alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ১০

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

: সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

পূর্ব প্রকাশের পর

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ইংরেজিতে অনার্স পড়া আমার সহপাঠী যারা ছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই অন্যতম ছিল হায়াত হোসেন, কারণ সে শুধু ডানপিটেই ছিল যেমন মেধাবি তেমনি প্রগতিশীল এবং উইটি ছিল। এই দীর্ঘাঙ্গী সুদর্শন হায়াত, আগেই বলেছি আমার রুমমেট ছিল। সে যাই-ই করতো তাই-ই আমার কাছে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা বলে মনে হতো এবং আমার মনে যুগপৎ ঈর্ষা এবং অনুকরণ-স্পৃহা জাগরুক হতো- আমি যদি হায়াত-এর মতো হতে পারতাম, কিম্বা হায়াত আসলে ভাল নয়- বড্ড বাড়াবাড়ি করে সব ব্যাপারে, এমনকি মেয়েদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রেও! মেয়েদের সাথে মেলামেশাতে তার আসলে কতটা উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল তার প্রমাণ শুধু তার বর্ণিত বিভিন্ন অভিযানের গল্প শুনেই জানতে পারতাম, এবং বিশ্বাসও করতাম। এই কাজটি হতো সাধারণত রাতের খাওয়ার পর আমাদের রুমে, অর্থাৎ আমি এবং হায়াত যে রুমে থাকতাম, এবং এই আসরে আমার চাচাত ভাই সাদুল্লাহও (ওর ডাক নাম ছিল সুরুজ এবং আমার খোকন, এবং আমরা পরস্পরকে এই ডাক নামেই সম্বোধন করতাম) শামিল হতো, যদিও ও অন্য রুমে থাকতো। ওরা দু’জন ক্যাম্পাসে ওদের সারাদিনের নারী-সাক্ষাতের গল্প শোনাতো- হায়াত, হয় আমার বিছানাতে কিম্বা ওর নিজের বিছানাতে বালিশে ঠেস দিয়ে জুতোসুদ্ধ পায়ে আধশোয়া হয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে, আর সুরুজ, কখনও চেয়ারে বসে আবার কখনও আমার বা হায়াত-এর বিছানাতে সটান শুয়ে। আমি যেখানে হোক বসে বা হেলান দিয়ে ওদের কথা বিমোহিত হয়ে শুনতাম- কখনও সামান্যতম অবিশ্বাস মনের ভেতর উদয় হতো না। হায়াত-এর সিগারেট টানার একটি নিজস্ব স্টাইল ছিলো- তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে সিগারেট ধরে মুষ্টিবদ্ধ হাতে সিগারেটে দীর্ঘ টান আর সেই ফাঁকে গল্প।

আমাদের সময় ক্যাম্পাসে মেয়েদের সাথে গল্প করাটাই অসম্ভব প্রায় ছিল। মেয়েরা কদাচিৎ ক্লাসের এবং তাদের কমন রুমের বাইরে বেরুতো, এমনকি শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দাতেও তাদের সাথে কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো। এমন একটি ঘটনা স্বয়ং আমার সাথেই ঘটেছে একবার- সে গল্প তোলা থাকলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার অভিজ্ঞতার বর্ণনার সময়কালের জন্য। মেয়েরা সবাই ক্লাসের সময় হলে শিক্ষকের সাথে সারি বেঁধে ক্লাসে ঢুকতো এবং ক্লাস শেষে শিক্ষকের সাথেই বেরিয়ে যেতো। এহেন কড়াকড়ির ভেতর ঠিক কোন সময়ে হায়াত বা সুরুজ মেয়েদের সান্নিধ্যে আসতে পারতো সে প্রশ্ন তখন আমার মনে কখোনই আসেনি।

তবে একটি অপরাধ আমরা তিনজনই করেছি আমাদের অজান্তে- কারণ ওই অপরিণত বয়সে, সময়ে, পরিবেশে তারুণ্যের অনুসন্ধিৎসার তাড়নাতে আমরা মানুষের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার কথা একবারও বিবেচনাতে আনি নি। আসলে হায়াত-এর প্রেমে অনেক মেয়েই পড়েছে একথা যেমন সত্যি, তেমনি একজন বিশেষ মেয়ে তাকে ভীষণ ভালবাসতো সেটাও সত্যি- তবে এর ভেতর তার এবং সুরুজের যে নারী-সাক্ষাতের গল্পগুলো ছিলো তা আসলে অধিকাংশই কল্পনাশ্রিত সে বিষয়টি বুঝতে আমার এবয়সে কোনোই কষ্ট হয় না, এবং একে আমি কোনো অপরাধও মনে করি না। ইংরেজি ভাষাভাষি পশ্চিমা দেশগুলোতে একে অপশব্দে বলা হয় লকার রুম টক, অর্থাৎ ছেলেদের শিক্ষায়তনে কিম্বা মাঠে পুরুষ খেলোয়াড়দের জিনিসপত্র রাখার দেরাজ ঘরে মেয়েদের নিয়ে যে রগরগে আলাপ। এমনটা একবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে করতে দেখা গেছে, যদিও ঐ দেরাজ ঘরে নয়, বাসে, এবং বিষয়টাকে কেউ অপরাধের পর্যায়ের বলে মনে করেনি। আমরাও দেরাজ ঘরে এমন আলাপ করতাম না কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেরাজ ঘর ছিলোই না, করতাম আমাদের হলের রুমে, এবং গল্পগুলো ঐ লকার রুম টক-এর চরিত্রেরই ছিলো।

তবে আমি যে বিষয়টিকে অপরাধ মনে করি সেটি হলো হায়াতকে লেখা ঐ মেয়েটির একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমপত্রের বেশ কিছু ঐ হলের রুমের আসরে সুরুজকে এবং আমাকে পড়ে শোনানো এবং তাকে হাসির খোরাক বানানো। কিন্তু এটাও ঠিক প্রাইভেসি বা একান্ততার শিক্ষাটা আমাদের সমাজে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে কখনই গুরুত্ব দেয়া হয় না, এবং আমি আমার জীবনে বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত, এবং দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করা অনেক বাঙালিকে (যাদের সাথে আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী ছিলাম বা আছি) দেখেছি, অন্যদের, বিশেষ করে নারীদের বিষয়ে অনাবশ্যক কৌতূহল দেখাতে।

