জামাল রেজা
রাত তখন আড়াইটা। ফ্ল্যাটে ঢুকেই ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে সুমিত। সে মদ্যপ। বাবা শিবেন সরকার ছেলের পাশে গিয়ে বসেন। ছেলের ভাবমূর্তি খেয়াল করেন। পাশেই ছেলের বউ পুর্ণি দাঁড়িয়ে আছে ড্যাব ড্যাব চোখে। কারও মুখে রা নেই। নীরবতা ভাঙ্গে সুমিত।
বাবা আমার মা মরল ক্যান?
হায়াত ছিল না। বললেন শিবেন সরকার।
কীভাবে মরল?
স্ট্রোক করে।
না, আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি নেশা করি, মা নিষেধ করে। তার নিষেধ আমি মানি নি। ক্ষোভে, দুঃখে মা আমার...
এরপর কথা থেমে যায় সুমিত সরকারের। সে বাবা এবং স্ত্রীর দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকায়।
তুমি ঘরে চল, বলে পুর্র্ণি সুমিতের স্ত্রী। তার কণ্ঠ ভেজা।
আমি ঘরে যাব না। ঘর থেকে ডায়েরি নিয়ে এস।
তুমি এখন ঘরে যাও। ঘুমাও গিয়ে। বললেন শিবেন সরকার।
হেলিয়ে পড়া সুমিত মাথা সোজা করে চোখ টেনে তাকায়। স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলে- যাও ডায়েরি নিয়ে এস। বাবার সঙ্গে আজ আমার চুক্তি লিখন হবে।
শ্বশুরের ইশারা পেয়ে পুর্র্ণি বেডরুম থেকে ডায়েরি এনে সুমিতের হাতে দেয়। পকেট থেকে কলম বের করে গজ গজ করে ডায়েরিতে লিখতে থাকে। অন্যদিকে বাবা ছেলে এবং ছেলের বউয়ের দিকে তাকায়। নেশার ঘোরে ছেলে যে বুঁদ হয়ে আছে তা বুঝতে পারেন শিবেন সরকার। তিনি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সতেরো বছর। গত ফেব্রুয়ারিতে অবসর নিয়েছেন। মহল্লায় সরকার হোমিও নামের একটি ফার্মেসিতে বসেন। এখন সকাল বিকেল দুইবেলা বসেন। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও সরকার হোমিও হলের রোগীর ভিড় চোখে পড়ার মতো। গুলশান এক নম্বরের পুব দিকে লেকের পাড়ে গুদারাঘাটে এই হোমিও ফার্মিসিতে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসে। শিবেন সরকার নাড়ি টিপে চিকিৎসাপত্র দেন। মানুষের রোগ নিরাময় হয়।
সুমিত লিখে ডায়েরির পৃষ্ঠা ভরে ফেলেছে। এবার বাবার দিকে এগিয়ে ধরে। বলে, বাবা কি লিখেছি পড়।
তুমি ঘুমাও গিয়ে রাত অনেক হয়েছে। বলেন বাবা।
আর অনেক রাত হবে না। সেই কথাই ডায়েরিতে লিখেছি, পড়, দেখ।
তুমিই পড় তাহলে-
বাবার হাত থেকে ডায়েরি নিয়ে সুমিত বুজে আসা চোখ খোলে পড়তে শুরু করে।
চুক্তি লিখন। বাবা এই লেখাটার নাম চুক্তি লিখন।
এরপর শিবেন সরকারের দিকে তাকায় সুমিত। বাবা পড়তে ইশারা করেন। সুমিত আবার পড়তে শুরু করে। আমি এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি যে, আজকের পর থেকে আর কোনোদিন রাতে বাইরে থাকিব না- অর্থাৎ দশটার মধ্যে অবশ্যই বাসায় ফিরিব। কোনো অবস্থায়ই মদ্যপান করিব না। সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করিব। এরপর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইব।
ঠিক আছে আর পড়তে হবে না। তুমি ভুল পথ থেকে শুদ্ধতার দিকে ফিরে এস- সেটাই আমার প্রত্যাশা। তুমি আমার একমাত্র সন্তান। অবলম্বন।
অনেক আদরের বাবা, অনেক আদরের সন্তান আমি। ছোটবেলা থেকে আমার কোনো ইচ্ছা তুমি অপূরণীয় ধ্যাৎ অপূর্ণ রাখোনি। আমি তোমাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছি। আমার মা আমারই দুঃখে হু হু হু ... মরে গেছে।
এরপর সুমিত হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবা উঠে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলেন, ‘যাও বাবা- ঘুমাও গিয়ে। ভগবান তোমার সুমতি দিক। আমি আর কিছুই চাই না। আমি শুধু তোমার সুস্থ ও সুন্দর জীবন চাই।
কিছুটা জোর করে ধরেই বসা থেকে ছেলেকে উঠিয়ে ঘরে পৌঁছে দেন শিবেন সরকার। সুমিত পা টেনে টেনে হাঁটছিল। বাবার চোখ জল ভাঙল তখন।
ছেলেকে ঘরে দিয়ে এসে সোফায় বসলেন শিবেন সরকার। অতীত ভাবনায় মন ডুবল তার। কী সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট সংসার ছিল। সেই সংসারে সুমিতের জন্মটাকে ভগবানের আশীর্বাদ মনে করেছিলেন তিনি। আদর ¯েœহ আর সুশিক্ষা দিয়েই বড় করে তুলেছিলেন ছেলেকে। কিন্তু কে জানত ছাত্রজীবনেই সে মদের গ্লাস তুলে নেবে হাতে?
পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল সুমিত। রেজাল্টও ভালো। বিবিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও দিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকে ইন্টারভ্যু দিয়ে ঢুকে গেল জবে। অফিসে তার অনেক সুনাম। সকাল নটা মানে নটাতেই অফিসে ঢোকে। একটানা কাজ করে। ব্যাংকের এডি ইফতেখার মুনিম সুমিতের কাজ নিয়ে খুবই খুশি। শিবেন সরকারের সঙ্গেই সেই আলোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘সুমিতের মতো এমন কর্মঠ আর বিচক্ষণ কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা ব্যাংকে বাড়লে আমাদের ব্যাংকিং খাত খুব দ্রুতই উন্নত হবে।
সেদিন ছেলের প্রশংসা শুনে বাবা হিসেবে খুবই গর্ববোধ করেছিলেন প্রিন্সিপাল শিবেন সরকার। ভেবেছিলেন, ‘বিসিএস না দিলেও ক্ষতি নেই। ব্যাংকেই নিজের উন্নতি ঘটাতে পারবে। কিন্তু ছেলের অমনোযোগিতার খবর তিনি পান আরও পরে। স্ত্রী বীনা সোম অপারগ হয়ে জানান যে, তার ছেলে প্রতিরাতেই মদ খেয়ে বাসায় ফেরে।
স্ত্রীর কথা শুনে শিবেন সরকার হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সময় না নিয়ে দ্রুতই ছেলের সাথে আলোচনায় বসেন। এক পর্যায়ে ছেলে স্বীকার করে নেয় মায়ের অভিযোগের সত্যতা। তবে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মদ ছেড়ে দেবে সে।
অবশ্য মদ্যপান ছাড়েনি ছেলে। নিয়ম করে প্রতিরাতেই মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফেরে। মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন শিবেন সরকার। ছেলেকে কাউন্সিলিং করান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শ্যালিকা সীমা সোম পেশায় চিকিৎসক। তার পরামর্শে ছেলেকে তড়িঘড়ি করে বিয়ে করান। নিকট আত্মীয়স্বজনের অনেকেই বিয়ে করাবার পরামর্শ দিয়েছে। সেইসব পরামর্শ শিবেন সরকার মেনে নিয়েই বিয়ে করালেন পুর্র্ণি নামের এই লক্ষ্মী মেয়েটিকে। কিন্তু কাজে এল না। সুমিত মদ ছাড়েনি। আগের মতোই নিয়ম করে প্রতিরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফেরে সে।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় পিতার শোবার রুমে যায় সুমিত। বাবা কি ঘুমিয়ে আছ- বাবা-
চট করেই শোয়া থেকে উঠে বসেন শিবেন সরকার। ক্যান কী হয়েছে বাবা?
