মামুন হুসাইন
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তরমুজের রক্ত পান করতে করতে আমাদের সামান্য পুনরুত্থান হয় অথবা পূর্ণিমার আলো এসে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ঘোলা করে ফেলে। ফলে উনিশশ’ পঁচাশির দিকে শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের আব্দুল মজিদ, মাইক্রোফোনে একাত্তরের রাজনৈতিক সৈন্যদলের প্রিয়পাত্র, বদু মওলানার পুত্রের মুখে ‘আপনাদের ধন্যবাদ’ শুনতে পেয়ে স্পঞ্জ স্যান্ডেলের ফিতা হারিয়ে সামান্য ধন্ধে পড়ে। আব্দুল মজিদ শঙ্কিত চোখে কাক দেখে, বদু মওলানার জোব্বা দেখে, জোব্বায় লেগে থাকা একদা উত্তাল মার্চে ক্যাপ্টেনের পেশাব দেখে, মৃত হিজড়ার রঙিন নখ দেখে, কতিপয় রাজাকারকে তুলসী পাতা চিবুতে দেখে, বাসন্তি গোমেজের ভাই পঙ্কজ গোমেজকে গিটার বাজাতে দেখে, বদু মওলানার নপুংশক পুত্রের খৎনা দেখে, বোনের লাশ দেখে, মায়াবতীর চিঠি পোড়ানো ছাই দেখে তুলসীর বেদীমূলে আর দেখে একাত্তর সালের একুশটি মাথার খুলি কলাপাতার ওপর সাতটি সারিতে সাজানো, যখন সম্ভ্রান্ত কাক-সম্প্রদায় বৈদ্যুতিক তার জুড়ে বহুদিন পর সম্মেলক-সঙ্গীত গাইছে- আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে...; কিন্তু মহল্লার মানুষ সহসা সঙ্গীত আস্বাদ করতে ব্যর্থ হয়ে, উদ্দীপনার সন্ধানে একজন বাজিকরের হাত থেকে মুঠি মুঠি ডুমুর খেতে শুরু করে। ডুমুর আনন্দ দেয় এবং একঘেয়ি করে। তারপর মনোটোনি এড়াতে মানুষ যখন উইক এন্ডে সুহাসিনী গ্রামে বেড়াতে আসে, তাদের আবারও অনুমান হয় তারা বাঁচবে অন্তত একশ’ এগার বছর। ওস্তাদ শিখাইছিল যে, মাইনষের জীবনের উপর ভর কইর্যা থাকে চাইরটা জিনিস, এ্যার একটা হইলো, সূরযো, তার বাদে চান, মঙ্গল আর শনি। একবার মনে হইছিল যানি রক্তের ভিতর চুবান খায়া উইঠছিল সেদিন চানটা। চন্দ্র সূর্যের বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা কয়েকটি নতুন জায়গার নাম শিখি- কুত্তা মারার মাঠ, রৌছারবিল ও চান্দাইকোনা, আর শুনতে পাই বিশেষ এক গোপন যাদুবিদ্যায় আমরা বাঁচতে পারবো অন্তত একশ’ এগার বছর। কৃষকেরা তামাকের ধোঁয়ার ভেতর লালশাক দেখে এবং গল্প করে- কে এক নবজাতককে জ্যোৎস্নার আলোয় কলসিতে রাখা পানি দিয়ে গোসল করানো হলো। একজন রক্তে ডুবোনো চাঁদ দেখে আর ভাবে- একশ’ এগার বছর আমি চেয়ারম্যান অথবা সাংসদ হয়ে সুহাসিনী গ্রামের জ্যোৎস্না পান করবো। কিন্তু গ্রামের ভেতর আগুন, পুলিশ ও মিলিটারি এসে সিরিয়াল কিলিংয়ের একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে ফেলে।
এরকম এক হুজ্জতের কালে, বালিহাঁসের ডিম খুঁজতে যেয়ে হাঁড়ির ভেতর একটি ফুটফুটে মেয়ে খুঁজে পায় আকালু। নতুন হাটের নামকরণ হয় আগারগাঁও কলোনির নিখোঁজ নয়নতারা ফুলের নামে, নয়নতারার হাট। নয়নতারা হাটে পৌঁছানো মাত্রই গল্প ছুটে আসে ডলু নদীর হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আকালু কবে পাঙ্গাসি হাটের ইমামের কাছে যেয়ে বিয়ে করলো, তার উত্তেজক বর্ণনা ভাসে বাতাসে। কেউ গল্প শোনায়- একবার আমরা বহুদিন ভোলানাথ অপেরায় নিমজ্জিত ছিলাম লাঙল ও চাষবাস ছেড়ে, অথবা পলাতক হয়েছিলাম সুহাসিনী গ্রাম থেকে। ভোলানাথ অপেরার ক্লারিওনেট অথবা গানবাদ্য নিঃশেষ হয়ে গেলে এই গ্রামের চন্দ্রভানের কাছে জ্বীন আসে এবং সে রাতভর হেঁটে বেড়ায়। এরকম এক সুশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খলার কালে গ্রামের কতিপয় স্লিপওয়াকার মাও সেতুংয়ের পাঁচটি প্রবন্ধ অথবা ছয়টি প্রবন্ধের বই খুঁজে পায়। প্রবন্ধের লাল বইগুলো রক্তাক্ত পূর্ণিমায় স্লান করে কোথায় নিখোঁজ হয়, সুহাসিনীর কেউ জানতে পারে না। সবুজ-উজ্জ্বল সব্জি কিনতে ব্যর্থ হয়ে