অখিল পোদ্দার
বহুমাত্রিক ঋতুর আবর্তে আলাদা এক আবহ শরতের; সদ্য জেগে ওঠা নবীন চরের মতো স্নিগ্ধ একটা ঘ্রাণ তাতে বিদ্যমান। রূপের মাধুর্য, রসের সঞ্জিবনী আর নীল আকাশে শাদা মেঘের আবরণে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সোঁদা মাটির কাশফুল। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি স্মিত সমীরণের মধুলগনে জন্মেছিলেন তিনি। যিনি গ্রাম থিয়েটারের বদৌলতে চিনেছেন মানুষ, জেনেছেন প্রকৃতি আর আদিমজন থেকে জাদুবাস্তবতার শহর ঢাকা। তিনি আর কেউ নন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে কেউবা চেনেন নাট্যজন হিসেবে। কুশীলবের বাইরে যিনি পুরোদস্তুর বাহুবলী সাংবাদিক। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর বহুগুণে গুণান্বিত এ মানুষটির ৭৪তম জন্মদিন।
কঞ্চির কলমে হাতেখড়ি গোপালগঞ্জের স্কুলে। অতপর রাজেন্দ্র কলেজের চৌহদ্দি টপকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাঠের বিষয়-গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা।
বহুবিধ কারণে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ বিশেষ পরিচিত। কেউ তাঁকে জেনেছেন নাট্যজন হিসেবে, কেউ কেউ আবৃত্তিকার, অন্যরা চেনেন মুক্তবুদ্ধির ঝড়ো আন্দোলনের প্রমিথিউস রূপে। একাত্তরের রণাঙ্গণে তিনি ছিলেন আগুনমুখো নদীর মতো ঝাঁঝালো। যাঁর বারুদে দগ্ধ হয়েছিল রাজাকার আলবদর আলশামস আর পাকি দোসরেরা। এসব কারণে মামলা—হামলা আর ষড়যন্ত্র আঠার মতো লেগেই আছে পিছে—পিছে। তবু অন্তর্গহীনে এখনও শক্তিশালী পীযূষ স্বপ্ন দেখেন-এ বাংলা সত্যি সত্যিই একদিন আপামর মানুষের হবে। থাকবে না ভেদাভেদ, জেদাজেদি আর অন্তর্কোন্দল। জাতির জনকের স্বপ্নের মানচিত্রজুড়ে প্রকাশ পাবে ধারাবাহিক স্বস্তি আর অবারিত শান্তি। চেতনার গোলা ভর্তি হবে কোটি জনতার সমস্বরে।
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি তাঁর হাতে গড়া। যেটি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ে আবহমান বাংলার ঐহিক দর্শন প্রচারে ব্যস্ত। এর বাইরেও তিনি ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী। ব্যস্ততার ফোকর গলে নিয়মিত কলম ধরার চেষ্টা করেন সমসাময়িক ইস্যুতে। বাছাই করা সিনেমা আর বিষয়ভিত্তিক নাটকে করেন অভিনয়। যোগ দেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বক্তৃতা আর মিছিলে। ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জ মেনে স্রোতের বিপরীতে এখনও পাথরভেলা হয়ে বাঙালির চিরায়ত জীবনদর্শনের দীক্ষা প্রচারে ব্যস্ত। এসব বহুমূখী কারণে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৩ বছর বয়সেও সন্ধ্যাকাশের দূরতম নিকটতারার মতো জ্বাজ্বল্যমান।
একটি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে এ লেখার অমসৃণতা খোঁচাবে বটে! তখন ২০০৪ সাল। চারপাশে বঙ্গবন্ধুবিরোধী গুমোট গরম পরিবেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে হয় ফিসফিস করে, ইঙ্গিত আকারে। ক্রান্তিকালের আঁধার কাটাতে কলম ধরলেন নমস্যজন আবদুল গাফফার চৌধুরী। বাংলাদেশের স্থপতিকে নিয়ে লিখলেন মঞ্চনাটক। আর সেই নাটকের ‘প্রোটাগনিস্ট ক্যারেটার’ নির্বাচন করলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কারণ অন্ধকার ভেদ করে আলোকজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে শেখ মুজিবের কথা বলার মতো কাঙ্ক্ষিত কাউকে গাফফার চৌধুরী সেদিন পাচ্ছিলেন না। ঝড়ো নাবিকের মতো বঙ্গবন্ধুর পাল উঁচিয়ে সাত সমূদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মঞ্চে সে আলোর বিচ্চুরণ ঘটেছিল ভূমধ্যসাগরের এপার হতে আটলান্টিকের ওপারে। কমার্শিয়াল ভেঞ্চার উতরে সেটিকে সিনেমায় রূপ দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মীদের কর্ণতূল্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ নাটকে শেখ মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করার কারণে লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে মৌলবাদীগোষ্ঠীর হামলারও শিকার হন তিনি। এরপরও দমে যাননি। বিভিন্ন সময়ে হত্যার হুমকি ও জঙ্গীদের শিরোশ্ছেদের ঘোষণা উপেক্ষা করে মাঠে তেপান্তরে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন কারুনাট্যকার পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী একান্ত সাক্ষাতকারে লন্ডনের শো’ সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন সে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
সাদামাটা কক্ষে পায়চারি করছেন শেখ মুজিব। দীপ্তিময় প্রক্ষেপণ তাঁর অবয়ব জুড়ে। মঞ্চের হালকা আলো উতরে ঢিলাঢালা পাঞ্জাবি গোটাচ্ছেন জাতির জনক। পায়ের চটি, চশমা আর চুরুটের ভঙ্গিমায় পীযূষকে সেদিন সত্যি সত্যিই বাংলার মুজিব মনে হয়েছিল। তার চেয়েও বড় ব্যাপারটি হলো-- অনেককেই সেধেছিলাম ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকে অভিনয় করতে। বেশিরভাগ লোকজনই গাঁইগুঁই করেছেন। অথচ পীযূষ ছেলেটা একবাক্যে রাজি হয়েছিল। তাঁর নৈর্বক্তিকতা আর বিশাল বুক চিতিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে দাঁড় করানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আমার হৃদয় ছুঁয়েছিল।
গাফফার চৌধুরী আরও বলেন, পীযূষ বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করাতে একটা সুবিধাও পেয়েছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর কথায় ফরিদপুরের যে আঞ্চলিকতা ছিল সেটা ও খুব ভালো করে তুলে ধরতে পেরেছিল। শেখ মুজিবের যে বিশিষ্টতা, কথার আন্তরিকতা, মিষ্টতা ও সারল্যপনা-ফরিদপুরের সন্তান হওয়াতে পীযূষ তাতে মুন্সিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে লন্ডনের বিভিন্ন অডিটরিয়াম ছাড়াও নিউ ইয়র্কের এ্যাস্টোরিয়া ও ব্রুকলিনে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিল জনতা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল— পূর্ব-লন্ডনে যখন এটার রিহার্সাল হতো তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিনয়ে অংশ নিতে আসতো বাঙালিরা। কতোটা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হলে দুঃসময়ে তারা জোটবদ্ধ হয়েছিল বিদেশ বিজনে— বলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, গ্রাম থিয়েটার ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নদীনালা খাল বিলের গ্রামীণ প্রকৃতি আর সরল সহজ মানুষ। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানে সাদা মেঘের ভেলা যেমন তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গহীনে তেমনি এদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও তিনি বিশ্লেষণ করেন গভীর উপলব্ধী থেকে। সবুজ ঘাসের ডগায় জ্বলজ্বলে শিশিরবিন্দুতে তিনি যেমন মুগ্ধ হন, তেমনি শুভবুদ্ধির তারুণ্য তাঁকে আশাজানাগানিয়া করে তোলে প্রতিনিয়ত।
