জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর গল্প
প্লাবন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়- রেখেও যায় কিছু, ফিরিয়েও দেয় কিছু কখনো। বর্ষায় ফুঁসে ওঠা, গ্রীষ্মে ক্ষীণতোয়ার শরীর যখন নিরাভরণ, তখন দেখা যায়। গভীর জলাশয়ের সব সম্পদ নদীতে ফিরে গেলেও পলিতে গাঁথা থাকে তস্কর প্লাবনের লুণ্ঠিত কিছু সামগ্রী। তবে ঠিক যেমনভাবে তাকে নিয়ে গেছিল, তেমন করে ফিরিয়ে দেয় না, সেই চেহারায়ও নয়। অনেক সময় চেনাও যায় না। তবু সে চিনেছিল।
বান সরে গেলে মাঠ যখন আবার সবুজ হয়, পথে যখন ধূলিরাশি ওড়ে আবার, বর্ষায় কূলছাপানো, যেন আদিগন্ত বিস্তৃতই, তখন ছোট শুকনো বিলের বুকে ডোবানো ডালপালা সরালে জলচর প্রাণিদের দেখা মেলে, সাগ্রহে সকলে তাদের ঘরে নিয়ে যায় কিন্তু অকস্মাৎ সেই শূন্যপত্র কর্দমাক্ত বৃক্ষশাখা আর জঞ্জালের নিচে যদি দেখা যায় দেহহীন কোনো কায়া, সভয়ে সকলে সরে যায়। দ্রুত উঠে যায় জলাশয়ের পাড়ে। নানা চিৎকার কোলাহলে অনতিদূর গ্রামের লোকজনও ছুটে আসে কিন্তু কেউ কিছু বোঝে না, চেনে না, জানে না। আর্ত বিস্ময়ে বিমূঢ় সকলে সেদিকে চেয়ে থাকে কেবল। আর তখনই সে এসেছিল, ছুটে নেমেছিল শুকনো বিলের বুকে। পলিমাটি, বালি সরিয়ে স্পষ্ট করেছিল দেহহীন সেই কায়াকে আর মুহূর্তেই সে চিনেছিল। চিনবেই বা না কেন? ধাতব গোলাকার মণিবন্ধনীটি নোনাজল কি বালুমাটিতে যতই বিবর্ণ হোক দেহহীনার হাতে তখনো সেটি অটুট ছিল। আর সেটি দেখেই সে জড়িয়ে ধরেছিল দেহহীন কায়াকে জল, মাটি, কাদা, বালির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে। ধরবেই বা না-কেন, সে জানতো নিজ ইচ্ছায় কোনোমতে ঘর ছাড়েনি সে। ভাসায়নি তাকে বানেও। যে যা-ই বলুক না কেন।
পাড়ের সকলে তখন বিলের শুকনো বুকে নেমে আসে। তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে চায় কেউ কেউ। নানা কথা বলে সকলে, নানা কোলাহল। দেহহীন কায়াকে অতো সহজে চেনা যায় না। বানে ভাসানো কবরের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে, কি শ্মশানের পোড়াকাঠের নিচে থেকেও। নানা যুক্তিও তখনই শোনা যায়। কাছে কোনো সমাধীস্থল নেই, কি নেই কোনো শ্মশানঘাট। আর শ্মশানের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে দেয় প্রায় সবই। রাখে সামান্যই। কারো দেহহীন কায়া অমন অটুট থাকে না।
কেউ গ্রাম্যপ্রধানের কাছে ছুটে যাওয়ার কথা বলে, কেউ বলে ‘চেয়ারম্যানরে ডাকো’। সে কারো কোনো কথায় কান দেয় না। কেশ, মেদ, মজ্জা, শিরা, ত্বকহীন আপনজনের কর্দমাক্ত কায়াটিকে বুকে তুলে নিয়ে বিলের পাড়ে উঠে আসে। ছুটতে থাকে নিজ ঘরের দিকে।
বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে নিয়ে ধোয়ায় সে ঘরে ফিরিয়ে আনা আপনজনকে। সযতেœ তুলে রাখা নিরুদ্দিষ্টার ডুরে শাড়িটিকে বিছিয়ে দেয়। বলে, ওই শাড়িটিই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। সেটিই না হয় পরুক এখন।
ততোক্ষণে গ্রামের মোড়ল ও চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। থানাতেও খবর দেওয়া প্রয়োজন কিনা এমন কথা উঠলে উভয়েই কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত। স্পষ্ট কোনো অপরাধের চিহ্ন দেখা যায় না। জলে ডোবা কি ডুবিয়ে দেওয়া, ভেসে আসা কি ভাসিয়ে দেওয়া দেহাবশেষ যে ওই নিরুদ্দিষ্টারই তারই বা ঠিক কী? সে বলে, মণিবন্ধের ওই অলংকার চেনে সে? অটুট দুটি গোলাকার মণিবন্ধনী- অতি বিবর্ণ, কালো, কিন্তু সে ওই অলংকারের অসমান ঢেউ তোলা আস্তরণ দেখেই বুঝেছে নিজ হাতে কিনেছিল।
তখন সকলে বলে, তাহলে না-হয় শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা যাক। গ্রামপ্রধান কি চেয়ারম্যান সেটি মানে না। ওই দুগাছি চুড়িই পরিচয় নিশ্চিত করে না, আর পরিচয়হীন কারো শেষকৃত্যের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পরিচয় সঠিকও যদি হয় তাহলে কোন অপরাধ, কী দুর্ঘটনা ইত্যাদি স্থির করার জন্যেও ওই দেহাবশেষের প্রয়োজন। শূন্যে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না তাকে।