তো এইস্মার্ট হায়াতকে বেশ ভুগতে হয়েছে তার অতি প্রগতিবাদের জন্য। আমি আগের এক কিস্তিতে বলেছি হায়াতকে তদানীন্তন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডেরেশন দুচোখে দেখতে পারতো না এবং এজন্য তাকে এবং আমাকেও তার রুমমেট হিসাবে বেশ হেনস্তার ভেতর পড়তে হয়েছে কয়েকবার। আমাদের শিক্ষাজীবনের পুরো সময়টাই আইয়ুবীও যুগ ছিলো। এর যেমন অতি খারাপ দিক ছিলো তেমনি অতি ভাল দিকও ছিলো। ঐ অতি খারাপ দিকের কারণেই হায়াত-এর আপাতদৃষ্টিতে কপাল পুড়েছিলো। অইয়ুব খান- ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান- এই উপমহাদেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান যে ক্যু দেতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার গোড়াপত্তন করে যার ধারাবাহিকতা আজও পাকিস্তানে সচল এবং যার বিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বাংলাদেশেও পরিলক্ষিত। ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালে এবং এই ক্ষমতা বিভিন্ন বাহানাতে দখল করে রাখে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত- ক্ষমতা থেকে সরে যেতে তাকে বাধ্য করতে হয়েছে এই আমাদেরই, অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণদেরই, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, আর এই ক্ষমতা ছাড়ার অন্দোলনে তদানীন্তন ছাত্র সমাজের বিশাল ভূমিকা ছিলো। আমরা অধিকাংশ ছাত্র, যারা ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তারা মনেপ্রাণে সামরিক প্রধানের শাসনের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছি- যদিও আইয়ুব খান তার একান্ত ব্রেইন চাইল্ড ‘বেসিক ডিমোক্রাসি’ দিয়ে আমাদের বুঝ দিতে চেয়ে ছিলো।

এই ফিল্ড মার্শাল সাহেবের একান্ত চরণ দাসানু দাস ছিলো আর একজন ‘খান’- আবদুল মোনেম খান- যে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত ছিলো আইয়ুব খান কর্তৃক। প্রসঙ্গত কাজী নজরুল ইসলাম উদ্ভাবিত একটি অসাধারণ শব্দ মনে উঠে আসছে- কোনো এক রাজনৈতিক (আমরা তো জানি নজরুল ইসলাম ভীষণ রাজনীতি সচেতন ছিলেন) রচনাতে তিনি এই গভর্নর শব্দটির প্রকৃত বাংলা অর্থ করেছিলেন গোবরনর, নরের (মানুষের) গোবর (বিষ্ঠা)। তো এই গোবরনর মোনেম খান-এর একবার খায়েশ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬৪ সালের সমাবর্তনে চান্সেলর হিসাবে উপস্থিত হবে। কার্জন হলে বিশাল প্যান্ডেল প্রস্তুত, কিন্তু সব ভ-ুল করে দিলো ছাত্ররা- আইয়ুব খান-এর পোষ্যপুত্র মোনেম খানকে সমাবর্তনে ঢুকতে দেয়া হবে না; প্যান্ডেল ভাঙার দৃশ্য আমরা দূর থেকে দেখলাম- যার একটি দৃশ্যমান বর্ণনা এপ্রিল ১২, ২০২১ সালের দ্য ডেলি অবজারভার পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। মীজানূর রহমান শেলী (লেখাটি তাঁর মৃত্যু ২০১৯ সালের পর মুদ্রিত) এই ঘটনা নিয়ে লেখেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সিভিল সার্ভেন্ট কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর উদ্ধৃতি সহকারে- কিন্তু তখন পর্যন্ত জানতাম না আমার রুমমেট হায়াত হোসেন এই প্যান্ডেল ভাঙচুরের ভেতর অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো। উল্লেখ করা সমীচীন ডঃ মীজানূর রহমান শেলী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সাইন্স-এর অধ্যাপক ছিলেন আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম। তিনি একসময় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন।

ঐ রাতে হায়াত রুমে আসেনি। এমনটা ও মাঝেমধ্যে করতো; ওর কোনও আত্মীয়ের বাসাতে অথবা অন্য কোনো হলে তার কোনো বন্ধুর সাথে থেকে যেতো; তাই আমি কোনো অশনিসংকেতের ইঙ্গিত পাইনি। কিন্তু পরদিন সেই সময়ের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য পাকিস্তান অবজারভার-এর (১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটির মালিক ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী এবং সম্পাদক ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক আবদুস সালাম) প্রথম পৃষ্ঠাতে অন্যান্যদের সাথে হায়াত-এর এই প্যান্ডেল ভাঙার ছবি দেখে বুঝলাম ঝড় আসছে। এবং ঝড় এলো, ওই ঘটনাতে জড়িত হায়াতসহ সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলো।

একটি অপরাধ আমরা তিনজনই করেছি আমাদের অজান্তে- কারণ ওই অপরিণত বয়সে, সময়ে, পরিবেশে তারুণ্যের অনুসন্ধিৎসার তাড়নাতে আমরা মানুষের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার কথা একবারও বিবেচনাতে আনি নি