কতিপয় হাটুরে মানুষ ইউএনও সাহেবের সবুজ জিপ উড়ে যেতে দেখে অগত্যা, আর শুনতে পায় যমুনা বক্ষে ইনোসেন্ট ইরেনদিরা’র মতো এক গণিকা বহুকাল আগে হয়ে উঠেছিল মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো এবং করুণাময়ী ধরণীর মতো। হাটুরে মানুষ, দূর থেকে নাসিরুদ্দিনকে চিনতে পারে, যে মোরগের আ-া উপহার দিয়েছিল দুলালিকে খাওয়ার জন্য, যেন সে আরো ফর্সা হয়। দুলালি কবে সাতান্নটি চিরকুট তৈরি করে, সে খবর তৈরি হয় কারোর মাথায়, আর মন খারাপ হয়, চিরকুটের বক্তব্য পড়তে পড়তে- ‘তুমি কিছু কও না কেন’! মানুষ সহসা কথা বলতে ভুলে যায়। অথবা তারা হয়তো ভুলে যায় না, হয়তো ভেবেছিল, একত্রে তারা দুলালি ও নাসিরুদ্দিনের সম্পর্কহীনতার দুর্যোগ মোকাবেলা করবে। কিন্তু সুরধ্বনি গ্রামের ভেতর হঠাৎ ঢুকে পড়া প্রথম-মোটরগাড়ির সম্মান অনুধ্যান করতে করতে তারা বিভ্রমে পড়ে এবং চিন্তাচ্যুত হয়- দেখে একটি চার দরজার ঝকঝকে কার জোড়া নৌকার ফেরিতে চড়ে করতোয়া হয়ে এইমতে ধানঘড়া হাটে নামলো। হয়তো তখন-ই দ্বিতীয় ভেইকল হিসেবে মেজর ইলিয়াসের গাড়ি এসেও হাজির হয়, অথবা গাড়ির ধুলোয় দেখতে অসুবিধে হয় দুলালিকে, যে একা কথা বলছিল খোকসা গাছের পাতার সাথে, কিংবা সে তরল রোদ পান করার মতো, ড্রামে গুলানো হলুদ রঙ হয়তো পান করছিল নাসির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, যখন সাতান্নটি চিরকুট ঘাসের ভেতর শালুক ফুলের মতো ফুটেছিল। হয়তো তখন কেউ যুদ্ধে যাওয়ার আশায় মাটির ভেতর পতাকা পুঁতে ফেলে। হয়তো যুদ্ধ থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। হয়তো ফের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে আর দীর্ঘ একটি কবরের ভেতর পুরো পরিবার বিশেষ এক রাজনৈতিক বাস্তবতার জের ধরে চিরকালের মতো আটক হয়ে যায়। হয়তো লোকটিকে আর বাঁচানো যায়নি একশ’ এগার বছর, কিংবা সে হয়তো বেঁচে যায়, হয়তো লোকটি পালিয়ে যায় কাঠের ভুষির ভেতর দূর কোনো সমুদ্রের শহরে। হয়তো ডলু নদীর হাওয়ায় সে ঘুমিয়ে পড়ে, অথবা দেখে দূরের হালদা নদীর জলে সার-সার নৌকা, মাছ ও ডিম্বাণুর আশায় প্রহর গুনছে। হয়তো নৌকার নিংড়ানো আলোর রাজ্যে খৈমন নামে একটি কন্যার সে সন্ধান পায়। হয়তো এরা সবাই খৈমন, দুলালি অথবা জুলি ফ্লোরেন্স নাম ধারণ করে। ভ্যাটিকান কুন জায়গায়?... ভ্যাটিকান রোমে, ইটালিতে, ইটালি কোথায়?- এমনি সব প্রশ্ন করে বিরক্তি ছড়ায়। যোসেফ ইউজিন, বব এবং মিসেস ক্লার্কের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে কথা হয় কোনো কোনোদিন। তখন নয় মাসের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে যায় আর স্কুলের বারান্দায় একদিন পাকিস্তানি মিলিটারি মানুষ মেরে হয়রান হয়া গলা শুকায়া ফালায়। মহল্লায় তখন ফের বান্দর আসে এবং কেউ বান্দরের উৎপাত নিয়ে সাংবাদিকদের লিখতে বলে। মৈশুন্দি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবুবকর মওলানা সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-তামাশা ও ঐকমত্য করে। আব্দুল গণি কমান্ডার এই ফাঁকে একটি অবাক করা বাক্য বানায়- খৈমনের মুখটা কী পানিতে ভেজা বৃক্ষ শাখার মতো বলতে পারি আমি। শহীদুল জবাব না দিয়ে ডুমুর চিবোয়! আর সরদার ফজলুল করিমের ক্লাসে পড়া প্রটেস্টান্ট ইথিক্স সম্পর্কে, ঝিকরগাছার ফাদার অ্যান্থনি ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হতে থাকে। কিন্তু ফাদার কেবল অ্যালবার্ট ডি সুজা ও লাবণ্যবিষয়ক গল্প-গাছা শোনায়। লাবণ্যের ছায়া যখন বৃক্ষের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন জুলিফ্লোরেন্সের ভালোবাসায় শহীদুলের কোনো এক বন্ধু ধীরে ধীরে মাঙ্কিবয় হয়ে ওঠে, মাঙ্কিবয় সবুজ ও লাল রং চিনতে পারে না কোনোদিন। ফলে জনৈক কালার ব্লাইন্ড-মাঙ্কিবয় ফরেন ইনভেস্টারসদের রং বুঝতে না পেরে তাদেরকে প্রশ্ন কাতর করে- উই আর ফরেন ইনভেস্টারস, হাউ ডেয়ার দে স্টিল আওয়ার প্রপার্টি। সেনাপ্রজাতন্ত্রী কনক দ্বীপপুঞ্জের দুর্বিনীত মাঙ্কিবয় আনুগত্য প্রকাশের জন্য এবার পোঁটলার পোলা কাম চানমিঞা কাম কারথিপ কাম খরগোশ হয়া আসমানতারার খাঁচার ভেতর বিশ্রাম নেয়ার আয়োজন শুরু করে।
