alt

সাময়িকী

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ওবায়েদ আকাশ

: বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (১৯২৭-২০১৪)

একার জগত থেকে সমগ্র বিশ্বকে অতীব সূক্ষ্ম ও নিপুণভাবে দেখবার ও দেখাবার ক্ষমতা যার সর্বাধিক তিনি লেখক। যিনি তাঁর স্ব-সময়ে বসে অতীত ও ভবিষ্যৎকেও চেনাবার ক্ষমতাবান, তিনি সময়ের ভাষ্যকার লেখক কবি বা কথাকার। অথচ তিনি একা ও নিঃসঙ্গ সর্বদা। বিশ ও একুশ শতকের আধুনিক ও আধুনিক-উত্তর কালে যে অনুষঙ্গটি সচেতন লেখক সমাজকে সবচে’ বেশি আবিষ্ট করেছে, সেটি নিঃসঙ্গতা। গত শতাব্দির তিরিশের দশকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এবং পরবর্তী পুরো শতকজুড়ে লেখক সমাজ তথা সমাজের সচেতন অংশ এই নিঃসঙ্গতা বোধকে শনাক্ত করেছে; যা থেকে জন্ম নিয়েছে ব্যক্তি থেকে সমগ্রের জীবনে একাকিত্বের হাহাকার, বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা থেকে শুরু করে তলশূন্য জীবনের উঁচু-নিচু পারম্পর্যহীনতার মতো অসামঞ্জস জীবনবোধের অমসৃণ সড়ক। বিশ শতক জুড়েই মানুষের ভেতর নিঃসঙ্গপ্রিয়তা কিংবা অবধারিত নিঃসঙ্গতা সাধারণ থেকে লেখক সমাজের জীবনাধ্যায়কে ভীষণ তাড়িয়েছে- যা এখন আরও সোনালি-ধূসর মোড়কে নানান বাস্তবতায়, ভিন্ন খোলসে সমাজ-মানসলোকে আসন পেতেছে। এই নিঃসঙ্গতাকে, তার উৎকৃষ্ট প্রকারকে ভাষ্যরূপ দিয়ে আমাদের মনের নিভৃত ও সদর আসনে অবস্থান নিয়েছেন বিশ শতকের অপ্রতিদ্বন্দ্বি কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মার্কেজ শুধু আমদের নিঃসঙ্গতার গল্প শোনাননি, নিপীড়িত শোষিত মানুষের চরম দারিদ্র্য, নারীর জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের কাছে সর্বস্ব বিকিয়ে আত্মসমর্পণ, নর-নারীর প্রেম, পুরুষের বহুগামিতা, বিশ্বসংস্কৃতিতে মানব সমাজের সঠিক অবস্থান তুলে ধরার সার্থক ভাষ্যকার তিনি।

মার্কেজ শুধু বিশ শতকের নন, তারও বহু বহু কাল অতীতের অব্যর্থ গল্প শোনানোর কুশলি জাদুকর। কখনো শতবর্ষ কখনো সহ¯্র-লক্ষ বছর অতীতে বসে তিনি আমাদের রূপকথার আদলে গল্প শুনিয়ে মোহিত করেন। আরও কত গল্প বলিয়ে আরও কত মহান কথকের উচ্চকণ্ঠ চারপাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বতি হয় বটে, কিন্তু মার্কেজের প্রখর ধারালো মধুর স্বর কিছুতেই আমাদের তাঁর গল্প শুনতে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে না। সত্যি এ এক জাদুই বটে। বিগত কয়েক শতাব্দিতে এমন কথার জাদুতে আমাদের মোহিত করেছেন খুব কম লেখকই। তাই আমরা বিস্মিত হয়ে মার্কেজের গল্প শুনি। তাঁকে জাদুবাস্তব-কুহকীবাস্তব কিংবা অপার রহস্যসৃষ্টির কথাকার- যে যে নামেই ডাকি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমরা একটার পর একটা স্তর অতিক্রম করে মার্কেজের গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইলিয়ম ফকনার কিংবা ফ্রানৎস কাফকার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন বলে সমালোচকগণ ধারণা করলেও সত্যিকার অর্থে মার্কেজ যেন এ সবের কোনোখানেই নেই। তিনি স্বতন্ত্র, তিনি অনন্য, তিনি তাঁরই মতো শুধু, তিনি পুরনো, তিনি গল্পকার, তিনি ঔপন্যাসিক, তিনি রূপকথাকার, তিনি কথার জাদুকর, তিনি সমসাময়িক, তিনি সময়কে পেরিয়ে উত্তর-সমসাময়িক। তলস্তয়কে সেরা লেখক না বললেও তাঁর ‘ওয়ার এন্ড পিস’কে সেরা উপন্যাসের আখ্যায় ভূষিত করেছেন মার্কেজ, কাফকার ‘মেটামরফোসিস’কে তাঁর গল্প লেখার প্রথম উদ্দীপনা বলে স্বীকার করলেও তিনি আমাদেরকে তাঁর দাদি নানির মুখের রূপকথার গল্প বলে মোহিত করেছেন। তিনি শোনাতে শুরু করলেন, এবং এমনভাবেই তা শুরু করলেন যে, এক জীবনে তো নয়ই, শত জীবনেও তা আর শেষ হবার নয়।