হায়াতরা উচ্চ আদালতে মামলা করেছিলো। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, এই মামলা চলেছিলো দীর্ঘ সময় ধরে যদিও আমার নির্দিষ্টভাবে মনে নেই কত দিন, কিন্তু মামলাতে হায়াতদের জিত হয় এবং হায়াত একদিন সদর্পে ইংরেজি বিভাগের ক্লাসে ফিরে আসে, তবে যতদূর মনে পড়ছে তাকে সলিমুল্লাহ হলে আমার রুমে আর ফিরে পাইনি। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের এম. এ. প্রিলিমিনারির এক শিক্ষার্থীকে ঐ রুমের সিটটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। যদিও নাম মনে নেই, এই ব্যক্তিটি বেশ মজারই ছিলেন। আমাকে কয়েকটি চাঁটগাইয়া গান শিখিয়েছিলেন যার মধ্য অন্যতম ছিলো: অ্যাঁরা চাটগাইয়া নউজোয়ান/দজ্জার কুলত বসত করি অ্যাঁরা ঠেকাই ঝড়তুফান। তবে ভদ্রলোক খুব হাইপার ছিলেন, পরীক্ষার সময় ঘনঘন মাথাতে পানি ঢালতেন এবং হাহুতাশ করতেন তাঁর পরীক্ষার প্রিপারেশন একদম হয় নি এবং উনি নির্ঘাত ফেল করবেন। একবার অবশ্য করেও- ছিলেন।

হায়াত হোসেন ক্লাসে ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু ১৯৬৬ সালে ফাইনাল অনার্স পরীক্ষা দিতে পারলো না। আমি আগেই বলেছি আমাদের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন সেই ইংরেজ বাঙালি বা বাঙালি ইংরেজ ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন যিনি ছিলেন একজন ডাইহার্ড বা গোঁড়া পাকিস্তানি। হায়াত-এর এই অতি প্রগতিবাদ এবং কনভোকেশন প্যান্ডেল ভাংচুরে তার প্রত্যক্ষ যোগদান তিনি মোটেও পছন্দ করেন নি যদিও আইনের উপর তাঁর প্রভাব বিস্তারের কোনো অবকাশ ছিলো না। কিন্তু তিনি যেখানে হাত দেয়া সম্ভব সেখানে দিলেন। আমাদের সময় অনার্স পরীক্ষা তিন বছর ক্লাস করার পর হতো, এখনকার মতো সেমেস্টার সিস্টেম ছিলো না, এবং প্রতিটা বিষয়ে চার ঘণ্টা করে পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষা দেবার যোগ্যতার বিচারের জন্য তিন বছর পর ক্লাস উপস্থিতি গুনে দেখা হতো এবং নিয়ম ছিলো প্রতিটি ক্লাসে সর্বমোট অন্তত ৭৫% উপস্থিতি থাকতে হবে নইলে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। যুক্তিসঙ্গত কারণেই হায়াত-এর এই প্রয়োজনীয় উপস্থিতি ছিলো না কারণ মামলা চলাকালে দীর্ঘ দিন তাকে ক্লাস করতে দেয়া হয় নি। আমি আজ ভাবি, হায়াত এবং সৈয়দ সাজ্জাদ, দুজনেরই পারিবারিক নাম হোসেন বা হোসায়েন, কিন্তু এদের সম্পর্কটা এভাবে এমন অ-পারিবারিক কেনো হলো। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন হায়াত হোসেনকে ইংরেজি অনার্স পরীক্ষা থেকে বিরত করতে পেরে নিশ্চয়ই অন্তর্যামীর হাসি হেসে ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না খোদার উপরও খোদকারি কিভাবে যেনো অনেক সময়ই হয়ে যায়- সম্ভবত সেটাই চূড়ান্ত খোদকারি।

আমি একবার কোনো এক কিস্তিতে লিখেছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৬৬ সালে, যে বছর আমাদের অনার্স পরীক্ষা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন ডঃ এ. আর. মল্লিক, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন; এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান হয়ে যোগদান করেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডঃ আবদুল করিম। ডঃ আবদুল করিম-এর বাড়ি চট্টগ্রাম, এবং তিনি, আমি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইস্ট হাউসের হাউস টিউটর ছিলেন। আমার জীবনে উনার মতো মৃদুভাষী, স্নেহপরায়ণ এবং ছাত্রবান্ধব অধ্যাপক খুব কমই দেখেছি।

তো হায়াত যখন পরীক্ষা দেয়া থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে নিষিদ্ধ হলো তখন সম্ভবত ড. আবদুল করিম-এর পরামর্শে বি. এ. পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এম. এ. পড়ে এবং যতদূর জানি সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তী কালে সে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতাতে যোগদান করে। আমার সাথে তার দেখা হয়েছে বার কয়েক, এবং তার ভেতর কিছু পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করলেও তাকে উচ্ছল, উদ্দীপ্ত, জীবনকে উপভোগ করা সেই হায়াত হোসেন বলেই মনে হয়েছে আমার। ওর ফেইস বুকে মাঝে কয়েকবার আমি সংযুক্ত হয়ে জেনেছি তার বাড়ির নাম হায়াত এনক্লেভ যেখানে প্রায় নিয়মিতভাবে ওর ছাত্রছাত্রী এবং বন্ধুদের আড্ডা জমে- বাড়ির নামকরণ তার চারিত্র্যের সাথে মিল করে একদম যথাযথ হয়েছে।

আমি আমার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের রুমমেট হায়াত-এর কথা এতো বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করলাম কারণ আমি আগেই বলেছি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা আইয়ুবিও যুগে কাটিয়েছি এবং এর যেমন অতি খারাপ দিক ছিলো তেমনি অতি ভাল দিকও ছিলো। আমি এই খারাপ দিকের উদাহরণ রূপে হায়াত-এর কথা বলেছি- এ শুধু একটি ঘটনা যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। ওই সময়ে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ হবার পর অন্তত দু’তিন বছর পর্যন্ত আইয়ুব খান-এর অশনি প্রভাব ছাত্র সমাজের উপর দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন-এর মতো কিছু শিক্ষক তাদের অতি পাকিস্তানপ্রীতির পাগলামিতে অনেক ছাত্রের জীবনকে সঙ্কটে ফেলেছে। মনে পড়ে সেই তথাকথিত ছাত্রসন্ত্রাস নেতা পাঁচপাত্তুরের কথা যে এই পাকিস্তানপ্রীতির লালনেই এই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পবিত্রতা নষ্ট করেছে।

