alt

সাময়িকী

স্পেনের গৃহযুদ্ধের আট দশক এবং লোরকার অস্থি

অংকুর সাহা

: বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)

“বুঝতে পারলাম আমাকে খুন করা হয়েছে।
কাফে, কবরখানা ও গির্জের ভেতর
ওরা খুঁজে বেড়াল, ওরা খুলে দেখল
কাঠের পিপে আর সিন্দুক,
সোনার দাঁত খুলে নেওয়ার জন্য ওরা
তিন তিনটে কংকাল চুরি করল
তবু ওরা আমায় খুঁজে পেল না।
ওরা আমায় খুঁজে পেল না?
না, ওরা আমায় খুঁজে পেল না।”
-ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)
[বাংলা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত]

১. স্পেনের গৃহযুদ্ধ
স্পেনের গৃহযুদ্ধ সে দেশের ইতিহাসে একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে এবং চলেছিল প্রায় তিন বছর ১৭ জুলাই ১৯৩৬ থেকে ১ এপ্রিল ১৯৩৯।

যুদ্ধের শেষে চালু হয় স্পেনের ইতিহাসের এক কলংকিত অধ্যায়- ফ্যাসিবাদী জেনারেল ফ্রানসিস্কো ফ্রাংকোর (১৮১২-১৯৭৫) সাড়ে তিন দশকের একনায়কতান্ত্রিক অপশাসন।

ঊনবিশংশ শতকের প্রথম থেকেই স্পেনে রাজতন্ত্রের কড়া শাসন- ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের সক্রিয় সমর্থনে। ঈশ্বর, দেশ ও রাজা- সে দেশের শাসন ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভ। অভিজাত, জোতদার এবং ধর্মপ্রচারকদের কবলে দেশের সব কৃষিজমি। আর লক্ষ লক্ষ সাধারণ পরিবার তাদের ভূমিদাস চাষি। মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ ঘটে এবং কঠোর হাতে দমন করা হয় তাদের- রক্তাক্ত ও নির্মম। ১৮৭৩ সালে গঠিত হয়েছিল বিদ্রোহী সরকার, কিন্তু তার পতন ঘটে অল্পদিনের মধ্যে। ১৮৮৭ সালে স্পেনের সিংহাসনে বসেন সম্রাট ত্রয়োদশ আলফোন্সো- তিনি রাজত্ব করেন ১৯৩০ সাল অব্দি। কিন্তু ১৯২৩ সাল নাগাদ প্রকৃত শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় সামরিক একনায়ক মিশেল প্রিমো দি রিডেরার হাতে।

রাজতন্ত্রের পাশাপাশি ইউরোপে চলেছে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের আন্দোলন। তার প্রথম সফলতা ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার জারতন্ত্রের অপসারণে এবং বলশেভিকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে। লেনিনের নেতৃত্বে সমাজবাদী সরকার গঠন এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধে তাদের জয়ের পর ইউরোপের অন্যান্য দেশের শ্রমিক-কৃষকরাও তাঁদের দেশে সমাজতন্ত্রী সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন ও অন্যান্য দেশে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংগঠন জোরদার হয় এবং জনপ্রিয়তা বাড়ে। রাশিয়ার মতো সশস্ত্র বিপ্লবে সফল না হলেও তাঁরা শ্রমিক-কৃষকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিদার দাবিতে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। স্পেনে বামপন্থি ও সমাজবাদী দলগুলোকে বলা হতো রিপাবলিকান।

১১৩০ সালে রিভেরার একনায়কতন্ত্রী সামরিক সরকারের পতন ঘটলে বামপন্থি ও মধ্যপন্থি দলগুলো নির্বাচনে জিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এই সরকারটিকে বলা হয় স্পেনের দ্বিতীয় রিপাবলিক। এই প্রথম স্পেনের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন করলেন। নতুন সরকার ভূমিসংস্কারের কাজে এবং দেশের শাসনক্ষমতায় সামরিক বাহিনী ও ধর্মযাজকদের প্রভাব খর্ব করার কাজে লাগালেন।

এইভাবে সংঘাতের সূচনা। ধর্মগুরু পোপ একাদশ পায়াস (১৮৭৬-১৯৫৮) তীব্র নিন্দা করলেন রিপাবলিকান সরকারের। দক্ষিণপন্থি, রক্ষণশীল, রাজতন্ত্রের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো সমবেত হলেন সরকারের বিরোধিতায়, তাঁদের নাম হল জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট কোয়ালিশন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীর বেশ কিছু অসন্তুষ্ট সদস্য এবং ক্যাথলিক ধর্মযাজক। সেনাবাহিনীর দক্ষিণপন্থি জেনারেলরা প্রকাশ্যেই সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। তাদের নেতৃত্বে এক গোঁড়া রক্ষণশীল জেনারেল ফ্রানসিসকো ফ্রাংকো। বাহামোন্দে (১৮১২-১৯৭৫)। তিনি স্পেনীয় জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুললেন। তার সঙ্গে মেশালেন ক্যাথলিক ধর্ম, কমিউনিস্ট বিরোধিতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। তার কর্তব্য দেশের সনাতন ঐতিহ্য অর্থাৎ জমিদারের হাতে কৃষক নির্যাতন বজায় রাখা।

১৯৩৬ সাল নাগাদ পুরো দেশটি ভাগ হয়ে যেতে লাগল রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী ঘাঁটিতে। পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হল ১৭ জুলাই ১৯৩৬।

পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে নামকরা লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছিলেন এই যুদ্ধে- সৈন্য এবং সাংবাদিক হিসেবে; আমেরিকা থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১), ব্রিটেন থেকে জর্জ অরওয়েলসহ (১৯০৩-১৯৫০) অনেকে। তাদের সহানুভূতি ছিল রিপাবলিকানদের পক্ষে। শিল্পী ও সাহিত্যিকরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এই যুদ্ধ থেকে।

১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল জাতীয়তাবাদীদের বিমানবাহিনী নির্বিচারে বোমাবর্ষণে ধ্বংস করে গ্যের্নিকা (Guernica) শহরটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় ১৬৫৪ জন অসামরিক নাগরিকের। তার প্রতিবাদে পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩) তাঁর বিখ্যাত ‘গ্যের্নিকা’ প্রাচীরচিত্রটি আঁকেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদর দালি (১৯০৪-১৯৮৯) তাঁর ‘গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস’ ছবিটি আঁকেন ১৯৩৬ সালে- সংবাদপত্রের সংবাদিক হিসেবে এবং রিপাবলিকান মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে চিলির দূতাবাসে উচ্চপদে কাজ করতেন কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩); স্পেনের গৃহযুদ্ধ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় বামপন্থা দৃঢ় হয় এবং সমাজতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস আজীবন অটুট থাকে। স্পেন থেকে পলাতক ২০০ রিফিউজিকে ফ্রান্সের রিলিফ ক্যাম্প থেকে চিলিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কুবার কবি নিকোলাস গ্যিয়েনও (১৯০২-১১৮১) স্পেনে উপস্থিত ছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় সাংবাদিক হিসেবে।

এই যুদ্ধে রিপাবলিকানদের পরাজয় বামপন্থা, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপজুড়ে তখন ফ্যাসিবাদের জয়জয়কার। অনেকদিন আগেই (১৯২২ সালে) ইতালিতে ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫); তাঁর জার্মান সংস্করণ নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫), তাঁর দেশে ১৯৩৩ সালে। দুজনই প্রবলভাবে যুদ্ধ শুরু করলেন ফ্রাংকোর পক্ষ নিয়ে এক হাজার ৯০০ জার্মান সৈন্য এবং ৭৫ হাজার ইতালীয় সৈন্য যুদ্ধ করেছিল জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে। তার সঙ্গে দুদেশের ট্যাংক, কামান ও বোমারু বিমান। রিপাবলিকানদের সাহায্য করেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া এবং মেহিকো; তিন হাজার মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী গঠন করেছিলেন আব্রাহাম লিংকন ব্রিগেড এবং স্পেনে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন রিপাবলিকানদের পক্ষে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিহত হন। যাঁরা জীবিত দেশে ফেরেন তাদের অনেকের বিচার হয় কমিউনিস্ট অভিযোগে। মার্কিন সেনাবাহিনীতে তাদের যোগদানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সমর্থনে গান লিখেছিলেন পল রবসন (১৮১৮-১৯৭৬)।

