হাফিজুর রহমান
শহীদ কাদরী আমার কাছে এটা শুধু নাম নয়, স্মৃতিময় যৌবনের হারিয়ে যাওয়া অনন্য ছবি যেন! ফেলে আসা জীবনের হিরণ¥য় ফ্রেমে আঁটা নস্টালজিয়া! আধুনিক বাংলা কবিতার নাগরিক-ধারার উজ্জ্বল নাম শহীদ কাদরী! বাংলাদেশের কাব্যধারার দশকভিত্তিক বিভাজনে তিনি পঞ্চাশের কবি হিসাবে পরিচিত হলেও ষাটের দশকই তাঁর অনন্যতার উন্মেষকাল! মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থে অধিকার করেছিলেন স্বাতন্ত্র্যবাহী নিজস্ব আসনটি! শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী- এই তিনটি নাম একসাথে উচ্চারিত হয় অবলীলায়! যদিও এক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে এসময়ের একজন কবি জানিয়েছেন, শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীর সম্পর্ক বড়ভাই-ছোট ভাইয়ের মতোই! তবু এই তিন কবির কাব্যভুবনের ত্রিমাত্রিক চালচিত্রের আয়নায় বাংলাদেশের সবটুকু ছবিগাথা চিত্রিত হয়ে আছে বলেই এঁদেরকে ভিত্তিস্বরূপ গণনা করা অমূলক নয় আদৌ!
৩
যে শহীদ কাদরীকে আমি চিনতাম তিনি অনন্যকান্তি কবিপুরুষ তো বটেই, তারচে’ বেশি আড্ডা-পাগল এক অসাধারণ বাঙালি বোহেমিয়ান! সংসারে থেকেও যিনি সংসার-বিরাগী! ঘরের ভিতরে থেকেও বড্ড বেশি ভবঘুরে যেন! মনে ও মননে বাঙালি হয়েও অনবদ্য এক বিশ্বনাগরিক! রবীন্দ্র-নজরুলের জগত থেকে শুরু করে ত্রিশোত্তর বাংলা-কবিতার অগ্রসরমান ধারা ও সমসাময়িক বিশ্ব-কবিতার ধারায় অমেয় দখল নিয়েই কাব্যযাত্রার শুরু তাঁর! বাংলা-কাব্যধারায় এক অনন্য সংযোজন তিনি!
৪
কবে যে প্রথম তাঁর সান্নিধ্যে আসি, তা মনেই পড়ে না এখন! শুধু মনে পড়ে পুরানা পল্টনের সেই বাড়িটির ছবি! গেট দিয়ে ঢুকেই উঠোনের ছায়ার মায়ায় ঢাকা ঘরখানির কথা! ঘরভর্তি বন্ধুজন, ঢাকা শহরের আড্ডা-পাগল কবিদের নিরন্তর জটলা সদা-চলমান! তক্তপোষের উপর ঠিক বসে আছেন সর্বজনপ্রিয় কবিবর! শহীদ কাদরী!
পুরানা পল্টনের বাসায় আমাদের সময়-অসময়ের বাছ-বিচারহীন সেই তুমুল আড্ডার স্মৃতি কোনোদিন ভুলবার মতো কি! বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে সেই অলস অথচ গৌরবময় সময়টা প্রায়ই কেটেছে শহীদ ভাইয়ের ঘরে! দিনদুপুরে ঢুকে কোনো কোনোদিন ফিরেছি রাতদুপুরে! সাহিত্য-সঙ্গীতসহ শিল্পের এমন কোনো শাখা ছিলো না, যা বিষয় হয়ে ওঠেনি! ঘরটা উপচে উঠতো মাঝেমধ্যে!
কে না আসতেন! মফিদুল ভাই, বটু ভাই (মাহমুদুল হক), রফিক আজাদ ভাই, সিকদার ভাই, শিহাব, সুমন (আবিদ আজাদ), মাহবুব হাসান, ইকবাল হাসান! আরও যে কতো জন! শহীদ ভাইয়ের অকৃত্রিম সুহৃদ বুড়ো ভাইও আসতেন প্রায়ই!
বুড়ো ভাইয়ের নাম আসতেই একটা মজার স্মৃতি মনে পড়লো! কোনো এক অনুষ্ঠানে বুড়ো ভাই নেমন্তন্ন করেছিলেন আমাদের! তাঁর ইত্তেফাক অফিসের পিছনের বাসায় খেতে বসেছি আমরা! শহীদ ভাই, ইকবালসহ সকলের খাওয়া শেষ! বরাবরই খেতে দেরি হয় আমার! হঠাৎ দেখি, পরবর্তী মজলিশ বসে গেছে! আমি কিছু না বুঝে সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে দিয়ে উঠতে গেছি, ঠিক তখনই শহীদ ভাই ছুটে এসে ওয়েটারকে বললেন, এখানে প্লেট দিলে না?
বুড়ো ভাইও দৌড়ে এসে তদারকি শুরু করলেন! পুনরায় প্লেট এলো, খাবার এলো! সকলের সাথে ফের আমাকে বসে বসে খাওয়ার অভিনয় করতে হলো! পাশ থেকে নড়লেন না শহীদ ভাই! এও একরকম ঠাট্টা ছিলো তাঁর!
