শহীদ কাদরী
ওবায়েদ আকাশ
সকল অনাসৃষ্টির ধকল উজিয়ে, উজ্জ্বল তীক্ষè সোনালি কাঁটার মতো কবির কবিতা একদিন দূর ঔজ্জ্বল্য ভেদ করে চলে যায় অন্য লোকান্তরে; যেখানে বসবাস করে আমাদের অদেখা উত্তরাধিকার, আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যুগান্তকারী সমাধান। ফুটবলের মতো সময় গড়াতে গড়াতে একদিন খুঁজে পায় নদীর ঢালের মতো নিষ্কটক গড়ান, এবং অনায়াসে ভেসে মিলে যায় ¯্রােত-নিরবধিতে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কর্তব্য তো আমরা পালন করি যৎসামান্যই। অনুপ্রবিষ্ট আলস্যপনা আর গতানুগতিকতার উল্লম্ফ ঘোড়ায় উঠে পড়ি লাগাম না ধরেই। কখনো পালাবার মতো অরণ্যপথ যেমন একদিকে, অন্যদিকে বেছে নিই অর্থহীন কিংবা চাকচিক্যময় চোখ ধাঁধানো রঙিন গালিচা বিছানো পথ। রাশি রাশি ছেটানো পাপড়ি আর গোলাপজলে সিক্ত হয়ে লাল গালিচা উড়িয়ে নিয়ে চলে জন্মান্ধ ঘোড়া। তাই পথের পাশে এলানো লুকানো মহার্ঘ পুষ্পের সন্ধান আমাদের চোখে পড়ে অতি সামান্যই। কিংবা কখনো সে আশাও আমাদের থাকতে দেই না যে কার সুবাস দিয়ে আমরা শ্বাস নেবো আর কাকে মাড়িয়ে চলে যাবো দূর হাতছানিকে লক্ষ্য-সীমানা করে। পায়ে পায়ে শনাক্তযোগ্য পথই যখন আমাদের নিয়তি, আমাদের জন্য অনিবার্য বন্ধ্যত্ব তখন বিধৃত অন্ধকারে ঝিঁঝিদের মতো মুখ টিপে হেসে আমাদের পৌঁছে দেয় আবার পুরনো দিনের গতানুগতিক ধারাবাহিকতায়। ফলে আমরা পড়ে থাকি সেই জন্মতিমিরেই; এবং এক বয়োবৃদ্ধ অন্ধকার এসে আমাদের টেনে নিয়ে যায়, সেই জন্মান্ধ পূর্বপুরুষের চিরচেনা নীড়ে। আর ব্যতিক্রম যারা তাদের জন্য উপরে বর্ণিত কথাগুলো বিভার্স করে অনুধাবন করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
এমন একজন জীবনের গতানুগতিকতায় পা-না-ফেলা মানুষ কবি শহীদ কাদরী। তিনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পথের পাশের আগাছাগুলো ঝেড়ে দেখেছেন; দুই আঁজলা ভরে অন্ধকার পান করে দিনের পর দিন তাকে আলো হয়ে ভেসে উঠতে পথ করে দিয়েছেন। শেষাবধি অভিনিবিষ্ট এক ¯্রষ্টার আসনে বসে শনাক্ত করেছেন চারদিকের অসংলগ্নতা, জাগিয়ে তুলেছেন প্রেম, হৃদয় খুঁড়ে তুলে এনেছেন মানবিকতা, প্রেমহীন হৃদয়ের বিশুষ্কতা এবং ইহিতাস, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অসংলগ্নতা। এবং একইভাবে তিনি নিজেও ওই আলো-না-পড়া বাগানবৃক্ষটি হয়ে আজীবন পেয়ে এসেছেন অবহেলা, অনাদর, অস্বীকৃতি, অমূল্যায়নের মতো অসহনীয় অভিঘাতগুলো। দিনে দিনে তার নভোনীলিমায় গজিয়ে উঠেছে অভিমানের মতো বিষাদছায়াবৃক্ষ। চোখ ভরা কুয়াশা আর বুক ফুলে ওঠা বিষাদ যাতনা নিয়ে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলেন দূর পরদেশে, প্রবাসে-
দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকিভরা
এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা
দিগন্তের শান্ত দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।
জীবনকে শ্বাপদসংকুল করে তুলেছো
এবং আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর
তোমাদের তাক করা বন্দুকের নল।
ঝোপে ঝাড়ে সরীসৃপের মতো মতন বুকে
নিরাপদ নিভৃত কুটির খুঁজতে হয়েছে আমাকে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।
[তাই এই দীর্ঘ পরবাস, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও]
আর দীর্ঘ আটত্রিশ বছর দেশের জন্য কেঁদেকেটে, আকুলিবিকুলি করে শেষতক ফিরে এসেছেন প্রাণহীন নিথর দেহে কাক্সিক্ষত নিজ দেশে।