প্রায় তিন বছরব্যাপী এই যুদ্ধে পাঁচ থেকে দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে এক লক্ষ ১০ হাজার রিপাবলিকান সৈন্য। অসংখ্য লোকের মৃত্যু ফ্রাংকোর সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার শিকার হয়েছিল অসামরিক পুরুষ-নারী ও শিশু; তাদের সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। তবে এই শ্বেতসন্ত্রাসের আনুমানিক বলি ২ লাখের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে একজন হলেন স্পেনের বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)। প্রায় পাঁচ লক্ষ রিফিউজি পালিয়ে যান ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশে।

স্পেনের রিপাবলিকানদের লক্ষ্য ছিল হিটলার, মুসোলিনি ও ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে ইউরোপে ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তোলা। তাহলে হয়ত এড়ানো যেত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্স তখন হিটলার তোষণে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো রিপাবলিকানদের কোনোরকম সাহায্য না করার জন্য ফ্রাংকোর জয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।

১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পী-সাহিত্যেকরা অনেকেই দেশ ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু লোরকার আপত্তি স্বেচ্ছানির্বাসনে; তিনি কবি, তাঁর কোনো শত্রু নেই। রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষের সমর্থনকারী কবি নাট্যকাররা তাঁর বন্ধু। সুতরাং তাঁর কোনো ক্ষতি কেউ করবে না

১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে বার্সেলোনার পতন ঘটে; তার কয়েক হপ্তার ভেতর পুরো কতোলোনিয়া প্রদেশটিই ফ্রাংকোর দখলে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ফ্রাংকো সরকারকে। রিপাবলিকানদের দখল সংকুচিত হতে হতে কেবল মাদ্রিদ শহর ও তার চারপাশে সীমাবদ্ধ হয়। মার্চের শেষে মাদ্রিদের পতন এবং দেশজুড়ে নির্বিচার গণহত্যা শুরু হয়। ১ এপ্রিল রিপাবলিকানদের আত্মসমর্পণে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আর তার ছয় মাসের মধ্যে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৫)
আর্হেন্তিনার সুসাহিত্যিক হর্হে লুইস বর্হেসের (১৮৯৯-১৯৮৬) অখ্যাতি রয়েছে দুর্মুখ হিসেবে।

১৯৬০-এর দশকে তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল লোরকার কবিতা বিষয়ে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, লোরকা ভাগ্যবান। কারণ অল্প বয়সেই খুন করা হয়েছিল তাঁকে। সুভদ্রজনোচিত না হলেও বর্হেসের এই মন্তব্য সুপ্রযুক্ত এবং সত্য। লোরকার অকালমৃত্যু আদতে তাঁর কবিখ্যাতির অঙ্গ এবং অনেক লোককাহিনি গড়ে উঠেছে তাঁর হত্যাকে ঘিরে।

পরবর্তী সত্তর বছরে অনেক নতুন শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু তিনি। তাঁকে ঘিরে কবিতা লিখেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ (১৯২৬-১৯৭৫) এবং পৃথিবীর কোণে কোণে আরও অনেকে। কবিতা ছাড়াও গান, নাটক, চলচ্চিত্র রচিত হয়েছে তাঁর বিষয়ে; গান গেয়েছেন জোন বায়াজ (১৯৪১) এবং লেনার্ড কোহেলের (১৯৩৪) মতো মহীরূহ শিল্পীরা। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় কবির জীবনী অবলম্বনে খুবই কম; কিন্তু লোরকা বিষয়ে হয়েছে বেশ কয়েকটি। এমনকী একটি স্পেনীয় চলচ্চিত্রে তিনি অলৌকিকভাবে মৃত্যুকে এড়িয়ে প্রাণে বাঁচেন এবং চিত্রনাট্য রচয়িতার কল্পনায় গঠিত হয় তাঁর বাকি জীবন।

লোরকার জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ জুন স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশের ফুয়েন্তো ভাকেরোস গ্রামে; কাছাকাছি বড় শহর গ্রানাডা। বাবা বর্ধিষ্ণু কৃষক, প্রচুর জমিজমা, বাগান দিয়ে ঘেরা সুদৃশ্য ভিলা। মামাবাড়িও ধনী, মা লেখাপড়া শিখেছিলেন, স্কুলে পড়াতেন। তিনিই বড় ছেলে, তাঁর পর আরও দু’বোন এবং একভাই। ছোটবেলায় প্রায়ই রোগে ভুগতেন এবং হাঁটতেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, বালক বয়সে ছিলেন ঘরকুনো ও কল্পনাপ্রবণ। তাঁর যখন দশ বছর বয়স, পরিবারটি উঠে আসে গ্রানাডা শহরে; সেখানে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি কলেজে যান আইন পড়তে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগেও নামে লেখান। কিন্তু কোনো শিক্ষাই সমাপ্ত করেননি এই অস্থিরমতি ছাত্র।

১৯১৬ সালে বেড়াতে গেলেন আন্দালুসিয়ার বিভিন্ন শহরে এবং আলাপ হল কবি, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। ১৯১৮ সালে প্রথম গদ্যগ্রন্থ সংবেদন ও নিসর্গচিত্র (Impresiones Y Paisajes) সেই ভ্রমণের স্মৃতি।

১৯২১ সালে প্রথম কবিতার বই ‘কাব্যগ্রন্থ’ (Libro de Poemas); পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে সালভাদর দালি, রাফায়েল আলবের্তি (১৯০২-১৯৯৯), লুই বুনুয়েল (১৯০০-১৯৮৩) এবং পেডো সেলিনাসের (১৮৯১-১৯৫১) সঙ্গে। পরের বছরগুলো কবিতা ও নাটক রচনায় মুখর সেই সঙ্গে লেখক হিসেবে খ্যাতি। ১৯২৫ সালে নাটক ‘মারিয়ানো পিনেদা’; ১৯২৭ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘সংগীত’ (canciones) ১৯২৮ সালে, খুব সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘জিপসি গাথা’ (Romancero Gitano)।

১৯২৯ সালে লোরকা তাঁর প্রাক্তন শিক্ষক ফার্নান্দো দে লম রিয়সের ১৮১৯-১৯৪৯) সঙ্গে ন্যু ইয়র্কে যান। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ছাত্র হিসেবে নাম লেখান। কিন্তু দেশ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনোটাই তাঁর পছন্দ হয়নি। এক বছর ছিলেন সেখানে। সেই সময়ে রচিত কবিতাগুলো সংকলিত হয় ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ (Poeta en Nueva York) কাব্যগ্রন্থে। পরের বছর কুবায় যান এবং বিশ্ববিখ্যাত দুয়েন্দে (Duende) বক্তৃতা দেন। পরে তিনি আর্হেন্তিনা এবং স্পেনে ওই একই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শিল্পের সঙ্গে মৃত্যুভাবনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং মাটির প্রতি অনুরাগ ছিল তার বিষয়বস্তু।

