সা’দাত হাসান মান্টোর গল্প
মূল উর্দু থেকে অনুবাদ-হাইকেল হাশমী
আমি ভাবছি।
যখন দুনিয়ার প্রথম মহিলা মা হলো, তখন বিশ্বব্রহ্মা-ের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
দুনিয়ার প্রথম পুরুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার প্রথম ভাষায় খুব গর্বের সাথে কি বলে নাই, “আমিও তো ¯্রষ্টা”। টেলিফোনের রিং বেজে উঠলো। আমার বাউ-ুলে ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। ব্যালকনি থেকে উঠে আমি ভিতরের রুমে এলাম। টেলিফোন জেদি বাচ্চার মতো চিৎকার করেই যাচ্ছে।
টেলিফোন খুবই উপকারী জিনিস কিন্তু আমি এটাকে অত্যন্ত অপছন্দ করি। তার কারণ হচ্ছে এটা সময়ে অসময়ে বেজে ওঠে। আমি খুব অনিচ্ছার সাথে রিসিভার তুললাম আর আমার ফোনের নম্বর বললাম, “ফোর ফোর ফাইভ সেভেন”।
অন্য প্রান্ত থেকে হ্যালো হ্যালো শুরু হয়ে গেল, আমি রেগে গিয়ে বললাম, “কে বলছেন?”
উত্তর পেলাম, “আয়া”।
আমি আয়াদের ভঙ্গিতে বললাম, “কারে চাই?”
“মেম সাব আছে?”
“আছে দাঁড়াও”।
টেলিফোনের রিসিভার এক পাশে রেখে আমি আমার বউকে ডাকলাম, সে বোধয় ভিতরে ঘুমাচ্ছিলো, “মেম সাব- ও মেম সাব”।
আমার ডাক শুনে বউ বের হয়ে এলো, “এটা কি কথা, মেম সাব, মেম সাব”।
আমি মুচকি হেসে বললাম, “মেম সাব ঠিক আছে। তোমার মনে আছে, তুমি তোমার প্রথম আয়াকে বলেছিলে তোমাকে মেম সাব না ডেকে যেন বেগম সাব ডাকে এবং সে তোমাকে বেগুন সাব বানিয়ে দিয়েছিল”।
একটি হাসিমাখা হাই তুলে সে জিজ্ঞাসা করলো, “কে ফোন করেছে?”
“তাকে নিজেই জিজ্ঞাসা করে নাও”।
আমার বউ টেলিফোন তুলে হ্যালো হ্যালো শুরু করে দিল। আমি আবার ব্যালকনিতে চলে গেলাম। এই মহিলারা টেলিফোনে অনেক লম্বা কথা বলে তাই পনের বিশ মিনিট পর্যন্ত এই হ্যালো হ্যালো চললো।
আমি ভাবছিলাম- টেলিফোনে প্রতি কয়েকটি শব্দের পর হ্যালো কেন বলে? এই হ্যালো বলার পিছনে কোন হীনম্মন্য কারণ তো নয়? বারে বারে হ্যালো সেই বলে যার মনে এই সন্দেহ কাজ করে যে তার ফালতু কথা শুনে অন্য প্রান্তের ব্যক্তি ফোন যেন না কেটে দেয়। আবার এটাও হতে পারে এটা শুধুই একটি অভ্যাস।
হঠাৎ আমার বউ চেঁচিয়ে উঠলো, “সা’দাত সাব এবার ব্যপারটা বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে”।
“কোন ব্যপারটা?”
সেই ব্যপার সম্বন্ধে কিছু না বলেই আমার স্ত্রী বলতে শুরু করলো, “কথা বাড়তে বাড়তে তালাক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পাগলামিরও একটি সীমা থাকে। আমি বাজি ধরতে পারি এমন কিছুই হয় নাই, কোনো একটা ছোট ব্যাপারকে তারা বড় করে ফেলেছে- দুইজনই পাগল”।
“কারা পাগল?”
“আমি কি আপনাকে বলি নাই? ওই টেলিফোন তাহেরার ছিল”।
“তাহেরা? তাহেরা কে?”
“মিসেজ ইয়াজদানী”।
“ওহ, আচ্ছা, আমি সব ঘটনা বুঝে গেছি। নিশ্চয় কোন নতুন ঝগড়া বেধেছে”।
“নতুন আর বেশ নাজুক ব্যপার। যান মিঃ ইয়জদানী আপনার সাথে কথা বলতে চায়”।
“আমার সাথে আবার কি কথা বলতে চায়?”