৫
কীভাবে ভুলি সেইসব স্মৃতির বিস্ময়! আমাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিতেন বোধকরি ভিন্ন একটি কারণে! আবুল হাসানের বোন বুড়ির সাথে সম্পর্কের কথাটা কীভাবে যেন জেনেছিলেন! সদা-কৌতুকপ্রিয় শহীদ ভাই যেন মোক্ষম তূণ হাতে পেলেন! কিছু বললেই হাসতে হাসতে বলে উঠতেন, দাঁড়াও! তোমাকে জব্দ করার অস্ত্র আমার হাতের মুঠোয়! নালিশ করবো কিন্তু বুড়ির কাছে! বলেই কী যে একটা প্রাণময় হাসির হুল্লোড় তুলতেন!
কোনো কোনো সময়ে কানের কাছে মুখ এনে গোপন কথা বলার মতো চুপিসারে বলে উঠতেন, কী! আমাগো বোনটারে ছ্যাকা দেওনের মতলব নেই তো ? হাসানের বোন বইলা কথা!
অকাল-প্রয়াত আবুল হাসানকে যে কতোখানি আপন ভাবতেন, তা বুঝতে বাকি থাকতো না!
মনে আছে, আটাত্তরের চৌদ্দই আগস্ট দুপুরে গিয়েছি তাঁর বাসায়! কথায় কথায় হঠাৎ বলে উঠলেন, হাফিজ, বিয়ে করছো কবে?
আমি তো অবাক! আচমকা আক্রমণে অস্বস্তিতেও পড়েছি বেশ! কী বলবো ভাবছি যখন, শহীদ ভাই বললেন, মিয়া আজই বিয়া করো তোমরা! যাও! নিয়া আসো ওকে!
আমার কোনো যুক্তি কোনো অজুহাত সেদিন ধোপে টেকেনি! বুড়ি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী! থাকতো শামসুন্নাহার হলে!
সেই বিকেলে বুড়িকে হল থেকে এনে ছুটতে হলো মগবাজার! কাজীর অফিসে! কে কে সঙ্গে ছিলো ঠিক মনে নেই! তবে যদ্দুর মনে পড়ে, আবিদ আজাদ ও ইকবাল হাসান ছিলো! সে এক অসাধারণ মুহূর্তের স্মৃতি যেন! কাজী সাহেব যখন বিয়ের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদ পড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রথাসিদ্ধ প্রশ্নটি করলেন, কবুল?
সমস্ত শরীরে কী এক শিহরন খেলে গেলো যেন! মনে হলো, পৃথিবীর অনন্য অথচ অনন্ত এক দায়ভার মাথার উপর চাপিয়ে দিলেন কেউ! শহীদ ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো মুহূর্তের জন্যে! বললাম, কবুল! মনে হলো, খুব পবিত্র হলাম! পরিপূর্ণ হলাম! ধন্যবাদ আপনাকে, শহীদ কাদরী!
রোজার দিন! কাগজ-কলমের কাজ সেরে লাইব্রেরির লনে এসে ইফতার করিয়েছিলাম বুড়িকে! তারপর সন্ধ্যায় ঢুকলো হলে! এভাবেই শুরু হলো নতুন জীবন! ঢাকায় ছোটফুপুর বাসায় থাকতাম! রাতে ঘরে ফিরে ফুপুআম্মাকে বললাম, বুড়িকে বিয়ে করলাম আজ! ফুপুআম্মা শুধু বললেন, জানাজানি করিস না! চেপে থাকিস! আনুষ্ঠানিকভাবেই হবে ফের!
হয়েওছিলো ঊনআশির ২৭ মে তারিখে! দুটো দিনই উদযাপন করি আমরা! তবে আগস্টের আবেদনই শাশ্বত যেন! সেই আগস্টেই শহীদ ভাই নেই হয়ে গেলেন চিরতরে!
৬
বৈবাহিক জীবনের আটত্রিশ বছর পেরিয়েছি আমরা! সত্তরের দশকেই শহীদ ভাই পাড়ি জমান বিদেশে! তবু বুকের কোথাও না কোথাও টের পেতাম তিনি রয়েছেন! ভাবতাম, আছেন তো! থাকবেনই!
কতোদিন দেখিনি তাঁকে! বন্ধুবর ইকবাল হাসান প্রায়ই ফেসবুক-স্ট্যাটাসে জানাতো শহীদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দিনের পর দিন আড্ডায় মেতে ওঠার খবর! পড়ে আকুল হতাম! ইনবক্সে একদিন জানালো, হাফিজ, শহীদ ভাই তোমার কথা খুব বলছিলেন সেদিন! উতলা হয়ে শুধুমাত্র খোঁজ-খবর নেওয়া ও ভিডিওকলে কথা বলার সুযোগলাভের উপায় হিসাবে ভাবিকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম! তখনই শুনলাম, নেই! সাতদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন! বাংলা-কবিতার অত্যাধুনিক মনন ও মনীষার রূপকার চুপচাপ হঠাৎ-ই নেই হয়ে গেলেন! এ দুঃসহ সংবাদ আমাকে নির্ঘুম রেখেছে সারাটা রাত! স্মৃতিময়তায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে সারারাত জাগিয়ে রাখলেন!
কই নেই! স্মৃতির ভিতরের ছবিগুলো উঁকি দিয়ে বলেছে সারারাত, না...! আছেন তো! আছেন!
৭
কবিতালাপ-এর অনুষ্ঠানে যেবার তাঁকে খুলনায় আনা হয়েছিলো, শহীদ ভাই আমার ভাড়া বাসাতেই থাকলেন! নতুন চাকরি তখন! গোলপাতায় ছাওয়া একটা ঘরে থাকতাম! কোনো টুঁ শব্দটি করেননি কখনো! সারাদিন তো বটেই, আড্ডা চলেছে সারারাত! আমার সেই গোলপাতার ঘরে সারা খুলনা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো সেই কয়টা দিন! কবিযশপ্রার্থী, সাহিত্য-রসিক আর অগণিত পাঠকের মিলনমেলা হয়ে উঠেছিলো যেন! আড্ডা বসেছিলো আমার প্রিয় ছাত্রী সৈয়দা সাবিহা ও বন্ধুবর মোজাম্মেল হক-এর বাড়িতেও!