নানা কথায়, কোলাহলে, উত্তেজনায়, বিতর্কে বেলা চলে যেতে থাকে। বিহ্বল, উ™£ান্ত লোকটি যেন উন্মাদ। এমন সময়ে শহরে পড়ুয়া গ্রামের ছেলেটি বলে, সে বরং শহরে যাক। বড় হাসপাতালের ডাক্তারেরা, শোনা যায়, নানা উপায়ে দেহহীন কায়ারও নাকি পরিচয় নির্ণয় করতে পারেন।
পাড়ের সকলে তখন বিলের শুকনো বুকে নেমে আসে। তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে চায় কেউ কেউ। নানা কথা বলে সকলে, নানা কোলাহল। দেহহীন কায়াকে অতো সহজে চেনা যায় না। বানে ভাসানো কবরের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে, কি শ্মশানের পোড়াকাঠের নিচে থেকেও
সন্ধ্যা ক্রমে নামে। আগ্রহ, উত্তেজনা ক্রমে স্তিমিত হয়। সকলে যার যার ঘরে কী কাজে ফিরে যায়। তাহলে না-হয় তা-ই করো বলে মোড়ল ও চেয়ারম্যানও উঠোন ছেড়ে যায়। প্রতিবেশী কেউ একটি আলো জ্বেলে আনে। রেখে দেয় ডুরে শাড়িটির পাশে। সে স্থির চোখে ওই আলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
দুই
শহরের বড় রাস্তার পাশেই সব সাজানো, নদীর পাড় ধরেই আদালত, ট্রেজারি, উকিল, মোক্তার আর মক্কেলের মিলনস্থল, উঁচু প্রাচীরঘেরা জেলখানা, হাসপাতাল, ম্যাজিস্ট্রেটের নিবাস, সিভিল সার্জনের অফিস, বাসা- আর তার পাশের রাস্তা দিয়ে নদীর দিকে গেলেই ডানে চোখে পড়বে পুলিশপ্রধানের বাসস্থল। সবকটি স্থাপনার পেছন দিয়ে বয়ে গেছে নদী- সমস্ত শহরেরই পাশ দিয়ে যেন। ওইসব দালানকোঠার মাঝে মাঝে রাস্তা নদীর দিকে চলে গেছে লোকালয় থেকে। রাস্তা যেখানে শেষ সেখানে নদীর ঘাট। প্রায়ই বাঁধানো। বর্ষায় নদীর ঢেউ-বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে ছলকে ওঠে। খরার দিনে সিঁড়ি সব শূন্যে ঝুলে থাকে- অনেক নিচে শুকনো নদীর খাত। শুধু হাসপাতাল আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসস্থানের মাঝখানের ঘাটটিই সবসময় ভরা থাকে। বিস্তৃতও নদী এখানে অনেক- গল্পও তাই অনেক। শোনা যায়, চৌধুরীদের বড় ছেলে এই ঘাটে স্নান করতে এসে যেদিন তলিয়ে যায় সেদিনই তার প্রথম বিভাগে পাস করার খবর আসে। ননদের বিয়ের লোকাচারের জন্যে ঘাটে এসে পা পিছলে নদীর গভীরে চলে যায় যে বধূটি সে-ও কখনো ফিরে আসে না। শোনা যায় জল উথাল-পাতাল করেও নাকি কোনো অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেমন পাওয়া যায়নি ওই কৃতবিদ্য ধনী সন্তানের। নদীর নানা ঘাটের নানা গল্প থাকে- আদালতের ঘাটে ডুবে যায় মামলায় সর্বস্ব-হারানো সুদিনশেষের জমিদার, ভরা নদীতেও লাফ দিয়ে পরে আর ওঠে না জেলখানা থেকে নৌকায় ওপারের জেলবাগানে যাওয়ার কয়েদি, চোরাবালিতে ডুবে যায় তুখোড় বক্তা রাজনৈতিক কর্মী যুবকটি- পুলিশ সাহেবের ঘাটেই। আর সব গল্পের শেষেই থাকে ওই একটি কথাই, কারো কোনো অবশেষ কেউ কখনো খুঁজে পায়নি। তাদের পিতা-মাতা, পুত্র, কন্যা নদীর ঘাটে এসে সারাজীবন বসে থাকলেও নয়। কিন্তু সে পেয়েছিল।
তাই সদর রাস্তা থেকে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথটির মোড়ে যখন এক ভোরে দেখা যায় বসে আছে গ্রাম্য কৃষক, প্রায় শূন্যপত্র বেলগাছের নিচে- তখন সকলে চমকে যায়। দেখে সামনে ছড়ানো ভাঁজ করা ডুরে শাড়িটি আর তার ওপরে শোয়ানো এক দেহাবশেষ, তখন অনেকে চমকেও যায়। রাস্তার উলটো পাড় ঘেঁষেও চলে যায় অনেকে। স্কুলের কোমলমতি বালকই কয়েকটি নিঃসন্দেহে, মুখে শব্দ তুলে দৌড়ে জায়গাটি পার হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়ে তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ ওপরে চোখ তুলে তাকায়, দেখে প্রায় শূন্যপত্র বেলফলের গাছটি, ছোট দু-একটি ফলও দেখা যায়, আর তখনই তাদের মনে পড়ে, অশরীরী দেহহীনদের কথা। এই দিনের পরিষ্কার আলোয় ডুরে শাড়ির ওপরে যে শুয়ে আছে, সে কায়াহীন নয়- এ-কথা ভুলে যায়। নদীর ঘাটে নিখোঁজ যারা তাদের কখনো কোনো দেহ ছিল না, কায়াও নয়; এ-কথা বুঝি তাদের মনে পড়ে, তাই স্নানশেষে ফিরতি পথে অসম সাহসী কয়েকজন ঘিরে দাঁড়ায় দেহহীন কায়াটিকে- শংকা, ভয়, উত্তেজনায় দ্রুত শ্বাসও নেয় কেউ কেউ।
লোকটি তখন তাদের কাছে শাড়িতে শোয়ানো আপনজনের কথা বলে। ভেজা চোখে দুই অটুট মণিবন্ধের অলংকার দেখায়, নিজ হাতে কেনা- তাই কোনোমতে তার ভুল হয়নি। চিকিৎসক কি অস্থিবিদেরা কোনোমতে কি পারে না পরিচয় নিশ্চিত করতে? কেউ কি পারে না কেন সে দেহহীন এ-কথা বলে দিতে?
