কবিতা লেখা এবং খ্যাতি কখনই ভাল চোখে দেখেননি কোনো এক অজ্ঞাত কারণে। যদিও সাইফুল ইসলাম খান ট্যক্সেশন সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন, কবিতা চর্চা থেকে বিরত হননি কখনও এবং ২০১৮ সালে ভাষা ও সাহিত্যে তিনি একুশে পদক পান।

সাইফুল ইসলাম খান বা হায়াৎ সাইফ সম্মন্ধে আরও একটু কিছু বলা বিশেষভাবে প্রয়োজন। ১৯৭২ সালে আমার বিয়ের পর আমি জানতে পারি সাইফুল ইসলাম খান-এর সাথে যে মহিলার বিয়ে হয়েছে সেই মহিলা আমার স্ত্রীর স্কুল-কলেজের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং সেই বন্ধুত্বের বন্ধন এখনও অটুট আছে। তাদের এই বন্ধুত্বের কারণে আমাদের দুই পরিবারের ভেতর বেশ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। সম্প্রতি ২০১৯ সালে সাইফুল ইসলাম খান ইহলোক ত্যাগ করেন।

তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী সম্মন্ধে আগেই লিখেছি- উনি নওগাঁ কে ডি স্কুলে আমার বড় ভাইয়ের সহপাঠী ছিলেন। আমার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে দ্রুত আবাস পাবার ব্যাপারে উনি অনেক সাহায্য করেছিলেন। যদিও বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা হবার পর ব্যস্ততার কারণে তাঁর সেসব শৈশব এবং ছাত্রজীবন স্মৃতি মনে আছে কিনা জানি না। উনি অত্যন্ত মেধাবি ছাত্র ছিলেন, তবে সলিমুল্লাহ হলে থাকাকালে কী কারণে যেন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন করতেন, এবং আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ১৯৭১ সালে যখন চুয়াডাঙ্গার মহাকুমা কর্মকর্তা ছিলেন তখন বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ডাকে সাড়া দিয়ে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ করেন। তাঁর এই ‘মেটামরফসিস’ আমাকে চমৎকৃত করেছে, গর্বিত করেছে।

তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর সাথে আরও একজন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বকে আমার মনে পড়ছে। তিনি হলেন আব্দুল্লাহ- যার পুরো নাম আমি মনে করতে পারছি না। উনিও তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরীর সহপাঠি ছিলেন অর্থনীতি বিভাগে। আব্দুল্লাহ ছিলেন, শুনেছি, বিখ্যাত অভিনেতা, সুবর্ণা মুস্তাফার পিতা গোলাম মুস্তাফার ভ্রাতা। আব্দুল্লাহ ছিলেন আসাধারণ পড়ুয়া, শিল্প-সাহিত্য সচেতন মানুষ। উনি আমাদের হলের শিল্পসংস্কৃতি সপ্তাহে রবীন্দ্র সঙ্গীত গাইতেন, কবিতা আবৃত্তি করতেন- উনাকে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা বই হাতে দেখতাম। ফলে তাঁর চোখে মোটা লেন্সের চশমা লাগানো থাকতো এবং উনি বই পড়তেন চোখের এক ইঞ্চি দূর থেকে এবং ফাঁকেফাঁকে বইটি নাক দিয়ে শুঁকতেন। আমরা এটা দেখে বলাবলি করতাম আব্দুল্লাহ ভাই নাক দিয়ে শুঁকেই বলে দিতে পারতেন কোন বই উনার পড়া আর কোনটা পড়া নয়। আমার মনে আছে ১৯৬২ সালে নোবেল বিজয়ী মার্কিন ঔপন্যাসিক জন স্টাইনবেক-এর বিখ্যাত উপন্যাস- যে উপন্যাস ন্যাশনাল বুক এওয়ার্ড ও পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিল এবং তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলো, সেই দ্যা গ্রেইপস অফ রথ উপন্যাসটি হাতে করে ঐভাবে নাকে শুঁকে হলময় পড়ে বেড়াতেন। পরে উনার মুখে সাহিত্য নিয়ে অনেক বক্তৃতা আমি শুনে ভাবতাম উনি কেন অর্থনীতি পড়ছেন, উনার আসলে সাহিত্য পড়াটাই ঠিক ছিল। আমি বিভিন্ন সূত্র থেকে জেনেছি উনি অর্থনীতিতে বিদেশে (সম্ভবত যুক্তরাজ্যে) কোনো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে বিদেশেই স্থায়ী হয়েছেন। সত্যমিথ্যা জানি না।