মূল আকর্ষণ হয়ে শহীদ ভাই একাই মাতিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে! সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা আমরা!
শহীদ কাদরীর হাসি বলে কথা! কিছু একটা বলেন, আর দমকে দমকে হাসির ঢেউয়ে নিজের শরীর দুলিয়ে নিজের পরিতৃপ্তির আনন্দটুকু সংক্রমিত করে দেন সকলের মাঝে! রাত্রির সুনসান নীরবতা খানখান হতো তাঁর হাসি আর কথার দমকে! একদিন তো পাশের বাড়ির এক নিরীহ ভদ্রলোক আমাকে বলেই ফেললেন, রাতে আপনারা ঘুমান না স্যার?
তাঁকে শহীদ ভাইয়ের গল্পের কথা জানালে পরদিন দেখি তিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন সারারাত! কবিতার প্রেমে নয় বোধকরি, শহীদ ভাইয়ের সম্মোহনি উপস্থিতি টেনে এনেছিলো তাঁকে!
কবে যেন ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই হাত থেকে সিগ্রেটটা পড়ে গিয়েছিলো! পাশের সহযাত্রীকে বললেন, ভাই! সিগ্রেটটা তুলে দিন না প্লিজ!
তিনি তো অগ্নিশর্মা! কী! আমাকে তুলে দিতে হবে!
শহীদ ভাই বলেছিলেন, জানেন তো, মাজায় ব্যথা আমার! নিচু হতে পারি না তো! তাই!
ভদ্রলোক স্যরি বলে তুলে দিলেন সিগ্রেটটা! ঘটনাটা বলে সে যে কী হাসির দমক তাঁর!
এমনি ঝরতো গল্পের ফোয়ারা!
এইসব আড্ডায় শরিক ছিলেন সৈয়দ কামরুল, মোজাম্মেল হক, নাসিরুজ্জামান, মেহেদী আল আমিন, কামাল মাহমুদ, মিলন মাহমুদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই! আমাদের গ্রামের বাড়িতেও যেতে চেয়েছিলেন! সুন্দরবনে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ডুমুরিয়ায় যাওয়া হয়নি আর! আমাদের প্রিয় নদী ভদ্রার গল্প তাঁকে টেনেছিলো খুব! কী আশ্চর্য, সেই নদী এখন কঙ্কাল!
সেখানে বসতবাড়ি! ভদ্রা বিগত হয়েছে প্রকৃতি-পিপাসু কবিরও আগে! অকালে!
৮
ঢাকা থেকে আসা অন্য অতিথিরা চলে গেলেও শহীদ ভাই আমাদের সাথে ছিলেন কিছুদিন! অকালপ্রয়াত কবি মিলন মাহমুদ তখন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে! তাঁরই উদ্যোগে আমরা তিনজন নিউজপ্রিন্টের গেস্ট হিসেবে সুন্দরবনে গিয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম!
নিউজপ্রিন্টের যে জাহাজটি সুন্দরবনের বাংলোতে অবস্থানকারী নিউজপ্রিন্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক রসদ ও খাবার-পানি সরবরাহ করতো, সেই জাহাজের কেবিনে ক’রে যাওয়া হলো! সাতদিন ছিলাম গহীন জঙ্গলে! সেখানে নষ্ট একটা জাহাজে চমৎকার বাংলো! রাতের অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে পশু-পাখির কোলাহল, ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে বনমোরগের ডাক, হাওয়ার সুনির্মল পরশ- এসব কিছুই বিভোর করে তুলেছিলো আমাদের! বিকেলে সংরক্ষিত এলাকায় ব্যাডমিন্টন খেলার কথা মনে পড়লে আজও মনে হয়, যাই ছুটে ফের একবার!
প্রতিদিন সকালে একটা স্পিডবোট নিয়ে আমরা ঢুকতাম গভীর জঙ্গলে! সঙ্গী থাকতেন শিকারী ও গানম্যান! খালের ভিতর দিয়ে ক্রমশ ঢুকে যেতাম বনের প্রত্যন্ত সব নিভৃত অঞ্চলে! কিছু দূরে দূরে গাছের উপর মাচা বাঁধা ঘর! ওদের ভাষায় টোঙ্! বন-প্রহরীদের তাৎক্ষণিক আশ্রয়!
একদিন জানা গেলো, যে টোঙ-এর ধারে আমরা গিয়েছি, সেখানে আগের রাতে বাঘ এসেছিলো! শহীদ ভাই তো নাছোড়-বান্দা! তিনি নামবেনই! লম্বা লাইনে এগুলাম আমরা! সবার আগে গাইড, পরেই শহীদ ভাই; সবার পিছনে গানম্যান, তার সামনে আমি! দুপাশে বাঘছাপও মিললো! সারা শরীরে কাঁটা জাগছিলো ভয়ে! হঠাৎ গাইড বললেন, সাবধান সবাই! চারদিকে চোখ রেখে চলবেন! বাঘ আশেপাশে থাকলে ওঁৎ পাতবেই! লাফ দিলে পিছনের দিকেই টার্গেট করবে! আমার যে কী দশা তখন! মুহূর্তে এ্যাবাউট-টার্ন করেই শহীদ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম! সবাই ফিরলে আমার অবস্থান তখন সামনের দিকে! খুব উদ্বিগ্নচিত্তে বললাম, আর না শহীদ ভাই! চলেন ফিরি!
অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে সেদিন তাঁকে ফিরতে রাজি করানো গিয়েছিলো! কোনো কিছুর আদ্যোপান্ত দেখার এই আকাক্সক্ষা কবিদের সহজাত বুঝি!
হংসরাজ নদীর কাছাকাছি একটা বড়ো মাঠের মতো চরটির কথা আজও ভুলতে পারি না! শক্ত-নরম মাটির ধুধু মাঠজুড়ে কেওড়াগাছের সারি! চরের সীমানায় নদীতে টলটলে পানির তিরতির ঢেউ! সমস্ত চরে নানা বয়সের হরিণগুলি জড়ো হয়েছে পানি খেতে! অসংখ্য হরিণ! শহীদ ভাই নাম দিয়েছিলেন, হরিণের হাট!
হরিণেরা পানি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কেওড়াগাছের ডালে বসে থাকা অগুনতি বানরের ছুঁড়ে দেওয়া কেওড়ার ফল খাচ্ছে নিরুদ্বেগে! সেই অপরূপ ছবিখানি আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই যেন! সৃষ্টিকর্তার কী নির্ভুল নিয়ম! বিস্ময়ের ঘোর কাটে না দেখলে!
ফেরার সময়ে স্পিডবোটের ইঞ্জিন খারাপ হওয়া ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা! টানা বৈঠা বেয়ে ফিরতে হতো তখন! একটা চরে অনেকগুলির হরিণশাবক খেলছিলো! আমরা বোট থামিয়ে অবাক চোখে দেখছিলাম ওদের! ওরা দেখছিলো আমাদেরকে! বাচ্চাগুলির চোখে বিস্ময় ছিলো! কিন্তু কোনো উদ্বেগ দেখিনি! হঠাৎ কোত্থেকে মা-হরিণটা এসে কিছু একটা বলতেই মুহূর্তে হারিয়ে গেলো সবগুলোই!
বুঝেছিলাম বাচ্চা-হরিণগুলি তখনো মানুষ দেখেনি, মানুষের নিষ্ঠুরতার পরিচয় জানেনি! পোড়-খাওয়া মা-হরিণটা জানিয়ে দিতেই ছুটলো দিগিদিক!
সুন্দরবন থেকে ফিরে শহীদ ভাই একটা কবিতা লিখেছিলেন! মা-হরিণের শঙ্কার কারণটাকে কী নির্মম নির্লিপ্ততায় যে এঁকেছিলেন! আমিও লিখেছিলাম একটা!
৯
একসময়ে আমরা ব্যবসার উদ্যোগও নিয়েছিলাম! শহীদ ভাই, সুমন (আবিদ আজাদ) ও আমি মিলে গড়ে তুলেছিলাম একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান! ‘ত্রিকাল’! আইডিয়াটা শহীদ ভাইয়েরই ছিলো! প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন-নির্ভর ব্যবসা! সাতাত্তরের প্রথম থেকে কী অমানবিক পরিশ্রম যে করেছিলাম আবিদ আর আমি! সকালে নাস্তা সেরে বেরুতাম! সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে সন্ধ্যায় শহীদ ভাইকে রিপোর্ট করতাম!
শহীদ ভাইয়ের বড়োভাই শাহেদ কাদরী তখন একটি সরকারি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তি! তাঁর পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় কেবল একটি কাজের ওয়ার্কঅর্ডার পেয়েছি যখন, ঠিক তখনই বিশেষ কারণে কলেজের চাকরি নিয়ে আমাকে খুলনায় ফিরতে হলো! আর যুক্ত থাকার সুযোগ পাইনি! শুনেছিলাম আমি ছেড়ে আসার পরে শহীদ ভাইও নিজেকে গুটিয়ে নেন! আবিদ আজাদ আমৃত্যু ‘শিল্পতরু’ নামে ব্যবসাটা চালিয়ে গেছে!
১০
সেই শহীদ কাদরী নেই আজ! তাঁর নশ্বর দেহটা তাঁরই অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী প্রিয়ভূমিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো! গোটা জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় অন্তিম-বিদায় জানিয়েছে কবিকে! শহীদ মিনারের পবিত্র ছায়ায় রাখা প্রিয় মানুষটির কফিন ফুলে ফুলে ঢেকে গিয়েছিলো! দূরে বসে টিভি ও পত্রিকার ছবিতে দেখে নিঃশব্দে কেঁদেছি! অসুস্থতার কারণে ছুটে যেতে পারিনি ঢাকায়! স্মৃতিময়তায় ডুবে ঘটমান ছবিগুলি কল্পনায় দেখেছি কেবল!
১১
আমরাও তো আসছি শহীদ ভাই! ওই লোকান্তর ভুবনে হয়তো ফের দেখা হবে!
প্রিয় কবি! যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন! আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন আপনার সহায় হোন! আমিন!