তিন
বেলার সঙ্গে বাড়ে লোক চলাচলও, আর তাই বাড়ে ভয়, শংকা, উত্তেজনা, কৌতূহল। দেহহীনের অনেক গল্প তারা জানে, জানে না কি শোনেনি কখনো দেহহীন কোনো শরীরের গল্প।
ছায়াহীন গাছটি পার হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই বাঁপাশে দাতব্য চিকিৎসালয়। সেখানে কখনো কোনো চিকিৎসক বসে না- কেবল তার সহকারী নানা রঙের আরক-ভরা বোতল নাড়াচাড়া করে সারাদিন। শত ডাকাডাকিতেও সে বেরোয় না। দেহহীন কোনো শরীরের পরিচয় নিশ্চিত করার ক্ষমতা তার নেই।
বড় রাস্তায় যান চলাচল বাড়ে। চলে যায় উকিল, মোক্তার, জজ, আমলা, দফতরি কি কেরানির দল। পায়ে-হাঁটা কেউ তার সামনে দিয়ে গেলে সে ওই গাছতলায় বসেই কাতর মিনতি জানায়। ওই দৃশ্য যে মনোহারি নয় এ-কথা সে বোঝে না, কেবল দেখে দ্রুত পায়ে সরে যাওয়া লোকজন। কেউ যদি সাহস নিয়ে দাঁড়ায়, তাকে দেখায় সে মণিবন্ধের অলংকার। নিজ হাতে কেনা।
বেলা বাড়ে, রৌদ্র প্রখর হয়। আকাশে কিছু মেঘও জমে কখনো। বর্ষণ হয়। লোকটি তেমনি বসে থাকে। আবার রোদ ওঠে। লোকটি বসে থাকে। প্রায় বেলাশেষে হাসপাতালের বড় ডাক্তার তার সামনে এসে বোঝান ওই মণিবন্ধনীই কেবল কোনো পরিচয় নিশ্চিত করে না। আর করলেই বা কি। কারো ক্ষমতা নেই বলার, কেন তার আপনজন এখন দেহহীন। কে তাকে ঘরছাড়া করেছিল, কী ভাসিয়েছিল, কী ডুবিয়েছিলে কারো ক্ষমতা নেই সে-কথা বলার। যদি ঠিকই জানা যেত দেহহীনা কে তাহলে হয়তো পুলিশ কি বিচারক খোঁজখবর নিতে পারে। কিন্তু সেটি স্থির করার কোনো উপায় জানা নেই সরকারি চিকিৎসকের।
আবারো দিনশেষে সন্ধ্যা আসে। হাসপাতাল আর ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ির বিস্তৃত ঘেরা প্রাঙ্গণের মাঝখানে শহরের টাউন ক্লাব। বনেদি অধিবাসীদের মিলনস্থল। বেলা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাবের লোকজন সিমেন্ট-বাঁধানো টেনিস কোটের মাঝ বরাবর প্রায় বুকসমান উঁচু জাল টাঙিয়ে দিয়ে যায়। জালের দুই প্রান্তে জোরালো বৈদ্যুতিক আলোর স্তম্ভ। বিত্তবান, যশস্বী, প্রতাপী কেউ কেউ টেনিস খেলার সাদা পোশাক পরে খেলায় নামে। আলোয় চারপাশ স্পষ্ট দেখা যায়। দেখা যায় লোকটিকেও, আর তার সামনে শ্বেত কায়া উজ্জ্বল আলোয় আরো শুভ্রতা পায়।
তবু তারা আসে। গাছটির আড়ালে, সামান্য অন্ধকারে দাঁড়ায়। বলে, সারাদিনে কিছুই তো মেলেনি তার, মিলবেও না কখনো। শুধু শুধু কেন সে ডোরাকাটা শাড়িতে শোয়ানো ওই দেহহীনাকে বয়ে বেড়াবে। বরং দিয়ে দিক সেটি তাদের হাতে তুলে। কিছু নিঃসন্দেহে মিলবে তার।
বিস্ময়ে ত্রাসে চারপাশে তাকায় সে, অন্য কাউকে দেখে না কাছে। কিছুদূরের টেনিস খেলার মাঠে সহর্ষ শব্দ কেবল। হাসপাতালের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। দাতব্য চিকিৎসালয় অন্ধকার। সহকারী চিকিৎসক কোনকালে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেছে। বড় রাস্তায় যান চলাচল কমে এসেছে, লোক চলাচলও। রাত্রিবেলায় এই পথে হাঁটে না তেমন কেউ।
