alt

সাময়িকী

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ১১

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

: সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

পূর্ব প্রকাশের পর

‘পদ্মার ঢেউ রে-

মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা, যা রে।’

এটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি ভাটিয়ালি অঙ্গের গান। পদ্মার কাছে মিনতি করা হচ্ছে যাতে সে তার বিরহী প্রেমিকাকে গিয়ে হৃদয়-পদ্ম উপহার দেয়। ‘রে’ উপজ শব্দ ব্যবহার করে গানটিতে ভাটিয়ালি অঙ্গের রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘এভব সাগরে কেমনে দিন পাড়ি রে/দিবা নিশি কান্দি রে নদীর কূলে বইয়া/ও মন রে ঘার আছে রসিক নাইয়া/আগে তরী গেল বাইয়ারে/আমি ঠইকা রইলাম বালুচরে মাঝি-মল্লা লইয়ারে।’ এই গানটিতে জীবনকে সাগরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ জীবন পাড়ি দেওয়া কঠিন। জীবনের উত্থান-পতনের সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আরও একটি প্রচলিত রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ভাটিয়ালি ‘এমন প্রেমের নদী সই গো/ডুব দিলাম না/নদীর কূলে কূলে ঘুরে বেড়াই/পাই না ত ঘাটের ঠিকানা/নিত্যঘাটে আসি বসি/জলের ছায়ায় ওইরূপ দেখি গো/ জলে নামি নামি নামি করি/মরণ ভয়ে নামি না।’ ‘চণ্ডীদাস আর রজকিনী/তারা প্রেমের শিরোমণি গো/তারা এক মরণে দুইজন মরে/না’ ... কৃষ্ণকে এক নজর দেখার জন্য রাধার মন ব্যাকুল থাকে। মূলত চিরন্তন প্রেমেরে আকুতি রাধা-কৃষ্ণের লীলার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে।

তাঁর আরও একটি বিখ্যাত ভাটিয়ালি গান রয়েছে যার ভাবসম্পদ শ্রোতার মনে অসাধারণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে-

‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস্ রে-

চোখ গেল পাখি (রে)!

তোর ও চোখে কাহার চোখ পড়েছে না কি রে

চোখ গেল পাখি (রে)।।

উল্লিখিত গানটি ভাটিয়ালি গান হলেও এত ঝুমুরের আবেশ পাওয়া যায়। ঝুমুর যেমন ছন্দে ছন্দে গীত হয় এই গানটিতেও তেমনি ভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভাটিয়ালি গানগুলো হলে- ‘এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা/(রে ভাই) এই বিধির খেলা/সকাল বেলার আমির রে ভাই/ ফকির সন্ধ্যাবেলা’ (পৃ. ২৭০) ‘আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে/আমি খুঁজে বেড়াই তারেই ভাই’ (পৃ. ৬৭৪), ‘নাইতে এসে ভাটির ¯্রােতে কল্সি, বন্ধু রয় যে দেশে’ (পৃ. ৭৬), ‘আমার গহীন জলের নদী/আমি তোমার জলে ভেসে রইলাম জনম অবধি’ (পৃ. ২৮২), ‘আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব সে কন্যার দেশ রে’ (পৃ. ০৩), ‘কোন বিদেশের নাইয়া তুমি আইলা আমার গাঁও/কুল-বধূর সিনান ঘাটে বাঁধলে তোমার নাও’ (পৃ. ২১৬), ‘দুধে আলতায় রঙ যেন তার সোনার অঙ্গ ছেয়ে/(সে) ভিন্ গেরামের মেয়ে’, (পৃ. ৬৭৩), ‘বন-বিহঙ্গ যাও রে উড়ে মেঘ্না নদীর পারে/ দেখা হলে আমার কথা কয়ো গিয়ে তারে’ (পৃ. ২৫), ‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে ঐ সখি লো কমল-দীঘির পারে।/আমি জল নিতে যাই সকালে সাঁঝে সই’ (পৃ. ৬৭৬)।

