কতটা আঁধার
দিলারা হাফিজ
কতটা আঁধার
নেমে এলে
মানুষেরা একা
হয়ে যায়?
পাখিরাও ছন্নছাড়া সন্ধ্যা ডেকে আনে
নিজস্ব নিলয়ে...
দেহ থেকে হৃৎপি-
খসে গেলে
কতটা সন্ন্যাস তুমি
খুঁজে নিতে পারো
নিতান্তের নিস্ব এই নামাবলি গায়ে?
মানুষ, তুমি তো নিস্ব
ছিলে না কখনো!
জনতার এত আলো,
বাতাসে বিদেশি বেলা
কোথাও নেই তো এতটুকু অবহেলা!
তবু ঘুমছিন্ন রাত
শঙ্কাময় এই দিন
রক্তের এ ধারদেনা
নিজেকে হারিয়ে ফেলা এক তোলা ঋণ
কী করে শুধবো আমি
বাঁচি যদি আরো কিছু দিন?
আমার অপূর্ণ অহম
আবদুর রাজ্জাক
শীতের স্বপ্নগুলি বিবর্ণ হলেও অহমিকা এখনও অটুট,
সীমাবদ্ধ আকাক্সক্ষার আয়তনে তোমার মুখ
খুব উজ্জ্বল দেখায়।
আমি কি তোমার দ্রৌপদী বিনয় ভুলে যেতে পেরেছি?
দীর্ঘশ্বাসের পর নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
কার জন্য এই অভাবিত দীর্ঘশ্বাস আর এই অহম?
তোমাকে এভাবে হিসেবে টেনে আনা ঠিক হয় না,
প্রতিদিন আমি সেই ভুলটাই করে থাকি, একই ভুল, যা
আমি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,
আমার অপেক্ষার দিনে কোনো বৃষ্টি হয় না, আমি সেই
কাজটাই করে থাকি যা করার ইচ্ছে কখনই ছিলো না।
প্রার্থনার রাতে অত্যধিক ঘুম পায় আমার, আমি নিজে
নিজেরই প্রশংসা করি যে তোমাকে ভুলে যেতে পেরেছি।
সাদামাটা স্বপ্নগুলো রাতে এলোমেলো হয়ে যায়, আমার
অপেক্ষাগুলো মিশে যায় সেপ্টেম্বরের শুকনো ধুলোয়।
তারপর শুরু অন্তহীন কষ্টের মহড়া, এক হাজার প্রশ্নের
উত্তর থাকে ‘না’ কোনো। আমিও জানি না, কি সেই না?
‘ম’তে মা
বিশ^জিৎ ঘোষ
কত দিন দেখা হয় না তোমার সাথে
ম-বর্ণ দেখলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠো তুমি
মুহূর্তেই দেখি তোমার প্রসন্ন মুখশ্রী।
মনে পড়ে প্রতি সন্ধ্যায় মেঝেতে মাদুর পেতে
আমাকে নিয়ে পড়তে বসেছো তুমি।
তোমার হাতে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’
কখনো ধারাপাত, কখনো-বা ‘আদর্শলিপি’।
আমার গায়ে পরশ বুলাতো তোমার তালপাতার বাতাস,
পৌষী সন্ধ্যায় তোমার হাতে-বোনা নকশিকাঁথার ওম।
শৈশবে দেখেছি তোমার কর্মব্যস্ত সারাটা সময়
সবকিছু দেখভাল করে সকলকে খাইয়ে
অবশেষে তোমার আহার।
কাউকে বুঝতে দিতে না তোমার কষ্ট
নীলকণ্ঠের মতো সব কষ্ট বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখে
সারাটা সময় তুমি থাকতে স্মিতহাস্য।
অপরাহ্ণে আমাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে তুমি,
তোমার তন্দ্রার সুযোগ নিয়ে গুলতি হাতে আমি
বেরিয়ে পড়তাম চড়–ই কি দোয়েলের খোঁজে।
সন্ধ্যায় তুলসিতলায় প্রদীপ জে¦লে
ধূপ-ধোঁয়ায় তুমি পবিত্র করে নিতে বাড়ি-ঘর।
বৃহস্পতিবার এলেই সন্ধ্যারাতে তোমার হাতে উঠতো ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’
তুমি সুললিত সুরে বলে যেতে লক্ষ্মীর মহিমা
আমার কানে এখনো বাজে এই মন্ত্র-
‘ওঁ বিশ^রূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমহস্তুতে ॥”
তোমার পাশে বেলপাতা আর দূর্বা হাতে নিয়ে
বসে থাকতাম আমি
আমার কল্পচোখে তখন তুমিই হয়ে উঠতে লক্ষ্মীর মুরতি!
