আবদুর রাজ্জাক
একসময় বাংলা কবিতাপ্রেমীরা জীবনানন্দের কবিতার প্রতি অনীহা এবং অমনোযোগ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু বিগত প্রায় সাত দশক ধরে সেই একই জীবনানন্দকে নতুনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নন্দনতত্ত্বের দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সংবেদী পাঠক আরো-আরো বেশি জীবনানন্দকে পাঠ করে চলেছেন। কেন এই পাঠাগ্রহিতা? ভালোলাগা? তার কবিতা ভালো না লাগলে তার মূল্য কী? মূল্যহীনপাঠ কোনো কাজে আসে না। বর্তমান সময়ে জীবনানন্দপাঠ রবীন্দ্রপাঠের থেকেও এগিয়ে রয়েছে।প্রকারান্তরে রবীন্দ্রপাঠ কি থেমে গেছে? থেমে যায়নি তবে জীবনানন্দ এগিয়ে রয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতা প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের কবিতাকে ‘চিত্ররূপময়শব্দগুচ্ছ’ বলেছেন।রবীন্দ্রপাঠে একবার নিমগ্ন হলে একেবারেই ওঠা যায় না, সত্য কিন্তু জীবনানন্দপাঠ আরো এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বিশেষত তাঁর কবিতা একটি বিশেষ ঘোর সৃষ্টি করে।
‘কবিতা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে, কবিতা নিজেও জানে না’- কোলরিজ
আজ থেকে ষাট বছর আগে বাংলা কবিতাপ্রেমীরা জানতো না যে জীবনানন্দের কবিতা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! নির্জন নিসর্গের কবি ততদিনে শহরে এসেছেন। নিসর্গের ধান, শিশির, ঘাস আর লাবণ্যময়ী হেমন্তের গন্ধ ছেড়ে। ‘আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এ-পারে/ বিয়োবার দেরী নাই/রূপ ঝ’রে পড়ে তার/ শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে।’ এসব বিস্ময় ছেড়ে কবি পৃথিবীর ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি সম্পদের দিকে আকর্ষিত হয়েছেন (বাস্তবে নয়)। কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, পাঠকের চেয়ে তার কবিতার অনুকারকের সংখ্যাই বেশি। জীবনানন্দকে তিনি সামনে এনেছিলেন ঠিকই আবার কলকাতায় বসবাসকারী কবি জীবনানন্দের বিরূপ সমালোচনা তিনিই শুরু করেছিলেন।
পঞ্চপা-বদের রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতা কতখানি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সেটা বিচার্য নয়, কিন্তু জীবনানন্দ নিজ নির্মাণে, নিজস্ব ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সময় ও সমাজবাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন। আর তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন নিতান্ত ভিন্নস্বরে। ‘সন্ধ্যা আসে শিশিরের শব্দের মতোন’ ইন্দ্রিয়বিপর্যয়ী এরূপ শব্দসম্ভার তার অনুভবের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে সত্য কিন্তু হেমন্তে কাঁঠালের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ার শব্দ পঞ্চ পা-বদের কেউই শোনেননি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও না। কিন্তু জীবনানন্দ শুনেছেন। জীবনানন্দ জানতেন বিশ শতকীয় সভ্যতা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে, এবং অতীত ভ্রমণ না করে শুরু করতে হবে নতুন স্বরে, নতুন ভ্রমণে।
জীবনানন্দ দাশ ঐশী প্রেমের কবি নন, জীবনানন্দের ডায়েরিতে উল্লিখিত ‘রুরালগার্ল’ অর্থাৎ ‘গ্রামীণ কিশোরীর প্রেম’ শুধু বনলতা সেন নয়, শঙ্খমালাতেও প্রতিফলিত। বিশেষত আমরা জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক ও বিষাদের কবি বলে আখ্যায়িত করে থাকি
১৯৩৩ সালের দিকে তিনি বেশ কিছু গল্প উপন্যাস লিখেছিলেন, কিছু সম্পূর্ণ, কিছু অসম্পূর্ণ। রূপসী বাংলার কবি হয়েও তিনি ‘মহাপৃথিবীর কবি’। তিনি দূরকে আর খুব নিকটকে নিজের ভেতরেই দেখতে পেয়েছিলেন। জীবনানন্দে ঘাস ও পাখি। রবীন্দ্রনাথে ফুল, জীবনানন্দের পাখিরা আকাশ থেকে নিচে নেমে আসে আর পরবর্তী জন্মে পাখি হয়ে পৃথিবীতে ফেরার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে।
জীবনানন্দ আপ্লুত হয়েছিলেন অন্ধকারে, ধূসর জগতে। ঘাস সাম্র্রাজ্যে এবং বিদর্ভ নগরে। তাঁর অনন্ত অন্বেষা যাত্রা শেষ হয় রূপময়ী জগত নাটোরে। শুধু নাটোরেই কবির এই যাত্রাবিরতি ঘটেছে, তবে কবির এই বিরতি দু’দণ্ডের বিরতি।
শিল্পীমাত্রই যাত্রাপথের পথিক। জীবনানন্দও সুদূর অতীত থেকে যাত্রা শুরু করেছেন এক অধরা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে। কবি হুইটম্যানও শিল্পযাত্রার পথিক ছিলেন। তিনি ছিলেন নারী বিবর্জিত, তিনি কোনো প্রেমের কবিতা লেখেননি। চিরকুমার হুইটম্যান প্রেমিক হিসাবে খ্যাতনামা ছিলেন। তবে হুইটম্যানে যৌনতা রয়েছে, জীবনানন্দে রয়েছে ‘বিউটি অব ফর্ম কিংবা ফর্ম অব বিউটি’। হাজার বছর পর তিনি কোনো একজনের কাছে ফিরে এসেছেন। সমুদ্রের তীর ধরে তিনি হেঁটে এসেছেন, অন্যদিকে অডিসিয়াস দেশে ফেরার জন্য অন্তহীন বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন।
হাজার বছর ধরে খেলা করে এই কবিতাটিতে আমরা কবির শান্তিদাত্রী মানসীকে পেয়ে যাই। অন্য একটি পুরনো কবিতাতেও মানসীকে প্রশ্ন করতে দেখা যায়- ‘কোথায় গিয়েছো তুমি আজ/ এই বেলা!’
‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে আমরা সেই তুমি নামের কালো মেয়েটির দেখা পাই। যে কালো মেয়েটিকে জীবনানন্দ ভালোবেসেছিলেন কোনো এক ভোরে। কারুবাসনা উপন্যাসটি লেখার আরো বিশ বছর আগে তিনি সেই কালো মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো কুড়ি/বাইশ বছর। মেয়েটি তাদেরই আঙ্গিনার নিকটবর্তিনী ছিলেন। তাঁর নিজের লেখার সামান্য উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, “চারিদিক তাকিয়ে দেখি, শুধু মৌসুমীর কাজলঢালা ছায়া, কিশোরবেলায় যে কালো মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম কোনো এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙ্গিনার নিকটবর্তিনী ছিলো... বহুদিন আগে যাকে হারিয়েছি, আজ সে-ই যেন দিগবালিকা। পূর্ণ যৌবনে উত্তর আকাশের দিগঙ্গনা সেজে সে এসেছে। পশ্চিম আকাশের সেই বিগত জীবনের কৃষ্ণামণি। পুব আকাশে আকাশ ঘিরে তারই নিটোল কালোমুখ। নক্ষত্রমাখা রাত্রির কালোদিঘির জলে চিত্রল হরিণীর প্রতিবিম্বের মতো রূপ তার, প্রিয় পরিত্যক্ত মৌনমুখী চমরীর মতো অপরূপ। মিষ্টি, ক্লান্ত অশ্রুমাখা চোখ। নগ্ন শীতল নিরাভরণ দু’খানা হাত, ম্লান ঠোঁট... সে-ই বনলতা, আমাদের পাশের বাড়িতে কুড়ি বাইশ বছরের আগের দক্ষিণ আকাশের এক পৃথিবীতে। বাবা তার লম্বা চেহারার, মাঝ গড়নের মানুষ- শাদাদাড়ি। স্নিগ্ধ মুসলমান ফকিরের মতো দেখতে, বহুদিন হয় তিনি আর এ পৃথিবীতে নেই। কত শীতের ভোরের কুয়াশাও ভোরের রোদের সঙ্গে জড়িত তাদের সেই খড়ের ঘরখানাও নেই।’ পৃষ্ঠা ৩৯-এ লিখেছেন- ‘বছর পনের আগে দেখেছি, মানুষজন নেই, থমথমে দৃশ্য, লেবুফুল ফোটে, ঝরে যায়, হোগলার বেড়াগুলো উঁইয়ে খেয়ে ফেলেছে। চালের উপর হেমন্তের বিকেলে শালিখ আর দাঁড়কাক এসে উদ্দশ্যহীন কলরব করে। গভীররাতে জ্যোৎস্নায় লক্ষ্মীপেঁচা ঝোঁপ থেকে উড়ে আসে। খানিকটা খড় আর ধুলো ছড়িয়ে যায়। বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিলো। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, চালের বাতায় হাত দিয়ে, মা-পিসিমার সঙ্গে কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকে আসছিলো। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক, নতমুখে মাঝপথে গেলো থেমে। তারপর খিড়কির, পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক-গুগল পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভেতর দিয়ে, চলে গেলো সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে দাঁড়ালো, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো। তারপর তাকে আর দেখিনি।
অনেকদিন পর আজ আবার সে এলো, মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে। চিকন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে এসে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি অশ্রুমাখা চোখ। ঠা-া নির্জন দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা। সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন, হায় অন্ধকারে তার যাত্রা।”
এডগার এলেন পো’র ঞড় ঐবষবহ কবিতা থেকে হয়তো তিনি বনলতা সেন কবিতার কিছু উপকরণ পেয়েছেন, সেটুকু শুধু বনলতা সেন কবিতার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু আরো চারটি কবিতায় ও তিনি তার মানস প্রতিমার কথা লিখেছেন। কারুবাসনার কবি ওই কবিতাগুলিতে নিজেকে সেভাবেই প্রকাশ করেছেন।
প্রায় সকলেই বলে থাকেন জীবনানন্দ কাব্যপুরাণ, গল্প কিংবা উপন্যাসে ঐতিহাসিক যাত্রার অভিসারী। তারপরও তিনি সমকাল সম্পর্কে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। মানস প্রকৃতির সহজাত কারণে তিনি প্রকৃতির উপরেও ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। বোধ ও বোধির চমৎকার সমন্বয় তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেনি।
ধূসর জগতের কবি, নিসর্গ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এক গ্রামীণ কিশোরীর অকালমৃত্যু কবিকে কক্ষচ্যুত করে, এবং এই ঘটনা কবির কবিতায় গভীর প্রভাব ফেলে।
ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেক কাব্যগ্রন্থেই এটা লক্ষ্য করা যায়- ‘যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে/ হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরো ঝরো/ কামিনীর ব্যথার শিয়রে.../ শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা/ দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া।’
বিচ্ছেদ বেদনার আর্তি তার অনেক কবিতাতেই পাওয়া যায়- ‘জানিনে কোথায় তুমি-/ শব্দের ভেতরে সন্ধ্যা যেই আসে,/ নদীটি যখন শান্ত হয়... তখন তোমার মুখ- তোমার মুখের রূপ/ আমার হৃদয়ে এসে ভিজে গন্ধচাঁপার মতন/ ফুটে থাকে’ (জানিনা কোথায় তুমি), ‘কিংবা তুমি আর আসিবে না,/ জানি আমি-/ জীবনের প্রথম ফসল/এখন আসিছে সন্ধ্যা আর শীত আর তীব্র শিশিরের জল।’
জীবনানন্দ জীবনানন্দই! যার ভেতরে মৃত্যুবোধ ধীরে ধীরে ঘন হয়ে এসেছে। ইন্দ্রিয়বিপর্যয়ী কৌশলে প্রায় কবিতায় তিনি তার অনুভবের ছবিটি গাঢ় কোরে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কল্পনার মৃত্যুতে মহাসুন্দরও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবনানন্দের মৃত্যুতে জীবনের সম্মেলনে এক বিপুল প্রশান্তি অনুভূত হয়ে থাকে। ‘শঙ্খমালা’ কবিতায় আমরা মৃত্যুবোধের সঞ্চার অনুভব করি। ‘কড়ির মতন শাদা মুখ তার,/ দুইখানা হাত তার হিম;/ চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম/ চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়/ সে আগুনে হায়।’
কবি ইয়েটস পরিভ্রমণ করেছেন জাহাজে, সমুদ্রপথে। জীবনানন্দ পরিভ্রমণ করেছেন সমুদ্রের কিনার ধরে, হাঁটাপথে। কবির এই ভ্রমণকে আমরা তাঁর মানস ভ্রমণ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। হাজার বছরের আয়ু নিয়ে হাজার বছর পথহাঁটা সম্ভব নয়। বনলতা সেন কবিতায় ঞড় ঐবষবহ কবিতার প্রভাব নিয়ে যা কিছু বলা হোক না উল্লেখ্য যে কবি ইয়েটস-এর বহু কবিতার সাথে সেইলিং টু বাইজেন্টিয়াম কবিতাটিও কবিকে প্রভাবিত করেছিল। কিটস যখন প্রৌঢ়, জীবনানন্দ তখন মাত্র তেতাল্লিশ।
কিটস জাগতিক ভোগস্পৃহা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছেন, বিপরীতে জীবনানন্দ অনুসন্ধান করেছেন প্রেমে দু’দ- শান্তি। জীবনানন্দে আছে ধূসর আবিলতা। ইয়েটস-এর আছে, যিধঃ রং ঢ়ধংঃ ড়ৎ ঢ়ধংংরহম ঃড় সব ঢ়ধংংরহম ঃড় সব, কিটস সেই ‘গ্রেসিয়ান’ কবিতার বংশীবাদক গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজায়। আর সেই বাঁশির সুর, কাল আর সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রবহমান কাল ধরে সবুজ গাছটির নিচে বেজেই চলে।” এরপরও ইয়েটস নো কান্ট্রি ফর ওল্ডম্যান বলে বিলাপ করেছেন।
ইয়েটস এর কবিতায় যে অন্বেষণ, জীবনানন্দের অন্বেষণে সে মরীচিকা নেই। হাজার বছরের প্রবাহমানতা প্রকৃতপক্ষেই কাব্যসত্য। ইয়েটস-এর সেলিং টু বাজেনটিয়াম এবং কিটস-এর ‘অন এ গ্রেসিয়ান আর্ন-এ সেটা মূর্ত রয়েছে।’
ইয়েটসের অন্বেষণে শাশ^তকে পাওয়া যায়। কাব্যসত্যে জীবনানন্দও তাই পেয়েছেন। বাইজেন্টিয়াম আর্টের তুলনা আর বনলতার মুখের সৌন্দর্যের বর্ণনা সে-ই একই রূপেরই তুল না। জীবনানন্দের কল্পনার তীলোত্তমা আর সেইলিং টু বাইজেন্টিয়ামের শিল্পভাস্কর্যের চিত্রকল্প প্রায় একভাবে মুগ্ধ করে। জীবনানন্দের বহু কবিতায় চুল ও মুখের বর্ণনা রয়েছে- “তোমার গভীর কালো চুলের ভেতরে/ কবেকার সমুদ্রের নুন/ তোমার মুখের রেখা আজো/ মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান/ সিন্ধুর অন্ধকার থেকে এসে/ নবসূর্যের জাগার মতন/ কত কাছে/ তবু কতদূর।’’
‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটিতে- ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:/ চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;/ বালির উপরে জ্যোৎস্না- দেবদারু ছায়া/ ইতস্তত/ বিচূর্ণ থামের মতো:/ দাঁড়ায়ে রয়েছে, মৃত, ম্লান,/শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-/ ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন/ ‘মনে আছে?’