একসময় নিয়ম করে লিখেছেন ছড়া-কবিতা-গল্প ও উপন্যাস। ব্যস্ততর সময় সামলে এখন আর খুব একটা লেখা হয়ে ওঠে না। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ১৮। পুরুদস্তর সংগঠক হিসেবেই ইদানীং তিনি সুপরিচিত। তবে মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশ হচ্ছে। ফুরসত মিললে এখনও গ্রীন রুম হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদি কি-না মনের মতো কাহিনী আর পরিচালক মেলাতে পারেন। যদিও বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘শাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করে আশির দশকেই পীযূষ হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার নায়ক। এমনকি রাস্তাঘাটে তাঁকে শাহেদ নামেই অনেকে ডাকতে পছন্দ করতেন। শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন তা সমসাময়িক খুব কম শিল্পীর ভাগ্যেই জুটেছে।
জীবনের অনেকগুলো বছর পেরুনো পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও সাংস্কৃতিক নীলিমায় ভাস্বর এক সন্ধ্যাতারা। তাতে যেমন আলোর বিকিরণ আছে তেমনি রয়েছে সৌন্দর্যময় প্রতিভা। জয়তু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। শতায়ু হোন স্বমহিমায়। শুভ জন্মদিন।
অখিল পোদ্দার
শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩
বহুমাত্রিক ঋতুর আবর্তে আলাদা এক আবহ শরতের; সদ্য জেগে ওঠা নবীন চরের মতো স্নিগ্ধ একটা ঘ্রাণ তাতে বিদ্যমান। রূপের মাধুর্য, রসের সঞ্জিবনী আর নীল আকাশে শাদা মেঘের আবরণে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে সোঁদা মাটির কাশফুল। সন্ধ্যা থেকে ভোর অব্দি স্মিত সমীরণের মধুলগনে জন্মেছিলেন তিনি। যিনি গ্রাম থিয়েটারের বদৌলতে চিনেছেন মানুষ, জেনেছেন প্রকৃতি আর আদিমজন থেকে জাদুবাস্তবতার শহর ঢাকা। তিনি আর কেউ নন, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে কেউবা চেনেন নাট্যজন হিসেবে। কুশীলবের বাইরে যিনি পুরোদস্তুর বাহুবলী সাংবাদিক। আজ ২৩ সেপ্টেম্বর বহুগুণে গুণান্বিত এ মানুষটির ৭৪তম জন্মদিন।
কঞ্চির কলমে হাতেখড়ি গোপালগঞ্জের স্কুলে। অতপর রাজেন্দ্র কলেজের চৌহদ্দি টপকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পাঠের বিষয়-গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা।
বহুবিধ কারণে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠ বিশেষ পরিচিত। কেউ তাঁকে জেনেছেন নাট্যজন হিসেবে, কেউ কেউ আবৃত্তিকার, অন্যরা চেনেন মুক্তবুদ্ধির ঝড়ো আন্দোলনের প্রমিথিউস রূপে। একাত্তরের রণাঙ্গণে তিনি ছিলেন আগুনমুখো নদীর মতো ঝাঁঝালো। যাঁর বারুদে দগ্ধ হয়েছিল রাজাকার আলবদর আলশামস আর পাকি দোসরেরা। এসব কারণে মামলা—হামলা আর ষড়যন্ত্র আঠার মতো লেগেই আছে পিছে—পিছে। তবু অন্তর্গহীনে এখনও শক্তিশালী পীযূষ স্বপ্ন দেখেন-এ বাংলা সত্যি সত্যিই একদিন আপামর মানুষের হবে। থাকবে না ভেদাভেদ, জেদাজেদি আর অন্তর্কোন্দল। জাতির জনকের স্বপ্নের মানচিত্রজুড়ে প্রকাশ পাবে ধারাবাহিক স্বস্তি আর অবারিত শান্তি। চেতনার গোলা ভর্তি হবে কোটি জনতার সমস্বরে।
‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনটি তাঁর হাতে গড়া। যেটি বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষকে নিয়ে আবহমান বাংলার ঐহিক দর্শন প্রচারে ব্যস্ত। এর বাইরেও তিনি ঐতিহ্যবাহী টেলিভিশন চ্যানেল একুশে টিভির প্রধান নির্বাহী। ব্যস্ততার ফোকর গলে নিয়মিত কলম ধরার চেষ্টা করেন সমসাময়িক ইস্যুতে। বাছাই করা সিনেমা আর বিষয়ভিত্তিক নাটকে করেন অভিনয়। যোগ দেন বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের বক্তৃতা আর মিছিলে। ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জ মেনে স্রোতের বিপরীতে এখনও পাথরভেলা হয়ে বাঙালির চিরায়ত জীবনদর্শনের দীক্ষা প্রচারে ব্যস্ত। এসব বহুমূখী কারণে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় ৭৩ বছর বয়সেও সন্ধ্যাকাশের দূরতম নিকটতারার মতো জ্বাজ্বল্যমান।
একটি প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলে এ লেখার অমসৃণতা খোঁচাবে বটে! তখন ২০০৪ সাল। চারপাশে বঙ্গবন্ধুবিরোধী গুমোট গরম পরিবেশ। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলতে হয় ফিসফিস করে, ইঙ্গিত আকারে। ক্রান্তিকালের আঁধার কাটাতে কলম ধরলেন নমস্যজন আবদুল গাফফার চৌধুরী। বাংলাদেশের স্থপতিকে নিয়ে লিখলেন মঞ্চনাটক। আর সেই নাটকের ‘প্রোটাগনিস্ট ক্যারেটার’ নির্বাচন করলেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কারণ অন্ধকার ভেদ করে আলোকজ্জ্বল রঙ্গমঞ্চে শেখ মুজিবের কথা বলার মতো কাঙ্ক্ষিত কাউকে গাফফার চৌধুরী সেদিন পাচ্ছিলেন না। ঝড়ো নাবিকের মতো বঙ্গবন্ধুর পাল উঁচিয়ে সাত সমূদ্র তেরো নদী পেরিয়ে মঞ্চে সে আলোর বিচ্চুরণ ঘটেছিল ভূমধ্যসাগরের এপার হতে আটলান্টিকের ওপারে। কমার্শিয়াল ভেঞ্চার উতরে সেটিকে সিনেমায় রূপ দেয়ার পরিকল্পনাও করেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মীদের কর্ণতূল্য পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।
আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘পলাশী থেকে ধানমণ্ডি’ নাটকে শেখ মুজিবের চরিত্রে অভিনয় করার কারণে লন্ডন ও নিউ ইয়র্কে মৌলবাদীগোষ্ঠীর হামলারও শিকার হন তিনি। এরপরও দমে যাননি। বিভিন্ন সময়ে হত্যার হুমকি ও জঙ্গীদের শিরোশ্ছেদের ঘোষণা উপেক্ষা করে মাঠে তেপান্তরে পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন কারুনাট্যকার পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী একান্ত সাক্ষাতকারে লন্ডনের শো’ সম্পর্কে আমাকে বলেছিলেন সে ঘটনার আদ্যোপান্ত।
