সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
একজন অসাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। তাঁর সম্পাদনার পেশাদারিত্ব সকলকে মোহিত করত। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্পাদনা করতে পারতেন, যা ছিল আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। নবীন-প্রবীণ সকল লেখকের কাছ থেকেই তিনি লেখা আদায় করে নিতে পারতেন। প্রবীণ লেখকদের যেমন সম্মান দেখাতে জানতেন, এবং তাঁদের লেখা প্রকাশ করতেন, তেমনি তরুণদেরকেও তিনি উৎসাহিত করতেন এবং নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন।
তার আগে আহসান হাবীবের সম্পাদনার কথা বলি। তিনি মোহাম্মদী, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় সাহিত্য সম্পাদনা করতেন। তিনি সম্পাদনাকে একটি উচ্চমাত্রা দান করেছিলেন। এবং একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তিনি তরুণ-প্রবীণ মেধাবী লেখকদের কাছে খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। এর পরবর্তীতে আবুল হাসনাতের কাছে আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আবুল হাসনাতের সম্পাদনা আহসান হাবীবের অভাব পূরণ করেছিল।
আবুল হাসনাত ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল সম্পাদক, তিনি যে রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালপ্রয়াত হলেন, সেই রোগটিও অত্যধিক কর্মব্যস্ততার কারণে তাঁর মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। তিনি হাসপাতালে শুয়েও তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যের মাধ্যমে আমার কাছে লেখা চেয়েছেন।
আমি আবুল হাসনাতকে শুরুতে পাই ‘দৈনিক সংবাদ’-এর একজন সাংবাদিক হিসেবে। তিনি দীর্ঘদিন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করে ‘সংবাদ সাময়িকী’কে একটি বিশেষ উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, আবুল হাসনাত এমনভাবে লেখা চাইতেন যে, তাঁর অনুরোধকে কখনো উপেক্ষা করা যেত না। কারো কাছ থেকে লেখা আদায় করার এই অসাধারণ ক্ষমতা সবার মধ্যে থাকে না।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি থাকা দরকার সেটা হলো লেখা চেনার ক্ষমতা। এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আবুল হাসনাত ভালো লেখা সহজে চিনতে পারতেন। তাঁর সম্পাদনার মুন্সিয়ানার কারণে ভালো লেখা পেতে সমস্যা হতো না। ‘সংবাদ’ ছেড়ে তিনি যখন ‘কালি ও কলম’-এ যোগ দিলেন, এবং আমরা জানতে পারলাম; সেখানেও না লিখে কোনো উপায় ছিলো না। মূলত হাসনাতের কারণে সেখানে লেখালেখি করেছি। এখানে এসেও এমনভাবে তিনি লেখা চাইতেন যে, তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি।
তাঁর কিছুটা অকালে চলে যাওয়াতে আমি অত্যন্ত শোকার্ত ও বেদনাহত হয়েছি। আমি আর যে কারণে হাসনাতকে কোনো দিন ভুলবো না, সেটা হলো, আমি যে ‘সময় বহিয়া যায়’ শিরোনামে ১৪ বছর সংবাদ-এ কলাম লিখেছি ‘গাছপাথর’ নামে, সেই লেখাটি হাসনাতই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করতেন। প্রতি মঙ্গবার এই লেখাটি সংবাদ-এ প্রকাশিত হতো। জহুর হোসেন চৌধুরীর মৃত্যুর পর, আমি এই লেখাটি শুরু করি। তখন আরো লিখতেন আবু জাফর শামসুদ্দিন ও সন্তোষ গুপ্ত। হাসনাত সাহিত্যপাতা দেখতেন, এবং সেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নবীন-প্রবীণ লেখকগণ লেখালেখি করতেন।
সম্পাদনার বাইরে হাসনাত যে গদ্য লিখতে শুরু করেন, সেখানেও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে। সেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে বই প্রকাশিত হতে শুরু করে। তাঁর এই লেখাগুলোতে তিনি তাঁর সময়কে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলি ও নানা উত্থানপতন ভাঙচুরের কথা, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা তাঁর লেখায় জায়গা পেয়েছে। তিনি অত্যন্ত আবেগ নিয়ে লেখা শুরু করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণও করেছেন।
হাসনাত ছিলেন একজন প্রচ- শিল্প সমঝদার মানুষ। সংবাদ এবং কালি ও কলমের সম্পাদনায় এর স্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি নিজেও অনেক শিল্প সমালোচনা লিখেছেন। তাঁর শিল্প সমালোচনায়ও প্রতিভার স্বাক্ষর লক্ষ্যণীয় ছিলো। তাঁর সম্পাদনার মাধ্যমে অনেক শিল্প সমালোচককেও আমরা চিনতে পারি, যারা সংবাদ, কালি ও কলমে লিখেছেন। সমসাময়িক অনেক শিল্পীই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুজন।
এরপর হাসনাতের কবিতার কথা বলি, তিনি খুব অল্প লিখেছেন, তবে তাঁর কবিতাও আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি।
