alt

সাময়িকী

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

সাদ কামালী

: সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস / জন্ম : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩; মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম তত্ত্বটি প্রবল বেগে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্যে নোবেল জয়ের ঘটনায় যাদুবাস্তবতার পালে যে ভীষণ বাতাস দোলা দেয় তার ঢেউ-তরঙ্গ বাংলায় পৌঁছতে দেরি হয় না

ইলিয়াসের গলা ধরে আসে, মুখের ভাষাও মধ্যবিত্তের ভব্যতার সীমানা গলে তরল হয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হক আলগোছে সতর্ক করেন, ‘এইবার ছাড়ুন, আর কত খাবেন?’ ইলিয়াসের ঠোঁট ঘিরে জ্যোৎস্না ভাসে, ‘যার খাচ্ছি সে আমার খালাতো ভাই, ... আমি জানি আরো দুটো স্কচ ওর কাছে আছে।’ আরো স্কচের তথ্য নয়, হাসান আজিজুল হক সতর্ক সচেতন অবস্থান থেকে ইলিয়াসের বিশেষ কিছু ভাবনা-চিন্তার খোঁজ করেন- ‘সাহিত্যতত্ত্বগুলো সম্বন্ধে কী বলবেন ইলিয়াস?’ চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে ইলিয়াসের চোখের পাতা একবারও বেশি পড়ে না, ভাবনার রেখাও কোথাও জাগে না সময় খরচ না করে কনফিডেন্ট উত্তর দেন, ‘ওগুলোর মায়েরে বাপ!...শুনুন, লেখক হিসেবে সংকট আমার। সাহিত্যতত্ত্ব কি সাহায্য করবে? লেখক শালা এমন একটা ইঞ্জিন যার স্টিম নিজেকেই সাপ্লাই করতে হয়। আরেকজনের দেওয়া স্টিমে এই ইঞ্জিন চলে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, কলমে কালি বইছে না। ধর্মের ষাঁড়ের মতো গাদা গাদা বীর্য নিয়ে বসে আছি, ঢালবার জায়গা নেই। সাহিত্যতত্ত্বে কোনো সাহিত্যিকের কবে লাভ হয়েছে?’ সাহিত্যপাঠ ও মূল্যায়নের সময় পড়–য়া পাঠক তত্ত্বের ঘেরাটোপে যাচাই-বাছাই করে নিতে পারে বৈকি। সৃষ্টিশীল লেখকের শিল্প সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বোধ আলোড়িত স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কখনো তত্ত্বের সংজ্ঞা শর্ত সাপেক্ষে নয়, তা অবাধ, স্বয়ম্ভূ। লেখা, বিষয় ও তার দর্শনটুকু প্রমাণের জন্য সৃষ্টিশীল লেখক প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত কোন শিল্পতত্ত্বের সাঁচে নয়, অনুকূল বা যথার্থ আঙ্গিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিষয়কে প্রকাশ করে। কাঠামোবাদ বা উত্তর কাঠমোবাদ বা উত্তর উপনিবেশবাদ তত্ত্বে মোলড্ বা সাঁচে লেখক তার বিষয়Ñ তরল সোনা ঢেলে খাপে খাপ কাঠামোবাদ ইত্যাদি নির্মাণ করে না, ওই কাঠামোবাদের ধারণা রবীন্দ্র-জীবনানন্দ-দেবেশ-ইলিয়াস-উৎপল-জয়কে সাহায্য করেনি। ডিলুস-দেরিদা-ফুকো ‘ইউলিসিস’ ‘রক্ত করবী’ ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’ বা ‘যোগাযোগ’ সৃষ্টি করেন না। শিল্প তাত্ত্বিকের তত্ত্ব নিয়ে শিল্পরসিক আলোচক কিছু জ্ঞান বৃদ্ধির ব্যায়াম করতে পারেন মাত্র। লেখকের শিল্পবোধ, জগৎ জীবন সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে অনুভব উপলব্ধি তার রচনা বা শিল্প নির্মাণে ভূমিকা রাখে, কলোনিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির মনস্ততত্ত্বকে উদ্ধার বা চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘হারবার্ট’ লেখা হয় না। বরং স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতন্ত্র আঙ্গিকে নির্মিত ‘হারবার্ট’-এ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙ্গে পড়ে। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ লিখতে কোনো তত্ত্ব, মডেল এমনকি অগ্রজ মহাজন লেখকদের উপন্যাস বা উপন্যাসরীতিও ইলিয়াসকে সাহায্য করেনি। খালাতো ভাই মতিনের যোগান দেয়া স্কচের অভিঘাতে দ্বিধাহীন ইলিয়াস জানান- ‘চিলেকোঠার সেপাই’ যখন লিখি, আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারেনি। উপন্যাসের বুর্জোয়া মডেল আমার কোন কাজে এলো না।... না, আমি কোন সাহায্য পাইনি, সাহিত্য থেকেও নয়, সাহিত্যতত্ত্ব থেকেও নয়, ... উপন্যাস সম্পর্কে আমার নিজের মত থেকেও নয়। লাঙল চালিয়ে নিজেকে ফালা ফালা করে চষে ফেলেছি আর লেখার পর মনে হয়েছে- এই শালা, ব্লাডি ‘বকচ্ছপ’, ‘হাঁসজারু’ শুয়োরের মতো আমার লেখা। এই ব্লাডি ‘বকচ্ছপ’ ‘হাঁসজারু’ই স্বকীয় বিশেষত্বের মধ্যে প্রকাশিত ও নির্মিত হয়েছে। আর কোথাও তার সম্পূর্ণ অনুরূপ ‘কোলন’ আর একটি নেই। যে গ্রন্থে লেখকের রচনা স্বকীয় হয়ে ওঠে, সেই দুর্লভ গুণটিই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সাহিত্য রচয়িতার। তা রজঃগুণ নয়, তমোগুণও নয়, তা কল্পনাশক্তির ও রচনাশক্তির গুণ’ (সাহিত্য বিচার)। তো রচনাশক্তি সৃষ্টিশক্তিই লেখককে সাহায্য করে। কোন মডেল বা তত্ত্ব নয়।