নদীর নানা ঘাটের নানা গল্প থাকে- আদালতের ঘাটে ডুবে যায় মামলায় সর্বস্ব-হারানো সুদিনশেষের জমিদার, ভরা নদীতেও লাফ দিয়ে পরে আর ওঠে না জেলখানা থেকে নৌকায় ওপারের জেলবাগানে যাওয়ার কয়েদি, চোরাবালিতে ডুবে যায় তুখোড় বক্তা রাজনৈতিক কর্মী যুবকটি- পুলিশ সাহেবের ঘাটেই
দিশাহীন লোকটি তখন উঠে দাঁড়ায়। শাড়ি দিয়ে দেহহীনার সমস্ত শরীর জড়িয়ে নেয়। জড়িয়ে বুকের কাছে ধরে রাখে। পাশে দাঁড়ানো সাহায্যদানে উৎসুকজনকে বলে, তারা চলে যাক। সে বরং যাবে আদালতপাড়াতেই। সারারাতের শেষে সকালে জজ সাহেব তো আসবেনই। আদালতের উল্টোদিকে পুলিশপ্রধানের দফতর। জানে সে। সেখানেও না-হয় যাবে। সকাল হলে কারো-না-কারো দেখা তো মিলবেই। কেউ-না-কেউ তো এগিয়ে আসবেই। শুনবে তার কথা। চাই কি কোনো উপায়ে তার মিলবে সে যা চায়।
সন্ত্রাসীজন হাসে কেবল। কিছুই মিলবে না আগামীদিন শেষেও, এ-কথা বললেও দেহাবশেষ তার হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার সাহস তাদের হয় না। জজ পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের অঞ্চল। নানা প্রহরী পুলিশের ঘোরাফেরা। সামান্য আর্তচিৎকার শুনলেও তাদের কেউ ছুটে আসবে এ-কথা জানে দুর্জন সকলে। তাই বড় রাস্তায় উঠে ডানে ঘুরে আদালতপাড়ার দিকে যেতে দেয় তাকে।
অসমান পা ফেলে হাঁটে সে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কি অবসাদ কিছু সে মানেনি। কিন্তু ওইসবই তার সঙ্গে আছে। কেবল সে-ই কিছু বোঝে না। অসমান পায়ে হাঁটতে থাকে। এই রাত্রিটুকুই তো কেবল- ভাবে বুঝি।
ঘন বটপাকুড়ের ছায়ায় ঢাকা আদালতের রাস্তা। আলোর স্তম্ভ দাঁড়ানো দূরে দূরে। কিছু অন্ধকার তারা দূর করে। ডানপাশে সহগ্র কক্ষের আদালত ভবন- যেন শেষ- শুরু দেখা যায় না। বাঁপাশে পুলিশের আস্তানা। সেখানে সান্ত্রী দাঁড়ানো। আদালতের শেষে ট্রেজারি- সরকারি ধনাগার। ঘণ্টা পেটানোর হাতুড়ি হাতে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত্রী সেখানেও। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আওয়াজ তোলার জন্যেই।
কোনো ভয় তাকে স্পর্শ করে না। পুলিশ কোর্টের উল্টোদিকে আদালত ভবনের ঠিক মাঝখানে আলোর নিচে বসে সে। সে কোনো অন্যায়ী নয়- ভয় কিসের তার।
দেহহীনাকে পাশে রাখে সে। সকালের অপেক্ষায় নিজেও সিঁড়ির ধাপে হেলান দেয়। চোখ বুঁজবে না সে কিছুতেই কিন্তু বুঁজলেই দেখতে পেতো পাশেই ডোরাকাটা শাড়ি পরে বসে আছে যে হাতে তার ঝকঝকে বালা দুটি। তেমনি মসৃণ ত্বক- হাত বোলালেই বুঝতো সে। দেখতো খোলা চুল উড়ছে সামান্য বাতাসে।
আর মাত্র কিছু সময়। এই সময়টুকুই আছে তার দেহহীনার দেহকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। ফিরিয়ে এনে বিচারকের সামনে দাঁড়াবে সে। সামান্য কৃষকের মুখে যে-কথা মানায় না, যে-কথা শোনা যায় না; সে-কথাই বলবে সে। বলবে, মহামান্য বিচারক, দেখুন এই আমার সে- জলে ভাসে না, আগুনে পোড়ে না। আমি জানি, সে কে। এখন আপনি বলে দিন, সে কে? সে আমার কে?