ভাওয়াইয়া

নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা,

পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি।

‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’ নজরুলের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি লোকপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান। এই গানের বাণী ভাবে অত্যন্ত সরল-সহজ-ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রাম্য বালিকার সাধারণ জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, প্রেম-ভাবনা এ গানের মূল উপজীব্য। ‘সেদিন তুলতে গেলাম দুপুর বেলা/কলমি শাকে ঢোলা (সই)/হ’ল না আর সখি লো শাক তোলা।’ কত সরল-সহজ প্রেমময় উক্তি। সেই ললনা তার কাজ করছে কিন্তু বারবারই তার প্রেমিকাকে উক্তি। সেই ললনা তার কাজ করেছে কিন্তু বরাবরই তার প্রেমিকের কথা মনে পড়েছে। ঘরে ফেরার পথে একজন সাধারণ গ্রামবালিকার ঝিলের গহিন জলে শালুক ফুটে থাকা দেখে প্রেমিকের কথা মনে হওয়া আর ঝিলের জলের সাথে চোখের জলের মাখামাখি হওয়ার উপমা একেবারেই গ্রামীণ জীবনচিত্র, যা নজরুল সরল উক্তির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।

ভাওয়াইয়া বাউল-ভাটিয়ালির মতোই লোকসংগীতের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ধারা। ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য হলো- এতে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার নিবিড়-গভীর ব্যঞ্জনা ভাব ফুটে ওঠে। ‘আমার বাড়ী যান ও প্রাণের মৈষাল/বইসতে দিব মোড়া/বুক্কুতে হেলান দিয়া রে/বাজাইবেন দোত্রা/... জলপান করিতে দিব রে/সরু ধানের চিড়া/বিরম ধানের খই/ঘরে আছে চম্পা কলা রে মৈষাল/ গামছা বান্ধা দই।’ এখানে বিরহ ভাব তীব্র এবং পাশাপাশি এক ধরনের নিরাসক্ত ভাবও পরিলক্ষিত হয়। নজরুল দুই ধরনের ভাবের সমন্বয়ে তাঁর ভাওয়াইয়া গান সৃষ্টি করেছেন। বলা যায় তিনি এ ধরনের গানেও স্বতন্ত্র ভাবধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা গানের সকল ধারায়ই আকৃষ্ট হন এবং সংগীত সৃষ্টি করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংগীত পায় সার্বজনীনতা। ভাওয়াইয়া গান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জানি না এই সুরের কি মায়া; আমার মন বলে যায়, কোন পাহাড়িয়া দেশের সবুজ মাঠের আঁকবাঁকা আলো প্রন্তিতে উপপ্রান্তিকে’। ‘ভাব থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা’। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত গান ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া গানের লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হলো- পঙ্ক্তিবিশেষের সুরে দীর্ঘ টান দেওয়া হয় এবং মাঝে মাঝে ধাক্কাজনিত এক ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করা হয়। পাঠক-শ্রোতা যখন সুরের মধ্য দিয়ে এ গান শোনে তখন এক ধরনের মরমিভাব অনুভব করে, কী যেন আপন মানুষকে আপনার মাঝে খোঁজার এক বাসনা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর আরও একটি ভাওয়াইয়া গানে প্রাণের ভেতরে কী গভীর মায়া তৈরি করে তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়- ‘পদ্মাদীঘির ধারে ধরে ঐ সখি লো কমল-দীঘির পারে-/আমি জল নিতে যাই সকাল সাঝেঁ সই/ সখি, চল ত’রে সে মাছ ধরে, আর, চায় সে বারে বারে,/মাছ ধরে সে, বড়শী আমার বুকে এসে বেঁধে,/ওলো সই বুকে এসে বেঁধে’ (পৃ. ৬৭৬)’। নমুনায়নের মাধ্যমে ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’- এই গানটির বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো-