না, কিছু না। বাবা আজ থেকে ওসব ছাইপাশ আর খাব না আমি পণ করেছি।
ভেরি গুড। অফিস যাচ্ছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানায় সুমিত।
কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ছেলের ভাবমূর্তি লক্ষ করলেন বাবা। কিছু বলবে?
বাবা আমার হাত ফাঁকা- কিছু টাকা দিতে পারবে?
অবশ্যই, কত লাগবে?
দু’তিন হাজার হলেই চলবে-
তারপর আর কথা বললেন না-
শিবেন সরকার পকেট থেকে চারটি পাঁচশ টাকার নোট ছেলের দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, ‘টাকা নাও, তবে কথা রেখ। বাজে খরচ কর না। তোমাকে বিয়ে দিলাম। ঘরে এল জোছনার আলো নিয়ে পুর্র্ণি। এবার সেই ঘরে আগমন ঘটতে যাচ্ছে তোমাদের সন্তানের। ভগবানের কৃপায় তুমি বাবা হচ্ছো। এবার দেখ জীবনের আরেক আনন্দ।
আসি বাবা-
যাও, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
স্বামীকে বিদায় করে শ্বশুরের বেডরুমে যায় পুর্ণি। ছেলের বউয়ের দিকে তাকান শিবেন সরকার। পুর্ণি উচ্ছ্বাস ভেজানো কণ্ঠে বলে, ‘বাবা আপনার ছেলে আজ থেকে আর নেশা করবে না।’
শিবেন সরকার কিছু বললেন না। তাকিয়ে থাকলেন পুর্ণির দিকে। পুর্ণিই আবার কথা তুলে আনলো মুখে, অন্যদিনের প্রতিশ্রুতি আর আজকের মধ্যে পার্থক্য আছে বাবা।
তাই যেন হয়। জানো মা এই ছেলেটা আমাদের কোলে আসার পর থেকে-
কথা আর বাড়াতে পারলেন না শিবেন সরকার। কণ্ঠ ধরে এল। দুচোখ বেয়েও অশ্রু গড়াল। মানুষ সুখে এবং দুঃখে কাঁদে। প্রিন্সিপাল শিবেন সরকার সুখে নাকি দুঃখে কাঁদলেন তা অনুমান করতে পারল না পুর্ণি। বেশিক্ষণ দাঁড়াল না বউটি। চলে গেল শ্বশুরের বেডরুম থেকে। শ্বশুর ছেলের বউয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবলেন তার তৃতীয় প্রজন্ম আগমনের কথা।
শিবেন সরকার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। মেইন রোডে গাড়ির ভিড় জমে গেছে। হর্ন বাজার শব্দ হচ্ছে একনাগাড়ে। তার চোখ গেল নিচতলায় বাড়ির পূর্ব দক্ষিণের কোণে তুলসী গাছটার দিকে। স্ত্রী বীনা সোমের শাখাপরা হাতে পূজা দেবার ভঙ্গিটি মনে পড়ে তার। এই বাড়িটাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বত্রিশ বছর আগে স্বল্পমূল্যে পৌনে দুই কাঠার একতলা বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি। তারপর স্ত্রী বীনা সোম তাগিদ দিয়ে দোতলার তিনটি রুমের একটি ফ্ল্যাট করান। বা দিকটায় ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে আজও। স্ত্রীর লাগানো নিম গাছটার চিরল পাতায় রোদ পড়েছে। চিকচিক করছে নিম পাতাগুলো। স্মৃতিগুলোও ভেতরে তেমনই জ্বলজ্বল। কোনোকিছুই ভুলবার নয়। প্রেম ভালোবাসার এক মায়াময় বন্ধন ছিল স্ত্রীর সঙ্গে। দুজনই চেয়েছিলেন মৃত্যু যেন একসাথে হয়। পরমেশ্বর ভগবান তা করেননি। জোড়-ভাঙ্গা পাখির মতোই শিবেন সরকার শুকনো ডালে বসে প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে অতীত স্মৃতির জাবর কাটছেন। স্মৃতির পিরামিড তাকে নিয়ে গেল পেছনে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে ঘরে ফেরার পর স্ত্রী বলেছিল, ‘আমাদের দুঃখের দিন শেষ। এখন আমরা চল ঘুরে বেড়াই জগৎময়।’
পুর্ণির ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন শিবেন সরকার। ঘুরে তাকালেন।
বাবা- আপনার চা দিয়েছি।
ছেলের বউয়ের হাতের চা খুব ভালো হয়। তিনি নিয়ম ভেঙে যখন তখন চা চেয়ে বসেন শুধু ভালো- চা বানায় বলেই। ইদানীং নরেনের মাকে চা বানাতে বলেন। বৌমা পোয়াতি। সময়টা নিয়ম মেনে চলবার।
বাবা আসেন। আবারও ডাকল পুর্ণি। শিবেন সরকার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরমুখো হলেন। ভেতরে একটা জটিল প্রশ্ন মাথা তোলে। ‘স্ত্রীর স্েগ তারও মৃত্যু হলে পৃথিবীর কী ক্ষতি হতো?’
ঘরে গিয়ে স্ত্রীর ছবি দেখলেন। স্মৃতিরা আঁকুপাঁকু করে উঠল। ফোন করলেন সুমিতকে। সে ফোন ধরে বলল, জ্বি বাবা বলো-
আজ বিকেলে অফিস থেকে সরাসরি বাসায় চলে এস, শ্মশানে যাব।
জি বাবা রাখি- আমি চলে আসব। তুমি রেডি থেকো, পুর্ণি কী করে?
বিশ্রাম নিচ্ছে, ওর এখন বিশ্রামের সময়।
শ্মশানে শুধু আমরা দুজন যাব।
হ্যাঁ আমরা দুজন। নরেনের মা পুর্ণিকে নিয়ে বাসায় থাকবে।
এরপর নরেনকে সঙ্গে নিয়ে ফার্মেসিতে যাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন শিবেন সরকার। নরেনটাও বড় হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট থাকতে তার মা তাকে নিয়ে এল এই বাড়িতে। স্ত্রী বীনা সোম গ্রাম থেকে নরেনসহ নরেনের মাকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ‘এই মেয়েটা খুব দুঃখী। স্বামী বেচারা ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। বাচ্চাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছে মেয়েটা। গরিব মানুষ। মানুষের প্রতি মানুষই তো সদয় হবে, কী বলো?
সেদিন স্ত্রীর কথা কোনো আপত্তি করেননি শিবেন সরকার। মেনে নিয়েছিলেন। তাতে লাভই হয়েছে। নরেনের মায়ের হাতেই ছেলে সুমিতও বড় হয়েছে। ¯েœহ মমতার কমতি ছিল না কখনও। এখনও সুমিতের জন্য রাত জেগে প্রতীক্ষা করে। কে এতটা মায়া দেখায়? এই জগতে কে কার?
সরকার হোমিও হলের সামনে রোগীর ভিড় জমেছে। ঢাকা শহরে বিরোধী দলের অবরোধ দুদিন ধরে। তারপরও রোগী কমেনি। শিবেন সরকার ফার্মেসিতে বসেই রোগী দেখতে শুরু করলেন। ওষুধ এখন প্রেসক্রাইব দেখে নরেনই দিতে পারে। তাতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে শিবেন সরকারের।
তখন সন্ধ্যে ছটা, ছেলেকে ফোন করলেন শিবেন সরকার। সুমিত ফোন ধরে বলল, ‘বাবা অফিসের কাজের চাপ ছিল। এইমাত্র শেষ হলো। আজ না হয় শ্মশানে না যাই?