এই ‘বিশ্রামের আয়োজন’ রায়গঞ্জ অথবা সুহাসিনী গ্রামের কেউ বাংলায় অনুবাদ করে,... ধুলোর দিনে ফেরা! ডুমুর খাওয়ার দিনগুলোতে কে একজন ইলিয়াসের স্মৃতির উদ্দেশে তখন বই লেখে। লোকে বলে ধুলোর গন্ধের ভেতর অন্য একজন মানুষ ঘরে ফেরারকালে মাঠের সবুজ চিবুতে চিবুতে হঠাৎ গতকাল মৃতদেহ হয়ে উঠেছে। এই লোকটির ছিল দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্ন। কিন্তু সে একবার শ্যামল ও সুশ্রী ভরা-নদীর মতো নূরজাহানকে পাখি এবং নারীর মধ্যেকার সঠিক সম্পর্ক বোঝাতে হোঁচট খেয়েছিল- ম্যাবাই ময়নার ছাও কয়া আমাক শালিক দিছিলেন ক্যা? তখন পাকা নোয়ানো ধানের ভেতর প্রতিশোধ নেয়ার উৎসব শুরু হয়- আব্দুল ওয়াহিদের ক্ষতবিক্ষত পিঠে গেঞ্জির ওপর কাগজের টুকরো সাঁটা,... প্রতিশোধ নিয়ে গেলাম। গ্রামের মানুষ বলে, আব্দুল ওয়াহিদ কিছুকাল থেকে পাখি ও ফুলগাছের সঙ্গে নিম্নস্বরে কথা বলতে শুরু করেছিল, অথবা কেউ বললো সে আসলে স্বপ্ন পুনর্নির্মাণ শুরু করেছিল। স্বপ্নের সবুজ আনন্দময় গন্ধে রায়গঞ্জের মানুষ ফের স্বপ্ন দেখা শুরু করে তাদের প্রিয় লিথিয়াম অ্যালার্ম ক্যাসিও ক্রোনোর সময়-কণা গুনতে গুনতে। দয়াবান সচিব শহীদুল হক রায়গঞ্জের আব্দুল করিমকে তার নিরুদ্দেশকালের মনোটনি এড়ানোর জন্য আগারগাঁও, ভূতের গলি, বনগ্রাম, নারিন্দা অথবা র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের কোনো একটি মেসে ভর্তি করে দেন। শহীদুল হক আব্দুল করিমের জন্য বেবিট্যাক্সির বাতিল টায়ার কিনে দেন, কালো রঙের মাটির কলসটি যথাযথ বসিয়ে রাখার জন্য। একটি সিঙ্গেল খাট উপহার দেন, বই সরবরাহ করেন, বেতের চেয়ার দান আর আব্দুল করিম চেক লুঙ্গি পরে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বেতের চেয়ারে বসে বই পড়ে।
শহীদুল নিয়ম করে আব্দুল করিমকে আধা ডজন সস্তা কাঁচের গ্লাস কিনে দেন, গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলতে বলেন, আর সারাদিন শিশি-বোতল কাগজওয়ালার সঙ্গে বিকিকিনির দরপত্র তৈরি করতে বলেন। আব্দুল করিম অন্ধকারের ভেতর দুইবার কাশি দেন। কিংবা আলো এলে, তিনি কাশি দিলেন না। তিনি আলোর ভেতর ঘুমিয়ে গেলেন এবং স্বপ্নমগ্ন হলেন। কিন্তু আমরা আব্দুল করিমকে স্বপ্নের ভেতর আড়াল হয়ে যেতে দিতে পারবো না। কারণ আমরা তো জানি যে, স্বপ্ন জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ, অথবা জীবন, স্বপ্নের মতো। আমরা তাই তাকে স্বপ্নের ভেতর ধরবো, আমরা তার আলোকিত জানালাটি দেখতে পাবো এবং তাকে, এই জানালার পাশে সমতল একটি ভূমির ওপর, আমাদের মনে হবে যে, আমরাও হয়তো স্বপ্ন দেখছি, অথবা এটা তো তারই স্বপ্ন।
শহীদুল হক খদ্দরের সাদা চাদরের ভেতর ডুবে থাকা শহীদুল জহিরকে স্বপ্ন দেখার ভয় দূর করার জন্য ডাকেন। তার কডের প্যান্ট, ব্লেজার এবং ভারি জুতো ঘরের এককোণে। তার হাতের লিথিয়াম ক্রোনো অ্যালার্ম ক্যাসিও ঘড়ি থেকে সময় ঝরে পড়ছে। তিনি ভাবছিলেন পার্বত্য দপ্তর সামলানোর জন্য একবার কী কাপ্তাই বাঁধ দেখতে যাওয়া দরকার? কেউ মৃদু ভর্ৎসনা করে- আপনে তিনটা ভাঙা গেলাস এইখানে রাইখেন না। চাইরটা ভাঙলে রাইখেন। শহীদুল হক আনমনে চতুর্থমাত্রার খসড়া করেন, পরপর চারটি গ্লাস ভাঙেন, পার্বত্য বাঁধ নিয়ে