alt

সাময়িকী

জীবনানন্দ দাশ

সময়োত্তরের কবি

কামরুল ইসলাম

: রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩

জীবনানন্দ দাশ / জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯; মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- “কবিতা কী, এ-জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে, কবিতা অনেক রকম। হোমরও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে, র্যাঁবো ও রিলকেও। শেক্সপিয়র, বদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টও কবিতা রচনা করে গেছেন। কেউ-কেউ কবিকে সবের ওপরে সংস্কারকের ভূমিকায় দ্যাখেন; কারো-কারো ঝোঁক একান্তই রসের দিকে। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস- শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।” (শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা)

কবিতা বা শিল্পকে কোনো বিশেষ সংজ্ঞার আওতায় আনা মুশকিলই বটে। আমার কাছে কবিতা কিংবা শিল্পকে মনে হয় ‘ঞযব ড়িড়ফং ধৎব ষড়াবষু, ফধৎশ ধহফ ফববঢ়’ কিংবা ‘শ্রাবণসন্ধ্যায় যে মেঘ ভেসে গেল, ছুঁয়ে গেল বেদনার বাড়ি’। অপার বেদনার ছিন্নমূল বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক রহস্যঘন বনভূমির আঁধারে যা দেখা যায় (আশরীর ছায়া) তার ভেতরে কবির আত্মা মলযুদ্ধে মত্ত। তাই প্রকৃত কবিতার শরীরে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যায় প্রসবের রক্তচিহ্ন। কবিতার টেক্সটকে রক্তাক্ত গোধূলির মতো মনে হয় আমার কাছে। জীবনের খসে যাওয়া অংশগুলোই কবিতার সবুজ হাওয়ায় নেচে নেচে দোল খায়, এইসব নাচের মুদ্রায় মৃত্যুর সম্মোহন কিংবা জাগৃতির গন্ধ লেগে থাকে। মরণের ভোর ভোর আলোয় কবি কিংবা শিল্পী হয়তো দেখে যান কিংবা যান না সৃষ্টির এইসব চিরায়ত সবুজের বিবিধ তৈজস। কবি জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টির অপার আনন্দকে খুঁজেছেন মৃত্যুর ত্রিভূজ সীমানায়, জীবনের অন্য এক স্রোতে- যেখানে মিশে আছে অন্তর্গত বিষাদ কিংবা নৈরাশ্যে নিষিক্ত এক দূরন্বয়ী চেতনা যা বিপন্ন বিস্ময়ের ঐশ্বর্যে রক্তিম।

‘আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে :

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,

সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।’

(নগ্ন নির্জন হাত)

এই কবিতার কল্পচিত্র এবং বাকরীতির নতুনত্ব সে-সময়ে তো বটেই, আজকেও অনেকখানি অবাক করার মতো। তিনি মূলত চিত্রকল্পের কবি। নানা রকম চিত্রকল্পের সমাহার দেখা যায় তাঁর কবিতায়। এজরা পাউন্ড অ Few Donts by an Imagiste (১৯১৩) গ্রন্থে লিখেছেন-

“An ‘Image’ is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time. I use the term ‘complex’ rather in the technical sense employed by the newer psychologists, such as Hart, though we might not agree absolutely in our application.”

চিত্রকল্পের সাথে জড়িয়ে থাকে জটিল আবেগীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষঙ্গ, মনোজগতের নানা আবহ। কবির সৃজনীশক্তিরই প্রকাশ এই চিত্রকল্প কখনো গুচ্ছ চিত্রকল্প কিংবা সাবলাইম চিত্রকল্প হিসেবে কবিতায় এক ছায়াঘন নিবিড় অখ- বোধকে স্থিরিকৃত করে। জীবনানন্দের কবিতায় অনেক ইন্দ্রিয়জ চিত্রকল্পের দেখা পাওয়া যায়- যা প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কখনো কখনো ইন্দ্রিয়াতীত ব্যাপার হয়েও দাঁড়ায়।

‘আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল

পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভেতরে,

যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফিরে আরো নীল আকাশের তল

পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;

আমরা দেখেছি যারা সুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে রোজ,

প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;’

এই কবিতায় কবি রঙের বৈচিত্র্যে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকল্প তৈরির প্রয়াস নিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পের বৈচিত্র্য আমাদের বিস্মিত করে বৈকি। তার কবিতায় নানা ধরনের রঙের ব্যবহার তাঁকে অন্যের থেকে আলাদা করে তুলেছে। কোন রঙ কখন ব্যবহার করতে হয়, তা বোধ করি জীবনানন্দের সমকালীন কোনো বাঙালি কবি অতোটা সুচারুভাবে জানতেন বলে মনে হয় না। তবে তাঁর কবিতায় অন্য রঙের ব্যবহার থাকলেও ধূসর রঙের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়।

‘দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে

ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়ে

হৃদয়ের আকাক্সক্ষার নদী

ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়- ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি,

তবে এই পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে

লিখিতে যেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে

অন্তরের কথা;’

জীবনানন্দের অনেক কবিতায় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দেখা মেলে, যেগুলো তার অবচেতনের গভীর গহন থেকে উঠে আসা, যেখানে স্বপ্ন ও কল্পনার মেলবন্ধন এইসব চিত্রকল্পকে জটিল ও রহস্যাবৃত করে তোলে। জীবনানন্দের কথা ধার নিয়েই বলা যায়, চিত্রকল্পই কবিতা নয়, তবে চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহারেই কবিত্ব

জীবনানন্দের অনেক কবিতায় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দেখা মেলে, যেগুলো তার অবচেতনের গভীর গহন থেকে উঠে আসা, যেখানে স্বপ্ন ও কল্পনার মেলবন্ধন এইসব চিত্রকল্পকে জটিল ও রহস্যাবৃত করে তোলে। জীবনানন্দের কথা ধার নিয়েই বলা যায়, চিত্রকল্পই কবিতা নয়, তবে চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহারেই কবিত্ব। স্বপ্ন ও কল্পনার যুগল সত্তায় ভাষা এক অলৌকিক জলযানে ভেসে যেতে থাকে। কবির স্বপ্ন এক নিটোল সন্ন্যাস, কখনো কখনো সেই স্বপ্নের একটি স্থায়ী ঠিকানার জন্ম দেয় কোনো কবিতা। কোনো শিল্পী বা কবির জীবনে বাস্তবতা যত রূঢ় হয়, যতটা কঠিন যন্ত্রণাময় সময়ের মধ্য দিয়ে কবি পথ হাঁটেন, তাঁর স্বপ্নও ততোটা গভীর হয়। স্বপ্নকে আশ্রয় করে কবি রাস্তা খোঁজেন বেঁচে থাকার।

‘স্বপ্নের ভিতরে বুঝি- ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে

দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে

হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;

বাতাস ঝরিছে ডানা - মুক্তা ঝ’রে যায়

পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে- বনে বনে- হরিণের চোখে;

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।

হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে

হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,-

বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,

ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।

বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে -

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।’

(হরিণেরা, রনলতা সেন)।

এই ধরনের চিত্রকল্পের উন্মেষ তাঁরই গভীর স্বপ্নগত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। অবচেতন থেকে উঠে আসা এইসব সজীব পরাবাস্তব চিত্রকল্প জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফ্রয়েডের মতে, An unconscious impulse creates the poem no less than the dream; it provides the mental energy required for its formation. (The Theory of Regression)

২.

