alt

সাময়িকী

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

যাকিয়া সুমি সেতু

: বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ও. হেনরি (উইলিয়াম সিডনি পোর্টার) / জন্ম: ১১ সেপ্টেম্বর; মৃত্যু: ৫ জুন ১৯১০

বিশ্বসাহিত্যের শৈল্পিক পরিসরে গভীর অস্তিত্ববাদী ও জ্ঞানতাত্ত্বিক এক বিশিষ্ট ছোটগল্পকার হলেন উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, যিনি “ও. হেনরি” নামে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর গল্পগুলো জীবন ও বাস্তবতার সূক্ষ্মতম উপস্থাপন, চিন্তার স্থিতপ্রাজ্ঞ বিশ্বায়ন ও শৈল্পিক উৎকর্ষতা ধারণ করে আরোপিত। মানবজীবনের অতিসাধারণ অথচ গভীর সত্যগুলোর শৈল্পিক প্রকাশে ও. হেনরির অদ্বিতীয় কুশলতা এক অভূতপূর্ব মাত্রায় অভিষিক্ত। তাঁর ছোটগল্পগুলোতে জীবনের নান্দনিকতা, হাস্যরস, মানবিক দুর্বলতা এবং জীবনযাত্রার অপ্রত্যাশিত পরিণতির প্রতিচ্ছবি নির্মল অথচ তীক্ষèভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। লেখক স্বল্প শব্দের মাধ্যমে জটিল জীবনের রহস্যময়তাকে এমন সূক্ষ্মতায় উপস্থাপন করেছেন যে, প্রতিটি বাক্য ও অনন্য সমাপ্তি পাঠককে গভীর জীবনদর্শনের সম্মুখীন করে।

ও. হেনরি তাঁর সাহিত্যের সূচনা থেকে ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং কাহিনীর আকস্মিক, চমকপ্রদ পরিণতির জন্য এক যৌক্তিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন, যা তাঁকে তৎকালীন সাহিত্য সমাজে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর গল্পে অলীক বাস্তবতা এবং জীবনমুখী দুঃখবোধের এক সুরম্য সংমিশ্রণ বিদ্যমান, যা তাঁকে সমসাময়িক লেখকদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। মাত্র এক দশকের সাহিত্যিক কর্মজীবনে তিনি যে অনন্য সাহিত্যকীর্তি সৃষ্টি করেছেন, তা আজও পৃথিবীর পাঠকদের মুগ্ধ করে চলেছে। তাঁর গল্পগুলিতে মানব প্রকৃতি, সামাজিক সম্পর্ক এবং ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের সূক্ষ্ম অথচ গভীর অনুসন্ধান প্রতিফলিত হয়েছে, যা একাধারে মনস্তাত্ত্বিক ও অস্তিত্ববাদী দর্শনের দিকনির্দেশ করে। তাঁর মনোজগতের পরিম-লে প্রতিফলিত হয় ফ্রিডরিখ নিটশে, আলবেয়ার কাম্যু এবং খলিল জিবরানের মতো দার্শনিকদের প্রভাব।

বিশেষ করে দার্শনিক খলিল জিবরানের প্রজ্ঞায় যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, “Out of suffering have emerged the strongest souls; the most massive characters are seared with scars” তেমনি ও. হেনরির গল্পগুলোতেও দেখা যায় সেই চিরায়ত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আত্মার জয়গাথা।

