বিনয় মজুমদার
দীপংকর গৌতম
কালের কবি, কালান্তরের কবি
অনেকে তাকে ‘কবিদের কবি’ অভিধায়ও অভিযুক্ত করেন। কেউ কেউ তাঁর কবিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ পড়ে একবারেই বলে ফেলেছেন- বিনয় মজুমদারের কবিতা অশ্লীলতায় ভরা। অর্থাৎ বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে নানা মুনির রয়েছে নানা মত। এই নানা মতের কারণও ঘিলুর তারতম্য। ওপার বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র তার এক লেখায় লিখেছিলেন- ‘কেচোর মায়ের পুত্রশোক মাত্র দু’দিনের। গরুর মায়ের আরেকটু বেশি। এই কমবেশি হওয়ার কারণ শুধুমাত্র ঘিলুর তারতম্য।’ এসব কথা এজন্যই বলা যে, বাজার অর্থনীতির পণ্য দস্যুতা। এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর ধাক্কা মননশীলতার ওপরও যেন আছড়ে পড়েছে। যার পরিণতির নাম নেটিজেন সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের বড় ধরনের সর্বনাশ করেছে। বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে যারা কবিতা সম্বন্ধে আলোচনার ধৃষ্টতা দেখায়। একবারে যেকোনো কাউকে তারা অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু এই প্রবণতাকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছে যে, বিনয় মজুমদারের মতো কবির কবিতাকে তারা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট করে। তার কবিতার সমালোচনা করার স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু সমালেচনা যেখানে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয় সেখানে আর বলার কী থাকে। এই গৌরচন্দ্রিকা শুধুমাত্র বিনয়ের জন্য- যে কবি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন-
“ভালোবাসা দিতে পারি তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?” পংক্তিটির মধ্য দিয়ে কবিতার ইশতেহার প্রকাশিত হয়ে যায়। বোঝা যায়, একজন কবির দৃষ্টি কতোটা প্রখর এবং তার অনুভূতির প্রাবল্য কতোটা সাহসী। তাঁর নিজের সম্বন্ধে নিজে যে উচ্চারণ করেছেন তার মধ্য দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন নিজেকে।
তাই লিখেছেন অনেক কথা- যেসব কোনো সাধারণ কথা নয়। তাঁর কবিতার টেক্সচার নির্মাণে সেসব বিষয় স্পষ্ট। তাঁর সম্পর্কে অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের মূল্যায়নও গুরুত্ববহ। কবি বিনয় মজুমদারকে কেউ স্বাভাবিক মেধাবী কবি ভাবেননি কখনও। “কবিদের কবি” হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। এ খ্যাতি কখন কার ভাগ্যে মেলে?
তিনি এসেছিলেন, ভালো বেসেছিলেন,
প্রকৃতি, সারস, ফুল, বৃক্ষ-লতা, গাঁওগেরাম, নদী,
মানুষের সত্য, মনুষ্যত্ব, অকপট আচরণ যেন নির্বোধের
তিনি নেই আর ঠাকুর পুকুরে, জলে-স্থলে-অনন্ত রোদসী আকাশে,
পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণে ও আনাচে কানাচে।
ভালো ছাত্র। বিনয় ছিলেন না ঠিক টিপটপ, সামাজিক।
(অভিমানে অন্তর্ধান, মৃণাল কান্তি সেনগুপ্ত)
বিনয় মজুমদার। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার, গণিতবেত্তা ও কবি। এ যেন নানা বর্ণের সত্তার এক জীবন। একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি গণিতের নানা কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন। যার গাণিতিক সূত্রগুলো ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি পারদর্শী ছিলেন রুশ ভাষায়, যা খুব সহজেই রপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গণিত-প্রকৌশল সব বিষয়কে তিনি অতিক্রম করেছিলেন কবিতার কাব্যপ্রতিমা নির্মাণ করে। তাঁর কবিতার মেটাফর তাই অত্যন্ত শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়ানো। একই সঙ্গে বলতে হয় তাঁর কবিতার দার্শনিক ভিত্তিও প্রথাগত নয়। তাঁর কাব্য চেতনায় ‘প্রেম-ভালোবাসার চিরায়ত বিষয়টিকে তিনি সাজিয়েছিলেন ভিন্নভাবে। তাঁর কবিতায় তিনি লিখেছেন সেইকথাই, তবে তাঁর প্রকাশটা ঠিক ওভাবে নয়। কাব্য ‘ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে/শান্তি এনে দিতে। কেবল নারীর প্রতি পুরুষের কিম্বা কোনো পুরুষের প্রতি/কোনো নারীর প্রণয় ভালোবাসা...’। বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ যন্ত্রশিল্পী হয়েও নিজেকে বিস্তৃত করে হয়ে উঠলেন কাব্যশিল্পী। এরই মধ্যে কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করেন আবার ছেড়েও দেন। তারপর কথাশিল্পীর কারখানা গড়ে তুলেছিলেন কলকাতার কফি হাউসে। সেখানে তার বন্ধু ছিল সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাবেক বার্মার একটি গ্রামে জন্ম হয়েছিল বিনয় মজুমদারের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেখান থেকে বাবা-মার আর বহু মানুষের সঙ্গে বালক বিনয় চলে আসে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে, পৈতৃক ভিটায়। দেশভাগের পর ওপার বাংলার কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুলে ভর্তি হয়। মেধাবী কিশোর বিনয় স্কুল ফাইনাল পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পাস করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। রুশ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে শুরু করেন রুশ ভাষার গল্প, কবিতার অনুবাদ। এমনকি লেরমনতভ্ আর পুশকিনের বেশ কিছু কবিতাও তিনি অনুবাদ করেন। তাঁর এই কবিতা অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে ও বিমল চন্দ্র ঘোষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরই পাশাপাশি গণিত চর্চার আশ্চর্য বুৎপত্তি অর্জন করেছিল বিনয় মজুমদার। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর একটি গবেষণাপত্র পড়ে এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে সেটিকে তিনি সানন্দে সুপারিশ করেছিলেন মহাফেজখানায় রক্ষা করার জন্য। গণিতের পঠন-প্রক্রিয়া বা স্ট্রাকচার বরাবরই তাঁর কবিতাকে ও আঙ্গিককে এক ধরনের আদল দিয়েছে। যাকে বলে ‘অ্যাক্সিওমেটিক ট্রুথ’। বিনয় মজুমদারের কূট কবিভাষা বা পরিভাষা ছিল গাণিতিক এবং সাংকেতিক। উন্মাদ অবস্থায় তাঁর বিশেষ বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছেন “এই বা কে জানে, বিনয় মজুমদার রামানুজনের মতোই এক অজ্ঞাত গণিত প্রতিভা কি না।”
গণিত ছিল বিনয় মজুমদারের প্রিয় বিষয়। ব্যবকলন (ক্যালকুলাস), স্থানাঙ্ক জ্যামিতি, ঘনমূল প্রক্রিয়ার উল্লেখ মাঝে মাঝেই আসে তাঁর কবিতায়, গণিত হিসেবে নয়, অবশ্যই কবিতা হিসেবেই। তাঁর একটি কবিতার নামই হলো ‘আমি গণিত আবিষ্কর্তা।’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি এরকম, “আমি গণিত আবিষ্কর্তা, আমার নিজের আবিষ্কৃত/ঘনমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিটি বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক গণিতে/ অন্তর্ভুক্ত আর পাঠ্য হয়ে গেছে যেটি/ ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর সব বিদ্যালয়ে/পাঠ্য হবে।”
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন বামপন্থি ছাত্রসংগঠনে। ভাষায় পারদর্শিতা, গণিত, কবিতা এমনকি রাজনীতি নিয়েও যেন তাঁর গভীরতার কমতি ছিল না। তিনি তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, “আমি এক কমিউনিস্ট- এই কথা উচ্চারিত হোক/ দিকে দিকে পৃথিবীতে-এ আমার সঙ্গত কামনা।”
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, গণিতবিদ ওমর খৈয়াম, সালভাতোর কোয়াসিমিদো, এডওয়ার্ড লিয়র কবিতার সঙ্গে সখ্য করেছিলেন। কমলকুমার মজুমদার গণিত-রসিক ছিলেন কিন্তু কবিতা লেখেননি। আর বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কবি কিংবা সরদার ফজলুল করিমের মতো প-িত-সাহিত্যিকও গণিতের প্রতি তাদের ভয়ের কথা স্বীকার করেন সরলভাবেই। তবে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা এমন ৬০ দশকের শুরুতে বাংলার এককোনায় কবিতা ও গণিতের এমন এক সমাহার হয়েছিল- যা হয়তো ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। গণিতের এই দুর্বোধ্যতার মিথ এবং কবিতা ও গণিতে একেবারে দুই বিপরীত মেরুর বিষয় এই মিথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনয় মজুমদার নামে একটি মিথের জন্ম। তিনি যেন এক মিথ হয়ে যাওয়া কবি। তাঁর কবিতা আর গণিতের সমাহার প্রসংগে তাঁরই লেখা থেকে:
“প্রত্যেক শিশুই কিছু জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভে থাকে,
প্রত্যেক শিশুই এই জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়েছে,
প্রমাণ: প্রত্যেক শিশু জন্মই মায়ের দুধ
পান করে চুষে চুষে, দেখি।”