কীর্তন

আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝানি কি রসিক বঁধু।

তুমি মন বোঝ মনোচোর মান বোঝ নাকি হে-

রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক লৌকিক উপাদানের ভিত্তিতে কীর্তন গান রচিত হয়েছে। এ গানে শ্রীখোল, মন্দিরা, করতাল, সারিন্দা বাদ্যযন্ত্রগুলো ব্যবহৃত হয়। সবাই একসাথে জড়ো হয় এবং এই সকল বাদ্যযন্ত্রগুলোর সহযোগে রাধা-কৃষ্ণের গুণ-কীর্তন করা হয়। কীর্তনের ভক্তিভাব উপস্থিত সকলের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে পড়ে এবং শ্রোতা ও শিল্পী একাকার হয়ে পড়ে সুরের অনুষদে। গ্রাম-গঞ্জে ঐতিহ্যপূর্ণ মৌলিক গায়নশৈলী এ কীর্তন। কীর্তন দুই প্রকারের-

১ নাম কীর্তন

২ লীলা কীর্তন

নাম কীর্তন : ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’ নামই কেবল উচ্চারিত হয়। কিন্তু লীলা কীর্তনে রাধা-কৃষ্ণের লীলা কাহিনী অবলম্বনে রচিত পদ গান হয়ে থাকে। তবে ‘কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কীর্তন পর্যায়ের গানগুলোতে রাধা-কৃষ্ণর প্রেমকে উপজীব্য করে অর্থাৎ পদাবলি ভাব অবলম্বন করে রচনা করেছেন। এ সকল কীর্তন গানে কখনো ভাঙা সুরের ধারা ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো আবার লোক সুরের আঙ্গিকেও কীর্তনের সুর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

‘আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝনি কি রসিক বঁধু’ একটি ফেতরা তালে রচিত নজরুলের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি কীর্তন। এখানে রাধা-কৃষ্ণের বেদনা-বিধুর-মধুর লীরার বর্ণনা রয়েছে। এই গানের চিত্রকল্পে চেনা কিংবা জানার কথাও বলা হয়েছে। নরনারীর লীলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে চাঁদ। চাঁদ নিয়ে হিন্দুদের পুরাণের চিত্রকল্প আছে গানটিতে- ‘কলঙ্কী বলে গগনের চাঁদ প্রতি দিন ক্ষয় হয়/তুমি নিত্য পূর্ণ চাঁদ সম প্রিয়তম চির অক্ষয়/এ চাঁদে একাদশী নাই হে’- একাদশীর চাঁদ পুণ্য তিথি হিসেবে। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে উপবাস করেন হিন্দ ধর্ম অনুসারীরা। এই গানের চিত্রকল্পে রাধার কাছে কৃষ্ণ পূর্ণ চাঁদসময় চির অক্ষয় এবং এই চাঁদের কোনো একাদশী নেই! লীলা এবং বিরহের সংমিশ্রণে এক অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে এই গানে। গানটিতে বেশ কয়েকবার তাল পরিবর্তন হয়। শ্রোতা যখন কীর্তনের সুরের মধ্যদিয়ে শোনে তখন মুহূর্তেই এর ভাবের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে। গানটিতে রাধা-কৃষ্ণের মান-ভঞ্জন, প্রেমলীলা নানাভাবে নান উপমায় বোঝাবার প্রয়াস রয়েছে। (চলবে)

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

ছবি

আব্দুলরাজাক গুনরাহর সাহিত্যচিন্তা

ছবি

অমিতাভ ঘোষের ‘গান আইল্যান্ড’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

tab

সাময়িকী

নজরুল সঙ্গীতবিষয়ক ধারাবাহিক রচনা : ১১

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

সম্পা দাস

সোমবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৩

পূর্ব প্রকাশের পর

‘পদ্মার ঢেউ রে-

মোর শূন্য হৃদয়-পদ্ম নিয়ে যা, যা রে।’