কোনো জাতির শেষ আশ্রয় সে জাতির কবিতা- যেখানে লুকিয়ে থাকে তার প্রাণ ও ঐশ্বর্য, আর এ প্রাণৈশ্বর্য-সঞ্চারকারী ব্যক্তিটি কবি, যিনি ভেতরে বিষের বালি নিয়ে মুখ বুঁজে মুক্তো ফলান, যার রক্তাক্ত হৃদয়ের তীরে কেবল তার নিজস্ব ঈশ্বর ছাড়া আর কারো ছায়াপাত ঘটে না, যিনি নিঃসঙ্গ, নিস্ব এবং একা। তার মস্তিষ্কের জরায়ু চুইয়ে নেমে আসা শব্দ-উপমার অন্তঃশীলা স্রোতের মধ্যে যে রুপালি-সোনালি শস্যের অধরা গুঞ্জন আমাদের নান্দিক চৈতন্যের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের নিয়ে যায় ভিন্ন জগতে, তা কোনো মানবিক অভিজ্ঞানেরই রূপান্তর নাকি এক পর্যটক আলোর দুপুর, যাকে সান্নিধ্যের সুতোয় বেঁধে আমরা তা ওড়াতে ওড়াতে নীড়ে ফেরা পাখিদের দলে ঠেলে দিই- এসবের কোনো ত্বরিৎ মীমাংসা নেই। yeats লিখেছেন: Out of our quarrel with ourselves we make poetry. কবিতা কীভাবে তৈরি হয়- এ বিষয়ে একটি সাদামাটা মতামত যদিও আমাদের বিভ্রান্ত করে, তথাপি এসব কথা আমাদের হরহামেশাই শুনতে হয়, শোনা লাগে। কারণ, কবিতা তৈরির রসায়ন ও রহস্য জানার এক অদম্য ব্যাকুলতার মধ্যে কবি কিংবা কোনো কবিতা-প্রেমিকের দিন অতিবাহিত হয়। কবি কি নিজেই জানেন কীভাবে তার ভাবনার দুয়ার ঠেলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে কবিতারা? কবিতার সমূহ সূর্যালোকে দাঁড়িয়েও কি কোনো কবি বোঝেন কবিতা আসলে কী? কবিতা কেবলই সঙ্গহীন এক বিনীত সুন্দর- যা একই সাথে সম্ভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত, যার দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেবল হাত পেতে চাওয়া যায়। কবিতার ভাঁড়ার থেকে এই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিয়ে কোনো আলোচনারও দরকার পড়ে না। কারণ, চাওয়াটার মধ্যেই আনন্দ, সেই আনন্দে যারা প্রীত হতে জানেন তারাই কেবল কবিতার সংসারে মেনে যান। জীবনানন্দ দাশ কবিতার সংসারে সেই মেনে যাওয়া মানুষ, যাকে কবিতার বারামখানায় আকাশ ও নক্ষত্রের ঐশী আলোয় চিত্ত-বিমোচনের সাধনায় আমরা সিক্ত হতে দেখেছি।

‘সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো- আকাশে এক তিল

ফাঁক ছিলো না;

পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;

অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো

ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার

শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!

কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো।’

(হাওয়ার রাত)

‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটি আমার কাছে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে মনে হয়েছে। এই কবিতার ব্যাপ্তি ও গভীর উজ্জ্বল শব্দ-সম্ভারের সংকেতময় আবহ কোনো কবিতা-পাঠককে নিয়ে যায় অনেক দূরের শূন্যে, এ যেন এক মহান দ্রষ্টার তৃতীয় নয়নের অবিরাম ছুটে চলা আকাশ-নক্ষত্রের বারান্দায় বারান্দায়।

চর্যাপদ থেকে আজ অবধি কত শত কবিতা লেখা হয়েছে, সে-হিসেব আমাদের কাছে গৌণ এ-কারণে যে, কাল পরম্পরায় কবিতার ইতিহাস জাগরূক সত্যের চর্চিত সমন্বয় মাত্র- যাকে আমরা অসংখ্য চিহ্ন ও সময়ব্যাপ্তির সূত্রগুলোয় খুঁজে পাই। ফলে একটি কাল-পরিচয়ের মধ্যে কবিতারও এক ধরনের পরিচয় আভাসিত হয় এবং বোধের জানালায় সেগুলোর চেহারা উদ্ভাসিত হলে আমরা কেবল কিছু মুখস্থ সূত্র কিংবা উপরিতলের ছায়াকে ঘিরে কাগজ ব্যয় করে একটি আলোচনা কিংবা ডিসকোর্স তৈরি করি। এই নির্মাণ আবার বিনির্মিত হয়ে ফিরে আসে, এতে শিল্প কিংবা কবিতার কতটুকু পাওয়া সম্ভব সে বিষয়ে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু আমরা লিখি, লিখছি- কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে কখনো স্ব-প্রণোদনায় এবং এইভাবে অজস্র লেখার মধ্যে ভেসে উঠছে কবিতার রহস্যাবলি নানা ধরনের বিশ্বাসের রঙ মেখে। সেই রঙগুলো কখনো চোখ ধাঁধানো, কখনো বিনম্র ভাবের উন্নাসিকতায় আচ্ছন্ন আবার কখনো কৌশলী বিচ্ছিন্ন চেতনায় অন্বিষ্ট। তবে একথা মানতেই হয় যে, হয়ে ওঠার পথে কবিতার জাত বিচার বড়ই কঠিন কাজ এবং প্রকৃত কবিতা চেনার বিষয়ও কোনো বিশেষ কালখ-ের কোনো ব্যাপার নয়। অনুভূতির গভীরতল থেকে কিংবা অবচেতনের দেশ থেকে আলো না এলে কবিতা হয় না। আমরা জীবনানন্দ দাশ থেকে পাই : ‘মানুষের ভাষা তবু অনুভূতির দেশ থেকে আলো/না এলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমোলা নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।’ বাকরীতির এক অভিনব বিন্যাস, শব্দের স্বাভাবিক রীতি-বিরুদ্ধ ব্যবহার ও ব্যবহৃত শব্দের স্বচ্ছন্দে চলনের ক্যারিশমা জীবনানন্দ দাশ অবিরাম কসরতেই আয়ত্ব করেছিলেন: “আমলকি গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিখ/কার্তিকের রোদে আর জলে/আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন/সূর্য? নাকি সূর্যের চপ্পলে/পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে/পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়/এ জীবনে আমি ঢের শালিখ দেখেছি /তবু সেই তিনজন শালিখ কোথায়?” (কার্তিকের ভোরবেলা)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন- ‘ভাষার এই অকুতোভয় ব্যবহার, এই অনায়াস সঞ্চরণ, বাংলা কবিতায় এর আগে কিংবা পরে হয়েছে কিনা, সেই মর্মে সুবিনীত সংশয় প্রকাশ করা যায়।’ (জীবনানন্দ)।

আমরা বিভ্রান্ত হই, কখনো বিচলিত হই, আবার কখনো নিজের রুচি ও বিশ্বাসের তলায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করি মাটি - কখনো খেই হারিয়ে ঘুরতে থাকি শূন্যে, কারণ নিজেরও একটা শেষ আছে, আছে একটি পরিধি- এই শেষে এসে মনে হতে থাকে ‘কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো! কবির হাতে তখনই সৃষ্টি হয় কবিতার যখন অন্ধকার হাড়গিলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কবির সামনে, মরুঝড় কিংবা অবিরল অন্ধকার কবির চোখে ঢেলে দেয় চিরকালের স্তব্ধতা, তখন দূরের কোনো সিম্ফনি বকছানার মতো ঘুরতে থাকে কবির শবাধার ঘিরে, সেই গোলচক্রের ভেতর থেকে জন্ম হয় কবিতার- ঈশ্বর স্বয়ং নিজ হাতে লালন করেন সেই কবিতা। কবিতার সত্য সম্পাদিত হয় কবির মৃত্যুতে; অজস্র মৃত্যুর মধ্যে কবিকে পথ হাঁটতে হয়, মৃত্যুময় পরানে বেজে ওঠে কবিতা- সেই কবিতার জন্য যারা প্রস্তুত মূলত তারাই কবি। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সেই ধরনের কবি।

‘কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;

আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর

পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল;

আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে

আমার জানালার ভিতর দিয়েসাঁই সাঁই ক’রে,

সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো।’

(হাওয়ার রাত)

বোধের কোন পরিসীমায় পৌঁছালে এরকম কবিতা লেখা সম্ভব, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। আকাশ ও পৃথিবী তাঁর কবিতার বিস্তৃত দুনিয়ায় এমন এক ছায়া ফেলে আছে যে আমরা কখনোই এই ছায়ার কুহকী অবয়ব ছেড়ে তাঁর কবিতার কোনো দরজা খুঁজে পাবো না।

৩.