শুধুমাত্র বনলতা সেন কবিতায় আবদ্ধ না থেকে, রূপসী বাংলার মাঠ পেরিয়ে তিনি আরো কিছু অসাধারণ কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ‘পৃথিবীর ঘরের ভেতরে/ তবু আরো কিছু চাই।’
‘অনেক রাত্রিদিন’ কবিতায়- “মাঠের ভিতরে ক্রমে ছায়া নেমে আসে,/ দু’চারটে উঁচু গাছ রোদে খেলা করে। পৃথিবীতে রক্তপাত অশান্তি এখন,/ অর্থময়তা তবুও পেতে পারে মন।”... ‘বিষয়ের অনন্তহীন বাধা/ মিশে গিয়ে মানুষের প্রেম আর প্রয়াণের সীমা/ যে সব অসত্য নয়- তবুও দূরসাগর নীলিমা ডাকে ঝটিকার শব্দে- রূঢ়সূর্যে, / শত শত মৃত নাবিকের নামে/ এই পরিণাম থেকে মানুষকে উজ্জ্বল মূল্যের পরিনামে-।’ জীবনানন্দের কবিতাভুবনের বাইরের জগতটা কেমন সেটি দু’একটি কবিতায় প্রকাশ প্রায় অসম্ভব।
‘ঐদিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর/ স্কাইলাইট মাথার উপর/ পাখিরা কথা কয় পরস্পর/ তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে?/ তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিক ভাসে-’ (ধূসর পা-ুলিপি)।রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন- সমাজ সংসার মিছে, মিছে এই জীবনের কলরব/ কেবল আঁখি দিয়ে, আঁখির শুধা দিয়ে/ হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব/ আঁধারে মিশে গেছে বাকী সব। হারানো প্রেমিকার জন্য হাহাকার নয় বরং অন্বেষা ও আর্তি তাঁর অনেক কবিতায় উদ্ভাসিত।
‘শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের/ মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে/ বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা/ ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা/ সংকল্প স্বপ্নের/ উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতর।/ জানি না কোথায় তুমি- শব্দের ভেতরে যেই সন্ধ্যা আসে/ নদীটি যখন শান্ত হয়/ -তখন তোমার মুখ/ তোমার মুখের রূপ/ আমার হৃদয়ে এসে/ ভিজে, গন্ধচাঁপার মতো ফুটে থাকে’ (জানিনা কোথায় তুমি)কিংবা ‘তুমি আর আসিবে না, জানি আমি/ জীবনের প্রথম ফসল/ এখন আসিবে সন্ধ্যা আর শীত আর তীব্র শিশিরের জল।’
জীবনানন্দের প্রেমিকেরা কেমন ছিলো? কিশোরী নাকি পরিণত বয়সী? কবিতার খসরা খাতা থেকে- যতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়- ১৯১৯ সাল থেকে হারানো প্রেমিকার জন্য কবির যে আর্তি বিশেষত শঙ্খমালা ও বনলতা সেনের জন্য তা প্রায় একই আর্তি। তারা কি দুই ভিন্ন নামে পরিচিতা! পেয়ে হারানোর বেদনা ‘১৯৩৩’ কবিতাটিতে এভাবেই এসেছে, ‘তোমার শরীর- তাই নিয়ে এসেছিলে একবার/ তাই নিয়ে মানুষের ভিড়... / তোমাকে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানিনি তা... তুমি কি আসিবে প্রিয়!’
হতে পারে প্রয়াত শঙ্খমালাকেই তিনি নানা আঙ্গিকে বনলতা সেন-এ পরিণত করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রেমভাবনার সাথে জীবনানন্দের মিল রয়েছে খুবই সামান্য যা উল্লেখ করার মতো নয়। জীবনানন্দে প্রেম-পরিণতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে একাধিক গ্রন্থে’। গ্রামীণ প্রকৃতির কিশোরী শঙ্খমালার অকাল মৃত্যু গভীর প্রভাব ফেলে জীবনানন্দের কবিতায়। প্রেমের স্মৃতি মন থেকে মননে স্থায়ী রূপ নেয়। ‘অবিরল অন্ধকারের ভেতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে/ আবার ঘুমুতে চেয়েছি আমি/ অন্ধকারের স্তনের ভেতর, যোনির ভেতর/ অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।’ (অন্ধকার)
আমরা জানি যে সুররিয়ালিজমের উদ্ভব দাদাইজম থেকে, অর্থাৎ মনোলজিক এবং রিদম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে অন্তর্জগত ও বহির্জগতের দেয়াল ভেঙে অতিবাস্তবের রাজ্যে কিংবা কল্পলোকের রাজ্যের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে জীবনানন্দকে সুররিয়ালিজমের অগ্রপথিক বলা হয়ে থাকে
কারুবাসনার রচনাকাল ১৯৩৩। বনলতা সেন লিখিত ১৯৩৪ সালে। জীবনানন্দ দাশ ঐশী প্রেমের কবি নন, জীবনানন্দের ডায়েরিতে উল্লিখিত ‘রুরালগার্ল’ অর্থাৎ ‘গ্রামীণ কিশোরীর প্রেম’ শুধু বনলতা সেন নয়, শঙ্খমালাতেও প্রতিফলিত। বিশেষত আমরা জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক ও বিষাদের কবি বলে আখ্যায়িত করে থাকি। “কোনো প্রেম কিংবা কোনো স্বপ্নের, কোনোদিন মৃত্যু হয় না।” তাঁর বলার এই ধরনটাকে বিরতিহীন অন্তঃস্রোত নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।তিনি যেমন সবুজ ঘাসের দেশ বনলতার চোখের ভেতর দেখেছেন, অন্ধকারে বসেও তিনি জোনাকির আলো দেখেছেন। শুধু বিম্বিশার ধূসর জগতই নয়, হাওয়ার রাত, নগ্ন নির্জন হাত, সুরঞ্জনা, পথহাঁটা, এরকম অনেক কবিতায় ইতিহাসচারিতার সাথে স্বপ্নলোকের সৃষ্টি করেছেন তিনি, অতীতকে বর্তমানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। বেবিলনের সিংহের মূর্তি, পিরামিডের নিঃস্তব্ধতা, মিশরীয় সভ্যতা পেরিয়ে নিকট বর্তমানে এনেছেন। মাছরাঙা, শালিখ, নদী, মরুভূমি, সন্ধ্যার প্রান্তর, বস্তি, হিজল, জাম, এমনকি স্টেশনে রাত্রির প্লাটফর্মও ট্রেনের ভুবনকেও চেতনায় এনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
carried the past into the present. তাঁর মেটাফর বা রূপক পাঠককে ‘অবসন্নতা ও বিক্ষত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে’। তার কবিতায় গীতলতার ব্যবহার পাঠকের অনুভূতির বিস্তৃতি ঘটায়, এবং পরাবাস্তব বা বাস্তব রূপবাদের প্রভাব একটু বেশিই পরিলক্ষিত।
আমরা জানি যে সুররিয়ালিজমের উদ্ভব দাদাইজম থেকে, অর্থাৎ মনোলজিক এবং রিদম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে অন্তর্জগত ও বহির্জগতের দেয়াল ভেঙে অতিবাস্তবের রাজ্যে কিংবা কল্পলোকের রাজ্যের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে জীবনানন্দকে সুররিয়ালিজমের অগ্রপথিক বলা হয়ে থাকে।
এডগার এলেন পো বিস্মিত বিমুগ্ধ এক ঘনায়মান সন্ধ্যায়, দূরের জানালায় দাঁড়ানো, বন্ধু রবার্ট স্ট্যানার্ড এর মা, জেনস্টিথকে কল্পনা কোরে লিখেছিলেন টু হেলেন কবিতাটি। রোমান্টিকতা ও সৌন্দর্যকে আশ্রয় করে স্মৃতিমথিত কবিতাটি মাতৃরূপিনীকে উৎসর্গ করা।
মেজাজ ও মনোভঙ্গির ফারাক দুটি কবিতাতেই আবহ ও প্রকরণে ভিন্ন। বলা যেতে পারে যে- তিনি দ্যু-ভাল আশ্রিত কবিতাগুলি পড়েছিলেন, পড়েছিলেন ফ্যান ব্রাউনের প্রেমিক কিটসকে। এসব ক্ষীণ প্রসঙ্গ অনুষঙ্গে কিছুই যায় আসে না। শুধু ‘টু হেলেন’ নয়, ডিলা মেয়ারের লিসনার্স কবিতাটির প্রভাবের কথাও শোনা যায়। এছাড়া কোলরিজের ক্রিস্টাবেল, বা আবিসিনিয়ান মেড কবিতাটি সম্পর্কেও একই কথা উচ্চারিত। বনলতা সেন সম্পর্কে কোলরিজের কবিতার কম্যুনিকেটেড ইনটেলিজেনস শেষ পর্যন্ত মেটাফিজিক্স-এর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সমালোচক নেদারকট গেরাল্ডাইন হাবসী সুন্দরীকে, সুপার নেচারাল বলাটা যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।
পক্ষান্তরে জীবনানন্দ দাশের ভাবনা ও মেথড সম্পূর্ণ কাব্যিক। আঁর্তুর র্যাঁবোর অবচেতন মনের স্বপ্নময় ভাষা আর জীবনানন্দের ভাষা এক নয়। নয় লাস্যময়তা। মার্কিন কবি ম্যাকলিসও সময়ের উপস্থিতিকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন তাঁর অনেক কবিতায়। জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন শান্তিই খুঁজেছেন। নাটোরের রক্তমাংসের এক নারী তার শরীর দিয়ে তৃপ্তির শান্তি দিয়েছিল কবিকে। দেহের সে শান্তি দু’দ-ই ছিল বটে। যদিও অন্ধকার দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এর একটি হলো ব্যর্থতাজনিত অন্ধকার। অন্যটি মহাকাল উৎসারিত চিরন্তন অন্ধকার। ‘প্রেমের অপূর্ব শিশুর আরক্ত বাসনা ফুরাত না / যদি / আহা আমাদের হৃদয়ের থেকে।’ধূসরতার বাইরে থেকেও কবিকে ভাসিয়ে তোলেন অন্য কোনো প্রসঙ্গ। ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/ জানি;/ তারপর আমাদের দুস্থ হৃদয়/ কি নিয়ে থাকিবে বলো (দুজন)।’
তিনি দান্তে কিংবা ব্রাউনিং-এর মতো প্রেম এবং ঈশ্বরকে একাত্মকরণের চেষ্টা করেননি। ডিভাইন কমেডিতে দান্তে বিয়ত্রিচে যে আস্থা, জীবনানন্দের এরকম কোনো আস্থা ছিলো না। এ জন্যই তিনি স্থবিরতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ‘স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বলো তো!’
