alt

সাময়িকী

দূরের তারাটিকে

মেঘ অদিতি

: বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন মানুষ, স্নেহময়ী এক মা, বাংলা ভাষার একজন কবি হঠাৎ করেই সেদিন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বলছি ষাটের দশকের বাংলা কবিতার বরেণ্য কবি কাজী রোজীর কথা যাকে চিনেছিলাম বাইরে থেকে, তাঁর কবিতায়, গানে বা সাহিত্য বিষয়ক কিছু সভায়। আর চিনেছিলাম অন্দরমহলে তাঁর মাতৃসুলভ আচরণ আর স্নেহের ভেতর দিয়ে। তাঁর অন্তর্হিত হবার এক বছর পর আজ যখন তাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছি কেবলই মনে হচ্ছে, কেন সময় থাকতে কিছু লিখিনি। আজ আমার লেখা বা না লেখায় সত্যিই কি তাঁর কিছু এসে যায়! যায় না। বন্ধু সুমী সিকানদারের বাসায় একাধিক দুপুরে তাঁর উপস্থিতি আমার মনে যে ভাবমূর্তিটি তৈরি করেছিল, তা কেবলই এক মায়ের। কবি কাজী রোজীর চলে যাওয়া তাই কেবল একজন কবির চলে যাওয়া নয় আমার আরও একজন মা যার স্নেহছায়া থেকে বরাবরের মতো বঞ্চিত হওয়াও বটে।

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে আমার এই লেখাটি তাঁর সাহিত্য জীবনের সুবিশাল ক্যানভাসের এক তৃতীয়াংশও ধরতে অক্ষম কেন না খুব অল্প সময়ে লেখাটি লিখতে হচ্ছে। কাজেই, সামান্য এই লেখাটি আসলে তাঁকে দূর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। তাঁর কবিতা নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আবার নিশ্চয়ই লিখতে চাইব আমি। আজ এই লেখাটি কেবল কবি কাজী রোজীর কিছু কবিতা পাঠ এবং তাঁর কাজের ওই যে বিশাল ক্যানভাসের কথা বলেছিলাম তারই সামান্য একটি জায়গায় ?এনে রাখার একটি চেষ্টামাত্র।

কবি কাজী রোজী। ষাটের দশকে, বাংলা সাহিত্যে অন্যতম কবিদের একজন। দীর্ঘদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৭ সালে তিনি অবসরে যান। এছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত মাসিক সচিত্র বাংলাদেশ-এর সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে যেমন তিনি সক্রিয় ছিলেন তেমনই পরবর্তীকালে চাকরি থেকে অবসরের পর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাতক্ষীরা জেলার জন্য নির্ধারিত সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একসময় বেতার মাধ্যমে তিনি নিয়মিত আবৃত্তি, উপস্থাপনা করেছেন। বেতার-টিভির জন্যও লিখেছেন অসংখ্য গান। আবিদা সুলতানার কণ্ঠে, ‘আমার দোষে কারো নাকি কপাল ভেঙেছে’, শিল্পী শাকিলা জাফরের কন্ঠে ‘এ তোমার জানবার কথা নয়’, স্বাধীনতার পটভূমিকায় রচিত শিল্পী আবিদা সুলতানার কণ্ঠে ‘চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে হয়ত সে এক কথকতা’ উল্লেখযোগ্য এই গানগুলো তাঁরই রচিত। এছাড়াও তাঁর রচিত নাটক ‘কুসুম বেত্তান্ত’ শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়েছে। ‘কুসুম বেত্তান্ত’ মঞ্চস্থ হয়েছে দেশের বাইরে ভারতের উড়িষ্যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর শাণিত কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি দিয়ে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের মাঝেই যে সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া সাহসী এই নারী অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়েও। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও।