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম তত্ত্বটি প্রবল বেগে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘটনায় যাদুবাস্তবতার পালে যে ভীষণ বাতাস দোলা দেয় তার ঢেউ-তরঙ্গ বাংলায় পৌঁছতে দেরি হয় না। ইংরেজি, অনুবাদ আর ইন্টারনেট মিলিয়ে ক্রমে যাদুবাস্তবতার কথা ভালোই চাউড় হয়। আলোচকবৃন্দ বাংলা সাহিত্যেও যাদুর খোঁজ করতে শুরু করে। এই ধারণাটির মোদ্দা কথা এমন কোন দূরাগত, জটিল নয়, বরং আমাদের মতো প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যে এই যাদুর ব্যবহার বহু পুরনো, আফ্রিকা বা চীন দেশের সাহিত্যেও ‘যাদুবাস্তবতা’ নতুন কিছু নয়। তবে আধুনিক জীবনের নানামুখী সঙ্কট, সংশয়, অনিশ্চয়তা আর ক্রমে রূঢ় বাস্তবতার প্রখর সংক্রামে বাস্তবতা থেকে যাদুর ‘হেঁয়ালি’ মিলিয়ে যেতে চাইলেও আধুনিক লাতিন সাহিত্যে সাহিত্যশৈলী হিসেবে যাদুবাস্তবতা বিশেষ মনোযোগ পায়।

জার্মান আর্টক্রিটিক ফ্রানৎস রো’র (১৮৯০-১৯৫৫) ‘একসপ্রেশনিজমের পর ম্যাজিক বিয়ালিজম : নবীনতম ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যাবলী’ (১৯২৫) গ্রন্থে প্রথম ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ফ্রানৎস রো কখনো ম্যাজিক রিয়ালিজমকে সাহিত্যের একটি শৈলী বা তত্ত্ব হিসেবে দেখেননি। তিনি বরং এই ধারণাটিকে উত্তর একসপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক মনে করেছেন। রো’র মতে, যাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ছিল প্রতিদিনের জীবন যাপনের বাস্তবতার ভেতর নানা চমক, কুহকী ঘটনা এবং বিস্ময়ের অভিব্যক্তিতে।

ভেনেজুয়েলার আর্তুরো উসলার পায়েত্রি (ভেনেজুয়েলার মানুষ ও চিঠি : ১৯৪৮) কিউবার আনোজা কার্পেন্তিয়ের (‘এই মর্তের রাজত্ব’ ১৯৯০) গুয়াতেমালার মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস আর্জেন্টিনার লুই বোর্হেস, কলাম্বিয়ার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস প্রমুখ প্রধান ব্যক্তির সাহিত্যে শৈলী হিসেবে যাদুবাস্তবতার ব্যবহার ধারণাটিকে সুপরিচিত ও জনপ্রিয়ও করে তোলে। লাতিন আমেরিকার লেখকদের মধ্যে আর্তুরো উসলার ‘ভেনেজুয়েলার মানুষ ও চিঠি’ গ্রন্থেই প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিজমের উল্লেখ করেন।

যাদুবাস্তবতার মূল লক্ষণের মধ্যে স্বপ্ন, কল্পনা, লোকবিশ্বাস, সংস্কারের সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতা ও সত্যের সংমিশ্রণের প্রকাশ ঘটে কাহিনীক্রমে। স্থান-কালের সহসা বদল রহস্য, অলৌকিকতা, রূপকথার চমক, অভিব্যক্তিবাদী, কখনো পরাবাস্তববাদী বর্ণনা, আকস্মিকতা ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ও পরিস্থিতি যাদুবাস্তবতায় ঘটে। আধুনিক সহিত্যে গল্প কাহিনী নির্মাণের এই রীতিটির প্রভাব লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া খুব সাম্প্রতিককালেরই কথা। ষাটের দশকের শেষ বা সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে বা বাংলায় যাদু, মায়া, কুহক, বিস্ময়, ব্যাখ্যাতীত ঘটনা, রূপকথা সংস্কার এবং প্রখর প্রবল বাস্তবতা থাকলেও যাদুবাস্তবতা সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে পরিচিত ছিল না। তবে আনহেল ফ্লোরেসের ‘ম্যাজিক্যাল বিয়ালিজম ইন লাতিন আমেরিকান ফিকশন’ (১৯৫৫) গ্রন্থটি সমালোচক মহলে আলোচিত হলেও ঢাকায় এসে পৌঁছায়নি, অন্তত বলা যায় ‘যোগাযোগ’ গল্পের নির্মাতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাছে তখন পর্যন্ত নয়।