কবিকে সংগ্রাম করে যেতে হয়। আজীবন। সেই সংগ্রাম অবশ্যই বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরিক- জীবনের অনেকানেক না-পাওয়ার মধ্যে সেই সংগ্রাম যেমন গ্রথিত, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের মধ্যেও যার রয়েছে সাহসিক বিস্তৃতি। তবে কবির এই সংগ্রাম মূলত কবিতার জন্য সংগ্রাম। একটি ভালো কবিতা লেখার জন্য কবিকে যে সংগ্রাম করতে হয় তা কবি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কবির এই সংগ্রামকে জে. আইজাক্স এভাবে দেখেছেন:

‘অনেক সময় আমি ভেবেছি, যদিও কথাটা আপাতবিরোধী মনে হতে পারে যে, শেষতঃ সব কবিতাই কবিতা বিষয়ক এবং ‘কবিতার জন্য কবিতা’ কথাটি কিছুটা অর্থপূর্ণ। তবে আসন্ন বিপদের হাত থেকে নি®কৃতি পাওয়ার জন্য নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে কাব্যে আশ্রয় গ্রহণের কথা আমি বলছি না; বরং কাব্যকলায় দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টাই যে পৃথিবীতে কবির অস্বিত্বের প্রধান যুক্তি আমি একথাই বুঝাতে চাচ্ছি। এই দক্ষতা অর্জন না করা অবধি এবং সমস্যাক্রান্ত জীবনের অসঙ্গতি ও প্রচাপ, অন্যের অর্জিত ছাঁচ ও শক্তি, প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের ছাঁচ ইত্যাদি তার নিজের অর্থ ও সুরসঙ্গতিতে পুনর্বিন্যস্ত না করা পর্যন্ত কবি সংগ্রাম করে যান।’ (আধুনিক কাব্যের পটভূমি, হুমাযুন কবির অনূদিত)।

এই সুরসঙ্গতি কিংবা দক্ষতা অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রামে অপারগ কবিরাই মাইনর পোয়েটস, অবশ্য কবিতার সাম্রাজ্যে এই মাইনর কবিদেরও গুরুত্ব রয়েছে। মাইনর কবিরা থাকেন বলেই মেজর কবিদের সহজে চেনা যায়। প্রকৃত কবি সব সময়ই কবিতার মধ্যে থাকেন, এমনকি তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখনো। জীবনানন্দ দাশ যখন ট্রামের তলে চাপা পড়েছিলেন, তখনো তিনি কবিতার মধ্যেই ছিলেন। বাংলা ভাষার এই একমাত্র কবি যিনি কবিতার নিঝুম প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

‘যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো- অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে

... ... ...

আকাশের থেকে দূরে- আরো দূরে- আরো দূরে- নির্জন আকাশে

বাংলার- তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে।’

(যখন মৃত্যু ঘুমে, রূপসী বাংলা)

এই যে মৃত্যু যা তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ, এটা রোম্যান্টিক লীলালাস্য নয়, কবির জীবন-যন্ত্রণাপ্রসূত এক চিরায়ত জীবনবোধের প্রবহমানতা, যা আকাশ-নক্ষত্র কিংবা নদী-জল-মাটির সান্নিধ্যে সমুজ্বল।

ভাষার অহংকারই কবিতার মৌলিকতাকে জাগিয়ে তোলে। যুগ পরম্পরায় ভাষাই বহন করে চলে যুগ-মানসের নৃতাত্তিক-ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ। ভাষার অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে রক্তাক্ত সময়গুলোর অঙ্গীকার ও আলো। ভাষার ভিন্নতাই কোনো কবিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষাই কবিতা নয়। একজন কবির কাজ হলো ‘টু এমপ্লয় ল্যাংগুয়েজ টু কনজিয়র আপ দ্য গডস দ্যাট কন্ট্রোল আওয়ার বিয়িং।’ কবির সত্তার গহিনে খেলা করে ভাষা, কবিকে তা খুঁজে নিতে হয়। যে কবি সত্তার বিপুল আঁধারে কোনো কিছু খুঁজে পায় না, সে কখনো বড় মাপের কবি হতে পারে না। আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সে তার ভেতরের অমিত শক্তিকে জানতে চায় না। কবির ভেতরে কবির যে নিজস্ব ঈশ্বর বাস করে তাকে জাগাতে না পারলে কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। ভাষার আছে অলৌকিক গুণ। ভাষাই মন্ত্র, এই মন্ত্রই কবিকে সাহায্য করে বৃহত্তর পাঠকের হৃদয় জয় করতে। ভাষাই সর্বোপরি এক সৌন্দর্য-সৌধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবিতার অঙ্গে রেখে যায় চিরকালীন মৌলিক স্বাক্ষর। কবিতা যে উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন, তার সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা চলে না। মাকর্সবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, যা কিছু ভালো লাগে তাই-ই সুন্দর কিংবা যা কিছু মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে তাই-ই সুন্দর। কিট্স বলেছিলেন, ‘উইথ আ গ্রেট পোয়েট দ্য সেন্স অব বিউটি ওভারকামস এভরি আদার কনসিডারেশন, অর রাদার অব্লিটারেটস অল কনসিডারেশনস’ যে বিষয় নিয়েই কবিতা লেখা হোক না কেন, এই বোধ থেকে সরে দাঁড়াবার কোনো উপায় প্রকৃত কবির থাকে না। কিট্স-এর কবিতার সাথে জীবনানন্দ দাশের অন্তরঙ্গতা ছিল এবং তিনি খুব যতেœর সাথে ইয়েট্স-এর কবিতা পাঠ করেছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে তিনি খুঁজেছেন এক স্বপ্নিল সৌন্দর্যের আলাদা জগৎ এবং সেই জগতে তার রিক্ত নিঃস্ব মন গাছের মতো কিংবা কোনো পাখির মতো মিশে আছে যেন। তাঁর এই ধরনের প্রকৃতির কবিতায় আমরা দেখি তাঁর কল্পনার জগতের সাথে তাঁর কবিসত্তার নিবিড় সখ্য।

‘শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,

পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;

বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে

করুণ হয়েছে ঝাউবন

নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলরবে

ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রƒণ;

বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: ‘শান্ত হতে হবে-’

অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ’

(শিরীষের ডালপালা, বনলতা সেন)

এই আধুনিক কিংবা আধুনিক-উত্তর সময়েও আমরা এই সৌন্দর্য় চেতনার উঠোন থেকে সরে আসতে পারবো না- বলা যেতে পারে ভাষাই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই ভাষা। ভাষার অবক্ষয়িত অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন জরুরি, তেমনি দরকার ভাষার প্রগতি ও গণতান্ত্রিক প্রসারণ। ভাষা কালে কালেই বদলায়, কিন্তু ভাষার অন্তর্বয়নে থেকে যায় সেইসব কালের ধুলো, অসংখ্য মনি-মুক্তো যার মূল্যও নিতান্তই কম নয়। ভাষা বিকশিত হয় কিংবা বলা যায় ভাষার বিদ্রোহটা ফুটে ওঠে সাহিত্যে- ফিকশন কিংবা কবিতায়। নিয়ম ভেঙে কবিতায় শব্দ তার আসন গেড়ে বসে এবং ভাষার দিগন্ত বেয়ে ধেয়ে আসে নতুন দিনের হাওয়া। কবিতায় প্রথা ভেঙে এই যে ভাষার খেলা, সেখানেও কিন্তু কোনো-না-কোনো শৃঙ্খলা রয়েছে এবং সেই শৃঙ্খলার দায়বদ্ধতা কবিকেই বহন করতে হয়। তাই আজকের কবিতায় যখন আমরা সাধু ও চলিতের মিশ্রণ দেখি আমরা তাতে মোটেও বিস্মিত হয় না। কবি ব্যাকরণ মেনে চলতে অপারগ। কবিরা যুগে যুগে তাদের কবিতার ভাষায় রেখে যান এমন কিছু নতুন বিষয় বা চিহ্ন, যা ভাষাতাত্ত্বিকরা কিংবা ব্যাকরণবিদরা আবিষ্কার করেন এবং তাকে একটি সিদ্ধ নিয়মে দাঁড় করান।