তারো আগে মাত্র বারো তেরো বছর বয়সে প্রিয় জন্মমাটি কলকাতা ছেড়ে আসার বেদনা যেন তখন শুকিয়ে যাওয়া ঝরাপাতার মতো লুকিয়ে ছিল হৃদয়ের নিভৃত ব্যাখ্যায়। ঢাকায় এসে শেকড়হীনতার সংকট, সাহিত্যিক রাজনীতি, দলবাজি, চালবাজির কবলে পড়ে একদিন ছেড়ে দিতে হয়েছিল প্রিয় বাংলাদেশ। অপরিচিত হয়ে উঠেছিল প্রিয় বন্ধুর মুখ, পরিচিত চারপাশ, সুন্দর আকাশ, নদীর ¯্রােত, কবিতার আরাধ্য আকাশ। আর একদিন কৃত্রিম ডানায় ভর করে উড়ে যেতে হলো অচেনা মানুষ অজানা মাটির দেশে। এবং আমৃত্যু কাটিয়ে দিলেন শেষ বিভুঁই মার্কিন দেশে। দেশ ছাড়ার প্রক্কালে অন্য সবকিছুর মতো কবিতার আরাধ্য আকাশও যে ক্রমে অচেনা হয়ে ওঠে। এর অন্যতম প্রমাণ তিনি এই দীর্ঘ আটত্রিশ বছরে রচনা করেছেন একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। অন্যদিকে কবিতামাতালকালে ’৬৪ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত রচনা করেছেন তিনিটি কবিতাগ্রন্থ- উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ও কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এছাড়া ছড়ানো ছিটানো রয়েছে এই সময়ে করা তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম ও প্রবন্ধনিবন্ধ জাতীয় রচনা।
দীর্ঘ পরবাসকালে একটিমাত্র গ্রন্থ ছাড়া তার আরো কিছু কবিতার হদিস মিললেও তা একটি গ্রন্থাকারে প্রকাশসংখ্যাতুল্য কিনা, বিবেচ্য। বলতেই হয় যে তবু ভাগ্যবান তিনি, এই যৎসামান্য রচনাই তাকে দিয়ে গেল অমরত্বের আসন, দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের অনুপস্থিতিও ভুলতে দেয়নি ক্ষীণকায় তার তিনটি গ্রন্থ। কী আছে এই তিনটি গ্রন্থে যে, একজন কবিকে এভাবে স্মরণে রাখতে সহায়তা করতে পারে?
শহীদ কাদরীর কবিতা শানানো ফলার অধিক তীক্ষèতর হয়ে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে অভ্যস্ত। তিনি শব্দের সঙ্গে শব্দের বিপজ্জনক মিলন ঘটাতে পারেন, তা এক পর্যায়ে তার অনিবার্যতাকে নির্দেশ করে। তিনি শব্দকে যথার্থ শব্দ দিয়ে ঘায়েল করতে গিয়ে যে জাদুকরি আবহ তৈরি করেন, পাঠক তার মোহে বারবার শহীদ কাদরীর কবিতার কাছে ফেরে। তার ক্ষীণকায় স্বল্পসংখ্যক বইয়ে তিনি কিছু মৌলিক বিষয়কে ধারণ করেছেন, যার অন্যতম- তার পৃথিবীতে আবির্ভাবের ক্ষণটি তিনি ভাষা দিয়েছেন এক সংহারক সুর ও শব্দ মূর্ছনায়।
জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে-
সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিলো যেন
দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে
নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।
কাঁটা-তারে ঘেরা পার্ক, তাঁবু, কুচকাওয়াজ সারিবদ্ধ
সৈনিকের। হিরন্ময় রৌদ্রে শুধু জ্বলজ্বলে গম্ভীর কামান,
ভোরবেলা সচকিত পদশব্দে ঝোড়ো বিউগলে
গাছ-পালা, ঘরবাড়ি হঠাৎ বদলে গেছে রাঙা রণাঙ্গনে।
[উত্তরাধিকার]
কবিতায় তার শব্দ ও উচ্চারণের ঝঙ্কার বলে দেয় তিনি শব্দসখ্যের মাধুর্ষ নির্মাণে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে আগ্রহী নন। এমনকি তিনি একেবারে ঢিলেঢালা বা এলানো গোছের একটি পঙ্ক্তিও তার কোনো কাব্যশরীরে মানিয়ে নিতে রাজি নন। তার কবিতায় চাই টানটান উল্লম্ফগতি, এবং সাবলীলভাবে ভাষা ও ভাবের চলার স্বাচ্ছন্দ্য।
মানবজীবনের আর একটি মৌলিক অনুষঙ্গ প্রেম। এই প্রেমকে শহীদ কাদরী মানব মানবীর পর্যায় থেকে শুরু করে দেশপ্রেম পর্যন্ত এনে ঠেকিয়েছেন। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই প্রেমের বহুমুখ খুলে তার অসীমতা নিশ্চিত করেছেন। যেমন ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি তার অনন্য উদারহরণ হতে পারে-
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
কিংবা একই কবিতায় যখন বলেন-
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।
প্রেমের আবহ ও প্রকৃতি বদলে বদলে এমন এক বিস্তারে রূপ পায় যা শুধু সার্বজনীনই নয়, সর্বকেন্দ্রিক। সেখানে দেশপ্রেম থেকে মানবপ্রেম থেকে প্রকৃতি প্রেম থেকে কী-না থাকে।