ও. হেনরি, মূল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উত্তর ক্যারোলিনার গ্রিনসবোরো শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১০ সালের ৫ জুন নিউ ইয়র্ক সিটিতে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় অ্যাশেভিলের রিভারসাইড সিমেট্রিতে। পোর্টারের শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল। তাঁর পিতা, আলগারনন সিডনি পোর্টার, ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং তাঁর মাতা, মেরি জেন ভার্জিনিয়া সোয়াইম পোর্টার, ছিলেন এক প্রতিভাবান পিয়ানোবাদক। তবে পোর্টারের শৈশব ছিল তীব্র কষ্ট ও কঠিন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। মাত্র তিন বছর বয়সে মাতৃহীন হওয়ার পর তিনি দাদী ও ফুফুর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। শৈশবের এই প্রতিকূল অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টিশীলতার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। পোর্টার স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি মামার ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সাহিত্যপ্রীতি অল্প বয়স থেকেই বিকশিত হয়েছিল, এবং ১৫ বছর বয়সে তিনি বহুমুখী পঠনপাঠনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। জীবনে তিনি ফার্মাসিস্ট, নকশাকার, সাংবাদিক এবং ব্যাংক কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি লেখনীকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বিশেষত অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে কারাদ- প্রাপ্তির পর তাঁর জীবনে এক নাটকীয় পরিবর্তন আসে। কারাগারে থাকাকালীন তিনি ‘ও. হেনরি’ ছদ্মনাম গ্রহণ করে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। এই কঠোর অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং তাঁর সাহিত্যিক ধারা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ও. হেনরির শৈল্পিক দক্ষতা তাঁকে সমকালীন সাহিত্যিকদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে। তাঁর ছোটগল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ বুদ্ধিদীপ্ত ভাষার প্রয়োগ, সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য এবং বিশেষত চমকপ্রদ ও আকস্মিক সমাপ্তিÑ এসব তাঁকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর আমেরিকান জীবনযাত্রার জটিলতাগুলোকে তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম, দারিদ্র্য এবং সমাজের অবহেলিতদের কাহিনী তাঁর সাহিত্যিক কৃতির কেন্দ্রে অবস্থান করে। তাঁর গল্পের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মানব প্রকৃতির গভীর অনুধাবন পাঠককে অন্তদৃষ্টির এক নতুন জগতে পৌঁছে দেয়। ও. হেনরির চরিত্রগুলি, যারা কখনো ক্ষুদ্র অপরাধী, কখনো সংগ্রামী শিল্পী, কিংবা সাধারণ কর্মজীবী, প্রায়ই এমন পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় যেখানে জীবনের মর্মান্তিকতা ও হাস্যরস মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব বাস্তবতা সৃষ্টি করে। যদিও তাঁর গল্পগুলোতে কখনো কখনো নিরাশার ছায়া বিরাজ করে, তবুও মানবিক সহানুভূতি ও আশার প্রতিফলন তাঁর সাহিত্যের অন্তর্নিহিত গুণাবলী হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। এতে মানবজীবনের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত মোড়ের প্রতি এক বিশেষ আস্থা প্রতিফলিত হয়। ও. হেনরির সাহিত্যকর্মে নিয়তি এবং মানব ক্রিয়াকলাপের অপ্রত্যাশিত পরিণতি একটি অন্যতম প্রধান থিম হিসেবে পুনরাবৃত্তি পেয়েছে। বহু গল্পে দেখা যায়, চরিত্ররা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বা যুক্তিসঙ্গত মনে হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এমন পরিণতির সম্মুখীন হয় যা তাদের কল্পনারও অতীত। এই থিমটি তাঁর খ্যাতিমান গল্পসমূহে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছেÑ যেমন “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই”, “দ্য র?্যানসম অফ রেড চীফ”, এবং “দ্য লাস্ট লিফ”। পাশাপাশি “দ্য ডুপ্লিসিটি অফ হারগ্রেভস” ও “ক্যাবেজ এন্ড কিংস” উপন্যাসও তাঁর এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের চমৎকার উদাহরণ।

ও. হেনরি তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর মানসিক ও সামাজিক অবস্থার নিখুঁত চিত্রায়নে ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর অন্যতম সেরা রচনা “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” একটি অসাধারণ কাহিনী যা জিম ও ডেলা নামক এক যুবক দম্পতির আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। উভয়ই একে অপরের জন্য ক্রিসমাস উপহার কেনার উদ্দেশ্যে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করে। ডেলা তাঁর লম্বা, সুন্দর চুল বিক্রি করে জিমের ঘড়ির জন্য একটি চেইন ক্রয় করে, আর জিম তাঁর মূল্যবান ঘড়ি বিক্রি করে ডেলার চুলের জন্য একটি চিরুনি কিনে। এই গল্পের পরিপূর্ণ সত্তা প্রেম, আত্মত্যাগ এবং মানবীয় আচরণের অপ্রত্যাশিত দিকগুলোর প্রতিচ্ছবি বহন করে। “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” আজও এক কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা বিশ্বব্যাপী সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ও. হেনরির চিরায়ত থিমগুলোর সার্বজনীন প্রাসঙ্গিকতাকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে। যেমন তিনি তাঁর গল্পের উপসংহারে বলেছেন, “But in a last word to the wise of these days, let it be said that of all who give gifts, these two were the wisest. O all who give and receive gifts, such as they are wisest. Everywhere they are wisest. They are the magi.”