তিনি লিখেছেন অনেক নিপাট প্রেমের পদ্য। যেগুলো শুধুই প্রেমের কবিতা নয়। প্রেমের কবিতা তবে সঙ্গে আরও কিছু। অনেকেরই মতো বিনয় মজুমদার গণিতের রসবোধে পুরো একটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন শুধুই প্রেম নিয়ে। কাব্যগ্রন্থের নামেও রয়েছে চমক ‘ফিরে এসো, চাকা’। চাকা আমাদের সভ্যতাকে কতোটা গতিশীল করেছে সে ব্যাপারে নতুন কিছু বলার অবকাশ নেই। চাকা- ভালোবাসাকেও কতোটা জ্বালা কতোটা মুগ্ধতা দিয়েছে বিনয় মজুমদার তার প্রেমের কবিতায় সেকথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন। প্রেম বিনয়ের কবিতায় প্রচলিত ধারার বাইরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রেম মানেই কেবল মিলন বা বিচ্ছেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয়ের ঘেরাটোপে টানেননি তিনি। তাঁর প্রেমের কাব্যে তিনি অনায়াসেই প্রত্যাখ্যাত হবার মধ্যে যে পরাভবের বোধ থাকে, যে ধিক্কার থাকে তারও উল্লেখ করেছেন এভাবে:
“আমিও হতাশবোধে, অবক্ষয়ে, ক্ষোভে, ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়েছি একা”
আবার লিখেছেন: “প্রত্যাখাত প্রেম আজ অসহ ধিক্কারে আ’লীন/অগ্নি উদ্বমন করে এ গহ্বর ধীরে ধীরে তার/ চারিপাশে বর্তমান পর্বতের প্রাচীর তুলেছে।” তার কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো, চাকা’ নিয়ে ঋত্বিক ঘটকও বলেছেন, এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। তিনি বলতেন মানুষের সবচেয়ে পরম চাওয়া হলো দুটো মোটা ভাত আর দুটো স্নেহের হাত। বিনয় মজুমদারের বিশ্বাস তার এই কাব্যভাব জাগ্রত হবার পেছনে রয়েছে একজনই আর তিনি হলেন গায়ত্রী। আর তার ভালোবাসার প্রতিফলনে প্রথম প্রকাশ কাব্যগ্রন্থটা ‘গায়ত্রী’কে উৎসর্গ করতে দ্বিধান্বিত হননি। আর এই অনুভাবিত অনুচ্চার প্রেমই তাকে একবার মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বলে বন্ধুদের মধ্যে জনশ্রুতি আছে। সেই হাসপাতালেই পরিচয় ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। হাসপাতালে বসেই বিনয় মজুমদারকে নিয়ে নাটক লিখে ফেলেন তিনি। মুখ্য অভিনেতা বিনয় মজুমদার নিজেই। চলল মহড়া, কিন্তু মঞ্চস্থ হবার দিনই উধাও অভিনেতা নিজেই। ফলে সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়নি কোনোদিন।
বিনয় মজুমদার জীবনকে হিসেবের কষাঘাতে ফেলেছেন নিজের ইচ্ছায়। এক আজব স্বভাবের মানুষ তিনি। অবশ্য যে মানুষের মস্তিষ্কে গণিতের ক্যালকুলেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নানা ধরনের ইকুয়েশন আর কাব্যভাব একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতো, তিনি তো একটু আবেগঘন হবেনই। হঠাৎ তিনি একবার ভাবলেন পূর্ব বাংলায় আসবেন, তবে পাসপোর্ট ছাড়া। তখন পাসপোর্ট চালু হয়ে গেছে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। ইচ্ছেমতো যাওয়া আসা চলে না। কিন্তু বিনয় মজুমদারের একই কথা তিনি যাবেন পাসপোর্ট ছাড়াই। সবাই বোঝাতে শুরু করলেন এভাবে গেলে ধরা পড়লে গারদে ভরে দেবে। তার কথা, “ভরলে ভরবে। কিন্তু যেখানে আমি আমার বাল্যকাল কাটিয়েছি সেখানে পাসপোর্ট নিয়ে ঢুকতে কেউ আমাকে বাধ্য করতে পারে না।” নিজের মনমতো কাজ করলেন আর পাকিস্তানে ঢুকতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং কিছুদিন পাকিস্তানে জেল খেটে ফিরে যান কলকাতায়।
উনিশ শতকের বিখ্যাত জার্মান কবি ফ্রেডরিক হোন্ডারলিন জীবনের শেষ ৩৪টি বছর মানবেতর জীবন-যাপন করেছিলেন। মানসিক ভারসাম্য ছিল না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ তার জীবনের সাথী-ভাগী ছিল না। জীবনের অন্তিম বছরগুলোতে তার দেখাশোনা করতো একটা দরিদ্র মুচি পরিবার। দেশে অনেক লোক ছিল ফ্রেডরিকের মতো একজন কবির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল জার্মানির একটি মুচি পরিবার। আর বিনয় মজুমদার? সেকথা নয় নাইবা বললাম। তবু বাংলা ভাষা সাহিত্যের এই শহীদ কবির জন্য কষ্ট হয়। কেন এই কষ্টবোধ জানি না; তবু কেন জানি কবিতার এই শহীদের জন্য বুকের বুননে জমে ওঠে কষ্টের শ্যাওলা যতো।