হাফিজুর রহমান
বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪
শহীদ কাদরী আমার কাছে এটা শুধু নাম নয়, স্মৃতিময় যৌবনের হারিয়ে যাওয়া অনন্য ছবি যেন! ফেলে আসা জীবনের হিরণ¥য় ফ্রেমে আঁটা নস্টালজিয়া! আধুনিক বাংলা কবিতার নাগরিক-ধারার উজ্জ্বল নাম শহীদ কাদরী! বাংলাদেশের কাব্যধারার দশকভিত্তিক বিভাজনে তিনি পঞ্চাশের কবি হিসাবে পরিচিত হলেও ষাটের দশকই তাঁর অনন্যতার উন্মেষকাল! মাত্র তিনটি কাব্যগ্রন্থে অধিকার করেছিলেন স্বাতন্ত্র্যবাহী নিজস্ব আসনটি! শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শহীদ কাদরী- এই তিনটি নাম একসাথে উচ্চারিত হয় অবলীলায়! যদিও এক গবেষণাধর্মী প্রবন্ধে এসময়ের একজন কবি জানিয়েছেন, শামসুর রাহমান ও শহীদ কাদরীর সম্পর্ক বড়ভাই-ছোট ভাইয়ের মতোই! তবু এই তিন কবির কাব্যভুবনের ত্রিমাত্রিক চালচিত্রের আয়নায় বাংলাদেশের সবটুকু ছবিগাথা চিত্রিত হয়ে আছে বলেই এঁদেরকে ভিত্তিস্বরূপ গণনা করা অমূলক নয় আদৌ!
৩
যে শহীদ কাদরীকে আমি চিনতাম তিনি অনন্যকান্তি কবিপুরুষ তো বটেই, তারচে’ বেশি আড্ডা-পাগল এক অসাধারণ বাঙালি বোহেমিয়ান! সংসারে থেকেও যিনি সংসার-বিরাগী! ঘরের ভিতরে থেকেও বড্ড বেশি ভবঘুরে যেন! মনে ও মননে বাঙালি হয়েও অনবদ্য এক বিশ্বনাগরিক! রবীন্দ্র-নজরুলের জগত থেকে শুরু করে ত্রিশোত্তর বাংলা-কবিতার অগ্রসরমান ধারা ও সমসাময়িক বিশ্ব-কবিতার ধারায় অমেয় দখল নিয়েই কাব্যযাত্রার শুরু তাঁর! বাংলা-কাব্যধারায় এক অনন্য সংযোজন তিনি!
৪
কবে যে প্রথম তাঁর সান্নিধ্যে আসি, তা মনেই পড়ে না এখন! শুধু মনে পড়ে পুরানা পল্টনের সেই বাড়িটির ছবি! গেট দিয়ে ঢুকেই উঠোনের ছায়ার মায়ায় ঢাকা ঘরখানির কথা! ঘরভর্তি বন্ধুজন, ঢাকা শহরের আড্ডা-পাগল কবিদের নিরন্তর জটলা সদা-চলমান! তক্তপোষের উপর ঠিক বসে আছেন সর্বজনপ্রিয় কবিবর! শহীদ কাদরী!
পুরানা পল্টনের বাসায় আমাদের সময়-অসময়ের বাছ-বিচারহীন সেই তুমুল আড্ডার স্মৃতি কোনোদিন ভুলবার মতো কি! বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে সেই অলস অথচ গৌরবময় সময়টা প্রায়ই কেটেছে শহীদ ভাইয়ের ঘরে! দিনদুপুরে ঢুকে কোনো কোনোদিন ফিরেছি রাতদুপুরে! সাহিত্য-সঙ্গীতসহ শিল্পের এমন কোনো শাখা ছিলো না, যা বিষয় হয়ে ওঠেনি! ঘরটা উপচে উঠতো মাঝেমধ্যে!
কে না আসতেন! মফিদুল ভাই, বটু ভাই (মাহমুদুল হক), রফিক আজাদ ভাই, সিকদার ভাই, শিহাব, সুমন (আবিদ আজাদ), মাহবুব হাসান, ইকবাল হাসান! আরও যে কতো জন! শহীদ ভাইয়ের অকৃত্রিম সুহৃদ বুড়ো ভাইও আসতেন প্রায়ই!
বুড়ো ভাইয়ের নাম আসতেই একটা মজার স্মৃতি মনে পড়লো! কোনো এক অনুষ্ঠানে বুড়ো ভাই নেমন্তন্ন করেছিলেন আমাদের! তাঁর ইত্তেফাক অফিসের পিছনের বাসায় খেতে বসেছি আমরা! শহীদ ভাই, ইকবালসহ সকলের খাওয়া শেষ! বরাবরই খেতে দেরি হয় আমার! হঠাৎ দেখি, পরবর্তী মজলিশ বসে গেছে! আমি কিছু না বুঝে সামনে থেকে প্লেট সরিয়ে দিয়ে উঠতে গেছি, ঠিক তখনই শহীদ ভাই ছুটে এসে ওয়েটারকে বললেন, এখানে প্লেট দিলে না?
বুড়ো ভাইও দৌড়ে এসে তদারকি শুরু করলেন! পুনরায় প্লেট এলো, খাবার এলো! সকলের সাথে ফের আমাকে বসে বসে খাওয়ার অভিনয় করতে হলো! পাশ থেকে নড়লেন না শহীদ ভাই! এও একরকম ঠাট্টা ছিলো তাঁর!
৫
কীভাবে ভুলি সেইসব স্মৃতির বিস্ময়! আমাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিতেন বোধকরি ভিন্ন একটি কারণে! আবুল হাসানের বোন বুড়ির সাথে সম্পর্কের কথাটা কীভাবে যেন জেনেছিলেন! সদা-কৌতুকপ্রিয় শহীদ ভাই যেন মোক্ষম তূণ হাতে পেলেন! কিছু বললেই হাসতে হাসতে বলে উঠতেন, দাঁড়াও! তোমাকে জব্দ করার অস্ত্র আমার হাতের মুঠোয়! নালিশ করবো কিন্তু বুড়ির কাছে! বলেই কী যে একটা প্রাণময় হাসির হুল্লোড় তুলতেন!