ও. হেনরি ছিলেন মানবিক হাস্যরসের এক বিরল প্রতিভা, যাঁর গল্পে জীবনের গভীরতম বোধের পাশাপাশি সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষè ব্যঙ্গ ও রসিকতার অনবদ্য উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই অনুশীলন এমনিই প্রাঞ্জল, যা কখনোই তিক্ততা বা অতিরিক্ত অম্লতার দিকে ঝোঁকে না। তাঁর বহুল জনপ্রিয় গল্প “দ্য র?্যানসম অফ রেড চীফ” এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে অপহরণের প্রচলিত ধারা ব্যঙ্গাত্মকভাবে উল্টে দেওয়া হয়েছে। গল্পে দেখা যায়, স্যাম এবং বিল নামক দুই ছোটখাটো অপরাধী জনি নামক এক দুরন্ত শিশুকে অপহরণ করে তার ধনী পিতার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের আশায় থাকে। কিন্তু জনির অবাধ্য ও দুর্বিনীত স্বভাব এমন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, অপহরণকারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। জনি অপরাধীদের সঙ্গে এতটাই আনন্দে মেতে ওঠে যে, সে আর ফিরে যেতে চায় না। শেষ পর্যন্ত স্যাম এবং বিলকে মুক্তিপণ দাবির পরিবর্তে জনির পিতার কাছে অর্থ প্রদান করে ছেলেটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাতে হয়। এই গল্পে ও. হেনরির ন্যারেটিভ কৌশল, বিশেষত পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রূপান্তর এবং বিদ্রুপাত্মক উল্টো ঘটনা, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। এই বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীসমূহ ও. হেনরির গল্পের মূল বৈশিষ্ট্যকে সংজ্ঞায়িত করে। তাঁর লেখার সূচনা বাক্যে- “It looked like a good thing: but wait till I tell you. We were down South, in Alabama—Bill Driscoll and myself—when this kidnapping idea struck us”- গল্পের কাঠামোগত প্রতিকূলতার সূচনা স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়, যা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এক চমৎকার ব্যঙ্গাত্মক সুর সৃষ্টি করে।

ও. হেনরির “দ্য লাস্ট লিফ” গল্পে শিল্প, আশা এবং হতাশার বিরুদ্ধে সহনশীলতার এক গভীর রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। গ্রিনউইচ ভিলেজে অবস্থিত দুই সংগ্রামী শিল্পী সু এবং জনসির জীবনকেন্দ্রিক এই গল্পে, জনসি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে যে জানালার বাইরে থাকা গাছটির শেষ পাতা ঝরে পড়লেই তার জীবনাবসান ঘটবে। সু তার বন্ধুকে আশার বাণী শোনাতে ব্যর্থ হলেও, জনসির শারীরিক অবনতি ঘটতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ পাতা ঝরে না। পরে জানা যায়, তাদের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বেহরমান, যিনি একজন ব্যর্থ শিল্পী হিসেবে পরিচিত, রাতের অন্ধকারে প্রচ- ঠা-ায় বাইরে থেকে দেয়ালে একটি পাতা এঁকেছিলেন, জনসির আশা বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই মহত্ত্বপূর্ণ কর্মের মাধ্যমে বেহরমান নিজেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যুবরণ করেন। “দ্য লাস্ট লিফ” ও. হেনরির সবচেয়ে আবেগময় গল্পগুলোর একটি, যা মানব সহানুভূতির শক্তি ও ত্যাগের মহত্ত্বকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে। বেহরমানের শিল্পকর্মের মাধ্যমে, ও. হেনরি মানুষের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের গভীরতা এবং অন্যের জীবনে প্রভাব বিস্তারের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জনসির অসহায় অবস্থায় জানালার বাইরে পাতা গোনা দৃশ্যটি এই গল্পের একটি মর্মস্পর্শী মুহূর্ত: “She was looking out the window and counting—counting backward. ‘Twelve,’ she said, and a little later, ‘eleven’; and then ‘ten,’ and ‘nine’; and then ‘eight’ and ‘seven,’ almost together.”-এখানে জনসির প্রতিটি সংখ্যার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর প্রহরগননা এবং জীবনের অমোঘ নিয়তি প্রত্যক্ষ হয়, যা পাঠককে জীবনের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