আমি আইয়ুবীয় যুগের ভাল দিকের কথা বলছিলাম আর সেটা হলো, মানতেই হবে বিভিন্নভাবে আইয়ুব খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজকে তুষ্ট করার বিভিন্ন ফন্দি এঁটেছিলো। এর ভেতর ছিলো ঢালাও ভাবে ছাত্রদের বৃত্তি দেয়া। আমার মনে আছে আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো বৃত্তি পেতাম। অন্য আর একটি বিষয় ছিলো, বিদেশি বই আমদানির উপর শুল্ক মউকুফ। আমরা খুব অল্প দামে ইংরেজি অনেক বই কিনেছি ওই সময়, যেমন শেক্সপিয়র, শেলি, সমারসেট মম-এর রচনা সমগ্র, বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী, লিগুই ক্যাজামিওন-এর ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, জি. এম. ট্রেভালিওন-এর ইংলিশ সোশ্যাল হিস্ট্রি, এমন আরও অনেক। এরপর মনে আছে ঢাকাতে বর্তমান রাজউক ভবনে ১৯৬৪ সালে টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচার কেন্দ্র স্থাপন এবং সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের কমন রুমে একটি করে টেলিভিশন প্রদান। তখন জাপানের নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানি বা এন. ই. সি. এই টেলিভিশন কেন্দ্র এবং টেলিভিশন সেট বাংলাদেশে সরবরাহ করেছিলো। তো আমরাও আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কমন রুমে একটি চার পায়াঅলা এন ই সি সাদা-কালো টেলিভিশন পেয়েছিলাম। তখন অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো সম্ভবত সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা বা এগারোটা পর্যন্ত। আমরা এই সময়- বিশেষ করে যেদিন টিভি নাটক দেখানো হতো সেদিন ভিড় করে কমন রুমে টেলিভিশন দেখতাম।

কিন্তু আইয়ুব খান বুঝতে পারে নি, যা বেশিরভাগ স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরাই বোঝে না, একটা জাতিকে অল্প সময়ের জন্য বোকা বানানো সম্ভব কিন্তু সব সময়ের জন্য নয়। আইয়ুব খান হয়তো ভেবেছিলো এই জাতীয় নেশা আমাদের নেশাগ্রস্ত করে রাখবে এবং দেশের তথাকথিত অগ্রগতি ও উন্নতির এমন প্রমাণ আমাদেরকে তার প্রতি নম্র মনোভাবের উদ্রেক করাবে- কারণ ১৯৬৪ সালে ভারতেও কোনো টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হতে পারে নি। কিন্তু অন্যদিকে বিদেশি বইয়ের শুল্কমুক্ত আমদানিটা কিন্তু তার বিরুদ্ধেই গেছে, কারণ আমাদের এই মুক্তজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের সুযোগটা আমাদের ছাত্র সমাজকে স্বাধীকারে সচেতন করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহসও যুগিয়েছে। যেমন বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী পড়া এবং সেই সময়ে তার ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা এবং সে কারণে তার জেলে যাওয়া আমাদের যারপরনাই উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা এমন সভা, এমন মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শামিল হতাম। শুধু তাই নয় প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে রাত বারোটার সময় এক বাধ্যতামূলক ধর্মীয় রিচুয়ালের মতো যারযার আবাসিক হল থেকে বেরিয়ে আমরা সারাটা রাত কাটাতাম শহিদ মিনারের বেদীতে সংগ্রাম ও প্রতিবাদের সঙ্গীত শুনে, এবং সেখান থেকে প্রভাতফেরি করে আজিমপুরে শহিদদের সমাধিতে ফুল দিয়ে তবে হলে ফিরতাম। আইয়ুব খান এবং তাদের দোসরদের ধন্যবাদ যে তারা আমাদের ভেতর এমন একটা জেদ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো যারই ফলশ্রুতিতে আজ বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।

আমার সাথে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমার ইংরেজি বিভাগের সহপাঠীদের ভেতর- হায়াত এবং আমার চাচাত ভাই সাদুল্লাহ ছাড়া- মনে পড়ছে কুদ্দুস, আবু সালেহ, নুরুদ্দিন এবং আনিসুর রহমান-এর কথা। এদের ভেতর কুদ্দুস সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে এবং আশির দশকে আমরা দুজনই লিবিয়াতে শিক্ষকতা করতে গেছি; আবু সালেহ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে; নুরুদ্দিন ছাত্রকালে আইয়ুব খান-এর ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন করতো, পরবর্তীকালে তার সাথে আর যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি নি; আনিসুর-এর সাথে কিছু বিরতিতে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে ও ঢাকা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে অবসর নেবার আগেপরে, কিন্তু বর্তমানে কোনো খবর জানি না।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলো এক স্মৃতির সাগর আমার। আমার মনে হয় আমাকে আরও অনেক কিছু কথা লিখতে হবে আমার এই প্রিয় হলে আমার জীবন যাপন নিয়ে। (চলবে)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক স্মৃতিকথা : ১০