সাদামাটা কক্ষে পায়চারি করছেন শেখ মুজিব। দীপ্তিময় প্রক্ষেপণ তাঁর অবয়ব জুড়ে। মঞ্চের হালকা আলো উতরে ঢিলাঢালা পাঞ্জাবি গোটাচ্ছেন জাতির জনক। পায়ের চটি, চশমা আর চুরুটের ভঙ্গিমায় পীযূষকে সেদিন সত্যি সত্যিই বাংলার মুজিব মনে হয়েছিল। তার চেয়েও বড় ব্যাপারটি হলো-- অনেককেই সেধেছিলাম ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকে অভিনয় করতে। বেশিরভাগ লোকজনই গাঁইগুঁই করেছেন। অথচ পীযূষ ছেলেটা একবাক্যে রাজি হয়েছিল। তাঁর নৈর্বক্তিকতা আর বিশাল বুক চিতিয়ে বঙ্গবন্ধুকে নতুন করে দাঁড় করানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা আমার হৃদয় ছুঁয়েছিল।
গাফফার চৌধুরী আরও বলেন, পীযূষ বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করাতে একটা সুবিধাও পেয়েছিলাম। কারণ বঙ্গবন্ধুর কথায় ফরিদপুরের যে আঞ্চলিকতা ছিল সেটা ও খুব ভালো করে তুলে ধরতে পেরেছিল। শেখ মুজিবের যে বিশিষ্টতা, কথার আন্তরিকতা, মিষ্টতা ও সারল্যপনা-ফরিদপুরের সন্তান হওয়াতে পীযূষ তাতে মুন্সিয়ানা দেখাতে সক্ষম হয়েছিল। এভাবে লন্ডনের বিভিন্ন অডিটরিয়াম ছাড়াও নিউ ইয়র্কের এ্যাস্টোরিয়া ও ব্রুকলিনে ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’র অভিনয় দেখে মুগ্ধ হয়েছিল জনতা। সবচেয়ে মজার ব্যাপার ছিল— পূর্ব-লন্ডনে যখন এটার রিহার্সাল হতো তখন ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে অভিনয়ে অংশ নিতে আসতো বাঙালিরা। কতোটা বঙ্গবন্ধুপ্রেমী হলে দুঃসময়ে তারা জোটবদ্ধ হয়েছিল বিদেশ বিজনে— বলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন, গ্রাম থিয়েটার ও ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম। খুব কাছ থেকে দেখেছেন নদীনালা খাল বিলের গ্রামীণ প্রকৃতি আর সরল সহজ মানুষ। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানে সাদা মেঘের ভেলা যেমন তাঁর হৃদয়ের অন্তর্গহীনে তেমনি এদেশের রাজনীতির গতিপ্রকৃতিও তিনি বিশ্লেষণ করেন গভীর উপলব্ধী থেকে। সবুজ ঘাসের ডগায় জ্বলজ্বলে শিশিরবিন্দুতে তিনি যেমন মুগ্ধ হন, তেমনি শুভবুদ্ধির তারুণ্য তাঁকে আশাজানাগানিয়া করে তোলে প্রতিনিয়ত।
একসময় নিয়ম করে লিখেছেন ছড়া-কবিতা-গল্প ও উপন্যাস। ব্যস্ততর সময় সামলে এখন আর খুব একটা লেখা হয়ে ওঠে না। তাঁর বইয়ের সংখ্যা ১৮। পুরুদস্তর সংগঠক হিসেবেই ইদানীং তিনি সুপরিচিত। তবে মাঝেমধ্যে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তাঁর নিবন্ধ প্রকাশ হচ্ছে। ফুরসত মিললে এখনও গ্রীন রুম হয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান। যদি কি-না মনের মতো কাহিনী আর পরিচালক মেলাতে পারেন। যদিও বাংলাদেশ টেলিভিশনের ‘শাহেদ’ চরিত্রে অভিনয় করে আশির দশকেই পীযূষ হয়ে উঠেছিলেন আমজনতার নায়ক। এমনকি রাস্তাঘাটে তাঁকে শাহেদ নামেই অনেকে ডাকতে পছন্দ করতেন। শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নাট্যজন নাসিরউদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত ‘একাত্তরের যীশু’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে তিনি যে ভালোবাসা পেয়েছিলেন তা সমসাময়িক খুব কম শিল্পীর ভাগ্যেই জুটেছে।
জীবনের অনেকগুলো বছর পেরুনো পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় এখনও সাংস্কৃতিক নীলিমায় ভাস্বর এক সন্ধ্যাতারা। তাতে যেমন আলোর বিকিরণ আছে তেমনি রয়েছে সৌন্দর্যময় প্রতিভা। জয়তু পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। শতায়ু হোন স্বমহিমায়। শুভ জন্মদিন।