ও. হেনরির সাহিত্যকর্মে মানবিকতা এবং সামাজিক বাস্তবতার পারস্পরিক সম্পর্ক গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়, যেখানে প্রতিটি চরিত্র জীবনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও তাদের অন্তর্নিহিত আশা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রবল জ্যোতি সদা বিরাজমান। ও. হেনরি এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে, মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য ও শক্তি নিহিত রয়েছে তাদের মানসিক দৃঢ়তা, অপরিসীম সংকল্প এবং আশাবাদী মনোভঙ্গিতে। তাঁর গল্পগুলোতে জীবনের অপ্রত্যাশিত বাঁকগুলো এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির জানালা খুলে দেয়, যা পাঠককে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত করে। তাছাড়া ভাষার সহজতা, সরলতা এবং প্রাঞ্জলতা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর বর্ণনায় কখনো অতিরঞ্জন দেখা যায় না; বরং সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাষায় তিনি কাহিনীগুলো উপস্থাপন করেন, যা পাঠকের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। এই স্বচ্ছতায় আন্দোলিত তাঁর রচনার চরিত্রগুলোও তেমনি জীবন্ত, বাস্তবসম্মত এবং গভীর সংবেদনশীল। বিশেষত নিউ ইয়র্ক শহরের গলি, পথচারী, দোকানপাট-সবকিছুই তাঁর বর্ণনায় এতটাই সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে যে, মনে হয় পাঠক যেন সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় নিজেই বিচরণ করছে। ও. হেনরির প্রভাব কেবল পাঠক, সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর রচনা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতেও অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ও. হেনরির অপ্রত্যাশিত কাহিনীর মোড় এবং মানব প্রকৃতির জটিলতাকে অনন্যভাবে ধরার ক্ষমতা তাঁকে আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম কালজয়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর গল্পগুলো, যেমন “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই”-তে প্রেম ও ত্যাগের চিত্রণ, “দ্য র‌্যানসম অফ রেড চীফ”-এ মানব আচরণের বিদ্রƒপাত্মক প্রকাশ এবং “দ্য লাস্ট লিফ”-এ আশার শক্তির প্রতিফলন, চিরন্তনভাবে পাঠকের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম জীবনের জটিলতাগুলো সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত বাঁক সত্ত্বেও, মানব হৃদয় প্রেম, সহানুভূতি এবং আত্মত্যাগের শক্তিতে সদা সমৃদ্ধ। আলবার্ট শ্বাইটজারের ভাষায়, “The purpose of human life is to serve, and to show compassion and the will to help others.” এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, ও. হেনরির সাহিত্যকর্ম মানবিক ত্যাগ, সহানুভূতি এবং ভালবাসার শক্তির অনন্য রূপায়ণ, যা তাঁকে সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

সাময়িকী কবিতা

মার্কিন চলচ্চিত্র জগতের প্রাণকেন্দ্র লস এঞ্জেলেস

ছবি

যুদ্ধের জানালায় দাঁড়িয়ে

ছবি

শব্দঘর : বিপ্লব, দ্রোহ ও গুচ্ছ কবিতা সংখ্যা

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

সালভাতর কোয়াসিমোদোর কবিতা

ছবি

টুটু

ছবি

অর্ধেক জীবন

ছবি

ক্যান্ডি, শ্রীলঙ্কায় বেড়ানোর আদর্শ জায়গা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

‘দূরের কার্নিশ’

ছবি

কবিতায় উড়ন্ত সারস

ছবি

সাহিত্যের দর্শনানুসন্ধান

ছবি

রবীন্দ্রসংগীত চর্চা, বাংলাদেশে-

শক্তিমান কবির কলমে গল্প

ছবি

শহীদুল হকের জীবন ও আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতা

ছবি

জলবন্দী স্বপ্ন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কমল চক্রবর্তী, আদি ও অকৃত্রিম রিংমাস্টার

