দীপংকর গৌতম
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে প্রগতিশীলতার ধারা সাহিত্যে প্রাণের প্রবাহ অব্যাহত রেখেছিল; শামসুর রাহমান ছিলেন সেই প্রগতিশীল ধারার চেতনায় উজ্জীবিত কবি। সময় সচেতনতায় ঋদ্ধ কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটি ধারা নির্মাণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কবিতার বিষয়, প্রকরণ. কাঠামো নির্মাণে তিনি ছিলেন একদম আলাদা। কবিতার ধ্রুপদী বিন্যাসের বুননের সঙ্গে দর্শন ও রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া তাঁর কবিতাকে করেছিল গতিময় ও দিয়েছিল স্বতন্ত্র অভিধা। তাঁর কবিতার সামগ্রিক কাঠামো নির্মাণে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। তাঁর সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তিনি দিয়েছিলেন কাব্যভাষা। তাঁর অজ¯্র কবিতায় বাংলার সমাজ-রাজনীতির উত্তাল সময়ের স্বাক্ষর মেলে। তারপরও যদি প্রশ্ন করা হয় শামসুর রাহমান কেন প্রাসঙ্গিক? তাহলে বলতে হবে একজন কবি সমাজের কাছে মানুষের কাছে কতটা দায়বদ্ধ ও সচেতন সেটা শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠে স্পষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত একজন কবির কবিতায় তাঁর সার্বিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তাঁর জীবনদর্শনকে তুলে ধরা খুবই বড় বিষয়। যার মধ্য দিয়ে জানা যায় তিনি কতটা ব্যক্তিক-কতটা নৈর্ব্যক্তিক। এছাড়া কবিতায় প্রাতিস্বিক ধারা নির্মাণও তার জন্য একটি বড় বিষয়।
শামসুর রাহমানের পরিচয় তাঁর কবিতা। তার কারণ কবিতা যে সময়কে ধারণ করতে পারে এটা পুরোপুরি তাঁর কবিতা সংলগ্ন বিষয়। সময়ের অভিঘাত তাঁর কবিতার কাব্য শৈলীর অনন্য বিষয়। কবির যে কবিতার প্রতি দায় সেটা শামসুর রাহমানের কবিতায় বার বার প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর কবিতায় রাজনীতির যে ইতিহাস বিধৃত আছে সেটা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। শুধু তাই নয়, কবিতার ধারাকে করেছে জনসম্পৃক্ত ও কাব্য-স্পর্ধার দিক থেকে দিগন্ত-প্রসারী। কবিতার রাজনীতি সম্পর্কে শামসুর রাহমান তাঁর নিজের ভাষ্যে বলেছেনÑ “যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহাড়া বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে। সেকালে, বলা যায় আমার ধারণা ছিলো যে, কবিতা ও রাজনীতির মধ্যে অহিনকুলের সম্পর্ক বিদ্যমান। কলাকৈবল্যবাদের প্ররাচনায় আমি সেই ধারণায় বশীভূত হয়েছিলাম এবং এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য-জ্ঞান করতাম। অর্থাৎ সারাক্ষণ বিশুদ্ধ কবিতা রচনার তাগিদে মশগুল হয়ে থাকতাম এবং রাজনীতি-ঘেঁষা পদ্যকে কখনো কবিতা পদবাচ্য মনে হতো না। ফলে যাঁরা এক নিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত ভট্টচার্যের নাম উচ্চারণ করতেন তাঁদের কাব্যবোধ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ ছিলাম। এখন অবশ্য মনে হয়, অতীতে নজরুল ও সুকান্তের ওপর অবিচার করেছি, যদিও আজো এ বিশ্বাসে আমি অটল যে, উল্লিখিত তিনজন কবির প্রতিভার তারতম্য যাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়, তাঁরা আর যা-ই