ভাবেন আর ইংরেজিতে অনুবাদ করেন: আব্দুল করিমের পায়ের কাছে কচুপাতার ওপরকার পানির মতো তরল নারী টলমল করবে, আমরা দেখবো, কিন্তু সে দেখবে না। ডলু নদীর হাওয়ায় ঘরের পর্দা এবং কর্ডের প্যান্ট উড়ে বেড়ায়। শহীদুল হক পার্বত্য-দপ্তরের নতুন সরকারি হলুদ খাম খোলা-বন্ধ করেন; আর নতুন দফতরের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যবর্তী ছুটির কালে, অলস-অবসর কাটানোর জন্য কবিতা অনুবাদের পুরনো অভ্যাসে ফিরে যান বহুদিন পর- এবার বাংলা থেকে ইংরেজি নয়, ইংরেজি থেকে বাংলায়: এইভাবে হবে, এইভাবে একদিন শাশ্বত ইঁদুর এসে সমস্ত জ্যোৎস্না কুরে খাবে।... লাল ঘুড়ি বুকের ওপরে ঠেকে যায়, তুমি কোনদিক থেকে সুতো পাঠিয়েছ? শৈশব, তোমার সব গাছপালা এখন নিহত- ডুবে যেতে যেতেও উঠে আসি, এই এক অদ্ভুত খেলা চলেছে। আমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল ১৯৭১-এর এক ভোরবেলা, আমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল চেরিগাছের শীতকালীন পাতার মতো, তবু তো দাঁড়িয়ে উঠে আমি কথা বলছি। আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়াচ্ছি এদিক-ওদিক। ভারি পর্দা- তবু হাওয়া দিলে হঠাৎ হঠাৎ দুলে ওঠে। (সাদা খদ্দরের চাদর বাতাসে দোল খেতে-খেতে পর্দা অবধি পৌঁছায়।) জন্মের স্মৃতির দিকে চলে যাই। কিংবা জন্মেরও আগে, গর্ভের গুহায় আলো-আঁধারির ছায়া, ঝর্ণার চঞ্চলে টানে নুড়ি-পাথরের, আনাগোনা- আমার গলার স্বরে (দয়া করে) ঢুকে পড়। বিচিত্র বাজনা বাজে থেমে থেমে, কখনো বা জোরে। মানুষজনের সঙ্গে আরো কিছু কাজ বাকি আছে- সময় ফুরিয়ে এলো, এইবার সেরে নিতে হবে। তোমরা যারা দূরে আছো, তাড়াতাড়ি আমার ভেতর ঢুকে পড়ো।
নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে আমরা তখন ভূতের গলি, গ্রীন রোড অথবা আগারগাঁও কলোনির দিকে এগুতে থাকি। তারপর আমরা একদিন একশ’ এগার বছর বাঁচার আগেই সাদা খদ্দরের চাদরওয়ালা, সেনাপ্রজাতন্ত্রীর একমাত্র সচিব মহোদয়কে দেখতে গেলে অবাক হই- তার প্রিয় চিরঞ্জীব বনৌষধি ভাঙা গ্লাসের টুকরোর সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের গামলায় আর একটি ধবধবে কাপড়ের নার্স, তার রঙিন নখ দিয়ে আলগোছে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে নিচ্ছেন সুহাসিনী জনপদের অনুমতি ছাড়া-ই। শহীদুল হক আবছা খোলা চোখে, নাকের ভেতর কর্পূর মেশানো তুলো নিয়ে এবার রায়গঞ্জ থেকে আসা রাস্তার চারপাশে মৃতসঞ্জিবনীর অনুপান খুঁজতে শুরু করেন, অন্তত আরো একশ’ এগার বছর বাঁচার জন্য। মৃতসঞ্জিবনীর করণকৌশল যখন জানা হলো চিরঞ্জীব-বনৌষধির অখ- সংস্করণে তীব্র কম্বিং অপারেশন শেষে, তখন কেউ একজন যমুনার ভেতর থেকে উঠে আসা জলকন্যার মতো, উত্তাল-মেলার ইনোসেন্ট ইরেনদিরার মতো, নয়নতারার মতো, সম্মানিত গণিকার মতো, আব্দুল করিমের মতো, আব্দুল ওয়াহিদের মতো, মাঙ্কিবয়ের মতো, চাঁদ মিঞার মতো, জুলি ফ্লোরেন্সের মতো, ক্লার্কের মতো, খৈমন আর নিমফলদাসীর মতো মমতায় সঞ্জিবনীর নির্যাসময় পোর্সেলিন চামচ ঠোঁটে ধরেন। মৃতসঞ্জিবনীর জলরাশি শহীদুলের হঠাৎ কাশির দমকে ছলকে ওঠে যেন বা। তখন হাওয়া আসে ডলু নদী থেকে, আর ভূতের গলির কয়েক লাখ কাক এবং আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লাল বেলুন শহীদুল হককে পিঠের ওপর টেনে নেয়, আর শহীদুল মৃত বিস্তৃত মেঘের ভেতর ডুবে যেতে যেতে সরকারের পার্বত্য-সম্মেলনের জন্য কাপ্তাই বাঁধের আশপাশে খানিকটা শুকনো জায়গা খুঁজতে শুরু করেন। শিলপৈতাং, মারিশ্যা, সিজক, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, শুভলং, দূরছড়ি থেকে এবেলা মাননীয় সেনা সমর্থিত সেলফোন বাজে ঘন ঘন, কিন্তু এই প্রথম তিনি সরকারী প্রজ্ঞাপনপত্র অবমাননা করে, ফোন মিউট করে দেন। ফলে পার্বত্য শান্তি আলোচনা কোন প্রকার অগ্রগতি ছাড়া-ই স্থগিত হয়ে যায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমরা অতঃপর উদ্বিগ্ন হই, হতবিহ্বল হই এবং আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে জীবনকে নিমজ্জিত করি।