আমি জানি আমি আরও অনেক মহান মানুষের কথা মনে করতে পারছি না। কিন্তু কথা দিচ্ছি যখনি মনে পড়বে আমি তা লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করবো। এবার হলের আরও কিছু কথা ভুলে যাবার আগেই বলে ফেলি।

প্রথমেই মনে পড়ছে হলের সেই দীর্ঘদেহী গৌরবর্ণ সুপুরুষ নাজু-র কথা, নাজু ছিলো আমাদের মুসলিম হলের সার্বক্ষণিক প্রহরী। এমন ঐচিত্য চরিত্রের প্রহরী আমার এই সাতাত্তুর বছর বয়সের জীবনে যে আর দেখিনি তা হলফ করে বলতে পারি। এই মানুষটি বাঙালি ছিল না- পাঠান বংশোদ্ভূত- বহুদিন বাংলাদেশে (তখনকার পূর্ব পাকিস্তান) থাকার কারণে উর্দু-বাংলা মিশিয়ে কথা বলতো, কুর্তা-পাজামা পরতো, অনেক সময় মাথায় পাগড়ি বাঁধতো। এই পাগড়ি বিষয়টি তার ‘স্পেসালিটি’ ছিলো। প্রায়ই দেখতাব হলের সামনে খোলা বারান্দাতে বসে সে বিভিন্ন রঙের পাগড়ি বানাচ্ছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছিলাম হলের কোনো প্রাক্তন ছাত্রের বিয়ের পাগড়ি বানানো হচ্ছে। পাগড়িগুলো এত সুদর্শন ও রঙিন হতো বলার নয়। ভেবে রেখেছিলাম আমিও আমার বিয়ের সময় অমন পাগড়ি বানিয়ে নেবো নাজুর কাছ থেকে। কিন্তু আমি বিয়ে করেছি ১৯৭২-এ, যখন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়েছে নয় মাস যুদ্ধের পর। নাজু তখন জীবিত না মৃত, অথবা পলাতক, আমার জানা ছিল না। নাজুকে আমি সারা জীবনেও ভুলবো না।

ডাইনিং হলে একজন বিশ কি বাইশ বছরের তরুণ আমাদের (অন্যান্য আরও অনেকের সাথে) খাবার পরিবেশন করতো যার নাম ছিল সুরুজ, অন্তত আমরা তাকে সেই নামেই চিনতাম। এই তরুণও এক স্মৃতি আমার জীবনে। সুরুজ অমানুষিক কাজ করতো সকাল সন্ধ্যা, সেই বেলা বারোটা থেকে রাত দশ/এগারোটা পর্যন্ত- দিন বারোটার আগে রান্নাঘর, ডাইনিং ঘর, খাবার টেবিল ইত্যাদি পরিষ্কার এবং প্রস্তুত তো ছিলোই। কিন্তু সুরুজের মুখে সদাই একটুকরো হাসি লেগেই থাকতো। আমরা যারা বেলা করে খেতাম সুরুজকে বলে রাখতাম সেই মুরগির চ্যাপ্টা রান আমাদের জন্য সরিয়ে রাখতে। অনেক সময়ই ও সেটা করতে পারতো না- যার কারণ আগের কিস্তিতে বলেছি। তখন ও অনেক সময়ই বুদ্ধি দিতো ডিমভাজি করে দেবার। ডিম কাছাকাছি কোনও দোকান বা সামনে হলের ক্যান্টিন থেকে কিনে আনতো আমরা পয়সা দিলে, আর ও সুন্দর করে অনেক পেঁয়াজ দিয়ে ভেজে দিত। ভাতের সাথে সেই তরল পোকাপড়া ডাল মাখিয়ে ডিমভাজি খেতে অমৃত লাগতো।

আর একজন ছিল সিদ্দিক। নোয়াখালি বাড়ি- সে শত চেষ্টা করেও শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতো না- নোয়াখালির টান থেকেই যেতো তাঁর সাথে ইংরেজি শব্দ বা বাক্যের মিশেল। সিদ্দিক-এর একটা লক্কড়-ঝক্কড় সাইকেল ছিলো যার পেছনে একটা বেশ বড়সড় কেরিয়ার ছিলো। এই কেরিয়ারে করে সে পাহাড়সম স্তূপাকারে বিভিন্ন বই, পত্রিকা, ম্যগাজিন নিয়ে হলেহলে ঘুরতো ফেরি করার জন্য। বিশেষ করে রবিবার ছুটির দিনে।