স্মৃতির অতল তলে

আবদুস সেলিম

সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

পূর্ব প্রকাশের পর

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ইংরেজিতে অনার্স পড়া আমার সহপাঠী যারা ছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই অন্যতম ছিল হায়াত হোসেন, কারণ সে শুধু ডানপিটেই ছিল যেমন মেধাবি তেমনি প্রগতিশীল এবং উইটি ছিল। এই দীর্ঘাঙ্গী সুদর্শন হায়াত, আগেই বলেছি আমার রুমমেট ছিল। সে যাই-ই করতো তাই-ই আমার কাছে স্মার্টনেসের সংজ্ঞা বলে মনে হতো এবং আমার মনে যুগপৎ ঈর্ষা এবং অনুকরণ-স্পৃহা জাগরুক হতো- আমি যদি হায়াত-এর মতো হতে পারতাম, কিম্বা হায়াত আসলে ভাল নয়- বড্ড বাড়াবাড়ি করে সব ব্যাপারে, এমনকি মেয়েদের সাথে মেলামেশার ক্ষেত্রেও! মেয়েদের সাথে মেলামেশাতে তার আসলে কতটা উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল তার প্রমাণ শুধু তার বর্ণিত বিভিন্ন অভিযানের গল্প শুনেই জানতে পারতাম, এবং বিশ্বাসও করতাম। এই কাজটি হতো সাধারণত রাতের খাওয়ার পর আমাদের রুমে, অর্থাৎ আমি এবং হায়াত যে রুমে থাকতাম, এবং এই আসরে আমার চাচাত ভাই সাদুল্লাহও (ওর ডাক নাম ছিল সুরুজ এবং আমার খোকন, এবং আমরা পরস্পরকে এই ডাক নামেই সম্বোধন করতাম) শামিল হতো, যদিও ও অন্য রুমে থাকতো। ওরা দু’জন ক্যাম্পাসে ওদের সারাদিনের নারী-সাক্ষাতের গল্প শোনাতো- হায়াত, হয় আমার বিছানাতে কিম্বা ওর নিজের বিছানাতে বালিশে ঠেস দিয়ে জুতোসুদ্ধ পায়ে আধশোয়া হয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে, আর সুরুজ, কখনও চেয়ারে বসে আবার কখনও আমার বা হায়াত-এর বিছানাতে সটান শুয়ে। আমি যেখানে হোক বসে বা হেলান দিয়ে ওদের কথা বিমোহিত হয়ে শুনতাম- কখনও সামান্যতম অবিশ্বাস মনের ভেতর উদয় হতো না। হায়াত-এর সিগারেট টানার একটি নিজস্ব স্টাইল ছিলো- তর্জনী ও মধ্যমার মাঝে সিগারেট ধরে মুষ্টিবদ্ধ হাতে সিগারেটে দীর্ঘ টান আর সেই ফাঁকে গল্প।

আমাদের সময় ক্যাম্পাসে মেয়েদের সাথে গল্প করাটাই অসম্ভব প্রায় ছিল। মেয়েরা কদাচিৎ ক্লাসের এবং তাদের কমন রুমের বাইরে বেরুতো, এমনকি শ্রেণিকক্ষের বাইরে বারান্দাতেও তাদের সাথে কথা বলা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হতো। এমন একটি ঘটনা স্বয়ং আমার সাথেই ঘটেছে একবার- সে গল্প তোলা থাকলো আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করার অভিজ্ঞতার বর্ণনার সময়কালের জন্য। মেয়েরা সবাই ক্লাসের সময় হলে শিক্ষকের সাথে সারি বেঁধে ক্লাসে ঢুকতো এবং ক্লাস শেষে শিক্ষকের সাথেই বেরিয়ে যেতো। এহেন কড়াকড়ির ভেতর ঠিক কোন সময়ে হায়াত বা সুরুজ মেয়েদের সান্নিধ্যে আসতে পারতো সে প্রশ্ন তখন আমার মনে কখোনই আসেনি।

তবে একটি অপরাধ আমরা তিনজনই করেছি আমাদের অজান্তে- কারণ ওই অপরিণত বয়সে, সময়ে, পরিবেশে তারুণ্যের অনুসন্ধিৎসার তাড়নাতে আমরা মানুষের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার কথা একবারও বিবেচনাতে আনি নি। আসলে হায়াত-এর প্রেমে অনেক মেয়েই পড়েছে একথা যেমন সত্যি, তেমনি একজন বিশেষ মেয়ে তাকে ভীষণ ভালবাসতো সেটাও সত্যি- তবে এর ভেতর তার এবং সুরুজের যে নারী-সাক্ষাতের গল্পগুলো ছিলো তা আসলে অধিকাংশই কল্পনাশ্রিত সে বিষয়টি বুঝতে আমার এবয়সে কোনোই কষ্ট হয় না, এবং একে আমি কোনো অপরাধও মনে করি না। ইংরেজি ভাষাভাষি পশ্চিমা দেশগুলোতে একে অপশব্দে বলা হয় লকার রুম টক, অর্থাৎ ছেলেদের শিক্ষায়তনে কিম্বা মাঠে পুরুষ খেলোয়াড়দের জিনিসপত্র রাখার দেরাজ ঘরে মেয়েদের নিয়ে যে রগরগে আলাপ। এমনটা একবার ডোনাল্ড ট্রাম্পকে করতে দেখা গেছে, যদিও ঐ দেরাজ ঘরে নয়, বাসে, এবং বিষয়টাকে কেউ অপরাধের পর্যায়ের বলে মনে করেনি। আমরাও দেরাজ ঘরে এমন আলাপ করতাম না কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে দেরাজ ঘর ছিলোই না, করতাম আমাদের হলের রুমে, এবং গল্পগুলো ঐ লকার রুম টক-এর চরিত্রেরই ছিলো।

তবে আমি যে বিষয়টিকে অপরাধ মনে করি সেটি হলো হায়াতকে লেখা ঐ মেয়েটির একান্ত ব্যক্তিগত প্রেমপত্রের বেশ কিছু ঐ হলের রুমের আসরে সুরুজকে এবং আমাকে পড়ে শোনানো এবং তাকে হাসির খোরাক বানানো। কিন্তু এটাও ঠিক প্রাইভেসি বা একান্ততার শিক্ষাটা আমাদের সমাজে পারিবারিক বা সামাজিকভাবে কখনই গুরুত্ব দেয়া হয় না, এবং আমি আমার জীবনে বিদেশে উচ্চ শিক্ষিত, এবং দীর্ঘদিন বিদেশে বসবাস করা অনেক বাঙালিকে (যাদের সাথে আমি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সহকর্মী ছিলাম বা আছি) দেখেছি, অন্যদের, বিশেষ করে নারীদের বিষয়ে অনাবশ্যক কৌতূহল দেখাতে।