মামুন হুসাইন
বৃহস্পতিবার, ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
(পূর্ব প্রকাশের পর)
তরমুজের রক্ত পান করতে করতে আমাদের সামান্য পুনরুত্থান হয় অথবা পূর্ণিমার আলো এসে আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে ঘোলা করে ফেলে। ফলে উনিশশ’ পঁচাশির দিকে শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের আব্দুল মজিদ, মাইক্রোফোনে একাত্তরের রাজনৈতিক সৈন্যদলের প্রিয়পাত্র, বদু মওলানার পুত্রের মুখে ‘আপনাদের ধন্যবাদ’ শুনতে পেয়ে স্পঞ্জ স্যান্ডেলের ফিতা হারিয়ে সামান্য ধন্ধে পড়ে। আব্দুল মজিদ শঙ্কিত চোখে কাক দেখে, বদু মওলানার জোব্বা দেখে, জোব্বায় লেগে থাকা একদা উত্তাল মার্চে ক্যাপ্টেনের পেশাব দেখে, মৃত হিজড়ার রঙিন নখ দেখে, কতিপয় রাজাকারকে তুলসী পাতা চিবুতে দেখে, বাসন্তি গোমেজের ভাই পঙ্কজ গোমেজকে গিটার বাজাতে দেখে, বদু মওলানার নপুংশক পুত্রের খৎনা দেখে, বোনের লাশ দেখে, মায়াবতীর চিঠি পোড়ানো ছাই দেখে তুলসীর বেদীমূলে আর দেখে একাত্তর সালের একুশটি মাথার খুলি কলাপাতার ওপর সাতটি সারিতে সাজানো, যখন সম্ভ্রান্ত কাক-সম্প্রদায় বৈদ্যুতিক তার জুড়ে বহুদিন পর সম্মেলক-সঙ্গীত গাইছে- আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে...; কিন্তু মহল্লার মানুষ সহসা সঙ্গীত আস্বাদ করতে ব্যর্থ হয়ে, উদ্দীপনার সন্ধানে একজন বাজিকরের হাত থেকে মুঠি মুঠি ডুমুর খেতে শুরু করে। ডুমুর আনন্দ দেয় এবং একঘেয়ি করে। তারপর মনোটোনি এড়াতে মানুষ যখন উইক এন্ডে সুহাসিনী গ্রামে বেড়াতে আসে, তাদের আবারও অনুমান হয় তারা বাঁচবে অন্তত একশ’ এগার বছর। ওস্তাদ শিখাইছিল যে, মাইনষের জীবনের উপর ভর কইর্যা থাকে চাইরটা জিনিস, এ্যার একটা হইলো, সূরযো, তার বাদে চান, মঙ্গল আর শনি। একবার মনে হইছিল যানি রক্তের ভিতর চুবান খায়া উইঠছিল সেদিন চানটা। চন্দ্র সূর্যের বর্ণনা শুনতে শুনতে আমরা কয়েকটি নতুন জায়গার নাম শিখি- কুত্তা মারার মাঠ, রৌছারবিল ও চান্দাইকোনা, আর শুনতে পাই বিশেষ এক গোপন যাদুবিদ্যায় আমরা বাঁচতে পারবো অন্তত একশ’ এগার বছর। কৃষকেরা তামাকের ধোঁয়ার ভেতর লালশাক দেখে এবং গল্প করে- কে এক নবজাতককে জ্যোৎস্নার আলোয় কলসিতে রাখা পানি দিয়ে গোসল করানো হলো। একজন রক্তে ডুবোনো চাঁদ দেখে আর ভাবে- একশ’ এগার বছর আমি চেয়ারম্যান অথবা সাংসদ হয়ে সুহাসিনী গ্রামের জ্যোৎস্না পান করবো। কিন্তু গ্রামের ভেতর আগুন, পুলিশ ও মিলিটারি এসে সিরিয়াল কিলিংয়ের একটি রাজনৈতিক বাস্তবতা তৈরি করে ফেলে।
এরকম এক হুজ্জতের কালে, বালিহাঁসের ডিম খুঁজতে যেয়ে হাঁড়ির ভেতর একটি ফুটফুটে মেয়ে খুঁজে পায় আকালু। নতুন হাটের নামকরণ হয় আগারগাঁও কলোনির নিখোঁজ নয়নতারা ফুলের নামে, নয়নতারার হাট। নয়নতারা হাটে পৌঁছানো মাত্রই গল্প ছুটে আসে ডলু নদীর হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। আকালু কবে পাঙ্গাসি হাটের ইমামের কাছে যেয়ে বিয়ে করলো, তার উত্তেজক বর্ণনা ভাসে বাতাসে। কেউ গল্প শোনায়- একবার আমরা বহুদিন ভোলানাথ অপেরায় নিমজ্জিত ছিলাম লাঙল ও চাষবাস ছেড়ে, অথবা পলাতক হয়েছিলাম সুহাসিনী গ্রাম থেকে। ভোলানাথ অপেরার ক্লারিওনেট অথবা গানবাদ্য নিঃশেষ হয়ে গেলে এই গ্রামের চন্দ্রভানের কাছে জ্বীন আসে এবং সে রাতভর হেঁটে বেড়ায়। এরকম এক সুশৃঙ্খল-বিশৃঙ্খলার কালে গ্রামের