হোন কাব্যরসিক হিসেবে প্রথম পংক্তিতে বসবার যোগ্য নন। যা হোক, আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। কিন্তু সেই উঁকিঝুঁকি ছিলো ক্ষণস্থায়ী; ফলত, আমার প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে একটিও রাজনীতি-ভিত্তিক কবিতা ঠাঁই পায়নি। এক ধরনের শুচিবাই আমাকে উক্ত কাব্য গ্রন্থ থেকে বহু রাজনৈতিক পদ্য ছাঁটাই করতে বাধ্য করে। সেসব পদ্য আমার অন্য কোনো গ্রন্থেও জায়গা খুঁজে পায়নি। বেরহমের মতো সেগুলি বর্জন করেছি। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আমার কাব্যপ্রয়াস একটা নতুন বাঁক নেয় ব’লে মনে করি। যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠলো বর্হিজীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি মনষ্ক। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ ক’রে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান। এরপর থেকে আমার প্রতিটি পদ্য রাজনৈতিক আঁচে তৈরি হয়েছে এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। অনেকের ধারণা রাজনীতিকে ধারণ করলে কবিতা আর কবিতা থাকে না। এই ধারণার প্রতি আমার সায় নেই। রাজনীতি নির্ভর কবিতা উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট দু’ধরনেরই হতে পারে। এটা রাজনীতি বিবর্জিত কবিতার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। কোনো সচেতন কবি তাঁর দেশের রাজনীতি বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থাকতে পারেন না। দেশীয় রাজনীতি তো বটেই এমনকি বিশ্ব রাজনীতিও তাঁকে স্পর্শ করে, কেননা তিনি অন্য কোনো গ্রহের নয় এই গ্রহেরই বাসিন্দা। তাই কোনো কবির পক্ষে রাজনীতিকে বেমালুম ভুলে থাকা সম্ভব নয়। অবশ্য এ-কথা ঠিক, রাজনীতি ও কবিতাকে একাত্মা হতে হবে। কবিকে মনে রাখতে হবে যাতে কোনো পাঠকের মনে না হয় যে রাজনীতি আরোপিত কোনো ব্যাপার। কবিতা শেষ পর্যন্ত একটি শিল্প। শিল্পরহিত রচনা কখনো কবিতা ব’লে গ্রাহ্য হতে পারে না।” (কালের ধূলোয় লেখা, শামসুর রাহমান)।
কবিতা প্রসঙ্গে এ কথাটি কবি শামসুর রাহমান বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও বলেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে লেখক-শিল্পীর শ্রেণি অবস্থানের জন্য অথবা লেখক-শিল্পীর ওপর বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাব পড়ার কারণে সাধারণভাবে শিল্প-সাহিত্যে শ্রেণি-মানসের প্রতিফলন ঘটে। শিল্পীর শ্রেণি-অবস্থান, শ্রেণি-মানসিকতা থেকে শিল্প-সাহিত্যে সেই শ্রেণিগত মূল্যবোধ ও মতাদর্শের প্রশ্ন যখন এসে পড়ে, তখন সংগত কারণেই শ্রেণির রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্ন এসে পড়ে। কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যিকের মধ্যে অনুভূতির গভীরতা, দৃষ্টির ব্যাপকতা, সহানুভূতিশীল মনোভাব, ব্যক্তিত্ববোধ ইত্যাদি কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেণি-সংকীর্ণতার গ-ি অতিক্রম করতে দেখা যায়। লেনিন মনে করতেন, কোনো লেখক বা শিল্পী যদি প্রকৃতই মহৎ হন, তাহলে তাঁর রচনায় বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশ প্রতিফলিত না হয়ে পারে না।’ কারণ, ‘যতদিন পর্যন্ত মানুষের দ্বারা মানুষকে শোষণ করার ব্যবস্থাবলির উচ্ছেদ না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সাধারণভাবে মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতাকে সর্বজনীনতার ওপরে দাঁড় করানো যাবে না।’