এটি কাজী নজরুল ইসলামের একটি ভাটিয়ালি অঙ্গের গান। পদ্মার কাছে মিনতি করা হচ্ছে যাতে সে তার বিরহী প্রেমিকাকে গিয়ে হৃদয়-পদ্ম উপহার দেয়। ‘রে’ উপজ শব্দ ব্যবহার করে গানটিতে ভাটিয়ালি অঙ্গের রূপ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘এভব সাগরে কেমনে দিন পাড়ি রে/দিবা নিশি কান্দি রে নদীর কূলে বইয়া/ও মন রে ঘার আছে রসিক নাইয়া/আগে তরী গেল বাইয়ারে/আমি ঠইকা রইলাম বালুচরে মাঝি-মল্লা লইয়ারে।’ এই গানটিতে জীবনকে সাগরের সাথে তুলনা করা হয়েছে। এ জীবন পাড়ি দেওয়া কঠিন। জীবনের উত্থান-পতনের সঙ্গে সাগরের ঢেউয়ের সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আরও একটি প্রচলিত রাধাকৃষ্ণবিষয়ক ভাটিয়ালি ‘এমন প্রেমের নদী সই গো/ডুব দিলাম না/নদীর কূলে কূলে ঘুরে বেড়াই/পাই না ত ঘাটের ঠিকানা/নিত্যঘাটে আসি বসি/জলের ছায়ায় ওইরূপ দেখি গো/ জলে নামি নামি নামি করি/মরণ ভয়ে নামি না।’ ‘চণ্ডীদাস আর রজকিনী/তারা প্রেমের শিরোমণি গো/তারা এক মরণে দুইজন মরে/না’ ... কৃষ্ণকে এক নজর দেখার জন্য রাধার মন ব্যাকুল থাকে। মূলত চিরন্তন প্রেমেরে আকুতি রাধা-কৃষ্ণের লীলার মধ্যে দিয়ে ফুটে ওঠে।

তাঁর আরও একটি বিখ্যাত ভাটিয়ালি গান রয়েছে যার ভাবসম্পদ শ্রোতার মনে অসাধারণ ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে-

‘চোখ গেল’ ‘চোখ গেল’ কেন ডাকিস্ রে-

চোখ গেল পাখি (রে)!

তোর ও চোখে কাহার চোখ পড়েছে না কি রে

চোখ গেল পাখি (রে)।।

উল্লিখিত গানটি ভাটিয়ালি গান হলেও এত ঝুমুরের আবেশ পাওয়া যায়। ঝুমুর যেমন ছন্দে ছন্দে গীত হয় এই গানটিতেও তেমনি ভাব পরিলক্ষিত হয়। তাঁর বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ভাটিয়ালি গানগুলো হলে- ‘এ কূল ভাঙ্গে ও কূল গড়ে/এই তো নদীর খেলা/(রে ভাই) এই বিধির খেলা/সকাল বেলার আমির রে ভাই/ ফকির সন্ধ্যাবেলা’ (পৃ. ২৭০) ‘আমার ভাঙা নায়ের বৈঠা ঠেলে/আমি খুঁজে বেড়াই তারেই ভাই’ (পৃ. ৬৭৪), ‘নাইতে এসে ভাটির ¯্রােতে কল্সি, বন্ধু রয় যে দেশে’ (পৃ. ৭৬), ‘আমার গহীন জলের নদী/আমি তোমার জলে ভেসে রইলাম জনম অবধি’ (পৃ. ২৮২), ‘আমি ময়নামতীর শাড়ি দেব সে কন্যার দেশ রে’ (পৃ. ০৩), ‘কোন বিদেশের নাইয়া তুমি আইলা আমার গাঁও/কুল-বধূর সিনান ঘাটে বাঁধলে তোমার নাও’ (পৃ. ২১৬), ‘দুধে আলতায় রঙ যেন তার সোনার অঙ্গ ছেয়ে/(সে) ভিন্ গেরামের মেয়ে’, (পৃ. ৬৭৩), ‘বন-বিহঙ্গ যাও রে উড়ে মেঘ্না নদীর পারে/ দেখা হলে আমার কথা কয়ো গিয়ে তারে’ (পৃ. ২৫), ‘পদ্মদীঘির ধারে ধারে ঐ সখি লো কমল-দীঘির পারে।/আমি জল নিতে যাই সকালে সাঁঝে সই’ (পৃ. ৬৭৬)।