জ্যোতিপ্রকাশ দত্তর গল্প
সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩
প্লাবন সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়- রেখেও যায় কিছু, ফিরিয়েও দেয় কিছু কখনো। বর্ষায় ফুঁসে ওঠা, গ্রীষ্মে ক্ষীণতোয়ার শরীর যখন নিরাভরণ, তখন দেখা যায়। গভীর জলাশয়ের সব সম্পদ নদীতে ফিরে গেলেও পলিতে গাঁথা থাকে তস্কর প্লাবনের লুণ্ঠিত কিছু সামগ্রী। তবে ঠিক যেমনভাবে তাকে নিয়ে গেছিল, তেমন করে ফিরিয়ে দেয় না, সেই চেহারায়ও নয়। অনেক সময় চেনাও যায় না। তবু সে চিনেছিল।
বান সরে গেলে মাঠ যখন আবার সবুজ হয়, পথে যখন ধূলিরাশি ওড়ে আবার, বর্ষায় কূলছাপানো, যেন আদিগন্ত বিস্তৃতই, তখন ছোট শুকনো বিলের বুকে ডোবানো ডালপালা সরালে জলচর প্রাণিদের দেখা মেলে, সাগ্রহে সকলে তাদের ঘরে নিয়ে যায় কিন্তু অকস্মাৎ সেই শূন্যপত্র কর্দমাক্ত বৃক্ষশাখা আর জঞ্জালের নিচে যদি দেখা যায় দেহহীন কোনো কায়া, সভয়ে সকলে সরে যায়। দ্রুত উঠে যায় জলাশয়ের পাড়ে। নানা চিৎকার কোলাহলে অনতিদূর গ্রামের লোকজনও ছুটে আসে কিন্তু কেউ কিছু বোঝে না, চেনে না, জানে না। আর্ত বিস্ময়ে বিমূঢ় সকলে সেদিকে চেয়ে থাকে কেবল। আর তখনই সে এসেছিল, ছুটে নেমেছিল শুকনো বিলের বুকে। পলিমাটি, বালি সরিয়ে স্পষ্ট করেছিল দেহহীন সেই কায়াকে আর মুহূর্তেই সে চিনেছিল। চিনবেই বা না কেন? ধাতব গোলাকার মণিবন্ধনীটি নোনাজল কি বালুমাটিতে যতই বিবর্ণ হোক দেহহীনার হাতে তখনো সেটি অটুট ছিল। আর সেটি দেখেই সে জড়িয়ে ধরেছিল দেহহীন কায়াকে জল, মাটি, কাদা, বালির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে। ধরবেই বা না-কেন, সে জানতো নিজ ইচ্ছায় কোনোমতে ঘর ছাড়েনি সে। ভাসায়নি তাকে বানেও। যে যা-ই বলুক না কেন।
পাড়ের সকলে তখন বিলের শুকনো বুকে নেমে আসে। তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে চায় কেউ কেউ। নানা কথা বলে সকলে, নানা কোলাহল। দেহহীন কায়াকে অতো সহজে চেনা যায় না। বানে ভাসানো কবরের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে, কি শ্মশানের পোড়াকাঠের নিচে থেকেও। নানা যুক্তিও তখনই শোনা যায়। কাছে কোনো সমাধীস্থল নেই, কি নেই কোনো শ্মশানঘাট। আর শ্মশানের লেলিহান শিখা পুড়িয়ে দেয় প্রায় সবই। রাখে সামান্যই। কারো দেহহীন কায়া অমন অটুট থাকে না।
কেউ গ্রাম্যপ্রধানের কাছে ছুটে যাওয়ার কথা বলে, কেউ বলে ‘চেয়ারম্যানরে ডাকো’। সে কারো কোনো কথায় কান দেয় না। কেশ, মেদ, মজ্জা, শিরা, ত্বকহীন আপনজনের কর্দমাক্ত কায়াটিকে বুকে তুলে নিয়ে বিলের পাড়ে উঠে আসে। ছুটতে থাকে নিজ ঘরের দিকে।
বাড়ির পাশের পুকুরপাড়ে নিয়ে ধোয়ায় সে ঘরে ফিরিয়ে আনা আপনজনকে। সযতেœ তুলে রাখা নিরুদ্দিষ্টার ডুরে শাড়িটিকে বিছিয়ে দেয়। বলে, ওই শাড়িটিই সবচেয়ে পছন্দের ছিল। সেটিই না হয় পরুক এখন।
ততোক্ষণে গ্রামের মোড়ল ও চেয়ারম্যান বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়িয়েছে। থানাতেও খবর দেওয়া প্রয়োজন কিনা এমন কথা উঠলে উভয়েই কিঞ্চিৎ দ্বিধান্বিত। স্পষ্ট কোনো অপরাধের চিহ্ন দেখা যায় না। জলে ডোবা কি ডুবিয়ে দেওয়া, ভেসে আসা কি ভাসিয়ে দেওয়া দেহাবশেষ যে ওই নিরুদ্দিষ্টারই তারই বা ঠিক কী? সে বলে, মণিবন্ধের ওই অলংকার চেনে সে? অটুট দুটি গোলাকার মণিবন্ধনী- অতি বিবর্ণ, কালো, কিন্তু সে ওই অলংকারের অসমান ঢেউ তোলা আস্তরণ দেখেই বুঝেছে নিজ হাতে কিনেছিল।
তখন সকলে বলে, তাহলে না-হয় শেষকৃত্যের ব্যবস্থা করা যাক। গ্রামপ্রধান কি চেয়ারম্যান সেটি মানে না। ওই দুগাছি চুড়িই পরিচয় নিশ্চিত করে না, আর পরিচয়হীন কারো শেষকৃত্যের কোনো প্রশ্নই ওঠে না। পরিচয় সঠিকও যদি হয় তাহলে কোন অপরাধ, কী দুর্ঘটনা ইত্যাদি স্থির করার জন্যেও ওই দেহাবশেষের প্রয়োজন। শূন্যে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না তাকে।
নানা কথায়, কোলাহলে, উত্তেজনায়, বিতর্কে বেলা চলে যেতে থাকে। বিহ্বল, উ™£ান্ত লোকটি যেন উন্মাদ। এমন সময়ে শহরে পড়ুয়া গ্রামের ছেলেটি বলে, সে বরং শহরে যাক। বড় হাসপাতালের ডাক্তারেরা, শোনা যায়, নানা উপায়ে দেহহীন কায়ারও নাকি পরিচয় নির্ণয় করতে পারেন।