স্বপ্ন অলৌকিকতা আর বাস্তবের বিশেষ যোগাযোগ ঘটে ‘যোগাযোগ’ গল্পে। ‘যাদুবাস্তবতার’ সকল লক্ষণ গল্পের প্রথম থেকেই বর্তমান। গল্পটি প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’-এ (মে ১৯৭৬) অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রন্থের গল্পগুলো ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সময় পরে লেখা। এই তথ্য ‘তৃণমূল’ ইলিয়াস সংখ্যা এবং রচনা সমগ্র ১-এ উল্লেখ আছে। ‘যোগাযোগ’ রচনার তারিখটি জানা না গেলেও জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জিন্নাহ এভেন্যুর রেস্টুরেন্ট ‘রেকস’ এবং নবাবপুরের হোটেল ‘আরজু’র জমজমাট আড্ডা-উত্তরকালে লেখা। রেকস ও আরজুর আড্ডায় নিয়মিত সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, খালেদ চৌধুরী, মাজহারুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ। আড্ডার পাশাপাশি লিখছেন গল্প-কবিতা আর পড়ছেন ‘বিশেষত আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য’। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু আড্ডা হতো গুলিস্তান সিনেমা হল সংলগ্ন ‘গুলসিতান’ রেস্টুরেন্টে। তো এই বিশেষ আড্ডা পর্বে ইলিয়াস কি ‘ম্যাজিক্যাল বিয়ালিজম ইন লাতিন আমেরিকান ফিকশন’ গ্রন্থটি পড়েছিলেন? আড্ডার সঙ্গীদের দু’জন জানিয়েছেন, তখন পর্যন্ত যাদুবাস্তবতার কথা তারা শোনেননি। যোগাযোগ গল্পের প্রথম থেকেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের এমন নিপুণ প্রয়োগ অব্যর্থভাবে ঘটে যে আধুনিক বাংলাদেশে গল্পে সাহিত্যে তার তুলনা বিরল। বলা যায়, সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে যাদুবাস্তবতার কোনো পাঠ ছাড়াই ইলিয়াস গল্পটি লিখেছেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জিন্নাহ এভেন্যুর রেস্টুরেন্ট ‘রেকস’ এবং নবাবপুরের হোটেল ‘আরজু’র জমজমাট আড্ডা-উত্তরকালে লেখা। রেকস ও আরজুর আড্ডায় নিয়মিত সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, খালেদ চৌধুরী, মাজহারুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ

তন বছর আগে মৃত মা স্বপ্নের ভিতর রোকেয়াকে ডাকে, ‘রোকেয়া, অ রোকেয়া, আর কতো ঘুমাইবি? কাইন্দা কাইন্দা পোলার তর শ্বাস বন্ধ হয়, উঠলি? অ রোকেয়া!’ ‘পোলার’ কান্না আর মায়ের ডাক শুনে রোকেয়ার স্বপ্ন ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বপ্নের ভিতর মৃত মায়ের ডাক বা ছেলে খোকনের কান্নার কথা জানালেও সজাগ রোকেয়ার মনে হয়, ‘পোলায় না জানি কখন থাইক্যা কান্দে। রোকেয়া তার বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ বড় মামাকে দেখতে গিয়াছিল। ট্রেনের কামরায় তখন অন্য একটি শিশু না জানি কোন কষ্টে লম্বা সময় ধরে তখন কাঁদছিল। রোকেয়ার একবার মনে হয়, স্বপ্নের ভেতর তার মায়ের জানানো খোকনের কান্না তবে খোকনের নয়, এই সঙ্গী যাত্রীটির সন্তানের কান্নাও হতে পারে, এরকম সান্ত¡না দেয় নিজেকে। কিন্তু একঘেয়ে শিশুর কান্না, ট্রেনের বিরক্তিকর লম্বা যাত্রা, যাত্রীদের ভারি নিশ্বাসপতন, একটি মাত্র পাখার ভোঁ ভোঁ করে ঘোরা সব মিলিয়ে রোকেয়ার বুকে ঠক ঠক বাড়ি মারে, মৃত মায়ের ডাক খোকনের কান্না আবার তাকে আতঙ্কিত করে ‘খোকনের আমার না জানি কি হইলো’।