ভাওয়াইয়া

নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা,

পাখি সে নয় নাচে কালো আঁখি।

‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’ নজরুলের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি লোকপ্রিয় ভাওয়াইয়া গান। এই গানের বাণী ভাবে অত্যন্ত সরল-সহজ-ব্যঞ্জনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। গ্রাম্য বালিকার সাধারণ জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনা, প্রেম-ভাবনা এ গানের মূল উপজীব্য। ‘সেদিন তুলতে গেলাম দুপুর বেলা/কলমি শাকে ঢোলা (সই)/হ’ল না আর সখি লো শাক তোলা।’ কত সরল-সহজ প্রেমময় উক্তি। সেই ললনা তার কাজ করছে কিন্তু বারবারই তার প্রেমিকাকে উক্তি। সেই ললনা তার কাজ করেছে কিন্তু বরাবরই তার প্রেমিকের কথা মনে পড়েছে। ঘরে ফেরার পথে একজন সাধারণ গ্রামবালিকার ঝিলের গহিন জলে শালুক ফুটে থাকা দেখে প্রেমিকের কথা মনে হওয়া আর ঝিলের জলের সাথে চোখের জলের মাখামাখি হওয়ার উপমা একেবারেই গ্রামীণ জীবনচিত্র, যা নজরুল সরল উক্তির মধ্য দিয়ে তুলে ধরেছেন।

ভাওয়াইয়া বাউল-ভাটিয়ালির মতোই লোকসংগীতের আরও একটি বৈশিষ্ট্য ধারা। ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য হলো- এতে মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখ, চাওয়া-পাওয়ার নিবিড়-গভীর ব্যঞ্জনা ভাব ফুটে ওঠে। ‘আমার বাড়ী যান ও প্রাণের মৈষাল/বইসতে দিব মোড়া/বুক্কুতে হেলান দিয়া রে/বাজাইবেন দোত্রা/... জলপান করিতে দিব রে/সরু ধানের চিড়া/বিরম ধানের খই/ঘরে আছে চম্পা কলা রে মৈষাল/ গামছা বান্ধা দই।’ এখানে বিরহ ভাব তীব্র এবং পাশাপাশি এক ধরনের নিরাসক্ত ভাবও পরিলক্ষিত হয়। নজরুল দুই ধরনের ভাবের সমন্বয়ে তাঁর ভাওয়াইয়া গান সৃষ্টি করেছেন। বলা যায় তিনি এ ধরনের গানেও স্বতন্ত্র ভাবধারা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলা গানের সকল ধারায়ই আকৃষ্ট হন এবং সংগীত সৃষ্টি করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর সংগীত পায় সার্বজনীনতা। ভাওয়াইয়া গান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জানি না এই সুরের কি মায়া; আমার মন বলে যায়, কোন পাহাড়িয়া দেশের সবুজ মাঠের আঁকবাঁকা আলো প্রন্তিতে উপপ্রান্তিকে’। ‘ভাব থেকে ভাওয়াইয়া শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকের ধারণা’। উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত গান ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া গানের লক্ষণীয় একটি বৈশিষ্ট্য হলো- পঙ্ক্তিবিশেষের সুরে দীর্ঘ টান দেওয়া হয় এবং মাঝে মাঝে ধাক্কাজনিত এক ধরনের ভাঙনের সৃষ্টি করা হয়। পাঠক-শ্রোতা যখন সুরের মধ্য দিয়ে এ গান শোনে তখন এক ধরনের মরমিভাব অনুভব করে, কী যেন আপন মানুষকে আপনার মাঝে খোঁজার এক বাসনা পরিলক্ষিত হয়। তাঁর আরও একটি ভাওয়াইয়া গানে প্রাণের ভেতরে কী গভীর মায়া তৈরি করে তা ভাষা দিয়ে প্রকাশ করা সম্ভব নয়- ‘পদ্মাদীঘির ধারে ধরে ঐ সখি লো কমল-দীঘির পারে-/আমি জল নিতে যাই সকাল সাঝেঁ সই/ সখি, চল ত’রে সে মাছ ধরে, আর, চায় সে বারে বারে,/মাছ ধরে সে, বড়শী আমার বুকে এসে বেঁধে,/ওলো সই বুকে এসে বেঁধে’ (পৃ. ৬৭৬)’। নমুনায়নের মাধ্যমে ‘নদীর নাম সই অঞ্জনা নাচে তীরে খঞ্জনা’- এই গানটির বিষয়বস্তু আলোচনা করা হলো-