না, আজই যাব। রিপ্লাই করলেন শিবেন সরকার। স্ত্রীর কথা খুব করে মনে পড়ছে তার।
ছেলে বলল, ‘তাহলে তুমি ওয়েট কর, আই উইল ট্রাই টু এট বেস্ট আর্লি-
ওকে মাই সন-
ফোন রেখে ফার্মেসি বন্ধ করতে বললেন শিবেন সরকার। তারপর ফিরলেন ঘরে। যে ঘরে স্ত্রী নেই- আছে তার বেদনাকাতর স্মৃতি।
বাসার বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে আছেন শিবেন সরকার। মন ভীষণ খারাপ। নরেনের মা চা দিয়ে গেল। কাপ এগিয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘সুমিত মামা তো এহনতরী আইল না দাদা।’
নরেনের মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবেন সরকার বললেন, আজ নাকি অফিসে দেরি হয়েছে।
বৌমা যে বলল, ফোন নাকি বন্ধ।
চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রেখে ছেলেকে ফোন করলেন শিবেন সরকার। সত্যি সত্যিই ফোন বন্ধ। এই বিষয়টি খুবই খারাপ। বারে গেলে ফোন বন্ধ করে দেয় সে। নরেনের মায়ের দিকে তাকালেন সরকার। নরেনের মায়ের চোখ শ্রাবণের জলভরা মেঘের মতো। নিজের চোখের কোণেও বুঝি জল জমা হচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে গেলেন তিনি। দাঁড়ালেন গিয়ে বারান্দার দেয়াল ধরে। মেইন রোডে গাড়ির লাইটগুলো জোনাক জ্বলা রাতের আবেশেই বুঝি ছড়িয়েছিল চোখের সামনে।
নরসিংদীর এক অজপাড়া গাঁ থেকে পড়াশোনা করতে ঢাকায় আসা এবং পরবর্তীতে ঢাকাতেই থেকে যাওয়া শিবেন সরকারের। অতঃপর বিয়ে আর ঘর-সংসারের বেড়াজালে আটকে যাওয়া এই মানুষটার হৃদয়জুড়ে এখনও গ্রামের স্মৃতি ঘুরপাক খায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষ আর ছায়াময় পথঘাট আজও তাকে আবেশে ডেকে নিয়ে যায় শৈশব স্মৃতিতে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করেছেন শিবেন সরকার। মানুষের মনন গঠনে বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশ্বাস তার। বিশ্বাস ছিল ছেলেও তার মতোই গুণে আর বিদ্যায় বড় হবে। মানুষের কিছু স্বপ্ন মনে হয় পূরণ হয় না। কিংবা কোনো কোনো স্বপ্নের বিপরীতেও বুঝি জীবন চলে।
ছেলের মোবাইল ফোনে কতবার যে কল করেছেন শিবেন সরকার তার কোনো হিসাব নেই। ফলাফল একই। সুমিতের ফোন বন্ধ। ছেলের বউ কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। নরেনের মা কিছুক্ষণ পরপর বারান্দায় গিয়ে গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শিবেন সরকারও কান খাড়া রাখছেন। মন তার ভেজা। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে আজ আরও বেশি আবেগাপ্লুত এবং ভেঙে পড়েছেন তিনি। হতাশাও গ্রাস করছে তাকে। প্রতীক্ষার গ-িও যখন পেরোয় তখন মানুষ হতাশায় ভোগে। চোখ হয়ে পড়ে স্বপ্নহীন, আর মনও যায় ভেঙে।
রাত পৌনে দুটায় সুমিত বাসায় ফেরে। স্ত্রী ফ্ল্যাটের দরজা খুলেই দেখে, স্বামীর জামা-কাপড় সব ভেজা। আঁতকে ওঠে পুর্ণি। একি অবস্থা তোমার?
কথা বল না প্লিজ। চোখ জ্বালা করছিল। হাতির ঝিলে যেই হাতমুখ ধুতে নামলাম অমনি টুপপুস।
কী বলছ এসব, বাবা এদিকে আসুন, দেখুন আপনার ছেলের অবস্থা।
শিবেন সরকার তড়িঘড়ি করে এসে দেখে ছেলে অচেনা হয়ে গেছে। কিছু বুলে ওঠার আগেই সুমিত দুহাত জোড় করে বলে,- ‘মা কালির দিব্যি আর মদ খাব না বাবা। আজ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু খেয়েছি। মাত্র দুপেগ। পুর্ণি বাবাকে তুমি ডেকে আনলে কেন? আমার বাবা কি তোমার বাবার মতো জুচ্চোর?
চুপ, আর একটি কথাও বলবি না। সোজা ঘরে চলে যা। পুর্ণি ওকে নিয়ে যাও। পাজিটাকে কালই আমি শায়েস্তা করব। সে ভেবেছে কী? ধমকিয়ে বললেন শিবেন সরকার।
কিচ্ছু ভাবিনি বাবা। এখন থেকে ভাবব। ভুল হয়ে গেছে। আর ভুল হবে না। এই জীবনে আমি সুমিত আর কোনোদিন মদের গ্লাস হাতে নেব না- এই বলে রাখলাম।
জড়তা মুখে কথাগুলো বলল সুমিত। শিবেন সরকার মারতে উদ্যত হয়েও মারলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘প্রয়োজন হলে তোকে পুলিশে দেব। তোর মতো এমন কুলাঙ্গারের কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’
নরেনের মা শিবেন সরকারের সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল। আপনি ঘরে যান দাদা। ভগবান সব ঠিক করে দেবেন।
শিবেন সরকার এরপর বিড়বিড় করে কী যে বললেন তা আর বোঝা গেল না। এই প্রথম ছেলেকে তিনি তুই করে বলেছেন। স্ত্রীর মুখটা ভাসল তার মনে। বীনা বলেছিল, ‘ তোমার সন্তান মদখোর হবে কল্পনাও করিনি কোনোদিন। আমি মনে হয় পাপ করেছিলাম, আর আমারই পাপের ফসল এই সুমিত।’
এদিকে পুর্ণির সঙ্গে ঘরে ঢোকে কথা বাড়ায়নি সুমিত। বিছানায় দুই-পা জড়িয়ে ধরে বলেছে, অনেক দিনের অভ্যেস, বন্ধুদের টান- সব মিলিয়ে দু’পেগ খেয়েছি। আর খাব না বউ- বিশ্বাস কর পুর্ণি আমি আর মাল খাব না, মা কালির দিব্যি।
এরপর ডুকরে কেঁদে ওঠে পুর্ণি। স্বামীকে অনুনয় করে পা ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে কাপড়, জামা পাল্টিয়ে দেয়। আর ধপ করে বিছানায় পড়েই ঘুমিয়ে পড়ে সুমিত।
পরদিন সকালে যথারীতি সুমিত সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের আচরণ করে। বাবা আর স্ত্রীর কাছে কথা দেয় মদ খাবে না বলে। কিন্তু মদ খাওয়া ছাড়তে পারেনি। তাতে করে বাবা পুর্ণি আর নরেনের মা হতাশাগ্রস্ত হয়। ছেলেকে রিহ্যাব সেন্টারে দেবার ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেয় বাবা। কিন্তু নভেম্বরের ১১ তারিখ পুর্ণির বাচ্চা হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। বাচ্চার পজিশন খারাপ ছিল বলে ডাক্তার অপারেশন করতে বাধ্য হয়। সেই রাতেও মদ গিলে গভীর রাতে ফেরে সুমিত। দরজা খুলে দেয় নরেন। তার মা এবং সুমিতের বাবা ছিলেন সেই রাতে হাসপাতালে। সুমিত ঘরে ঢুকে বিছানায় পড়ে থাকে।
সুমিত সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির লোকজন তালাশ করলে নরেন সব ঘটনা খুলে বলে। সুমিত দ্রুত তৈরি হয়ে ছুটে যায় মনোয়ারা হসপিটালে। ওখানেই তার কন্যা সন্তান জন্মেছে।
সুমিত হসপিটালে পৌঁছে পৌনে দশটায়। পুর্ণি তখনও অবজারবেশন রুমে। নরেনের মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশু। হাসি দিয়ে সুমিত সন্তানের কাছে যায়। নরেনের মা মেয়েকে সুমিতের কোলে দেয়। সুমিত একদৃষ্টিতে মুগ্ধতা নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে নরেনের মা খুশি হয়। সুমিত বিড়বিড় করে বলে, ‘মায়ের মতোই সুন্দর হবে তাই না মাসি?’