বনলতাকে খুঁজতে তিনি হাজার বছর ক্ষয় করেছেন। মৃত্যুচিন্তা তাকে গ্রাস করেছে, কিন্তু তিনি অপসৃত হননি। এ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা কিংবা রোমিও জুলিয়েটকেও মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়াতে হয়েছিলো। হেগেল স্পিরিচুয়াল রিয়েলিটির কথা বলেছেন। জীবনানন্দও সেই জীবন সৃষ্টি করেছেন। ধূসর এবং নির্জনতার বাইরে যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, হাইড্রেন্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/ অথবা সেই হাইড্রেন্ট গিয়েছিলো ফেঁসে/ এখন দুপুর রাত, নগরীতে দল বেঁধে নামে।/ একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেলো কেশে, অস্থির পেট্রোল ঝেড়ে/ সতত সতর্ক থেকে তবু কেউ যেনো/ ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে/ তিনটি রিক্সা ছুটে মিশে গেলো/ শেষ গ্যাসল্যাম্পে/ মায়াবীর মতো যাদুবলে। নবাগত কবিকে অন্নদাশঙ্কর রায় শুদ্ধতম কবি আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন, পরে আব্দুল মান্নান সৈয়দ ওই নামটিই তাঁর গবেষণালব্ধ বইয়ের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র আলাদা ধরনের কবি অভিধায় অভিহিত করেছেন তাঁকে।
‘বাতাসে ধর্মের কলও নড়ে ওঠে/ নড়ে চলে ধীরে/ সূর্যসাগর তীরে, মানুষের তীক্ষè ইতিহাসে/ কত কৃষ্ণ জননীর/ মৃত্যু হলো রক্তে- উপেক্ষায়: বুকের সন্তান তবু / নতুন সংকল্পে আজো আসে/ প্রতিমার প্রায়/ নগর গুঞ্জন ক্ষান্ত নক্ষত্র নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়’। ‘শিপ্রা নদীর পারে আরতি থামিয়ে গেলো শিবের মন্দিরে।’ (শিপ্রা নদীর পারে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কিংবা কালীদাসের যক্ষপ্রিয়া, ভারত চন্দ্রের কস্তরী, বা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক নায়িকারা কি জীবনানন্দকে আলোড়িত করেনি? টি এস এলিয়ট ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ ঃযব ঞযব রহফরারফঁধষ ঞবষবহঃ প্রবন্ধে বনলতা সেন সম্পর্কে বলেছেন- ‘It (Tradition) involves... the historical sense...; and the historical sense involves a Perception, not only of the pastness of the past but of its presence, which is a sense of the timeless as well as of the temporal together, is what makes a writer traditional.’
জীবনান্দের ইন্দ্রিয় তার নিজস্বসীমা অতিক্রম করে অন্য অভিজ্ঞতায় চলে যায়। রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যগ্রন্থের ‘স্বপ্ন’ কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “একজন শ্রেষ্ঠতম কবির কাব্যে তাঁর যুগ এমন মানবীয় পূর্ণতায় প্রতিফলিত হয় যে-সে যুগেও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পথে, ভাবে বা ভাষায়, কবিতার ইঙ্গিতে বা নিহিত অর্থে, সেই মহাকবিকে এড়িয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।”
ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ, তাঁর সাহিত্য প্রেরণার প্রধান উৎস। ইংরেজি সাহিত্যপাঠ দ্বারা তিনি উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত, প্রভাবিত এবং সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছিলেন। ইংরেজি শিল্প সম্ভারের যাদুস্পর্শে তিনি অমর সব কবিতা লিখেছেন। যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ঊর্বশী কবিতাটি পড়ি তখন আমরা সুইনবার্নের- যখন বর্ষশেষ কবিতাটি পড়ি তখন শেলির ওয়েস্ট- ‘জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ জীবনানন্দের এই লাইনটি কবি কিটসের ইনডিমিয়ন বুক-২-এর দুটি লাইনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কলকাতায় এসে কবি তার ইন্দ্রিয়সীমা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন এবং তিনি অনেক জায়গায় অনেক জটিল চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। রিয়ালিজম এবং ম্যাজিক রিয়ালিজম তাঁর কবিতায় অন্য রকম সুর পেয়েছে। ‘কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে’ নগর জীবনের রূঢ় বাস্তবতার এই চিত্রটি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।জীবনানন্দ শুধু রূপসী বাংলার কবি, বনলতা সেনের কবি, এমনটা সঠিক নয়। রূপসী বাংলার ধূসর গন্ধ রেখে যেন অন্য এক জীবনানন্দ এভাবেই বলেন, ‘কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে কিংবা শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর।’
অন্ধকার কবিতায়, ‘আমি/ অন্ধকারের স্তনের ভিতর, / যোনির ভিতর/ অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে/ থাকতে চেয়েছি।’ জীবনানন্দের অনেক কবিতার বিষয় এক হলেও, ব্যঞ্জনা এক নয়। তাঁর ভাষা এবং ছন্দের মধ্যেও রয়েছে প্রচলিতের বিরোধ। কোনো এক প্রসঙ্গে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি বলেছেন যে, আমার প্রকৃতি সব সময় ধূসর, তা কিন্তু নয়।একথার পরিপ্রক্ষিতে আমরা ধরে নিতে পারি যে-প্রকৃতি কিংবা ধূসরতাই জীবনানন্দ নন। কাললগ্ন মানুষও তাঁর কবিতার উৎস। ‘আমার এ আঁখি উৎসুক পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ দূর হতে নিভৃতে প্রদীপ জ্বালান দেখেছেন। একারণেই রবীন্দ্রনাথের আঁখি উৎসুক আর জীবনানন্দের কল্পনার রাজ্যে অশরীরী ছায়ার বিশেষ আনাগোনা ভিন্ন আঙ্গিকে।
আবদুর রাজ্জাক
রোববার, ২৬ নভেম্বর ২০২৩