“জানি না, তাহেরার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে আমাকে এইটুকুই বলল, “ভাবী একটু মান্টো সাবকে ডাকেন”।
“খামাখা আমার মাথা নষ্ট করবে” এই বলে আমি টেলিফোনে ইয়াজদানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার?”।
সে এইটুকুই বলল, “ব্যপারটা খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। তুমি আর ভাবী এখনই আমার বাসায় চলে এসো”।
আমি আর আমার বউ তাড়াতাড়ি কাপড় বদলিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে ইয়জদানীর বাসার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাস্তায় আমরা দুইজন ইয়জদানী আর তাহেরার সম্বন্ধে অনেক কথা বললাম।
তাহেরা হলো একজন বিখ্যাত প্রেমী সুরকারের সুন্দরী মেয়ে আর আতা ইয়জদানী একজন পাঠান আড়ৎদারের ছেলে। সে প্রথমে কবিতা লিখতে শুরু করলো তার পর নাটক তার পর আস্তে আস্তে ছায়াছবির কাহিনী লিখতে লাগলো। তাহেরার বাবা তার অষ্টম প্রেম করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল আর আতা ইয়াজদানী, আল্লামা মাশরাকির খাকেসার আন্দোলনের জন্য বেলচা নামক নাটক লিখতে ব্যস্ত ছিল।
এক বিকেলে ইয়জদানীর চোখে তাহেরা ধরা পড়লো এবং সেই রাতে সারাটি রাত জেগে সে তাকে একটি চিঠি লিখলো আর সকালে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসলো। কয়েক মাস তাদের মধ্যে চিঠির আদান প্রদান চললো আর অবশেষে তাদের বিয়ে কোন ঝঞ্ঝাট ছাড়া হয়ে গেল। ইয়জদানীর একটি দুঃখ রয়ে গেল যে তাদের প্রেম কোনো নাটক ছাড়াই বিবাহতে শেষ হলো।
তাহেরা প্রকৃতি ড্রামায় ভরপুর ছিল। প্রেম আর বিয়ের আগে যখন সে তার বান্ধবীদের সাথে শপিং-এ যেতো তখন তাদের জন্য বিপদ হয়ে যেতো। কোন টাক পড়া লোক দেখলেই তার হাতে চুলকানি শুরু হতো, “আমি তার মাথায় এক থাপ্পর মারবই মারবো, তোমরা যাই করো”।
বুদ্ধিমতি ছিল- একবার তার কাছে কোন পেটিকোট ছিল না। সে কোমরে একটি ফিতা বেঁধে তার ভিতরে শাড়ি ঢুকিয়ে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে চলে গেল।
তাহেরা কি আসলেই ইয়জদানীর প্রেমে পড়েছিল? এই ব্যপারে নির্ভরযোগ্যভাবে বলা দুষ্কর। ইয়াজদানীর প্রথম প্রেমপত্র পেয়ে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে যে খেলাটা বেশ মজাদার মনে হচ্ছে খেলতে কোনো অসুবিধা নেই, চলো খেলে নেই। বিয়ের সম্বন্ধে তার প্রতিক্রিয়া একই রকম ছিল। এমনি সে বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ছিল কিন্তু ছিল বেশ চঞ্চল। ওর যে স্বামীর সাথে রোজ রোজ ঝগড়া লেগে থাকতো, আমি মনে করি তাও এক ধরনের খেলাই ছিল। কিন্তু আমরা ওখানে পৌঁছে আঁচ করতে পারলাম যে অবস্থা বেশ বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।
আমরা বাসার ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে এমন চেঁচামেচি শুরু হলো যে কিছুই বোঝা মুশকিল হয়ে গেল। তাহেরা আর ইয়াজদানী, দুইজনই উঁচু স্বরে বলতে শুরু করলো, নালিশ, অভিযোগ, কটাক্ষ, পুরান মরা দেহে নতুন লাশ, নতুন লাশে পুরান মৃতদেহ। যখন তারা ক্লান্ত হয়ে গেল তখন কিসের জন্য এই বিবাদ পরিষ্কার হতে শুরু হলো।
তাহেরার অভিযোগ যে আতা স্টুডিও-এর ফালতু মেয়েদেরকে ট্যাক্সিতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ইয়জদানী বলল, এটা শুধুই দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাহেরা কোরান ছুঁতে রাজি হয়ে গেল যে আতার ওই অভিনেত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ইয়াজদানী তা মানতে রাজি না। তখন তাহেরা তীক্ষè গলায় বলল, “নিজেকে অনেক সাধু মনে করো। এই আয়া যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কি তুমি চুমু খেতে চেষ্টা করো নি? আমি সেদিন তখনই উপর থেকে নিচে চলে এসেছিলাম”।
ইয়জদানী জোরে চিৎকার দিল, “তোমার ফালতু কথা বন্ধ করো”।
তারপর আবার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।
আমি বুঝালাম, আমার স্ত্রী তাদের বোঝালো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আমি ইয়জদানীকে বকা দিলাম, “তুমি বেশি বেশি করছো, যাও তার থেকে ক্ষমা চেয়ে ব্যপারটা মিটমাট করো”।
আতা আমার দিকে খুব গম্ভীরভাবে তাকালো আর বলল, “সা’দাত এই গল্প এমনি শেষ হবে না। এই মহিলা আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছে, আমি কিন্তু তার সম্বন্ধে কিছুই বলি নাই। তুমি এনায়েতকে চিনো?”
“এনায়েত, কোন এনায়েত?”