দীর্ঘ ৭২ বছরের জীবননাট্যে তিনি একাধারে একজন সফল কর্মের মানুষ আর অন্যদিকে বড় বেদনার, বড় কষ্টের আর করুণ জীবন। তাঁর জীবনের শেষ পরিণতি ঘটে ১১ ডিসেম্বর, ২০০৬ সালে সকাল সাড়ে ৮টায় নিজ বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের শিমুলপুরে। যে মানুষটি ধীরে ধীরে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি নিজের শরীরের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলার দরুন অসুস্থ হন। ভীষণ অসুস্থ হয়ে সরকারি সাহায্যে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এসময় তিনি ছবিও এঁকেছেন। এরই মধ্যে তাঁর জীবনের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে বলেন, “জানিস, মজুমদার উপাধিটা আগের কালের নবাব/বাদশাহের কাছ থেকে পাওয়া যেত। আমার মনে হয়, ওরা যদি বুদ্ধি করে মজুমদার না দিয়ে মজুতদার দিতো তাহলে খুব মানানসই হতো, বিনয় মজুতদার।” একটু মুচকি হেসে আরো বললেন, “কিরে, মজুতদার দিলে ভালো হতো না? দেখ না কত যন্ত্রণা, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, ব্যথা সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে নিয়ে বসে আছি। বিনয় মজুতদার ভালো হতো না।”
কবিতা আর গণিতে এক লড়াই চলে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে। তিনি লাল খাতার পর হলুদ খাতা, হলুদের পর সবুজ-কখনো কখনো দিনে পঞ্চাশ ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতেন। লিখতেন ইংরেজিতে, মলাটে কোনো খাতার নাম ‘কনিক সেকশন’ কোনোটা ‘ইন্টার পোলেশন সিরিজ’। আর গণিত চর্চার অবসরে চলতো কাব্য ভাবনা। নব্যক্যালকুলাসের জনক বিনয় মজুমদার কবিতার পর কবিতা লিখে চলতেন। তার মৃত্যুর বছর খানেক আগে বলেছিলেন ‘আর কবিতা লিখব না, অন্তত এক বছর না, তার বদলে অঙ্ক কষব। একটা নতুন সিরিজ মাথায় এসেছে তাকে ঝালিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজন হলে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির কোনো বিশারদকে দিয়ে পরীক্ষাও করতে পারি।’ বিনয় মজুমদারের কাছে গণিত আর কবিতায় কোনো প্রভেদ ছিল না। কবিতায়ই যেন তার ধ্যান, তার প্রকৃত গণিত। তিনি জার্মানের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় আর জাপান থেকে আহ্বান পেয়েছিলেন গণিতে অধ্যাপনার জন্য। লন্ডন থেকে ডাক পেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে তিনি রয়ে গেলেন পাখিডাকা গাছ-গাছালিময় বাগান ঘেরা তাঁর ঠাকুরনগর-শিমুলপুরের নিভৃত আশ্রমে। ‘দৃষ্টি বিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়/তোমাকে অস্তিত্বহীনা, হয়তো লুপ্ত, মৃত/অথবা করেছো ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো, পথে/জীবনের কথা ভাবি/ ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে/পুনরায় কেশোদ্গম হবে না/বিমর্ষ ভাবনায় রাত্রির মাছের মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা।” তার কবিতায় ক্ষতসংক্রান্ত বিষয়টি একটি বৈজ্ঞানিক ভাবনার প্রতিফলন। যেটা বিনয়কে ছাড়া অন্য কারো কবিতায় এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট দেখা যায়নি। ক্ষতস্থান কোনোদিন শুকায় না। সেখানে পশমও গজায় না। কবিতায় এটি যে যুক্ত করতে পারে তিনি একজন কালের কথক। বিনয় মজুমদারের ক্ষতে এ অভিধা যোগ করা অত্যুক্তি নয়। শেষ জীবনে প্রকৃতির একদম কাছাকাছি থেকে লিখেছিলেন, “আমরা এখন সাগরে-আকাশে সঞ্চারিত হতে চাই। আমরা পাখিদের আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু পাখিদের কাছে যাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। “হায় হাসি, হায় দেবদারু/মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।” এই দার্শনিক সত্যের চর্চা তার কবিতায় ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? কবিদের ধর্মচেতনার কথা বললে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ পরম আস্তিক ছিলেন। সুধীন দত্ত শূন্যবাদী। জীবনানন্দ দাশ ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রকৃতিকে ঈশ্বর মেনেছিলেন। বিনয়ও জীবনানন্দের মতো প্রকৃতির কণ্ঠ শুনেছিলেন। জীবনে তার অর্জনকে বড়ো করেই দেখা হয়; কিন্তু তাকে দেখার এই প্রবণতা যখন চালু হয়েছে- তখন সাহিতের বিজ্ঞানী সারস তার পালক রেখে উড়ে গেছে নিরন্তরের ঠিকানায়।
তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার, কবিতীর্থ পুরস্কার, কীর্তিবাস পুরস্কার অর্জন করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, ফিরে এসো, চাকা, আমার ঈশ্বরীকে, অঘ্রাণের অনুভূতিমালার জন্য। তিনি তার কবিতা সম্পর্কে বলেন, “আমার সব কবিতাই আসলে দিনপঞ্জি।” বিশ্বমানের কবি আর গণিতজ্ঞ বিনয় মজুমদার কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন নিঃশব্দে আবার প্রস্থানও করলেন নিঃশব্দে। কিন্তু রেখে গেলেন তার অসংখ্য কীর্তি:
‘মাত্র দুটো শব্দকে নিয়ে/ শিল্পীর কণ্ঠে গান,/চিত্রকরের তুলিতে টান,/কবির কলমের চলাফেরা/চিকিৎসকের ভাবনা/বৈজ্ঞানিকের কপালের বলিরেখা/কত শত শোকগাথা, বশ করা যায় না এমন/সত্য/ মৃত্যু, তুমি এক কবিতা।”
দোহাই
বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা
বিনয় মজুমদার স্মারক সংখ্যা
(বাংলাদেশ-ভারত)
নানান রঙের বিনয় মজুমদার
সুপা সাদিয়া
বিনয় মজুমদার
দীপংকর গৌতম
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কালের কবি, কালান্তরের কবি
অনেকে তাকে ‘কবিদের কবি’ অভিধায়ও অভিযুক্ত করেন। কেউ কেউ তাঁর কবিতার বিভিন্ন প্রসঙ্গ পড়ে একবারেই বলে ফেলেছেন- বিনয় মজুমদারের কবিতা অশ্লীলতায় ভরা। অর্থাৎ বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে নানা মুনির রয়েছে নানা মত। এই নানা মতের কারণও ঘিলুর তারতম্য। ওপার বাংলার বিখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব শম্ভু মিত্র তার এক লেখায় লিখেছিলেন- ‘কেচোর মায়ের পুত্রশোক মাত্র দু’দিনের। গরুর মায়ের আরেকটু বেশি। এই কমবেশি হওয়ার কারণ শুধুমাত্র ঘিলুর তারতম্য।’ এসব কথা এজন্যই বলা যে, বাজার অর্থনীতির পণ্য দস্যুতা। এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এর ধাক্কা মননশীলতার ওপরও যেন আছড়ে পড়েছে। যার পরিণতির নাম নেটিজেন সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি আমাদের শিল্প-সাহিত্যের বড় ধরনের সর্বনাশ করেছে। বইয়ের ফ্ল্যাপ পড়ে যারা কবিতা সম্বন্ধে আলোচনার ধৃষ্টতা দেখায়। একবারে যেকোনো কাউকে তারা অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু এই প্রবণতাকে তারা এমন জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছে যে, বিনয় মজুমদারের মতো কবির কবিতাকে তারা অশ্লীলতার দোষে দুষ্ট করে। তার কবিতার সমালোচনা করার স্বাধীনতা সবারই আছে। কিন্তু সমালেচনা যেখানে পক্ষপাত দোষে দুষ্ট হয় সেখানে আর বলার কী থাকে। এই গৌরচন্দ্রিকা শুধুমাত্র বিনয়ের জন্য- যে কবি দৃঢ়তার সঙ্গে বলতে পারেন-
“ভালোবাসা দিতে পারি তোমরা কি গ্রহণে সক্ষম?” পংক্তিটির মধ্য দিয়ে কবিতার ইশতেহার প্রকাশিত হয়ে যায়। বোঝা যায়, একজন কবির দৃষ্টি কতোটা প্রখর এবং তার অনুভূতির প্রাবল্য কতোটা সাহসী। তাঁর নিজের সম্বন্ধে নিজে যে উচ্চারণ করেছেন তার মধ্য দিয়ে তিনি আবিষ্কার করেছেন নিজেকে।
তাই লিখেছেন অনেক কথা- যেসব কোনো সাধারণ কথা নয়। তাঁর কবিতার টেক্সচার নির্মাণে সেসব বিষয় স্পষ্ট। তাঁর সম্পর্কে অন্যান্য কবি সাহিত্যিকদের মূল্যায়নও গুরুত্ববহ। কবি বিনয় মজুমদারকে কেউ স্বাভাবিক মেধাবী কবি ভাবেননি কখনও। “কবিদের কবি” হিসেবেই তাঁর খ্যাতি। এ খ্যাতি কখন কার ভাগ্যে মেলে?
তিনি এসেছিলেন, ভালো বেসেছিলেন,
প্রকৃতি, সারস, ফুল, বৃক্ষ-লতা, গাঁওগেরাম, নদী,
মানুষের সত্য, মনুষ্যত্ব, অকপট আচরণ যেন নির্বোধের
তিনি নেই আর ঠাকুর পুকুরে, জলে-স্থলে-অনন্ত রোদসী আকাশে,
পৃথিবীর প্রত্যন্ত কোণে ও আনাচে কানাচে।
ভালো ছাত্র। বিনয় ছিলেন না ঠিক টিপটপ, সামাজিক।
(অভিমানে অন্তর্ধান, মৃণাল কান্তি সেনগুপ্ত)
বিনয় মজুমদার। একাধারে ইঞ্জিনিয়ার, গণিতবেত্তা ও কবি। এ যেন নানা বর্ণের সত্তার এক জীবন। একজন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি গণিতের নানা কঠিন সমস্যার সমাধান দিয়ে গেছেন। যার গাণিতিক সূত্রগুলো ইংল্যান্ডের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। তিনি পারদর্শী ছিলেন রুশ ভাষায়, যা খুব সহজেই রপ্ত করেছিলেন। শুধু তাই নয়, গণিত-প্রকৌশল সব বিষয়কে তিনি অতিক্রম করেছিলেন কবিতার কাব্যপ্রতিমা নির্মাণ করে। তাঁর কবিতার মেটাফর তাই অত্যন্ত শক্তিশালী ভিতের ওপর দাঁড়ানো। একই সঙ্গে বলতে হয় তাঁর কবিতার দার্শনিক ভিত্তিও প্রথাগত নয়। তাঁর কাব্য চেতনায় ‘প্রেম-ভালোবাসার চিরায়ত বিষয়টিকে তিনি সাজিয়েছিলেন ভিন্নভাবে। তাঁর কবিতায় তিনি লিখেছেন সেইকথাই, তবে তাঁর প্রকাশটা ঠিক ওভাবে নয়। কাব্য ‘ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে/শান্তি এনে দিতে। কেবল নারীর প্রতি পুরুষের কিম্বা কোনো পুরুষের প্রতি/কোনো নারীর প্রণয় ভালোবাসা...’। বিনয় মজুমদার ইঞ্জিনিয়ার অর্থাৎ যন্ত্রশিল্পী হয়েও নিজেকে বিস্তৃত করে হয়ে উঠলেন কাব্যশিল্পী। এরই মধ্যে কিছুদিন খবরের কাগজে চাকরি করেন আবার ছেড়েও দেন। তারপর কথাশিল্পীর কারখানা গড়ে তুলেছিলেন কলকাতার কফি হাউসে। সেখানে তার বন্ধু ছিল সুনীল গাঙ্গুলী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শরৎ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