‘নিউ ইয়র্কে কবি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৪০ সালে। তার অব্যবহিত পরেই ইংরেজি অনুবাদে বন্দিত হয় বিশ্বময়। ১৯৩০ পড়ার মুখে সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রিপাবলিকান সরকার। যদিও তিনি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, প্রগতিশীল শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী বলে সমর্থন পেলেন সরকারের। ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন নাটক রচনা ও পরিচালনার কাজে। তার জনপ্রিয়তম নাটকগুলির রচনা এই সময় তিনটি নাটককে একসঙ্গে নাম দেওয়া হয় ‘গ্রাম্য ট্রিলজি’; প্রথমে ‘রক্তাক্ত বিবাহ’ (Bodas de sangre) রচনা ১৯৩২, প্রযোজনা ১৯৩৩; তারপর ‘ইয়েরমা’ (Yerma); রচনা ১৯৩৪, প্রযোজনা ১৯৩৪; সবশেষে ‘আইবুড়ো দনিয়া রোসিতা’ (Dona Rosita la soltera); রচনা ১৯৩৫, প্রযোজনা ১৯৩৫।

১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পী-সাহিত্যেকরা অনেকেই দেশ ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু লোরকার আপত্তি স্বেচ্ছানির্বাসনে; তিনি কবি, তাঁর কোনো শত্রু নেই। রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষের সমর্থনকারী কবি নাট্যকাররা তাঁর বন্ধু। সুতরাং তাঁর কোনো ক্ষতি কেউ করবে না। তিনি তার কাজকর্ম চালিয়ে গেলেন আগের মতোই। নাটক লিখে চললেন ‘নামহীন নাট্য’ (comedia sin Titulo) রচনা ১৯৩৬, প্রযোজনা ১৯৩৬; এবং ‘বার্নার্দা আলবার ঘরবাড়ি’ (La casa de Bernarda Alba) রচনা ১০৩৬; তাঁর জীবৎকালে মঞ্চস্থ হয়নি। কবিতার বই ‘কালো প্রেমের সনেটগুচ্ছ’ (Sonetos del amor oscuro) প্রকাশ ১৯৩৬, অনেক সমালোচকের মতে সমকামী প্রেমের কবিতা; এবং ‘প্রথম সংগীত’ (Primeras canciones) প্রকাশ ১৯৩৬।

১৮ আগস্ট ১৯৩৬ যুদ্ধ বেধে গেল গ্রানাদা শহরে। কবির জামাইবাবু গ্রানাদার মেয়র রিপাবলিকান ও সমাজবাদী- তাকে গুলি করে মারল ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী হানাদার বাহিনী। লোরকা গ্রেফতার হলেন। পরের দিন আরও তিনজন বন্দির সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ভিসনার এবং আলফাকার শহরের মাঝামাঝি হাইওয়ের পাশে ফুয়েন্তে গ্রান্দের (যার অপর নাম অশুর ঝর্না) এক পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিতে তাঁর মৃত্যু। গণকবরে অতি অবহেলায় পুঁতে ফেলা হল স্পেন ও স্পেনীয় ভাষার এক মহান কবিকে।

সাত দশক পরের কাহিনি
১৯৩৯ সালে সেই যে পুরো স্পেন দেশটি ফ্রাংকোর কবলে এসে গেল, তারপর চলল অকথ্য স্বৈরাচার ১৯৭৫ সালে ফ্রাংকোর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ সালের ভেতর চার লক্ষের বেশি নাগরিককে বন্দি রাখা হয় কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া হয় রিপাবলিকানদের কথা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে, অনেকদিন আগে স্পেন শাসন করত কিছু খারাপ লোক। তখন রোজ রাস্তাঘাটে গোলাগুলি চলত আর পোড়ানো হত গির্জা। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে মহানুভব ফ্রাংকো তাদের যুদ্ধে পরাস্ত করে দেশে শান্তি ও সুশাসন চালু করেন।

ফ্রাংকোর ৩৬ বছরের রাজত্বকালে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন পাঁচ লক্ষের বেশি নাগরিক। ফ্রাংকোর তথাকথিত কমিউনিস্টবিরোধিতার জন্য তাঁকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমের দেশগুলো।

ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর স্পেনে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার, কিন্তু তাঁরাও অতীতের স্বৈরাচারের কোনোরকম তদন্ত বা প্রতিকার করতে অনিচ্ছুক। তাঁরা কেবল ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চান, পুরনো কলংকের কথা নয়।

১৯৭৭ সালে স্পেনের পার্লামেন্টে ‘সর্বজনীন মার্জনা’ আইন পাস করা হয়, যার অন্য নাম ‘বিস্মৃতির চুক্তিপত্র’ (pacto de olvido) অর্থাৎ ফ্রাংকোর অপরাধী সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এভাবেই চলে প্রায় দুই দশক।

১৯৯০ দশকের দ্বিতীয়ভাগে নিহত রিপাবলিকান, কমিউনিস্ট, সমাজবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের বংশধরেরা জোট বাঁধতে শুরু করেন ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি’ নাম দিয়ে এবং শুরু করেন আন্দোলন।

১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্পেনের রাষ্ট্রপতি ছিলেন রক্ষশীল হোসে মারিয়া আসনার (১৯৫৩), তিনি কোনোরকম প্রতিবাদ কানেই তোলেননি। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি প্রগতিশীল হোসে লুইস বড়রিনোস সাদ্যতেরো (১৯৬০-); তার শাসনকালে সফলতা পায় এই আন্দোলন। ২০০৭ সালে ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি আইন’ পাস হল পার্লামেন্টে। তার ফলে স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং ফ্রাংকোর অত্যাচারী শাসন বিষয়ে আলোচনা, গবেষণা ও তর্কবিতর্কের সূচনা। হাজার গণকবর ছড়িয়ে রয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেগুলো আবার খুঁড়ে মৃতদেহগুলো শনাক্তকরণের পথে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকল না। আর যে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী মানুষ ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বে- লাতিন আমেরিকায় দশ লক্ষেরও বেশি, কুবায় দুলক্ষ, ইউরোপেও কয়েক লক্ষ, তাঁদের আবার মঞ্জুর করা হল স্পেনের নাগরিকত্ব।

ফ্রাংকোর শাসনকালের প্রথম দেড় দশক স্পেনে লোরকার রচনার প্রকাশ ও পাঠ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৯৫৩ সালে আংশিকভাবে হলেও তা শিথিল করা হয়। সে বছরই লোরকার অনুরাগীরা প্রকাশ করেন অসম্পূর্ণ এবং সেনসর করা তাঁর ‘ওব্রাস কমপ্লিতাস’ (রচনা সমগ্র); বাদ পড়ে গভীর প্রেমের সনেটগুচ্ছ এবং আরও অনেক কবিতা। সেই গ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয় ১৯৮৩-৮৪ বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া পা-ুলিপির খসড়া থেকে। মূল ও সম্পূর্ণ পা-ুলিপি হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো। লোরকার সঙ্গে সঙ্গে খুন করা হয় আরও তিনজনকে- দুজন বুলফাইটার এবং একজন শিক্ষক। সকলকে কবর দেওয়া হয় একসঙ্গে। খুন করার আগে কবির সমকামিতা নিয়ে অকথ্য খিস্তি করেছিল খুনিরা। সেই বধ্যস্থলে এখনও তীর্থদর্শনে যান কবিতাপ্রেমীরা, রেখে আসেন কবির প্রিয় লাল গোলাপ। দেয়ালের গায়ে বুলেটের দাগ রয়েছে অসংখ্য, বন্দিদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রিভলবার দিয়ে গুলি করা হয়েছিল মাথার খুলিতে।

২০০৮ সালে দেয়ালে একটি ছোট ফলক বসে “To the victims of francoism who were shot at this wall”। এছাড়া আগে বোঝার উপায় ছিল না কত নাটকীয় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল সেখানে। কিন্তু রাতের গভীরে ফ্রাংকোবাদী দুর্বৃত্তরা খুলে নিয়ে যায় সেই ফলকটি। আর সামান্য দূরে বড় রাস্তার ধারে সেই গণকবর, যেখানে লোরকা চিরশায়িত বলে অনেকের ধারণা।