ছবি

নূরুল হক : আধুনিক মরমি কবি

ছবি

নজরুল : বিশ্বতোরণে বৈজয়ন্তী মানব-বিজয়-কেতন

ছবি

নিছক সাজুর গল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

কবিতায় বিশ্বস্ত স্বর

ছবি

স্মৃতির আয়নাজুড়ে শহীদ ভাই

ছবি

ব্যক্তিগত শহীদ

ছবি

দূরের তারাটিকে

ছবি

একটি দুর্বিনীত নাশকতার অন্তিম চিৎকার

ছবি

যেদিন সুবিমল মিশ্র চলে গেলেন

tab

সাময়িকী

ও. হেনরি : ছোটগল্পের কালজয়ী অগ্রদূত

যাকিয়া সুমি সেতু

ও. হেনরি (উইলিয়াম সিডনি পোর্টার) / জন্ম: ১১ সেপ্টেম্বর; মৃত্যু: ৫ জুন ১৯১০

বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিশ্বসাহিত্যের শৈল্পিক পরিসরে গভীর অস্তিত্ববাদী ও জ্ঞানতাত্ত্বিক এক বিশিষ্ট ছোটগল্পকার হলেন উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, যিনি “ও. হেনরি” নামে সুপ্রসিদ্ধ। তাঁর গল্পগুলো জীবন ও বাস্তবতার সূক্ষ্মতম উপস্থাপন, চিন্তার স্থিতপ্রাজ্ঞ বিশ্বায়ন ও শৈল্পিক উৎকর্ষতা ধারণ করে আরোপিত। মানবজীবনের অতিসাধারণ অথচ গভীর সত্যগুলোর শৈল্পিক প্রকাশে ও. হেনরির অদ্বিতীয় কুশলতা এক অভূতপূর্ব মাত্রায় অভিষিক্ত। তাঁর ছোটগল্পগুলোতে জীবনের নান্দনিকতা, হাস্যরস, মানবিক দুর্বলতা এবং জীবনযাত্রার অপ্রত্যাশিত পরিণতির প্রতিচ্ছবি নির্মল অথচ তীক্ষèভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। লেখক স্বল্প শব্দের মাধ্যমে জটিল জীবনের রহস্যময়তাকে এমন সূক্ষ্মতায় উপস্থাপন করেছেন যে, প্রতিটি বাক্য ও অনন্য সমাপ্তি পাঠককে গভীর জীবনদর্শনের সম্মুখীন করে।

ও. হেনরি তাঁর সাহিত্যের সূচনা থেকে ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং কাহিনীর আকস্মিক, চমকপ্রদ পরিণতির জন্য এক যৌক্তিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত হন, যা তাঁকে তৎকালীন সাহিত্য সমাজে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠিত করে। তাঁর গল্পে অলীক বাস্তবতা এবং জীবনমুখী দুঃখবোধের এক সুরম্য সংমিশ্রণ বিদ্যমান, যা তাঁকে সমসাময়িক লেখকদের থেকে আলাদা করে তুলেছে। মাত্র এক দশকের সাহিত্যিক কর্মজীবনে তিনি যে অনন্য সাহিত্যকীর্তি সৃষ্টি করেছেন, তা আজও পৃথিবীর পাঠকদের মুগ্ধ করে চলেছে। তাঁর গল্পগুলিতে মানব প্রকৃতি, সামাজিক সম্পর্ক এবং ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনের সূক্ষ্ম অথচ গভীর অনুসন্ধান প্রতিফলিত হয়েছে, যা একাধারে মনস্তাত্ত্বিক ও অস্তিত্ববাদী দর্শনের দিকনির্দেশ করে। তাঁর মনোজগতের পরিম-লে প্রতিফলিত হয় ফ্রিডরিখ নিটশে, আলবেয়ার কাম্যু এবং খলিল জিবরানের মতো দার্শনিকদের প্রভাব।

বিশেষ করে দার্শনিক খলিল জিবরানের প্রজ্ঞায় যেমন প্রতিফলিত হয়েছে, “Out of suffering have emerged the strongest souls; the most massive characters are seared with scars” তেমনি ও. হেনরির গল্পগুলোতেও দেখা যায় সেই চিরায়ত যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আত্মার জয়গাথা।