মার্কেজকে পাঠ করলে যেন মনে হয়, এ গল্প প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু হয়েছে, চলবে পৃথিবীর শেষ দিন অবধি। কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর নতুন অধ্যায় বা পূর্বের গল্পেরই ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে মৃত্যুর পরের জীবনেও। আরও কত খ্যাতিমান যোগ্যতম গল্পকার ঔপন্যাসিক যেমন- চিনুয়া আচেবে, ভি এস নাইপল, ওরহান পামুক, মারিও ভার্গাস ওসা, হারুকি মোরাকামি, সালমান রুশদি প্রমুখ তো দাবড়ে বেড়াচ্ছেন দাপটে; আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন আমাদের ভাবনা ও প্রতিদিনের জীবনযাপনে। আমরা সমৃদ্ধ, আলোকিত হই তাদের লেখা পড়ে; তবু কেন মার্কেজের গল্পের জাদু কিছুতেই এড়ানো যায় না। ফিওদর দস্তয়ভস্কি, রবীন্দ্রনাথ, অস্কার ওয়াইল্ড, ভার্জিনিয়া উল্ফ, চার্লস ডিকেন্স, সমারসেট মম, জে কে রাউলিংয়ের মতো অগণিত জগতবিখ্যাত লেখক- যাঁরা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, সুখ-দুঃখের সঙ্গে অভিন্ন সুতোয় গেঁথে আছেন; একইভাবে আর এক নতুন আলো ছড়িয়ে আমাদের আলোকিত করলেন সময়ের সেরা কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তাঁকে জাদুবাস্তবতার বা অলৌকিক বাস্তবতার লেখক অভিধায় চিহ্নিত করে খ-িত করার চেয়ে তাঁকে সমগ্র জীবনের লেখক বললেই বরং যথার্থ বিচার করা হয়। তিনি আসলে এসব অভিধা অতিক্রম করেই নিজেকে নির্মাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, “মার্কেজ-আলোচনা প্রসঙ্গে কুহকী বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি কথা বারবার উঠছে বটে, কিন্তু তার তেমন দরকার আছে বলে মনে হয় না, অন্তত মার্কেজের লেখা পড়তে গিয়ে তো নয়ই। মার্কেজ নিজে এসব আলোচনায় উৎসাহিত হতে পারবেন না, কারণ ঐতিহাসিকভাবেই কুহকী বাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার কথাবার্তা অনেক আগেই হয়ে গেছে সেই ১৯৪৩ সালে, যখন আলেহো কার্পেন্তিয়ের ম্যাজিক ওিয়ালীজম কথাটা বলেছিলেন। চল্লিশের দশকেই মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস কুহকী বাস্তবতা কিংবা অলৌকিক বাস্তবতার কথা তুলেছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ইয়োরোপীয় পটের সঙ্গে ভিন্নতার পরিপ্রক্ষিতে সে আলোচনায় এখানে ঢোকার কোনো প্রয়োজন নেই।” সুতরাং আজ মার্কেজকে বিচার করতে হবে যে কোনো ইজম, মতবাদ, ধারার বিপরীতে একজন সামগ্রিক লেখক হিসেবেই।