একসময় শেষ হতো তোমার পাঁচালি-পাঠ
আমার হাতে তুমি দিতে নাড়–, বাতাসা কিংবা
একফালি পেয়ারা।
আমার জিহ্বায় এখনো লেগে আছে
তোমার দেওয়া সেই প্রসাদের স্বাদ।
সেদিন স্বপ্নে দেখলাম-
সন্ধ্যালগ্নে মাদুর পেতে আমাকে নিয়ে পড়তে বসেছো তুমি।
তুমি আবৃত্তি করছো মদনমোহনের ‘প্রভাত বর্ণন’-
‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল...’
তোমার কণ্ঠের যাদু আমায় টেনে ধরেছে...
তুমি হাতে নিয়েছো সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শলিপি’...
পরক্ষণেই দেখি তোমার হাতে যোগীন্দ্রনাথ সরকার
‘হাসিখুশি’ খুলে তুমি একে একে বলে যাচ্ছ-
অ-তে অজগর, ক-তে কাকাতুয়া, ম-তে ময়ূর...
আমি তোমায় থামিয়ে দিয়ে বললাম-
অ-তে অজগর... ক-তে কাকাতুয়া... ম-তে মা...
কুসুমিত ইন্দ্রজাল
হাদিউল ইসলাম
বৃষ্টিভেজা কামিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে
আমার প্রেমিকাদের গন্ধ ভিন্ন ভিন্ন পুষ্পাকারে
অন্ধকারে ঝরে
তখন সন্দেহ
বিরহ কুঞ্জের গূঢ় বারান্দায় বেদনার রূপ
ঝোঁপের আড়ালে সুবর্ণ মাকাল অহেতু সৌন্দর্যে
উনুনে অঙ্গার হাসে
নিকটেই বাতাবি নেবুর নুয়ে পড়া ডালে
দীর্ঘশ্বাসের এক দমকা হাওয়ায় ঈষৎ নড়ে ওঠে
রাতের দোয়েল, ফল আর বোঁটার বিশ্বাস
অম্লমধুর জলে ও জোছনায়
টনটনে ফোঁড়ান মতো এক প্রেক্ষপটের ভেতর
নাইট কুইন এতোদিন পর কোথাও ফুটেছে
পাথর সময়
প্রণব মজুমদার
মজিদ চাচার কোশা নৌকাটি আমার জন্যই
দাঁড়িয়ে থাকত, ভয়হীন চপল প্রেমিকের মতো।
সূর্যাস্তের পর বেলাশেষে কিংবা মায়াময় সন্ধ্যায়-
হরিণীর মতো নবযৌবনের লজ্জা রক্ষার অপেক্ষায়
জীবন্ত চৌধুরী ঘাট, ডাকাতিয়া নদী পারাপারের-
লোকগুলো তন্ময়ে তাকিয়ে থাকে অপলক!
লেডি প্রতিমা মিত্র বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস-
শেষে হেঁটে হেঁটে গুদারা ঘাটের সামনে থামি;
মাঝিদের নাওয়ে ওঠার ডাক, দাঁড়াতেই হাঁক-
‘মিজি বাড়ীর পড়–য়া মেয়েদের নদী কুল বদলে
পয়সা লাগে না!’ আপন করে বলত ননী কাকা!