কতিপয় স্লিপওয়াকার মাও সেতুংয়ের পাঁচটি প্রবন্ধ অথবা ছয়টি প্রবন্ধের বই খুঁজে পায়। প্রবন্ধের লাল বইগুলো রক্তাক্ত পূর্ণিমায় স্লান করে কোথায় নিখোঁজ হয়, সুহাসিনীর কেউ জানতে পারে না। সবুজ-উজ্জ্বল সব্জি কিনতে ব্যর্থ হয়ে কতিপয় হাটুরে মানুষ ইউএনও সাহেবের সবুজ জিপ উড়ে যেতে দেখে অগত্যা, আর শুনতে পায় যমুনা বক্ষে ইনোসেন্ট ইরেনদিরা’র মতো এক গণিকা বহুকাল আগে হয়ে উঠেছিল মায়ের মতো, প্রেমিকার মতো এবং করুণাময়ী ধরণীর মতো। হাটুরে মানুষ, দূর থেকে নাসিরুদ্দিনকে চিনতে পারে, যে মোরগের আ-া উপহার দিয়েছিল দুলালিকে খাওয়ার জন্য, যেন সে আরো ফর্সা হয়। দুলালি কবে সাতান্নটি চিরকুট তৈরি করে, সে খবর তৈরি হয় কারোর মাথায়, আর মন খারাপ হয়, চিরকুটের বক্তব্য পড়তে পড়তে- ‘তুমি কিছু কও না কেন’! মানুষ সহসা কথা বলতে ভুলে যায়। অথবা তারা হয়তো ভুলে যায় না, হয়তো ভেবেছিল, একত্রে তারা দুলালি ও নাসিরুদ্দিনের সম্পর্কহীনতার দুর্যোগ মোকাবেলা করবে। কিন্তু সুরধ্বনি গ্রামের ভেতর হঠাৎ ঢুকে পড়া প্রথম-মোটরগাড়ির সম্মান অনুধ্যান করতে করতে তারা বিভ্রমে পড়ে এবং চিন্তাচ্যুত হয়- দেখে একটি চার দরজার ঝকঝকে কার জোড়া নৌকার ফেরিতে চড়ে করতোয়া হয়ে এইমতে ধানঘড়া হাটে নামলো। হয়তো তখন-ই দ্বিতীয় ভেইকল হিসেবে মেজর ইলিয়াসের গাড়ি এসেও হাজির হয়, অথবা গাড়ির ধুলোয় দেখতে অসুবিধে হয় দুলালিকে, যে একা কথা বলছিল খোকসা গাছের পাতার সাথে, কিংবা সে তরল রোদ পান করার মতো, ড্রামে গুলানো হলুদ রঙ হয়তো পান করছিল নাসির ভাইয়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য, যখন সাতান্নটি চিরকুট ঘাসের ভেতর শালুক ফুলের মতো ফুটেছিল। হয়তো তখন কেউ যুদ্ধে যাওয়ার আশায় মাটির ভেতর পতাকা পুঁতে ফেলে। হয়তো যুদ্ধ থেকে কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না। হয়তো ফের পূর্ণিমার চাঁদ ওঠে আর দীর্ঘ একটি কবরের ভেতর পুরো পরিবার বিশেষ এক রাজনৈতিক বাস্তবতার জের ধরে চিরকালের মতো আটক হয়ে যায়। হয়তো লোকটিকে আর বাঁচানো যায়নি একশ’ এগার বছর, কিংবা সে হয়তো বেঁচে যায়, হয়তো লোকটি পালিয়ে যায় কাঠের ভুষির ভেতর দূর কোনো সমুদ্রের শহরে। হয়তো ডলু নদীর হাওয়ায় সে ঘুমিয়ে পড়ে, অথবা দেখে দূরের হালদা নদীর জলে সার-সার নৌকা, মাছ ও ডিম্বাণুর আশায় প্রহর গুনছে। হয়তো নৌকার নিংড়ানো আলোর রাজ্যে খৈমন নামে একটি কন্যার সে সন্ধান পায়। হয়তো এরা সবাই খৈমন, দুলালি অথবা জুলি ফ্লোরেন্স নাম ধারণ করে। ভ্যাটিকান কুন জায়গায়?... ভ্যাটিকান রোমে, ইটালিতে, ইটালি কোথায়?- এমনি সব প্রশ্ন করে বিরক্তি ছড়ায়। যোসেফ ইউজিন, বব এবং মিসেস ক্লার্কের সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে কথা হয় কোনো কোনোদিন। তখন নয় মাসের জন্য স্কুল বন্ধ হয়ে যায় আর স্কুলের বারান্দায় একদিন পাকিস্তানি মিলিটারি মানুষ মেরে হয়রান হয়া গলা শুকায়া ফালায়। মহল্লায় তখন ফের বান্দর আসে এবং কেউ বান্দরের উৎপাত নিয়ে সাংবাদিকদের লিখতে বলে। মৈশুন্দি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আবুবকর মওলানা সাংবাদিকদের সঙ্গে হাসি-তামাশা ও ঐকমত্য করে। আব্দুল গণি কমান্ডার এই ফাঁকে একটি অবাক করা বাক্য বানায়- খৈমনের মুখটা কী পানিতে ভেজা বৃক্ষ শাখার মতো বলতে পারি আমি। শহীদুল জবাব না দিয়ে ডুমুর চিবোয়! আর সরদার ফজলুল করিমের ক্লাসে পড়া প্রটেস্টান্ট ইথিক্স সম্পর্কে, ঝিকরগাছার ফাদার অ্যান্থনি ম্যারিয়েত্তির সঙ্গে কথা বলার জন্য অস্থির হতে থাকে। কিন্তু ফাদার কেবল অ্যালবার্ট ডি সুজা ও লাবণ্যবিষয়ক গল্প-গাছা শোনায়। লাবণ্যের ছায়া যখন বৃক্ষের মতো ছড়িয়ে যাচ্ছে, তখন জুলিফ্লোরেন্সের ভালোবাসায় শহীদুলের কোনো এক বন্ধু ধীরে ধীরে মাঙ্কিবয় হয়ে ওঠে, মাঙ্কিবয় সবুজ ও লাল রং চিনতে পারে না কোনোদিন। ফলে জনৈক কালার ব্লাইন্ড-মাঙ্কিবয় ফরেন ইনভেস্টারসদের রং বুঝতে না পেরে তাদেরকে প্রশ্ন কাতর করে- উই আর ফরেন ইনভেস্টারস, হাউ ডেয়ার দে স্টিল আওয়ার প্রপার্টি। সেনাপ্রজাতন্ত্রী কনক দ্বীপপুঞ্জের দুর্বিনীত মাঙ্কিবয় আনুগত্য প্রকাশের জন্য এবার পোঁটলার পোলা কাম চানমিঞা কাম কারথিপ কাম খরগোশ হয়া আসমানতারার খাঁচার ভেতর বিশ্রাম নেয়ার আয়োজন শুরু করে।