এসব দিক বিবেচনা করে আমরা দেখি, রাজনীতি ছাড়া আসলে কি মানুষ হয়? রাজনীতি নেই এমন মানুষ লেখক হলে সামাজিক চিত্র রচনার কাজটি করবে কে? বিশে^ও যেসব বরেণ্য কবি, লেখক শিল্পীদের আমরা অনুসরণ করি তারাও কোনও না কোনওভাবে রাজনীতির ভিতর থেকে উঠে এসছেন। সামাজিক সংকট যখন একজন কবির সামাজিক দায় হয়ে ওঠে, তখন তার শিল্প-সাহিত্যে এর প্রভাব পড়বেই। তাছাড়া কবির আত্মোপলব্ধি তাকে রাজনীতির দিকে নিয়ে যায় কখনো কখনো। এদিক থেকে আমরা দেখি কবি শামসুর রাহমান ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানÑ সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে দিয়ে তিনি চলে এসছেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ তাঁকে আন্দোলিত করেছে। তাঁর কবিতায় সেসব বিষয় আত্মোপলব্ধির অন্তরঙ্গ অংশ হয়ে ওঠার কারণে তিনি লিখেছেন অমর সব কবিতা। এখানে একটা কথা বলা জরুরি যে, তিনি স্লোগান লেখেননি। কিন্তু স্লোগান যখন তাকে আন্দোলিত করেছে তাঁর কবিতা স্লোগানের রস নিষিক্ত হয়েছে। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে তাঁর কালোত্তীর্ণ সব কবিতা।
যে কারণে তাঁর কবিতার খোলা জানালা দিয়ে তাঁকে অবলোকন করা যায়, তার সত্তার বিষয়টিকে অনুভব করা যায়। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতি, জনজীবনের চিত্র আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্রায়ণ অনবদ্য। একইভাবে ‘আসাদের শার্ট’ কবিতার মধ্য দিয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের চিত্র ইতিহাসের ধারায় নন্দনতত্ত্বের বুনন রচনা করে। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘বরকতের ফটোগ্রাফ’, ‘ ফেব্রয়ারি ১৯৬৯’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ এবং ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ এই ধরনের তাঁর অজ¯্র কবিতা ভাষা আন্দোলনপরবর্তী স্বাধিকারের জন্য সংঘটিত সব আন্দোলন সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করে। ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলো এখনো পাঠককে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাহিত্যানুরাগীদের ইতিহাস বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। অনাগত যে কবি সাহিত্যের দ্বারে তার অভিষেক করবে তাকে ইতিহাস, দর্শনের বুনটে কাব্যের বিন্যাসী আয়োজনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে শামসুর রাহমানের কবিতা অনন্য। কবিতাকর্মীরা কাব্যচর্চার শুরুতে যেমন কাব্যভাষা, রীতি, প্রকরণ আশা করেন শামসুর রাহমানের কবিতা তাদের জন্য আদর্শ পাঠ্য। দেশের যে কোনো দুর্দিনে তিনি সম্মুখ সারিতে থেকে কথা বলেছেন। দেশের প্রয়োজনে ও মানুষের স্বার্থে প্রগতিশীল যে কোনো আন্দোলনে একাত্ম ছিলেন তিনি। তাই কেবল কাব্য সাহিত্য নয়, সামাজিক জীবন, মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাস চর্চার জন্য শামসুর রাহমানের কবিতা সাহিত্য ও ইতিহাসের এক একটি শিলালিপির মতো কাজ করবে।