কোনো লেখকই কোনো ইজমে আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করেন না, কারণ তিনি একক হয়ে ধারণ করেন সমগ্র বিশ্বের জীবন। লেখককে আলোড়িত করে না এমন কোনো ঘটনা নিঃসন্দেহে বিশ্বের কোনো মানুষকেই আলোড়িত করে না। কারণ, এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, সংবেদনশীলতার নিরিখে লেখকের স্থান সবার উপরে। আর মার্কেজের ক্ষেত্রে তো বটেই। মার্কেজ তাঁর লেখার ইতিহাস বা গল্পলেখার বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে বলেছেন, “আমি একটা ভালো গল্প বলতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আমার সত্যিকারের উচ্চাকাক্সক্ষাও বলা যায়। এটা আমি পেয়েছি আমার দিদিমার কাছ থেকে। তিনি আমাকে মাঝরাত্তিরে উঠিয়ে গল্প শোনাতেন। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আমার গল্প লেখার ইতিহাস।” সুতরাং আর কী কথা থাকতে পারে। অলৌকিক বাস্তবতা বলে মার্কেজকে দূরের লেখক বলে আমরা ভাবতে পারি না। কারণ মার্কেজের গল্প সংগৃহীত হয়েছে তাঁর জীবন থেকে। লৌকিক দুনিয়া থেকে। সমগ্র বিশ্বে যা জাদু হয়তো ল্যাটিনে তা বাস্তব। এমন বাস্তবতাকে স্বীকার করে মার্কেজ নিজে এই ম্যাজিক ওিয়ালীজমের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি। যে কারণে ল্যাটিন আমেরিকার মার্কেজ হয়ে উঠেছেন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের তো বটেই; সমগ্র বিশ্বেরই নিজস্ব গল্প বলিয়ে।

আমরা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান যে, মার্কেসের জীবদ্দশাতেই আমাদেরও জন্ম হয়েছে। এবং আমরা দেখলাম তার পরপারে চলে যাওয়া। কিন্তু এমন সৌভাগ্য খুব কম সময়েরই হয়। অনেক অনুর্বর অন্ধকার সময় পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে এমন একজন মার্কেসের জন্ম দিয়ে থাকেন। আর সেই ভাগ্যবান সময়টি ছিল এই বিগত শতক- যে সময়ে মার্কেস তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো লিখে ফেলেন। সাহিত্যের শক্তি কতটা সুদূরপ্রসারি তা প্রমাণ করে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা নিয়ে, সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন আমাদের নিজস্ব লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মৃত্যুর পর যেন তাঁর শক্তিমত্তা আরও প্রবলভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। একজন মার্কেজের হয়ে-ওঠা সম্পর্কে এ সময়ের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম বলেন, “প্রজাপতির প্রজাপতি হয়ে ওঠার জন্যে ৩৮ কোটি বছর লাগবার মতো তারও মার্কেজ হয়ে উঠবার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল সেই সফোক্লিসের কাল থেকে... অথবা কে জানে, আরও দূর অতীত থেকে! তিনিও বেড়ে উঠেছেন শত বছরের নির্জনতায়, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় কেবলই ১৮ মাসের এবং যে নির্জনতার শক্তি বুঝতে নোবেল কমিটির সময় লেগেছে প্রায় এক কুড়ি বছর।” শেষ পর্যন্ত নোবেল কমিটি যে তাঁকে চিনতে পেরেছিল এর চেয়ে শান্তির কথা খুব কমই হয়? তা না হলে তো আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশ, কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো লেখকদের কাতারে ফেলে তাঁকে নিয়েও আমাদের আফসোসের অন্ত থাকতো না।

মার্কেজের রচনার জ্যোতি, সম্মোহন ক্ষমতা, জীবন বোধ, গল্পের জাদু, উপস্থাপনার অভিনবত্ব আমাদের নানাভাবে মোহিত করে। ল্যাটিন আমেরিকার হয়েও তিনি যেন আমাদের, এই ভারতবর্ষ বা বাঙালি ভূখণ্ডের কথাই বলেছেন। আমাদের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের বয়ান রচনা করেছেন তিনি। তার বলা গল্প যেন আমাদের দাদি-নানিরাই একদিন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। যেমন এমনটি ধরে নিয়েছেন অন্য ভূখণ্ডের র্মানুষ।