কোনো কোনো সময়ে কানের কাছে মুখ এনে গোপন কথা বলার মতো চুপিসারে বলে উঠতেন, কী! আমাগো বোনটারে ছ্যাকা দেওনের মতলব নেই তো ? হাসানের বোন বইলা কথা!
অকাল-প্রয়াত আবুল হাসানকে যে কতোখানি আপন ভাবতেন, তা বুঝতে বাকি থাকতো না!
মনে আছে, আটাত্তরের চৌদ্দই আগস্ট দুপুরে গিয়েছি তাঁর বাসায়! কথায় কথায় হঠাৎ বলে উঠলেন, হাফিজ, বিয়ে করছো কবে?
আমি তো অবাক! আচমকা আক্রমণে অস্বস্তিতেও পড়েছি বেশ! কী বলবো ভাবছি যখন, শহীদ ভাই বললেন, মিয়া আজই বিয়া করো তোমরা! যাও! নিয়া আসো ওকে!
আমার কোনো যুক্তি কোনো অজুহাত সেদিন ধোপে টেকেনি! বুড়ি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ছাত্রী! থাকতো শামসুন্নাহার হলে!
সেই বিকেলে বুড়িকে হল থেকে এনে ছুটতে হলো মগবাজার! কাজীর অফিসে! কে কে সঙ্গে ছিলো ঠিক মনে নেই! তবে যদ্দুর মনে পড়ে, আবিদ আজাদ ও ইকবাল হাসান ছিলো! সে এক অসাধারণ মুহূর্তের স্মৃতি যেন! কাজী সাহেব যখন বিয়ের প্রয়োজনীয় দোয়া-দরুদ পড়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে প্রথাসিদ্ধ প্রশ্নটি করলেন, কবুল?
সমস্ত শরীরে কী এক শিহরন খেলে গেলো যেন! মনে হলো, পৃথিবীর অনন্য অথচ অনন্ত এক দায়ভার মাথার উপর চাপিয়ে দিলেন কেউ! শহীদ ভাইয়ের হাস্যোজ্জ্বল মুখটা ভেসে উঠলো মুহূর্তের জন্যে! বললাম, কবুল! মনে হলো, খুব পবিত্র হলাম! পরিপূর্ণ হলাম! ধন্যবাদ আপনাকে, শহীদ কাদরী!
রোজার দিন! কাগজ-কলমের কাজ সেরে লাইব্রেরির লনে এসে ইফতার করিয়েছিলাম বুড়িকে! তারপর সন্ধ্যায় ঢুকলো হলে! এভাবেই শুরু হলো নতুন জীবন! ঢাকায় ছোটফুপুর বাসায় থাকতাম! রাতে ঘরে ফিরে ফুপুআম্মাকে বললাম, বুড়িকে বিয়ে করলাম আজ! ফুপুআম্মা শুধু বললেন, জানাজানি করিস না! চেপে থাকিস! আনুষ্ঠানিকভাবেই হবে ফের!
হয়েওছিলো ঊনআশির ২৭ মে তারিখে! দুটো দিনই উদযাপন করি আমরা! তবে আগস্টের আবেদনই শাশ্বত যেন! সেই আগস্টেই শহীদ ভাই নেই হয়ে গেলেন চিরতরে!
৬
বৈবাহিক জীবনের আটত্রিশ বছর পেরিয়েছি আমরা! সত্তরের দশকেই শহীদ ভাই পাড়ি জমান বিদেশে! তবু বুকের কোথাও না কোথাও টের পেতাম তিনি রয়েছেন! ভাবতাম, আছেন তো! থাকবেনই!
কতোদিন দেখিনি তাঁকে! বন্ধুবর ইকবাল হাসান প্রায়ই ফেসবুক-স্ট্যাটাসে জানাতো শহীদ ভাইয়ের বাসায় গিয়ে দিনের পর দিন আড্ডায় মেতে ওঠার খবর! পড়ে আকুল হতাম! ইনবক্সে একদিন জানালো, হাফিজ, শহীদ ভাই তোমার কথা খুব বলছিলেন সেদিন! উতলা হয়ে শুধুমাত্র খোঁজ-খবর নেওয়া ও ভিডিওকলে কথা বলার সুযোগলাভের উপায় হিসাবে ভাবিকে একটা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম! তখনই শুনলাম, নেই! সাতদিন হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে হেরে গেলেন! বাংলা-কবিতার অত্যাধুনিক মনন ও মনীষার রূপকার চুপচাপ হঠাৎ-ই নেই হয়ে গেলেন! এ দুঃসহ সংবাদ আমাকে নির্ঘুম রেখেছে সারাটা রাত! স্মৃতিময়তায় আকণ্ঠ ডুবিয়ে সারারাত জাগিয়ে রাখলেন!
কই নেই! স্মৃতির ভিতরের ছবিগুলো উঁকি দিয়ে বলেছে সারারাত, না...! আছেন তো! আছেন!
৭
কবিতালাপ-এর অনুষ্ঠানে যেবার তাঁকে খুলনায় আনা হয়েছিলো, শহীদ ভাই আমার ভাড়া বাসাতেই থাকলেন! নতুন চাকরি তখন! গোলপাতায় ছাওয়া একটা ঘরে থাকতাম! কোনো টুঁ শব্দটি করেননি কখনো! সারাদিন তো বটেই, আড্ডা চলেছে সারারাত! আমার সেই গোলপাতার ঘরে সারা খুলনা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলো সেই কয়টা দিন! কবিযশপ্রার্থী, সাহিত্য-রসিক আর অগণিত পাঠকের মিলনমেলা হয়ে উঠেছিলো যেন! আড্ডা বসেছিলো আমার প্রিয় ছাত্রী সৈয়দা সাবিহা ও বন্ধুবর মোজাম্মেল হক-এর বাড়িতেও!