দীপংকর গৌতম
বৃহস্পতিবার, ২৪ অক্টোবর ২০২৪
১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যে প্রগতিশীলতার ধারা সাহিত্যে প্রাণের প্রবাহ অব্যাহত রেখেছিল; শামসুর রাহমান ছিলেন সেই প্রগতিশীল ধারার চেতনায় উজ্জীবিত কবি। সময় সচেতনতায় ঋদ্ধ কবি হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটি ধারা নির্মাণে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তাঁর কবিতার বিষয়, প্রকরণ. কাঠামো নির্মাণে তিনি ছিলেন একদম আলাদা। কবিতার ধ্রুপদী বিন্যাসের বুননের সঙ্গে দর্শন ও রাজনীতির মিথস্ক্রিয়া তাঁর কবিতাকে করেছিল গতিময় ও দিয়েছিল স্বতন্ত্র অভিধা। তাঁর কবিতার সামগ্রিক কাঠামো নির্মাণে তিনি ছিলেন খুবই সচেতন। তাঁর সময়ের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে তিনি দিয়েছিলেন কাব্যভাষা। তাঁর অজ¯্র কবিতায় বাংলার সমাজ-রাজনীতির উত্তাল সময়ের স্বাক্ষর মেলে। তারপরও যদি প্রশ্ন করা হয় শামসুর রাহমান কেন প্রাসঙ্গিক? তাহলে বলতে হবে একজন কবি সমাজের কাছে মানুষের কাছে কতটা দায়বদ্ধ ও সচেতন সেটা শামসুর রাহমানের কবিতা পাঠে স্পষ্ট হয়। দ্বিতীয়ত একজন কবির কবিতায় তাঁর সার্বিক কর্মতৎপরতার মাধ্যমে তাঁর জীবনদর্শনকে তুলে ধরা খুবই বড় বিষয়। যার মধ্য দিয়ে জানা যায় তিনি কতটা ব্যক্তিক-কতটা নৈর্ব্যক্তিক। এছাড়া কবিতায় প্রাতিস্বিক ধারা নির্মাণও তার জন্য একটি বড় বিষয়।
শামসুর রাহমানের পরিচয় তাঁর কবিতা। তার কারণ কবিতা যে সময়কে ধারণ করতে পারে এটা পুরোপুরি তাঁর কবিতা সংলগ্ন বিষয়। সময়ের অভিঘাত তাঁর কবিতার কাব্য শৈলীর অনন্য বিষয়। কবির যে কবিতার প্রতি দায় সেটা শামসুর রাহমানের কবিতায় বার বার প্রতিভাত হয়েছে। তাঁর কবিতায় রাজনীতির যে ইতিহাস বিধৃত আছে সেটা তাঁর কবিতাকে দিয়েছে নতুন মাত্রা। শুধু তাই নয়, কবিতার ধারাকে করেছে জনসম্পৃক্ত ও কাব্য-স্পর্ধার দিক থেকে দিগন্ত-প্রসারী। কবিতার রাজনীতি সম্পর্কে শামসুর রাহমান তাঁর নিজের ভাষ্যে বলেছেনÑ “যখন প্রথম কবিতা লিখতে শুরু করি, তখন চতুর্দিকে কড়া পাহাড়া বসিয়ে দিয়েছিলাম যাতে আমার কাব্যক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ না ঘটে। সেকালে, বলা যায় আমার ধারণা ছিলো যে, কবিতা ও রাজনীতির মধ্যে অহিনকুলের সম্পর্ক বিদ্যমান। কলাকৈবল্যবাদের প্ররাচনায় আমি সেই ধারণায় বশীভূত হয়েছিলাম এবং এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনেকটা বুদ্ধদেব বসুর প্রভাবে রাজনীতিকে অস্পৃশ্য-জ্ঞান করতাম। অর্থাৎ সারাক্ষণ বিশুদ্ধ কবিতা রচনার তাগিদে মশগুল হয়ে থাকতাম এবং রাজনীতি-ঘেঁষা পদ্যকে কখনো কবিতা পদবাচ্য মনে হতো না। ফলে যাঁরা এক নিশ্বাসে রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল ইসলাম এবং সুকান্ত ভট্টচার্যের নাম উচ্চারণ করতেন তাঁদের কাব্যবোধ সম্পর্কে যথেষ্ট সন্দেহপ্রবণ ছিলাম। এখন অবশ্য মনে হয়, অতীতে নজরুল ও সুকান্তের ওপর অবিচার করেছি, যদিও আজো এ বিশ্বাসে আমি অটল যে, উল্লিখিত তিনজন কবির প্রতিভার তারতম্য যাঁদের কাছে স্পষ্ট নয়, তাঁরা আর যা-ই হোন কাব্যরসিক হিসেবে প্রথম পংক্তিতে বসবার যোগ্য নন। যা হোক, আমার কবিজীবনের গোড়ার