১৯৬৬ সালে ইয়ান গিবসন নামে আয়ারল্যান্ডের এক ঐতিহাসিক লোরকার প্রামাণ্য জীবনী লেখেন, তাতে তিনি কবরটির ঠিকানা দেন। কবরটির প্রামাণ্যতা নির্ণয় করার জন্য তদন্তের দাবি কিন্তু লোরকা পরিবারের পক্ষ থেকে আসেনি; এসেছিল ফ্রানসিসকো গারাদির কাছ থেকে, যাঁর বুলফাইটার পিতামহ খুন হয়েছিলেন লোরকার সঙ্গে। ফ্রানসিসকোর পিতা তাঁর মৃত্যুশয্যায় পুত্রকে দিয়ে শপথ করান যে, তিনি পিতামহের অস্থি উদ্ধার করবেন এবং সম্মানের সঙ্গে সমাধি দেবেন আবার।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি শেষঅব্দি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। বিচারক বালতাসার গারসোঁ আদেশ দেন, কবর খুঁড়ে অস্থি উদ্ধারের। এর ফলে স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নীরবতা ভাঙে। যুদ্ধ শেষ হবার সত্তর বছর পর শেষপর্যন্ত শুরু হতে থাকে আলোচনা ও বিতর্ক।

কিন্তু আপত্তি আসে লোরকা পরিবারের পক্ষ থেকে- তাঁর নেতৃত্বে কবির ভাইঝি লরা গার্সিয়া লোরকা, যিনি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর, তিনি বলেন, “We don’t want this to become a spectacle. But it is very difficult to imagine that the bones and skull of Federico Garcia Lorca will not end up on YouTube.”

শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছে
২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে কবর খুঁড়ে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথমে জায়গাটি ঘিরে ২০০ বর্গমিটার এলাকা কর্তন করে রাখে পুলিশ; কাজের তত্ত্বাবধান করেন গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা; লোরকা পরিবারের অনুরোধে কারও অনুমতি ছিল না ক্যামেরা অথবা সেলফোন সঙ্গে নিয়ে যাবার। অস্থিগুলো সন্তর্পণে রক্ষিত আছে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘসময় ধরে চলেছে তার তদন্ত এবং বিশ্লেষণ। অন্য তিনজন মৃতের পরিবারও তাঁদের ডিএনএ’র নমুনা দাখিল করেছেন। শেষপর্যন্ত লোরকা পরিবারও রাজি হল। কিন্তু সন্দেহ থেকেই গেল অস্থিগুলোর পরিচয় নিয়ে।

স্থানীয় ঐতিহাসিক মিশেল কাবাইয়েরো পেরেস কিন্তু হাল ছাড়েননি। বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে পুলিশ ও মিলিটারি অভিলেখাগারে দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি এসপানিওল ভাষায়- “গার্সিয়া লোরকার জীবনের অন্তিম তেরো ঘণ্টা” নামে একটি বই লেখেন। তিনি সেই দিনের ফায়ারিং স্কোয়াডের বন্দুকধারীদেরও কয়েক জনকে শনাক্ত করে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পেরেসের গবেষণা অনুযায়ী আগের স্থান থেকে আধমাইল দূরে অবস্থিত গণকবরে লোরকা সমাহিত। তাঁর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। কিন্তু তার আগেই স্পেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন রক্ষণশীল মারিয়ানো রাহয় ব্রেই (১৯৫৫-); তাঁর প্রথম কাজই হয় এই অনুসন্ধান কর্মের সমস্ত সরকারি অনুদান বাতিল করে দেওয়া।

তারপর থেকে এই কর্মযজ্ঞ চলছে সরকারি সাহায্য ছাড়াই, সাধারণ মানুষের থেকে চাঁদা তুলে এবং নানান লোকহিতকর সংস্থার অর্থসাহায্যে।

নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে। প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা হাভিয়ের নাভারোর দৃঢ় বিশ্বাস, এই স্থানটিই লোরকার প্রকৃত সমাধি। তিনি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের সাংবাদিককে জানিয়েছেন, “Everything we have done to date confirms that this is the spot we have been looking for.”

অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন, কোনোদিন সঠিক সত্য জানা যাবে কি না। আশা রাখি খুব শিগগির সমাধান হবে এই রহস্যের এবং জাতীয় সম্মানসহ পুনর্সমাহিত করা হবে এই মহান কবিকে। কিন্তু লোরকা পরিবারের ভয় পুরো ব্যাপারটি যেন প্রহসনে পর্যবসিত না হয়।

“যখন আমি মরে যাব
আমার গীটারসমেত আমায় কবর দিও
বালির তলায়।
যখন আমি মরে যাব
কমলালেবুর গাছ
আর পুদিনাঝাড়ের মাঝখানে।
যখন আমি মরে যাব
ইচ্ছে হলে আমায় কবর দিও
একটা হাওয়াকলের ভেতর।
যখন আমি মরে যাব।

(শেষ ইচ্ছে/ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা অনুবাদ : পুষ্কর দাশগুপ্ত)

[কবিতার উদ্ধৃতিগুলো কবি পুষ্কর দাশগুপ্তের অনুমতি নিয়ে এখানে সংকলিত হয়েছে। অনুমতির জন্য লেখক কৃতজ্ঞ।]

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

tab

সাময়িকী

স্পেনের গৃহযুদ্ধের আট দশক এবং লোরকার অস্থি

অংকুর সাহা

ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)

বৃহস্পতিবার, ০৪ মে ২০২৩

“বুঝতে পারলাম আমাকে খুন করা হয়েছে।
কাফে, কবরখানা ও গির্জের ভেতর
ওরা খুঁজে বেড়াল, ওরা খুলে দেখল
কাঠের পিপে আর সিন্দুক,
সোনার দাঁত খুলে নেওয়ার জন্য ওরা
তিন তিনটে কংকাল চুরি করল
তবু ওরা আমায় খুঁজে পেল না।
ওরা আমায় খুঁজে পেল না?
না, ওরা আমায় খুঁজে পেল না।”
-ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)
[বাংলা অনুবাদ: পুষ্কর দাশগুপ্ত]

১. স্পেনের গৃহযুদ্ধ
স্পেনের গৃহযুদ্ধ সে দেশের ইতিহাসে একটি রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। ঘটনাটি ঘটেছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক আগে এবং চলেছিল প্রায় তিন বছর ১৭ জুলাই ১৯৩৬ থেকে ১ এপ্রিল ১৯৩৯।

যুদ্ধের শেষে চালু হয় স্পেনের ইতিহাসের এক কলংকিত অধ্যায়- ফ্যাসিবাদী জেনারেল ফ্রানসিস্কো ফ্রাংকোর (১৮১২-১৯৭৫) সাড়ে তিন দশকের একনায়কতান্ত্রিক অপশাসন।

ঊনবিশংশ শতকের প্রথম থেকেই স্পেনে রাজতন্ত্রের কড়া শাসন- ক্যাথলিক ধর্মগুরু পোপের সক্রিয় সমর্থনে। ঈশ্বর, দেশ ও রাজা- সে দেশের শাসন ব্যবস্থার তিনটি স্তম্ভ। অভিজাত, জোতদার এবং ধর্মপ্রচারকদের কবলে দেশের সব কৃষিজমি। আর লক্ষ লক্ষ সাধারণ পরিবার তাদের ভূমিদাস চাষি। মাঝেমধ্যে বিদ্রোহ ঘটে এবং কঠোর হাতে দমন করা হয় তাদের- রক্তাক্ত ও নির্মম। ১৮৭৩ সালে গঠিত হয়েছিল বিদ্রোহী সরকার, কিন্তু তার পতন ঘটে অল্পদিনের মধ্যে। ১৮৮৭ সালে স্পেনের সিংহাসনে বসেন সম্রাট ত্রয়োদশ আলফোন্সো- তিনি রাজত্ব করেন ১৯৩০ সাল অব্দি। কিন্তু ১৯২৩ সাল নাগাদ প্রকৃত শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয় সামরিক একনায়ক মিশেল প্রিমো দি রিডেরার হাতে।