মামা বাড়ি যাওয়ার পথেই রোকেয়ার বুক অজানা কারণে ‘খচখচ’ করছিল। শৈশবের শত সহস্র স্মৃতির ভিতর দিয়ে মামা বাড়ির চলার পথে খোকনের জন্য মন খারাপ ভাবটা যায় না। নৌকার ভিতর পা পিছলে পড়তে পড়তে সামনে বসলেও খোকনের জন্য মনটা তার কেমন জানি করে। মামার শরীর ভালো না। এবাড়ি সেবাড়ি তবুও ঘুরে রোকেয়া। রোকেয়ার মা সজনে ডাঁটা খেতে পছন্দ করত বলে পুকুর পাড়ে গোটা চারেক সজনে গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা সেই সজনে তলায় কোনো কোনো দিন সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রোকেয়ার ভালো করে দেখবার আগেই মেয়েটি কোথায় যেন চলে যায়। আবার হঠাৎ দেখে, অন্যদিক থেকে সাদা শাড়ি পরা অল্পবয়সী একটি মেয়ে বেগুন ক্ষেত পার হয়ে বাঁশঝাড়ের পথ ধরলো। রোকেয়ার বুকের মধ্যে শিরশির করে ওঠে, ‘বাঁশঝাড়ে চাঁদের ময়লা আলো’। সেই মেয়েটি রোকেয়ার খুব কাছে চলে এলে, রোকেয়া শোনে মেয়েটি বলছে- ‘রোকেয়া তর পোলায় কেমুন আছে?’ মায়ের কণ্ঠস্বরে রোকেয়া খুব চমকে উঠে চারদিকে তাকায়, না কোথাও কেউ নেই। সামনে পুকুর, পুকুরের ওপারে মাঠ। মাঠ ভরা পাকা ধানে হলদে জ্যোৎস্না অলস গা এলিয়ে ঘুম ঘুম চোখে শূন্যতা দেখে। ডান দিকে কালচে সবুজ গ্রাম, বাঁ-দিকে সুপারি বাগান।’ রোকেয়ার মা তবে দৃশ্যমান প্রকৃতির ভিতর কোথায় গেল। বিহ্বল বিস্মিত রোকেয়া ওই সন্ধ্যার ভিতর ঘরে ফিরে শুনলো, খোকনের বাবা হান্নান টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। দোতলার কার্নিশ থেকে খোকন পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।

রোকেয়ার ট্রেন চলছে, মনে আশঙ্কা আর কত মন্দ ভাবনায় শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। সারিবাঁধা টেলিগ্রাফের পোস্ট পার হয় দ্রুত, আর পোস্টের গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো দেখে তার মাকে, ‘আবার দ্যাখো আরেকটা পোস্টের ওপারে উবু হয়ে মাটি খুঁড়ছে রোকেয়ার স্বামী। ট্রেন চলছেই। হান্নান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, পেছনে মুখ ফিরিয়ে দেখলো রোকেয়া। ট্রেন চলে যায়। দুর্ভাবনায় রোকেয়ার মন ক্লান্ত। রোকেয়ার বাবা সোলায়মা আলী ট্রেনের কামরাতে ফজর নামাজ শেষ করে। ভোরের প্রশান্ত পবিত্র আলোর ভিতর বিশ্বাসে তার মন ভরে ওঠে। আশঙ্কায় কাতর মেয়ে রোকেয়ার পিঠে হাত রাখে সোলায়মান আলী, খুব মিনতিমাখা গলায় বলে ‘রোকেয়া’ আমি তরে কই, তোর পোলার কিছুই হইবো না, তুই হুদাহুদি ভাইবা মরস রে পাগলী!’

মামাবাড়ির এক সন্ধ্যায় পুকুর পারের সজনে গাছের তলা দিয়ে ওঠে এসে বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে মৃত মা রোকেয়ার মনে ছেলে খোকনের বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে যায়, সেই সন্ধ্যার টেলিগ্রামে খোকনের কার্নিশ থেকে পড়ে যাওয়ার খবর আসে। ঘুমিয়ে পড়া রোকেয়াকে স্বপ্নে এসে মা বলে, পোলায় তোর কান্দে তারপর দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় রোকেয়া টেলিগ্রাফ পোস্টের ফাঁকে ফাঁকে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। শেষে বিশ্বাসে কোমল ও আশ্বস্ত কণ্ঠে বাবা বলে, খোকনের তেমন কিছু হয় নাই। আহত, ব্যথায় কাতর, দীর্ণ খোকন হাসপাতালের বেডে গোঙায়, বেঁচে আছে। এ এক অলৌকিক, রহস্যময় যোগাযোগ। সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি কেয়ার না করা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সৃষ্টি শক্তির অমিত গুণে যাদুবাস্তবতার যোগাযোগ সৃষ্টি করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে।

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

সাদ কামালী

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস / জন্ম : ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩; মৃত্যু : ৪ জানুয়ারি ১৯৯৭

সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম তত্ত্বটি প্রবল বেগে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গার্সিয়া মার্কেসের সাহিত্যে নোবেল জয়ের ঘটনায় যাদুবাস্তবতার পালে যে ভীষণ বাতাস দোলা দেয় তার ঢেউ-তরঙ্গ বাংলায় পৌঁছতে দেরি হয় না