দিকে রাজনীতি-প্রতিরোধকারী যে দুর্গটি গড়ে তুলেছিলাম তাতে প্রথম চিড় ধরে ১৯৫২ সালে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের কালে। তখন থেকেই আমার পদ্যে রাজনীতি উঁকিঝুঁকি দিতে শুরু করে। কিন্তু সেই উঁকিঝুঁকি ছিলো ক্ষণস্থায়ী; ফলত, আমার প্রথম কবিতার বই ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’তে একটিও রাজনীতি-ভিত্তিক কবিতা ঠাঁই পায়নি। এক ধরনের শুচিবাই আমাকে উক্ত কাব্য গ্রন্থ থেকে বহু রাজনৈতিক পদ্য ছাঁটাই করতে বাধ্য করে। সেসব পদ্য আমার অন্য কোনো গ্রন্থেও জায়গা খুঁজে পায়নি। বেরহমের মতো সেগুলি বর্জন করেছি। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আমার কাব্যপ্রয়াস একটা নতুন বাঁক নেয় ব’লে মনে করি। যে-আমি ছিলাম পুরোপুরি বিবরবাসী, অন্তর্জীবনে সমর্পিত, সে আমি ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠলো বর্হিজীবনের প্রতি মনোযোগী এবং রাজনীতি মনষ্ক। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের অনুগত না হয়েই আমি রাজনীতি থেকে, গণসংগ্রাম থেকে শোষণ ক’রে নিলাম আমার কবিতার নানা উপাদান। এরপর থেকে আমার প্রতিটি পদ্য রাজনৈতিক আঁচে তৈরি হয়েছে এ কথা বললে সত্যের অপলাপ হবে। অনেকের ধারণা রাজনীতিকে ধারণ করলে কবিতা আর কবিতা থাকে না। এই ধারণার প্রতি আমার সায় নেই। রাজনীতি নির্ভর কবিতা উৎকৃষ্ট এবং নিকৃষ্ট দু’ধরনেরই হতে পারে। এটা রাজনীতি বিবর্জিত কবিতার ব্যাপারেও প্রযোজ্য। কোনো সচেতন কবি তাঁর দেশের রাজনীতি বিষয়ে পুরোপুরি উদাসীন থাকতে পারেন না। দেশীয় রাজনীতি তো বটেই এমনকি বিশ্ব রাজনীতিও তাঁকে স্পর্শ করে, কেননা তিনি অন্য কোনো গ্রহের নয় এই গ্রহেরই বাসিন্দা। তাই কোনো কবির পক্ষে রাজনীতিকে বেমালুম ভুলে থাকা সম্ভব নয়। অবশ্য এ-কথা ঠিক, রাজনীতি ও কবিতাকে একাত্মা হতে হবে। কবিকে মনে রাখতে হবে যাতে কোনো পাঠকের মনে না হয় যে রাজনীতি আরোপিত কোনো ব্যাপার। কবিতা শেষ পর্যন্ত একটি শিল্প। শিল্পরহিত রচনা কখনো কবিতা ব’লে গ্রাহ্য হতে পারে না।” (কালের ধূলোয় লেখা, শামসুর রাহমান)।
কবিতা প্রসঙ্গে এ কথাটি কবি শামসুর রাহমান বিভিন্ন সাক্ষাৎকারেও বলেছেন। অন্যদিকে রাজনৈতিক সাহিত্য প্রসঙ্গে লেনিন বলেছেন, শ্রেণিবিভক্ত সমাজে লেখক-শিল্পীর শ্রেণি অবস্থানের জন্য অথবা লেখক-শিল্পীর ওপর বিভিন্ন শ্রেণির প্রভাব পড়ার কারণে সাধারণভাবে শিল্প-সাহিত্যে শ্রেণি-মানসের প্রতিফলন ঘটে। শিল্পীর শ্রেণি-অবস্থান, শ্রেণি-মানসিকতা থেকে শিল্প-সাহিত্যে সেই শ্রেণিগত মূল্যবোধ ও মতাদর্শের প্রশ্ন যখন এসে পড়ে, তখন সংগত কারণেই শ্রেণির রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রশ্ন এসে পড়ে। কিন্তু শিল্পী-সাহিত্যিকের মধ্যে অনুভূতির গভীরতা, দৃষ্টির ব্যাপকতা, সহানুভূতিশীল মনোভাব, ব্যক্তিত্ববোধ ইত্যাদি কারণে অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের শ্রেণি-সংকীর্ণতার গ-ি অতিক্রম করতে দেখা যায়। লেনিন মনে করতেন, কোনো লেখক বা শিল্পী যদি প্রকৃতই মহৎ হন, তাহলে তাঁর রচনায় বিপ্লবের কোনো না কোনো মর্মগত অংশ প্রতিফলিত না হয়ে পারে না।’ কারণ, ‘যতদিন পর্যন্ত মানুষের দ্বারা মানুষকে শোষণ করার ব্যবস্থাবলির উচ্ছেদ না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত সাধারণভাবে মানবীয় দৃষ্টিভঙ্গি ও নৈতিকতাকে সর্বজনীনতার ওপরে দাঁড় করানো যাবে না।’