রাজকইন্যা হইছে মামা আপনার ঘরে। দেখেন কেমুন সুন্দর চোখ। গায়ের রঙ কত সুন্দর। আনন্দঘন সেই মুহূর্তে শিবেন সরকার বাইরে থেকে এসে কেবিনে ঢুকেন। সুমিত বাবার দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ঢংয়ে হাসে। বাবার দিকে মেয়েকে এগিয়ে দেয়। বলে, ‘বাবা ওকে ধর। আমি অফিসে যাই। মিষ্টি খাওয়াতে হবে সেকশনের সবাইকে।’
সুমিত শিবেন সরকারের কোলে মেয়েকে তুলে দেয়। ফের হাত দিয়ে ছুঁতে যায় শিশুর শরীর। ঠিক তখনই মেয়ের হাতে বাবার হাত যায়। দৈবচক্রেই কি না কে বলবে, সুমিতের আঙ্গুল ধরে ফেলে সদ্যজাত শিশু।
সুমিত চমকে ওঠে। তার শরীরে জাগে শিহরন। মনে মনে ভাবে এটাই মনে হয় সন্তানের সাথে মানুষের সম্পর্ক। তার মন যেতে চায় না। মনটাকে ফেলেই যাই বলে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন সুমিত অফিসে মিষ্টি কিনে নিয়ে যায়। বিভাগের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। বিকেল পাঁচটা বাজতেই বেরোয় আবার অফিস থেকে। গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা হাসপাতালে চলে যায়। পুর্ণিকে তখন কেবিনে দেয়া হয়েছে। তার মাথার কাছে বসে সুমিত। বলে, তোমার মেয়ে- তোমার মতোই। শিবেন সরকার বাইরে থেকে চা খেয়ে ঢুকেন কেবিনে। সুমিতের আনন্দ দেখে তিনিও আনন্দিত হোন। মনে মনে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
সুমিত স্বাভাবিক হয়ে যায়। বাবাকে বলে বাবা কাল তো তোমরা ছিলে হাসপাতালে, আজ আমি থাকব।
শিবেন সরকার বলেন, ‘তোমার সীমা মাসিমা আসতেছে- রাতে থাকবে বলে।’
আসুক বাবা, আমিও থাকব। বিশ্বাস কর, আমি আর বারে যাব না।
শিবেন সরকার খুশি হোন। মানুষের জীবনে আনন্দের মুহূর্ত খুব বেশি থাকে না। নাতিনের জন্ম আর ছেলের মদ ছেড়ে ফিরে আসা তাকে অপার আনন্দ দিয়েছে। নরেনের মাকে নিয়ে বাসায় চলে যান তখন।
যে তিনদিন পুর্ণি হাসপাতালে ছিল সেই সময়টাতে সুমিতও ছিল সঙ্গে। দিনে অফিস করেছে, কিছুক্ষণ আর বাকি সময়টাতে মেয়েকে নিয়ে আনন্দে সময় কাটিয়েছে। তাতে সকলেই আনন্দিত হয়েছে। শিবেন সরকার সবচে বেশি খুশি হয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন। বাসায় আত্মীয়স্বজনদের ডেকে খাইয়েছেন। সুমিতের পরিবর্তনে নতুন এক জীবনই বুঝি ফিরে পেলেন শিবেন সরকার। মনে মনে বললেন, ‘এই সুখের জন্যেই তিনি বেঁচে ছিলেন।’
সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। নি¤œচাপ চলছিল। সমুদ্র উপকূলে দেয়া হয়েছিল, সাত নম্বর বিপদ সংকেত। সেই নিদানের রাতে সুমিত ছিল বাইরে। ফোন করে পাননি বাবা। সুস্থির মনটা অস্থির হয়ে পড়েছিল রাত বাড়ার সাথে সাথে। সুমিতের পুরোনো কয়েকজন বন্ধুকেও ফোন করলেন শিবেন সরকার। অফিস কলিগদের কাছ থেকে খবর পেলেন, সুমিত নাকি সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে।
তাহলে কোথায় সুমিত? শিবেন সরকার কী করবেন, কোথায় যাবেন?
ততক্ষণে বাতাস বেড়ে গেছে বাইরে। সমুদ্র উপকূলাঞ্চলের লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে ঝড়-তুফান।
রাত তখন চারটা পাঁচ। অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। শিবেন সরকার ফোন রিসিভ করলেন।
হ্যালো, কে বলছেন-? বললেন শিবেন সরকার।
আমি কি শিবেন সরকারের সঙ্গে কথা বলছি? অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো।
জ্বি বলছি।
আপনার ছেলে সুমিত এক্সিডেন্ট করেছে, আমি পুলিশের লোক।
বলেন কী?
হ্যাঁ।
এক্সিডেন্ট, কোথায় কীভাবে?
ড্রাগ অবস্থায় ড্রাইভ করছিল। বাংলা মোটর মোড়ে পিলারের সঙ্গে গাড়ি মেরে দিয়েছে।
বলেন কী! আমার ছেলে এখন কোথায়, কেমন আছে সে?
আপনার ছেলে ভালোই আছে, তবে গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এসেছি, আপনি আসুন।
শিবেন সরকারের মাথার ভেতরেই বুঝি বজ্রপাত হলো। কাউকে কিছু না বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। বিপদের সময় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শিবেন সরকার গিয়ে পৌছলেন সাড়ে চারটায়। ছুটে গেলেন ইমার্জেন্সিতে। ওখানেই একটা বেডে চলছিল চিকিৎসা।
শিবেন সরকার ছেলের কাছে গেলেন। মাথায় হাত দিলেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কেমন আছ বাবা?’
চোখ মেলে তাকাল সুমিত। সাপের মতোই পলকহীন দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে সে বলল, ‘সরি বাবা সরি।’
শিবেন সরকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার, নার্স এবং পুলিশের দুজন সদস্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। চোখের কোণেও দেখা দিল না এক বিন্দু জল।
তেমন সময়ে এমনই হয় বুঝি?
জামাল রেজা
বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪
রাত তখন আড়াইটা। ফ্ল্যাটে ঢুকেই ড্রয়িংরুমের সোফায় ধপ করে বসে পড়ে সুমিত। সে মদ্যপ। বাবা শিবেন সরকার ছেলের পাশে গিয়ে বসেন। ছেলের ভাবমূর্তি খেয়াল করেন। পাশেই ছেলের বউ পুর্ণি দাঁড়িয়ে আছে ড্যাব ড্যাব চোখে। কারও মুখে রা নেই। নীরবতা ভাঙ্গে সুমিত।
বাবা আমার মা মরল ক্যান?
হায়াত ছিল না। বললেন শিবেন সরকার।
কীভাবে মরল?
স্ট্রোক করে।
না, আমার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। আমি নেশা করি, মা নিষেধ করে। তার নিষেধ আমি মানি নি। ক্ষোভে, দুঃখে মা আমার...