১৯৩৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সাবেক বার্মার একটি গ্রামে জন্ম হয়েছিল বিনয় মজুমদারের। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় সেখান থেকে বাবা-মার আর বহু মানুষের সঙ্গে বালক বিনয় চলে আসে অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুরে, পৈতৃক ভিটায়। দেশভাগের পর ওপার বাংলার কলকাতার মেট্রোপলিটন স্কুলে ভর্তি হয়। মেধাবী কিশোর বিনয় স্কুল ফাইনাল পাস করে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পাস করে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ডিগ্রি অর্জন করেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। রুশ ভাষায় দক্ষতা অর্জন করে শুরু করেন রুশ ভাষার গল্প, কবিতার অনুবাদ। এমনকি লেরমনতভ্ আর পুশকিনের বেশ কিছু কবিতাও তিনি অনুবাদ করেন। তাঁর এই কবিতা অগ্রজ কবি বিষ্ণু দে ও বিমল চন্দ্র ঘোষেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এরই পাশাপাশি গণিত চর্চার আশ্চর্য বুৎপত্তি অর্জন করেছিল বিনয় মজুমদার। আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর একটি গবেষণাপত্র পড়ে এতই বিস্মিত হয়েছিলেন যে সেটিকে তিনি সানন্দে সুপারিশ করেছিলেন মহাফেজখানায় রক্ষা করার জন্য। গণিতের পঠন-প্রক্রিয়া বা স্ট্রাকচার বরাবরই তাঁর কবিতাকে ও আঙ্গিককে এক ধরনের আদল দিয়েছে। যাকে বলে ‘অ্যাক্সিওমেটিক ট্রুথ’। বিনয় মজুমদারের কূট কবিভাষা বা পরিভাষা ছিল গাণিতিক এবং সাংকেতিক। উন্মাদ অবস্থায় তাঁর বিশেষ বন্ধু জ্যোতির্ময় দত্ত বলেছেন “এই বা কে জানে, বিনয় মজুমদার রামানুজনের মতোই এক অজ্ঞাত গণিত প্রতিভা কি না।”
গণিত ছিল বিনয় মজুমদারের প্রিয় বিষয়। ব্যবকলন (ক্যালকুলাস), স্থানাঙ্ক জ্যামিতি, ঘনমূল প্রক্রিয়ার উল্লেখ মাঝে মাঝেই আসে তাঁর কবিতায়, গণিত হিসেবে নয়, অবশ্যই কবিতা হিসেবেই। তাঁর একটি কবিতার নামই হলো ‘আমি গণিত আবিষ্কর্তা।’ কবিতার প্রথম পঙ্ক্তি এরকম, “আমি গণিত আবিষ্কর্তা, আমার নিজের আবিষ্কৃত/ঘনমূল নির্ণয়ের পদ্ধতিটি বিদ্যালয়ে ঐচ্ছিক গণিতে/ অন্তর্ভুক্ত আর পাঠ্য হয়ে গেছে যেটি/ ক্রমে ক্রমে পৃথিবীর সব বিদ্যালয়ে/পাঠ্য হবে।”
ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ই জড়িয়ে পড়েন বামপন্থি ছাত্রসংগঠনে। ভাষায় পারদর্শিতা, গণিত, কবিতা এমনকি রাজনীতি নিয়েও যেন তাঁর গভীরতার কমতি ছিল না। তিনি তাঁর রাজনীতি প্রসঙ্গে বলেন, “আমি এক কমিউনিস্ট- এই কথা উচ্চারিত হোক/ দিকে দিকে পৃথিবীতে-এ আমার সঙ্গত কামনা।”
সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত, গণিতবিদ ওমর খৈয়াম, সালভাতোর কোয়াসিমিদো, এডওয়ার্ড লিয়র কবিতার সঙ্গে সখ্য করেছিলেন। কমলকুমার মজুমদার গণিত-রসিক ছিলেন কিন্তু কবিতা লেখেননি। আর বুদ্ধদেব বসু, সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কবি কিংবা সরদার ফজলুল করিমের মতো প-িত-সাহিত্যিকও গণিতের প্রতি তাদের ভয়ের কথা স্বীকার করেন সরলভাবেই। তবে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা এমন ৬০ দশকের শুরুতে বাংলার এককোনায় কবিতা ও গণিতের এমন এক সমাহার হয়েছিল- যা হয়তো ইতিহাসে আর কখনও হয়নি। গণিতের এই দুর্বোধ্যতার মিথ এবং কবিতা ও গণিতে একেবারে দুই বিপরীত মেরুর বিষয় এই মিথের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিনয় মজুমদার নামে একটি মিথের জন্ম। তিনি যেন এক মিথ হয়ে যাওয়া কবি। তাঁর কবিতা আর গণিতের সমাহার প্রসংগে তাঁরই লেখা থেকে:
“প্রত্যেক শিশুই কিছু জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভে থাকে,
প্রত্যেক শিশুই এই জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়েছে,
প্রমাণ: প্রত্যেক শিশু জন্মই মায়ের দুধ
পান করে চুষে চুষে, দেখি।”