আরো একটি অপরিহার্য অধ্যায় মানব জীবনকে ঘিরে প্রতিনিয়ত তার প্রভাব অব্যাহত রেখেছে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে অনুভূতিশীল মানবমনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটি। মানুষ মূলত বিরহকামী নাকি মিলন প্রত্যাশী? মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে। যিনি নারীর হৃদয়, প্রেম, গৃহ, অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা পেয়েই যে মানব হৃদয় তৃপ্ত নয়, আরো এক আকাক্সক্ষা, আরো এক অপার বিস্ময় যে মানবমনকে ক্লান্ত করে, তা শনাক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে শহীদ কাদরী শনাক্ত করলেন, মানুষ যতই মিলনাকাক্সক্ষী হোক না কেন, মিলনেও কখনো শান্তি মেলে না।
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
[‘সঙ্গতি’]
শহীদ কাদরী বিষয় ও ভাবের গভীরতায় যেমন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক চমক দেখিয়েছেন, বিপরীতে কাব্যের ত্রিকালদর্শী অন্বেষায় মানুষের নিজের বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি শনাক্ত করেছেন চিরাচরিত রাষ্ট্রের চরিত্র, রাষ্ট্রের গূঢ়ার্থ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মতো সুদূরান্বেষী অন্বয়গুলো। এসব ব্যাপারে গণমানুষ যেখানে মুখ খুলতে তটস্থ, যেখানে সত্যোচ্চারণে ভীত, তখন কবির উচ্চারণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। শহীদ কাদরী সেইসব চাতক মানুষের মুখে এভাবে বৃষ্টিধারার মতো কবিতার পঙ্ক্তি তুলে দিয়ে আসেন।
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪-ধারা,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে ধাবমান খাকি,
জিপের পেছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি,
কাঠগড়া, গরাদের সারি সারি খোপ,
কাতারে কাতারে রাজবন্দি;
রাষ্ট্র বললেই মনে হয় মিছিল থেকে না-ফেরা
কনিষ্ঠ সহোদরের মুখ
রাষ্ট্র বললেই মনে হয় তেজগাঁ
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা,
হাসপাতালে আহত মজুরের মুখ।
[রাষ্ট্রমানেই লেফ্ট্ রাইট লেফ্ট্]
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যে ক’জন কবি এভাবে মৌলিক সত্য উচ্চারণ করে তাদের কবিতাকে জনমানুষের আকাক্সক্ষার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে শহীদ কাদরী অন্যতম। এক্ষেত্রে তার অপর দুই বন্ধু শামসুর রাহমন ও আল মাহমুদের গন্তব্য রচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথে। বলাই যায় শহীদ কাদরী বাঙালির শাশ্বত ভাষার কবি; শহীদ কাদরী প্রেম প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রিক অসংলগ্নতার বিরুদ্ধে সত্যোচ্চাণের কবি।
শহীদ কাদরী আরো বেশি মহান ও মহত্তর হয়ে ওঠেন তাঁর সূক্ষ্ম মানবিকবোধগুলো যখন অনায়াস সাধ্যে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন। প্রাণিদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী কবি, পানিতে পড়ে যাওয়া একটি পিঁপড়েকে ডাঙায় তুলে আনার জন্য তাঁর ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। চিকন বঁটিতে কেটে ফেলা একটি মাছের জীবনাবসান তাঁর মনকে রক্তাক্ত করে, তিনি কবিতায় তুলে আনেন অসহায় পতিতাদের অবদানের কথা। তিনি রচনা করেন ‘আলোকিত গণিকাবৃন্দ’।
ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা
কানাকড়ির মূল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিকূলে তা নেই
অচির মুহূর্তের ঘরে তোমরাই তো উজ্জ্বল ঘরণী
ভ্রাম্যমানেরে ফিরিয়ে দিলে ঘরের আঘ্রাণ,
তোমাদের স্তব বৈ সকল মূল্যবোধ যেন ম্লান!