মধ্যযুগীয় আবহ থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে তা নানা ভাবে-বৈচিত্র্যে বিকশিত হয়েছে। মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার দুই পথিকৃৎ, যাদের হাতে বাংলা কবিতা আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে এবং কবিতার সানন্দ মুক্তি ঘটেছে। পাশ্চাত্য-প্রভাবিত আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে তিরিশের দশকে এবং সেই দশকে বাংলা কবিতার চারপাশে জীবন ও জগতের যে শক্ত আবরণ গ্রথিত হয়, তাকে একটি মহাবৈপ্লবিক দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে। এ-সময়ের পাঁচজন কবির কবিতার ওপর ভর করে পরবর্তীতে এবং আজ অবধি বাংলা কবিতার যে মহাপ্লাবী পথ-পরিক্রমা এবং নানা বাঁকে বাঁকে নানা গুঞ্জরন, তা ঐ তিরিশের কবিদের পথ করে দেওয়া ছাড়া সম্ভব হতো না। যে কারণে বাংলা কবিতার সেই তিরিশের কাব্যান্দোলনের সমূহ বার্তাকে এক রেনেসাঁ হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। তিরিশের কবিতারই বিস্তৃতি দেখা যায় ৪০, ৫০ কিংবা ৬০-এর দশকে, যদিও চল্লিশের কিছু কবির মধ্যে অধিক সমাজ-সচেতনতা ও মার্ক্সসীয় দৃষ্টিভঙ্গির এক আলাদা স্বর লক্ষ করা যায়। তিরিশের এই পাঁচজন কবির মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সর্বাধিক প্রভাবসঞ্চারী ও প্রতিনিধিত্বকারী কবি হিসেবে তার পরের কবিদের আলোড়িত করেছেন, তাদের নতুন ভাষায় নতুন কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি আজ কবিদের কবি। এক নতুন বোধের শিহরণ ও আলোড়ন দেখি তাঁর অনেক কবিতায়। কবিতার এমন এক গল্পের ভেতরে আমাদের নিয়ে যান তিনি যে আমরা সেই গল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রচ-ভাবে অসহায় বোধ করি।

‘মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে

শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী

কেমন আশ্চর্য গান গায়;

বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;

গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে

রাত্রির বর্ণের মতো কালো-কালো শিকারী বেড়াল

প্রেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে;’

(এই সব দিনরাত্রি : বেলা অবেলা কালবেলা)

এই কতিায় ফ্রয়েডীয় অবদমনের (জবঢ়ৎবংংরড়হ) ইঙ্গিত রয়েছে। এছাড়া এই কবিতার ভাষিক আয়োজন এমনই সব চিত্রকল্পের কাছাকাছি নিয়ে যায় আমাদের যে আমরা শুধু ভেবে যেতে পারি এই কবির সৃষ্টি কৌশলের অভিনবত্ব ও সংগ্রাম। ভাবনার নতুন দিগন্তের খোঁজে তাঁর মন ও হৃদয় যেন সারাক্ষণ এক অবিচল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ডুবে থেকেছে নতুন দিনের কবিতার জন্যে, কবিতার নতুন পথ তৈরির অদম্য আশায়।

তার কবিতায় আছে বেদনার উন্মেষ অথবা উন্মেষের বেদনা যা তার ব্যক্তিমানসের এক নিষ্ঠুর অমোঘ বাস্তবতা। এই বাস্তবতা থেকে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও বেরুতে পারেননি। হয়তো সেই বেদনার অন্তঃস্থ আঙুররসের উন্মাদনাই তার বোধের জগতের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। এই শক্তি বাংলা কবিতায় কেবল তারই ছিল। তার কবিতার হৃদয়মুখী এই বেদনা-বিধুর টান আমাদের চিরহরিৎ মনের জানালায় যে অভিঘাত ফেলে যায়, সেই কম্পন, সেই উদাস মেঘমালার দূর দিগন্তের ইশারা, সেই নিঃসঙ্গ পাখিটির উড়াল-ছায়ার অশ্রুত গান কিংবা ছায়াঘন মৌলিক উড়ালের দিগন্তপ্লাবী বিচ্ছুরণই তার কবিতার অন্য এক আলো, যে আলোর নিহিতার্থে কোনো তথাকথিত ব্যাকরণ নেই, আছে অন্তর্লীন সৃজনের সেইসব অভিলাষী দুপুর এবং তার ভেতরের শস্যখেত, বিস্তৃত মাঠ কিংবা মাঠ থেকে বেরিয়ে আসা জঙ্গলের বাতাস- এইসব ভিন্নতা, বাঙালি-মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, হাওয়া-সৈকতে, মৌলিক রসের আঙিনায়।

‘পৃথিবী প্রবীণ আরো হ’য়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে;

বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।

ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই- সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে

নড়িতেছে- জ্বলিতেছে- মায়াবীর মতো জাদুবলে।

সে-আগুন জ্ব’লে যায়- দহেনাকো কিছু।

সে-আগুন জ্ব’লে যায়

সে-আগুন জ্ব’লে যায়

সে-আগুন জ্ব’লে যায় দহেনাকো কিছু।’

(একটি কবিতা, সাতটি তারার তিমির)

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যা পড়ুন)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

জীবনানন্দ দাশ

সময়োত্তরের কবি

কামরুল ইসলাম

জীবনানন্দ দাশ / জন্ম : ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৯; মৃত্যু : ২২ অক্টোবর ১৯৫৪ প্রতিকৃতি : মাসুক হেলাল

রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩

কবি জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন- “কবিতা কী, এ-জিজ্ঞাসার কোনো আবছা উত্তর দেওয়ার আগে এটুকু অন্তত স্পষ্টভাবে বলতে পারা যায় যে, কবিতা অনেক রকম। হোমরও কবিতা লিখেছিলেন, মালার্মে, র্যাঁবো ও রিলকেও। শেক্সপিয়র, বদলেয়র, রবীন্দ্রনাথ ও এলিয়টও কবিতা রচনা করে গেছেন। কেউ-কেউ কবিকে সবের ওপরে সংস্কারকের ভূমিকায় দ্যাখেন; কারো-কারো ঝোঁক একান্তই রসের দিকে। কবিতা রসেরই ব্যাপার, কিন্তু এক ধরনের উৎকৃষ্ট চিত্তের বিশেষ সব অভিজ্ঞতা ও চেতনার জিনিস- শুদ্ধ কল্পনা বা একান্ত বুদ্ধির রস নয়।” (শ্রেষ্ঠ কবিতার ভূমিকা)

কবিতা বা শিল্পকে কোনো বিশেষ সংজ্ঞার আওতায় আনা মুশকিলই বটে। আমার কাছে কবিতা কিংবা শিল্পকে মনে হয় ‘ঞযব ড়িড়ফং ধৎব ষড়াবষু, ফধৎশ ধহফ ফববঢ়’ কিংবা ‘শ্রাবণসন্ধ্যায় যে মেঘ ভেসে গেল, ছুঁয়ে গেল বেদনার বাড়ি’। অপার বেদনার ছিন্নমূল বারান্দায় দাঁড়িয়ে এক রহস্যঘন বনভূমির আঁধারে যা দেখা যায় (আশরীর ছায়া) তার ভেতরে কবির আত্মা মলযুদ্ধে মত্ত। তাই প্রকৃত কবিতার শরীরে কোথাও না কোথাও দেখতে পাওয়া যায় প্রসবের রক্তচিহ্ন। কবিতার টেক্সটকে রক্তাক্ত গোধূলির মতো মনে হয় আমার কাছে। জীবনের খসে যাওয়া অংশগুলোই কবিতার সবুজ হাওয়ায় নেচে নেচে দোল খায়, এইসব নাচের মুদ্রায় মৃত্যুর সম্মোহন কিংবা জাগৃতির গন্ধ লেগে থাকে। মরণের ভোর ভোর আলোয় কবি কিংবা শিল্পী হয়তো দেখে যান কিংবা যান না সৃষ্টির এইসব চিরায়ত সবুজের বিবিধ তৈজস। কবি জীবনানন্দ দাশ সৃষ্টির অপার আনন্দকে খুঁজেছেন মৃত্যুর ত্রিভূজ সীমানায়, জীবনের অন্য এক স্রোতে- যেখানে মিশে আছে অন্তর্গত বিষাদ কিংবা নৈরাশ্যে নিষিক্ত এক দূরন্বয়ী চেতনা যা বিপন্ন বিস্ময়ের ঐশ্বর্যে রক্তিম।

‘আবার আকাশে অন্ধকার ঘন হয়ে উঠছে :

আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার।

যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে

অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখিনি,

সেই নারীর মতো

ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়ে উঠেছে।’

(নগ্ন নির্জন হাত)

এই কবিতার কল্পচিত্র এবং বাকরীতির নতুনত্ব সে-সময়ে তো বটেই, আজকেও অনেকখানি অবাক করার মতো। তিনি মূলত চিত্রকল্পের কবি। নানা রকম চিত্রকল্পের সমাহার দেখা যায় তাঁর কবিতায়। এজরা পাউন্ড অ Few Donts by an Imagiste (১৯১৩) গ্রন্থে লিখেছেন-

“An ‘Image’ is that which presents an intellectual and emotional complex in an instant of time. I use the term ‘complex’ rather in the technical sense employed by the newer psychologists, such as Hart, though we might not agree absolutely in our application.”