পাড়ের সকলে তখন বিলের শুকনো বুকে নেমে আসে। তাকে হাত ধরে টেনে তুলতে চায় কেউ কেউ। নানা কথা বলে সকলে, নানা কোলাহল। দেহহীন কায়াকে অতো সহজে চেনা যায় না। বানে ভাসানো কবরের আশ্রয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সে, কি শ্মশানের পোড়াকাঠের নিচে থেকেও
সন্ধ্যা ক্রমে নামে। আগ্রহ, উত্তেজনা ক্রমে স্তিমিত হয়। সকলে যার যার ঘরে কী কাজে ফিরে যায়। তাহলে না-হয় তা-ই করো বলে মোড়ল ও চেয়ারম্যানও উঠোন ছেড়ে যায়। প্রতিবেশী কেউ একটি আলো জ্বেলে আনে। রেখে দেয় ডুরে শাড়িটির পাশে। সে স্থির চোখে ওই আলোর দিকে তাকিয়ে বসে থাকে।
দুই
শহরের বড় রাস্তার পাশেই সব সাজানো, নদীর পাড় ধরেই আদালত, ট্রেজারি, উকিল, মোক্তার আর মক্কেলের মিলনস্থল, উঁচু প্রাচীরঘেরা জেলখানা, হাসপাতাল, ম্যাজিস্ট্রেটের নিবাস, সিভিল সার্জনের অফিস, বাসা- আর তার পাশের রাস্তা দিয়ে নদীর দিকে গেলেই ডানে চোখে পড়বে পুলিশপ্রধানের বাসস্থল। সবকটি স্থাপনার পেছন দিয়ে বয়ে গেছে নদী- সমস্ত শহরেরই পাশ দিয়ে যেন। ওইসব দালানকোঠার মাঝে মাঝে রাস্তা নদীর দিকে চলে গেছে লোকালয় থেকে। রাস্তা যেখানে শেষ সেখানে নদীর ঘাট। প্রায়ই বাঁধানো। বর্ষায় নদীর ঢেউ-বাঁধানো ঘাটের সিঁড়িতে ছলকে ওঠে। খরার দিনে সিঁড়ি সব শূন্যে ঝুলে থাকে- অনেক নিচে শুকনো নদীর খাত। শুধু হাসপাতাল আর জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের বাসস্থানের মাঝখানের ঘাটটিই সবসময় ভরা থাকে। বিস্তৃতও নদী এখানে অনেক- গল্পও তাই অনেক। শোনা যায়, চৌধুরীদের বড় ছেলে এই ঘাটে স্নান করতে এসে যেদিন তলিয়ে যায় সেদিনই তার প্রথম বিভাগে পাস করার খবর আসে। ননদের বিয়ের লোকাচারের জন্যে ঘাটে এসে পা পিছলে নদীর গভীরে চলে যায় যে বধূটি সে-ও কখনো ফিরে আসে না। শোনা যায় জল উথাল-পাতাল করেও নাকি কোনো অবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেমন পাওয়া যায়নি ওই কৃতবিদ্য ধনী সন্তানের। নদীর নানা ঘাটের নানা গল্প থাকে- আদালতের ঘাটে ডুবে যায় মামলায় সর্বস্ব-হারানো সুদিনশেষের জমিদার, ভরা নদীতেও লাফ দিয়ে পরে আর ওঠে না জেলখানা থেকে নৌকায় ওপারের জেলবাগানে যাওয়ার কয়েদি, চোরাবালিতে ডুবে যায় তুখোড় বক্তা রাজনৈতিক কর্মী যুবকটি- পুলিশ সাহেবের ঘাটেই। আর সব গল্পের শেষেই থাকে ওই একটি কথাই, কারো কোনো অবশেষ কেউ কখনো খুঁজে পায়নি। তাদের পিতা-মাতা, পুত্র, কন্যা নদীর ঘাটে এসে সারাজীবন বসে থাকলেও নয়। কিন্তু সে পেয়েছিল।
তাই সদর রাস্তা থেকে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার পথটির মোড়ে যখন এক ভোরে দেখা যায় বসে আছে গ্রাম্য কৃষক, প্রায় শূন্যপত্র বেলগাছের নিচে- তখন সকলে চমকে যায়। দেখে সামনে ছড়ানো ভাঁজ করা ডুরে শাড়িটি আর তার ওপরে শোয়ানো এক দেহাবশেষ, তখন অনেকে চমকেও যায়। রাস্তার উলটো পাড় ঘেঁষেও চলে যায় অনেকে। স্কুলের কোমলমতি বালকই কয়েকটি নিঃসন্দেহে, মুখে শব্দ তুলে দৌড়ে জায়গাটি পার হয়ে যায়। একটু দূরে গিয়ে তাদেরই মধ্যে কেউ কেউ ওপরে চোখ তুলে তাকায়, দেখে প্রায় শূন্যপত্র বেলফলের গাছটি, ছোট দু-একটি ফলও দেখা যায়, আর তখনই তাদের মনে পড়ে, অশরীরী দেহহীনদের কথা। এই দিনের পরিষ্কার আলোয় ডুরে শাড়ির ওপরে যে শুয়ে আছে, সে কায়াহীন নয়- এ-কথা ভুলে যায়। নদীর ঘাটে নিখোঁজ যারা তাদের কখনো কোনো দেহ ছিল না, কায়াও নয়; এ-কথা বুঝি তাদের মনে পড়ে, তাই স্নানশেষে ফিরতি পথে অসম সাহসী কয়েকজন ঘিরে দাঁড়ায় দেহহীন কায়াটিকে- শংকা, ভয়, উত্তেজনায় দ্রুত শ্বাসও নেয় কেউ কেউ।
লোকটি তখন তাদের কাছে শাড়িতে শোয়ানো আপনজনের কথা বলে। ভেজা চোখে দুই অটুট মণিবন্ধের অলংকার দেখায়, নিজ হাতে কেনা- তাই কোনোমতে তার ভুল হয়নি। চিকিৎসক কি অস্থিবিদেরা কোনোমতে কি পারে না পরিচয় নিশ্চিত করতে? কেউ কি পারে না কেন সে দেহহীন এ-কথা বলে দিতে?