হয়তো এই বোধ ক্ষণে অক্ষণে আলো-ছায়ার আধারিতে আমাদেরকেও ছুঁয়ে যায়। কিন্তু তা আমরা ধরে রাখতে কতটুকু ব্যয় করে থাকি, তা বিবেচ্য। কিন্তু শহীদ কাদরী তাকে চিরদিনের ভাষায় স্মরণীয় করে রাখতে পারেন। কবি শহীদ কাদরীর এই মহত্ত্ব এক মহামানবের তুল্যে বিবেচ্য তো অবশ্যই। সুতরাং শহীদ কাদরী বাংলা ভাষা ও বাঙালির হয়ে, আন্তর্জাতিক বোধে যখন শুধু বাংলা ও বাঙালি বন্দনায় নিজের সাহিত্য জীবনকে উৎসর্গ করেন, তখন সেই জাতিকে তিনি একই সঙ্গে ভাগ্যবান করে তোলেন সন্দেহ নেই। তাই শহীদ কাদরী তার জীবনের দীর্ঘ সময় প্রবাসে অতিবাহিত করলেও বাঙালি কোনো দিন তাঁর কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না।
যে মানুষ বিশ্বের সেরা ক্ষমতাধর দেশের অনায়াস নাগরিকত্ব পেয়েও শুধুমাত্র বাঙালি পরিচয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছায় তা গ্রহণ করেন না, যে মানুষ বিদেশ বিভুঁইয়ে বসেও তাঁর শেষ চুম্বনগুলো বাঙালিকে উৎসর্গ করে যান- তাঁর ঋণ বাঙালি কখনো ভুলে যেতে পারে না। তাঁর মনুষ্যত্ব কখনো সাধারণ বলে বিবেচ্য হতে পারে না।
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু
শুধু তুমি,
আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।
[আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও]
সুদূর মার্কিন মুল্লুকে বসে যার প্রাণ আষাঢ়ে শ্রাবণে ভেজা বংলার মাটির জন্য সারাক্ষণ হাহাকার করে বেড়ায় তাকে ছাড়া বাঙালিও যে একদ- থাকতে পারে না, মৃত্যুর পরে হলেও তাঁকে দেশে এনে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ।
ব্যক্তি জীবনে শহীদ কাদরী তিনজন স্ত্রীর পাণি গ্রহক করেন। প্রথম ও সাবেক স্ত্রী নাজমুননেসা পিয়ারী, দ্বিতীয় ও সাবেক স্ত্রী আমেরিকাবাসী ইহুদী নারী ডেনা (প্রয়াত) এবং সর্বশেষ স্ত্রী নীরা কাদরী।
কবিতা লেখার বাইরে শহীদ কাদরী বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করতে পছন্দ করলেও তিনি তা প্রকাশ করতে চাননি। ‘অমৃতের সন্তান’ নামে অনুবাদ করেছেন ইউজিন ও’নীলের একটি অনবদ্য নাটক, যেখানে দেখা যাবে পাশ্চাত্যের সাদা-কালো তরুণ-তরুণীর প্রেম-উপখ্যান। অনুবাদ করেছেন তাঁর প্রিয় কবি পাবলো নেরুদা, কনস্তানতিন কাভাফি ও আন্তোনিন বার্তুসেকের কবিতা।
আমরা শহীদ কাদরীতে আরো আরো পাঠের ভিতর দিয়ে আপদনখশির এই বাঙালিকে যথার্থ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারি।
শহীদ কাদরী
ওবায়েদ আকাশ
বৃহস্পতিবার, ২৯ আগস্ট ২০২৪
সকল অনাসৃষ্টির ধকল উজিয়ে, উজ্জ্বল তীক্ষè সোনালি কাঁটার মতো কবির কবিতা একদিন দূর ঔজ্জ্বল্য ভেদ করে চলে যায় অন্য লোকান্তরে; যেখানে বসবাস করে আমাদের অদেখা উত্তরাধিকার, আমাদের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের যুগান্তকারী সমাধান। ফুটবলের মতো সময় গড়াতে গড়াতে একদিন খুঁজে পায় নদীর ঢালের মতো নিষ্কটক গড়ান, এবং অনায়াসে ভেসে মিলে যায় ¯্রােত-নিরবধিতে। সেদিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের কর্তব্য তো আমরা পালন করি যৎসামান্যই। অনুপ্রবিষ্ট আলস্যপনা আর গতানুগতিকতার উল্লম্ফ ঘোড়ায় উঠে পড়ি লাগাম না ধরেই। কখনো পালাবার মতো অরণ্যপথ যেমন একদিকে, অন্যদিকে বেছে নিই অর্থহীন কিংবা চাকচিক্যময় চোখ ধাঁধানো রঙিন গালিচা বিছানো পথ। রাশি রাশি ছেটানো পাপড়ি আর গোলাপজলে সিক্ত হয়ে লাল গালিচা উড়িয়ে নিয়ে চলে জন্মান্ধ ঘোড়া। তাই পথের পাশে এলানো লুকানো মহার্ঘ পুষ্পের সন্ধান আমাদের চোখে পড়ে অতি সামান্যই। কিংবা কখনো সে আশাও আমাদের থাকতে দেই না যে কার সুবাস দিয়ে আমরা শ্বাস নেবো আর কাকে মাড়িয়ে চলে যাবো দূর হাতছানিকে লক্ষ্য-সীমানা করে। পায়ে পায়ে শনাক্তযোগ্য পথই যখন আমাদের নিয়তি, আমাদের জন্য অনিবার্য বন্ধ্যত্ব তখন বিধৃত অন্ধকারে ঝিঁঝিদের মতো মুখ টিপে হেসে আমাদের পৌঁছে দেয় আবার পুরনো দিনের গতানুগতিক ধারাবাহিকতায়। ফলে আমরা পড়ে থাকি সেই জন্মতিমিরেই; এবং এক বয়োবৃদ্ধ অন্ধকার এসে আমাদের টেনে নিয়ে যায়, সেই জন্মান্ধ পূর্বপুরুষের চিরচেনা নীড়ে। আর ব্যতিক্রম যারা তাদের জন্য উপরে বর্ণিত কথাগুলো বিভার্স করে অনুধাবন করলেই পরিষ্কার হয়ে যায়।