শিল্পের নানা শাখায় অনায়াস বিচরণকারী এই কবির বর্ণাঢ্য যাপনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত তারুণ্যদীপ্ত, প্রাণোচ্ছল। প্রবল জীবনিশক্তি নিয়েই যেন তিনি এসেছিলেন। ক্যান্সারের মতো এক জটিল অসুখের সাথে যে দিনগুলো কাটিয়েছেন সেসব দিনেও কবির মনের জোর একফোঁটাও কমেনি। যখনই তাঁকে দেখেছি তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখটির সমাদরের কাছে নত হয়েছি। তিনি যেমন ছিলেন সামাজিক, তেমনই স্বভাবে ছিলেন আন্তরিক। স্বল্প পরিচয়েও মানুষকে কাছে টানার এই অনন্য গুণটি তাঁর স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল। বহুদিন বন্ধু সুমী বাসায় আড্ডা মারতে মারতে দেখেছি একটি সভা থেকে ফিরে দুটো নাকেমুখে গুঁজেই তিনি ফের বেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী সভায় অংশ নেবার জন্য। মাঝের ওইটুকু সামান্য সময়, তারই মাঝে তিনি আমার সাথে কথা বলছেন, মাথায় হাত রাখছেন। তাঁর সেই স্নেহের কাছে আমি চিরঋণী।

কবিতামুখর যাপনে এই কবি আবহমান বাংলা কবিতাকে দিয়ে গেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর কিছু কবিতা এবং গান মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। কবির দুটি কবিতা পাঠ করা যাক।

সেই উঠোন

উঠোনটাকে পেরিয়ে গিয়ে পথ

পথের শেষে অন্ধকারের রূপ

বৃক্ষরাজির গভীর ঘন ছুঁয়ে

তোমার আলো কালো কাটার পথ।

অন্য আদেশ অন্য সময় মেনে

রাতদুপুরে সুখের সীমা টানি

আনন্দ বেশ জড়িয়ে নেব নিজে

তোমার কোনো ক্ষতির কারণ, নয়।

শত্রুপাখি গাছের ডালে থাকে

তার নিধনে আমরা ডাকি তাকে

হায় না জেনে, আড়াল যারে করি

তার বাঁধনে নিজের ভাগ্য গড়ি।

আবার আসি সেই উঠোনে আমি

তোমার দুহাত জড়িয়ে ধরে থাকি

বৃক্ষরাজির গুল্মলতার মতো

আলোর নাগাল উঠোন ভরে রাখি।

সোনালু

সোনালু একটি ঘরের নাম।

একটি ওয়াশরুম। একটি ডবল খাট

আর একটি সিঙ্গেল খাট।

ছোট সাইড টেবিল- তাতে একটি জগ- মামের বোতল

একটি-দুটি গ্লাস, সবটাই জল-পূর্ণ।

মৌলভীবাজার সার্কিট হাউস থেকে ওটা দেখা যায়।

ঘরটায় দিন-রাত নেই- সারাক্ষণ অন্ধকার।

সুইচ আছে- বাল্ব নেই। ফ্যান ঘোরে সারাক্ষণ।

কে বা কারা সেই ঘরে থাকে আমি জানিনে।

একদিন আমিও ছিলাম।

টিনের চালে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি-নূপুর।

ঘরের ভেতর শব্দ-নূপুর- ওর নাম সোনালু।

ওকে চেনা যায় না, অন্ধকারে সেঁটে থাকে ওর রং-

রাতের কালো রঙের মতো গভীর নিবিড়।

সারাক্ষণ সোনালুর নিয়ন্ত্রণে ছিলাম আমি।

আমার সকল সুখ ওর নিবেদনে ছিল।

ভরাট যমুনার গান দিয়ে ও আমায় ভরিয়েছিল

অথচ আমি ওর আলাদা কিছু টের পাইনি।

সম্বিত ফিরলেই বুঝলাম...

আসলে সোনালু ছিল অস্বাভাবিক

পাগলের জড়াজড়ি।

জলজ প্রাণী- জগভরা জলের মতো তৃপ্তিদায়ক।

সরল ভাষায় হৃদয়ের গভীর অনুভূতিকে এভাবে ক’জন প্রকাশ করতে পারেন! ব্যথায়, প্রেমে, দ্রোহে, প্রতিবাদে শব্দের উচ্চকিত ব্যবহার নয়, অহেতুক আড়ম্বর নয় বরং হৃদয়ের সরলতম ভাষায় তিনি লিখে গেছেন ভনিতাবিহীন কবিতা। বাংলাদেশের কবিতা অঙ্গনে প্রাণসঞ্চারী এই মানুষটি গত বছর চিরতরে হারিয়ে গেছেন। তাঁর সেই শূন্যতা অপূরণীয় একথা যেমন ঠিক তেমনই বলব, সময়ের নানা অভিঘাতের পরও যতদিন বাংলা কবিতা বেঁচে থাকবে, সন্দেহাতীতভাবে কবি কাজী রোজী তাঁর কবিতা এবং সমস্ত কর্মকা-ের ভেতর দিয়েই বেঁচে আছেন, থাকবেন।