তো এইস্মার্ট হায়াতকে বেশ ভুগতে হয়েছে তার অতি প্রগতিবাদের জন্য। আমি আগের এক কিস্তিতে বলেছি হায়াতকে তদানীন্তন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডেরেশন দুচোখে দেখতে পারতো না এবং এজন্য তাকে এবং আমাকেও তার রুমমেট হিসাবে বেশ হেনস্তার ভেতর পড়তে হয়েছে কয়েকবার। আমাদের শিক্ষাজীবনের পুরো সময়টাই আইয়ুবীও যুগ ছিলো। এর যেমন অতি খারাপ দিক ছিলো তেমনি অতি ভাল দিকও ছিলো। ঐ অতি খারাপ দিকের কারণেই হায়াত-এর আপাতদৃষ্টিতে কপাল পুড়েছিলো। অইয়ুব খান- ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান- এই উপমহাদেশের প্রথম সেনাবাহিনী প্রধান যে ক্যু দেতা করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার গোড়াপত্তন করে যার ধারাবাহিকতা আজও পাকিস্তানে সচল এবং যার বিচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতা বাংলাদেশেও পরিলক্ষিত। ফিল্ড মার্শাল মুহাম্মদ আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করে ১৯৫৮ সালে এবং এই ক্ষমতা বিভিন্ন বাহানাতে দখল করে রাখে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত- ক্ষমতা থেকে সরে যেতে তাকে বাধ্য করতে হয়েছে এই আমাদেরই, অর্থাৎ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণদেরই, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে, আর এই ক্ষমতা ছাড়ার অন্দোলনে তদানীন্তন ছাত্র সমাজের বিশাল ভূমিকা ছিলো। আমরা অধিকাংশ ছাত্র, যারা ষাটের দশকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছি তারা মনেপ্রাণে সামরিক প্রধানের শাসনের চরম বিরুদ্ধাচরণ করেছি- যদিও আইয়ুব খান তার একান্ত ব্রেইন চাইল্ড ‘বেসিক ডিমোক্রাসি’ দিয়ে আমাদের বুঝ দিতে চেয়ে ছিলো।

এই ফিল্ড মার্শাল সাহেবের একান্ত চরণ দাসানু দাস ছিলো আর একজন ‘খান’- আবদুল মোনেম খান- যে ১৯৬২ থেকে ১৯৬৯ পর্যন্ত তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত ছিলো আইয়ুব খান কর্তৃক। প্রসঙ্গত কাজী নজরুল ইসলাম উদ্ভাবিত একটি অসাধারণ শব্দ মনে উঠে আসছে- কোনো এক রাজনৈতিক (আমরা তো জানি নজরুল ইসলাম ভীষণ রাজনীতি সচেতন ছিলেন) রচনাতে তিনি এই গভর্নর শব্দটির প্রকৃত বাংলা অর্থ করেছিলেন গোবরনর, নরের (মানুষের) গোবর (বিষ্ঠা)। তো এই গোবরনর মোনেম খান-এর একবার খায়েশ হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৬৪ সালের সমাবর্তনে চান্সেলর হিসাবে উপস্থিত হবে। কার্জন হলে বিশাল প্যান্ডেল প্রস্তুত, কিন্তু সব ভ-ুল করে দিলো ছাত্ররা- আইয়ুব খান-এর পোষ্যপুত্র মোনেম খানকে সমাবর্তনে ঢুকতে দেয়া হবে না; প্যান্ডেল ভাঙার দৃশ্য আমরা দূর থেকে দেখলাম- যার একটি দৃশ্যমান বর্ণনা এপ্রিল ১২, ২০২১ সালের দ্য ডেলি অবজারভার পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়। মীজানূর রহমান শেলী (লেখাটি তাঁর মৃত্যু ২০১৯ সালের পর মুদ্রিত) এই ঘটনা নিয়ে লেখেন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ এবং সিভিল সার্ভেন্ট কামাল উদ্দিন সিদ্দিকীর উদ্ধৃতি সহকারে- কিন্তু তখন পর্যন্ত জানতাম না আমার রুমমেট হায়াত হোসেন এই প্যান্ডেল ভাঙচুরের ভেতর অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলো। উল্লেখ করা সমীচীন ডঃ মীজানূর রহমান শেলী যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পলিটিক্যাল সাইন্স-এর অধ্যাপক ছিলেন আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় হিসেবে আমি তাঁর ছাত্র ছিলাম। তিনি একসময় বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীও ছিলেন।

ঐ রাতে হায়াত রুমে আসেনি। এমনটা ও মাঝেমধ্যে করতো; ওর কোনও আত্মীয়ের বাসাতে অথবা অন্য কোনো হলে তার কোনো বন্ধুর সাথে থেকে যেতো; তাই আমি কোনো অশনিসংকেতের ইঙ্গিত পাইনি। কিন্তু পরদিন সেই সময়ের বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক দ্য পাকিস্তান অবজারভার-এর (১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটির মালিক ছিলেন হামিদুল হক চৌধুরী এবং সম্পাদক ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য সাংবাদিক আবদুস সালাম) প্রথম পৃষ্ঠাতে অন্যান্যদের সাথে হায়াত-এর এই প্যান্ডেল ভাঙার ছবি দেখে বুঝলাম ঝড় আসছে। এবং ঝড় এলো, ওই ঘটনাতে জড়িত হায়াতসহ সবাইকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হলো।

একটি অপরাধ আমরা তিনজনই করেছি আমাদের অজান্তে- কারণ ওই অপরিণত বয়সে, সময়ে, পরিবেশে তারুণ্যের অনুসন্ধিৎসার তাড়নাতে আমরা মানুষের প্রাইভেসি বা গোপনীয়তার কথা একবারও বিবেচনাতে আনি নি

হায়াতরা উচ্চ আদালতে মামলা করেছিলো। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, এই মামলা চলেছিলো দীর্ঘ সময় ধরে যদিও আমার নির্দিষ্টভাবে মনে নেই কত দিন, কিন্তু মামলাতে হায়াতদের জিত হয় এবং হায়াত একদিন সদর্পে ইংরেজি বিভাগের ক্লাসে ফিরে আসে, তবে যতদূর মনে পড়ছে তাকে সলিমুল্লাহ হলে আমার রুমে আর ফিরে পাইনি। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের এম. এ. প্রিলিমিনারির এক শিক্ষার্থীকে ঐ রুমের সিটটি বরাদ্দ করা হয়েছিল। যদিও নাম মনে নেই, এই ব্যক্তিটি বেশ মজারই ছিলেন। আমাকে কয়েকটি চাঁটগাইয়া গান শিখিয়েছিলেন যার মধ্য অন্যতম ছিলো: অ্যাঁরা চাটগাইয়া নউজোয়ান/দজ্জার কুলত বসত করি অ্যাঁরা ঠেকাই ঝড়তুফান। তবে ভদ্রলোক খুব হাইপার ছিলেন, পরীক্ষার সময় ঘনঘন মাথাতে পানি ঢালতেন এবং হাহুতাশ করতেন তাঁর পরীক্ষার প্রিপারেশন একদম হয় নি এবং উনি নির্ঘাত ফেল করবেন। একবার অবশ্য করেও- ছিলেন।