এমন একজন জীবনের গতানুগতিকতায় পা-না-ফেলা মানুষ কবি শহীদ কাদরী। তিনি জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে পথের পাশের আগাছাগুলো ঝেড়ে দেখেছেন; দুই আঁজলা ভরে অন্ধকার পান করে দিনের পর দিন তাকে আলো হয়ে ভেসে উঠতে পথ করে দিয়েছেন। শেষাবধি অভিনিবিষ্ট এক ¯্রষ্টার আসনে বসে শনাক্ত করেছেন চারদিকের অসংলগ্নতা, জাগিয়ে তুলেছেন প্রেম, হৃদয় খুঁড়ে তুলে এনেছেন মানবিকতা, প্রেমহীন হৃদয়ের বিশুষ্কতা এবং ইহিতাস, মুক্তিযুদ্ধ, রাজনৈতিক অসংলগ্নতা। এবং একইভাবে তিনি নিজেও ওই আলো-না-পড়া বাগানবৃক্ষটি হয়ে আজীবন পেয়ে এসেছেন অবহেলা, অনাদর, অস্বীকৃতি, অমূল্যায়নের মতো অসহনীয় অভিঘাতগুলো। দিনে দিনে তার নভোনীলিমায় গজিয়ে উঠেছে অভিমানের মতো বিষাদছায়াবৃক্ষ। চোখ ভরা কুয়াশা আর বুক ফুলে ওঠা বিষাদ যাতনা নিয়ে একদিন পাড়ি জমিয়েছিলেন দূর পরদেশে, প্রবাসে-
দু টুকরো রুটি কিংবা লাল শানকিভরা
এবং নক্ষত্রকুচির মতন কিছু লবণের কণা
দিগন্তের শান্ত দাওয়ায় আমাকে চাও নি তুমি দিতে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।
জীবনকে শ্বাপদসংকুল করে তুলেছো
এবং আমার প্রতিটি পদক্ষেপের ওপর
তোমাদের তাক করা বন্দুকের নল।
ঝোপে ঝাড়ে সরীসৃপের মতো মতন বুকে
নিরাপদ নিভৃত কুটির খুঁজতে হয়েছে আমাকে-
তাই এই দীর্ঘ পরবাস।
[তাই এই দীর্ঘ পরবাস, আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও]
আর দীর্ঘ আটত্রিশ বছর দেশের জন্য কেঁদেকেটে, আকুলিবিকুলি করে শেষতক ফিরে এসেছেন প্রাণহীন নিথর দেহে কাক্সিক্ষত নিজ দেশে।
তারো আগে মাত্র বারো তেরো বছর বয়সে প্রিয় জন্মমাটি কলকাতা ছেড়ে আসার বেদনা যেন তখন শুকিয়ে যাওয়া ঝরাপাতার মতো লুকিয়ে ছিল হৃদয়ের নিভৃত ব্যাখ্যায়। ঢাকায় এসে শেকড়হীনতার সংকট, সাহিত্যিক রাজনীতি, দলবাজি, চালবাজির কবলে পড়ে একদিন ছেড়ে দিতে হয়েছিল প্রিয় বাংলাদেশ। অপরিচিত হয়ে উঠেছিল প্রিয় বন্ধুর মুখ, পরিচিত চারপাশ, সুন্দর আকাশ, নদীর ¯্রােত, কবিতার আরাধ্য আকাশ। আর একদিন কৃত্রিম ডানায় ভর করে উড়ে যেতে হলো অচেনা মানুষ অজানা মাটির দেশে। এবং আমৃত্যু কাটিয়ে দিলেন শেষ বিভুঁই মার্কিন দেশে। দেশ ছাড়ার প্রক্কালে অন্য সবকিছুর মতো কবিতার আরাধ্য আকাশও যে ক্রমে অচেনা হয়ে ওঠে। এর অন্যতম প্রমাণ তিনি এই দীর্ঘ আটত্রিশ বছরে রচনা করেছেন একটিমাত্র কাব্যগ্রন্থ ‘আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও’। অন্যদিকে কবিতামাতালকালে ’৬৪ থেকে ’৭৮ পর্যন্ত রচনা করেছেন তিনিটি কবিতাগ্রন্থ- উত্তরাধিকার, তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা ও কোথাও কোনো ক্রন্দন নেই। এছাড়া ছড়ানো ছিটানো রয়েছে এই সময়ে করা তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ অনুবাদকর্ম ও প্রবন্ধনিবন্ধ জাতীয় রচনা।
দীর্ঘ পরবাসকালে একটিমাত্র গ্রন্থ ছাড়া তার আরো কিছু কবিতার হদিস মিললেও তা একটি গ্রন্থাকারে প্রকাশসংখ্যাতুল্য কিনা, বিবেচ্য। বলতেই হয় যে তবু ভাগ্যবান তিনি, এই যৎসামান্য রচনাই তাকে দিয়ে গেল অমরত্বের আসন, দীর্ঘ আটত্রিশ বছরের অনুপস্থিতিও ভুলতে দেয়নি ক্ষীণকায় তার তিনটি গ্রন্থ। কী আছে এই তিনটি গ্রন্থে যে, একজন কবিকে এভাবে স্মরণে রাখতে সহায়তা করতে পারে?