রাজতন্ত্রের পাশাপাশি ইউরোপে চলেছে শ্রমিক, কৃষক ও মেহনতি মানুষের আন্দোলন। তার প্রথম সফলতা ১৯১৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার জারতন্ত্রের অপসারণে এবং বলশেভিকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলে। লেনিনের নেতৃত্বে সমাজবাদী সরকার গঠন এবং পরবর্তী গৃহযুদ্ধে তাদের জয়ের পর ইউরোপের অন্যান্য দেশের শ্রমিক-কৃষকরাও তাঁদের দেশে সমাজতন্ত্রী সরকার গড়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। ব্রিটেন, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, স্পেন ও অন্যান্য দেশে সোশাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সংগঠন জোরদার হয় এবং জনপ্রিয়তা বাড়ে। রাশিয়ার মতো সশস্ত্র বিপ্লবে সফল না হলেও তাঁরা শ্রমিক-কৃষকদের অধিকার ও সুযোগ-সুবিদার দাবিতে গণআন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। স্পেনে বামপন্থি ও সমাজবাদী দলগুলোকে বলা হতো রিপাবলিকান।

১১৩০ সালে রিভেরার একনায়কতন্ত্রী সামরিক সরকারের পতন ঘটলে বামপন্থি ও মধ্যপন্থি দলগুলো নির্বাচনে জিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে। রাজা ত্রয়োদশ আলফোনসো দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। এই সরকারটিকে বলা হয় স্পেনের দ্বিতীয় রিপাবলিক। এই প্রথম স্পেনের মানুষ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সরকার গঠন করলেন। নতুন সরকার ভূমিসংস্কারের কাজে এবং দেশের শাসনক্ষমতায় সামরিক বাহিনী ও ধর্মযাজকদের প্রভাব খর্ব করার কাজে লাগালেন।

এইভাবে সংঘাতের সূচনা। ধর্মগুরু পোপ একাদশ পায়াস (১৮৭৬-১৯৫৮) তীব্র নিন্দা করলেন রিপাবলিকান সরকারের। দক্ষিণপন্থি, রক্ষণশীল, রাজতন্ত্রের সমর্থক রাজনৈতিক দলগুলো সমবেত হলেন সরকারের বিরোধিতায়, তাঁদের নাম হল জাতীয়তাবাদী বা ন্যাশনালিস্ট কোয়ালিশন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিলেন সেনাবাহিনীর বেশ কিছু অসন্তুষ্ট সদস্য এবং ক্যাথলিক ধর্মযাজক। সেনাবাহিনীর দক্ষিণপন্থি জেনারেলরা প্রকাশ্যেই সামরিক অভ্যুত্থানের ষড়যন্ত্র করতে লাগলেন। তাদের নেতৃত্বে এক গোঁড়া রক্ষণশীল জেনারেল ফ্রানসিসকো ফ্রাংকো। বাহামোন্দে (১৮১২-১৯৭৫)। তিনি স্পেনীয় জাতীয়তাবাদের ধুয়ো তুললেন। তার সঙ্গে মেশালেন ক্যাথলিক ধর্ম, কমিউনিস্ট বিরোধিতা এবং দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা। তার কর্তব্য দেশের সনাতন ঐতিহ্য অর্থাৎ জমিদারের হাতে কৃষক নির্যাতন বজায় রাখা।

১৯৩৬ সাল নাগাদ পুরো দেশটি ভাগ হয়ে যেতে লাগল রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী ঘাঁটিতে। পুরোদমে যুদ্ধ শুরু হল ১৭ জুলাই ১৯৩৬।

পৃথিবীর বিভিন্ন অংশ থেকে নামকরা লেখক ও বুদ্ধিজীবীরা অংশ নিয়েছিলেন এই যুদ্ধে- সৈন্য এবং সাংবাদিক হিসেবে; আমেরিকা থেকে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (১৮৯৯-১৯৬১), ব্রিটেন থেকে জর্জ অরওয়েলসহ (১৯০৩-১৯৫০) অনেকে। তাদের সহানুভূতি ছিল রিপাবলিকানদের পক্ষে। শিল্পী ও সাহিত্যিকরা অনুপ্রেরণা পেয়েছেন এই যুদ্ধ থেকে।

১৯৩৭ সালের ২৬ এপ্রিল জাতীয়তাবাদীদের বিমানবাহিনী নির্বিচারে বোমাবর্ষণে ধ্বংস করে গ্যের্নিকা (Guernica) শহরটি কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মৃত্যু হয় ১৬৫৪ জন অসামরিক নাগরিকের। তার প্রতিবাদে পাবলো পিকাসো (১৮৮১-১৯৭৩) তাঁর বিখ্যাত ‘গ্যের্নিকা’ প্রাচীরচিত্রটি আঁকেন। সুররিয়ালিস্ট শিল্পী সালভাদর দালি (১৯০৪-১৯৮৯) তাঁর ‘গৃহযুদ্ধের পূর্বাভাস’ ছবিটি আঁকেন ১৯৩৬ সালে- সংবাদপত্রের সংবাদিক হিসেবে এবং রিপাবলিকান মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনে। স্পেনের মাদ্রিদ শহরে চিলির দূতাবাসে উচ্চপদে কাজ করতেন কবি পাবলো নেরুদা (১৯০৪-১৯৭৩); স্পেনের গৃহযুদ্ধ স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করে তাঁর রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় বামপন্থা দৃঢ় হয় এবং সমাজতন্ত্রে তাঁর বিশ্বাস আজীবন অটুট থাকে। স্পেন থেকে পলাতক ২০০ রিফিউজিকে ফ্রান্সের রিলিফ ক্যাম্প থেকে চিলিতে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন। কুবার কবি নিকোলাস গ্যিয়েনও (১৯০২-১১৮১) স্পেনে উপস্থিত ছিলেন গৃহযুদ্ধের সময় সাংবাদিক হিসেবে।

এই যুদ্ধে রিপাবলিকানদের পরাজয় বামপন্থা, সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের অগ্রগতির পথে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। ইউরোপজুড়ে তখন ফ্যাসিবাদের জয়জয়কার। অনেকদিন আগেই (১৯২২ সালে) ইতালিতে ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠা করেছেন বেনিতো মুসোলিনি (১৮৮৩-১৯৪৫); তাঁর জার্মান সংস্করণ নাৎসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছেন হিটলার (১৮৮৯-১৯৪৫), তাঁর দেশে ১৯৩৩ সালে। দুজনই প্রবলভাবে যুদ্ধ শুরু করলেন ফ্রাংকোর পক্ষ নিয়ে এক হাজার ৯০০ জার্মান সৈন্য এবং ৭৫ হাজার ইতালীয় সৈন্য যুদ্ধ করেছিল জাতীয়তাবাদীদের পক্ষে। তার সঙ্গে দুদেশের ট্যাংক, কামান ও বোমারু বিমান। রিপাবলিকানদের সাহায্য করেছিলেন সোভিয়েত রাশিয়া এবং মেহিকো; তিন হাজার মার্কিন স্বেচ্ছাসেবী গঠন করেছিলেন আব্রাহাম লিংকন ব্রিগেড এবং স্পেনে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলেন রিপাবলিকানদের পক্ষে। প্রায় এক-তৃতীয়াংশ নিহত হন। যাঁরা জীবিত দেশে ফেরেন তাদের অনেকের বিচার হয় কমিউনিস্ট অভিযোগে। মার্কিন সেনাবাহিনীতে তাদের যোগদানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সমর্থনে গান লিখেছিলেন পল রবসন (১৮১৮-১৯৭৬)।