চিত্রকল্পের সাথে জড়িয়ে থাকে জটিল আবেগীয়, বুদ্ধিবৃত্তিক অনুষঙ্গ, মনোজগতের নানা আবহ। কবির সৃজনীশক্তিরই প্রকাশ এই চিত্রকল্প কখনো গুচ্ছ চিত্রকল্প কিংবা সাবলাইম চিত্রকল্প হিসেবে কবিতায় এক ছায়াঘন নিবিড় অখ- বোধকে স্থিরিকৃত করে। জীবনানন্দের কবিতায় অনেক ইন্দ্রিয়জ চিত্রকল্পের দেখা পাওয়া যায়- যা প্রকৃতি ও ঐতিহ্যের সমন্বয়ে কখনো কখনো ইন্দ্রিয়াতীত ব্যাপার হয়েও দাঁড়ায়।

‘আমরা দেখেছি যারা নিবিড় বটের নিচে লাল লাল ফল

পড়ে আছে; নির্জন মাঠের ভিড় মুখ দেখে নদীর ভেতরে,

যত নীল আকাশেরা রয়ে গেছে খুঁজে ফিরে আরো নীল আকাশের তল

পথে পথে দেখিয়াছি মৃদু চোখ ছায়া ফেলে পৃথিবীর ’পরে;

আমরা দেখেছি যারা সুপুরির সারি বেয়ে সন্ধ্যা নেমে আসে রোজ,

প্রতিদিন ভোর আসে ধানের গুচ্ছের মতো সবুজ সহজ;’

এই কবিতায় কবি রঙের বৈচিত্র্যে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রকল্প তৈরির প্রয়াস নিয়েছেন। জীবনানন্দ দাশের চিত্রকল্পের বৈচিত্র্য আমাদের বিস্মিত করে বৈকি। তার কবিতায় নানা ধরনের রঙের ব্যবহার তাঁকে অন্যের থেকে আলাদা করে তুলেছে। কোন রঙ কখন ব্যবহার করতে হয়, তা বোধ করি জীবনানন্দের সমকালীন কোনো বাঙালি কবি অতোটা সুচারুভাবে জানতেন বলে মনে হয় না। তবে তাঁর কবিতায় অন্য রঙের ব্যবহার থাকলেও ধূসর রঙের ব্যবহারই বেশি দেখা যায়।

‘দিনের উজ্জ্বল পথ ছেড়ে দিয়ে

ধূসর স্বপ্নের দেশে গিয়ে

হৃদয়ের আকাক্সক্ষার নদী

ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায়- ঢেউ তুলে তৃপ্তি পায় যদি,

তবে এই পৃথিবীর দেয়ালের ’পরে

লিখিতে যেও না তুমি অস্পষ্ট অক্ষরে

অন্তরের কথা;’

জীবনানন্দের অনেক কবিতায় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দেখা মেলে, যেগুলো তার অবচেতনের গভীর গহন থেকে উঠে আসা, যেখানে স্বপ্ন ও কল্পনার মেলবন্ধন এইসব চিত্রকল্পকে জটিল ও রহস্যাবৃত করে তোলে। জীবনানন্দের কথা ধার নিয়েই বলা যায়, চিত্রকল্পই কবিতা নয়, তবে চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহারেই কবিত্ব

জীবনানন্দের অনেক কবিতায় পরাবাস্তব চিত্রকল্পের দেখা মেলে, যেগুলো তার অবচেতনের গভীর গহন থেকে উঠে আসা, যেখানে স্বপ্ন ও কল্পনার মেলবন্ধন এইসব চিত্রকল্পকে জটিল ও রহস্যাবৃত করে তোলে। জীবনানন্দের কথা ধার নিয়েই বলা যায়, চিত্রকল্পই কবিতা নয়, তবে চিত্রকল্পের সার্থক ব্যবহারেই কবিত্ব। স্বপ্ন ও কল্পনার যুগল সত্তায় ভাষা এক অলৌকিক জলযানে ভেসে যেতে থাকে। কবির স্বপ্ন এক নিটোল সন্ন্যাস, কখনো কখনো সেই স্বপ্নের একটি স্থায়ী ঠিকানার জন্ম দেয় কোনো কবিতা। কোনো শিল্পী বা কবির জীবনে বাস্তবতা যত রূঢ় হয়, যতটা কঠিন যন্ত্রণাময় সময়ের মধ্য দিয়ে কবি পথ হাঁটেন, তাঁর স্বপ্নও ততোটা গভীর হয়। স্বপ্নকে আশ্রয় করে কবি রাস্তা খোঁজেন বেঁচে থাকার।

‘স্বপ্নের ভিতরে বুঝি- ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে

দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে

হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;

বাতাস ঝরিছে ডানা - মুক্তা ঝ’রে যায়

পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে- বনে বনে- হরিণের চোখে;

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তার আলোকে।

হীরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে

হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,-

বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,

ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।

বাতাস ঝাড়িছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে -

হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।’

(হরিণেরা, রনলতা সেন)।

এই ধরনের চিত্রকল্পের উন্মেষ তাঁরই গভীর স্বপ্নগত আবেগের বহিঃপ্রকাশ। অবচেতন থেকে উঠে আসা এইসব সজীব পরাবাস্তব চিত্রকল্প জীবনানন্দ দাশের কবিতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ফ্রয়েডের মতে, An unconscious impulse creates the poem no less than the dream; it provides the mental energy required for its formation. (The Theory of Regression)

২.