একসময় বাংলা কবিতাপ্রেমীরা জীবনানন্দের কবিতার প্রতি অনীহা এবং অমনোযোগ দেখিয়েছিলেন, কিন্তু বিগত প্রায় সাত দশক ধরে সেই একই জীবনানন্দকে নতুনভাবে আবিষ্কারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নন্দনতত্ত্বের দিক দিয়ে বাংলা সাহিত্যের সংবেদী পাঠক আরো-আরো বেশি জীবনানন্দকে পাঠ করে চলেছেন। কেন এই পাঠাগ্রহিতা? ভালোলাগা? তার কবিতা ভালো না লাগলে তার মূল্য কী? মূল্যহীনপাঠ কোনো কাজে আসে না। বর্তমান সময়ে জীবনানন্দপাঠ রবীন্দ্রপাঠের থেকেও এগিয়ে রয়েছে।প্রকারান্তরে রবীন্দ্রপাঠ কি থেমে গেছে? থেমে যায়নি তবে জীবনানন্দ এগিয়ে রয়েছেন। জীবনানন্দের কবিতা প্রাসঙ্গিকতায় রবীন্দ্রনাথ জীবনানন্দের কবিতাকে ‘চিত্ররূপময়শব্দগুচ্ছ’ বলেছেন।রবীন্দ্রপাঠে একবার নিমগ্ন হলে একেবারেই ওঠা যায় না, সত্য কিন্তু জীবনানন্দপাঠ আরো এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বিশেষত তাঁর কবিতা একটি বিশেষ ঘোর সৃষ্টি করে।
‘কবিতা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে, কবিতা নিজেও জানে না’- কোলরিজ
আজ থেকে ষাট বছর আগে বাংলা কবিতাপ্রেমীরা জানতো না যে জীবনানন্দের কবিতা শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে! নির্জন নিসর্গের কবি ততদিনে শহরে এসেছেন। নিসর্গের ধান, শিশির, ঘাস আর লাবণ্যময়ী হেমন্তের গন্ধ ছেড়ে। ‘আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই- নুয়ে আছে নদীর এ-পারে/ বিয়োবার দেরী নাই/রূপ ঝ’রে পড়ে তার/ শীত এসে নষ্ট ক’রে দিয়ে যাবে তারে।’ এসব বিস্ময় ছেড়ে কবি পৃথিবীর ঐশ্বর্য সমৃদ্ধি সম্পদের দিকে আকর্ষিত হয়েছেন (বাস্তবে নয়)। কবি বুদ্ধদেব বসু বলেছিলেন, পাঠকের চেয়ে তার কবিতার অনুকারকের সংখ্যাই বেশি। জীবনানন্দকে তিনি সামনে এনেছিলেন ঠিকই আবার কলকাতায় বসবাসকারী কবি জীবনানন্দের বিরূপ সমালোচনা তিনিই শুরু করেছিলেন।
পঞ্চপা-বদের রবীন্দ্রনাথকে অস্বীকার করার প্রবণতা কতখানি প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল সেটা বিচার্য নয়, কিন্তু জীবনানন্দ নিজ নির্মাণে, নিজস্ব ভাষায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনি সময় ও সমাজবাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে নিজেকে সাজিয়ে নিয়েছেন। আর তিনি তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেছেন নিতান্ত ভিন্নস্বরে। ‘সন্ধ্যা আসে শিশিরের শব্দের মতোন’ ইন্দ্রিয়বিপর্যয়ী এরূপ শব্দসম্ভার তার অনুভবের বিচ্ছুরণ ঘটিয়েছে সত্য কিন্তু হেমন্তে কাঁঠালের পাতা হলুদ হয়ে ঝরে পড়ার শব্দ পঞ্চ পা-বদের কেউই শোনেননি, এমনকি রবীন্দ্রনাথও না। কিন্তু জীবনানন্দ শুনেছেন। জীবনানন্দ জানতেন বিশ শতকীয় সভ্যতা ভেঙে খান খান হয়ে যাবে, এবং অতীত ভ্রমণ না করে শুরু করতে হবে নতুন স্বরে, নতুন ভ্রমণে।
জীবনানন্দ দাশ ঐশী প্রেমের কবি নন, জীবনানন্দের ডায়েরিতে উল্লিখিত ‘রুরালগার্ল’ অর্থাৎ ‘গ্রামীণ কিশোরীর প্রেম’ শুধু বনলতা সেন নয়, শঙ্খমালাতেও প্রতিফলিত। বিশেষত আমরা জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক ও বিষাদের কবি বলে আখ্যায়িত করে থাকি
১৯৩৩ সালের দিকে তিনি বেশ কিছু গল্প উপন্যাস লিখেছিলেন, কিছু সম্পূর্ণ, কিছু অসম্পূর্ণ। রূপসী বাংলার কবি হয়েও তিনি ‘মহাপৃথিবীর কবি’। তিনি দূরকে আর খুব নিকটকে নিজের ভেতরেই দেখতে পেয়েছিলেন। জীবনানন্দে ঘাস ও পাখি। রবীন্দ্রনাথে ফুল, জীবনানন্দের পাখিরা আকাশ থেকে নিচে নেমে আসে আর পরবর্তী জন্মে পাখি হয়ে পৃথিবীতে ফেরার আকাক্সক্ষা ব্যক্ত করে।
জীবনানন্দ আপ্লুত হয়েছিলেন অন্ধকারে, ধূসর জগতে। ঘাস সাম্র্রাজ্যে এবং বিদর্ভ নগরে। তাঁর অনন্ত অন্বেষা যাত্রা শেষ হয় রূপময়ী জগত নাটোরে। শুধু নাটোরেই কবির এই যাত্রাবিরতি ঘটেছে, তবে কবির এই বিরতি দু’দণ্ডের বিরতি।
শিল্পীমাত্রই যাত্রাপথের পথিক। জীবনানন্দও সুদূর অতীত থেকে যাত্রা শুরু করেছেন এক অধরা প্রেমিকার উদ্দেশ্যে। কবি হুইটম্যানও শিল্পযাত্রার পথিক ছিলেন। তিনি ছিলেন নারী বিবর্জিত, তিনি কোনো প্রেমের কবিতা লেখেননি। চিরকুমার হুইটম্যান প্রেমিক হিসাবে খ্যাতনামা ছিলেন। তবে হুইটম্যানে যৌনতা রয়েছে, জীবনানন্দে রয়েছে ‘বিউটি অব ফর্ম কিংবা ফর্ম অব বিউটি’। হাজার বছর পর তিনি কোনো একজনের কাছে ফিরে এসেছেন। সমুদ্রের তীর ধরে তিনি হেঁটে এসেছেন, অন্যদিকে অডিসিয়াস দেশে ফেরার জন্য অন্তহীন বাধাবিপত্তির মধ্য দিয়ে সমুদ্রযাত্রা শুরু করেছিলেন।
হাজার বছর ধরে খেলা করে এই কবিতাটিতে আমরা কবির শান্তিদাত্রী মানসীকে পেয়ে যাই। অন্য একটি পুরনো কবিতাতেও মানসীকে প্রশ্ন করতে দেখা যায়- ‘কোথায় গিয়েছো তুমি আজ/ এই বেলা!’
‘কারুবাসনা’ উপন্যাসে আমরা সেই তুমি নামের কালো মেয়েটির দেখা পাই। যে কালো মেয়েটিকে জীবনানন্দ ভালোবেসেছিলেন কোনো এক ভোরে। কারুবাসনা উপন্যাসটি লেখার আরো বিশ বছর আগে তিনি সেই কালো মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলেন। তখন তাঁর বয়স ছিলো কুড়ি/বাইশ বছর। মেয়েটি তাদেরই আঙ্গিনার নিকটবর্তিনী ছিলেন। তাঁর নিজের লেখার সামান্য উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, “চারিদিক তাকিয়ে দেখি, শুধু মৌসুমীর কাজলঢালা ছায়া, কিশোরবেলায় যে কালো মেয়েটিকে ভালোবেসেছিলাম কোনো এক বসন্তের ভোরে, বিশ বছর আগে যে আমাদেরই আঙ্গিনার নিকটবর্তিনী ছিলো... বহুদিন আগে যাকে হারিয়েছি, আজ সে-ই যেন দিগবালিকা। পূর্ণ যৌবনে উত্তর আকাশের দিগঙ্গনা সেজে সে এসেছে। পশ্চিম আকাশের সেই বিগত জীবনের কৃষ্ণামণি। পুব আকাশে আকাশ ঘিরে তারই নিটোল কালোমুখ। নক্ষত্রমাখা রাত্রির কালোদিঘির জলে চিত্রল হরিণীর প্রতিবিম্বের মতো রূপ তার, প্রিয় পরিত্যক্ত মৌনমুখী চমরীর মতো অপরূপ। মিষ্টি, ক্লান্ত অশ্রুমাখা চোখ। নগ্ন শীতল নিরাভরণ দু’খানা হাত, ম্লান ঠোঁট... সে-ই বনলতা, আমাদের পাশের বাড়িতে কুড়ি বাইশ বছরের আগের দক্ষিণ আকাশের এক পৃথিবীতে। বাবা তার লম্বা চেহারার, মাঝ গড়নের মানুষ- শাদাদাড়ি। স্নিগ্ধ মুসলমান ফকিরের মতো দেখতে, বহুদিন হয় তিনি আর এ পৃথিবীতে নেই। কত শীতের ভোরের কুয়াশাও ভোরের রোদের সঙ্গে জড়িত তাদের সেই খড়ের ঘরখানাও নেই।’ পৃষ্ঠা ৩৯-এ লিখেছেন- ‘বছর পনের আগে দেখেছি, মানুষজন নেই, থমথমে দৃশ্য, লেবুফুল ফোটে, ঝরে যায়, হোগলার বেড়াগুলো উঁইয়ে খেয়ে ফেলেছে। চালের উপর হেমন্তের বিকেলে শালিখ আর দাঁড়কাক এসে উদ্দশ্যহীন কলরব করে। গভীররাতে জ্যোৎস্নায় লক্ষ্মীপেঁচা ঝোঁপ থেকে উড়ে আসে। খানিকটা খড় আর ধুলো ছড়িয়ে যায়। বছর আষ্টেক আগে বনলতা একবার এসেছিলো। দক্ষিণের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, চালের বাতায় হাত দিয়ে, মা-পিসিমার সঙ্গে কথা বলল অনেকক্ষণ ধরে। তারপর আঁচলে ঠোঁট ঢেকে আমার ঘরের দিকে আসছিলো। কিন্তু কেন যেন অন্যমনস্ক, নতমুখে মাঝপথে গেলো থেমে। তারপর খিড়কির, পুকুরের কিনারা দিয়ে, শামুক-গুগল পায়ে মাড়িয়ে, বাঁশের জঙ্গলের ছায়ার ভেতর দিয়ে, চলে গেলো সে। নিবিড় জামরুল গাছটার নিচে দাঁড়ালো, তারপর পৌষের অন্ধকারের ভেতর অদৃশ্য হয়ে গেলো। তারপর তাকে আর দেখিনি।