এরপর কথা থেমে যায় সুমিত সরকারের। সে বাবা এবং স্ত্রীর দিকে ড্যাবড্যাব চোখে তাকায়।
তুমি ঘরে চল, বলে পুর্র্ণি সুমিতের স্ত্রী। তার কণ্ঠ ভেজা।
আমি ঘরে যাব না। ঘর থেকে ডায়েরি নিয়ে এস।
তুমি এখন ঘরে যাও। ঘুমাও গিয়ে। বললেন শিবেন সরকার।
হেলিয়ে পড়া সুমিত মাথা সোজা করে চোখ টেনে তাকায়। স্ত্রীকে ধমক দিয়ে বলে- যাও ডায়েরি নিয়ে এস। বাবার সঙ্গে আজ আমার চুক্তি লিখন হবে।
শ্বশুরের ইশারা পেয়ে পুর্র্ণি বেডরুম থেকে ডায়েরি এনে সুমিতের হাতে দেয়। পকেট থেকে কলম বের করে গজ গজ করে ডায়েরিতে লিখতে থাকে। অন্যদিকে বাবা ছেলে এবং ছেলের বউয়ের দিকে তাকায়। নেশার ঘোরে ছেলে যে বুঁদ হয়ে আছে তা বুঝতে পারেন শিবেন সরকার। তিনি বাংলাদেশ হোমিওপ্যাথিক মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের প্রিন্সিপাল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন সতেরো বছর। গত ফেব্রুয়ারিতে অবসর নিয়েছেন। মহল্লায় সরকার হোমিও নামের একটি ফার্মেসিতে বসেন। এখন সকাল বিকেল দুইবেলা বসেন। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটলেও সরকার হোমিও হলের রোগীর ভিড় চোখে পড়ার মতো। গুলশান এক নম্বরের পুব দিকে লেকের পাড়ে গুদারাঘাটে এই হোমিও ফার্মিসিতে ঢাকার বাইরে থেকেও রোগী আসে। শিবেন সরকার নাড়ি টিপে চিকিৎসাপত্র দেন। মানুষের রোগ নিরাময় হয়।
সুমিত লিখে ডায়েরির পৃষ্ঠা ভরে ফেলেছে। এবার বাবার দিকে এগিয়ে ধরে। বলে, বাবা কি লিখেছি পড়।
তুমি ঘুমাও গিয়ে রাত অনেক হয়েছে। বলেন বাবা।
আর অনেক রাত হবে না। সেই কথাই ডায়েরিতে লিখেছি, পড়, দেখ।
তুমিই পড় তাহলে-
বাবার হাত থেকে ডায়েরি নিয়ে সুমিত বুজে আসা চোখ খোলে পড়তে শুরু করে।
চুক্তি লিখন। বাবা এই লেখাটার নাম চুক্তি লিখন।
এরপর শিবেন সরকারের দিকে তাকায় সুমিত। বাবা পড়তে ইশারা করেন। সুমিত আবার পড়তে শুরু করে। আমি এই মর্মে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছি যে, আজকের পর থেকে আর কোনোদিন রাতে বাইরে থাকিব না- অর্থাৎ দশটার মধ্যে অবশ্যই বাসায় ফিরিব। কোনো অবস্থায়ই মদ্যপান করিব না। সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করিব। এরপর বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইব।
ঠিক আছে আর পড়তে হবে না। তুমি ভুল পথ থেকে শুদ্ধতার দিকে ফিরে এস- সেটাই আমার প্রত্যাশা। তুমি আমার একমাত্র সন্তান। অবলম্বন।
অনেক আদরের বাবা, অনেক আদরের সন্তান আমি। ছোটবেলা থেকে আমার কোনো ইচ্ছা তুমি অপূরণীয় ধ্যাৎ অপূর্ণ রাখোনি। আমি তোমাকে শুধুই কষ্ট দিয়েছি। আমার মা আমারই দুঃখে হু হু হু ... মরে গেছে।
এরপর সুমিত হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। বাবা উঠে ছেলের মাথায় হাত দিয়ে আদর করতে করতে বলেন, ‘যাও বাবা- ঘুমাও গিয়ে। ভগবান তোমার সুমতি দিক। আমি আর কিছুই চাই না। আমি শুধু তোমার সুস্থ ও সুন্দর জীবন চাই।
কিছুটা জোর করে ধরেই বসা থেকে ছেলেকে উঠিয়ে ঘরে পৌঁছে দেন শিবেন সরকার। সুমিত পা টেনে টেনে হাঁটছিল। বাবার চোখ জল ভাঙল তখন।
ছেলেকে ঘরে দিয়ে এসে সোফায় বসলেন শিবেন সরকার। অতীত ভাবনায় মন ডুবল তার। কী সুন্দর ছিমছাম ছোট্ট সংসার ছিল। সেই সংসারে সুমিতের জন্মটাকে ভগবানের আশীর্বাদ মনে করেছিলেন তিনি। আদর ¯েœহ আর সুশিক্ষা দিয়েই বড় করে তুলেছিলেন ছেলেকে। কিন্তু কে জানত ছাত্রজীবনেই সে মদের গ্লাস তুলে নেবে হাতে?
পড়াশোনায় বরাবরই ভালো ছিল সুমিত। রেজাল্টও ভালো। বিবিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়েও দিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকে ইন্টারভ্যু দিয়ে ঢুকে গেল জবে। অফিসে তার অনেক সুনাম। সকাল নটা মানে নটাতেই অফিসে ঢোকে। একটানা কাজ করে। ব্যাংকের এডি ইফতেখার মুনিম সুমিতের কাজ নিয়ে খুবই খুশি। শিবেন সরকারের সঙ্গেই সেই আলোচনা করেছেন। বলেছেন, ‘সুমিতের মতো এমন কর্মঠ আর বিচক্ষণ কর্মকর্তা কর্মচারীর সংখ্যা ব্যাংকে বাড়লে আমাদের ব্যাংকিং খাত খুব দ্রুতই উন্নত হবে।
সেদিন ছেলের প্রশংসা শুনে বাবা হিসেবে খুবই গর্ববোধ করেছিলেন প্রিন্সিপাল শিবেন সরকার। ভেবেছিলেন, ‘বিসিএস না দিলেও ক্ষতি নেই। ব্যাংকেই নিজের উন্নতি ঘটাতে পারবে। কিন্তু ছেলের অমনোযোগিতার খবর তিনি পান আরও পরে। স্ত্রী বীনা সোম অপারগ হয়ে জানান যে, তার ছেলে প্রতিরাতেই মদ খেয়ে বাসায় ফেরে।
স্ত্রীর কথা শুনে শিবেন সরকার হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সময় না নিয়ে দ্রুতই ছেলের সাথে আলোচনায় বসেন। এক পর্যায়ে ছেলে স্বীকার করে নেয় মায়ের অভিযোগের সত্যতা। তবে প্রতিশ্রুতি দেয় যে, মদ ছেড়ে দেবে সে।
অবশ্য মদ্যপান ছাড়েনি ছেলে। নিয়ম করে প্রতিরাতেই মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফেরে। মানসিক ডাক্তারের শরণাপন্ন হোন শিবেন সরকার। ছেলেকে কাউন্সিলিং করান। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। শ্যালিকা সীমা সোম পেশায় চিকিৎসক। তার পরামর্শে ছেলেকে তড়িঘড়ি করে বিয়ে করান। নিকট আত্মীয়স্বজনের অনেকেই বিয়ে করাবার পরামর্শ দিয়েছে। সেইসব পরামর্শ শিবেন সরকার মেনে নিয়েই বিয়ে করালেন পুর্র্ণি নামের এই লক্ষ্মী মেয়েটিকে। কিন্তু কাজে এল না। সুমিত মদ ছাড়েনি। আগের মতোই নিয়ম করে প্রতিরাতে মদ্যপ অবস্থায় বাসায় ফেরে সে।
পরদিন সকাল সাড়ে আটটায় পিতার শোবার রুমে যায় সুমিত। বাবা কি ঘুমিয়ে আছ- বাবা-
চট করেই শোয়া থেকে উঠে বসেন শিবেন সরকার। ক্যান কী হয়েছে বাবা?
না, কিছু না। বাবা আজ থেকে ওসব ছাইপাশ আর খাব না আমি পণ করেছি।
ভেরি গুড। অফিস যাচ্ছ?
মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ জানায় সুমিত।
কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে সে। ছেলের ভাবমূর্তি লক্ষ করলেন বাবা। কিছু বলবে?