সিদ্দিক খুব বুদ্ধিমান ছেলে ছিলো। ও জানতো আমাদের মতো উঠতি বয়সী তরুণদের যৌন বিষয়ের কৌতূহল কতোটা তীব্র হতে পারে, বিশেষ করে আমাদের‘ট্যাবু’ আক্রান্ত সমাজে। ফলে ও যেমন ভাল ভাল ইংরেজি বাংলা উপন্যাস, প্রবন্ধের বই (তার কাছ থেকে কেনা বার্ট্রান্ড রাসেল-এর চার খণ্ডের আত্মজীবনী এবং সমার সেট মম-এর রচনা সমগ্র আমার শেলফে এখনও দেখতে পাচ্ছি), পত্রিকা, ম্যাগাজিন আনতো তেমনি ছোট চটি বাংলা ‘পোর্ণ’-ও আনতো। আমরা অবশ্য বাংলা চটিপোর্ণ পড়ে হতাশ হয়ে ইংরেজি কিছু উপন্যাস সংগ্রহ করতে শুরু করি- যার ভেতর ছিলো ‘ঋধহহু ঐরষষ’ (গবসড়রৎং ড়ভ ধ ডড়সধহ ড়ভ চষবধংঁৎব), ‘অভঃবৎ গরফহরমযঃ ঝপযড়ষধৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধহপবৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধঢ়ৎরপড়ৎহ’ জাতীয় রগরগে উপন্যাসের প্রতি। এরই সাথে ছিল বাংলাতে প্রকাশিত একটি মাসিক যৌনশিক্ষা পত্রিকা “নরনারী”। এ পত্রিকাটি আসলে যৌনশিক্ষার জন্য অনেক দিক দিয়েই ভাল ছিলো যদিও আমরা সেই সময় এটিকে ‘পোর্ণ’- বলে কিনতাম এবং পড়তাম। এই পত্রিকাটি নিয়ে মোহাম্মদ জমীর আলী এবং হায়াত হোসেন-এর ভেতর এক ধরনের ঠা-াযুদ্ধ প্রায়ই লেগে থাকতো। না, জমীর আলী এ পত্রিকা আপাতদৃষ্টে পড়তো না- আপাতদৃষ্টে বলছি কারণ আমার অভিজ্ঞতা বলে ‘আপাতদৃষ্টে’ অনেককেই ভাজামাছ উল্টে খেতে জানে না বা স্বাত্ত্বিক মনে হলেও সময়ে ও পরিস্থিতিতে গোপনে তারা অনেক কিছুই করতে সক্ষম। সে অভিজ্ঞতা এই হল থেকেই প্রাপ্ত।

আমি সিদ্দিকের কাছ থেকে অনেক বই কিনেছি যা, আগেই বলেছি, এখনও আমার বইয়ের সেলফে রাখা আছে। তবে ‘ঋধহহু ঐরষষ’ (গবসড়রৎং ড়ভ ধ ডড়সধহ ড়ভ চষবধংঁৎব), ‘অভঃবৎ গরফহরমযঃ ঝপযড়ষধৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধহপবৎ’, ‘ঞৎড়ঢ়রপ ড়ভ ঈধঢ়ৎরপড়ৎহ’ জাতীয় বইগুলো হাতছাড়া হয়ে গেছে কারণ আমরা যারা হলে থাকতাম তাদের মধ্যে যারা এমন বই একটি কিনতো সেটি একজনের পর একজন পড়ার জন্য নিতো এবং হাত ফিরে ফিরে শেষ পর্যন্ত কার কাছে পৌঁছাতো তার কোনো হদিস থাকতো না। আমাদের যুগে এটিই ছিল আমাদের উঠতি যৌনচেতনার খোরাক, যদিও পরিস্থিতি আগের চাইতে উন্নত হয়েছে বলে মনে হয় না। সম্ভবত ১৯৬৫-৬৬ সালের দিকে আমরা প্রথম চষধুনড়ু পত্রিকার হদিস পাই, এবং এরপর স্টিল ছবিতে রতিকর্ম দেখার সুযোগ হয়। পোর্ণ চলচ্চিত্র তো আরও অনেক পরের কথা।