এখনো মার্কেজ আমাদের কাছে অপার রহস্যময়। তাঁর রচনাবলি সম্পূর্ণ উদ্ধার করা দুএকটি শতক দিয়ে অন্তত সম্ভব নয়। তাঁর রচনার গভীরতা স্পর্শ করার মতো মেধা সব কালের, সব যুগের, সব শতাব্দির থাকে না। মার্কেসের এই অনুদ্ধারিত মণিমানিক্যের জগত উদ্ধার করতে তাই যুগের পর যুগ অনুরাগীগণ মার্কেস সমুদ্রে ডুব দিয়ে যাবেন।

ছবি

দোজখের ঘাম

ছবি

‘ব্যাস’ সম্পর্কে কিছু অনিবার্য কথা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

সমর সেন : কেন প্রাসঙ্গিক

ছবি

কবিতার রাজপুত্র

ছবি

অস্কার ওয়াইল্ড : সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিত রূপকার

ছবি

কথা কম কাজ বেশি

ছবি

সম্পাদনার পেশাদারিত্ব ও আবুল হাসনাত

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অর্বাচীন নোঙর

ছবি

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

অস্থির পৃথিবীর মায়াবী কবি

ছবি

সম্প্রীতির সাধক মরমী বাউল উকিল মুন্সী

ছবি

‘দিবারাত্রির কাব্য’ এবং ‘দ্য আউটসাইডার’ এক নিবিড় সাযুজ্য

ছবি

চুক্তি লিখন

ছবি

লিওপল্ড সেদর সেঙ্ঘর-এর কবিতা

ছবি

হিমু ও হুমায়ূন আহমেদ

শরতের পদাবলি

tab

সাময়িকী

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

ওবায়েদ আকাশ

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস (১৯২৭-২০১৪)

বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪

একার জগত থেকে সমগ্র বিশ্বকে অতীব সূক্ষ্ম ও নিপুণভাবে দেখবার ও দেখাবার ক্ষমতা যার সর্বাধিক তিনি লেখক। যিনি তাঁর স্ব-সময়ে বসে অতীত ও ভবিষ্যৎকেও চেনাবার ক্ষমতাবান, তিনি সময়ের ভাষ্যকার লেখক কবি বা কথাকার। অথচ তিনি একা ও নিঃসঙ্গ সর্বদা। বিশ ও একুশ শতকের আধুনিক ও আধুনিক-উত্তর কালে যে অনুষঙ্গটি সচেতন লেখক সমাজকে সবচে’ বেশি আবিষ্ট করেছে, সেটি নিঃসঙ্গতা। গত শতাব্দির তিরিশের দশকের বিশ্ব প্রেক্ষাপটে এবং পরবর্তী পুরো শতকজুড়ে লেখক সমাজ তথা সমাজের সচেতন অংশ এই নিঃসঙ্গতা বোধকে শনাক্ত করেছে; যা থেকে জন্ম নিয়েছে ব্যক্তি থেকে সমগ্রের জীবনে একাকিত্বের হাহাকার, বিচ্ছিন্নতা, আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা থেকে শুরু করে তলশূন্য জীবনের উঁচু-নিচু পারম্পর্যহীনতার মতো অসামঞ্জস জীবনবোধের অমসৃণ সড়ক। বিশ শতক জুড়েই মানুষের ভেতর নিঃসঙ্গপ্রিয়তা কিংবা অবধারিত নিঃসঙ্গতা সাধারণ থেকে লেখক সমাজের জীবনাধ্যায়কে ভীষণ তাড়িয়েছে- যা এখন আরও সোনালি-ধূসর মোড়কে নানান বাস্তবতায়, ভিন্ন খোলসে সমাজ-মানসলোকে আসন পেতেছে। এই নিঃসঙ্গতাকে, তার উৎকৃষ্ট প্রকারকে ভাষ্যরূপ দিয়ে আমাদের মনের নিভৃত ও সদর আসনে অবস্থান নিয়েছেন বিশ শতকের অপ্রতিদ্বন্দ্বি কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মার্কেজ শুধু আমদের নিঃসঙ্গতার গল্প শোনাননি, নিপীড়িত শোষিত মানুষের চরম দারিদ্র্য, নারীর জীবনের অধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষের কাছে সর্বস্ব বিকিয়ে আত্মসমর্পণ, নর-নারীর প্রেম, পুরুষের বহুগামিতা, বিশ্বসংস্কৃতিতে মানব সমাজের সঠিক অবস্থান তুলে ধরার সার্থক ভাষ্যকার তিনি।