ক্লান্তিতে ফুটো নৌকার জল সরাই আনন্দ চিত্তে
ঢেউ তরঙ্গে দোল খেতে খেতে দেখি জলকুসুম
উচ্ছ্বসিত হয়ে নয়নমুখ করে চিকচিক বারবার।
মাতাল হাওয়ায় শ্রান্ত মন, ডিঙি ভিড়ে যায় ঘাটে!
আড়াই কুড়ি জীবনের সভ্যতায় দৃশ্যান্তর খেয়াপার;
নদীর ওপর সুরকি, বালি ও লোহার মিশ্রণে সেতু,
জড় সেতুর মতো রাতারাতি বদলে গেল ‘মানুষ’!
জলের মতো আমাদের পরিচয় আর মানুষ নয়;
ভোগ মোহে দ্বিপদী প্রাণী করে ধর্মের বিভাজন।
নেই মজিদ চাচা, ননী কাকা ও আদুরে খেয়াঘাট,
সময় উজানে দিনবদলে পাথর হয়ে গেছে হৃদয়।
আত্মহত্যা
বেনজির শিকদার
পারতপক্ষে আপনি খুব একটা কথা বলতেন না।
তবুও জেনেছিলাম,
পাট শাক আপনার ভীষণ প্রিয়!
ভাতের লোকমার সাথে ভাজা লঙ্কা আর চোখে জল আনা
কাসুন্দি আয়েস করে খেতেন!
বুকভর্তি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও
একটা সাদাকালো চেক শার্টেই আটকেছিল সময়।
দীর্ঘশ্বাসের দূর দ্রাঘিমায় তাকিয়ে-
শ্মশানপোড়া গন্ধের মতো ভেসে যেত হাজারও জিপসি রাত।
স্বপ্ন বলতে-
চারচালা একখান ঘর,
দুটো হালের বলদ
মায়ের হাতে একগাছা সোনার বালা আর
বোনের আঁচলে একটুখানি রং মেখে দেওয়া, ওটুকুই।
এছাড়া সাপের পাঁচ পা দেখার কোনো খেয়াল
কখনও চেপেছিল বলে শুনিনি।
কেবল বাবার বুকের ব্যথাটা বাড়লেই
আপনি প্যান্থার কিংবা ডাকাত হয়ে উঠতে চাইতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে নাকি
প্রায় রাতেই ঢগ ঢগ করে পানি খেয়ে ঘুমুতে যেতেন!
স্টুডেন্ট পড়ানোর কালে ট্রেতে চেপে যে খাবারটুকু আসতো,
মুখে না বললেও- সপ্তাহের তিনটি দিন
সেটুকু বেশ সুখ সুখ ঢেঁকুর দিতো আপনাকে!
শুনেছিলাম, শ্রীকান্তের মতো-
আপনার গলায়ও কেউ একজন বঁইচি ফুলের মালা দিয়েছিল!
¯্রােত খরতর-
নৌকাখানি ঘাটে লাগার আগেই
আজ টিভিপর্দায় দেখলাম
ট্রেনের চাকায় থেঁতলে যাওয়া আপনার দেহখানি।
তবে কি-
বেকারত্বের চেয়েও অধিক সহজ একটি খুন বা আত্মহত্যা?
বিমুখ বিকেলের প্রজ্ঞাপন
সঞ্জয় দেওয়ান
এক বিমুখ বিকেল প্রজ্ঞাপনে সাফ জানায়,
পথিক, তোমার পথের শেষ এখানেই!
বিমর্ষ পথিক সচকিতে ফেলে আসা পথে চোখ পাতে;
শত স্মৃতির পায়চারি, আহাজারি।
ঝলমলে স্মৃতির নহরে পালতোলা দিন,
ফানুস রঙিন, শান্ত ফড়িং, আষাঢ়ে গাঙচিল!