কীর্তন

আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝানি কি রসিক বঁধু।

তুমি মন বোঝ মনোচোর মান বোঝ নাকি হে-

রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক লৌকিক উপাদানের ভিত্তিতে কীর্তন গান রচিত হয়েছে। এ গানে শ্রীখোল, মন্দিরা, করতাল, সারিন্দা বাদ্যযন্ত্রগুলো ব্যবহৃত হয়। সবাই একসাথে জড়ো হয় এবং এই সকল বাদ্যযন্ত্রগুলোর সহযোগে রাধা-কৃষ্ণের গুণ-কীর্তন করা হয়। কীর্তনের ভক্তিভাব উপস্থিত সকলের মধ্যে প্রবাহিত হয়ে পড়ে এবং শ্রোতা ও শিল্পী একাকার হয়ে পড়ে সুরের অনুষদে। গ্রাম-গঞ্জে ঐতিহ্যপূর্ণ মৌলিক গায়নশৈলী এ কীর্তন। কীর্তন দুই প্রকারের-

১ নাম কীর্তন

২ লীলা কীর্তন

নাম কীর্তন : ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে’ নামই কেবল উচ্চারিত হয়। কিন্তু লীলা কীর্তনে রাধা-কৃষ্ণের লীলা কাহিনী অবলম্বনে রচিত পদ গান হয়ে থাকে। তবে ‘কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর কীর্তন পর্যায়ের গানগুলোতে রাধা-কৃষ্ণর প্রেমকে উপজীব্য করে অর্থাৎ পদাবলি ভাব অবলম্বন করে রচনা করেছেন। এ সকল কীর্তন গানে কখনো ভাঙা সুরের ধারা ব্যবহৃত হয়েছে। কখনো আবার লোক সুরের আঙ্গিকেও কীর্তনের সুর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’

‘আমি কলহেরি তরে কলহ করেছি বোঝনি কি রসিক বঁধু’ একটি ফেতরা তালে রচিত নজরুলের অত্যন্ত বিখ্যাত একটি কীর্তন। এখানে রাধা-কৃষ্ণের বেদনা-বিধুর-মধুর লীরার বর্ণনা রয়েছে। এই গানের চিত্রকল্পে চেনা কিংবা জানার কথাও বলা হয়েছে। নরনারীর লীলায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে চাঁদ। চাঁদ নিয়ে হিন্দুদের পুরাণের চিত্রকল্প আছে গানটিতে- ‘কলঙ্কী বলে গগনের চাঁদ প্রতি দিন ক্ষয় হয়/তুমি নিত্য পূর্ণ চাঁদ সম প্রিয়তম চির অক্ষয়/এ চাঁদে একাদশী নাই হে’- একাদশীর চাঁদ পুণ্য তিথি হিসেবে। চাঁদের শুক্ল ও কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিতে উপবাস করেন হিন্দ ধর্ম অনুসারীরা। এই গানের চিত্রকল্পে রাধার কাছে কৃষ্ণ পূর্ণ চাঁদসময় চির অক্ষয় এবং এই চাঁদের কোনো একাদশী নেই! লীলা এবং বিরহের সংমিশ্রণে এক অসাধারণ চিত্রকল্প ফুটে উঠেছে এই গানে। গানটিতে বেশ কয়েকবার তাল পরিবর্তন হয়। শ্রোতা যখন কীর্তনের সুরের মধ্যদিয়ে শোনে তখন মুহূর্তেই এর ভাবের সাথে একাত্ম হয়ে পড়ে। গানটিতে রাধা-কৃষ্ণের মান-ভঞ্জন, প্রেমলীলা নানাভাবে নান উপমায় বোঝাবার প্রয়াস রয়েছে। (চলবে)

back to top