এই ‘বিশ্রামের আয়োজন’ রায়গঞ্জ অথবা সুহাসিনী গ্রামের কেউ বাংলায় অনুবাদ করে,... ধুলোর দিনে ফেরা! ডুমুর খাওয়ার দিনগুলোতে কে একজন ইলিয়াসের স্মৃতির উদ্দেশে তখন বই লেখে। লোকে বলে ধুলোর গন্ধের ভেতর অন্য একজন মানুষ ঘরে ফেরারকালে মাঠের সবুজ চিবুতে চিবুতে হঠাৎ গতকাল মৃতদেহ হয়ে উঠেছে। এই লোকটির ছিল দিগন্তবিস্তৃত স্বপ্ন। কিন্তু সে একবার শ্যামল ও সুশ্রী ভরা-নদীর মতো নূরজাহানকে পাখি এবং নারীর মধ্যেকার সঠিক সম্পর্ক বোঝাতে হোঁচট খেয়েছিল- ম্যাবাই ময়নার ছাও কয়া আমাক শালিক দিছিলেন ক্যা? তখন পাকা নোয়ানো ধানের ভেতর প্রতিশোধ নেয়ার উৎসব শুরু হয়- আব্দুল ওয়াহিদের ক্ষতবিক্ষত পিঠে গেঞ্জির ওপর কাগজের টুকরো সাঁটা,... প্রতিশোধ নিয়ে গেলাম। গ্রামের মানুষ বলে, আব্দুল ওয়াহিদ কিছুকাল থেকে পাখি ও ফুলগাছের সঙ্গে নিম্নস্বরে কথা বলতে শুরু করেছিল, অথবা কেউ বললো সে আসলে স্বপ্ন পুনর্নির্মাণ শুরু করেছিল। স্বপ্নের সবুজ আনন্দময় গন্ধে রায়গঞ্জের মানুষ ফের স্বপ্ন দেখা শুরু করে তাদের প্রিয় লিথিয়াম অ্যালার্ম ক্যাসিও ক্রোনোর সময়-কণা গুনতে গুনতে। দয়াবান সচিব শহীদুল হক রায়গঞ্জের আব্দুল করিমকে তার নিরুদ্দেশকালের মনোটনি এড়ানোর জন্য আগারগাঁও, ভূতের গলি, বনগ্রাম, নারিন্দা অথবা র্যাঙ্কিন স্ট্রিটের কোনো একটি মেসে ভর্তি করে দেন। শহীদুল হক আব্দুল করিমের জন্য বেবিট্যাক্সির বাতিল টায়ার কিনে দেন, কালো রঙের মাটির কলসটি যথাযথ বসিয়ে রাখার জন্য। একটি সিঙ্গেল খাট উপহার দেন, বই সরবরাহ করেন, বেতের চেয়ার দান আর আব্দুল করিম চেক লুঙ্গি পরে, স্যান্ডো গেঞ্জি গায়ে বেতের চেয়ারে বসে বই পড়ে।
শহীদুল নিয়ম করে আব্দুল করিমকে আধা ডজন সস্তা কাঁচের গ্লাস কিনে দেন, গ্লাসগুলো ভেঙে ফেলতে বলেন, আর সারাদিন শিশি-বোতল কাগজওয়ালার সঙ্গে বিকিকিনির দরপত্র তৈরি করতে বলেন। আব্দুল করিম অন্ধকারের ভেতর দুইবার কাশি দেন। কিংবা আলো এলে, তিনি কাশি দিলেন না। তিনি আলোর ভেতর ঘুমিয়ে গেলেন এবং স্বপ্নমগ্ন হলেন। কিন্তু আমরা আব্দুল করিমকে স্বপ্নের ভেতর আড়াল হয়ে যেতে দিতে পারবো না। কারণ আমরা তো জানি যে, স্বপ্ন জীবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ, অথবা জীবন, স্বপ্নের মতো। আমরা তাই তাকে স্বপ্নের ভেতর ধরবো, আমরা তার আলোকিত জানালাটি দেখতে পাবো এবং তাকে, এই জানালার পাশে সমতল একটি ভূমির ওপর, আমাদের মনে হবে যে, আমরাও হয়তো স্বপ্ন দেখছি, অথবা এটা তো তারই স্বপ্ন।
শহীদুল হক খদ্দরের সাদা চাদরের ভেতর ডুবে থাকা শহীদুল জহিরকে স্বপ্ন দেখার ভয় দূর করার জন্য ডাকেন। তার কডের প্যান্ট, ব্লেজার এবং ভারি জুতো ঘরের এককোণে। তার হাতের লিথিয়াম ক্রোনো অ্যালার্ম ক্যাসিও ঘড়ি থেকে সময় ঝরে পড়ছে। তিনি ভাবছিলেন পার্বত্য দপ্তর সামলানোর জন্য একবার কী কাপ্তাই বাঁধ দেখতে যাওয়া দরকার? কেউ মৃদু ভর্ৎসনা করে- আপনে তিনটা ভাঙা গেলাস এইখানে রাইখেন না। চাইরটা ভাঙলে রাইখেন। শহীদুল হক আনমনে চতুর্থমাত্রার খসড়া করেন, পরপর চারটি গ্লাস ভাঙেন, পার্বত্য বাঁধ নিয়ে ভাবেন আর ইংরেজিতে অনুবাদ করেন: আব্দুল করিমের পায়ের কাছে কচুপাতার ওপরকার