“প্লে-ব্যাক সিংগার, এর বাবা’র শাগরেদ”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ”।
“এক নম্বর বদমাইশ কিন্তু এই মহিলা প্রত্যেক দিন তাকে এখানে ডাকে আর অজুহাত দেয় যে”...
তাহেরা তাকে কথা বলতে দিল না এবং বলল, “কোন অজুহাত দেই না, বলো তুমি কী বলতে চাও?”
আতা অতি ঘৃণার সাথে বলল, “কিছুই না”।
তাহেরা তার কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে বলল, “এনায়েত আমাকে ভালবাসে, আর কিছুই না”।
আতা গাল দিল, এনায়েতকে বড় গাল আর তাহেরাকে ছোট গাল।
আবার একবার সেটাই ঘটলো যা এতক্ষণ ঘটে যাচ্ছিল। আমি আর আমার স্ত্রী মধ্যস্থতা করার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পরিণাম ওই শূন্য। আমার মনে হলো যে আতা আর তাহেরা নিজেদের ঝগড়ায় খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। ঝগড়ার আগুন অনেক জোরে জ্বলে উঠে কোন ফলাফল ছাড়া আবার নিভে যায়। আবার নতুন করে জ্বালানো হলো কিন্তু পরিণাম কিছুই বের হচ্ছে না।
আমি অনেক ক্ষণ চিন্তা করলাম আতা আর তাহেরা আসলে কী চায় কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি নাই। আমি খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম, দুই ঘণ্টা ধরে বক বক আর ঝগড়া চলছে আর কতোক্ষণ চলবে তার কোনো ঠিক নেই। বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, “যদি তোমরা একসাথে থাকতে চাও না তা হলে আলাদা হয়ে যাও”।
তাহেরা চুপ থাকলো কিন্তু আতা কিছু চিন্তা করে চেঁচিয়ে উঠলো, “আলাদা না আমি তালাক দিবো তালাক”।
তাহেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, “তালাক, তালাক, তালাক, দাও না কেন তালাক, আমি কি তোমার পায়ে পড়ে বলেছি যে, আমাকে তালাক দিও না”।
আতা খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, “তালাক দিয়ে দিবো, খুব শীঘ্রই”।
তাহেরা তার কপাল থেকে চুলের ঝালর সরিয়ে বলল, “আজকেই দাও তালাক”।
আতা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে বলল, “আমি এখনই কাজীর সাথে কথা বলছি”।
আমি যখন দেখলাম ব্যপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন আমি উঠে আতাকে বাধা দিলাম , “বোকার মতো কাজ কর না। বসো, একটু আরাম কর”।
তাহেরা বলল, “ভাইজান আপনি ওকে থামাবেন না”।
আমার স্ত্রী তাহেরাকে বকা দিল, “ফালতু কথা বলার দরকার নেই”।
“এই ফালতু কথা এখন তালাক থেকেই বন্ধ হবে”- এই বলে সে নিজে পা নাচাতে লাগলো।
“তুমি শুনলে” আতা আমাকে বলল আর আবার টেলিফোনের দিকে অগ্রসর হলো, কিন্তু আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম।
তাহেরা আমার বউকে বলল, “আমাকে তালাক দিয়ে ওই ফালতু নায়িকার সাথে বিয়ে করবে”।
আতা তাহেরাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আর তুই?”
তাহেরা তার কপাল থেকে ঘামে ভেজা চুল সরিয়ে বলল, “আমি তো ওই হজরত ইউসুফ দ্বিতীয়, এনায়েত খানকে বিয়ে করবো”।
“ব্যাস, অনেক হয়েছে, এবার সে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। তুমি সরো” আতা টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে ফোন নম্বর খুঁজতে লাগলো। যখন সে ফোন ডায়াল করছিলো তখন আমি তাকে বাধা দেওয়াটা ঠিক মনে করি নি। সে দুইবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাইন পেলো না। আমি এবার সুযোগ পেয়ে তাকে বললাম সে যেন এই কাজটি থেকে বিরত থাকে। আমার স্ত্রীও তাকে অনুরোধ করলো কিন্তু সে কোনো কথা শুনতে নারাজ। তখন তাহেরা আমার বউকে বলল, “সাফিয়া, কিছু বলার দরকার নেই। এই মানুষের বুকে হৃদয় নয় পাথর আছে। আমি তোমাকে সেই চিঠিগুলো দেখাবো যেগুলো সে আমাকে বিয়ের আগে লিখেছিল। তখন আমি তার মনের শান্তি, তার চোখের জ্যোতি ছিলাম। আমার মুখ থেকে বের হওয়া একটি শব্দ না কি তার মৃতদেহে জীবন সঞ্চার করতো। সে না কি এক নজর আমার মুখম-ল দেখার জন্য মরতে রাজি আছে। কিন্তু আজ সে আমাকে মোটেও কোন মূল্য দেয় না”।
আতা আবারো নম্বর মেলানোর চেষ্টা করলো।
তাহেরা বলতে থাকলো, “আমার বাবার সুর থেকে তার না কি প্রেম ছিল। সে না কি খুব গর্বিত ছিল এতো বড় শিল্পী তাকে তার মেয়ের জামাই হিসাবে বিবেচিত করেছে। তাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য সে তার পা পর্যন্ত টিপেছে আর আজ তার কোনো মূল্য নেই”।
আতা ফোনের ডায়াল ঘোরাতে থাকলো।
তাহেরা আমাকে উদ্দেশ করে বলল, “ও না কি আপনাকে ভাই বলে, আপনাকে অনেক সম্মান করে, বলছিল ভাইজান যা বলবে আমি তা মেনে নিবো। কিন্তু আপনি তো দেখছেন, এখন ফোন করছে কাজীকে- যেন আমাকে তালাক দিতে পারে”।
আমি টেলিফোন একদিকে সরিয়ে দিলাম আর আতাকে বললাম, “অনেক হয়েছে, এবার ছাড়ো”।
“না” এই বলে সে আবার ফোনটা নিজের দিকে টেনে নিলো।
“তাহেরা বলল, “ছেড়ে দেন ভাইজান- ওর মনে আমার জন্য তো বাদই দিলাম টুটুর জন্যও কোন মায়া নেই”।
আতা দ্রুত উত্তর দিলো, “টুটুর নাম নিও না”।
তাহেরা মুখ ফুলিয়ে বলল, “কেন তার নাম নিবো না?”