বাবা আমার হাত ফাঁকা- কিছু টাকা দিতে পারবে?
অবশ্যই, কত লাগবে?
দু’তিন হাজার হলেই চলবে-
তারপর আর কথা বললেন না-
শিবেন সরকার পকেট থেকে চারটি পাঁচশ টাকার নোট ছেলের দিকে এগিয়ে ধরে বলেন, ‘টাকা নাও, তবে কথা রেখ। বাজে খরচ কর না। তোমাকে বিয়ে দিলাম। ঘরে এল জোছনার আলো নিয়ে পুর্র্ণি। এবার সেই ঘরে আগমন ঘটতে যাচ্ছে তোমাদের সন্তানের। ভগবানের কৃপায় তুমি বাবা হচ্ছো। এবার দেখ জীবনের আরেক আনন্দ।
আসি বাবা-
যাও, ভগবান তোমার মঙ্গল করুন।
স্বামীকে বিদায় করে শ্বশুরের বেডরুমে যায় পুর্ণি। ছেলের বউয়ের দিকে তাকান শিবেন সরকার। পুর্ণি উচ্ছ্বাস ভেজানো কণ্ঠে বলে, ‘বাবা আপনার ছেলে আজ থেকে আর নেশা করবে না।’
শিবেন সরকার কিছু বললেন না। তাকিয়ে থাকলেন পুর্ণির দিকে। পুর্ণিই আবার কথা তুলে আনলো মুখে, অন্যদিনের প্রতিশ্রুতি আর আজকের মধ্যে পার্থক্য আছে বাবা।
তাই যেন হয়। জানো মা এই ছেলেটা আমাদের কোলে আসার পর থেকে-
কথা আর বাড়াতে পারলেন না শিবেন সরকার। কণ্ঠ ধরে এল। দুচোখ বেয়েও অশ্রু গড়াল। মানুষ সুখে এবং দুঃখে কাঁদে। প্রিন্সিপাল শিবেন সরকার সুখে নাকি দুঃখে কাঁদলেন তা অনুমান করতে পারল না পুর্ণি। বেশিক্ষণ দাঁড়াল না বউটি। চলে গেল শ্বশুরের বেডরুম থেকে। শ্বশুর ছেলের বউয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। ভাবলেন তার তৃতীয় প্রজন্ম আগমনের কথা।
শিবেন সরকার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালেন। মেইন রোডে গাড়ির ভিড় জমে গেছে। হর্ন বাজার শব্দ হচ্ছে একনাগাড়ে। তার চোখ গেল নিচতলায় বাড়ির পূর্ব দক্ষিণের কোণে তুলসী গাছটার দিকে। স্ত্রী বীনা সোমের শাখাপরা হাতে পূজা দেবার ভঙ্গিটি মনে পড়ে তার। এই বাড়িটাকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জড়িয়ে আছে। বত্রিশ বছর আগে স্বল্পমূল্যে পৌনে দুই কাঠার একতলা বাড়িটি কিনেছিলেন তিনি। তারপর স্ত্রী বীনা সোম তাগিদ দিয়ে দোতলার তিনটি রুমের একটি ফ্ল্যাট করান। বা দিকটায় ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে আজও। স্ত্রীর লাগানো নিম গাছটার চিরল পাতায় রোদ পড়েছে। চিকচিক করছে নিম পাতাগুলো। স্মৃতিগুলোও ভেতরে তেমনই জ্বলজ্বল। কোনোকিছুই ভুলবার নয়। প্রেম ভালোবাসার এক মায়াময় বন্ধন ছিল স্ত্রীর সঙ্গে। দুজনই চেয়েছিলেন মৃত্যু যেন একসাথে হয়। পরমেশ্বর ভগবান তা করেননি। জোড়-ভাঙ্গা পাখির মতোই শিবেন সরকার শুকনো ডালে বসে প্রতীক্ষায় পথ চেয়ে অতীত স্মৃতির জাবর কাটছেন। স্মৃতির পিরামিড তাকে নিয়ে গেল পেছনে। ছেলেকে বিয়ে করিয়ে বউ নিয়ে ঘরে ফেরার পর স্ত্রী বলেছিল, ‘আমাদের দুঃখের দিন শেষ। এখন আমরা চল ঘুরে বেড়াই জগৎময়।’
পুর্ণির ডাকে সম্বিত ফিরে পেলেন শিবেন সরকার। ঘুরে তাকালেন।
বাবা- আপনার চা দিয়েছি।
ছেলের বউয়ের হাতের চা খুব ভালো হয়। তিনি নিয়ম ভেঙে যখন তখন চা চেয়ে বসেন শুধু ভালো- চা বানায় বলেই। ইদানীং নরেনের মাকে চা বানাতে বলেন। বৌমা পোয়াতি। সময়টা নিয়ম মেনে চলবার।
বাবা আসেন। আবারও ডাকল পুর্ণি। শিবেন সরকার একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরমুখো হলেন। ভেতরে একটা জটিল প্রশ্ন মাথা তোলে। ‘স্ত্রীর স্েগ তারও মৃত্যু হলে পৃথিবীর কী ক্ষতি হতো?’
ঘরে গিয়ে স্ত্রীর ছবি দেখলেন। স্মৃতিরা আঁকুপাঁকু করে উঠল। ফোন করলেন সুমিতকে। সে ফোন ধরে বলল, জ্বি বাবা বলো-
আজ বিকেলে অফিস থেকে সরাসরি বাসায় চলে এস, শ্মশানে যাব।
জি বাবা রাখি- আমি চলে আসব। তুমি রেডি থেকো, পুর্ণি কী করে?
বিশ্রাম নিচ্ছে, ওর এখন বিশ্রামের সময়।
শ্মশানে শুধু আমরা দুজন যাব।
হ্যাঁ আমরা দুজন। নরেনের মা পুর্ণিকে নিয়ে বাসায় থাকবে।
এরপর নরেনকে সঙ্গে নিয়ে ফার্মেসিতে যাবার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন শিবেন সরকার। নরেনটাও বড় হয়ে গেছে। সেই ছোট্ট থাকতে তার মা তাকে নিয়ে এল এই বাড়িতে। স্ত্রী বীনা সোম গ্রাম থেকে নরেনসহ নরেনের মাকে নিয়ে এসেছিল। বলেছিল, ‘এই মেয়েটা খুব দুঃখী। স্বামী বেচারা ইন্ডিয়া বেড়াতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। বাচ্চাটা নিয়ে বিপাকে পড়েছে মেয়েটা। গরিব মানুষ। মানুষের প্রতি মানুষই তো সদয় হবে, কী বলো?
সেদিন স্ত্রীর কথা কোনো আপত্তি করেননি শিবেন সরকার। মেনে নিয়েছিলেন। তাতে লাভই হয়েছে। নরেনের মায়ের হাতেই ছেলে সুমিতও বড় হয়েছে। ¯েœহ মমতার কমতি ছিল না কখনও। এখনও সুমিতের জন্য রাত জেগে প্রতীক্ষা করে। কে এতটা মায়া দেখায়? এই জগতে কে কার?
সরকার হোমিও হলের সামনে রোগীর ভিড় জমেছে। ঢাকা শহরে বিরোধী দলের অবরোধ দুদিন ধরে। তারপরও রোগী কমেনি। শিবেন সরকার ফার্মেসিতে বসেই রোগী দেখতে শুরু করলেন। ওষুধ এখন প্রেসক্রাইব দেখে নরেনই দিতে পারে। তাতে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে শিবেন সরকারের।
তখন সন্ধ্যে ছটা, ছেলেকে ফোন করলেন শিবেন সরকার। সুমিত ফোন ধরে বলল, ‘বাবা অফিসের কাজের চাপ ছিল। এইমাত্র শেষ হলো। আজ না হয় শ্মশানে না যাই?