ইলিয়াসের গলা ধরে আসে, মুখের ভাষাও মধ্যবিত্তের ভব্যতার সীমানা গলে তরল হয়ে ওঠে। হাসান আজিজুল হক আলগোছে সতর্ক করেন, ‘এইবার ছাড়ুন, আর কত খাবেন?’ ইলিয়াসের ঠোঁট ঘিরে জ্যোৎস্না ভাসে, ‘যার খাচ্ছি সে আমার খালাতো ভাই, ... আমি জানি আরো দুটো স্কচ ওর কাছে আছে।’ আরো স্কচের তথ্য নয়, হাসান আজিজুল হক সতর্ক সচেতন অবস্থান থেকে ইলিয়াসের বিশেষ কিছু ভাবনা-চিন্তার খোঁজ করেন- ‘সাহিত্যতত্ত্বগুলো সম্বন্ধে কী বলবেন ইলিয়াস?’ চশমার মোটা কাঁচের আড়ালে ইলিয়াসের চোখের পাতা একবারও বেশি পড়ে না, ভাবনার রেখাও কোথাও জাগে না সময় খরচ না করে কনফিডেন্ট উত্তর দেন, ‘ওগুলোর মায়েরে বাপ!...শুনুন, লেখক হিসেবে সংকট আমার। সাহিত্যতত্ত্ব কি সাহায্য করবে? লেখক শালা এমন একটা ইঞ্জিন যার স্টিম নিজেকেই সাপ্লাই করতে হয়। আরেকজনের দেওয়া স্টিমে এই ইঞ্জিন চলে না। আমি মরছি নিজের জ্বালায়, কলমে কালি বইছে না। ধর্মের ষাঁড়ের মতো গাদা গাদা বীর্য নিয়ে বসে আছি, ঢালবার জায়গা নেই। সাহিত্যতত্ত্বে কোনো সাহিত্যিকের কবে লাভ হয়েছে?’ সাহিত্যপাঠ ও মূল্যায়নের সময় পড়–য়া পাঠক তত্ত্বের ঘেরাটোপে যাচাই-বাছাই করে নিতে পারে বৈকি। সৃষ্টিশীল লেখকের শিল্প সৃষ্টি প্রক্রিয়ায় বোধ আলোড়িত স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ কখনো তত্ত্বের সংজ্ঞা শর্ত সাপেক্ষে নয়, তা অবাধ, স্বয়ম্ভূ। লেখা, বিষয় ও তার দর্শনটুকু প্রমাণের জন্য সৃষ্টিশীল লেখক প্রচলিত প্রতিষ্ঠিত কোন শিল্পতত্ত্বের সাঁচে নয়, অনুকূল বা যথার্থ আঙ্গিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই বিষয়কে প্রকাশ করে। কাঠামোবাদ বা উত্তর কাঠমোবাদ বা উত্তর উপনিবেশবাদ তত্ত্বে মোলড্ বা সাঁচে লেখক তার বিষয়Ñ তরল সোনা ঢেলে খাপে খাপ কাঠামোবাদ ইত্যাদি নির্মাণ করে না, ওই কাঠামোবাদের ধারণা রবীন্দ্র-জীবনানন্দ-দেবেশ-ইলিয়াস-উৎপল-জয়কে সাহায্য করেনি। ডিলুস-দেরিদা-ফুকো ‘ইউলিসিস’ ‘রক্ত করবী’ ‘আত্মজা একটি করবী গাছ’ বা ‘যোগাযোগ’ সৃষ্টি করেন না। শিল্প তাত্ত্বিকের তত্ত্ব নিয়ে শিল্পরসিক আলোচক কিছু জ্ঞান বৃদ্ধির ব্যায়াম করতে পারেন মাত্র। লেখকের শিল্পবোধ, জগৎ জীবন সমাজ সংস্কৃতি বিষয়ে অনুভব উপলব্ধি তার রচনা বা শিল্প নির্মাণে ভূমিকা রাখে, কলোনিয়াল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জাতির মনস্ততত্ত্বকে উদ্ধার বা চিহ্নিত করার উদ্দেশ্য নিয়েই ‘হারবার্ট’ লেখা হয় না। বরং স্বতঃস্ফূর্ত ও স্বতন্ত্র আঙ্গিকে নির্মিত ‘হারবার্ট’-এ ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গি ভেঙ্গে পড়ে। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ লিখতে কোনো তত্ত্ব, মডেল এমনকি অগ্রজ মহাজন লেখকদের উপন্যাস বা উপন্যাসরীতিও ইলিয়াসকে সাহায্য করেনি। খালাতো ভাই মতিনের যোগান দেয়া স্কচের অভিঘাতে দ্বিধাহীন ইলিয়াস জানান- ‘চিলেকোঠার সেপাই’ যখন লিখি, আমাকে কেউ সাহায্য করতে পারেনি। উপন্যাসের বুর্জোয়া মডেল আমার কোন কাজে এলো না।... না, আমি কোন সাহায্য পাইনি, সাহিত্য থেকেও নয়, সাহিত্যতত্ত্ব থেকেও নয়, ... উপন্যাস সম্পর্কে আমার নিজের মত থেকেও নয়। লাঙল চালিয়ে নিজেকে ফালা ফালা করে চষে ফেলেছি আর লেখার পর মনে হয়েছে- এই শালা, ব্লাডি ‘বকচ্ছপ’, ‘হাঁসজারু’ শুয়োরের মতো আমার লেখা। এই ব্লাডি ‘বকচ্ছপ’ ‘হাঁসজারু’ই স্বকীয় বিশেষত্বের মধ্যে প্রকাশিত ও নির্মিত হয়েছে। আর কোথাও তার সম্পূর্ণ অনুরূপ ‘কোলন’ আর একটি নেই। যে গ্রন্থে লেখকের রচনা স্বকীয় হয়ে ওঠে, সেই দুর্লভ গুণটিই রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘সাহিত্য রচয়িতার। তা রজঃগুণ নয়, তমোগুণও নয়, তা কল্পনাশক্তির ও রচনাশক্তির গুণ’ (সাহিত্য বিচার)। তো রচনাশক্তি সৃষ্টিশক্তিই লেখককে সাহায্য করে। কোন মডেল বা তত্ত্ব নয়।