আতা ফোনের রিসিভার রেখে বলল, “ও আমার”।
তাহেরা উঠে দাঁড়িয়ে গেল, “যখন আমি তোমার না তখন সে তোমার কীভাবে হবে? তুমি ওর নামও নিবে না”।
আতা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমি সব ব্যবস্থা করবো”।
তাহেরার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, “তুমি কি টুটুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে?”
আতা খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, “হ্যাঁ”।
“পাষাণ”, তাহেরা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল তখন আমার স্ত্রী তাকে ধরলো। আতা একদম বিচলিত হয়ে গেল, তাহেরার মুখে পানির ছিটা দিল, ইউ-ডি-ক্লোন, স্মেলিং সল্ট শুঁকালো। ডাক্তারকে ফোন করলো, নিজের চুল ছিঁড়লো, শার্ট ছিঁড়ে নিল, আজব সব কা- করলো। তাহেরার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “জানু টুটু তোমার, টুটু শুধুই তোমার”।
তাহেরা কাঁদতে লাগলো, “না ও তোমারও”।
আতা তাহেরার অশ্রুভরা চোখে চুমু দিয়ে বলল, “আমি তোমার, তুমি আমার, টুটু তোমারও আর আমারও”।
আমি আমার স্ত্রীকে ইশারা করলাম, সে বের হয়ে গেল তার একটু পর আমিও বের হয়ে গেলাম। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল আমরা ওটাতে উঠে পড়লাম। আমার স্ত্রী মুচকি হাসছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই টুটু কে?
আমার বউ সজোরে হেসে দিল, “ওদের ছেলে”।
আমি হয়রান হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তাদের ছেলে?”
আমার বউ ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লো।
আমি আরো বেশি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, “কখন জন্ম নিয়েছিল? আমি বলতে চাচ্ছি”...।
“এখনো জন্ম নেয় নাই, মাত্র চার মাসের পেটে আছে”।
চতুর্থ মাস, অর্থাৎ এই ঘটনার ঠিক চার মাস পর আমি বাইরের ব্যালকনিতে কোনো চিন্তা ছাড়া বসে ছিলাম তখন ভিতরের রুমে টেলিফোনের বেল বাজতে শুরু করলো। আমি খুব বিরক্তির সাথে ওঠার জন্য দাঁড়ালাম তখনই বেলের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। একটু পর আমার বউ এলো, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে ফোন করেছিল?”
“ইয়জদানী সাব”।
“কোন নতুন ঝগড়া?”
“না, তাহেরার একটি মেয়ে হয়েছে- মৃত” এই বলে সে কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে চলে গেল।
আমি চিন্তায় ডুবে গেলাম, “আবার তাহেরা আর আতা’র ঝগড়া হলে কোন টুটু এই ঝগড়া মিটাবে?”
সা’দাত হাসান মান্টোর গল্প
মূল উর্দু থেকে অনুবাদ-হাইকেল হাশমী
বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪
আমি ভাবছি।
যখন দুনিয়ার প্রথম মহিলা মা হলো, তখন বিশ্বব্রহ্মা-ের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
দুনিয়ার প্রথম পুরুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে দুনিয়ার প্রথম ভাষায় খুব গর্বের সাথে কি বলে নাই, “আমিও তো ¯্রষ্টা”। টেলিফোনের রিং বেজে উঠলো। আমার বাউ-ুলে ভাবনার তার ছিঁড়ে গেল। ব্যালকনি থেকে উঠে আমি ভিতরের রুমে এলাম। টেলিফোন জেদি বাচ্চার মতো চিৎকার করেই যাচ্ছে।
টেলিফোন খুবই উপকারী জিনিস কিন্তু আমি এটাকে অত্যন্ত অপছন্দ করি। তার কারণ হচ্ছে এটা সময়ে অসময়ে বেজে ওঠে। আমি খুব অনিচ্ছার সাথে রিসিভার তুললাম আর আমার ফোনের নম্বর বললাম, “ফোর ফোর ফাইভ সেভেন”।
অন্য প্রান্ত থেকে হ্যালো হ্যালো শুরু হয়ে গেল, আমি রেগে গিয়ে বললাম, “কে বলছেন?”