শহীদ কাদরীর কবিতা শানানো ফলার অধিক তীক্ষèতর হয়ে পাঠকের হৃদয়ে প্রবেশ করে অভ্যস্ত। তিনি শব্দের সঙ্গে শব্দের বিপজ্জনক মিলন ঘটাতে পারেন, তা এক পর্যায়ে তার অনিবার্যতাকে নির্দেশ করে। তিনি শব্দকে যথার্থ শব্দ দিয়ে ঘায়েল করতে গিয়ে যে জাদুকরি আবহ তৈরি করেন, পাঠক তার মোহে বারবার শহীদ কাদরীর কবিতার কাছে ফেরে। তার ক্ষীণকায় স্বল্পসংখ্যক বইয়ে তিনি কিছু মৌলিক বিষয়কে ধারণ করেছেন, যার অন্যতম- তার পৃথিবীতে আবির্ভাবের ক্ষণটি তিনি ভাষা দিয়েছেন এক সংহারক সুর ও শব্দ মূর্ছনায়।
জন্মেই কুঁকড়ে গেছি মাতৃজরায়ন থেকে নেমে-
সোনালি পিচ্ছিল পেট আমাকে উগরে দিলো যেন
দীপহীন ল্যাম্পপোস্টের নিচে, সন্ত্রস্ত শহরে
নিমজ্জিত সবকিছু, রুদ্ধচক্ষু সেই ব্ল্যাক-আউটে আঁধারে।
কাঁটা-তারে ঘেরা পার্ক, তাঁবু, কুচকাওয়াজ সারিবদ্ধ
সৈনিকের। হিরন্ময় রৌদ্রে শুধু জ্বলজ্বলে গম্ভীর কামান,
ভোরবেলা সচকিত পদশব্দে ঝোড়ো বিউগলে
গাছ-পালা, ঘরবাড়ি হঠাৎ বদলে গেছে রাঙা রণাঙ্গনে।
[উত্তরাধিকার]
কবিতায় তার শব্দ ও উচ্চারণের ঝঙ্কার বলে দেয় তিনি শব্দসখ্যের মাধুর্ষ নির্মাণে বিন্দুমাত্র ছাড় দিতে আগ্রহী নন। এমনকি তিনি একেবারে ঢিলেঢালা বা এলানো গোছের একটি পঙ্ক্তিও তার কোনো কাব্যশরীরে মানিয়ে নিতে রাজি নন। তার কবিতায় চাই টানটান উল্লম্ফগতি, এবং সাবলীলভাবে ভাষা ও ভাবের চলার স্বাচ্ছন্দ্য।
মানবজীবনের আর একটি মৌলিক অনুষঙ্গ প্রেম। এই প্রেমকে শহীদ কাদরী মানব মানবীর পর্যায় থেকে শুরু করে দেশপ্রেম পর্যন্ত এনে ঠেকিয়েছেন। এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই প্রেমের বহুমুখ খুলে তার অসীমতা নিশ্চিত করেছেন। যেমন ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’ কবিতাটি তার অনন্য উদারহরণ হতে পারে-
ভয় নেই, আমি এমন ব্যবস্থা করবো
বন-বাদাড় ডিঙ্গিয়ে
কাঁটা-তার, ব্যারিকেড পার হয়ে, অনেক রণাঙ্গনের স্মৃতি নিয়ে
আর্মার্ড-কারগুলো এসে দাঁড়াবে
ভায়োলিন বোঝাই করে
কেবল তোমার দোরগোড়ায় প্রিয়তমা।
কিংবা একই কবিতায় যখন বলেন-
ভয় নেই আমি এমন ব্যবস্থা করবো মুদ্রাস্ফীতি কমে গিয়ে বেড়ে যাবে
শিল্পোত্তীর্ণ কবিতার সংখ্যা প্রতিদিন
আমি এমন ব্যবস্থা করবো গণরোষের বদলে
গণচুম্বনের ভয়ে
হন্তারকের হাত থেকে পড়ে যাবে ছুরি, প্রিয়তমা।
প্রেমের আবহ ও প্রকৃতি বদলে বদলে এমন এক বিস্তারে রূপ পায় যা শুধু সার্বজনীনই নয়, সর্বকেন্দ্রিক। সেখানে দেশপ্রেম থেকে মানবপ্রেম থেকে প্রকৃতি প্রেম থেকে কী-না থাকে।
আরো একটি অপরিহার্য অধ্যায় মানব জীবনকে ঘিরে প্রতিনিয়ত তার প্রভাব অব্যাহত রেখেছে, আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে অনুভূতিশীল মানবমনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটি। মানুষ মূলত বিরহকামী নাকি মিলন প্রত্যাশী? মনে পড়ে জীবনানন্দ দাশকে। যিনি নারীর হৃদয়, প্রেম, গৃহ, অর্থ, কীর্তি, সচ্ছলতা পেয়েই যে মানব হৃদয় তৃপ্ত নয়, আরো এক আকাক্সক্ষা, আরো এক অপার বিস্ময় যে মানবমনকে ক্লান্ত করে, তা শনাক্ত করেছিলেন। অন্যদিকে শহীদ কাদরী শনাক্ত করলেন, মানুষ যতই মিলনাকাক্সক্ষী হোক না কেন, মিলনেও কখনো শান্তি মেলে না।