না, আজই যাব। রিপ্লাই করলেন শিবেন সরকার। স্ত্রীর কথা খুব করে মনে পড়ছে তার।
ছেলে বলল, ‘তাহলে তুমি ওয়েট কর, আই উইল ট্রাই টু এট বেস্ট আর্লি-
ওকে মাই সন-
ফোন রেখে ফার্মেসি বন্ধ করতে বললেন শিবেন সরকার। তারপর ফিরলেন ঘরে। যে ঘরে স্ত্রী নেই- আছে তার বেদনাকাতর স্মৃতি।
বাসার বারান্দায় পেতে রাখা বেতের চেয়ারে বসে আছেন শিবেন সরকার। মন ভীষণ খারাপ। নরেনের মা চা দিয়ে গেল। কাপ এগিয়ে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘সুমিত মামা তো এহনতরী আইল না দাদা।’
নরেনের মায়ের হাত থেকে চায়ের কাপ নিতে নিতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শিবেন সরকার বললেন, আজ নাকি অফিসে দেরি হয়েছে।
বৌমা যে বলল, ফোন নাকি বন্ধ।
চায়ে চুমুক দিয়ে কাপ নামিয়ে রেখে ছেলেকে ফোন করলেন শিবেন সরকার। সত্যি সত্যিই ফোন বন্ধ। এই বিষয়টি খুবই খারাপ। বারে গেলে ফোন বন্ধ করে দেয় সে। নরেনের মায়ের দিকে তাকালেন সরকার। নরেনের মায়ের চোখ শ্রাবণের জলভরা মেঘের মতো। নিজের চোখের কোণেও বুঝি জল জমা হচ্ছিল। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উঠে গেলেন তিনি। দাঁড়ালেন গিয়ে বারান্দার দেয়াল ধরে। মেইন রোডে গাড়ির লাইটগুলো জোনাক জ্বলা রাতের আবেশেই বুঝি ছড়িয়েছিল চোখের সামনে।
নরসিংদীর এক অজপাড়া গাঁ থেকে পড়াশোনা করতে ঢাকায় আসা এবং পরবর্তীতে ঢাকাতেই থেকে যাওয়া শিবেন সরকারের। অতঃপর বিয়ে আর ঘর-সংসারের বেড়াজালে আটকে যাওয়া এই মানুষটার হৃদয়জুড়ে এখনও গ্রামের স্মৃতি ঘুরপাক খায়। গ্রামের সহজ সরল মানুষ আর ছায়াময় পথঘাট আজও তাকে আবেশে ডেকে নিয়ে যায় শৈশব স্মৃতিতে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরেও প্রচুর পড়াশোনা করেছেন শিবেন সরকার। মানুষের মনন গঠনে বই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বলে বিশ্বাস তার। বিশ্বাস ছিল ছেলেও তার মতোই গুণে আর বিদ্যায় বড় হবে। মানুষের কিছু স্বপ্ন মনে হয় পূরণ হয় না। কিংবা কোনো কোনো স্বপ্নের বিপরীতেও বুঝি জীবন চলে।
ছেলের মোবাইল ফোনে কতবার যে কল করেছেন শিবেন সরকার তার কোনো হিসাব নেই। ফলাফল একই। সুমিতের ফোন বন্ধ। ছেলের বউ কান্নাকাটি করে চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে এরই মধ্যে। নরেনের মা কিছুক্ষণ পরপর বারান্দায় গিয়ে গেটের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকে। শিবেন সরকারও কান খাড়া রাখছেন। মন তার ভেজা। স্মৃতির অতলে ডুব দিয়ে আজ আরও বেশি আবেগাপ্লুত এবং ভেঙে পড়েছেন তিনি। হতাশাও গ্রাস করছে তাকে। প্রতীক্ষার গ-িও যখন পেরোয় তখন মানুষ হতাশায় ভোগে। চোখ হয়ে পড়ে স্বপ্নহীন, আর মনও যায় ভেঙে।
রাত পৌনে দুটায় সুমিত বাসায় ফেরে। স্ত্রী ফ্ল্যাটের দরজা খুলেই দেখে, স্বামীর জামা-কাপড় সব ভেজা। আঁতকে ওঠে পুর্ণি। একি অবস্থা তোমার?
কথা বল না প্লিজ। চোখ জ্বালা করছিল। হাতির ঝিলে যেই হাতমুখ ধুতে নামলাম অমনি টুপপুস।
কী বলছ এসব, বাবা এদিকে আসুন, দেখুন আপনার ছেলের অবস্থা।
শিবেন সরকার তড়িঘড়ি করে এসে দেখে ছেলে অচেনা হয়ে গেছে। কিছু বুলে ওঠার আগেই সুমিত দুহাত জোড় করে বলে,- ‘মা কালির দিব্যি আর মদ খাব না বাবা। আজ বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে একটু খেয়েছি। মাত্র দুপেগ। পুর্ণি বাবাকে তুমি ডেকে আনলে কেন? আমার বাবা কি তোমার বাবার মতো জুচ্চোর?
চুপ, আর একটি কথাও বলবি না। সোজা ঘরে চলে যা। পুর্ণি ওকে নিয়ে যাও। পাজিটাকে কালই আমি শায়েস্তা করব। সে ভেবেছে কী? ধমকিয়ে বললেন শিবেন সরকার।
কিচ্ছু ভাবিনি বাবা। এখন থেকে ভাবব। ভুল হয়ে গেছে। আর ভুল হবে না। এই জীবনে আমি সুমিত আর কোনোদিন মদের গ্লাস হাতে নেব না- এই বলে রাখলাম।
জড়তা মুখে কথাগুলো বলল সুমিত। শিবেন সরকার মারতে উদ্যত হয়েও মারলেন না। দাঁতে দাঁত চেপে চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘প্রয়োজন হলে তোকে পুলিশে দেব। তোর মতো এমন কুলাঙ্গারের কোনো প্রয়োজন নেই আমার।’
নরেনের মা শিবেন সরকারের সামনে এসে হাতজোড় করে দাঁড়াল। আপনি ঘরে যান দাদা। ভগবান সব ঠিক করে দেবেন।
শিবেন সরকার এরপর বিড়বিড় করে কী যে বললেন তা আর বোঝা গেল না। এই প্রথম ছেলেকে তিনি তুই করে বলেছেন। স্ত্রীর মুখটা ভাসল তার মনে। বীনা বলেছিল, ‘ তোমার সন্তান মদখোর হবে কল্পনাও করিনি কোনোদিন। আমি মনে হয় পাপ করেছিলাম, আর আমারই পাপের ফসল এই সুমিত।’
এদিকে পুর্ণির সঙ্গে ঘরে ঢোকে কথা বাড়ায়নি সুমিত। বিছানায় দুই-পা জড়িয়ে ধরে বলেছে, অনেক দিনের অভ্যেস, বন্ধুদের টান- সব মিলিয়ে দু’পেগ খেয়েছি। আর খাব না বউ- বিশ্বাস কর পুর্ণি আমি আর মাল খাব না, মা কালির দিব্যি।
এরপর ডুকরে কেঁদে ওঠে পুর্ণি। স্বামীকে অনুনয় করে পা ছাড়িয়ে বাথরুমে ঢুকিয়ে কাপড়, জামা পাল্টিয়ে দেয়। আর ধপ করে বিছানায় পড়েই ঘুমিয়ে পড়ে সুমিত।
পরদিন সকালে যথারীতি সুমিত সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষের আচরণ করে। বাবা আর স্ত্রীর কাছে কথা দেয় মদ খাবে না বলে। কিন্তু মদ খাওয়া ছাড়তে পারেনি। তাতে করে বাবা পুর্ণি আর নরেনের মা হতাশাগ্রস্ত হয়। ছেলেকে রিহ্যাব সেন্টারে দেবার ভেতরে ভেতরে প্রস্তুতি নেয় বাবা। কিন্তু নভেম্বরের ১১ তারিখ পুর্ণির বাচ্চা হয় সিজারিয়ানের মাধ্যমে। বাচ্চার পজিশন খারাপ ছিল বলে ডাক্তার অপারেশন করতে বাধ্য হয়। সেই রাতেও মদ গিলে গভীর রাতে ফেরে সুমিত। দরজা খুলে দেয় নরেন। তার মা এবং সুমিতের বাবা ছিলেন সেই রাতে হাসপাতালে। সুমিত ঘরে ঢুকে বিছানায় পড়ে থাকে।
সুমিত সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির লোকজন তালাশ করলে নরেন সব ঘটনা খুলে বলে। সুমিত দ্রুত তৈরি হয়ে ছুটে যায় মনোয়ারা হসপিটালে। ওখানেই তার কন্যা সন্তান জন্মেছে।
সুমিত হসপিটালে পৌঁছে পৌনে দশটায়। পুর্ণি তখনও অবজারবেশন রুমে। নরেনের মায়ের কোলে সদ্যজাত শিশু। হাসি দিয়ে সুমিত সন্তানের কাছে যায়। নরেনের মা মেয়েকে সুমিতের কোলে দেয়। সুমিত একদৃষ্টিতে মুগ্ধতা নিয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তা দেখে নরেনের মা খুশি হয়। সুমিত বিড়বিড় করে বলে, ‘মায়ের মতোই সুন্দর হবে তাই না মাসি?’