তিনি লিখেছেন অনেক নিপাট প্রেমের পদ্য। যেগুলো শুধুই প্রেমের কবিতা নয়। প্রেমের কবিতা তবে সঙ্গে আরও কিছু। অনেকেরই মতো বিনয় মজুমদার গণিতের রসবোধে পুরো একটি কাব্যগ্রন্থ লিখলেন শুধুই প্রেম নিয়ে। কাব্যগ্রন্থের নামেও রয়েছে চমক ‘ফিরে এসো, চাকা’। চাকা আমাদের সভ্যতাকে কতোটা গতিশীল করেছে সে ব্যাপারে নতুন কিছু বলার অবকাশ নেই। চাকা- ভালোবাসাকেও কতোটা জ্বালা কতোটা মুগ্ধতা দিয়েছে বিনয় মজুমদার তার প্রেমের কবিতায় সেকথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তুলে ধরেছেন। প্রেম বিনয়ের কবিতায় প্রচলিত ধারার বাইরে নেমে এসেছে। অর্থাৎ প্রেম মানেই কেবল মিলন বা বিচ্ছেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ কোনো বিষয়ের ঘেরাটোপে টানেননি তিনি। তাঁর প্রেমের কাব্যে তিনি অনায়াসেই প্রত্যাখ্যাত হবার মধ্যে যে পরাভবের বোধ থাকে, যে ধিক্কার থাকে তারও উল্লেখ করেছেন এভাবে:
“আমিও হতাশবোধে, অবক্ষয়ে, ক্ষোভে, ক্লান্ত হয়ে মাটিতে শুয়েছি একা”
আবার লিখেছেন: “প্রত্যাখাত প্রেম আজ অসহ ধিক্কারে আ’লীন/অগ্নি উদ্বমন করে এ গহ্বর ধীরে ধীরে তার/ চারিপাশে বর্তমান পর্বতের প্রাচীর তুলেছে।” তার কাব্যগ্রন্থ ‘ফিরে এসো, চাকা’ নিয়ে ঋত্বিক ঘটকও বলেছেন, এই সময়ের উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। তিনি ছিলেন ভালোবাসার কাঙাল। তিনি বলতেন মানুষের সবচেয়ে পরম চাওয়া হলো দুটো মোটা ভাত আর দুটো স্নেহের হাত। বিনয় মজুমদারের বিশ্বাস তার এই কাব্যভাব জাগ্রত হবার পেছনে রয়েছে একজনই আর তিনি হলেন গায়ত্রী। আর তার ভালোবাসার প্রতিফলনে প্রথম প্রকাশ কাব্যগ্রন্থটা ‘গায়ত্রী’কে উৎসর্গ করতে দ্বিধান্বিত হননি। আর এই অনুভাবিত অনুচ্চার প্রেমই তাকে একবার মানসিক হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বলে বন্ধুদের মধ্যে জনশ্রুতি আছে। সেই হাসপাতালেই পরিচয় ঋত্বিক ঘটকের সঙ্গে। হাসপাতালে বসেই বিনয় মজুমদারকে নিয়ে নাটক লিখে ফেলেন তিনি। মুখ্য অভিনেতা বিনয় মজুমদার নিজেই। চলল মহড়া, কিন্তু মঞ্চস্থ হবার দিনই উধাও অভিনেতা নিজেই। ফলে সে নাটক আর মঞ্চস্থ হয়নি কোনোদিন।
বিনয় মজুমদার জীবনকে হিসেবের কষাঘাতে ফেলেছেন নিজের ইচ্ছায়। এক আজব স্বভাবের মানুষ তিনি। অবশ্য যে মানুষের মস্তিষ্কে গণিতের ক্যালকুলেশন, ইঞ্জিনিয়ারিং-এর নানা ধরনের ইকুয়েশন আর কাব্যভাব একসঙ্গে ঘোরাফেরা করতো, তিনি তো একটু আবেগঘন হবেনই। হঠাৎ তিনি একবার ভাবলেন পূর্ব বাংলায় আসবেন, তবে পাসপোর্ট ছাড়া। তখন পাসপোর্ট চালু হয়ে গেছে ভারত আর পাকিস্তানের মধ্যে। ইচ্ছেমতো যাওয়া আসা চলে না। কিন্তু বিনয় মজুমদারের একই কথা তিনি যাবেন পাসপোর্ট ছাড়াই। সবাই বোঝাতে শুরু করলেন এভাবে গেলে ধরা পড়লে গারদে ভরে দেবে। তার কথা, “ভরলে ভরবে। কিন্তু যেখানে আমি আমার বাল্যকাল কাটিয়েছি সেখানে পাসপোর্ট নিয়ে ঢুকতে কেউ আমাকে বাধ্য করতে পারে না।” নিজের মনমতো কাজ করলেন আর পাকিস্তানে ঢুকতে গিয়ে গ্রেফতার হন এবং কিছুদিন পাকিস্তানে জেল খেটে ফিরে যান কলকাতায়।
উনিশ শতকের বিখ্যাত জার্মান কবি ফ্রেডরিক হোন্ডারলিন জীবনের শেষ ৩৪টি বছর মানবেতর জীবন-যাপন করেছিলেন। মানসিক ভারসাম্য ছিল না। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা কেউ তার জীবনের সাথী-ভাগী ছিল না। জীবনের অন্তিম বছরগুলোতে তার দেখাশোনা করতো একটা দরিদ্র মুচি পরিবার। দেশে অনেক লোক ছিল ফ্রেডরিকের মতো একজন কবির গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিল জার্মানির একটি মুচি পরিবার। আর বিনয় মজুমদার? সেকথা নয় নাইবা বললাম। তবু বাংলা ভাষা সাহিত্যের এই শহীদ কবির জন্য কষ্ট হয়। কেন এই কষ্টবোধ জানি না; তবু কেন জানি কবিতার এই শহীদের জন্য বুকের বুননে জমে ওঠে কষ্টের শ্যাওলা যতো।
দীর্ঘ ৭২ বছরের জীবননাট্যে তিনি একাধারে একজন সফল কর্মের মানুষ আর অন্যদিকে বড় বেদনার, বড় কষ্টের আর করুণ জীবন। তাঁর জীবনের শেষ পরিণতি ঘটে ১১ ডিসেম্বর, ২০০৬ সালে সকাল সাড়ে ৮টায় নিজ বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরের শিমুলপুরে। যে মানুষটি ধীরে ধীরে কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছিলেন তিনি নিজের শরীরের প্রতি চূড়ান্ত অবহেলার দরুন অসুস্থ হন। ভীষণ অসুস্থ হয়ে সরকারি সাহায্যে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এসময় তিনি ছবিও এঁকেছেন। এরই মধ্যে তাঁর জীবনের কথা বলতে গিয়ে তাঁর বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে বলেন, “জানিস, মজুমদার উপাধিটা আগের কালের নবাব/বাদশাহের কাছ থেকে পাওয়া যেত। আমার মনে হয়, ওরা যদি বুদ্ধি করে মজুমদার না দিয়ে মজুতদার দিতো তাহলে খুব মানানসই হতো, বিনয় মজুতদার।” একটু মুচকি হেসে আরো বললেন, “কিরে, মজুতদার দিলে ভালো হতো না? দেখ না কত যন্ত্রণা, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, ব্যথা সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে নিয়ে বসে আছি। বিনয় মজুতদার ভালো হতো না।”