বন্য শূকর খুঁজে পাবে প্রিয় কাদা
মাছরাঙা পাবে অন্বেষণের মাছ,
কালো রাতগুলো বৃষ্টিতে হবে শাদা
ঘন জঙ্গলে ময়ূর দেখাবে নাচ
প্রেমিক মিলবে প্রেমিকার সাথে ঠিক-ই
কিন্তু শান্তি পাবে না, পাবে না, পাবে না...
[‘সঙ্গতি’]
শহীদ কাদরী বিষয় ও ভাবের গভীরতায় যেমন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এক চমক দেখিয়েছেন, বিপরীতে কাব্যের ত্রিকালদর্শী অন্বেষায় মানুষের নিজের বিচক্ষণতার প্রমাণ দিয়েছেন। তিনি শনাক্ত করেছেন চিরাচরিত রাষ্ট্রের চরিত্র, রাষ্ট্রের গূঢ়ার্থ ও রাষ্ট্রের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের মতো সুদূরান্বেষী অন্বয়গুলো। এসব ব্যাপারে গণমানুষ যেখানে মুখ খুলতে তটস্থ, যেখানে সত্যোচ্চারণে ভীত, তখন কবির উচ্চারণের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। শহীদ কাদরী সেইসব চাতক মানুষের মুখে এভাবে বৃষ্টিধারার মতো কবিতার পঙ্ক্তি তুলে দিয়ে আসেন।
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে রেসকোর্সের কাঁটাতার,
কারফিউ, ১৪৪-ধারা,
রাষ্ট্র বললেই মনে পড়ে ধাবমান খাকি,
জিপের পেছনে মন্ত্রীর কালো গাড়ি,
কাঠগড়া, গরাদের সারি সারি খোপ,
কাতারে কাতারে রাজবন্দি;
রাষ্ট্র বললেই মনে হয় মিছিল থেকে না-ফেরা
কনিষ্ঠ সহোদরের মুখ
রাষ্ট্র বললেই মনে হয় তেজগাঁ
ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা,
হাসপাতালে আহত মজুরের মুখ।
[রাষ্ট্রমানেই লেফ্ট্ রাইট লেফ্ট্]
গত শতকের পঞ্চাশের দশকে যে ক’জন কবি এভাবে মৌলিক সত্য উচ্চারণ করে তাদের কবিতাকে জনমানুষের আকাক্সক্ষার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন, তাদের মধ্যে শহীদ কাদরী অন্যতম। এক্ষেত্রে তার অপর দুই বন্ধু শামসুর রাহমন ও আল মাহমুদের গন্তব্য রচিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পথে। বলাই যায় শহীদ কাদরী বাঙালির শাশ্বত ভাষার কবি; শহীদ কাদরী প্রেম প্রতিবাদ ও রাষ্ট্রিক অসংলগ্নতার বিরুদ্ধে সত্যোচ্চাণের কবি।
শহীদ কাদরী আরো বেশি মহান ও মহত্তর হয়ে ওঠেন তাঁর সূক্ষ্ম মানবিকবোধগুলো যখন অনায়াস সাধ্যে কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে পারেন। প্রাণিদের সমান অধিকারে বিশ্বাসী কবি, পানিতে পড়ে যাওয়া একটি পিঁপড়েকে ডাঙায় তুলে আনার জন্য তাঁর ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন তাঁর কবিতায়। চিকন বঁটিতে কেটে ফেলা একটি মাছের জীবনাবসান তাঁর মনকে রক্তাক্ত করে, তিনি কবিতায় তুলে আনেন অসহায় পতিতাদের অবদানের কথা। তিনি রচনা করেন ‘আলোকিত গণিকাবৃন্দ’।
ক্ষণকাল সে নকল স্বর্গলোকের আমি নতজানু রাজা
কানাকড়ির মূল্যে যা দিলে জীবনের ত্রিকূলে তা নেই
অচির মুহূর্তের ঘরে তোমরাই তো উজ্জ্বল ঘরণী
ভ্রাম্যমানেরে ফিরিয়ে দিলে ঘরের আঘ্রাণ,
তোমাদের স্তব বৈ সকল মূল্যবোধ যেন ম্লান!