কোনো জাতির শেষ আশ্রয় সে জাতির কবিতা- যেখানে লুকিয়ে থাকে তার প্রাণ ও ঐশ্বর্য, আর এ প্রাণৈশ্বর্য-সঞ্চারকারী ব্যক্তিটি কবি, যিনি ভেতরে বিষের বালি নিয়ে মুখ বুঁজে মুক্তো ফলান, যার রক্তাক্ত হৃদয়ের তীরে কেবল তার নিজস্ব ঈশ্বর ছাড়া আর কারো ছায়াপাত ঘটে না, যিনি নিঃসঙ্গ, নিস্ব এবং একা। তার মস্তিষ্কের জরায়ু চুইয়ে নেমে আসা শব্দ-উপমার অন্তঃশীলা স্রোতের মধ্যে যে রুপালি-সোনালি শস্যের অধরা গুঞ্জন আমাদের নান্দিক চৈতন্যের পালে হাওয়া লাগিয়ে আমাদের নিয়ে যায় ভিন্ন জগতে, তা কোনো মানবিক অভিজ্ঞানেরই রূপান্তর নাকি এক পর্যটক আলোর দুপুর, যাকে সান্নিধ্যের সুতোয় বেঁধে আমরা তা ওড়াতে ওড়াতে নীড়ে ফেরা পাখিদের দলে ঠেলে দিই- এসবের কোনো ত্বরিৎ মীমাংসা নেই। yeats লিখেছেন: Out of our quarrel with ourselves we make poetry. কবিতা কীভাবে তৈরি হয়- এ বিষয়ে একটি সাদামাটা মতামত যদিও আমাদের বিভ্রান্ত করে, তথাপি এসব কথা আমাদের হরহামেশাই শুনতে হয়, শোনা লাগে। কারণ, কবিতা তৈরির রসায়ন ও রহস্য জানার এক অদম্য ব্যাকুলতার মধ্যে কবি কিংবা কোনো কবিতা-প্রেমিকের দিন অতিবাহিত হয়। কবি কি নিজেই জানেন কীভাবে তার ভাবনার দুয়ার ঠেলে নাচতে নাচতে বেরিয়ে আসে কবিতারা? কবিতার সমূহ সূর্যালোকে দাঁড়িয়েও কি কোনো কবি বোঝেন কবিতা আসলে কী? কবিতা কেবলই সঙ্গহীন এক বিনীত সুন্দর- যা একই সাথে সম্ভ্রান্ত ও সন্ত্রস্ত, যার দুয়ারে দাঁড়িয়ে কেবল হাত পেতে চাওয়া যায়। কবিতার ভাঁড়ার থেকে এই চাওয়া-পাওয়ার হিসেব নিয়ে কোনো আলোচনারও দরকার পড়ে না। কারণ, চাওয়াটার মধ্যেই আনন্দ, সেই আনন্দে যারা প্রীত হতে জানেন তারাই কেবল কবিতার সংসারে মেনে যান। জীবনানন্দ দাশ কবিতার সংসারে সেই মেনে যাওয়া মানুষ, যাকে কবিতার বারামখানায় আকাশ ও নক্ষত্রের ঐশী আলোয় চিত্ত-বিমোচনের সাধনায় আমরা সিক্ত হতে দেখেছি।

‘সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিলো- আকাশে এক তিল

ফাঁক ছিলো না;

পৃথিবীর সমস্ত ধূসর প্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি;

অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চূড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির-ভেজা চোখের মতো

ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা;

জ্যোৎস্নারাতে বেবিলনের রানীর ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার

শালের মতো জ্বলজ্বল করছিলো বিশাল আকাশ!

কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো।’

(হাওয়ার রাত)

‘হাওয়ার রাত’ কবিতাটি আমার কাছে তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে মনে হয়েছে। এই কবিতার ব্যাপ্তি ও গভীর উজ্জ্বল শব্দ-সম্ভারের সংকেতময় আবহ কোনো কবিতা-পাঠককে নিয়ে যায় অনেক দূরের শূন্যে, এ যেন এক মহান দ্রষ্টার তৃতীয় নয়নের অবিরাম ছুটে চলা আকাশ-নক্ষত্রের বারান্দায় বারান্দায়।

চর্যাপদ থেকে আজ অবধি কত শত কবিতা লেখা হয়েছে, সে-হিসেব আমাদের কাছে গৌণ এ-কারণে যে, কাল পরম্পরায় কবিতার ইতিহাস জাগরূক সত্যের চর্চিত সমন্বয় মাত্র- যাকে আমরা অসংখ্য চিহ্ন ও সময়ব্যাপ্তির সূত্রগুলোয় খুঁজে পাই। ফলে একটি কাল-পরিচয়ের মধ্যে কবিতারও এক ধরনের পরিচয় আভাসিত হয় এবং বোধের জানালায় সেগুলোর চেহারা উদ্ভাসিত হলে আমরা কেবল কিছু মুখস্থ সূত্র কিংবা উপরিতলের ছায়াকে ঘিরে কাগজ ব্যয় করে একটি আলোচনা কিংবা ডিসকোর্স তৈরি করি। এই নির্মাণ আবার বিনির্মিত হয়ে ফিরে আসে, এতে শিল্প কিংবা কবিতার কতটুকু পাওয়া সম্ভব সে বিষয়ে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। তবু আমরা লিখি, লিখছি- কখনো অনুরুদ্ধ হয়ে কখনো স্ব-প্রণোদনায় এবং এইভাবে অজস্র লেখার মধ্যে ভেসে উঠছে কবিতার রহস্যাবলি নানা ধরনের বিশ্বাসের রঙ মেখে। সেই রঙগুলো কখনো চোখ ধাঁধানো, কখনো বিনম্র ভাবের উন্নাসিকতায় আচ্ছন্ন আবার কখনো কৌশলী বিচ্ছিন্ন চেতনায় অন্বিষ্ট। তবে একথা মানতেই হয় যে, হয়ে ওঠার পথে কবিতার জাত বিচার বড়ই কঠিন কাজ এবং প্রকৃত কবিতা চেনার বিষয়ও কোনো বিশেষ কালখ-ের কোনো ব্যাপার নয়। অনুভূতির গভীরতল থেকে কিংবা অবচেতনের দেশ থেকে আলো না এলে কবিতা হয় না। আমরা জীবনানন্দ দাশ থেকে পাই : ‘মানুষের ভাষা তবু অনুভূতির দেশ থেকে আলো/না এলে নিছক ক্রিয়া; বিশেষণ; এলোমোলা নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল।’ বাকরীতির এক অভিনব বিন্যাস, শব্দের স্বাভাবিক রীতি-বিরুদ্ধ ব্যবহার ও ব্যবহৃত শব্দের স্বচ্ছন্দে চলনের ক্যারিশমা জীবনানন্দ দাশ অবিরাম কসরতেই আয়ত্ব করেছিলেন: “আমলকি গাছ ছুঁয়ে তিনটি শালিখ/কার্তিকের রোদে আর জলে/আমারি হৃদয় দিয়ে চেনা তিন নারীর মতন/সূর্য? নাকি সূর্যের চপ্পলে/পা গলিয়ে পৃথিবীতে এসে/পৃথিবীর থেকে উড়ে যায়/এ জীবনে আমি ঢের শালিখ দেখেছি /তবু সেই তিনজন শালিখ কোথায়?” (কার্তিকের ভোরবেলা)

অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত লিখেছেন- ‘ভাষার এই অকুতোভয় ব্যবহার, এই অনায়াস সঞ্চরণ, বাংলা কবিতায় এর আগে কিংবা পরে হয়েছে কিনা, সেই মর্মে সুবিনীত সংশয় প্রকাশ করা যায়।’ (জীবনানন্দ)।

আমরা বিভ্রান্ত হই, কখনো বিচলিত হই, আবার কখনো নিজের রুচি ও বিশ্বাসের তলায় খুঁজে পেতে চেষ্টা করি মাটি - কখনো খেই হারিয়ে ঘুরতে থাকি শূন্যে, কারণ নিজেরও একটা শেষ আছে, আছে একটি পরিধি- এই শেষে এসে মনে হতে থাকে ‘কোথায় আলো, কোথায় ওরে আলো! কবির হাতে তখনই সৃষ্টি হয় কবিতার যখন অন্ধকার হাড়গিলের মতো দাঁড়িয়ে থাকে কবির সামনে, মরুঝড় কিংবা অবিরল অন্ধকার কবির চোখে ঢেলে দেয় চিরকালের স্তব্ধতা, তখন দূরের কোনো সিম্ফনি বকছানার মতো ঘুরতে থাকে কবির শবাধার ঘিরে, সেই গোলচক্রের ভেতর থেকে জন্ম হয় কবিতার- ঈশ্বর স্বয়ং নিজ হাতে লালন করেন সেই কবিতা। কবিতার সত্য সম্পাদিত হয় কবির মৃত্যুতে; অজস্র মৃত্যুর মধ্যে কবিকে পথ হাঁটতে হয়, মৃত্যুময় পরানে বেজে ওঠে কবিতা- সেই কবিতার জন্য যারা প্রস্তুত মূলত তারাই কবি। জীবনানন্দ দাশ ছিলেন সেই ধরনের কবি।

‘কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেন;

আকাশের বিরামহীন বিস্তীর্ণ ডানার ভিতর

পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল;

আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে

আমার জানালার ভিতর দিয়েসাঁই সাঁই ক’রে,

সিংহের হুংকারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো।’

(হাওয়ার রাত)

বোধের কোন পরিসীমায় পৌঁছালে এরকম কবিতা লেখা সম্ভব, তা আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। আকাশ ও পৃথিবী তাঁর কবিতার বিস্তৃত দুনিয়ায় এমন এক ছায়া ফেলে আছে যে আমরা কখনোই এই ছায়ার কুহকী অবয়ব ছেড়ে তাঁর কবিতার কোনো দরজা খুঁজে পাবো না।

৩.