কবিতা আর গণিতে এক লড়াই চলে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে। তিনি লাল খাতার পর হলুদ খাতা, হলুদের পর সবুজ-কখনো কখনো দিনে পঞ্চাশ ষাট পৃষ্ঠা পর্যন্ত লিখতেন। লিখতেন ইংরেজিতে, মলাটে কোনো খাতার নাম ‘কনিক সেকশন’ কোনোটা ‘ইন্টার পোলেশন সিরিজ’। আর গণিত চর্চার অবসরে চলতো কাব্য ভাবনা। নব্যক্যালকুলাসের জনক বিনয় মজুমদার কবিতার পর কবিতা লিখে চলতেন। তার মৃত্যুর বছর খানেক আগে বলেছিলেন ‘আর কবিতা লিখব না, অন্তত এক বছর না, তার বদলে অঙ্ক কষব। একটা নতুন সিরিজ মাথায় এসেছে তাকে ঝালিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজন হলে ইংল্যান্ডের রয়্যাল সোসাইটির কোনো বিশারদকে দিয়ে পরীক্ষাও করতে পারি।’ বিনয় মজুমদারের কাছে গণিত আর কবিতায় কোনো প্রভেদ ছিল না। কবিতায়ই যেন তার ধ্যান, তার প্রকৃত গণিত। তিনি জার্মানের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় আর জাপান থেকে আহ্বান পেয়েছিলেন গণিতে অধ্যাপনার জন্য। লন্ডন থেকে ডাক পেয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানোর জন্য। কিন্তু সব কিছু ছেড়ে তিনি রয়ে গেলেন পাখিডাকা গাছ-গাছালিময় বাগান ঘেরা তাঁর ঠাকুরনগর-শিমুলপুরের নিভৃত আশ্রমে। ‘দৃষ্টি বিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়/তোমাকে অস্তিত্বহীনা, হয়তো লুপ্ত, মৃত/অথবা করেছো ত্যাগ অবৈধ পুত্রের মতো, পথে/জীবনের কথা ভাবি/ ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে/পুনরায় কেশোদ্গম হবে না/বিমর্ষ ভাবনায় রাত্রির মাছের মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা।” তার কবিতায় ক্ষতসংক্রান্ত বিষয়টি একটি বৈজ্ঞানিক ভাবনার প্রতিফলন। যেটা বিনয়কে ছাড়া অন্য কারো কবিতায় এ ধরনের এক্সপেরিমেন্ট দেখা যায়নি। ক্ষতস্থান কোনোদিন শুকায় না। সেখানে পশমও গজায় না। কবিতায় এটি যে যুক্ত করতে পারে তিনি একজন কালের কথক। বিনয় মজুমদারের ক্ষতে এ অভিধা যোগ করা অত্যুক্তি নয়। শেষ জীবনে প্রকৃতির একদম কাছাকাছি থেকে লিখেছিলেন, “আমরা এখন সাগরে-আকাশে সঞ্চারিত হতে চাই। আমরা পাখিদের আকাশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি। কিন্তু পাখিদের কাছে যাওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছি। “হায় হাসি, হায় দেবদারু/মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।” এই দার্শনিক সত্যের চর্চা তার কবিতায় ছাড়া আর কোথায় পাওয়া যাবে? কবিদের ধর্মচেতনার কথা বললে দেখা যাবে রবীন্দ্রনাথ পরম আস্তিক ছিলেন। সুধীন দত্ত শূন্যবাদী। জীবনানন্দ দাশ ওয়ার্ডসওয়ার্থের মতো প্রকৃতিকে ঈশ্বর মেনেছিলেন। বিনয়ও জীবনানন্দের মতো প্রকৃতির কণ্ঠ শুনেছিলেন। জীবনে তার অর্জনকে বড়ো করেই দেখা হয়; কিন্তু তাকে দেখার এই প্রবণতা যখন চালু হয়েছে- তখন সাহিতের বিজ্ঞানী সারস তার পালক রেখে উড়ে গেছে নিরন্তরের ঠিকানায়।
তিনি রবীন্দ্র পুরস্কার, একাডেমি পুরস্কার, সুধীন্দ্রনাথ পুরস্কার, কবিতীর্থ পুরস্কার, কীর্তিবাস পুরস্কার অর্জন করেছেন তাঁর কাব্যগ্রন্থ নক্ষত্রের আলোয়, গায়ত্রীকে, ফিরে এসো, চাকা, আমার ঈশ্বরীকে, অঘ্রাণের অনুভূতিমালার জন্য। তিনি তার কবিতা সম্পর্কে বলেন, “আমার সব কবিতাই আসলে দিনপঞ্জি।” বিশ্বমানের কবি আর গণিতজ্ঞ বিনয় মজুমদার কবিতার জগতে প্রবেশ করেছিলেন নিঃশব্দে আবার প্রস্থানও করলেন নিঃশব্দে। কিন্তু রেখে গেলেন তার অসংখ্য কীর্তি:
‘মাত্র দুটো শব্দকে নিয়ে/ শিল্পীর কণ্ঠে গান,/চিত্রকরের তুলিতে টান,/কবির কলমের চলাফেরা/চিকিৎসকের ভাবনা/বৈজ্ঞানিকের কপালের বলিরেখা/কত শত শোকগাথা, বশ করা যায় না এমন/সত্য/ মৃত্যু, তুমি এক কবিতা।”
দোহাই
বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা
বিনয় মজুমদার স্মারক সংখ্যা
(বাংলাদেশ-ভারত)
নানান রঙের বিনয় মজুমদার
সুপা সাদিয়া