হায়াত হোসেন ক্লাসে ফিরে এলো ঠিকই কিন্তু ১৯৬৬ সালে ফাইনাল অনার্স পরীক্ষা দিতে পারলো না। আমি আগেই বলেছি আমাদের ইংরেজি বিভাগের প্রধান ছিলেন সেই ইংরেজ বাঙালি বা বাঙালি ইংরেজ ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন যিনি ছিলেন একজন ডাইহার্ড বা গোঁড়া পাকিস্তানি। হায়াত-এর এই অতি প্রগতিবাদ এবং কনভোকেশন প্যান্ডেল ভাংচুরে তার প্রত্যক্ষ যোগদান তিনি মোটেও পছন্দ করেন নি যদিও আইনের উপর তাঁর প্রভাব বিস্তারের কোনো অবকাশ ছিলো না। কিন্তু তিনি যেখানে হাত দেয়া সম্ভব সেখানে দিলেন। আমাদের সময় অনার্স পরীক্ষা তিন বছর ক্লাস করার পর হতো, এখনকার মতো সেমেস্টার সিস্টেম ছিলো না, এবং প্রতিটা বিষয়ে চার ঘণ্টা করে পরীক্ষা দিতে হতো। পরীক্ষা দেবার যোগ্যতার বিচারের জন্য তিন বছর পর ক্লাস উপস্থিতি গুনে দেখা হতো এবং নিয়ম ছিলো প্রতিটি ক্লাসে সর্বমোট অন্তত ৭৫% উপস্থিতি থাকতে হবে নইলে পরীক্ষা দিতে দেয়া হবে না। যুক্তিসঙ্গত কারণেই হায়াত-এর এই প্রয়োজনীয় উপস্থিতি ছিলো না কারণ মামলা চলাকালে দীর্ঘ দিন তাকে ক্লাস করতে দেয়া হয় নি। আমি আজ ভাবি, হায়াত এবং সৈয়দ সাজ্জাদ, দুজনেরই পারিবারিক নাম হোসেন বা হোসায়েন, কিন্তু এদের সম্পর্কটা এভাবে এমন অ-পারিবারিক কেনো হলো। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন হায়াত হোসেনকে ইংরেজি অনার্স পরীক্ষা থেকে বিরত করতে পেরে নিশ্চয়ই অন্তর্যামীর হাসি হেসে ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না খোদার উপরও খোদকারি কিভাবে যেনো অনেক সময়ই হয়ে যায়- সম্ভবত সেটাই চূড়ান্ত খোদকারি।

আমি একবার কোনো এক কিস্তিতে লিখেছিলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৬৬ সালে, যে বছর আমাদের অনার্স পরীক্ষা হয়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন ডঃ এ. আর. মল্লিক, যিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন; এবং ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান হয়ে যোগদান করেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ ডঃ আবদুল করিম। ডঃ আবদুল করিম-এর বাড়ি চট্টগ্রাম, এবং তিনি, আমি ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হবার সময় সলিমুল্লাহ মুসলিম হল ইস্ট হাউসের হাউস টিউটর ছিলেন। আমার জীবনে উনার মতো মৃদুভাষী, স্নেহপরায়ণ এবং ছাত্রবান্ধব অধ্যাপক খুব কমই দেখেছি।

তো হায়াত যখন পরীক্ষা দেয়া থেকে বাধ্যতামূলক ভাবে নিষিদ্ধ হলো তখন সম্ভবত ড. আবদুল করিম-এর পরামর্শে বি. এ. পাস কোর্সে পরীক্ষা দিয়ে পাস করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসে এম. এ. পড়ে এবং যতদূর জানি সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উত্তীর্ণ হয়। পরবর্তী কালে সে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়েই ইতিহাস বিভাগে শিক্ষকতাতে যোগদান করে। আমার সাথে তার দেখা হয়েছে বার কয়েক, এবং তার ভেতর কিছু পরিবর্তন আমি লক্ষ্য করলেও তাকে উচ্ছল, উদ্দীপ্ত, জীবনকে উপভোগ করা সেই হায়াত হোসেন বলেই মনে হয়েছে আমার। ওর ফেইস বুকে মাঝে কয়েকবার আমি সংযুক্ত হয়ে জেনেছি তার বাড়ির নাম হায়াত এনক্লেভ যেখানে প্রায় নিয়মিতভাবে ওর ছাত্রছাত্রী এবং বন্ধুদের আড্ডা জমে- বাড়ির নামকরণ তার চারিত্র্যের সাথে মিল করে একদম যথাযথ হয়েছে।

আমি আমার সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের রুমমেট হায়াত-এর কথা এতো বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করলাম কারণ আমি আগেই বলেছি আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের পুরোটা আইয়ুবিও যুগে কাটিয়েছি এবং এর যেমন অতি খারাপ দিক ছিলো তেমনি অতি ভাল দিকও ছিলো। আমি এই খারাপ দিকের উদাহরণ রূপে হায়াত-এর কথা বলেছি- এ শুধু একটি ঘটনা যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী আমি। ওই সময়ে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়াশোনা শেষ হবার পর অন্তত দু’তিন বছর পর্যন্ত আইয়ুব খান-এর অশনি প্রভাব ছাত্র সমাজের উপর দীর্ঘায়িত হয়েছে এবং ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েন-এর মতো কিছু শিক্ষক তাদের অতি পাকিস্তানপ্রীতির পাগলামিতে অনেক ছাত্রের জীবনকে সঙ্কটে ফেলেছে। মনে পড়ে সেই তথাকথিত ছাত্রসন্ত্রাস নেতা পাঁচপাত্তুরের কথা যে এই পাকিস্তানপ্রীতির লালনেই এই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের পবিত্রতা নষ্ট করেছে।