কবিকে সংগ্রাম করে যেতে হয়। আজীবন। সেই সংগ্রাম অবশ্যই বহুমাত্রিক এবং বহুস্তরিক- জীবনের অনেকানেক না-পাওয়ার মধ্যে সেই সংগ্রাম যেমন গ্রথিত, তেমনি সামাজিক-রাজনৈতিক- অর্থনৈতিক প্রপঞ্চের মধ্যেও যার রয়েছে সাহসিক বিস্তৃতি। তবে কবির এই সংগ্রাম মূলত কবিতার জন্য সংগ্রাম। একটি ভালো কবিতা লেখার জন্য কবিকে যে সংগ্রাম করতে হয় তা কবি ছাড়া আর কেউ বুঝবে না। কবির এই সংগ্রামকে জে. আইজাক্স এভাবে দেখেছেন:

‘অনেক সময় আমি ভেবেছি, যদিও কথাটা আপাতবিরোধী মনে হতে পারে যে, শেষতঃ সব কবিতাই কবিতা বিষয়ক এবং ‘কবিতার জন্য কবিতা’ কথাটি কিছুটা অর্থপূর্ণ। তবে আসন্ন বিপদের হাত থেকে নি®কৃতি পাওয়ার জন্য নন্দনতাত্ত্বিক অর্থে কাব্যে আশ্রয় গ্রহণের কথা আমি বলছি না; বরং কাব্যকলায় দক্ষতা অর্জনের প্রচেষ্টাই যে পৃথিবীতে কবির অস্বিত্বের প্রধান যুক্তি আমি একথাই বুঝাতে চাচ্ছি। এই দক্ষতা অর্জন না করা অবধি এবং সমস্যাক্রান্ত জীবনের অসঙ্গতি ও প্রচাপ, অন্যের অর্জিত ছাঁচ ও শক্তি, প্রতিদ্বন্দ্বী ঈশ্বরের ছাঁচ ইত্যাদি তার নিজের অর্থ ও সুরসঙ্গতিতে পুনর্বিন্যস্ত না করা পর্যন্ত কবি সংগ্রাম করে যান।’ (আধুনিক কাব্যের পটভূমি, হুমাযুন কবির অনূদিত)।

এই সুরসঙ্গতি কিংবা দক্ষতা অর্জনের দীর্ঘ সংগ্রামে অপারগ কবিরাই মাইনর পোয়েটস, অবশ্য কবিতার সাম্রাজ্যে এই মাইনর কবিদেরও গুরুত্ব রয়েছে। মাইনর কবিরা থাকেন বলেই মেজর কবিদের সহজে চেনা যায়। প্রকৃত কবি সব সময়ই কবিতার মধ্যে থাকেন, এমনকি তিনি যখন ঘুমিয়ে থাকেন তখনো। জীবনানন্দ দাশ যখন ট্রামের তলে চাপা পড়েছিলেন, তখনো তিনি কবিতার মধ্যেই ছিলেন। বাংলা ভাষার এই একমাত্র কবি যিনি কবিতার নিঝুম প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন।

‘যখন মৃত্যুর ঘুমে শুয়ে রবো- অন্ধকারে নক্ষত্রের নিচে

... ... ...

আকাশের থেকে দূরে- আরো দূরে- আরো দূরে- নির্জন আকাশে

বাংলার- তারপর অকারণ ঘুমে আমি পড়ে যাই ঢুলে।’

(যখন মৃত্যু ঘুমে, রূপসী বাংলা)

এই যে মৃত্যু যা তার কবিতার অন্যতম অনুষঙ্গ, এটা রোম্যান্টিক লীলালাস্য নয়, কবির জীবন-যন্ত্রণাপ্রসূত এক চিরায়ত জীবনবোধের প্রবহমানতা, যা আকাশ-নক্ষত্র কিংবা নদী-জল-মাটির সান্নিধ্যে সমুজ্বল।

ভাষার অহংকারই কবিতার মৌলিকতাকে জাগিয়ে তোলে। যুগ পরম্পরায় ভাষাই বহন করে চলে যুগ-মানসের নৃতাত্তিক-ঐতিহাসিক প্রপঞ্চ। ভাষার অন্ধকারেই লুকিয়ে থাকে রক্তাক্ত সময়গুলোর অঙ্গীকার ও আলো। ভাষার ভিন্নতাই কোনো কবিকে স্বতন্ত্র করে তোলে। তবে মনে রাখতে হবে, ভাষাই কবিতা নয়। একজন কবির কাজ হলো ‘টু এমপ্লয় ল্যাংগুয়েজ টু কনজিয়র আপ দ্য গডস দ্যাট কন্ট্রোল আওয়ার বিয়িং।’ কবির সত্তার গহিনে খেলা করে ভাষা, কবিকে তা খুঁজে নিতে হয়। যে কবি সত্তার বিপুল আঁধারে কোনো কিছু খুঁজে পায় না, সে কখনো বড় মাপের কবি হতে পারে না। আধুনিক মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, সে তার ভেতরের অমিত শক্তিকে জানতে চায় না। কবির ভেতরে কবির যে নিজস্ব ঈশ্বর বাস করে তাকে জাগাতে না পারলে কবিতা অর্থহীন হয়ে পড়তে বাধ্য। ভাষার আছে অলৌকিক গুণ। ভাষাই মন্ত্র, এই মন্ত্রই কবিকে সাহায্য করে বৃহত্তর পাঠকের হৃদয় জয় করতে। ভাষাই সর্বোপরি এক সৌন্দর্য-সৌধ নির্মাণের মধ্য দিয়ে কবিতার অঙ্গে রেখে যায় চিরকালীন মৌলিক স্বাক্ষর। কবিতা যে উদ্দেশ্যেই লেখা হোক না কেন, তার সৌন্দর্যকে বাদ দিয়ে তার কোনো ব্যাখ্যা চলে না। মাকর্সবাদী নন্দনতাত্ত্বিকদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, যা কিছু ভালো লাগে তাই-ই সুন্দর কিংবা যা কিছু মানুষের মঙ্গলের জন্য অথবা ভালো কিছুর ইঙ্গিত করে তাই-ই সুন্দর। কিট্স বলেছিলেন, ‘উইথ আ গ্রেট পোয়েট দ্য সেন্স অব বিউটি ওভারকামস এভরি আদার কনসিডারেশন, অর রাদার অব্লিটারেটস অল কনসিডারেশনস’ যে বিষয় নিয়েই কবিতা লেখা হোক না কেন, এই বোধ থেকে সরে দাঁড়াবার কোনো উপায় প্রকৃত কবির থাকে না। কিট্স-এর কবিতার সাথে জীবনানন্দ দাশের অন্তরঙ্গতা ছিল এবং তিনি খুব যতেœর সাথে ইয়েট্স-এর কবিতা পাঠ করেছিলেন। প্রকৃতির মধ্যে তিনি খুঁজেছেন এক স্বপ্নিল সৌন্দর্যের আলাদা জগৎ এবং সেই জগতে তার রিক্ত নিঃস্ব মন গাছের মতো কিংবা কোনো পাখির মতো মিশে আছে যেন। তাঁর এই ধরনের প্রকৃতির কবিতায় আমরা দেখি তাঁর কল্পনার জগতের সাথে তাঁর কবিসত্তার নিবিড় সখ্য।

‘শিরীষের ডালপালা লেগে আছে বিকেলের মেঘে,

পিপুলের ভরা বুকে চিল নেমে এসেছে এখন;

বিকেলের শিশুসূর্যকে ঘিরে মায়ের আবেগে

করুণ হয়েছে ঝাউবন

নদীর উজ্জ্বল জল কোরালের মতো কলরবে

ভেসে নারকোলবনে কেড়ে নেয় কোরালীর ভ্রƒণ;

বিকেল বলেছে এই নদীটিকে: ‘শান্ত হতে হবে-’

অকূল সুপুরিবন স্থির জলে ছায়া ফেলে এক মাইল শান্তি কল্যাণ’

(শিরীষের ডালপালা, বনলতা সেন)