উত্তর পেলাম, “আয়া”।
আমি আয়াদের ভঙ্গিতে বললাম, “কারে চাই?”
“মেম সাব আছে?”
“আছে দাঁড়াও”।
টেলিফোনের রিসিভার এক পাশে রেখে আমি আমার বউকে ডাকলাম, সে বোধয় ভিতরে ঘুমাচ্ছিলো, “মেম সাব- ও মেম সাব”।
আমার ডাক শুনে বউ বের হয়ে এলো, “এটা কি কথা, মেম সাব, মেম সাব”।
আমি মুচকি হেসে বললাম, “মেম সাব ঠিক আছে। তোমার মনে আছে, তুমি তোমার প্রথম আয়াকে বলেছিলে তোমাকে মেম সাব না ডেকে যেন বেগম সাব ডাকে এবং সে তোমাকে বেগুন সাব বানিয়ে দিয়েছিল”।
একটি হাসিমাখা হাই তুলে সে জিজ্ঞাসা করলো, “কে ফোন করেছে?”
“তাকে নিজেই জিজ্ঞাসা করে নাও”।
আমার বউ টেলিফোন তুলে হ্যালো হ্যালো শুরু করে দিল। আমি আবার ব্যালকনিতে চলে গেলাম। এই মহিলারা টেলিফোনে অনেক লম্বা কথা বলে তাই পনের বিশ মিনিট পর্যন্ত এই হ্যালো হ্যালো চললো।
আমি ভাবছিলাম- টেলিফোনে প্রতি কয়েকটি শব্দের পর হ্যালো কেন বলে? এই হ্যালো বলার পিছনে কোন হীনম্মন্য কারণ তো নয়? বারে বারে হ্যালো সেই বলে যার মনে এই সন্দেহ কাজ করে যে তার ফালতু কথা শুনে অন্য প্রান্তের ব্যক্তি ফোন যেন না কেটে দেয়। আবার এটাও হতে পারে এটা শুধুই একটি অভ্যাস।
হঠাৎ আমার বউ চেঁচিয়ে উঠলো, “সা’দাত সাব এবার ব্যপারটা বেশ সিরিয়াস মনে হচ্ছে”।
“কোন ব্যপারটা?”
সেই ব্যপার সম্বন্ধে কিছু না বলেই আমার স্ত্রী বলতে শুরু করলো, “কথা বাড়তে বাড়তে তালাক পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। পাগলামিরও একটি সীমা থাকে। আমি বাজি ধরতে পারি এমন কিছুই হয় নাই, কোনো একটা ছোট ব্যাপারকে তারা বড় করে ফেলেছে- দুইজনই পাগল”।
“কারা পাগল?”
“আমি কি আপনাকে বলি নাই? ওই টেলিফোন তাহেরার ছিল”।
“তাহেরা? তাহেরা কে?”
“মিসেজ ইয়াজদানী”।
“ওহ, আচ্ছা, আমি সব ঘটনা বুঝে গেছি। নিশ্চয় কোন নতুন ঝগড়া বেধেছে”।
“নতুন আর বেশ নাজুক ব্যপার। যান মিঃ ইয়জদানী আপনার সাথে কথা বলতে চায়”।
“আমার সাথে আবার কি কথা বলতে চায়?”