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

ছবি

ফিরবে না তা জানি

ছবি

ওবায়েদ আকাশের বাছাই ৩২ কবিতা

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

দেহাবশেষ

ছবি

যাদুবাস্তবতা ও ইলিয়াসের যোগাযোগ

ছবি

বাংলার স্বাধীনতা আমার কবিতা

ছবি

মিহির মুসাকীর কবিতা

ছবি

শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

সময়োত্তরের কবি

ছবি

নাট্যকার অভিনেতা পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৭৪

ছবি

মহত্ত্বম অনুভবে রবিউল হুসাইন

‘লাল গহনা’ উপন্যাসে বিষয়ের গভীরতা

ছবি

‘শৃঙ্খল মুক্তির জন্য কবিতা’

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

মোহিত কামাল

ছবি

আশরাফ আহমদের কবিতা

ছবি

‘আমাদের সাহিত্যের আন্তর্জাতিকীকরণে আমাদেরই আগ্রহ নেই’

ছবি

ছোটগল্পের অনন্যস্বর হাসান আজিজুল হক

‘দীপান্বিত গুরুকুল’

ছবি

নাসির আহমেদের কবিতা

ছবি

শেষ থেকে শুরু

সাময়িকী কবিতা

ছবি

স্মৃতির অতল তলে

ছবি

রবীন্দ্রবোধন

ছবি

বাঙালির ভাষা-সাহিত্য-সংস্কৃতি হয়ে ওঠার দীর্ঘ সংগ্রাম

ছবি

হাফিজ রশিদ খানের নির্বাচিত কবিতা আদিবাসীপর্ব

ছবি

আনন্দধাম

ছবি

কান্নার কুসুমে চিত্রিত ‘ধূসরযাত্রা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফারুক মাহমুদের কবিতা

ছবি

পল্লীকবি জসীম উদ্দীন ও তাঁর অমর সৃষ্টি ‘আসমানী’

ছবি

‘অঞ্জলি লহ মোর সঙ্গীতে’

ছবি

পরিবেশ-সাহিত্যের নিরলস কলমযোদ্ধা

tab

সাময়িকী

দূরের তারাটিকে

মেঘ অদিতি

বৃহস্পতিবার, ০২ মার্চ ২০২৩

প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর একজন মানুষ, স্নেহময়ী এক মা, বাংলা ভাষার একজন কবি হঠাৎ করেই সেদিন চিরতরে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। বলছি ষাটের দশকের বাংলা কবিতার বরেণ্য কবি কাজী রোজীর কথা যাকে চিনেছিলাম বাইরে থেকে, তাঁর কবিতায়, গানে বা সাহিত্য বিষয়ক কিছু সভায়। আর চিনেছিলাম অন্দরমহলে তাঁর মাতৃসুলভ আচরণ আর স্নেহের ভেতর দিয়ে। তাঁর অন্তর্হিত হবার এক বছর পর আজ যখন তাঁকে নিয়ে লিখতে বসেছি কেবলই মনে হচ্ছে, কেন সময় থাকতে কিছু লিখিনি। আজ আমার লেখা বা না লেখায় সত্যিই কি তাঁর কিছু এসে যায়! যায় না। বন্ধু সুমী সিকানদারের বাসায় একাধিক দুপুরে তাঁর উপস্থিতি আমার মনে যে ভাবমূর্তিটি তৈরি করেছিল, তা কেবলই এক মায়ের। কবি কাজী রোজীর চলে যাওয়া তাই কেবল একজন কবির চলে যাওয়া নয় আমার আরও একজন মা যার স্নেহছায়া থেকে বরাবরের মতো বঞ্চিত হওয়াও বটে।

শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো যে আমার এই লেখাটি তাঁর সাহিত্য জীবনের সুবিশাল ক্যানভাসের এক তৃতীয়াংশও ধরতে অক্ষম কেন না খুব অল্প সময়ে লেখাটি লিখতে হচ্ছে। কাজেই, সামান্য এই লেখাটি আসলে তাঁকে দূর থেকে শ্রদ্ধা নিবেদনের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াসমাত্র। তাঁর কবিতা নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে আবার নিশ্চয়ই লিখতে চাইব আমি। আজ এই লেখাটি কেবল কবি কাজী রোজীর কিছু কবিতা পাঠ এবং তাঁর কাজের ওই যে বিশাল ক্যানভাসের কথা বলেছিলাম তারই সামান্য একটি জায়গায় ?এনে রাখার একটি চেষ্টামাত্র।

কবি কাজী রোজী। ষাটের দশকে, বাংলা সাহিত্যে অন্যতম কবিদের একজন। দীর্ঘদিন তথ্য মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পালন শেষে ২০০৭ সালে তিনি অবসরে যান। এছাড়া তিনি ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের সাথে যুক্ত ছিলেন। চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে প্রকাশিত মাসিক সচিত্র বাংলাদেশ-এর সম্পাদক ছিলেন। ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে যেমন তিনি সক্রিয় ছিলেন তেমনই পরবর্তীকালে চাকরি থেকে অবসরের পর আবার রাজনীতিতে সক্রিয় হন এবং ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সাতক্ষীরা জেলার জন্য নির্ধারিত সংরক্ষিত নারী আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।

একসময় বেতার মাধ্যমে তিনি নিয়মিত আবৃত্তি, উপস্থাপনা করেছেন। বেতার-টিভির জন্যও লিখেছেন অসংখ্য গান। আবিদা সুলতানার কণ্ঠে, ‘আমার দোষে কারো নাকি কপাল ভেঙেছে’, শিল্পী শাকিলা জাফরের কন্ঠে ‘এ তোমার জানবার কথা নয়’, স্বাধীনতার পটভূমিকায় রচিত শিল্পী আবিদা সুলতানার কণ্ঠে ‘চাঁদের বুড়ি চরকা কাটে হয়ত সে এক কথকতা’ উল্লেখযোগ্য এই গানগুলো তাঁরই রচিত। এছাড়াও তাঁর রচিত নাটক ‘কুসুম বেত্তান্ত’ শিল্পকলা একাডেমি ও মহিলা সমিতি মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয়েছে। ‘কুসুম বেত্তান্ত’ মঞ্চস্থ হয়েছে দেশের বাইরে ভারতের উড়িষ্যায়। ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতারে তাঁর শাণিত কণ্ঠের কবিতা আবৃত্তি দিয়ে কত শত মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষের মাঝেই যে সাহস জুগিয়েছেন তিনি! লিখেছেন গান, কবিতা, নাটক, আর জীবনী। কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যার দায়ে কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেওয়া সাহসী এই নারী অনেক বছর কাজ করেছেন প্রতিবন্ধীদের নিয়েও। যুক্ত ছিলেন ডিজেবল রাইটস গ্রুপ, সাবা, লারা, জাতীয় কবিতা পরিষদের সঙ্গে। বহু বছর কাজ করেছেন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর অধিবাসীদের নিয়েও।

শিল্পের নানা শাখায় অনায়াস বিচরণকারী এই কবির বর্ণাঢ্য যাপনে তিনি ছিলেন অত্যন্ত তারুণ্যদীপ্ত, প্রাণোচ্ছল। প্রবল জীবনিশক্তি নিয়েই যেন তিনি এসেছিলেন। ক্যান্সারের মতো এক জটিল অসুখের সাথে যে দিনগুলো কাটিয়েছেন সেসব দিনেও কবির মনের জোর একফোঁটাও কমেনি। যখনই তাঁকে দেখেছি তাঁর হাস্যোজ্জ্বল মুখটির সমাদরের কাছে নত হয়েছি। তিনি যেমন ছিলেন সামাজিক, তেমনই স্বভাবে ছিলেন আন্তরিক। স্বল্প পরিচয়েও মানুষকে কাছে টানার এই অনন্য গুণটি তাঁর স্বভাবজাত ক্ষমতা ছিল। বহুদিন বন্ধু সুমী বাসায় আড্ডা মারতে মারতে দেখেছি একটি সভা থেকে ফিরে দুটো নাকেমুখে গুঁজেই তিনি ফের বেরিয়ে পড়ছেন পরবর্তী সভায় অংশ নেবার জন্য। মাঝের ওইটুকু সামান্য সময়, তারই মাঝে তিনি আমার সাথে কথা বলছেন, মাথায় হাত রাখছেন। তাঁর সেই স্নেহের কাছে আমি চিরঋণী।