ও. হেনরি, মূল নাম উইলিয়াম সিডনি পোর্টার, ১৮৬২ সালের ১১ সেপ্টেম্বর উত্তর ক্যারোলিনার গ্রিনসবোরো শহরে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯১০ সালের ৫ জুন নিউ ইয়র্ক সিটিতে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় অ্যাশেভিলের রিভারসাইড সিমেট্রিতে। পোর্টারের শৈশব থেকেই সাহিত্য ও সঙ্গীতের প্রতি গভীর আকর্ষণ ছিল। তাঁর পিতা, আলগারনন সিডনি পোর্টার, ছিলেন একজন চিকিৎসক এবং তাঁর মাতা, মেরি জেন ভার্জিনিয়া সোয়াইম পোর্টার, ছিলেন এক প্রতিভাবান পিয়ানোবাদক। তবে পোর্টারের শৈশব ছিল তীব্র কষ্ট ও কঠিন বাস্তবতায় পরিপূর্ণ। মাত্র তিন বছর বয়সে মাতৃহীন হওয়ার পর তিনি দাদী ও ফুফুর তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। শৈশবের এই প্রতিকূল অভিজ্ঞতা পরবর্তীকালে তাঁর সৃষ্টিশীলতার ওপর গভীর ছাপ ফেলেছিল। পোর্টার স্কুলে তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি মামার ফার্মেসিতে কাজ শুরু করেন এবং মাত্র ১৯ বছর বয়সে একজন লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সাহিত্যপ্রীতি অল্প বয়স থেকেই বিকশিত হয়েছিল, এবং ১৫ বছর বয়সে তিনি বহুমুখী পঠনপাঠনের মাধ্যমে নিজেকে সমৃদ্ধ করেন। জীবনে তিনি ফার্মাসিস্ট, নকশাকার, সাংবাদিক এবং ব্যাংক কর্মচারী হিসেবে বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু জীবনের কঠিন বাস্তবতা ও সংগ্রামের মুখোমুখি হওয়ার পর তিনি লেখনীকে পেশা হিসেবে বেছে নেন। বিশেষত অর্থ কেলেঙ্কারির অভিযোগে কারাদ- প্রাপ্তির পর তাঁর জীবনে এক নাটকীয় পরিবর্তন আসে। কারাগারে থাকাকালীন তিনি ‘ও. হেনরি’ ছদ্মনাম গ্রহণ করে সাহিত্য রচনা শুরু করেন। এই কঠোর অভিজ্ঞতা তাঁর সাহিত্যকর্মে গভীর প্রভাব ফেলেছিল এবং তাঁর সাহিত্যিক ধারা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ও. হেনরির শৈল্পিক দক্ষতা তাঁকে সমকালীন সাহিত্যিকদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে চিহ্নিত করেছে। তাঁর ছোটগল্পের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলোÑ বুদ্ধিদীপ্ত ভাষার প্রয়োগ, সূক্ষ্ম ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্য এবং বিশেষত চমকপ্রদ ও আকস্মিক সমাপ্তিÑ এসব তাঁকে অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর শুরুর আমেরিকান জীবনযাত্রার জটিলতাগুলোকে তিনি অসাধারণ দক্ষতার সাথে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংগ্রাম, দারিদ্র্য এবং সমাজের অবহেলিতদের কাহিনী তাঁর সাহিত্যিক কৃতির কেন্দ্রে অবস্থান করে। তাঁর গল্পের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা মানব প্রকৃতির গভীর অনুধাবন পাঠককে অন্তদৃষ্টির এক নতুন জগতে পৌঁছে দেয়। ও. হেনরির চরিত্রগুলি, যারা কখনো ক্ষুদ্র অপরাধী, কখনো সংগ্রামী শিল্পী, কিংবা সাধারণ কর্মজীবী, প্রায়ই এমন পরিস্থিতিতে নিপতিত হয় যেখানে জীবনের মর্মান্তিকতা ও হাস্যরস মিলেমিশে এক অভূতপূর্ব বাস্তবতা সৃষ্টি করে। যদিও তাঁর গল্পগুলোতে কখনো কখনো নিরাশার ছায়া বিরাজ করে, তবুও মানবিক সহানুভূতি ও আশার প্রতিফলন তাঁর সাহিত্যের অন্তর্নিহিত গুণাবলী হিসেবে পরিলক্ষিত হয়। এতে মানবজীবনের অন্তর্নিহিত শক্তি এবং ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত মোড়ের প্রতি এক বিশেষ আস্থা প্রতিফলিত হয়। ও. হেনরির সাহিত্যকর্মে নিয়তি এবং মানব ক্রিয়াকলাপের অপ্রত্যাশিত পরিণতি একটি অন্যতম প্রধান থিম হিসেবে পুনরাবৃত্তি পেয়েছে। বহু গল্পে দেখা যায়, চরিত্ররা তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক বা যুক্তিসঙ্গত মনে হওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা এমন পরিণতির সম্মুখীন হয় যা তাদের কল্পনারও অতীত। এই থিমটি তাঁর খ্যাতিমান গল্পসমূহে সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছেÑ যেমন “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই”, “দ্য র?্যানসম অফ রেড চীফ”, এবং “দ্য লাস্ট লিফ”। পাশাপাশি “দ্য ডুপ্লিসিটি অফ হারগ্রেভস” ও “ক্যাবেজ এন্ড কিংস” উপন্যাসও তাঁর এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের চমৎকার উদাহরণ।

ও. হেনরি তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোর মানসিক ও সামাজিক অবস্থার নিখুঁত চিত্রায়নে ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর অন্যতম সেরা রচনা “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” একটি অসাধারণ কাহিনী যা জিম ও ডেলা নামক এক যুবক দম্পতির আত্মত্যাগের মর্মস্পর্শী ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। উভয়ই একে অপরের জন্য ক্রিসমাস উপহার কেনার উদ্দেশ্যে তাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ বিক্রি করে। ডেলা তাঁর লম্বা, সুন্দর চুল বিক্রি করে জিমের ঘড়ির জন্য একটি চেইন ক্রয় করে, আর জিম তাঁর মূল্যবান ঘড়ি বিক্রি করে ডেলার চুলের জন্য একটি চিরুনি কিনে। এই গল্পের পরিপূর্ণ সত্তা প্রেম, আত্মত্যাগ এবং মানবীয় আচরণের অপ্রত্যাশিত দিকগুলোর প্রতিচ্ছবি বহন করে। “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই” আজও এক কালজয়ী সাহিত্যকীর্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, যা বিশ্বব্যাপী সাহিত্যের পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং ও. হেনরির চিরায়ত থিমগুলোর সার্বজনীন প্রাসঙ্গিকতাকে দৃঢ়ভাবে তুলে ধরে। যেমন তিনি তাঁর গল্পের উপসংহারে বলেছেন, “But in a last word to the wise of these days, let it be said that of all who give gifts, these two were the wisest. O all who give and receive gifts, such as they are wisest. Everywhere they are wisest. They are the magi.”