রাজকইন্যা হইছে মামা আপনার ঘরে। দেখেন কেমুন সুন্দর চোখ। গায়ের রঙ কত সুন্দর। আনন্দঘন সেই মুহূর্তে শিবেন সরকার বাইরে থেকে এসে কেবিনে ঢুকেন। সুমিত বাবার দিকে তাকিয়ে অপূর্ব ঢংয়ে হাসে। বাবার দিকে মেয়েকে এগিয়ে দেয়। বলে, ‘বাবা ওকে ধর। আমি অফিসে যাই। মিষ্টি খাওয়াতে হবে সেকশনের সবাইকে।’
সুমিত শিবেন সরকারের কোলে মেয়েকে তুলে দেয়। ফের হাত দিয়ে ছুঁতে যায় শিশুর শরীর। ঠিক তখনই মেয়ের হাতে বাবার হাত যায়। দৈবচক্রেই কি না কে বলবে, সুমিতের আঙ্গুল ধরে ফেলে সদ্যজাত শিশু।
সুমিত চমকে ওঠে। তার শরীরে জাগে শিহরন। মনে মনে ভাবে এটাই মনে হয় সন্তানের সাথে মানুষের সম্পর্ক। তার মন যেতে চায় না। মনটাকে ফেলেই যাই বলে বেরিয়ে পড়ে। সেদিন সুমিত অফিসে মিষ্টি কিনে নিয়ে যায়। বিভাগের সবাইকে মিষ্টি খাওয়ায়। বিকেল পাঁচটা বাজতেই বেরোয় আবার অফিস থেকে। গাড়ি ড্রাইভ করে সোজা হাসপাতালে চলে যায়। পুর্ণিকে তখন কেবিনে দেয়া হয়েছে। তার মাথার কাছে বসে সুমিত। বলে, তোমার মেয়ে- তোমার মতোই। শিবেন সরকার বাইরে থেকে চা খেয়ে ঢুকেন কেবিনে। সুমিতের আনন্দ দেখে তিনিও আনন্দিত হোন। মনে মনে ভগবানকে কৃতজ্ঞতা জানান তিনি।
সুমিত স্বাভাবিক হয়ে যায়। বাবাকে বলে বাবা কাল তো তোমরা ছিলে হাসপাতালে, আজ আমি থাকব।
শিবেন সরকার বলেন, ‘তোমার সীমা মাসিমা আসতেছে- রাতে থাকবে বলে।’
আসুক বাবা, আমিও থাকব। বিশ্বাস কর, আমি আর বারে যাব না।
শিবেন সরকার খুশি হোন। মানুষের জীবনে আনন্দের মুহূর্ত খুব বেশি থাকে না। নাতিনের জন্ম আর ছেলের মদ ছেড়ে ফিরে আসা তাকে অপার আনন্দ দিয়েছে। নরেনের মাকে নিয়ে বাসায় চলে যান তখন।
যে তিনদিন পুর্ণি হাসপাতালে ছিল সেই সময়টাতে সুমিতও ছিল সঙ্গে। দিনে অফিস করেছে, কিছুক্ষণ আর বাকি সময়টাতে মেয়েকে নিয়ে আনন্দে সময় কাটিয়েছে। তাতে সকলেই আনন্দিত হয়েছে। শিবেন সরকার সবচে বেশি খুশি হয়েছেন। ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে গেছেন। বাসায় আত্মীয়স্বজনদের ডেকে খাইয়েছেন। সুমিতের পরিবর্তনে নতুন এক জীবনই বুঝি ফিরে পেলেন শিবেন সরকার। মনে মনে বললেন, ‘এই সুখের জন্যেই তিনি বেঁচে ছিলেন।’
সেদিন আকাশে মেঘ ছিল। নি¤œচাপ চলছিল। সমুদ্র উপকূলে দেয়া হয়েছিল, সাত নম্বর বিপদ সংকেত। সেই নিদানের রাতে সুমিত ছিল বাইরে। ফোন করে পাননি বাবা। সুস্থির মনটা অস্থির হয়ে পড়েছিল রাত বাড়ার সাথে সাথে। সুমিতের পুরোনো কয়েকজন বন্ধুকেও ফোন করলেন শিবেন সরকার। অফিস কলিগদের কাছ থেকে খবর পেলেন, সুমিত নাকি সন্ধ্যে সাড়ে ছটায় অফিস থেকে বেরিয়ে গেছে।
তাহলে কোথায় সুমিত? শিবেন সরকার কী করবেন, কোথায় যাবেন?
ততক্ষণে বাতাস বেড়ে গেছে বাইরে। সমুদ্র উপকূলাঞ্চলের লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। শুরু হয়ে গেছে ঝড়-তুফান।
রাত তখন চারটা পাঁচ। অচেনা নম্বর থেকে ফোন এল। শিবেন সরকার ফোন রিসিভ করলেন।
হ্যালো, কে বলছেন-? বললেন শিবেন সরকার।
আমি কি শিবেন সরকারের সঙ্গে কথা বলছি? অপরপ্রান্ত থেকে বলা হলো।
জ্বি বলছি।
আপনার ছেলে সুমিত এক্সিডেন্ট করেছে, আমি পুলিশের লোক।
বলেন কী?
হ্যাঁ।
এক্সিডেন্ট, কোথায় কীভাবে?
ড্রাগ অবস্থায় ড্রাইভ করছিল। বাংলা মোটর মোড়ে পিলারের সঙ্গে গাড়ি মেরে দিয়েছে।
বলেন কী! আমার ছেলে এখন কোথায়, কেমন আছে সে?
আপনার ছেলে ভালোই আছে, তবে গাড়ির ক্ষতি হয়েছে। আমরা তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এসেছি, আপনি আসুন।
শিবেন সরকারের মাথার ভেতরেই বুঝি বজ্রপাত হলো। কাউকে কিছু না বলে তিনি বেরিয়ে গেলেন। বিপদের সময় হিতাহিত জ্ঞান লোপ পায়।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে শিবেন সরকার গিয়ে পৌছলেন সাড়ে চারটায়। ছুটে গেলেন ইমার্জেন্সিতে। ওখানেই একটা বেডে চলছিল চিকিৎসা।
শিবেন সরকার ছেলের কাছে গেলেন। মাথায় হাত দিলেন এবং প্রশ্ন করলেন, ‘এখন কেমন আছ বাবা?’
চোখ মেলে তাকাল সুমিত। সাপের মতোই পলকহীন দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে থেকে অস্ফুটে সে বলল, ‘সরি বাবা সরি।’
শিবেন সরকার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার, নার্স এবং পুলিশের দুজন সদস্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তার মুখ থেকে কোনো কথা বের হলো না। চোখের কোণেও দেখা দিল না এক বিন্দু জল।
তেমন সময়ে এমনই হয় বুঝি?