কবিতামুখর যাপনে এই কবি আবহমান বাংলা কবিতাকে দিয়ে গেছেন অসংখ্য কবিতা। তাঁর কিছু কবিতা এবং গান মানুষের মুখে মুখে ফিরেছে। কবির দুটি কবিতা পাঠ করা যাক।

সেই উঠোন

উঠোনটাকে পেরিয়ে গিয়ে পথ

পথের শেষে অন্ধকারের রূপ

বৃক্ষরাজির গভীর ঘন ছুঁয়ে

তোমার আলো কালো কাটার পথ।

অন্য আদেশ অন্য সময় মেনে

রাতদুপুরে সুখের সীমা টানি

আনন্দ বেশ জড়িয়ে নেব নিজে

তোমার কোনো ক্ষতির কারণ, নয়।

শত্রুপাখি গাছের ডালে থাকে

তার নিধনে আমরা ডাকি তাকে

হায় না জেনে, আড়াল যারে করি

তার বাঁধনে নিজের ভাগ্য গড়ি।

আবার আসি সেই উঠোনে আমি

তোমার দুহাত জড়িয়ে ধরে থাকি

বৃক্ষরাজির গুল্মলতার মতো

আলোর নাগাল উঠোন ভরে রাখি।

সোনালু

সোনালু একটি ঘরের নাম।

একটি ওয়াশরুম। একটি ডবল খাট

আর একটি সিঙ্গেল খাট।

ছোট সাইড টেবিল- তাতে একটি জগ- মামের বোতল

একটি-দুটি গ্লাস, সবটাই জল-পূর্ণ।

মৌলভীবাজার সার্কিট হাউস থেকে ওটা দেখা যায়।

ঘরটায় দিন-রাত নেই- সারাক্ষণ অন্ধকার।

সুইচ আছে- বাল্ব নেই। ফ্যান ঘোরে সারাক্ষণ।

কে বা কারা সেই ঘরে থাকে আমি জানিনে।

একদিন আমিও ছিলাম।

টিনের চালে ঝমঝমাঝম বৃষ্টি-নূপুর।

ঘরের ভেতর শব্দ-নূপুর- ওর নাম সোনালু।

ওকে চেনা যায় না, অন্ধকারে সেঁটে থাকে ওর রং-

রাতের কালো রঙের মতো গভীর নিবিড়।

সারাক্ষণ সোনালুর নিয়ন্ত্রণে ছিলাম আমি।

আমার সকল সুখ ওর নিবেদনে ছিল।

ভরাট যমুনার গান দিয়ে ও আমায় ভরিয়েছিল

অথচ আমি ওর আলাদা কিছু টের পাইনি।

সম্বিত ফিরলেই বুঝলাম...

আসলে সোনালু ছিল অস্বাভাবিক

পাগলের জড়াজড়ি।

জলজ প্রাণী- জগভরা জলের মতো তৃপ্তিদায়ক।

সরল ভাষায় হৃদয়ের গভীর অনুভূতিকে এভাবে ক’জন প্রকাশ করতে পারেন! ব্যথায়, প্রেমে, দ্রোহে, প্রতিবাদে শব্দের উচ্চকিত ব্যবহার নয়, অহেতুক আড়ম্বর নয় বরং হৃদয়ের সরলতম ভাষায় তিনি লিখে গেছেন ভনিতাবিহীন কবিতা। বাংলাদেশের কবিতা অঙ্গনে প্রাণসঞ্চারী এই মানুষটি গত বছর চিরতরে হারিয়ে গেছেন। তাঁর সেই শূন্যতা অপূরণীয় একথা যেমন ঠিক তেমনই বলব, সময়ের নানা অভিঘাতের পরও যতদিন বাংলা কবিতা বেঁচে থাকবে, সন্দেহাতীতভাবে কবি কাজী রোজী তাঁর কবিতা এবং সমস্ত কর্মকা-ের ভেতর দিয়েই বেঁচে আছেন, থাকবেন।

back to top