অনেকদিন পর আজ আবার সে এলো, মনপবনের নৌকায় চড়ে, নীলাম্বরী শাড়ি পরে। চিকন চুল ঝাড়তে ঝাড়তে সে এসে দাঁড়িয়েছে। মিষ্টি অশ্রুমাখা চোখ। ঠা-া নির্জন দুখানা হাত, ম্লান ঠোঁট, শাড়ির ম্লানিমা। সময় থেকে সময়ান্তর, নিরবচ্ছিন্ন, হায় অন্ধকারে তার যাত্রা।”
এডগার এলেন পো’র ঞড় ঐবষবহ কবিতা থেকে হয়তো তিনি বনলতা সেন কবিতার কিছু উপকরণ পেয়েছেন, সেটুকু শুধু বনলতা সেন কবিতার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু আরো চারটি কবিতায় ও তিনি তার মানস প্রতিমার কথা লিখেছেন। কারুবাসনার কবি ওই কবিতাগুলিতে নিজেকে সেভাবেই প্রকাশ করেছেন।
প্রায় সকলেই বলে থাকেন জীবনানন্দ কাব্যপুরাণ, গল্প কিংবা উপন্যাসে ঐতিহাসিক যাত্রার অভিসারী। তারপরও তিনি সমকাল সম্পর্কে ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। মানস প্রকৃতির সহজাত কারণে তিনি প্রকৃতির উপরেও ছিলেন অতিমাত্রায় সচেতন। বোধ ও বোধির চমৎকার সমন্বয় তাঁর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় অস্বস্তির কারণ হয়ে ওঠেনি।
ধূসর জগতের কবি, নিসর্গ থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়োজন বোধ করেননি। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এক গ্রামীণ কিশোরীর অকালমৃত্যু কবিকে কক্ষচ্যুত করে, এবং এই ঘটনা কবির কবিতায় গভীর প্রভাব ফেলে।
ঝরাপালক কাব্যগ্রন্থ থেকে অনেক কাব্যগ্রন্থেই এটা লক্ষ্য করা যায়- ‘যাহারে খুঁজিয়াছিনু মাঠে মাঠে শরতের ভোরে/ হেমন্তের হিম ঘাসে যাহারে খুঁজিয়াছিনু ঝরো ঝরো/ কামিনীর ব্যথার শিয়রে.../ শুধু মেরু-আকাশের নীহারিকা, তারা/ দিয়ে যায় যেন সেই পলাতকা চকিতার সাড়া।’
বিচ্ছেদ বেদনার আর্তি তার অনেক কবিতাতেই পাওয়া যায়- ‘জানিনে কোথায় তুমি-/ শব্দের ভেতরে সন্ধ্যা যেই আসে,/ নদীটি যখন শান্ত হয়... তখন তোমার মুখ- তোমার মুখের রূপ/ আমার হৃদয়ে এসে ভিজে গন্ধচাঁপার মতন/ ফুটে থাকে’ (জানিনা কোথায় তুমি), ‘কিংবা তুমি আর আসিবে না,/ জানি আমি-/ জীবনের প্রথম ফসল/এখন আসিছে সন্ধ্যা আর শীত আর তীব্র শিশিরের জল।’
জীবনানন্দ জীবনানন্দই! যার ভেতরে মৃত্যুবোধ ধীরে ধীরে ঘন হয়ে এসেছে। ইন্দ্রিয়বিপর্যয়ী কৌশলে প্রায় কবিতায় তিনি তার অনুভবের ছবিটি গাঢ় কোরে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কল্পনার মৃত্যুতে মহাসুন্দরও শেষ হয়ে যায়। কিন্তু জীবনানন্দের মৃত্যুতে জীবনের সম্মেলনে এক বিপুল প্রশান্তি অনুভূত হয়ে থাকে। ‘শঙ্খমালা’ কবিতায় আমরা মৃত্যুবোধের সঞ্চার অনুভব করি। ‘কড়ির মতন শাদা মুখ তার,/ দুইখানা হাত তার হিম;/ চোখে তার হিজল কাঠের রক্তিম/ চিতা জ্বলে: দক্ষিণ শিয়রে মাথা শঙ্খমালা যেন পুড়ে যায়/ সে আগুনে হায়।’
কবি ইয়েটস পরিভ্রমণ করেছেন জাহাজে, সমুদ্রপথে। জীবনানন্দ পরিভ্রমণ করেছেন সমুদ্রের কিনার ধরে, হাঁটাপথে। কবির এই ভ্রমণকে আমরা তাঁর মানস ভ্রমণ বলে আখ্যায়িত করে থাকি। হাজার বছরের আয়ু নিয়ে হাজার বছর পথহাঁটা সম্ভব নয়। বনলতা সেন কবিতায় ঞড় ঐবষবহ কবিতার প্রভাব নিয়ে যা কিছু বলা হোক না উল্লেখ্য যে কবি ইয়েটস-এর বহু কবিতার সাথে সেইলিং টু বাইজেন্টিয়াম কবিতাটিও কবিকে প্রভাবিত করেছিল। কিটস যখন প্রৌঢ়, জীবনানন্দ তখন মাত্র তেতাল্লিশ।
কিটস জাগতিক ভোগস্পৃহা থেকে বের হয়ে আসতে চেয়েছেন, বিপরীতে জীবনানন্দ অনুসন্ধান করেছেন প্রেমে দু’দ- শান্তি। জীবনানন্দে আছে ধূসর আবিলতা। ইয়েটস-এর আছে, যিধঃ রং ঢ়ধংঃ ড়ৎ ঢ়ধংংরহম ঃড় সব ঢ়ধংংরহম ঃড় সব, কিটস সেই ‘গ্রেসিয়ান’ কবিতার বংশীবাদক গাছের নিচে বসে বাঁশি বাজায়। আর সেই বাঁশির সুর, কাল আর সময়ের ব্যবধান ঘুচিয়ে প্রবহমান কাল ধরে সবুজ গাছটির নিচে বেজেই চলে।” এরপরও ইয়েটস নো কান্ট্রি ফর ওল্ডম্যান বলে বিলাপ করেছেন।
ইয়েটস এর কবিতায় যে অন্বেষণ, জীবনানন্দের অন্বেষণে সে মরীচিকা নেই। হাজার বছরের প্রবাহমানতা প্রকৃতপক্ষেই কাব্যসত্য। ইয়েটস-এর সেলিং টু বাজেনটিয়াম এবং কিটস-এর ‘অন এ গ্রেসিয়ান আর্ন-এ সেটা মূর্ত রয়েছে।’
ইয়েটসের অন্বেষণে শাশ^তকে পাওয়া যায়। কাব্যসত্যে জীবনানন্দও তাই পেয়েছেন। বাইজেন্টিয়াম আর্টের তুলনা আর বনলতার মুখের সৌন্দর্যের বর্ণনা সে-ই একই রূপেরই তুল না। জীবনানন্দের কল্পনার তীলোত্তমা আর সেইলিং টু বাইজেন্টিয়ামের শিল্পভাস্কর্যের চিত্রকল্প প্রায় একভাবে মুগ্ধ করে। জীবনানন্দের বহু কবিতায় চুল ও মুখের বর্ণনা রয়েছে- “তোমার গভীর কালো চুলের ভেতরে/ কবেকার সমুদ্রের নুন/ তোমার মুখের রেখা আজো/ মৃত কত পৌত্তলিক খৃষ্টান/ সিন্ধুর অন্ধকার থেকে এসে/ নবসূর্যের জাগার মতন/ কত কাছে/ তবু কতদূর।’’
‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতাটিতে- ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকারে জোনাকির মতো:/ চারিদিকে চিরদিন রাত্রির নিধান;/ বালির উপরে জ্যোৎস্না- দেবদারু ছায়া/ ইতস্তত/ বিচূর্ণ থামের মতো:/ দাঁড়ায়ে রয়েছে, মৃত, ম্লান,/শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের-/ ঘুচে গেছে জীবনের সব লেনদেন/ ‘মনে আছে?’