পানির মতো তরল নারী টলমল করবে, আমরা দেখবো, কিন্তু সে দেখবে না। ডলু নদীর হাওয়ায় ঘরের পর্দা এবং কর্ডের প্যান্ট উড়ে বেড়ায়। শহীদুল হক পার্বত্য-দপ্তরের নতুন সরকারি হলুদ খাম খোলা-বন্ধ করেন; আর নতুন দফতরের দায়িত্ব গ্রহণের মধ্যবর্তী ছুটির কালে, অলস-অবসর কাটানোর জন্য কবিতা অনুবাদের পুরনো অভ্যাসে ফিরে যান বহুদিন পর- এবার বাংলা থেকে ইংরেজি নয়, ইংরেজি থেকে বাংলায়: এইভাবে হবে, এইভাবে একদিন শাশ্বত ইঁদুর এসে সমস্ত জ্যোৎস্না কুরে খাবে।... লাল ঘুড়ি বুকের ওপরে ঠেকে যায়, তুমি কোনদিক থেকে সুতো পাঠিয়েছ? শৈশব, তোমার সব গাছপালা এখন নিহত- ডুবে যেতে যেতেও উঠে আসি, এই এক অদ্ভুত খেলা চলেছে। আমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল ১৯৭১-এর এক ভোরবেলা, আমার তো মরে যাওয়া উচিত ছিল চেরিগাছের শীতকালীন পাতার মতো, তবু তো দাঁড়িয়ে উঠে আমি কথা বলছি। আস্তে আস্তে হেঁটে বেড়াচ্ছি এদিক-ওদিক। ভারি পর্দা- তবু হাওয়া দিলে হঠাৎ হঠাৎ দুলে ওঠে। (সাদা খদ্দরের চাদর বাতাসে দোল খেতে-খেতে পর্দা অবধি পৌঁছায়।) জন্মের স্মৃতির দিকে চলে যাই। কিংবা জন্মেরও আগে, গর্ভের গুহায় আলো-আঁধারির ছায়া, ঝর্ণার চঞ্চলে টানে নুড়ি-পাথরের, আনাগোনা- আমার গলার স্বরে (দয়া করে) ঢুকে পড়। বিচিত্র বাজনা বাজে থেমে থেমে, কখনো বা জোরে। মানুষজনের সঙ্গে আরো কিছু কাজ বাকি আছে- সময় ফুরিয়ে এলো, এইবার সেরে নিতে হবে। তোমরা যারা দূরে আছো, তাড়াতাড়ি আমার ভেতর ঢুকে পড়ো।
নির্দেশ পালনের উদ্দেশ্যে আমরা তখন ভূতের গলি, গ্রীন রোড অথবা আগারগাঁও কলোনির দিকে এগুতে থাকি। তারপর আমরা একদিন একশ’ এগার বছর বাঁচার আগেই সাদা খদ্দরের চাদরওয়ালা, সেনাপ্রজাতন্ত্রীর একমাত্র সচিব মহোদয়কে দেখতে গেলে অবাক হই- তার প্রিয় চিরঞ্জীব বনৌষধি ভাঙা গ্লাসের টুকরোর সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের গামলায় আর একটি ধবধবে কাপড়ের নার্স, তার রঙিন নখ দিয়ে আলগোছে অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে নিচ্ছেন সুহাসিনী জনপদের অনুমতি ছাড়া-ই। শহীদুল হক আবছা খোলা চোখে, নাকের ভেতর কর্পূর মেশানো তুলো নিয়ে এবার রায়গঞ্জ থেকে আসা রাস্তার চারপাশে মৃতসঞ্জিবনীর অনুপান খুঁজতে শুরু করেন, অন্তত আরো একশ’ এগার বছর বাঁচার জন্য। মৃতসঞ্জিবনীর করণকৌশল যখন জানা হলো চিরঞ্জীব-বনৌষধির অখ- সংস্করণে তীব্র কম্বিং অপারেশন শেষে, তখন কেউ একজন যমুনার ভেতর থেকে উঠে আসা জলকন্যার মতো, উত্তাল-মেলার ইনোসেন্ট ইরেনদিরার মতো, নয়নতারার মতো, সম্মানিত গণিকার মতো, আব্দুল করিমের মতো, আব্দুল ওয়াহিদের মতো, মাঙ্কিবয়ের মতো, চাঁদ মিঞার মতো, জুলি ফ্লোরেন্সের মতো, ক্লার্কের মতো, খৈমন আর নিমফলদাসীর মতো মমতায় সঞ্জিবনীর নির্যাসময় পোর্সেলিন চামচ ঠোঁটে ধরেন। মৃতসঞ্জিবনীর জলরাশি শহীদুলের হঠাৎ কাশির দমকে ছলকে ওঠে যেন বা। তখন হাওয়া আসে ডলু নদী থেকে, আর ভূতের গলির কয়েক লাখ কাক এবং আকাশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা লাল বেলুন শহীদুল হককে পিঠের ওপর টেনে নেয়, আর শহীদুল মৃত বিস্তৃত মেঘের ভেতর ডুবে যেতে যেতে সরকারের পার্বত্য-সম্মেলনের জন্য কাপ্তাই বাঁধের আশপাশে খানিকটা শুকনো জায়গা খুঁজতে শুরু করেন। শিলপৈতাং, মারিশ্যা, সিজক, বাঘাইছড়ি, খাগড়াছড়ি, শুভলং, দূরছড়ি থেকে এবেলা মাননীয় সেনা সমর্থিত সেলফোন বাজে ঘন ঘন, কিন্তু এই প্রথম তিনি সরকারী প্রজ্ঞাপনপত্র অবমাননা করে, ফোন মিউট করে দেন। ফলে পার্বত্য শান্তি আলোচনা কোন প্রকার অগ্রগতি ছাড়া-ই স্থগিত হয়ে যায় অনির্দিষ্ট কালের জন্য আমরা অতঃপর উদ্বিগ্ন হই, হতবিহ্বল হই এবং আমাদের রাজনৈতিক বাস্তবতার কাছে জীবনকে নিমজ্জিত করি।