এসব দিক বিবেচনা করে আমরা দেখি, রাজনীতি ছাড়া আসলে কি মানুষ হয়? রাজনীতি নেই এমন মানুষ লেখক হলে সামাজিক চিত্র রচনার কাজটি করবে কে? বিশে^ও যেসব বরেণ্য কবি, লেখক শিল্পীদের আমরা অনুসরণ করি তারাও কোনও না কোনওভাবে রাজনীতির ভিতর থেকে উঠে এসছেন। সামাজিক সংকট যখন একজন কবির সামাজিক দায় হয়ে ওঠে, তখন তার শিল্প-সাহিত্যে এর প্রভাব পড়বেই। তাছাড়া কবির আত্মোপলব্ধি তাকে রাজনীতির দিকে নিয়ে যায় কখনো কখনো। এদিক থেকে আমরা দেখি কবি শামসুর রাহমান ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানÑ সর্বোপরি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে দিয়ে তিনি চলে এসছেন। বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের প্রতিটি ধাপ তাঁকে আন্দোলিত করেছে। তাঁর কবিতায় সেসব বিষয় আত্মোপলব্ধির অন্তরঙ্গ অংশ হয়ে ওঠার কারণে তিনি লিখেছেন অমর সব কবিতা। এখানে একটা কথা বলা জরুরি যে, তিনি স্লোগান লেখেননি। কিন্তু স্লোগান যখন তাকে আন্দোলিত করেছে তাঁর কবিতা স্লোগানের রস নিষিক্ত হয়েছে। আর এভাবেই তৈরি হয়েছে তাঁর কালোত্তীর্ণ সব কবিতা।
যে কারণে তাঁর কবিতার খোলা জানালা দিয়ে তাঁকে অবলোকন করা যায়, তার সত্তার বিষয়টিকে অনুভব করা যায়। তাঁর অমর সৃষ্টি ‘স্বাধীনতা তুমি’ কবিতার মধ্য দিয়ে বাংলার প্রকৃতি, জনজীবনের চিত্র আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চিত্রায়ণ অনবদ্য। একইভাবে ‘আসাদের শার্ট’ কবিতার মধ্য দিয়ে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের চিত্র ইতিহাসের ধারায় নন্দনতত্ত্বের বুনন রচনা করে। ‘বর্ণমালা আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’, ‘বরকতের ফটোগ্রাফ’, ‘ ফেব্রয়ারি ১৯৬৯’, ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’, ‘বাংলাদেশ স্বপ্ন দ্যাখে’, ‘বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়’ এবং ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ এই ধরনের তাঁর অজ¯্র কবিতা ভাষা আন্দোলনপরবর্তী স্বাধিকারের জন্য সংঘটিত সব আন্দোলন সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রতিনিধিত্ব করে। ভাষা-আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাকে উপজীব্য করে লেখা কবিতাগুলো এখনো পাঠককে বাংলাদেশের ইতিহাস, সংগ্রাম ও সাহিত্যানুরাগীদের ইতিহাস বাস্তবতার কাছাকাছি নিয়ে যায়। অনাগত যে কবি সাহিত্যের দ্বারে তার অভিষেক করবে তাকে ইতিহাস, দর্শনের বুনটে কাব্যের বিন্যাসী আয়োজনের কাছাকাছি নিয়ে যেতে শামসুর রাহমানের কবিতা অনন্য। কবিতাকর্মীরা কাব্যচর্চার শুরুতে যেমন কাব্যভাষা, রীতি, প্রকরণ আশা করেন শামসুর রাহমানের কবিতা তাদের জন্য আদর্শ পাঠ্য। দেশের যে কোনো দুর্দিনে তিনি সম্মুখ সারিতে থেকে কথা বলেছেন। দেশের প্রয়োজনে ও মানুষের স্বার্থে প্রগতিশীল যে কোনো আন্দোলনে একাত্ম ছিলেন তিনি। তাই কেবল কাব্য সাহিত্য নয়, সামাজিক জীবন, মানুষের সংগ্রাম ও ইতিহাস চর্চার জন্য শামসুর রাহমানের কবিতা সাহিত্য ও ইতিহাসের এক একটি শিলালিপির মতো কাজ করবে।