শুধুমাত্র বনলতা সেন কবিতায় আবদ্ধ না থেকে, রূপসী বাংলার মাঠ পেরিয়ে তিনি আরো কিছু অসাধারণ কবিতায় নিজেকে প্রকাশ করেছেন। ‘পৃথিবীর ঘরের ভেতরে/ তবু আরো কিছু চাই।’
‘অনেক রাত্রিদিন’ কবিতায়- “মাঠের ভিতরে ক্রমে ছায়া নেমে আসে,/ দু’চারটে উঁচু গাছ রোদে খেলা করে। পৃথিবীতে রক্তপাত অশান্তি এখন,/ অর্থময়তা তবুও পেতে পারে মন।”... ‘বিষয়ের অনন্তহীন বাধা/ মিশে গিয়ে মানুষের প্রেম আর প্রয়াণের সীমা/ যে সব অসত্য নয়- তবুও দূরসাগর নীলিমা ডাকে ঝটিকার শব্দে- রূঢ়সূর্যে, / শত শত মৃত নাবিকের নামে/ এই পরিণাম থেকে মানুষকে উজ্জ্বল মূল্যের পরিনামে-।’ জীবনানন্দের কবিতাভুবনের বাইরের জগতটা কেমন সেটি দু’একটি কবিতায় প্রকাশ প্রায় অসম্ভব।
‘ঐদিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর/ স্কাইলাইট মাথার উপর/ পাখিরা কথা কয় পরস্পর/ তারপর চলে যায় কোথায় আকাশে?/ তাদের ডানার ঘ্রাণ চারিদিক ভাসে-’ (ধূসর পা-ুলিপি)।রবীন্দ্রনাথও লিখেছেন- সমাজ সংসার মিছে, মিছে এই জীবনের কলরব/ কেবল আঁখি দিয়ে, আঁখির শুধা দিয়ে/ হৃদয় দিয়ে হৃদি অনুভব/ আঁধারে মিশে গেছে বাকী সব। হারানো প্রেমিকার জন্য হাহাকার নয় বরং অন্বেষা ও আর্তি তাঁর অনেক কবিতায় উদ্ভাসিত।
‘শরীরে ঘুমের ঘ্রাণ আমাদের/ মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে/ বড় বড় নগরীর বুকভরা ব্যথা/ ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা/ সংকল্প স্বপ্নের/ উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতর।/ জানি না কোথায় তুমি- শব্দের ভেতরে যেই সন্ধ্যা আসে/ নদীটি যখন শান্ত হয়/ -তখন তোমার মুখ/ তোমার মুখের রূপ/ আমার হৃদয়ে এসে/ ভিজে, গন্ধচাঁপার মতো ফুটে থাকে’ (জানিনা কোথায় তুমি)কিংবা ‘তুমি আর আসিবে না, জানি আমি/ জীবনের প্রথম ফসল/ এখন আসিবে সন্ধ্যা আর শীত আর তীব্র শিশিরের জল।’
জীবনানন্দের প্রেমিকেরা কেমন ছিলো? কিশোরী নাকি পরিণত বয়সী? কবিতার খসরা খাতা থেকে- যতটুকু ইঙ্গিত পাওয়া যায়- ১৯১৯ সাল থেকে হারানো প্রেমিকার জন্য কবির যে আর্তি বিশেষত শঙ্খমালা ও বনলতা সেনের জন্য তা প্রায় একই আর্তি। তারা কি দুই ভিন্ন নামে পরিচিতা! পেয়ে হারানোর বেদনা ‘১৯৩৩’ কবিতাটিতে এভাবেই এসেছে, ‘তোমার শরীর- তাই নিয়ে এসেছিলে একবার/ তাই নিয়ে মানুষের ভিড়... / তোমাকে নিয়েছে ডেকে কোনদিকে জানিনি তা... তুমি কি আসিবে প্রিয়!’
হতে পারে প্রয়াত শঙ্খমালাকেই তিনি নানা আঙ্গিকে বনলতা সেন-এ পরিণত করেছেন। সুধীন্দ্রনাথ দত্তের প্রেমভাবনার সাথে জীবনানন্দের মিল রয়েছে খুবই সামান্য যা উল্লেখ করার মতো নয়। জীবনানন্দে প্রেম-পরিণতি স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে একাধিক গ্রন্থে’। গ্রামীণ প্রকৃতির কিশোরী শঙ্খমালার অকাল মৃত্যু গভীর প্রভাব ফেলে জীবনানন্দের কবিতায়। প্রেমের স্মৃতি মন থেকে মননে স্থায়ী রূপ নেয়। ‘অবিরল অন্ধকারের ভেতর সূর্যকে ডুবিয়ে ফেলে/ আবার ঘুমুতে চেয়েছি আমি/ অন্ধকারের স্তনের ভেতর, যোনির ভেতর/ অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে চেয়েছি।’ (অন্ধকার)
আমরা জানি যে সুররিয়ালিজমের উদ্ভব দাদাইজম থেকে, অর্থাৎ মনোলজিক এবং রিদম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে অন্তর্জগত ও বহির্জগতের দেয়াল ভেঙে অতিবাস্তবের রাজ্যে কিংবা কল্পলোকের রাজ্যের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে জীবনানন্দকে সুররিয়ালিজমের অগ্রপথিক বলা হয়ে থাকে
কারুবাসনার রচনাকাল ১৯৩৩। বনলতা সেন লিখিত ১৯৩৪ সালে। জীবনানন্দ দাশ ঐশী প্রেমের কবি নন, জীবনানন্দের ডায়েরিতে উল্লিখিত ‘রুরালগার্ল’ অর্থাৎ ‘গ্রামীণ কিশোরীর প্রেম’ শুধু বনলতা সেন নয়, শঙ্খমালাতেও প্রতিফলিত। বিশেষত আমরা জীবনানন্দ দাশকে রোমান্টিক ও বিষাদের কবি বলে আখ্যায়িত করে থাকি। “কোনো প্রেম কিংবা কোনো স্বপ্নের, কোনোদিন মৃত্যু হয় না।” তাঁর বলার এই ধরনটাকে বিরতিহীন অন্তঃস্রোত নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে।তিনি যেমন সবুজ ঘাসের দেশ বনলতার চোখের ভেতর দেখেছেন, অন্ধকারে বসেও তিনি জোনাকির আলো দেখেছেন। শুধু বিম্বিশার ধূসর জগতই নয়, হাওয়ার রাত, নগ্ন নির্জন হাত, সুরঞ্জনা, পথহাঁটা, এরকম অনেক কবিতায় ইতিহাসচারিতার সাথে স্বপ্নলোকের সৃষ্টি করেছেন তিনি, অতীতকে বর্তমানে এনে দাঁড় করিয়েছেন। বেবিলনের সিংহের মূর্তি, পিরামিডের নিঃস্তব্ধতা, মিশরীয় সভ্যতা পেরিয়ে নিকট বর্তমানে এনেছেন। মাছরাঙা, শালিখ, নদী, মরুভূমি, সন্ধ্যার প্রান্তর, বস্তি, হিজল, জাম, এমনকি স্টেশনে রাত্রির প্লাটফর্মও ট্রেনের ভুবনকেও চেতনায় এনে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন।
carried the past into the present. তাঁর মেটাফর বা রূপক পাঠককে ‘অবসন্নতা ও বিক্ষত অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করে’। তার কবিতায় গীতলতার ব্যবহার পাঠকের অনুভূতির বিস্তৃতি ঘটায়, এবং পরাবাস্তব বা বাস্তব রূপবাদের প্রভাব একটু বেশিই পরিলক্ষিত।
আমরা জানি যে সুররিয়ালিজমের উদ্ভব দাদাইজম থেকে, অর্থাৎ মনোলজিক এবং রিদম-এর প্রভাব থেকে মুক্ত রেখে অন্তর্জগত ও বহির্জগতের দেয়াল ভেঙে অতিবাস্তবের রাজ্যে কিংবা কল্পলোকের রাজ্যের অভ্যন্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এক্ষেত্রে জীবনানন্দকে সুররিয়ালিজমের অগ্রপথিক বলা হয়ে থাকে।
এডগার এলেন পো বিস্মিত বিমুগ্ধ এক ঘনায়মান সন্ধ্যায়, দূরের জানালায় দাঁড়ানো, বন্ধু রবার্ট স্ট্যানার্ড এর মা, জেনস্টিথকে কল্পনা কোরে লিখেছিলেন টু হেলেন কবিতাটি। রোমান্টিকতা ও সৌন্দর্যকে আশ্রয় করে স্মৃতিমথিত কবিতাটি মাতৃরূপিনীকে উৎসর্গ করা।
মেজাজ ও মনোভঙ্গির ফারাক দুটি কবিতাতেই আবহ ও প্রকরণে ভিন্ন। বলা যেতে পারে যে- তিনি দ্যু-ভাল আশ্রিত কবিতাগুলি পড়েছিলেন, পড়েছিলেন ফ্যান ব্রাউনের প্রেমিক কিটসকে। এসব ক্ষীণ প্রসঙ্গ অনুষঙ্গে কিছুই যায় আসে না। শুধু ‘টু হেলেন’ নয়, ডিলা মেয়ারের লিসনার্স কবিতাটির প্রভাবের কথাও শোনা যায়। এছাড়া কোলরিজের ক্রিস্টাবেল, বা আবিসিনিয়ান মেড কবিতাটি সম্পর্কেও একই কথা উচ্চারিত। বনলতা সেন সম্পর্কে কোলরিজের কবিতার কম্যুনিকেটেড ইনটেলিজেনস শেষ পর্যন্ত মেটাফিজিক্স-এর বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। সমালোচক নেদারকট গেরাল্ডাইন হাবসী সুন্দরীকে, সুপার নেচারাল বলাটা যুক্তিযুক্ত মনে করেছেন।
পক্ষান্তরে জীবনানন্দ দাশের ভাবনা ও মেথড সম্পূর্ণ কাব্যিক। আঁর্তুর র্যাঁবোর অবচেতন মনের স্বপ্নময় ভাষা আর জীবনানন্দের ভাষা এক নয়। নয় লাস্যময়তা। মার্কিন কবি ম্যাকলিসও সময়ের উপস্থিতিকে শৈল্পিক রূপ দিয়েছেন তাঁর অনেক কবিতায়। জীবনানন্দ দাশ সারাজীবন শান্তিই খুঁজেছেন। নাটোরের রক্তমাংসের এক নারী তার শরীর দিয়ে তৃপ্তির শান্তি দিয়েছিল কবিকে। দেহের সে শান্তি দু’দ-ই ছিল বটে। যদিও অন্ধকার দিয়েই তাঁর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। এর একটি হলো ব্যর্থতাজনিত অন্ধকার। অন্যটি মহাকাল উৎসারিত চিরন্তন অন্ধকার। ‘প্রেমের অপূর্ব শিশুর আরক্ত বাসনা ফুরাত না / যদি / আহা আমাদের হৃদয়ের থেকে।’ধূসরতার বাইরে থেকেও কবিকে ভাসিয়ে তোলেন অন্য কোনো প্রসঙ্গ। ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়/ জানি;/ তারপর আমাদের দুস্থ হৃদয়/ কি নিয়ে থাকিবে বলো (দুজন)।’
তিনি দান্তে কিংবা ব্রাউনিং-এর মতো প্রেম এবং ঈশ্বরকে একাত্মকরণের চেষ্টা করেননি। ডিভাইন কমেডিতে দান্তে বিয়ত্রিচে যে আস্থা, জীবনানন্দের এরকম কোনো আস্থা ছিলো না। এ জন্যই তিনি স্থবিরতাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন। ‘স্থবিরতা, কবে তুমি আসিবে বলো তো!’