হয়তো এই বোধ ক্ষণে অক্ষণে আলো-ছায়ার আধারিতে আমাদেরকেও ছুঁয়ে যায়। কিন্তু তা আমরা ধরে রাখতে কতটুকু ব্যয় করে থাকি, তা বিবেচ্য। কিন্তু শহীদ কাদরী তাকে চিরদিনের ভাষায় স্মরণীয় করে রাখতে পারেন। কবি শহীদ কাদরীর এই মহত্ত্ব এক মহামানবের তুল্যে বিবেচ্য তো অবশ্যই। সুতরাং শহীদ কাদরী বাংলা ভাষা ও বাঙালির হয়ে, আন্তর্জাতিক বোধে যখন শুধু বাংলা ও বাঙালি বন্দনায় নিজের সাহিত্য জীবনকে উৎসর্গ করেন, তখন সেই জাতিকে তিনি একই সঙ্গে ভাগ্যবান করে তোলেন সন্দেহ নেই। তাই শহীদ কাদরী তার জীবনের দীর্ঘ সময় প্রবাসে অতিবাহিত করলেও বাঙালি কোনো দিন তাঁর কৃতিকে অস্বীকার করতে পারে না।
যে মানুষ বিশ্বের সেরা ক্ষমতাধর দেশের অনায়াস নাগরিকত্ব পেয়েও শুধুমাত্র বাঙালি পরিচয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছায় তা গ্রহণ করেন না, যে মানুষ বিদেশ বিভুঁইয়ে বসেও তাঁর শেষ চুম্বনগুলো বাঙালিকে উৎসর্গ করে যান- তাঁর ঋণ বাঙালি কখনো ভুলে যেতে পারে না। তাঁর মনুষ্যত্ব কখনো সাধারণ বলে বিবেচ্য হতে পারে না।
স্বনির্বাচিত এই নির্বাসনে
নেকড়ের দঙ্গলের মতো আমাকে ছিঁড়ে খাক বরফে জ্বলতে থাকা ঋতু
শুধু তুমি,
আমার সংরক্ত চুম্বনের অন্তর্লীন আগুনগুলোকে
পৌঁছে দাও শ্রাবণে আষাঢ়ে রোরুদ্যমান
বিব্রত বাংলায়,
বজ্রে, বজ্রে, বেজে উঠুক নতজানু স্বদেশ আমার।
[আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও]
সুদূর মার্কিন মুল্লুকে বসে যার প্রাণ আষাঢ়ে শ্রাবণে ভেজা বংলার মাটির জন্য সারাক্ষণ হাহাকার করে বেড়ায় তাকে ছাড়া বাঙালিও যে একদ- থাকতে পারে না, মৃত্যুর পরে হলেও তাঁকে দেশে এনে তাঁর ইচ্ছার বাস্তবায়ন ঘটিয়ে তা প্রমাণ করেছে বাংলাদেশ।
ব্যক্তি জীবনে শহীদ কাদরী তিনজন স্ত্রীর পাণি গ্রহক করেন। প্রথম ও সাবেক স্ত্রী নাজমুননেসা পিয়ারী, দ্বিতীয় ও সাবেক স্ত্রী আমেরিকাবাসী ইহুদী নারী ডেনা (প্রয়াত) এবং সর্বশেষ স্ত্রী নীরা কাদরী।
কবিতা লেখার বাইরে শহীদ কাদরী বিদেশি সাহিত্যের অনুবাদ করতে পছন্দ করলেও তিনি তা প্রকাশ করতে চাননি। ‘অমৃতের সন্তান’ নামে অনুবাদ করেছেন ইউজিন ও’নীলের একটি অনবদ্য নাটক, যেখানে দেখা যাবে পাশ্চাত্যের সাদা-কালো তরুণ-তরুণীর প্রেম-উপখ্যান। অনুবাদ করেছেন তাঁর প্রিয় কবি পাবলো নেরুদা, কনস্তানতিন কাভাফি ও আন্তোনিন বার্তুসেকের কবিতা।
আমরা শহীদ কাদরীতে আরো আরো পাঠের ভিতর দিয়ে আপদনখশির এই বাঙালিকে যথার্থ শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাতে পারি।