ও. হেনরি ছিলেন মানবিক হাস্যরসের এক বিরল প্রতিভা, যাঁর গল্পে জীবনের গভীরতম বোধের পাশাপাশি সূক্ষ্ম অথচ তীক্ষè ব্যঙ্গ ও রসিকতার অনবদ্য উপস্থিতি পরিলক্ষিত হয়। এই অনুশীলন এমনিই প্রাঞ্জল, যা কখনোই তিক্ততা বা অতিরিক্ত অম্লতার দিকে ঝোঁকে না। তাঁর বহুল জনপ্রিয় গল্প “দ্য র?্যানসম অফ রেড চীফ” এই শৈল্পিক বৈশিষ্ট্যের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ, যেখানে অপহরণের প্রচলিত ধারা ব্যঙ্গাত্মকভাবে উল্টে দেওয়া হয়েছে। গল্পে দেখা যায়, স্যাম এবং বিল নামক দুই ছোটখাটো অপরাধী জনি নামক এক দুরন্ত শিশুকে অপহরণ করে তার ধনী পিতার কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের আশায় থাকে। কিন্তু জনির অবাধ্য ও দুর্বিনীত স্বভাব এমন এক চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যে, অপহরণকারীদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে। জনি অপরাধীদের সঙ্গে এতটাই আনন্দে মেতে ওঠে যে, সে আর ফিরে যেতে চায় না। শেষ পর্যন্ত স্যাম এবং বিলকে মুক্তিপণ দাবির পরিবর্তে জনির পিতার কাছে অর্থ প্রদান করে ছেলেটিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাতে হয়। এই গল্পে ও. হেনরির ন্যারেটিভ কৌশল, বিশেষত পরিস্থিতির সম্পূর্ণ বিপরীতমুখী রূপান্তর এবং বিদ্রুপাত্মক উল্টো ঘটনা, অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে। এই বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনীসমূহ ও. হেনরির গল্পের মূল বৈশিষ্ট্যকে সংজ্ঞায়িত করে। তাঁর লেখার সূচনা বাক্যে- “It looked like a good thing: but wait till I tell you. We were down South, in Alabama—Bill Driscoll and myself—when this kidnapping idea struck us”- গল্পের কাঠামোগত প্রতিকূলতার সূচনা স্পষ্টভাবে লক্ষ করা যায়, যা পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহে এক চমৎকার ব্যঙ্গাত্মক সুর সৃষ্টি করে।

ও. হেনরির “দ্য লাস্ট লিফ” গল্পে শিল্প, আশা এবং হতাশার বিরুদ্ধে সহনশীলতার এক গভীর রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। গ্রিনউইচ ভিলেজে অবস্থিত দুই সংগ্রামী শিল্পী সু এবং জনসির জীবনকেন্দ্রিক এই গল্পে, জনসি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি হয় এবং বিশ্বাস করতে শুরু করে যে জানালার বাইরে থাকা গাছটির শেষ পাতা ঝরে পড়লেই তার জীবনাবসান ঘটবে। সু তার বন্ধুকে আশার বাণী শোনাতে ব্যর্থ হলেও, জনসির শারীরিক অবনতি ঘটতে থাকে। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে, শেষ পাতা ঝরে না। পরে জানা যায়, তাদের বৃদ্ধ প্রতিবেশী বেহরমান, যিনি একজন ব্যর্থ শিল্পী হিসেবে পরিচিত, রাতের অন্ধকারে প্রচ- ঠা-ায় বাইরে থেকে দেয়ালে একটি পাতা এঁকেছিলেন, জনসির আশা বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু এই মহত্ত্বপূর্ণ কর্মের মাধ্যমে বেহরমান নিজেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যুবরণ করেন। “দ্য লাস্ট লিফ” ও. হেনরির সবচেয়ে আবেগময় গল্পগুলোর একটি, যা মানব সহানুভূতির শক্তি ও ত্যাগের মহত্ত্বকে এক অনন্য উচ্চতায় তুলে ধরে। বেহরমানের শিল্পকর্মের মাধ্যমে, ও. হেনরি মানুষের নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের গভীরতা এবং অন্যের জীবনে প্রভাব বিস্তারের এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। জনসির অসহায় অবস্থায় জানালার বাইরে পাতা গোনা দৃশ্যটি এই গল্পের একটি মর্মস্পর্শী মুহূর্ত: “She was looking out the window and counting—counting backward. ‘Twelve,’ she said, and a little later, ‘eleven’; and then ‘ten,’ and ‘nine’; and then ‘eight’ and ‘seven,’ almost together.”-এখানে জনসির প্রতিটি সংখ্যার মধ্য দিয়ে মৃত্যুর প্রহরগননা এবং জীবনের অমোঘ নিয়তি প্রত্যক্ষ হয়, যা পাঠককে জীবনের অনিশ্চয়তার মুখোমুখি দাঁড় করায়।