তিন
বেলার সঙ্গে বাড়ে লোক চলাচলও, আর তাই বাড়ে ভয়, শংকা, উত্তেজনা, কৌতূহল। দেহহীনের অনেক গল্প তারা জানে, জানে না কি শোনেনি কখনো দেহহীন কোনো শরীরের গল্প।
ছায়াহীন গাছটি পার হয়ে হাসপাতালে যাওয়ার পথেই বাঁপাশে দাতব্য চিকিৎসালয়। সেখানে কখনো কোনো চিকিৎসক বসে না- কেবল তার সহকারী নানা রঙের আরক-ভরা বোতল নাড়াচাড়া করে সারাদিন। শত ডাকাডাকিতেও সে বেরোয় না। দেহহীন কোনো শরীরের পরিচয় নিশ্চিত করার ক্ষমতা তার নেই।
বড় রাস্তায় যান চলাচল বাড়ে। চলে যায় উকিল, মোক্তার, জজ, আমলা, দফতরি কি কেরানির দল। পায়ে-হাঁটা কেউ তার সামনে দিয়ে গেলে সে ওই গাছতলায় বসেই কাতর মিনতি জানায়। ওই দৃশ্য যে মনোহারি নয় এ-কথা সে বোঝে না, কেবল দেখে দ্রুত পায়ে সরে যাওয়া লোকজন। কেউ যদি সাহস নিয়ে দাঁড়ায়, তাকে দেখায় সে মণিবন্ধের অলংকার। নিজ হাতে কেনা।
বেলা বাড়ে, রৌদ্র প্রখর হয়। আকাশে কিছু মেঘও জমে কখনো। বর্ষণ হয়। লোকটি তেমনি বসে থাকে। আবার রোদ ওঠে। লোকটি বসে থাকে। প্রায় বেলাশেষে হাসপাতালের বড় ডাক্তার তার সামনে এসে বোঝান ওই মণিবন্ধনীই কেবল কোনো পরিচয় নিশ্চিত করে না। আর করলেই বা কি। কারো ক্ষমতা নেই বলার, কেন তার আপনজন এখন দেহহীন। কে তাকে ঘরছাড়া করেছিল, কী ভাসিয়েছিল, কী ডুবিয়েছিলে কারো ক্ষমতা নেই সে-কথা বলার। যদি ঠিকই জানা যেত দেহহীনা কে তাহলে হয়তো পুলিশ কি বিচারক খোঁজখবর নিতে পারে। কিন্তু সেটি স্থির করার কোনো উপায় জানা নেই সরকারি চিকিৎসকের।
আবারো দিনশেষে সন্ধ্যা আসে। হাসপাতাল আর ম্যাজিস্ট্রেটের বাড়ির বিস্তৃত ঘেরা প্রাঙ্গণের মাঝখানে শহরের টাউন ক্লাব। বনেদি অধিবাসীদের মিলনস্থল। বেলা শেষ হওয়ার আগেই ক্লাবের লোকজন সিমেন্ট-বাঁধানো টেনিস কোটের মাঝ বরাবর প্রায় বুকসমান উঁচু জাল টাঙিয়ে দিয়ে যায়। জালের দুই প্রান্তে জোরালো বৈদ্যুতিক আলোর স্তম্ভ। বিত্তবান, যশস্বী, প্রতাপী কেউ কেউ টেনিস খেলার সাদা পোশাক পরে খেলায় নামে। আলোয় চারপাশ স্পষ্ট দেখা যায়। দেখা যায় লোকটিকেও, আর তার সামনে শ্বেত কায়া উজ্জ্বল আলোয় আরো শুভ্রতা পায়।
তবু তারা আসে। গাছটির আড়ালে, সামান্য অন্ধকারে দাঁড়ায়। বলে, সারাদিনে কিছুই তো মেলেনি তার, মিলবেও না কখনো। শুধু শুধু কেন সে ডোরাকাটা শাড়িতে শোয়ানো ওই দেহহীনাকে বয়ে বেড়াবে। বরং দিয়ে দিক সেটি তাদের হাতে তুলে। কিছু নিঃসন্দেহে মিলবে তার।
বিস্ময়ে ত্রাসে চারপাশে তাকায় সে, অন্য কাউকে দেখে না কাছে। কিছুদূরের টেনিস খেলার মাঠে সহর্ষ শব্দ কেবল। হাসপাতালের ঘরে ঘরে আলো জ্বলে। দাতব্য চিকিৎসালয় অন্ধকার। সহকারী চিকিৎসক কোনকালে দরজা বন্ধ করে বেরিয়ে গেছে। বড় রাস্তায় যান চলাচল কমে এসেছে, লোক চলাচলও। রাত্রিবেলায় এই পথে হাঁটে না তেমন কেউ।