“জানি না, তাহেরার হাত থেকে ফোন কেড়ে নিয়ে আমাকে এইটুকুই বলল, “ভাবী একটু মান্টো সাবকে ডাকেন”।
“খামাখা আমার মাথা নষ্ট করবে” এই বলে আমি টেলিফোনে ইয়াজদানীকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কী ব্যাপার?”।
সে এইটুকুই বলল, “ব্যপারটা খুব গম্ভীর হয়ে গেছে। তুমি আর ভাবী এখনই আমার বাসায় চলে এসো”।
আমি আর আমার বউ তাড়াতাড়ি কাপড় বদলিয়ে ট্যাক্সি নিয়ে ইয়জদানীর বাসার দিকে রওয়ানা হয়ে গেলাম। রাস্তায় আমরা দুইজন ইয়জদানী আর তাহেরার সম্বন্ধে অনেক কথা বললাম।
তাহেরা হলো একজন বিখ্যাত প্রেমী সুরকারের সুন্দরী মেয়ে আর আতা ইয়জদানী একজন পাঠান আড়ৎদারের ছেলে। সে প্রথমে কবিতা লিখতে শুরু করলো তার পর নাটক তার পর আস্তে আস্তে ছায়াছবির কাহিনী লিখতে লাগলো। তাহেরার বাবা তার অষ্টম প্রেম করা নিয়ে ব্যস্ত ছিল আর আতা ইয়াজদানী, আল্লামা মাশরাকির খাকেসার আন্দোলনের জন্য বেলচা নামক নাটক লিখতে ব্যস্ত ছিল।
এক বিকেলে ইয়জদানীর চোখে তাহেরা ধরা পড়লো এবং সেই রাতে সারাটি রাত জেগে সে তাকে একটি চিঠি লিখলো আর সকালে তার কাছে পৌঁছে দিয়ে আসলো। কয়েক মাস তাদের মধ্যে চিঠির আদান প্রদান চললো আর অবশেষে তাদের বিয়ে কোন ঝঞ্ঝাট ছাড়া হয়ে গেল। ইয়জদানীর একটি দুঃখ রয়ে গেল যে তাদের প্রেম কোনো নাটক ছাড়াই বিবাহতে শেষ হলো।
তাহেরা প্রকৃতি ড্রামায় ভরপুর ছিল। প্রেম আর বিয়ের আগে যখন সে তার বান্ধবীদের সাথে শপিং-এ যেতো তখন তাদের জন্য বিপদ হয়ে যেতো। কোন টাক পড়া লোক দেখলেই তার হাতে চুলকানি শুরু হতো, “আমি তার মাথায় এক থাপ্পর মারবই মারবো, তোমরা যাই করো”।
বুদ্ধিমতি ছিল- একবার তার কাছে কোন পেটিকোট ছিল না। সে কোমরে একটি ফিতা বেঁধে তার ভিতরে শাড়ি ঢুকিয়ে বান্ধবীদের সাথে বেড়াতে চলে গেল।
তাহেরা কি আসলেই ইয়জদানীর প্রেমে পড়েছিল? এই ব্যপারে নির্ভরযোগ্যভাবে বলা দুষ্কর। ইয়াজদানীর প্রথম প্রেমপত্র পেয়ে তার প্রতিক্রিয়া হতে পারে যে খেলাটা বেশ মজাদার মনে হচ্ছে খেলতে কোনো অসুবিধা নেই, চলো খেলে নেই। বিয়ের সম্বন্ধে তার প্রতিক্রিয়া একই রকম ছিল। এমনি সে বলিষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী ছিল কিন্তু ছিল বেশ চঞ্চল। ওর যে স্বামীর সাথে রোজ রোজ ঝগড়া লেগে থাকতো, আমি মনে করি তাও এক ধরনের খেলাই ছিল। কিন্তু আমরা ওখানে পৌঁছে আঁচ করতে পারলাম যে অবস্থা বেশ বিপজ্জনক হয়ে পড়েছে।
আমরা বাসার ভিতরে ঢোকার সাথে সাথে এমন চেঁচামেচি শুরু হলো যে কিছুই বোঝা মুশকিল হয়ে গেল। তাহেরা আর ইয়াজদানী, দুইজনই উঁচু স্বরে বলতে শুরু করলো, নালিশ, অভিযোগ, কটাক্ষ, পুরান মরা দেহে নতুন লাশ, নতুন লাশে পুরান মৃতদেহ। যখন তারা ক্লান্ত হয়ে গেল তখন কিসের জন্য এই বিবাদ পরিষ্কার হতে শুরু হলো।
তাহেরার অভিযোগ যে আতা স্টুডিও-এর ফালতু মেয়েদেরকে ট্যাক্সিতে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়।
ইয়জদানী বলল, এটা শুধুই দোষারোপ ছাড়া আর কিছুই নয়।
তাহেরা কোরান ছুঁতে রাজি হয়ে গেল যে আতার ওই অভিনেত্রীর সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে। কিন্তু ইয়াজদানী তা মানতে রাজি না। তখন তাহেরা তীক্ষè গলায় বলল, “নিজেকে অনেক সাধু মনে করো। এই আয়া যে তোমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, তাকে কি তুমি চুমু খেতে চেষ্টা করো নি? আমি সেদিন তখনই উপর থেকে নিচে চলে এসেছিলাম”।
ইয়জদানী জোরে চিৎকার দিল, “তোমার ফালতু কথা বন্ধ করো”।
তারপর আবার হৈ চৈ শুরু হয়ে গেল।
আমি বুঝালাম, আমার স্ত্রী তাদের বোঝালো কিন্তু কোনো লাভ হলো না। আমি ইয়জদানীকে বকা দিলাম, “তুমি বেশি বেশি করছো, যাও তার থেকে ক্ষমা চেয়ে ব্যপারটা মিটমাট করো”।
আতা আমার দিকে খুব গম্ভীরভাবে তাকালো আর বলল, “সা’দাত এই গল্প এমনি শেষ হবে না। এই মহিলা আমার সম্বন্ধে অনেক কিছু বলেছে, আমি কিন্তু তার সম্বন্ধে কিছুই বলি নাই। তুমি এনায়েতকে চিনো?”
“এনায়েত, কোন এনায়েত?”