হৃদয়জুড়ে দীর্ঘশ্বাস, চিরল চিরল মায়া,
যতেœ পোষা অভিমান।
কর্মক্লান্ত পথিক শিরদাঁড়া উঁচিয়ে বিকেলকে স্বাগত জানায়।
বিমুখ বিকেলের কাছে তার নিবেদন;
আমাকে গ্রহণ করো মাঠফেরত রাখালের
রাঙা পথের ধুলায় গোধূলি বেলায় বড় অবহেলায়!
বিভ্রম
চামেলী বসু
পাতা উল্টাতেই দেখি বিবর্ণ সে মুখ-
স্মৃতির ক্ষয়িত রেখা আঁকড়ে আছে
ভাস্বর অক্ষর
প্রবল শীতে
সে এসে দাঁড়ায় নতজানু
কামার্ত ঠোঁটে জাগে ভোরের শিশির
সময়ের কবরে আঁকি বিভ্রম আখ্যান-
তুমিই সে ধারলো পালক
এ হৃদয় উপরে দেখো
কতটা কেটেছো আড়াআড়ি
মনকাটা দাগ।
পরিচয় প্রান্তর থেকে
হানিফ রুবেল
এখান থেকেই এগোতে হবে- পিঠে দগদগে ক্ষত
আর রক্তাক্ত পদযুগল নিয়ে বৈরী দিনপঞ্জির ভিতর
হাঁটতে থাক বিচলিত গাঢ় সন্ধ্যা মাড়িয়ে
নানান বাঁকে পদচ্ছাপ পড়ে থাুক না হয় হেলায়।
কালবেলার বারান্দার এক কোণে বেমানান হয়ে
অবিচল থেকে যাও আদর্শের বৈভব জ্যোৎস্নায়,
নিজস্ব পরিচয় প্রান্তরে মথিত গাঢ় সবুজাভ হয়ে
যেন সময়ের ক্ষুধার্ত ঘোড়া তোমাকে পায় সতেজ ঘাসে।
বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪
কতটা আঁধার
দিলারা হাফিজ
কতটা আঁধার
নেমে এলে
মানুষেরা একা
হয়ে যায়?
পাখিরাও ছন্নছাড়া সন্ধ্যা ডেকে আনে
নিজস্ব নিলয়ে...
দেহ থেকে হৃৎপি-
খসে গেলে
কতটা সন্ন্যাস তুমি
খুঁজে নিতে পারো
নিতান্তের নিস্ব এই নামাবলি গায়ে?
মানুষ, তুমি তো নিস্ব
ছিলে না কখনো!
জনতার এত আলো,
বাতাসে বিদেশি বেলা
কোথাও নেই তো এতটুকু অবহেলা!
তবু ঘুমছিন্ন রাত
শঙ্কাময় এই দিন
রক্তের এ ধারদেনা
নিজেকে হারিয়ে ফেলা এক তোলা ঋণ
কী করে শুধবো আমি
বাঁচি যদি আরো কিছু দিন?
আমার অপূর্ণ অহম
আবদুর রাজ্জাক
শীতের স্বপ্নগুলি বিবর্ণ হলেও অহমিকা এখনও অটুট,
সীমাবদ্ধ আকাক্সক্ষার আয়তনে তোমার মুখ
খুব উজ্জ্বল দেখায়।
আমি কি তোমার দ্রৌপদী বিনয় ভুলে যেতে পেরেছি?
দীর্ঘশ্বাসের পর নিজেকে অপরাধী মনে হয়।
কার জন্য এই অভাবিত দীর্ঘশ্বাস আর এই অহম?
তোমাকে এভাবে হিসেবে টেনে আনা ঠিক হয় না,
প্রতিদিন আমি সেই ভুলটাই করে থাকি, একই ভুল, যা
আমি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম,
আমার অপেক্ষার দিনে কোনো বৃষ্টি হয় না, আমি সেই
কাজটাই করে থাকি যা করার ইচ্ছে কখনই ছিলো না।
প্রার্থনার রাতে অত্যধিক ঘুম পায় আমার, আমি নিজে
নিজেরই প্রশংসা করি যে তোমাকে ভুলে যেতে পেরেছি।
সাদামাটা স্বপ্নগুলো রাতে এলোমেলো হয়ে যায়, আমার
অপেক্ষাগুলো মিশে যায় সেপ্টেম্বরের শুকনো ধুলোয়।
তারপর শুরু অন্তহীন কষ্টের মহড়া, এক হাজার প্রশ্নের
উত্তর থাকে ‘না’ কোনো। আমিও জানি না, কি সেই না?