মার্কেজ শুধু বিশ শতকের নন, তারও বহু বহু কাল অতীতের অব্যর্থ গল্প শোনানোর কুশলি জাদুকর। কখনো শতবর্ষ কখনো সহ¯্র-লক্ষ বছর অতীতে বসে তিনি আমাদের রূপকথার আদলে গল্প শুনিয়ে মোহিত করেন। আরও কত গল্প বলিয়ে আরও কত মহান কথকের উচ্চকণ্ঠ চারপাশে ধ্বনিত প্রতিধ্বতি হয় বটে, কিন্তু মার্কেজের প্রখর ধারালো মধুর স্বর কিছুতেই আমাদের তাঁর গল্প শুনতে মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে না। সত্যি এ এক জাদুই বটে। বিগত কয়েক শতাব্দিতে এমন কথার জাদুতে আমাদের মোহিত করেছেন খুব কম লেখকই। তাই আমরা বিস্মিত হয়ে মার্কেজের গল্প শুনি। তাঁকে জাদুবাস্তব-কুহকীবাস্তব কিংবা অপার রহস্যসৃষ্টির কথাকার- যে যে নামেই ডাকি না কেন, শেষ পর্যন্ত আমরা একটার পর একটা স্তর অতিক্রম করে মার্কেজের গল্প শোনার জন্য ব্যাকুল হয়ে থাকি।

আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, উইলিয়ম ফকনার কিংবা ফ্রানৎস কাফকার দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছেন বলে সমালোচকগণ ধারণা করলেও সত্যিকার অর্থে মার্কেজ যেন এ সবের কোনোখানেই নেই। তিনি স্বতন্ত্র, তিনি অনন্য, তিনি তাঁরই মতো শুধু, তিনি পুরনো, তিনি গল্পকার, তিনি ঔপন্যাসিক, তিনি রূপকথাকার, তিনি কথার জাদুকর, তিনি সমসাময়িক, তিনি সময়কে পেরিয়ে উত্তর-সমসাময়িক। তলস্তয়কে সেরা লেখক না বললেও তাঁর ‘ওয়ার এন্ড পিস’কে সেরা উপন্যাসের আখ্যায় ভূষিত করেছেন মার্কেজ, কাফকার ‘মেটামরফোসিস’কে তাঁর গল্প লেখার প্রথম উদ্দীপনা বলে স্বীকার করলেও তিনি আমাদেরকে তাঁর দাদি নানির মুখের রূপকথার গল্প বলে মোহিত করেছেন। তিনি শোনাতে শুরু করলেন, এবং এমনভাবেই তা শুরু করলেন যে, এক জীবনে তো নয়ই, শত জীবনেও তা আর শেষ হবার নয়।