“প্লে-ব্যাক সিংগার, এর বাবা’র শাগরেদ”।
“হ্যাঁ হ্যাঁ”।
“এক নম্বর বদমাইশ কিন্তু এই মহিলা প্রত্যেক দিন তাকে এখানে ডাকে আর অজুহাত দেয় যে”...
তাহেরা তাকে কথা বলতে দিল না এবং বলল, “কোন অজুহাত দেই না, বলো তুমি কী বলতে চাও?”
আতা অতি ঘৃণার সাথে বলল, “কিছুই না”।
তাহেরা তার কপাল থেকে চুলের গুচ্ছ সরিয়ে বলল, “এনায়েত আমাকে ভালবাসে, আর কিছুই না”।
আতা গাল দিল, এনায়েতকে বড় গাল আর তাহেরাকে ছোট গাল।
আবার একবার সেটাই ঘটলো যা এতক্ষণ ঘটে যাচ্ছিল। আমি আর আমার স্ত্রী মধ্যস্থতা করার অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু পরিণাম ওই শূন্য। আমার মনে হলো যে আতা আর তাহেরা নিজেদের ঝগড়ায় খুব বেশি সন্তুষ্ট নয়। ঝগড়ার আগুন অনেক জোরে জ্বলে উঠে কোন ফলাফল ছাড়া আবার নিভে যায়। আবার নতুন করে জ্বালানো হলো কিন্তু পরিণাম কিছুই বের হচ্ছে না।
আমি অনেক ক্ষণ চিন্তা করলাম আতা আর তাহেরা আসলে কী চায় কিন্তু কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি নাই। আমি খুব বিরক্ত হচ্ছিলাম, দুই ঘণ্টা ধরে বক বক আর ঝগড়া চলছে আর কতোক্ষণ চলবে তার কোনো ঠিক নেই। বিরক্ত হয়ে আমি বললাম, “যদি তোমরা একসাথে থাকতে চাও না তা হলে আলাদা হয়ে যাও”।
তাহেরা চুপ থাকলো কিন্তু আতা কিছু চিন্তা করে চেঁচিয়ে উঠলো, “আলাদা না আমি তালাক দিবো তালাক”।
তাহেরা চিৎকার দিয়ে উঠলো, “তালাক, তালাক, তালাক, দাও না কেন তালাক, আমি কি তোমার পায়ে পড়ে বলেছি যে, আমাকে তালাক দিও না”।
আতা খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, “তালাক দিয়ে দিবো, খুব শীঘ্রই”।
তাহেরা তার কপাল থেকে চুলের ঝালর সরিয়ে বলল, “আজকেই দাও তালাক”।
আতা টেলিফোনের দিকে এগিয়ে বলল, “আমি এখনই কাজীর সাথে কথা বলছি”।
আমি যখন দেখলাম ব্যপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে তখন আমি উঠে আতাকে বাধা দিলাম , “বোকার মতো কাজ কর না। বসো, একটু আরাম কর”।
তাহেরা বলল, “ভাইজান আপনি ওকে থামাবেন না”।
আমার স্ত্রী তাহেরাকে বকা দিল, “ফালতু কথা বলার দরকার নেই”।
“এই ফালতু কথা এখন তালাক থেকেই বন্ধ হবে”- এই বলে সে নিজে পা নাচাতে লাগলো।
“তুমি শুনলে” আতা আমাকে বলল আর আবার টেলিফোনের দিকে অগ্রসর হলো, কিন্তু আমি মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলাম।
তাহেরা আমার বউকে বলল, “আমাকে তালাক দিয়ে ওই ফালতু নায়িকার সাথে বিয়ে করবে”।
আতা তাহেরাকে জিজ্ঞাসা করলো, “আর তুই?”