সিদ্দিক-এর কি হয়েছে আমি জানি না। শুনেছি মারা গেছে- কীভাবে তাও জানি না। কিন্তু তার কাছ থেকে কেনা বইগুলো যখন দেখি তখন প্রকৃতই স্মৃতিবিধূর হই, চোখ অশ্রুসজল হয়।

আরও একজন যার কথা ভুলবার নয়, যার সাথে আমাদের হল আবাসিকদের সকলেরই নিজেদের প্রয়োজনেই সখ্য ছিল। নামটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না। ও ছিলো অবাঙালি- বলা যায় বিহারি। বাচ্চা ছেলে- বারো/চৌদ্দ বছরের হবে- আমাদের জুতো কালি করতে আসতো। রুমের সামনে এসে চেঁচাতো: পালিশ, জুতা পালিশ! বিশেষ করে রবিবার, ছুটির দিন ভোরসকালে। ছেলেটা ভীষণ স্মার্ট ছিল। সম্ভবত ওর সাথে ওর এক ছোট ভাইও মাঝেমধ্যে আসতো। দুজনই ভীষণ কৃষ্ণবর্ণ এবং কৃশকায়। আমরা ওকে খুব বেশি হলে দু’আনা দিতাম, ও খুশি হতো কিন্তু বলতো: আপনাদের জুতা কালি করে লাভ নাই। আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম: তাহলে এখানে আসিস ক্যান? উত্তরে একগাল হেসে বলেছিল: আপনাদের এখানে আসতে খুব ভাল লাগে, আপনারা যে পড়াশোনা করেন। একজন সম্পূর্ণ আনপড় বাচ্চাছেলের কাছ থেকে একথা শুনে আমি এক শ্রেণিবিভক্ত সমাজের রূপ দেখে কষ্ট পেয়েছিলাম বৈ কি! ছেলেটা আর একদিন একটা গল্প বলেছিলো যে গল্পটা আমি এখনও আমার ক্লাসে বলি ঈড়সসঁহরপধঃরাব ঝশরষষ-এর উদাহরণ হিসেবে। ও বলেছিলো প্রতি বিকেলে ও ন্যু মার্কেটে জুতা পালিশ করতে যায়, বিশেষ করে বিদেশি খদ্দের ধরারা জন্যে। আমি জানতে চাইলাম ও তো ইংরেজি জানে না তাহলে কীভাবে খদ্দের ধরে। ও বললো খুব সোজা। আমি ওদের কাছে যেয়ে বলি: শু শেইন, শু শেইন? ওরা বলে, হা মাস, হা মাস? আমি তখন দুই আঙ্গুল দেখায়ে বলি রুপিস। অর্থাৎ দুই টাকা। ব্যাস এভাবেই কম্যুনিকেশন সম্পূর্ণ। জীবিকার অন্বেষণে কী অসাধারণ পড়সসঁহরপধঃরাব ংশরষষ!

মুসলিম হলের কেচ্ছা আরও আছে- বিশেষ করে আমার সহপাঠী ও ব্যাচমেটদের নিয়ে। সেটা আগামী কিস্তিতে আবার বর্ণিত হবে। তবে নাজু, সুরুজ, সিদ্দিক আর ঐ জুতা পালিশ করা বিহারি ছেলেটা আমার স্মৃতির অতল তলে কখনোই সমাহিত যাবে না- সদা জাগরুক থাকবে। আমি জানি না তারা কোথায়- ইহকালে না পরকালে- কিন্তু তারা যেখানেই থাকুক আমি মনেপ্রাণে চাই তারা ভাল থাকুক কারণ তারা প্রত্যেকে আমার হল এবং বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের মতোই আমার ব্যক্তিজীবনের অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে- জীবনের জন্য প্রস্তুত করেছে। ২০১৭ সালে প্রয়াত রুশ কবি ইয়েভগেনি ইয়াভতোশেঙ্কুর ঠিক এমনই বক্তব্য সম্বলিত একটি কবিতার ক’টি চরণ মনে উঠে আসছে: আমি শুধু অত্যুজ্জ্বল ফ্রেমে বাঁধা মানুষদের/কাছ থেকেই আমার শিক্ষা নিই নি,/বিবর্ণ পরিচয়হীন মানুষরাও/আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে।/... তোমাদেরকে আমার কিছুই শেখাবার নেই।/তোমাদের কাছেই শিখতে চাই আমি। (“আমার বিশ্ববিদ্যালয়গুলো”; কবিতাটি আবদুস সেলিম কর্তৃক অনূদিত)।

back to top