বনলতাকে খুঁজতে তিনি হাজার বছর ক্ষয় করেছেন। মৃত্যুচিন্তা তাকে গ্রাস করেছে, কিন্তু তিনি অপসৃত হননি। এ্যান্টনি ক্লিওপেট্রা কিংবা রোমিও জুলিয়েটকেও মৃত্যুর মুখামুখি দাঁড়াতে হয়েছিলো। হেগেল স্পিরিচুয়াল রিয়েলিটির কথা বলেছেন। জীবনানন্দও সেই জীবন সৃষ্টি করেছেন। ধূসর এবং নির্জনতার বাইরে যুদ্ধকালীন সময়ের বর্ণনায় তিনি বলেছেন, হাইড্রেন্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল/ অথবা সেই হাইড্রেন্ট গিয়েছিলো ফেঁসে/ এখন দুপুর রাত, নগরীতে দল বেঁধে নামে।/ একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেলো কেশে, অস্থির পেট্রোল ঝেড়ে/ সতত সতর্ক থেকে তবু কেউ যেনো/ ভয়াবহভাবে পড়ে গেছে জলে/ তিনটি রিক্সা ছুটে মিশে গেলো/ শেষ গ্যাসল্যাম্পে/ মায়াবীর মতো যাদুবলে। নবাগত কবিকে অন্নদাশঙ্কর রায় শুদ্ধতম কবি আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন, পরে আব্দুল মান্নান সৈয়দ ওই নামটিই তাঁর গবেষণালব্ধ বইয়ের নাম হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রেমেন্দ্র মিত্র আলাদা ধরনের কবি অভিধায় অভিহিত করেছেন তাঁকে।
‘বাতাসে ধর্মের কলও নড়ে ওঠে/ নড়ে চলে ধীরে/ সূর্যসাগর তীরে, মানুষের তীক্ষè ইতিহাসে/ কত কৃষ্ণ জননীর/ মৃত্যু হলো রক্তে- উপেক্ষায়: বুকের সন্তান তবু / নতুন সংকল্পে আজো আসে/ প্রতিমার প্রায়/ নগর গুঞ্জন ক্ষান্ত নক্ষত্র নিস্তব্ধ সন্ধ্যায়’। ‘শিপ্রা নদীর পারে আরতি থামিয়ে গেলো শিবের মন্দিরে।’ (শিপ্রা নদীর পারে- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর) কিংবা কালীদাসের যক্ষপ্রিয়া, ভারত চন্দ্রের কস্তরী, বা রবীন্দ্রনাথের রোমান্টিক নায়িকারা কি জীবনানন্দকে আলোড়িত করেনি? টি এস এলিয়ট ঞৎধফরঃরড়হ ধহফ ঃযব ঞযব রহফরারফঁধষ ঞবষবহঃ প্রবন্ধে বনলতা সেন সম্পর্কে বলেছেন- ‘It (Tradition) involves... the historical sense...; and the historical sense involves a Perception, not only of the pastness of the past but of its presence, which is a sense of the timeless as well as of the temporal together, is what makes a writer traditional.’
জীবনান্দের ইন্দ্রিয় তার নিজস্বসীমা অতিক্রম করে অন্য অভিজ্ঞতায় চলে যায়। রবীন্দ্রনাথের কল্পনা কাব্যগ্রন্থের ‘স্বপ্ন’ কবিতা সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “একজন শ্রেষ্ঠতম কবির কাব্যে তাঁর যুগ এমন মানবীয় পূর্ণতায় প্রতিফলিত হয় যে-সে যুগেও ইতস্তত বিক্ষিপ্ত পথে, ভাবে বা ভাষায়, কবিতার ইঙ্গিতে বা নিহিত অর্থে, সেই মহাকবিকে এড়িয়ে যাওয়া দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়ায়।”
ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তাঁর অনুরাগ, তাঁর সাহিত্য প্রেরণার প্রধান উৎস। ইংরেজি সাহিত্যপাঠ দ্বারা তিনি উজ্জীবিত, উদ্দীপ্ত, প্রভাবিত এবং সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়েছিলেন। ইংরেজি শিল্প সম্ভারের যাদুস্পর্শে তিনি অমর সব কবিতা লিখেছেন। যখন আমরা রবীন্দ্রনাথের ঊর্বশী কবিতাটি পড়ি তখন আমরা সুইনবার্নের- যখন বর্ষশেষ কবিতাটি পড়ি তখন শেলির ওয়েস্ট- ‘জোনাকির রঙে ঝিলমিল’ জীবনানন্দের এই লাইনটি কবি কিটসের ইনডিমিয়ন বুক-২-এর দুটি লাইনের কথা মনে করিয়ে দেয়। কলকাতায় এসে কবি তার ইন্দ্রিয়সীমা অতিক্রম করতে পেরেছিলেন এবং তিনি অনেক জায়গায় অনেক জটিল চিত্রকল্প ব্যবহার করেছেন। রিয়ালিজম এবং ম্যাজিক রিয়ালিজম তাঁর কবিতায় অন্য রকম সুর পেয়েছে। ‘কত যে ঘুমিয়ে রবো বস্তির পাশে’ নগর জীবনের রূঢ় বাস্তবতার এই চিত্রটি এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে।জীবনানন্দ শুধু রূপসী বাংলার কবি, বনলতা সেনের কবি, এমনটা সঠিক নয়। রূপসী বাংলার ধূসর গন্ধ রেখে যেন অন্য এক জীবনানন্দ এভাবেই বলেন, ‘কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে কিংবা শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর।’
অন্ধকার কবিতায়, ‘আমি/ অন্ধকারের স্তনের ভিতর, / যোনির ভিতর/ অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে/ থাকতে চেয়েছি।’ জীবনানন্দের অনেক কবিতার বিষয় এক হলেও, ব্যঞ্জনা এক নয়। তাঁর ভাষা এবং ছন্দের মধ্যেও রয়েছে প্রচলিতের বিরোধ। কোনো এক প্রসঙ্গে ১৯৪৫ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি লেখায় তিনি বলেছেন যে, আমার প্রকৃতি সব সময় ধূসর, তা কিন্তু নয়।একথার পরিপ্রক্ষিতে আমরা ধরে নিতে পারি যে-প্রকৃতি কিংবা ধূসরতাই জীবনানন্দ নন। কাললগ্ন মানুষও তাঁর কবিতার উৎস। ‘আমার এ আঁখি উৎসুক পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথ দূর হতে নিভৃতে প্রদীপ জ্বালান দেখেছেন। একারণেই রবীন্দ্রনাথের আঁখি উৎসুক আর জীবনানন্দের কল্পনার রাজ্যে অশরীরী ছায়ার বিশেষ আনাগোনা ভিন্ন আঙ্গিকে।