প্রায় তিন বছরব্যাপী এই যুদ্ধে পাঁচ থেকে দশ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়। তার মধ্যে এক লক্ষ ১০ হাজার রিপাবলিকান সৈন্য। অসংখ্য লোকের মৃত্যু ফ্রাংকোর সেনাবাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার শিকার হয়েছিল অসামরিক পুরুষ-নারী ও শিশু; তাদের সঠিক সংখ্যা কেউ জানে না। তবে এই শ্বেতসন্ত্রাসের আনুমানিক বলি ২ লাখের বেশি মানুষ। তাদের মধ্যে একজন হলেন স্পেনের বিখ্যাত কবি ও নাট্যকার ফেদেরিকো গারসিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৬)। প্রায় পাঁচ লক্ষ রিফিউজি পালিয়ে যান ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশে।

স্পেনের রিপাবলিকানদের লক্ষ্য ছিল হিটলার, মুসোলিনি ও ফ্রাংকোর বিরুদ্ধে ইউরোপে ফ্যাসিবিরোধী ফ্রন্ট গড়ে তোলা। তাহলে হয়ত এড়ানো যেত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ। কিন্তু ব্রিটেন ও ফ্রান্স তখন হিটলার তোষণে ব্যস্ত। গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো রিপাবলিকানদের কোনোরকম সাহায্য না করার জন্য ফ্রাংকোর জয় অনিবার্য হয়ে পড়ে।

১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পী-সাহিত্যেকরা অনেকেই দেশ ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু লোরকার আপত্তি স্বেচ্ছানির্বাসনে; তিনি কবি, তাঁর কোনো শত্রু নেই। রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষের সমর্থনকারী কবি নাট্যকাররা তাঁর বন্ধু। সুতরাং তাঁর কোনো ক্ষতি কেউ করবে না

১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে বার্সেলোনার পতন ঘটে; তার কয়েক হপ্তার ভেতর পুরো কতোলোনিয়া প্রদেশটিই ফ্রাংকোর দখলে আসে। ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রিটেন ও ফ্রান্স রাজনৈতিক স্বীকৃতি দেয় ফ্রাংকো সরকারকে। রিপাবলিকানদের দখল সংকুচিত হতে হতে কেবল মাদ্রিদ শহর ও তার চারপাশে সীমাবদ্ধ হয়। মার্চের শেষে মাদ্রিদের পতন এবং দেশজুড়ে নির্বিচার গণহত্যা শুরু হয়। ১ এপ্রিল রিপাবলিকানদের আত্মসমর্পণে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। আর তার ছয় মাসের মধ্যে বেজে ওঠে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা।

ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা (১৮৯৮-১৯৩৫)
আর্হেন্তিনার সুসাহিত্যিক হর্হে লুইস বর্হেসের (১৮৯৯-১৯৮৬) অখ্যাতি রয়েছে দুর্মুখ হিসেবে।

১৯৬০-এর দশকে তাঁকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল লোরকার কবিতা বিষয়ে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, লোরকা ভাগ্যবান। কারণ অল্প বয়সেই খুন করা হয়েছিল তাঁকে। সুভদ্রজনোচিত না হলেও বর্হেসের এই মন্তব্য সুপ্রযুক্ত এবং সত্য। লোরকার অকালমৃত্যু আদতে তাঁর কবিখ্যাতির অঙ্গ এবং অনেক লোককাহিনি গড়ে উঠেছে তাঁর হত্যাকে ঘিরে।

পরবর্তী সত্তর বছরে অনেক নতুন শিল্প-সাহিত্যের বিষয়বস্তু তিনি। তাঁকে ঘিরে কবিতা লিখেছেন অ্যালেন গিনসবার্গ (১৯২৬-১৯৭৫) এবং পৃথিবীর কোণে কোণে আরও অনেকে। কবিতা ছাড়াও গান, নাটক, চলচ্চিত্র রচিত হয়েছে তাঁর বিষয়ে; গান গেয়েছেন জোন বায়াজ (১৯৪১) এবং লেনার্ড কোহেলের (১৯৩৪) মতো মহীরূহ শিল্পীরা। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয় কবির জীবনী অবলম্বনে খুবই কম; কিন্তু লোরকা বিষয়ে হয়েছে বেশ কয়েকটি। এমনকী একটি স্পেনীয় চলচ্চিত্রে তিনি অলৌকিকভাবে মৃত্যুকে এড়িয়ে প্রাণে বাঁচেন এবং চিত্রনাট্য রচয়িতার কল্পনায় গঠিত হয় তাঁর বাকি জীবন।

লোরকার জন্ম ১৮৯৮ সালের ৫ জুন স্পেনের আন্দালুসিয়া প্রদেশের ফুয়েন্তো ভাকেরোস গ্রামে; কাছাকাছি বড় শহর গ্রানাডা। বাবা বর্ধিষ্ণু কৃষক, প্রচুর জমিজমা, বাগান দিয়ে ঘেরা সুদৃশ্য ভিলা। মামাবাড়িও ধনী, মা লেখাপড়া শিখেছিলেন, স্কুলে পড়াতেন। তিনিই বড় ছেলে, তাঁর পর আরও দু’বোন এবং একভাই। ছোটবেলায় প্রায়ই রোগে ভুগতেন এবং হাঁটতেন খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, বালক বয়সে ছিলেন ঘরকুনো ও কল্পনাপ্রবণ। তাঁর যখন দশ বছর বয়স, পরিবারটি উঠে আসে গ্রানাডা শহরে; সেখানে স্কুলের পড়া শেষ করে তিনি কলেজে যান আইন পড়তে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগেও নামে লেখান। কিন্তু কোনো শিক্ষাই সমাপ্ত করেননি এই অস্থিরমতি ছাত্র।

১৯১৬ সালে বেড়াতে গেলেন আন্দালুসিয়ার বিভিন্ন শহরে এবং আলাপ হল কবি, লেখক, শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে। ১৯১৮ সালে প্রথম গদ্যগ্রন্থ সংবেদন ও নিসর্গচিত্র (Impresiones Y Paisajes) সেই ভ্রমণের স্মৃতি।

১৯২১ সালে প্রথম কবিতার বই ‘কাব্যগ্রন্থ’ (Libro de Poemas); পরিচয় ও বন্ধুত্ব ঘটে সালভাদর দালি, রাফায়েল আলবের্তি (১৯০২-১৯৯৯), লুই বুনুয়েল (১৯০০-১৯৮৩) এবং পেডো সেলিনাসের (১৮৯১-১৯৫১) সঙ্গে। পরের বছরগুলো কবিতা ও নাটক রচনায় মুখর সেই সঙ্গে লেখক হিসেবে খ্যাতি। ১৯২৫ সালে নাটক ‘মারিয়ানো পিনেদা’; ১৯২৭ সালে কাব্যগ্রন্থ ‘সংগীত’ (canciones) ১৯২৮ সালে, খুব সম্ভবত তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘জিপসি গাথা’ (Romancero Gitano)।

১৯২৯ সালে লোরকা তাঁর প্রাক্তন শিক্ষক ফার্নান্দো দে লম রিয়সের ১৮১৯-১৯৪৯) সঙ্গে ন্যু ইয়র্কে যান। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্য বিভাগে ছাত্র হিসেবে নাম লেখান। কিন্তু দেশ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোনোটাই তাঁর পছন্দ হয়নি। এক বছর ছিলেন সেখানে। সেই সময়ে রচিত কবিতাগুলো সংকলিত হয় ‘নিউ ইয়র্কে কবি’ (Poeta en Nueva York) কাব্যগ্রন্থে। পরের বছর কুবায় যান এবং বিশ্ববিখ্যাত দুয়েন্দে (Duende) বক্তৃতা দেন। পরে তিনি আর্হেন্তিনা এবং স্পেনে ওই একই বক্তৃতা দিয়েছিলেন। শিল্পের সঙ্গে মৃত্যুভাবনার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এবং মাটির প্রতি অনুরাগ ছিল তার বিষয়বস্তু।