‘ম’তে মা
বিশ^জিৎ ঘোষ
কত দিন দেখা হয় না তোমার সাথে
ম-বর্ণ দেখলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠো তুমি
মুহূর্তেই দেখি তোমার প্রসন্ন মুখশ্রী।
মনে পড়ে প্রতি সন্ধ্যায় মেঝেতে মাদুর পেতে
আমাকে নিয়ে পড়তে বসেছো তুমি।
তোমার হাতে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ‘শিশুশিক্ষা’
কখনো ধারাপাত, কখনো-বা ‘আদর্শলিপি’।
আমার গায়ে পরশ বুলাতো তোমার তালপাতার বাতাস,
পৌষী সন্ধ্যায় তোমার হাতে-বোনা নকশিকাঁথার ওম।
শৈশবে দেখেছি তোমার কর্মব্যস্ত সারাটা সময়
সবকিছু দেখভাল করে সকলকে খাইয়ে
অবশেষে তোমার আহার।
কাউকে বুঝতে দিতে না তোমার কষ্ট
নীলকণ্ঠের মতো সব কষ্ট বুকের গভীরে লুকিয়ে রেখে
সারাটা সময় তুমি থাকতে স্মিতহাস্য।
অপরাহ্ণে আমাকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে তুমি,
তোমার তন্দ্রার সুযোগ নিয়ে গুলতি হাতে আমি
বেরিয়ে পড়তাম চড়–ই কি দোয়েলের খোঁজে।
সন্ধ্যায় তুলসিতলায় প্রদীপ জে¦লে
ধূপ-ধোঁয়ায় তুমি পবিত্র করে নিতে বাড়ি-ঘর।
বৃহস্পতিবার এলেই সন্ধ্যারাতে তোমার হাতে উঠতো ‘লক্ষ্মীর পাঁচালি’
তুমি সুললিত সুরে বলে যেতে লক্ষ্মীর মহিমা
আমার কানে এখনো বাজে এই মন্ত্র-
‘ওঁ বিশ^রূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে।
সর্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমহস্তুতে ॥”
তোমার পাশে বেলপাতা আর দূর্বা হাতে নিয়ে
বসে থাকতাম আমি
আমার কল্পচোখে তখন তুমিই হয়ে উঠতে লক্ষ্মীর মুরতি!
একসময় শেষ হতো তোমার পাঁচালি-পাঠ
আমার হাতে তুমি দিতে নাড়–, বাতাসা কিংবা
একফালি পেয়ারা।
আমার জিহ্বায় এখনো লেগে আছে
তোমার দেওয়া সেই প্রসাদের স্বাদ।
সেদিন স্বপ্নে দেখলাম-
সন্ধ্যালগ্নে মাদুর পেতে আমাকে নিয়ে পড়তে বসেছো তুমি।
তুমি আবৃত্তি করছো মদনমোহনের ‘প্রভাত বর্ণন’-
‘পাখী সব করে রব রাতি পোহাইল...’
তোমার কণ্ঠের যাদু আমায় টেনে ধরেছে...
তুমি হাতে নিয়েছো সীতানাথ বসাকের ‘আদর্শলিপি’...
পরক্ষণেই দেখি তোমার হাতে যোগীন্দ্রনাথ সরকার
‘হাসিখুশি’ খুলে তুমি একে একে বলে যাচ্ছ-
অ-তে অজগর, ক-তে কাকাতুয়া, ম-তে ময়ূর...
আমি তোমায় থামিয়ে দিয়ে বললাম-
অ-তে অজগর... ক-তে কাকাতুয়া... ম-তে মা...