মূল আকর্ষণ হয়ে শহীদ ভাই একাই মাতিয়ে রেখেছিলেন সবাইকে! সকলেই যেন মন্ত্রমুগ্ধ শ্রোতা আমরা!
শহীদ কাদরীর হাসি বলে কথা! কিছু একটা বলেন, আর দমকে দমকে হাসির ঢেউয়ে নিজের শরীর দুলিয়ে নিজের পরিতৃপ্তির আনন্দটুকু সংক্রমিত করে দেন সকলের মাঝে! রাত্রির সুনসান নীরবতা খানখান হতো তাঁর হাসি আর কথার দমকে! একদিন তো পাশের বাড়ির এক নিরীহ ভদ্রলোক আমাকে বলেই ফেললেন, রাতে আপনারা ঘুমান না স্যার?
তাঁকে শহীদ ভাইয়ের গল্পের কথা জানালে পরদিন দেখি তিনিও আমাদের সঙ্গী হলেন সারারাত! কবিতার প্রেমে নয় বোধকরি, শহীদ ভাইয়ের সম্মোহনি উপস্থিতি টেনে এনেছিলো তাঁকে!
কবে যেন ঢাকার রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই হাত থেকে সিগ্রেটটা পড়ে গিয়েছিলো! পাশের সহযাত্রীকে বললেন, ভাই! সিগ্রেটটা তুলে দিন না প্লিজ!
তিনি তো অগ্নিশর্মা! কী! আমাকে তুলে দিতে হবে!
শহীদ ভাই বলেছিলেন, জানেন তো, মাজায় ব্যথা আমার! নিচু হতে পারি না তো! তাই!
ভদ্রলোক স্যরি বলে তুলে দিলেন সিগ্রেটটা! ঘটনাটা বলে সে যে কী হাসির দমক তাঁর!
এমনি ঝরতো গল্পের ফোয়ারা!
এইসব আড্ডায় শরিক ছিলেন সৈয়দ কামরুল, মোজাম্মেল হক, নাসিরুজ্জামান, মেহেদী আল আমিন, কামাল মাহমুদ, মিলন মাহমুদ, জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়সহ অনেকেই! আমাদের গ্রামের বাড়িতেও যেতে চেয়েছিলেন! সুন্দরবনে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হওয়ায় ডুমুরিয়ায় যাওয়া হয়নি আর! আমাদের প্রিয় নদী ভদ্রার গল্প তাঁকে টেনেছিলো খুব! কী আশ্চর্য, সেই নদী এখন কঙ্কাল!
সেখানে বসতবাড়ি! ভদ্রা বিগত হয়েছে প্রকৃতি-পিপাসু কবিরও আগে! অকালে!
৮
ঢাকা থেকে আসা অন্য অতিথিরা চলে গেলেও শহীদ ভাই আমাদের সাথে ছিলেন কিছুদিন! অকালপ্রয়াত কবি মিলন মাহমুদ তখন খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিলে! তাঁরই উদ্যোগে আমরা তিনজন নিউজপ্রিন্টের গেস্ট হিসেবে সুন্দরবনে গিয়ে এক সপ্তাহ কাটিয়েছিলাম!
নিউজপ্রিন্টের যে জাহাজটি সুন্দরবনের বাংলোতে অবস্থানকারী নিউজপ্রিন্টের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাপ্তাহিক রসদ ও খাবার-পানি সরবরাহ করতো, সেই জাহাজের কেবিনে ক’রে যাওয়া হলো! সাতদিন ছিলাম গহীন জঙ্গলে! সেখানে নষ্ট একটা জাহাজে চমৎকার বাংলো! রাতের অস্বাভাবিক নৈঃশব্দ্যের বুক চিরে পশু-পাখির কোলাহল, ভোরের আলো ফোটার মুহূর্তে বনমোরগের ডাক, হাওয়ার সুনির্মল পরশ- এসব কিছুই বিভোর করে তুলেছিলো আমাদের! বিকেলে সংরক্ষিত এলাকায় ব্যাডমিন্টন খেলার কথা মনে পড়লে আজও মনে হয়, যাই ছুটে ফের একবার!
প্রতিদিন সকালে একটা স্পিডবোট নিয়ে আমরা ঢুকতাম গভীর জঙ্গলে! সঙ্গী থাকতেন শিকারী ও গানম্যান! খালের ভিতর দিয়ে ক্রমশ ঢুকে যেতাম বনের প্রত্যন্ত সব নিভৃত অঞ্চলে! কিছু দূরে দূরে গাছের উপর মাচা বাঁধা ঘর! ওদের ভাষায় টোঙ্! বন-প্রহরীদের তাৎক্ষণিক আশ্রয়!
একদিন জানা গেলো, যে টোঙ-এর ধারে আমরা গিয়েছি, সেখানে আগের রাতে বাঘ এসেছিলো! শহীদ ভাই তো নাছোড়-বান্দা! তিনি নামবেনই! লম্বা লাইনে এগুলাম আমরা! সবার আগে গাইড, পরেই শহীদ ভাই; সবার পিছনে গানম্যান, তার সামনে আমি! দুপাশে বাঘছাপও মিললো! সারা শরীরে কাঁটা জাগছিলো ভয়ে! হঠাৎ গাইড বললেন, সাবধান সবাই! চারদিকে চোখ রেখে চলবেন! বাঘ আশেপাশে থাকলে ওঁৎ পাতবেই! লাফ দিলে পিছনের দিকেই টার্গেট করবে! আমার যে কী দশা তখন! মুহূর্তে এ্যাবাউট-টার্ন করেই শহীদ ভাইয়ের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম! সবাই ফিরলে আমার অবস্থান তখন সামনের দিকে! খুব উদ্বিগ্নচিত্তে বললাম, আর না শহীদ ভাই! চলেন ফিরি!