‘নিউ ইয়র্কে কবি’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর পর, ১৯৪০ সালে। তার অব্যবহিত পরেই ইংরেজি অনুবাদে বন্দিত হয় বিশ্বময়। ১৯৩০ পড়ার মুখে সাধারণ মানুষের আশা আকাক্সক্ষাকে বাস্তব রূপ দিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে রিপাবলিকান সরকার। যদিও তিনি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক, প্রগতিশীল শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী বলে সমর্থন পেলেন সরকারের। ঝাঁপিয়ে পড়লেন নতুন নাটক রচনা ও পরিচালনার কাজে। তার জনপ্রিয়তম নাটকগুলির রচনা এই সময় তিনটি নাটককে একসঙ্গে নাম দেওয়া হয় ‘গ্রাম্য ট্রিলজি’; প্রথমে ‘রক্তাক্ত বিবাহ’ (Bodas de sangre) রচনা ১৯৩২, প্রযোজনা ১৯৩৩; তারপর ‘ইয়েরমা’ (Yerma); রচনা ১৯৩৪, প্রযোজনা ১৯৩৪; সবশেষে ‘আইবুড়ো দনিয়া রোসিতা’ (Dona Rosita la soltera); রচনা ১৯৩৫, প্রযোজনা ১৯৩৫।

১৯৩৬ সালে স্পেনের গৃহযুদ্ধ শুরু হলে শিল্পী-সাহিত্যেকরা অনেকেই দেশ ছাড়তে শুরু করেন। কিন্তু লোরকার আপত্তি স্বেচ্ছানির্বাসনে; তিনি কবি, তাঁর কোনো শত্রু নেই। রিপাবলিকান এবং জাতীয়তাবাদী উভয় পক্ষের সমর্থনকারী কবি নাট্যকাররা তাঁর বন্ধু। সুতরাং তাঁর কোনো ক্ষতি কেউ করবে না। তিনি তার কাজকর্ম চালিয়ে গেলেন আগের মতোই। নাটক লিখে চললেন ‘নামহীন নাট্য’ (comedia sin Titulo) রচনা ১৯৩৬, প্রযোজনা ১৯৩৬; এবং ‘বার্নার্দা আলবার ঘরবাড়ি’ (La casa de Bernarda Alba) রচনা ১০৩৬; তাঁর জীবৎকালে মঞ্চস্থ হয়নি। কবিতার বই ‘কালো প্রেমের সনেটগুচ্ছ’ (Sonetos del amor oscuro) প্রকাশ ১৯৩৬, অনেক সমালোচকের মতে সমকামী প্রেমের কবিতা; এবং ‘প্রথম সংগীত’ (Primeras canciones) প্রকাশ ১৯৩৬।

১৮ আগস্ট ১৯৩৬ যুদ্ধ বেধে গেল গ্রানাদা শহরে। কবির জামাইবাবু গ্রানাদার মেয়র রিপাবলিকান ও সমাজবাদী- তাকে গুলি করে মারল ফ্রাংকোর ফ্যাসিবাদী হানাদার বাহিনী। লোরকা গ্রেফতার হলেন। পরের দিন আরও তিনজন বন্দির সঙ্গে তাকে নিয়ে যাওয়া হল ভিসনার এবং আলফাকার শহরের মাঝামাঝি হাইওয়ের পাশে ফুয়েন্তে গ্রান্দের (যার অপর নাম অশুর ঝর্না) এক পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলিতে তাঁর মৃত্যু। গণকবরে অতি অবহেলায় পুঁতে ফেলা হল স্পেন ও স্পেনীয় ভাষার এক মহান কবিকে।

সাত দশক পরের কাহিনি
১৯৩৯ সালে সেই যে পুরো স্পেন দেশটি ফ্রাংকোর কবলে এসে গেল, তারপর চলল অকথ্য স্বৈরাচার ১৯৭৫ সালে ফ্রাংকোর মৃত্যু পর্যন্ত। ১৯৩৯ থেকে ১৯৪৭ সালের ভেতর চার লক্ষের বেশি নাগরিককে বন্দি রাখা হয় কনসেনট্রেশান ক্যাম্পে। ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে দেওয়া হয় রিপাবলিকানদের কথা। স্কুলের ছেলেমেয়েরা পড়ে, অনেকদিন আগে স্পেন শাসন করত কিছু খারাপ লোক। তখন রোজ রাস্তাঘাটে গোলাগুলি চলত আর পোড়ানো হত গির্জা। কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে মহানুভব ফ্রাংকো তাদের যুদ্ধে পরাস্ত করে দেশে শান্তি ও সুশাসন চালু করেন।

ফ্রাংকোর ৩৬ বছরের রাজত্বকালে লক্ষ লক্ষ মানুষকে জেলে পোরা হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে, দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন পাঁচ লক্ষের বেশি নাগরিক। ফ্রাংকোর তথাকথিত কমিউনিস্টবিরোধিতার জন্য তাঁকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমের দেশগুলো।

ফ্রাংকোর মৃত্যুর পর স্পেনে প্রতিষ্ঠিত হয় গণতান্ত্রিক সরকার, কিন্তু তাঁরাও অতীতের স্বৈরাচারের কোনোরকম তদন্ত বা প্রতিকার করতে অনিচ্ছুক। তাঁরা কেবল ভবিষ্যতের কথা ভাবতে চান, পুরনো কলংকের কথা নয়।

১৯৭৭ সালে স্পেনের পার্লামেন্টে ‘সর্বজনীন মার্জনা’ আইন পাস করা হয়, যার অন্য নাম ‘বিস্মৃতির চুক্তিপত্র’ (pacto de olvido) অর্থাৎ ফ্রাংকোর অপরাধী সাঙ্গোপাঙ্গদের বিচার করে শাস্তি দেওয়া যাবে না। এভাবেই চলে প্রায় দুই দশক।

১৯৯০ দশকের দ্বিতীয়ভাগে নিহত রিপাবলিকান, কমিউনিস্ট, সমাজবাদী ও নৈরাজ্যবাদীদের বংশধরেরা জোট বাঁধতে শুরু করেন ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি’ নাম দিয়ে এবং শুরু করেন আন্দোলন।

১৯৯৬ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত স্পেনের রাষ্ট্রপতি ছিলেন রক্ষশীল হোসে মারিয়া আসনার (১৯৫৩), তিনি কোনোরকম প্রতিবাদ কানেই তোলেননি। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি প্রগতিশীল হোসে লুইস বড়রিনোস সাদ্যতেরো (১৯৬০-); তার শাসনকালে সফলতা পায় এই আন্দোলন। ২০০৭ সালে ‘ঐতিহাসিক স্মৃতি আইন’ পাস হল পার্লামেন্টে। তার ফলে স্পেনের গৃহযুদ্ধ এবং ফ্রাংকোর অত্যাচারী শাসন বিষয়ে আলোচনা, গবেষণা ও তর্কবিতর্কের সূচনা। হাজার গণকবর ছড়িয়ে রয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, সেগুলো আবার খুঁড়ে মৃতদেহগুলো শনাক্তকরণের পথে আর কোনো নিষেধাজ্ঞা থাকল না। আর যে লক্ষ লক্ষ অভিবাসী মানুষ ছড়িয়ে আছেন সারা বিশ্বে- লাতিন আমেরিকায় দশ লক্ষেরও বেশি, কুবায় দুলক্ষ, ইউরোপেও কয়েক লক্ষ, তাঁদের আবার মঞ্জুর করা হল স্পেনের নাগরিকত্ব।