কুসুমিত ইন্দ্রজাল
হাদিউল ইসলাম
বৃষ্টিভেজা কামিনীর পাশ দিয়ে যেতে যেতে
আমার প্রেমিকাদের গন্ধ ভিন্ন ভিন্ন পুষ্পাকারে
অন্ধকারে ঝরে
তখন সন্দেহ
বিরহ কুঞ্জের গূঢ় বারান্দায় বেদনার রূপ
ঝোঁপের আড়ালে সুবর্ণ মাকাল অহেতু সৌন্দর্যে
উনুনে অঙ্গার হাসে
নিকটেই বাতাবি নেবুর নুয়ে পড়া ডালে
দীর্ঘশ্বাসের এক দমকা হাওয়ায় ঈষৎ নড়ে ওঠে
রাতের দোয়েল, ফল আর বোঁটার বিশ্বাস
অম্লমধুর জলে ও জোছনায়
টনটনে ফোঁড়ান মতো এক প্রেক্ষপটের ভেতর
নাইট কুইন এতোদিন পর কোথাও ফুটেছে
পাথর সময়
প্রণব মজুমদার
মজিদ চাচার কোশা নৌকাটি আমার জন্যই
দাঁড়িয়ে থাকত, ভয়হীন চপল প্রেমিকের মতো।
সূর্যাস্তের পর বেলাশেষে কিংবা মায়াময় সন্ধ্যায়-
হরিণীর মতো নবযৌবনের লজ্জা রক্ষার অপেক্ষায়
জীবন্ত চৌধুরী ঘাট, ডাকাতিয়া নদী পারাপারের-
লোকগুলো তন্ময়ে তাকিয়ে থাকে অপলক!
লেডি প্রতিমা মিত্র বালিকা বিদ্যালয়ের ক্লাস-
শেষে হেঁটে হেঁটে গুদারা ঘাটের সামনে থামি;
মাঝিদের নাওয়ে ওঠার ডাক, দাঁড়াতেই হাঁক-
‘মিজি বাড়ীর পড়–য়া মেয়েদের নদী কুল বদলে
পয়সা লাগে না!’ আপন করে বলত ননী কাকা!
ক্লান্তিতে ফুটো নৌকার জল সরাই আনন্দ চিত্তে
ঢেউ তরঙ্গে দোল খেতে খেতে দেখি জলকুসুম
উচ্ছ্বসিত হয়ে নয়নমুখ করে চিকচিক বারবার।
মাতাল হাওয়ায় শ্রান্ত মন, ডিঙি ভিড়ে যায় ঘাটে!
আড়াই কুড়ি জীবনের সভ্যতায় দৃশ্যান্তর খেয়াপার;
নদীর ওপর সুরকি, বালি ও লোহার মিশ্রণে সেতু,
জড় সেতুর মতো রাতারাতি বদলে গেল ‘মানুষ’!
জলের মতো আমাদের পরিচয় আর মানুষ নয়;
ভোগ মোহে দ্বিপদী প্রাণী করে ধর্মের বিভাজন।
নেই মজিদ চাচা, ননী কাকা ও আদুরে খেয়াঘাট,
সময় উজানে দিনবদলে পাথর হয়ে গেছে হৃদয়।
আত্মহত্যা
বেনজির শিকদার
পারতপক্ষে আপনি খুব একটা কথা বলতেন না।
তবুও জেনেছিলাম,
পাট শাক আপনার ভীষণ প্রিয়!
ভাতের লোকমার সাথে ভাজা লঙ্কা আর চোখে জল আনা
কাসুন্দি আয়েস করে খেতেন!