লাতিন আমেরিকার সাহিত্য প্রচারের সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিক রিয়ালিজম তত্ত্বটি প্রবল বেগে আলোচিত ও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে গার্সিয়া মার্কেস সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের ঘটনায় যাদুবাস্তবতার পালে যে ভীষণ বাতাস দোলা দেয় তার ঢেউ-তরঙ্গ বাংলায় পৌঁছতে দেরি হয় না। ইংরেজি, অনুবাদ আর ইন্টারনেট মিলিয়ে ক্রমে যাদুবাস্তবতার কথা ভালোই চাউড় হয়। আলোচকবৃন্দ বাংলা সাহিত্যেও যাদুর খোঁজ করতে শুরু করে। এই ধারণাটির মোদ্দা কথা এমন কোন দূরাগত, জটিল নয়, বরং আমাদের মতো প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর সাহিত্যে এই যাদুর ব্যবহার বহু পুরনো, আফ্রিকা বা চীন দেশের সাহিত্যেও ‘যাদুবাস্তবতা’ নতুন কিছু নয়। তবে আধুনিক জীবনের নানামুখী সঙ্কট, সংশয়, অনিশ্চয়তা আর ক্রমে রূঢ় বাস্তবতার প্রখর সংক্রামে বাস্তবতা থেকে যাদুর ‘হেঁয়ালি’ মিলিয়ে যেতে চাইলেও আধুনিক লাতিন সাহিত্যে সাহিত্যশৈলী হিসেবে যাদুবাস্তবতা বিশেষ মনোযোগ পায়।

জার্মান আর্টক্রিটিক ফ্রানৎস রো’র (১৮৯০-১৯৫৫) ‘একসপ্রেশনিজমের পর ম্যাজিক বিয়ালিজম : নবীনতম ইউরোপীয় চিত্রকলার সমস্যাবলী’ (১৯২৫) গ্রন্থে প্রথম ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম’ শব্দটির উল্লেখ পাওয়া যায়। তবে ফ্রানৎস রো কখনো ম্যাজিক রিয়ালিজমকে সাহিত্যের একটি শৈলী বা তত্ত্ব হিসেবে দেখেননি। তিনি বরং এই ধারণাটিকে উত্তর একসপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক মনে করেছেন। রো’র মতে, যাদুবাস্তবতার প্রয়োগ ছিল প্রতিদিনের জীবন যাপনের বাস্তবতার ভেতর নানা চমক, কুহকী ঘটনা এবং বিস্ময়ের অভিব্যক্তিতে।

ভেনেজুয়েলার আর্তুরো উসলার পায়েত্রি (ভেনেজুয়েলার মানুষ ও চিঠি : ১৯৪৮) কিউবার আনোজা কার্পেন্তিয়ের (‘এই মর্তের রাজত্ব’ ১৯৯০) গুয়াতেমালার মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস আর্জেন্টিনার লুই বোর্হেস, কলাম্বিয়ার গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস প্রমুখ প্রধান ব্যক্তির সাহিত্যে শৈলী হিসেবে যাদুবাস্তবতার ব্যবহার ধারণাটিকে সুপরিচিত ও জনপ্রিয়ও করে তোলে। লাতিন আমেরিকার লেখকদের মধ্যে আর্তুরো উসলার ‘ভেনেজুয়েলার মানুষ ও চিঠি’ গ্রন্থেই প্রথম ম্যাজিক রিয়ালিজমের উল্লেখ করেন।

যাদুবাস্তবতার মূল লক্ষণের মধ্যে স্বপ্ন, কল্পনা, লোকবিশ্বাস, সংস্কারের সঙ্গে প্রকৃত বাস্তবতা ও সত্যের সংমিশ্রণের প্রকাশ ঘটে কাহিনীক্রমে। স্থান-কালের সহসা বদল রহস্য, অলৌকিকতা, রূপকথার চমক, অভিব্যক্তিবাদী, কখনো পরাবাস্তববাদী বর্ণনা, আকস্মিকতা ও ব্যাখ্যাতীত ঘটনা ও পরিস্থিতি যাদুবাস্তবতায় ঘটে। আধুনিক সহিত্যে গল্প কাহিনী নির্মাণের এই রীতিটির প্রভাব লাতিন আমেরিকা ছাড়িয়ে বিশ্বের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়ে। এই ছড়িয়ে পড়া খুব সাম্প্রতিককালেরই কথা। ষাটের দশকের শেষ বা সত্তরের দশকের শুরুতে বাংলাদেশে বা বাংলায় যাদু, মায়া, কুহক, বিস্ময়, ব্যাখ্যাতীত ঘটনা, রূপকথা সংস্কার এবং প্রখর প্রবল বাস্তবতা থাকলেও যাদুবাস্তবতা সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে পরিচিত ছিল না। তবে আনহেল ফ্লোরেসের ‘ম্যাজিক্যাল বিয়ালিজম ইন লাতিন আমেরিকান ফিকশন’ (১৯৫৫) গ্রন্থটি সমালোচক মহলে আলোচিত হলেও ঢাকায় এসে পৌঁছায়নি, অন্তত বলা যায় ‘যোগাযোগ’ গল্পের নির্মাতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কাছে তখন পর্যন্ত নয়।