এই আধুনিক কিংবা আধুনিক-উত্তর সময়েও আমরা এই সৌন্দর্য় চেতনার উঠোন থেকে সরে আসতে পারবো না- বলা যেতে পারে ভাষাই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই ভাষা। ভাষার অবক্ষয়িত অবসাদ থেকে মুক্তি পাওয়া যেমন জরুরি, তেমনি দরকার ভাষার প্রগতি ও গণতান্ত্রিক প্রসারণ। ভাষা কালে কালেই বদলায়, কিন্তু ভাষার অন্তর্বয়নে থেকে যায় সেইসব কালের ধুলো, অসংখ্য মনি-মুক্তো যার মূল্যও নিতান্তই কম নয়। ভাষা বিকশিত হয় কিংবা বলা যায় ভাষার বিদ্রোহটা ফুটে ওঠে সাহিত্যে- ফিকশন কিংবা কবিতায়। নিয়ম ভেঙে কবিতায় শব্দ তার আসন গেড়ে বসে এবং ভাষার দিগন্ত বেয়ে ধেয়ে আসে নতুন দিনের হাওয়া। কবিতায় প্রথা ভেঙে এই যে ভাষার খেলা, সেখানেও কিন্তু কোনো-না-কোনো শৃঙ্খলা রয়েছে এবং সেই শৃঙ্খলার দায়বদ্ধতা কবিকেই বহন করতে হয়। তাই আজকের কবিতায় যখন আমরা সাধু ও চলিতের মিশ্রণ দেখি আমরা তাতে মোটেও বিস্মিত হয় না। কবি ব্যাকরণ মেনে চলতে অপারগ। কবিরা যুগে যুগে তাদের কবিতার ভাষায় রেখে যান এমন কিছু নতুন বিষয় বা চিহ্ন, যা ভাষাতাত্ত্বিকরা কিংবা ব্যাকরণবিদরা আবিষ্কার করেন এবং তাকে একটি সিদ্ধ নিয়মে দাঁড় করান।

মধ্যযুগীয় আবহ থেকে বাংলা কবিতাকে মুক্ত করেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। রবীন্দ্রনাথের হাতে এসে তা নানা ভাবে-বৈচিত্র্যে বিকশিত হয়েছে। মাইকেল ও রবীন্দ্রনাথ বাংলা কবিতার দুই পথিকৃৎ, যাদের হাতে বাংলা কবিতা আধুনিকতার স্পর্শ পেয়েছে এবং কবিতার সানন্দ মুক্তি ঘটেছে। পাশ্চাত্য-প্রভাবিত আধুনিকতার উন্মেষ ঘটে তিরিশের দশকে এবং সেই দশকে বাংলা কবিতার চারপাশে জীবন ও জগতের যে শক্ত আবরণ গ্রথিত হয়, তাকে একটি মহাবৈপ্লবিক দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে। এ-সময়ের পাঁচজন কবির কবিতার ওপর ভর করে পরবর্তীতে এবং আজ অবধি বাংলা কবিতার যে মহাপ্লাবী পথ-পরিক্রমা এবং নানা বাঁকে বাঁকে নানা গুঞ্জরন, তা ঐ তিরিশের কবিদের পথ করে দেওয়া ছাড়া সম্ভব হতো না। যে কারণে বাংলা কবিতার সেই তিরিশের কাব্যান্দোলনের সমূহ বার্তাকে এক রেনেসাঁ হিসেবেই গ্রহণ করতে হবে। তিরিশের কবিতারই বিস্তৃতি দেখা যায় ৪০, ৫০ কিংবা ৬০-এর দশকে, যদিও চল্লিশের কিছু কবির মধ্যে অধিক সমাজ-সচেতনতা ও মার্ক্সসীয় দৃষ্টিভঙ্গির এক আলাদা স্বর লক্ষ করা যায়। তিরিশের এই পাঁচজন কবির মধ্যে জীবনানন্দ দাশ সর্বাধিক প্রভাবসঞ্চারী ও প্রতিনিধিত্বকারী কবি হিসেবে তার পরের কবিদের আলোড়িত করেছেন, তাদের নতুন ভাষায় নতুন কবিতা লেখার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি আজ কবিদের কবি। এক নতুন বোধের শিহরণ ও আলোড়ন দেখি তাঁর অনেক কবিতায়। কবিতার এমন এক গল্পের ভেতরে আমাদের নিয়ে যান তিনি যে আমরা সেই গল্পের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রচ-ভাবে অসহায় বোধ করি।

‘মনে পড়ে কবে এক রাত্রির স্বপ্নের ভিতরে

শুনেছি একটি কুষ্ঠকলঙ্কিত নারী

কেমন আশ্চর্য গান গায়;

বোবা কালা পাগল মিনসে এক অপরূপ বেহালা বাজায়;

গানের ঝংকারে যেন সে এক একান্ত শ্যাম দেবদারু গাছে

রাত্রির বর্ণের মতো কালো-কালো শিকারী বেড়াল

প্রেম নিবেদন করে আলোর রঙের মতো অগণন পাখিদের কাছে;’

(এই সব দিনরাত্রি : বেলা অবেলা কালবেলা)

এই কতিায় ফ্রয়েডীয় অবদমনের (জবঢ়ৎবংংরড়হ) ইঙ্গিত রয়েছে। এছাড়া এই কবিতার ভাষিক আয়োজন এমনই সব চিত্রকল্পের কাছাকাছি নিয়ে যায় আমাদের যে আমরা শুধু ভেবে যেতে পারি এই কবির সৃষ্টি কৌশলের অভিনবত্ব ও সংগ্রাম। ভাবনার নতুন দিগন্তের খোঁজে তাঁর মন ও হৃদয় যেন সারাক্ষণ এক অবিচল নৈঃশব্দ্যের মধ্যে ডুবে থেকেছে নতুন দিনের কবিতার জন্যে, কবিতার নতুন পথ তৈরির অদম্য আশায়।

তার কবিতায় আছে বেদনার উন্মেষ অথবা উন্মেষের বেদনা যা তার ব্যক্তিমানসের এক নিষ্ঠুর অমোঘ বাস্তবতা। এই বাস্তবতা থেকে তিনি মৃত্যুর আগ পর্যন্তও বেরুতে পারেননি। হয়তো সেই বেদনার অন্তঃস্থ আঙুররসের উন্মাদনাই তার বোধের জগতের অন্যতম নিয়ামক শক্তি। এই শক্তি বাংলা কবিতায় কেবল তারই ছিল। তার কবিতার হৃদয়মুখী এই বেদনা-বিধুর টান আমাদের চিরহরিৎ মনের জানালায় যে অভিঘাত ফেলে যায়, সেই কম্পন, সেই উদাস মেঘমালার দূর দিগন্তের ইশারা, সেই নিঃসঙ্গ পাখিটির উড়াল-ছায়ার অশ্রুত গান কিংবা ছায়াঘন মৌলিক উড়ালের দিগন্তপ্লাবী বিচ্ছুরণই তার কবিতার অন্য এক আলো, যে আলোর নিহিতার্থে কোনো তথাকথিত ব্যাকরণ নেই, আছে অন্তর্লীন সৃজনের সেইসব অভিলাষী দুপুর এবং তার ভেতরের শস্যখেত, বিস্তৃত মাঠ কিংবা মাঠ থেকে বেরিয়ে আসা জঙ্গলের বাতাস- এইসব ভিন্নতা, বাঙালি-মনকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়, হাওয়া-সৈকতে, মৌলিক রসের আঙিনায়।

‘পৃথিবী প্রবীণ আরো হ’য়ে যায় মিরুজিন নদীটির তীরে;

বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।

ও-প্রাসাদে কারা থাকে? কেউ নেই- সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে

নড়িতেছে- জ্বলিতেছে- মায়াবীর মতো জাদুবলে।

সে-আগুন জ্ব’লে যায়- দহেনাকো কিছু।

সে-আগুন জ্ব’লে যায়

সে-আগুন জ্ব’লে যায়

সে-আগুন জ্ব’লে যায় দহেনাকো কিছু।’

(একটি কবিতা, সাতটি তারার তিমির)

(বাকি অংশ আগামী সংখ্যা পড়ুন)

back to top