বুকভর্তি ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও
একটা সাদাকালো চেক শার্টেই আটকেছিল সময়।
দীর্ঘশ্বাসের দূর দ্রাঘিমায় তাকিয়ে-
শ্মশানপোড়া গন্ধের মতো ভেসে যেত হাজারও জিপসি রাত।
স্বপ্ন বলতে-
চারচালা একখান ঘর,
দুটো হালের বলদ
মায়ের হাতে একগাছা সোনার বালা আর
বোনের আঁচলে একটুখানি রং মেখে দেওয়া, ওটুকুই।
এছাড়া সাপের পাঁচ পা দেখার কোনো খেয়াল
কখনও চেপেছিল বলে শুনিনি।
কেবল বাবার বুকের ব্যথাটা বাড়লেই
আপনি প্যান্থার কিংবা ডাকাত হয়ে উঠতে চাইতেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলোতে নাকি
প্রায় রাতেই ঢগ ঢগ করে পানি খেয়ে ঘুমুতে যেতেন!
স্টুডেন্ট পড়ানোর কালে ট্রেতে চেপে যে খাবারটুকু আসতো,
মুখে না বললেও- সপ্তাহের তিনটি দিন
সেটুকু বেশ সুখ সুখ ঢেঁকুর দিতো আপনাকে!
শুনেছিলাম, শ্রীকান্তের মতো-
আপনার গলায়ও কেউ একজন বঁইচি ফুলের মালা দিয়েছিল!
¯্রােত খরতর-
নৌকাখানি ঘাটে লাগার আগেই
আজ টিভিপর্দায় দেখলাম
ট্রেনের চাকায় থেঁতলে যাওয়া আপনার দেহখানি।
তবে কি-
বেকারত্বের চেয়েও অধিক সহজ একটি খুন বা আত্মহত্যা?
বিমুখ বিকেলের প্রজ্ঞাপন
সঞ্জয় দেওয়ান
এক বিমুখ বিকেল প্রজ্ঞাপনে সাফ জানায়,
পথিক, তোমার পথের শেষ এখানেই!
বিমর্ষ পথিক সচকিতে ফেলে আসা পথে চোখ পাতে;
শত স্মৃতির পায়চারি, আহাজারি।
ঝলমলে স্মৃতির নহরে পালতোলা দিন,
ফানুস রঙিন, শান্ত ফড়িং, আষাঢ়ে গাঙচিল!
হৃদয়জুড়ে দীর্ঘশ্বাস, চিরল চিরল মায়া,
যতেœ পোষা অভিমান।
কর্মক্লান্ত পথিক শিরদাঁড়া উঁচিয়ে বিকেলকে স্বাগত জানায়।
বিমুখ বিকেলের কাছে তার নিবেদন;
আমাকে গ্রহণ করো মাঠফেরত রাখালের
রাঙা পথের ধুলায় গোধূলি বেলায় বড় অবহেলায়!
বিভ্রম
চামেলী বসু
পাতা উল্টাতেই দেখি বিবর্ণ সে মুখ-
স্মৃতির ক্ষয়িত রেখা আঁকড়ে আছে
ভাস্বর অক্ষর
প্রবল শীতে
সে এসে দাঁড়ায় নতজানু
কামার্ত ঠোঁটে জাগে ভোরের শিশির
সময়ের কবরে আঁকি বিভ্রম আখ্যান-
তুমিই সে ধারলো পালক
এ হৃদয় উপরে দেখো
কতটা কেটেছো আড়াআড়ি
মনকাটা দাগ।
পরিচয় প্রান্তর থেকে
হানিফ রুবেল
এখান থেকেই এগোতে হবে- পিঠে দগদগে ক্ষত
আর রক্তাক্ত পদযুগল নিয়ে বৈরী দিনপঞ্জির ভিতর
হাঁটতে থাক বিচলিত গাঢ় সন্ধ্যা মাড়িয়ে
নানান বাঁকে পদচ্ছাপ পড়ে থাুক না হয় হেলায়।
কালবেলার বারান্দার এক কোণে বেমানান হয়ে
অবিচল থেকে যাও আদর্শের বৈভব জ্যোৎস্নায়,
নিজস্ব পরিচয় প্রান্তরে মথিত গাঢ় সবুজাভ হয়ে
যেন সময়ের ক্ষুধার্ত ঘোড়া তোমাকে পায় সতেজ ঘাসে।