মার্কেজকে পাঠ করলে যেন মনে হয়, এ গল্প প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে শুরু হয়েছে, চলবে পৃথিবীর শেষ দিন অবধি। কিংবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁর নতুন অধ্যায় বা পূর্বের গল্পেরই ধারাবাহিকতা চলতে থাকবে মৃত্যুর পরের জীবনেও। আরও কত খ্যাতিমান যোগ্যতম গল্পকার ঔপন্যাসিক যেমন- চিনুয়া আচেবে, ভি এস নাইপল, ওরহান পামুক, মারিও ভার্গাস ওসা, হারুকি মোরাকামি, সালমান রুশদি প্রমুখ তো দাবড়ে বেড়াচ্ছেন দাপটে; আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন আমাদের ভাবনা ও প্রতিদিনের জীবনযাপনে। আমরা সমৃদ্ধ, আলোকিত হই তাদের লেখা পড়ে; তবু কেন মার্কেজের গল্পের জাদু কিছুতেই এড়ানো যায় না। ফিওদর দস্তয়ভস্কি, রবীন্দ্রনাথ, অস্কার ওয়াইল্ড, ভার্জিনিয়া উল্ফ, চার্লস ডিকেন্স, সমারসেট মম, জে কে রাউলিংয়ের মতো অগণিত জগতবিখ্যাত লেখক- যাঁরা আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে একাকার হয়ে আমাদের ভাললাগা, মন্দলাগা, সুখ-দুঃখের সঙ্গে অভিন্ন সুতোয় গেঁথে আছেন; একইভাবে আর এক নতুন আলো ছড়িয়ে আমাদের আলোকিত করলেন সময়ের সেরা কথাসাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। তাঁকে জাদুবাস্তবতার বা অলৌকিক বাস্তবতার লেখক অভিধায় চিহ্নিত করে খ-িত করার চেয়ে তাঁকে সমগ্র জীবনের লেখক বললেই বরং যথার্থ বিচার করা হয়। তিনি আসলে এসব অভিধা অতিক্রম করেই নিজেকে নির্মাণ করেছেন। এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হক বলেছেন, “মার্কেজ-আলোচনা প্রসঙ্গে কুহকী বাস্তবতা, জাদুবাস্তবতা ইত্যাদি কথা বারবার উঠছে বটে, কিন্তু তার তেমন দরকার আছে বলে মনে হয় না, অন্তত মার্কেজের লেখা পড়তে গিয়ে তো নয়ই। মার্কেজ নিজে এসব আলোচনায় উৎসাহিত হতে পারবেন না, কারণ ঐতিহাসিকভাবেই কুহকী বাস্তবতা বা জাদুবাস্তবতার কথাবার্তা অনেক আগেই হয়ে গেছে সেই ১৯৪৩ সালে, যখন আলেহো কার্পেন্তিয়ের ম্যাজিক ওিয়ালীজম কথাটা বলেছিলেন। চল্লিশের দশকেই মিগেল আনহেল আস্তুরিয়াস কুহকী বাস্তবতা কিংবা অলৌকিক বাস্তবতার কথা তুলেছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন কারণে এবং ইয়োরোপীয় পটের সঙ্গে ভিন্নতার পরিপ্রক্ষিতে সে আলোচনায় এখানে ঢোকার কোনো প্রয়োজন নেই।” সুতরাং আজ মার্কেজকে বিচার করতে হবে যে কোনো ইজম, মতবাদ, ধারার বিপরীতে একজন সামগ্রিক লেখক হিসেবেই।

কোনো লেখকই কোনো ইজমে আবদ্ধ থাকতে পছন্দ করেন না, কারণ তিনি একক হয়ে ধারণ করেন সমগ্র বিশ্বের জীবন। লেখককে আলোড়িত করে না এমন কোনো ঘটনা নিঃসন্দেহে বিশ্বের কোনো মানুষকেই আলোড়িত করে না। কারণ, এ কথা প্রমাণিত সত্য যে, সংবেদনশীলতার নিরিখে লেখকের স্থান সবার উপরে। আর মার্কেজের ক্ষেত্রে তো বটেই। মার্কেজ তাঁর লেখার ইতিহাস বা গল্পলেখার বৃত্তান্ত বলতে গিয়ে বলেছেন, “আমি একটা ভালো গল্প বলতে পেরেছি এটাই আমার কাছে অনেক বড় ব্যাপার। আমার সত্যিকারের উচ্চাকাক্সক্ষাও বলা যায়। এটা আমি পেয়েছি আমার দিদিমার কাছ থেকে। তিনি আমাকে মাঝরাত্তিরে উঠিয়ে গল্প শোনাতেন। সংক্ষেপে এই হচ্ছে আমার গল্প লেখার ইতিহাস।” সুতরাং আর কী কথা থাকতে পারে। অলৌকিক বাস্তবতা বলে মার্কেজকে দূরের লেখক বলে আমরা ভাবতে পারি না। কারণ মার্কেজের গল্প সংগৃহীত হয়েছে তাঁর জীবন থেকে। লৌকিক দুনিয়া থেকে। সমগ্র বিশ্বে যা জাদু হয়তো ল্যাটিনে তা বাস্তব। এমন বাস্তবতাকে স্বীকার করে মার্কেজ নিজে এই ম্যাজিক ওিয়ালীজমের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখাননি। যে কারণে ল্যাটিন আমেরিকার মার্কেজ হয়ে উঠেছেন আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের তো বটেই; সমগ্র বিশ্বেরই নিজস্ব গল্প বলিয়ে।