স্বপ্ন অলৌকিকতা আর বাস্তবের বিশেষ যোগাযোগ ঘটে ‘যোগাযোগ’ গল্পে। ‘যাদুবাস্তবতার’ সকল লক্ষণ গল্পের প্রথম থেকেই বর্তমান। গল্পটি প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’-এ (মে ১৯৭৬) অন্তর্ভুক্ত। এই গ্রন্থের গল্পগুলো ১৯৬৫ থেকে ১৯৭৫ সময় পরে লেখা। এই তথ্য ‘তৃণমূল’ ইলিয়াস সংখ্যা এবং রচনা সমগ্র ১-এ উল্লেখ আছে। ‘যোগাযোগ’ রচনার তারিখটি জানা না গেলেও জগন্নাথ কলেজের প্রভাষক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জিন্নাহ এভেন্যুর রেস্টুরেন্ট ‘রেকস’ এবং নবাবপুরের হোটেল ‘আরজু’র জমজমাট আড্ডা-উত্তরকালে লেখা। রেকস ও আরজুর আড্ডায় নিয়মিত সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, খালেদ চৌধুরী, মাজহারুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ। আড্ডার পাশাপাশি লিখছেন গল্প-কবিতা আর পড়ছেন ‘বিশেষত আধুনিক ইউরোপীয় সাহিত্য’। মুক্তিযুদ্ধের সময় কিছু আড্ডা হতো গুলিস্তান সিনেমা হল সংলগ্ন ‘গুলসিতান’ রেস্টুরেন্টে। তো এই বিশেষ আড্ডা পর্বে ইলিয়াস কি ‘ম্যাজিক্যাল বিয়ালিজম ইন লাতিন আমেরিকান ফিকশন’ গ্রন্থটি পড়েছিলেন? আড্ডার সঙ্গীদের দু’জন জানিয়েছেন, তখন পর্যন্ত যাদুবাস্তবতার কথা তারা শোনেননি। যোগাযোগ গল্পের প্রথম থেকেই ম্যাজিক রিয়ালিজমের এমন নিপুণ প্রয়োগ অব্যর্থভাবে ঘটে যে আধুনিক বাংলাদেশে গল্পে সাহিত্যে তার তুলনা বিরল। বলা যায়, সাহিত্যতত্ত্ব হিসেবে যাদুবাস্তবতার কোনো পাঠ ছাড়াই ইলিয়াস গল্পটি লিখেছেন।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জিন্নাহ এভেন্যুর রেস্টুরেন্ট ‘রেকস’ এবং নবাবপুরের হোটেল ‘আরজু’র জমজমাট আড্ডা-উত্তরকালে লেখা। রেকস ও আরজুর আড্ডায় নিয়মিত সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন শহীদ কাদরী, আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, খালেদ চৌধুরী, মাজহারুল ইসলাম, মাহবুবুল আলম, মুহম্মদ খসরু প্রমুখ

তন বছর আগে মৃত মা স্বপ্নের ভিতর রোকেয়াকে ডাকে, ‘রোকেয়া, অ রোকেয়া, আর কতো ঘুমাইবি? কাইন্দা কাইন্দা পোলার তর শ্বাস বন্ধ হয়, উঠলি? অ রোকেয়া!’ ‘পোলার’ কান্না আর মায়ের ডাক শুনে রোকেয়ার স্বপ্ন ঘুম ভেঙ্গে যায়। স্বপ্নের ভিতর মৃত মায়ের ডাক বা ছেলে খোকনের কান্নার কথা জানালেও সজাগ রোকেয়ার মনে হয়, ‘পোলায় না জানি কখন থাইক্যা কান্দে। রোকেয়া তার বাবার সঙ্গে গ্রামের বাড়িতে অসুস্থ বড় মামাকে দেখতে গিয়াছিল। ট্রেনের কামরায় তখন অন্য একটি শিশু না জানি কোন কষ্টে লম্বা সময় ধরে তখন কাঁদছিল। রোকেয়ার একবার মনে হয়, স্বপ্নের ভেতর তার মায়ের জানানো খোকনের কান্না তবে খোকনের নয়, এই সঙ্গী যাত্রীটির সন্তানের কান্নাও হতে পারে, এরকম সান্ত¡না দেয় নিজেকে। কিন্তু একঘেয়ে শিশুর কান্না, ট্রেনের বিরক্তিকর লম্বা যাত্রা, যাত্রীদের ভারি নিশ্বাসপতন, একটি মাত্র পাখার ভোঁ ভোঁ করে ঘোরা সব মিলিয়ে রোকেয়ার বুকে ঠক ঠক বাড়ি মারে, মৃত মায়ের ডাক খোকনের কান্না আবার তাকে আতঙ্কিত করে ‘খোকনের আমার না জানি কি হইলো’।