আমি আইয়ুবীয় যুগের ভাল দিকের কথা বলছিলাম আর সেটা হলো, মানতেই হবে বিভিন্নভাবে আইয়ুব খান তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র সমাজকে তুষ্ট করার বিভিন্ন ফন্দি এঁটেছিলো। এর ভেতর ছিলো ঢালাও ভাবে ছাত্রদের বৃত্তি দেয়া। আমার মনে আছে আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম তাদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো বৃত্তি পেতাম। অন্য আর একটি বিষয় ছিলো, বিদেশি বই আমদানির উপর শুল্ক মউকুফ। আমরা খুব অল্প দামে ইংরেজি অনেক বই কিনেছি ওই সময়, যেমন শেক্সপিয়র, শেলি, সমারসেট মম-এর রচনা সমগ্র, বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী, লিগুই ক্যাজামিওন-এর ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাস, জি. এম. ট্রেভালিওন-এর ইংলিশ সোশ্যাল হিস্ট্রি, এমন আরও অনেক। এরপর মনে আছে ঢাকাতে বর্তমান রাজউক ভবনে ১৯৬৪ সালে টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রচার কেন্দ্র স্থাপন এবং সেই সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি হলের কমন রুমে একটি করে টেলিভিশন প্রদান। তখন জাপানের নিপ্পন ইলেকট্রিক কোম্পানি বা এন. ই. সি. এই টেলিভিশন কেন্দ্র এবং টেলিভিশন সেট বাংলাদেশে সরবরাহ করেছিলো। তো আমরাও আমাদের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের কমন রুমে একটি চার পায়াঅলা এন ই সি সাদা-কালো টেলিভিশন পেয়েছিলাম। তখন অনুষ্ঠান সম্প্রচার হতো সম্ভবত সন্ধ্যা ছয়টা থেকে রাত দশটা বা এগারোটা পর্যন্ত। আমরা এই সময়- বিশেষ করে যেদিন টিভি নাটক দেখানো হতো সেদিন ভিড় করে কমন রুমে টেলিভিশন দেখতাম।

কিন্তু আইয়ুব খান বুঝতে পারে নি, যা বেশিরভাগ স্বৈরাচারী সামরিক শাসকরাই বোঝে না, একটা জাতিকে অল্প সময়ের জন্য বোকা বানানো সম্ভব কিন্তু সব সময়ের জন্য নয়। আইয়ুব খান হয়তো ভেবেছিলো এই জাতীয় নেশা আমাদের নেশাগ্রস্ত করে রাখবে এবং দেশের তথাকথিত অগ্রগতি ও উন্নতির এমন প্রমাণ আমাদেরকে তার প্রতি নম্র মনোভাবের উদ্রেক করাবে- কারণ ১৯৬৪ সালে ভারতেও কোনো টেলিভিশন কেন্দ্র স্থাপিত হতে পারে নি। কিন্তু অন্যদিকে বিদেশি বইয়ের শুল্কমুক্ত আমদানিটা কিন্তু তার বিরুদ্ধেই গেছে, কারণ আমাদের এই মুক্তজ্ঞানের রাজ্যে প্রবেশের সুযোগটা আমাদের ছাত্র সমাজকে স্বাধীকারে সচেতন করেছে, স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার সাহসও যুগিয়েছে। যেমন বার্ট্রান্ড রাসেল-এর আত্মজীবনী পড়া এবং সেই সময়ে তার ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের বিরুদ্ধে তার ভূমিকা এবং সে কারণে তার জেলে যাওয়া আমাদের যারপরনাই উদ্বুদ্ধ করেছে। আমরা এমন সভা, এমন মিছিলে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে শামিল হতাম। শুধু তাই নয় প্রতিটি একুশে ফেব্রুয়ারির আগের রাতে রাত বারোটার সময় এক বাধ্যতামূলক ধর্মীয় রিচুয়ালের মতো যারযার আবাসিক হল থেকে বেরিয়ে আমরা সারাটা রাত কাটাতাম শহিদ মিনারের বেদীতে সংগ্রাম ও প্রতিবাদের সঙ্গীত শুনে, এবং সেখান থেকে প্রভাতফেরি করে আজিমপুরে শহিদদের সমাধিতে ফুল দিয়ে তবে হলে ফিরতাম। আইয়ুব খান এবং তাদের দোসরদের ধন্যবাদ যে তারা আমাদের ভেতর এমন একটা জেদ সৃষ্টি করে দিয়েছিলো যারই ফলশ্রুতিতে আজ বাংলাদেশ পেয়েছি আমরা।

আমার সাথে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে আমার ইংরেজি বিভাগের সহপাঠীদের ভেতর- হায়াত এবং আমার চাচাত ভাই সাদুল্লাহ ছাড়া- মনে পড়ছে কুদ্দুস, আবু সালেহ, নুরুদ্দিন এবং আনিসুর রহমান-এর কথা। এদের ভেতর কুদ্দুস সরকারি কলেজে অধ্যাপনা করে এবং আশির দশকে আমরা দুজনই লিবিয়াতে শিক্ষকতা করতে গেছি; আবু সালেহ সিভিল সার্ভিসে যোগদান করে; নুরুদ্দিন ছাত্রকালে আইয়ুব খান-এর ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন করতো, পরবর্তীকালে তার সাথে আর যোগাযোগ রক্ষা করতে পারি নি; আনিসুর-এর সাথে কিছু বিরতিতে দেখাসাক্ষাৎ হয়েছে ও ঢাকা কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হয়ে অবসর নেবার আগেপরে, কিন্তু বর্তমানে কোনো খবর জানি না।

সলিমুল্লাহ মুসলিম হলো এক স্মৃতির সাগর আমার। আমার মনে হয় আমাকে আরও অনেক কিছু কথা লিখতে হবে আমার এই প্রিয় হলে আমার জীবন যাপন নিয়ে। (চলবে)

back to top