নদীর নানা ঘাটের নানা গল্প থাকে- আদালতের ঘাটে ডুবে যায় মামলায় সর্বস্ব-হারানো সুদিনশেষের জমিদার, ভরা নদীতেও লাফ দিয়ে পরে আর ওঠে না জেলখানা থেকে নৌকায় ওপারের জেলবাগানে যাওয়ার কয়েদি, চোরাবালিতে ডুবে যায় তুখোড় বক্তা রাজনৈতিক কর্মী যুবকটি- পুলিশ সাহেবের ঘাটেই
দিশাহীন লোকটি তখন উঠে দাঁড়ায়। শাড়ি দিয়ে দেহহীনার সমস্ত শরীর জড়িয়ে নেয়। জড়িয়ে বুকের কাছে ধরে রাখে। পাশে দাঁড়ানো সাহায্যদানে উৎসুকজনকে বলে, তারা চলে যাক। সে বরং যাবে আদালতপাড়াতেই। সারারাতের শেষে সকালে জজ সাহেব তো আসবেনই। আদালতের উল্টোদিকে পুলিশপ্রধানের দফতর। জানে সে। সেখানেও না-হয় যাবে। সকাল হলে কারো-না-কারো দেখা তো মিলবেই। কেউ-না-কেউ তো এগিয়ে আসবেই। শুনবে তার কথা। চাই কি কোনো উপায়ে তার মিলবে সে যা চায়।
সন্ত্রাসীজন হাসে কেবল। কিছুই মিলবে না আগামীদিন শেষেও, এ-কথা বললেও দেহাবশেষ তার হাত থেকে কেড়ে নেওয়ার সাহস তাদের হয় না। জজ পুলিশ ম্যাজিস্ট্রেটের অঞ্চল। নানা প্রহরী পুলিশের ঘোরাফেরা। সামান্য আর্তচিৎকার শুনলেও তাদের কেউ ছুটে আসবে এ-কথা জানে দুর্জন সকলে। তাই বড় রাস্তায় উঠে ডানে ঘুরে আদালতপাড়ার দিকে যেতে দেয় তাকে।
অসমান পা ফেলে হাঁটে সে। ক্ষুধা-তৃষ্ণা কি অবসাদ কিছু সে মানেনি। কিন্তু ওইসবই তার সঙ্গে আছে। কেবল সে-ই কিছু বোঝে না। অসমান পায়ে হাঁটতে থাকে। এই রাত্রিটুকুই তো কেবল- ভাবে বুঝি।
ঘন বটপাকুড়ের ছায়ায় ঢাকা আদালতের রাস্তা। আলোর স্তম্ভ দাঁড়ানো দূরে দূরে। কিছু অন্ধকার তারা দূর করে। ডানপাশে সহগ্র কক্ষের আদালত ভবন- যেন শেষ- শুরু দেখা যায় না। বাঁপাশে পুলিশের আস্তানা। সেখানে সান্ত্রী দাঁড়ানো। আদালতের শেষে ট্রেজারি- সরকারি ধনাগার। ঘণ্টা পেটানোর হাতুড়ি হাতে সারাক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে শান্ত্রী সেখানেও। ঘণ্টায় ঘণ্টায় আওয়াজ তোলার জন্যেই।
কোনো ভয় তাকে স্পর্শ করে না। পুলিশ কোর্টের উল্টোদিকে আদালত ভবনের ঠিক মাঝখানে আলোর নিচে বসে সে। সে কোনো অন্যায়ী নয়- ভয় কিসের তার।
দেহহীনাকে পাশে রাখে সে। সকালের অপেক্ষায় নিজেও সিঁড়ির ধাপে হেলান দেয়। চোখ বুঁজবে না সে কিছুতেই কিন্তু বুঁজলেই দেখতে পেতো পাশেই ডোরাকাটা শাড়ি পরে বসে আছে যে হাতে তার ঝকঝকে বালা দুটি। তেমনি মসৃণ ত্বক- হাত বোলালেই বুঝতো সে। দেখতো খোলা চুল উড়ছে সামান্য বাতাসে।
আর মাত্র কিছু সময়। এই সময়টুকুই আছে তার দেহহীনার দেহকে ফিরিয়ে আনার জন্যে। ফিরিয়ে এনে বিচারকের সামনে দাঁড়াবে সে। সামান্য কৃষকের মুখে যে-কথা মানায় না, যে-কথা শোনা যায় না; সে-কথাই বলবে সে। বলবে, মহামান্য বিচারক, দেখুন এই আমার সে- জলে ভাসে না, আগুনে পোড়ে না। আমি জানি, সে কে। এখন আপনি বলে দিন, সে কে? সে আমার কে?