মামা বাড়ি যাওয়ার পথেই রোকেয়ার বুক অজানা কারণে ‘খচখচ’ করছিল। শৈশবের শত সহস্র স্মৃতির ভিতর দিয়ে মামা বাড়ির চলার পথে খোকনের জন্য মন খারাপ ভাবটা যায় না। নৌকার ভিতর পা পিছলে পড়তে পড়তে সামনে বসলেও খোকনের জন্য মনটা তার কেমন জানি করে। মামার শরীর ভালো না। এবাড়ি সেবাড়ি তবুও ঘুরে রোকেয়া। রোকেয়ার মা সজনে ডাঁটা খেতে পছন্দ করত বলে পুকুর পাড়ে গোটা চারেক সজনে গাছ লাগিয়ে দেয়া হয়েছিল। সন্ধ্যাবেলা সেই সজনে তলায় কোনো কোনো দিন সাদা শাড়ি পরা একটি মেয়েকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। রোকেয়ার ভালো করে দেখবার আগেই মেয়েটি কোথায় যেন চলে যায়। আবার হঠাৎ দেখে, অন্যদিক থেকে সাদা শাড়ি পরা অল্পবয়সী একটি মেয়ে বেগুন ক্ষেত পার হয়ে বাঁশঝাড়ের পথ ধরলো। রোকেয়ার বুকের মধ্যে শিরশির করে ওঠে, ‘বাঁশঝাড়ে চাঁদের ময়লা আলো’। সেই মেয়েটি রোকেয়ার খুব কাছে চলে এলে, রোকেয়া শোনে মেয়েটি বলছে- ‘রোকেয়া তর পোলায় কেমুন আছে?’ মায়ের কণ্ঠস্বরে রোকেয়া খুব চমকে উঠে চারদিকে তাকায়, না কোথাও কেউ নেই। সামনে পুকুর, পুকুরের ওপারে মাঠ। মাঠ ভরা পাকা ধানে হলদে জ্যোৎস্না অলস গা এলিয়ে ঘুম ঘুম চোখে শূন্যতা দেখে। ডান দিকে কালচে সবুজ গ্রাম, বাঁ-দিকে সুপারি বাগান।’ রোকেয়ার মা তবে দৃশ্যমান প্রকৃতির ভিতর কোথায় গেল। বিহ্বল বিস্মিত রোকেয়া ওই সন্ধ্যার ভিতর ঘরে ফিরে শুনলো, খোকনের বাবা হান্নান টেলিগ্রাম পাঠিয়েছে। দোতলার কার্নিশ থেকে খোকন পড়ে গিয়ে আহত হয়েছে।

রোকেয়ার ট্রেন চলছে, মনে আশঙ্কা আর কত মন্দ ভাবনায় শরীর কেঁপে কেঁপে ওঠে। সারিবাঁধা টেলিগ্রাফের পোস্ট পার হয় দ্রুত, আর পোস্টের গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো দেখে তার মাকে, ‘আবার দ্যাখো আরেকটা পোস্টের ওপারে উবু হয়ে মাটি খুঁড়ছে রোকেয়ার স্বামী। ট্রেন চলছেই। হান্নান সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, পেছনে মুখ ফিরিয়ে দেখলো রোকেয়া। ট্রেন চলে যায়। দুর্ভাবনায় রোকেয়ার মন ক্লান্ত। রোকেয়ার বাবা সোলায়মা আলী ট্রেনের কামরাতে ফজর নামাজ শেষ করে। ভোরের প্রশান্ত পবিত্র আলোর ভিতর বিশ্বাসে তার মন ভরে ওঠে। আশঙ্কায় কাতর মেয়ে রোকেয়ার পিঠে হাত রাখে সোলায়মান আলী, খুব মিনতিমাখা গলায় বলে ‘রোকেয়া’ আমি তরে কই, তোর পোলার কিছুই হইবো না, তুই হুদাহুদি ভাইবা মরস রে পাগলী!’

মামাবাড়ির এক সন্ধ্যায় পুকুর পারের সজনে গাছের তলা দিয়ে ওঠে এসে বাঁশঝাড়ের ভিতর দিয়ে যেতে যেতে মৃত মা রোকেয়ার মনে ছেলে খোকনের বিপদের ইঙ্গিত দিয়ে যায়, সেই সন্ধ্যার টেলিগ্রামে খোকনের কার্নিশ থেকে পড়ে যাওয়ার খবর আসে। ঘুমিয়ে পড়া রোকেয়াকে স্বপ্নে এসে মা বলে, পোলায় তোর কান্দে তারপর দীর্ঘ ট্রেন যাত্রায় রোকেয়া টেলিগ্রাফ পোস্টের ফাঁকে ফাঁকে মাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। শেষে বিশ্বাসে কোমল ও আশ্বস্ত কণ্ঠে বাবা বলে, খোকনের তেমন কিছু হয় নাই। আহত, ব্যথায় কাতর, দীর্ণ খোকন হাসপাতালের বেডে গোঙায়, বেঁচে আছে। এ এক অলৌকিক, রহস্যময় যোগাযোগ। সাহিত্যতত্ত্ব ইত্যাদি কেয়ার না করা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সৃষ্টি শক্তির অমিত গুণে যাদুবাস্তবতার যোগাযোগ সৃষ্টি করেন আধুনিক বাংলা সাহিত্যে।

back to top