আমরা নিঃসন্দেহে সৌভাগ্যবান যে, মার্কেসের জীবদ্দশাতেই আমাদেরও জন্ম হয়েছে। এবং আমরা দেখলাম তার পরপারে চলে যাওয়া। কিন্তু এমন সৌভাগ্য খুব কম সময়েরই হয়। অনেক অনুর্বর অন্ধকার সময় পৃথিবীকে ফাঁকি দিয়ে দিয়ে এমন একজন মার্কেসের জন্ম দিয়ে থাকেন। আর সেই ভাগ্যবান সময়টি ছিল এই বিগত শতক- যে সময়ে মার্কেস তার জীবনের শ্রেষ্ঠ রচনাগুলো লিখে ফেলেন। সাহিত্যের শক্তি কতটা সুদূরপ্রসারি তা প্রমাণ করে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা নিয়ে, সমগ্র বিশ্বকে কাঁদিয়ে চলে গেছেন আমাদের নিজস্ব লেখক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। মৃত্যুর পর যেন তাঁর শক্তিমত্তা আরও প্রবলভাবে প্রমাণিত হচ্ছে। একজন মার্কেজের হয়ে-ওঠা সম্পর্কে এ সময়ের বিশিষ্ট কথাসাহিত্যিক ইমতিয়ার শামীম বলেন, “প্রজাপতির প্রজাপতি হয়ে ওঠার জন্যে ৩৮ কোটি বছর লাগবার মতো তারও মার্কেজ হয়ে উঠবার যাত্রা শুরু করতে হয়েছিল সেই সফোক্লিসের কাল থেকে... অথবা কে জানে, আরও দূর অতীত থেকে! তিনিও বেড়ে উঠেছেন শত বছরের নির্জনতায়, আপাতদৃষ্টিতে যা মনে হয় কেবলই ১৮ মাসের এবং যে নির্জনতার শক্তি বুঝতে নোবেল কমিটির সময় লেগেছে প্রায় এক কুড়ি বছর।” শেষ পর্যন্ত নোবেল কমিটি যে তাঁকে চিনতে পেরেছিল এর চেয়ে শান্তির কথা খুব কমই হয়? তা না হলে তো আমাদের কবি জীবনানন্দ দাশ, কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর মতো লেখকদের কাতারে ফেলে তাঁকে নিয়েও আমাদের আফসোসের অন্ত থাকতো না।

মার্কেজের রচনার জ্যোতি, সম্মোহন ক্ষমতা, জীবন বোধ, গল্পের জাদু, উপস্থাপনার অভিনবত্ব আমাদের নানাভাবে মোহিত করে। ল্যাটিন আমেরিকার হয়েও তিনি যেন আমাদের, এই ভারতবর্ষ বা বাঙালি ভূখণ্ডের কথাই বলেছেন। আমাদের প্রতিদিনের সুখ-দুঃখের বয়ান রচনা করেছেন তিনি। তার বলা গল্প যেন আমাদের দাদি-নানিরাই একদিন আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে ঘুম পাড়াতেন। যেমন এমনটি ধরে নিয়েছেন অন্য ভূখণ্ডের র্মানুষ।

এখনো মার্কেজ আমাদের কাছে অপার রহস্যময়। তাঁর রচনাবলি সম্পূর্ণ উদ্ধার করা দুএকটি শতক দিয়ে অন্তত সম্ভব নয়। তাঁর রচনার গভীরতা স্পর্শ করার মতো মেধা সব কালের, সব যুগের, সব শতাব্দির থাকে না। মার্কেসের এই অনুদ্ধারিত মণিমানিক্যের জগত উদ্ধার করতে তাই যুগের পর যুগ অনুরাগীগণ মার্কেস সমুদ্রে ডুব দিয়ে যাবেন।

back to top