ফ্রাংকোর শাসনকালের প্রথম দেড় দশক স্পেনে লোরকার রচনার প্রকাশ ও পাঠ ছিল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ১৯৫৩ সালে আংশিকভাবে হলেও তা শিথিল করা হয়। সে বছরই লোরকার অনুরাগীরা প্রকাশ করেন অসম্পূর্ণ এবং সেনসর করা তাঁর ‘ওব্রাস কমপ্লিতাস’ (রচনা সমগ্র); বাদ পড়ে গভীর প্রেমের সনেটগুচ্ছ এবং আরও অনেক কবিতা। সেই গ্রন্থটি আবার প্রকাশিত হয় ১৯৮৩-৮৪ বন্ধু-বান্ধবদের কাছ থেকে পাওয়া পা-ুলিপির খসড়া থেকে। মূল ও সম্পূর্ণ পা-ুলিপি হারিয়ে গেছে চিরকালের মতো। লোরকার সঙ্গে সঙ্গে খুন করা হয় আরও তিনজনকে- দুজন বুলফাইটার এবং একজন শিক্ষক। সকলকে কবর দেওয়া হয় একসঙ্গে। খুন করার আগে কবির সমকামিতা নিয়ে অকথ্য খিস্তি করেছিল খুনিরা। সেই বধ্যস্থলে এখনও তীর্থদর্শনে যান কবিতাপ্রেমীরা, রেখে আসেন কবির প্রিয় লাল গোলাপ। দেয়ালের গায়ে বুলেটের দাগ রয়েছে অসংখ্য, বন্দিদের হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রিভলবার দিয়ে গুলি করা হয়েছিল মাথার খুলিতে।

২০০৮ সালে দেয়ালে একটি ছোট ফলক বসে “To the victims of francoism who were shot at this wall”। এছাড়া আগে বোঝার উপায় ছিল না কত নাটকীয় এবং ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল সেখানে। কিন্তু রাতের গভীরে ফ্রাংকোবাদী দুর্বৃত্তরা খুলে নিয়ে যায় সেই ফলকটি। আর সামান্য দূরে বড় রাস্তার ধারে সেই গণকবর, যেখানে লোরকা চিরশায়িত বলে অনেকের ধারণা।

১৯৬৬ সালে ইয়ান গিবসন নামে আয়ারল্যান্ডের এক ঐতিহাসিক লোরকার প্রামাণ্য জীবনী লেখেন, তাতে তিনি কবরটির ঠিকানা দেন। কবরটির প্রামাণ্যতা নির্ণয় করার জন্য তদন্তের দাবি কিন্তু লোরকা পরিবারের পক্ষ থেকে আসেনি; এসেছিল ফ্রানসিসকো গারাদির কাছ থেকে, যাঁর বুলফাইটার পিতামহ খুন হয়েছিলেন লোরকার সঙ্গে। ফ্রানসিসকোর পিতা তাঁর মৃত্যুশয্যায় পুত্রকে দিয়ে শপথ করান যে, তিনি পিতামহের অস্থি উদ্ধার করবেন এবং সম্মানের সঙ্গে সমাধি দেবেন আবার।

অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তিনি শেষঅব্দি উচ্চ আদালতে আবেদন করেন। বিচারক বালতাসার গারসোঁ আদেশ দেন, কবর খুঁড়ে অস্থি উদ্ধারের। এর ফলে স্পেনের গৃহযুদ্ধ নিয়ে নীরবতা ভাঙে। যুদ্ধ শেষ হবার সত্তর বছর পর শেষপর্যন্ত শুরু হতে থাকে আলোচনা ও বিতর্ক।

কিন্তু আপত্তি আসে লোরকা পরিবারের পক্ষ থেকে- তাঁর নেতৃত্বে কবির ভাইঝি লরা গার্সিয়া লোরকা, যিনি ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা ফাউন্ডেশনের ডিরেক্টর, তিনি বলেন, “We don’t want this to become a spectacle. But it is very difficult to imagine that the bones and skull of Federico Garcia Lorca will not end up on YouTube.”

শেষ পর্যন্ত রফা হয়েছে
২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে কবর খুঁড়ে মৃতদেহগুলো উদ্ধার করা হয়েছে। প্রথমে জায়গাটি ঘিরে ২০০ বর্গমিটার এলাকা কর্তন করে রাখে পুলিশ; কাজের তত্ত্বাবধান করেন গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক ও প্রত্নতত্ত্ববিদেরা; লোরকা পরিবারের অনুরোধে কারও অনুমতি ছিল না ক্যামেরা অথবা সেলফোন সঙ্গে নিয়ে যাবার। অস্থিগুলো সন্তর্পণে রক্ষিত আছে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘসময় ধরে চলেছে তার তদন্ত এবং বিশ্লেষণ। অন্য তিনজন মৃতের পরিবারও তাঁদের ডিএনএ’র নমুনা দাখিল করেছেন। শেষপর্যন্ত লোরকা পরিবারও রাজি হল। কিন্তু সন্দেহ থেকেই গেল অস্থিগুলোর পরিচয় নিয়ে।

স্থানীয় ঐতিহাসিক মিশেল কাবাইয়েরো পেরেস কিন্তু হাল ছাড়েননি। বছরের পর বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে পুলিশ ও মিলিটারি অভিলেখাগারে দলিলপত্র ঘেঁটে তিনি এসপানিওল ভাষায়- “গার্সিয়া লোরকার জীবনের অন্তিম তেরো ঘণ্টা” নামে একটি বই লেখেন। তিনি সেই দিনের ফায়ারিং স্কোয়াডের বন্দুকধারীদেরও কয়েক জনকে শনাক্ত করে তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। পেরেসের গবেষণা অনুযায়ী আগের স্থান থেকে আধমাইল দূরে অবস্থিত গণকবরে লোরকা সমাহিত। তাঁর গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ২০১২ সালে। কিন্তু তার আগেই স্পেনের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন রক্ষণশীল মারিয়ানো রাহয় ব্রেই (১৯৫৫-); তাঁর প্রথম কাজই হয় এই অনুসন্ধান কর্মের সমস্ত সরকারি অনুদান বাতিল করে দেওয়া।

তারপর থেকে এই কর্মযজ্ঞ চলছে সরকারি সাহায্য ছাড়াই, সাধারণ মানুষের থেকে চাঁদা তুলে এবং নানান লোকহিতকর সংস্থার অর্থসাহায্যে।

নতুন উদ্যমে কাজ শুরু হয়েছে ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে। প্রত্নতাত্ত্বিক দলের নেতা হাভিয়ের নাভারোর দৃঢ় বিশ্বাস, এই স্থানটিই লোরকার প্রকৃত সমাধি। তিনি লন্ডনের দ্য গার্ডিয়ান সংবাদপত্রের সাংবাদিককে জানিয়েছেন, “Everything we have done to date confirms that this is the spot we have been looking for.”

অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করেন, কোনোদিন সঠিক সত্য জানা যাবে কি না। আশা রাখি খুব শিগগির সমাধান হবে এই রহস্যের এবং জাতীয় সম্মানসহ পুনর্সমাহিত করা হবে এই মহান কবিকে। কিন্তু লোরকা পরিবারের ভয় পুরো ব্যাপারটি যেন প্রহসনে পর্যবসিত না হয়।

“যখন আমি মরে যাব
আমার গীটারসমেত আমায় কবর দিও
বালির তলায়।
যখন আমি মরে যাব
কমলালেবুর গাছ
আর পুদিনাঝাড়ের মাঝখানে।
যখন আমি মরে যাব
ইচ্ছে হলে আমায় কবর দিও
একটা হাওয়াকলের ভেতর।
যখন আমি মরে যাব।

(শেষ ইচ্ছে/ ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা অনুবাদ : পুষ্কর দাশগুপ্ত)

[কবিতার উদ্ধৃতিগুলো কবি পুষ্কর দাশগুপ্তের অনুমতি নিয়ে এখানে সংকলিত হয়েছে। অনুমতির জন্য লেখক কৃতজ্ঞ।]

back to top