অনেক অনুরোধ-উপরোধ করে সেদিন তাঁকে ফিরতে রাজি করানো গিয়েছিলো! কোনো কিছুর আদ্যোপান্ত দেখার এই আকাক্সক্ষা কবিদের সহজাত বুঝি!
হংসরাজ নদীর কাছাকাছি একটা বড়ো মাঠের মতো চরটির কথা আজও ভুলতে পারি না! শক্ত-নরম মাটির ধুধু মাঠজুড়ে কেওড়াগাছের সারি! চরের সীমানায় নদীতে টলটলে পানির তিরতির ঢেউ! সমস্ত চরে নানা বয়সের হরিণগুলি জড়ো হয়েছে পানি খেতে! অসংখ্য হরিণ! শহীদ ভাই নাম দিয়েছিলেন, হরিণের হাট!
হরিণেরা পানি খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে কেওড়াগাছের ডালে বসে থাকা অগুনতি বানরের ছুঁড়ে দেওয়া কেওড়ার ফল খাচ্ছে নিরুদ্বেগে! সেই অপরূপ ছবিখানি আজও চোখ বুজলে দেখতে পাই যেন! সৃষ্টিকর্তার কী নির্ভুল নিয়ম! বিস্ময়ের ঘোর কাটে না দেখলে!
ফেরার সময়ে স্পিডবোটের ইঞ্জিন খারাপ হওয়া ছিলো নৈমিত্তিক ঘটনা! টানা বৈঠা বেয়ে ফিরতে হতো তখন! একটা চরে অনেকগুলির হরিণশাবক খেলছিলো! আমরা বোট থামিয়ে অবাক চোখে দেখছিলাম ওদের! ওরা দেখছিলো আমাদেরকে! বাচ্চাগুলির চোখে বিস্ময় ছিলো! কিন্তু কোনো উদ্বেগ দেখিনি! হঠাৎ কোত্থেকে মা-হরিণটা এসে কিছু একটা বলতেই মুহূর্তে হারিয়ে গেলো সবগুলোই!
বুঝেছিলাম বাচ্চা-হরিণগুলি তখনো মানুষ দেখেনি, মানুষের নিষ্ঠুরতার পরিচয় জানেনি! পোড়-খাওয়া মা-হরিণটা জানিয়ে দিতেই ছুটলো দিগিদিক!
সুন্দরবন থেকে ফিরে শহীদ ভাই একটা কবিতা লিখেছিলেন! মা-হরিণের শঙ্কার কারণটাকে কী নির্মম নির্লিপ্ততায় যে এঁকেছিলেন! আমিও লিখেছিলাম একটা!
৯
একসময়ে আমরা ব্যবসার উদ্যোগও নিয়েছিলাম! শহীদ ভাই, সুমন (আবিদ আজাদ) ও আমি মিলে গড়ে তুলেছিলাম একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান! ‘ত্রিকাল’! আইডিয়াটা শহীদ ভাইয়েরই ছিলো! প্রিন্টিং অ্যান্ড পাবলিকেশন-নির্ভর ব্যবসা! সাতাত্তরের প্রথম থেকে কী অমানবিক পরিশ্রম যে করেছিলাম আবিদ আর আমি! সকালে নাস্তা সেরে বেরুতাম! সারাদিন কাজের সন্ধানে ঘুরে সন্ধ্যায় শহীদ ভাইকে রিপোর্ট করতাম!
শহীদ ভাইয়ের বড়োভাই শাহেদ কাদরী তখন একটি সরকারি কর্পোরেশনের কর্তাব্যক্তি! তাঁর পরামর্শ ও সক্রিয় সহযোগিতায় কেবল একটি কাজের ওয়ার্কঅর্ডার পেয়েছি যখন, ঠিক তখনই বিশেষ কারণে কলেজের চাকরি নিয়ে আমাকে খুলনায় ফিরতে হলো! আর যুক্ত থাকার সুযোগ পাইনি! শুনেছিলাম আমি ছেড়ে আসার পরে শহীদ ভাইও নিজেকে গুটিয়ে নেন! আবিদ আজাদ আমৃত্যু ‘শিল্পতরু’ নামে ব্যবসাটা চালিয়ে গেছে!
১০
সেই শহীদ কাদরী নেই আজ! তাঁর নশ্বর দেহটা তাঁরই অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী প্রিয়ভূমিতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিলো! গোটা জাতি বিনম্র শ্রদ্ধায় অন্তিম-বিদায় জানিয়েছে কবিকে! শহীদ মিনারের পবিত্র ছায়ায় রাখা প্রিয় মানুষটির কফিন ফুলে ফুলে ঢেকে গিয়েছিলো! দূরে বসে টিভি ও পত্রিকার ছবিতে দেখে নিঃশব্দে কেঁদেছি! অসুস্থতার কারণে ছুটে যেতে পারিনি ঢাকায়! স্মৃতিময়তায় ডুবে ঘটমান ছবিগুলি কল্পনায় দেখেছি কেবল!
১১
আমরাও তো আসছি শহীদ ভাই! ওই লোকান্তর ভুবনে হয়তো ফের দেখা হবে!
প্রিয় কবি! যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন! আল্লাহ্ রাব্বুল আ’লামিন আপনার সহায় হোন! আমিন!