তাহেরা তার কপাল থেকে ঘামে ভেজা চুল সরিয়ে বলল, “আমি তো ওই হজরত ইউসুফ দ্বিতীয়, এনায়েত খানকে বিয়ে করবো”।
“ব্যাস, অনেক হয়েছে, এবার সে অতিরিক্ত বেড়ে গেছে। তুমি সরো” আতা টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে ফোন নম্বর খুঁজতে লাগলো। যখন সে ফোন ডায়াল করছিলো তখন আমি তাকে বাধা দেওয়াটা ঠিক মনে করি নি। সে দুইবার চেষ্টা করলো কিন্তু লাইন পেলো না। আমি এবার সুযোগ পেয়ে তাকে বললাম সে যেন এই কাজটি থেকে বিরত থাকে। আমার স্ত্রীও তাকে অনুরোধ করলো কিন্তু সে কোনো কথা শুনতে নারাজ। তখন তাহেরা আমার বউকে বলল, “সাফিয়া, কিছু বলার দরকার নেই। এই মানুষের বুকে হৃদয় নয় পাথর আছে। আমি তোমাকে সেই চিঠিগুলো দেখাবো যেগুলো সে আমাকে বিয়ের আগে লিখেছিল। তখন আমি তার মনের শান্তি, তার চোখের জ্যোতি ছিলাম। আমার মুখ থেকে বের হওয়া একটি শব্দ না কি তার মৃতদেহে জীবন সঞ্চার করতো। সে না কি এক নজর আমার মুখম-ল দেখার জন্য মরতে রাজি আছে। কিন্তু আজ সে আমাকে মোটেও কোন মূল্য দেয় না”।
আতা আবারো নম্বর মেলানোর চেষ্টা করলো।
তাহেরা বলতে থাকলো, “আমার বাবার সুর থেকে তার না কি প্রেম ছিল। সে না কি খুব গর্বিত ছিল এতো বড় শিল্পী তাকে তার মেয়ের জামাই হিসাবে বিবেচিত করেছে। তাকে বিয়েতে রাজি করানোর জন্য সে তার পা পর্যন্ত টিপেছে আর আজ তার কোনো মূল্য নেই”।
আতা ফোনের ডায়াল ঘোরাতে থাকলো।
তাহেরা আমাকে উদ্দেশ করে বলল, “ও না কি আপনাকে ভাই বলে, আপনাকে অনেক সম্মান করে, বলছিল ভাইজান যা বলবে আমি তা মেনে নিবো। কিন্তু আপনি তো দেখছেন, এখন ফোন করছে কাজীকে- যেন আমাকে তালাক দিতে পারে”।
আমি টেলিফোন একদিকে সরিয়ে দিলাম আর আতাকে বললাম, “অনেক হয়েছে, এবার ছাড়ো”।
“না” এই বলে সে আবার ফোনটা নিজের দিকে টেনে নিলো।
“তাহেরা বলল, “ছেড়ে দেন ভাইজান- ওর মনে আমার জন্য তো বাদই দিলাম টুটুর জন্যও কোন মায়া নেই”।
আতা দ্রুত উত্তর দিলো, “টুটুর নাম নিও না”।
তাহেরা মুখ ফুলিয়ে বলল, “কেন তার নাম নিবো না?”
আতা ফোনের রিসিভার রেখে বলল, “ও আমার”।
তাহেরা উঠে দাঁড়িয়ে গেল, “যখন আমি তোমার না তখন সে তোমার কীভাবে হবে? তুমি ওর নামও নিবে না”।
আতা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, “আমি সব ব্যবস্থা করবো”।
তাহেরার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেল, “তুমি কি টুটুকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিবে?”
আতা খুব দৃঢ়তার সাথে বলল, “হ্যাঁ”।
“পাষাণ”, তাহেরা চিৎকার দিয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিল তখন আমার স্ত্রী তাকে ধরলো। আতা একদম বিচলিত হয়ে গেল, তাহেরার মুখে পানির ছিটা দিল, ইউ-ডি-ক্লোন, স্মেলিং সল্ট শুঁকালো। ডাক্তারকে ফোন করলো, নিজের চুল ছিঁড়লো, শার্ট ছিঁড়ে নিল, আজব সব কা- করলো। তাহেরার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তার হাত নিজের হাতে নিয়ে বলল, “জানু টুটু তোমার, টুটু শুধুই তোমার”।
তাহেরা কাঁদতে লাগলো, “না ও তোমারও”।
আতা তাহেরার অশ্রুভরা চোখে চুমু দিয়ে বলল, “আমি তোমার, তুমি আমার, টুটু তোমারও আর আমারও”।
আমি আমার স্ত্রীকে ইশারা করলাম, সে বের হয়ে গেল তার একটু পর আমিও বের হয়ে গেলাম। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল আমরা ওটাতে উঠে পড়লাম। আমার স্ত্রী মুচকি হাসছে। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “এই টুটু কে?
আমার বউ সজোরে হেসে দিল, “ওদের ছেলে”।
আমি হয়রান হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, “তাদের ছেলে?”
আমার বউ ইতিবাচক ভাবে মাথা নাড়লো।
আমি আরো বেশি বিস্ময়ের সাথে জিজ্ঞাসা করলাম, “কখন জন্ম নিয়েছিল? আমি বলতে চাচ্ছি”...।
“এখনো জন্ম নেয় নাই, মাত্র চার মাসের পেটে আছে”।
চতুর্থ মাস, অর্থাৎ এই ঘটনার ঠিক চার মাস পর আমি বাইরের ব্যালকনিতে কোনো চিন্তা ছাড়া বসে ছিলাম তখন ভিতরের রুমে টেলিফোনের বেল বাজতে শুরু করলো। আমি খুব বিরক্তির সাথে ওঠার জন্য দাঁড়ালাম তখনই বেলের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। একটু পর আমার বউ এলো, আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কে ফোন করেছিল?”
“ইয়জদানী সাব”।
“কোন নতুন ঝগড়া?”
“না, তাহেরার একটি মেয়ে হয়েছে- মৃত” এই বলে সে কাঁদতে কাঁদতে ভিতরে চলে গেল।
আমি চিন্তায় ডুবে গেলাম, “আবার তাহেরা আর আতা’র ঝগড়া হলে কোন টুটু এই ঝগড়া মিটাবে?”