ও. হেনরির সাহিত্যকর্মে মানবিকতা এবং সামাজিক বাস্তবতার পারস্পরিক সম্পর্ক গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়, যেখানে প্রতিটি চরিত্র জীবনের কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি হলেও তাদের অন্তর্নিহিত আশা এবং আত্মবিশ্বাসের প্রবল জ্যোতি সদা বিরাজমান। ও. হেনরি এই বিশ্বাসে অটল ছিলেন যে, মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য ও শক্তি নিহিত রয়েছে তাদের মানসিক দৃঢ়তা, অপরিসীম সংকল্প এবং আশাবাদী মনোভঙ্গিতে। তাঁর গল্পগুলোতে জীবনের অপ্রত্যাশিত বাঁকগুলো এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ও উপলব্ধির জানালা খুলে দেয়, যা পাঠককে গভীর চিন্তায় নিমজ্জিত করে। তাছাড়া ভাষার সহজতা, সরলতা এবং প্রাঞ্জলতা তাঁকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাঁর বর্ণনায় কখনো অতিরঞ্জন দেখা যায় না; বরং সংক্ষিপ্ত অথচ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ভাষায় তিনি কাহিনীগুলো উপস্থাপন করেন, যা পাঠকের মনোজগতে গভীর প্রভাব ফেলে। এই স্বচ্ছতায় আন্দোলিত তাঁর রচনার চরিত্রগুলোও তেমনি জীবন্ত, বাস্তবসম্মত এবং গভীর সংবেদনশীল। বিশেষত নিউ ইয়র্ক শহরের গলি, পথচারী, দোকানপাট-সবকিছুই তাঁর বর্ণনায় এতটাই সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে যে, মনে হয় পাঠক যেন সেই সময়ের নিউ ইয়র্ক শহরের রাস্তায় নিজেই বিচরণ করছে। ও. হেনরির প্রভাব কেবল পাঠক, সাহিত্যেই সীমাবদ্ধ নয়, তাঁর রচনা চলচ্চিত্র ও নাট্যজগতেও অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ও. হেনরির অপ্রত্যাশিত কাহিনীর মোড় এবং মানব প্রকৃতির জটিলতাকে অনন্যভাবে ধরার ক্ষমতা তাঁকে আমেরিকান সাহিত্যের অন্যতম কালজয়ী ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তাঁর গল্পগুলো, যেমন “দ্য গিফট অফ দ্য ম্যাজাই”-তে প্রেম ও ত্যাগের চিত্রণ, “দ্য র‌্যানসম অফ রেড চীফ”-এ মানব আচরণের বিদ্রƒপাত্মক প্রকাশ এবং “দ্য লাস্ট লিফ”-এ আশার শক্তির প্রতিফলন, চিরন্তনভাবে পাঠকের হৃদয়ে অনুরণিত হয়। তাঁর সাহিত্যকর্ম জীবনের জটিলতাগুলো সম্পর্কে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে এবং আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে ভাগ্যের অপ্রত্যাশিত বাঁক সত্ত্বেও, মানব হৃদয় প্রেম, সহানুভূতি এবং আত্মত্যাগের শক্তিতে সদা সমৃদ্ধ। আলবার্ট শ্বাইটজারের ভাষায়, “The purpose of human life is to serve, and to show compassion and the will to help others.” এই দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে, ও. হেনরির সাহিত্যকর্ম মানবিক ত্যাগ, সহানুভূতি এবং ভালবাসার শক্তির অনন্য রূপায়ণ, যা তাঁকে সাহিত্যের অগ্রদূত হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

back to top