সম্পাদনায় হাসনাত ছিলেন নৈর্ব্যক্তিক, কিন্তু কবিতায় ছিলেন তার বিপরীত। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, আবেগ, মান-অভিমান জায়গা করে নিত। অর্থাৎ তাকে আরো ব্যাপকভাবে খুঁজে পাওয়া যেত কবিতায়।
ব্যক্তিগত জীবনে হাসনাতের মতো এত বিনয়ী, রুচি¯িœগ্ধ ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর চলাফেরা অন্যের সঙ্গে আচার ব্যবহার ও জীবনযাপন ছিলো অসাধারণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ।
হাসনাত শুরু থেকেই রাজনীতির মানুষ ছিলেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে চলে যান। এবং সেখান থেকে পার্টির পক্ষে কাজ করেন।
হাসনাতের আর একটি ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই। চিত্তরঞ্জন সাহা ‘সাহিত্যপত্র’ নামে যে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, সেখানে সভাপতি হিসেবে আমার নাম ছাপা হতো, আর হাসনাত ছিলেন সম্পাদনা পরিষদে। যদিও সেখানে তাঁর নাম ছাপা হতো না। সেখানেও হাসনাত অত্যন্ত আগ্রহ ও কর্মতৎপরতার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন।
মোট কথা, সব কিছু ছাপিয়ে হাসনাতের সম্পাদনার অসাধারণত্ব ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও চোখে পড়ার মতো। তাঁর মতো এমন সম্পাদক সচরাচর চোখে পড়ে না। শ্রুতিলিখনÑ সাময়িকী প্রতিবেদক
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪
একজন অসাধারণ সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। তাঁর সম্পাদনার পেশাদারিত্ব সকলকে মোহিত করত। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে সম্পাদনা করতে পারতেন, যা ছিল আমাদের কাছে খুবই আকর্ষণীয়। নবীন-প্রবীণ সকল লেখকের কাছ থেকেই তিনি লেখা আদায় করে নিতে পারতেন। প্রবীণ লেখকদের যেমন সম্মান দেখাতে জানতেন, এবং তাঁদের লেখা প্রকাশ করতেন, তেমনি তরুণদেরকেও তিনি উৎসাহিত করতেন এবং নিয়মিত লেখা প্রকাশ করতেন।
তার আগে আহসান হাবীবের সম্পাদনার কথা বলি। তিনি মোহাম্মদী, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক বাংলায় সাহিত্য সম্পাদনা করতেন। তিনি সম্পাদনাকে একটি উচ্চমাত্রা দান করেছিলেন। এবং একজন সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তিনি তরুণ-প্রবীণ মেধাবী লেখকদের কাছে খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। এর পরবর্তীতে আবুল হাসনাতের কাছে আমরা তাঁর বৈশিষ্ট্য দেখতে পাই। আবুল হাসনাতের সম্পাদনা আহসান হাবীবের অভাব পূরণ করেছিল।
আবুল হাসনাত ছিলেন অত্যন্ত দায়িত্বশীল সম্পাদক, তিনি যে রোগে আক্রান্ত হয়ে অকালপ্রয়াত হলেন, সেই রোগটিও অত্যধিক কর্মব্যস্ততার কারণে তাঁর মধ্যে বাসা বেঁধেছিল। তিনি হাসপাতালে শুয়েও তাঁর দায়িত্ব পালন করেছেন। অন্যের মাধ্যমে আমার কাছে লেখা চেয়েছেন।
আমি আবুল হাসনাতকে শুরুতে পাই ‘দৈনিক সংবাদ’-এর একজন সাংবাদিক হিসেবে। তিনি দীর্ঘদিন সংবাদের সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করে ‘সংবাদ সাময়িকী’কে একটি বিশেষ উচ্চতায় দাঁড় করিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, আবুল হাসনাত এমনভাবে লেখা চাইতেন যে, তাঁর অনুরোধকে কখনো উপেক্ষা করা যেত না। কারো কাছ থেকে লেখা আদায় করার এই অসাধারণ ক্ষমতা সবার মধ্যে থাকে না।
সম্পাদনার ক্ষেত্রে যে গুণটা সবচেয়ে বেশি থাকা দরকার সেটা হলো লেখা চেনার ক্ষমতা। এবং লেখাটিকে সঠিকভাবে তুলে ধরা। আবুল হাসনাত ভালো লেখা সহজে চিনতে পারতেন। তাঁর সম্পাদনার মুন্সিয়ানার কারণে ভালো লেখা পেতে সমস্যা হতো না। ‘সংবাদ’ ছেড়ে তিনি যখন ‘কালি ও কলম’-এ যোগ দিলেন, এবং আমরা জানতে পারলাম; সেখানেও না লিখে কোনো উপায় ছিলো না। মূলত হাসনাতের কারণে সেখানে লেখালেখি করেছি। এখানে এসেও এমনভাবে তিনি লেখা চাইতেন যে, তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে পারিনি।
তাঁর কিছুটা অকালে চলে যাওয়াতে আমি অত্যন্ত শোকার্ত ও বেদনাহত হয়েছি। আমি আর যে কারণে হাসনাতকে কোনো দিন ভুলবো না, সেটা হলো, আমি যে ‘সময় বহিয়া যায়’ শিরোনামে ১৪ বছর সংবাদ-এ কলাম লিখেছি ‘গাছপাথর’ নামে, সেই লেখাটি হাসনাতই আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে সংগ্রহ করতেন। প্রতি মঙ্গবার এই লেখাটি সংবাদ-এ প্রকাশিত হতো। জহুর হোসেন চৌধুরীর মৃত্যুর পর, আমি এই লেখাটি শুরু করি। তখন আরো লিখতেন আবু জাফর শামসুদ্দিন ও সন্তোষ গুপ্ত। হাসনাত সাহিত্যপাতা দেখতেন, এবং সেখানে দেশের গুরুত্বপূর্ণ নবীন-প্রবীণ লেখকগণ লেখালেখি করতেন।
সম্পাদনার বাইরে হাসনাত যে গদ্য লিখতে শুরু করেন, সেখানেও তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর মেলে। সেগুলো নিয়ে পরবর্তীতে বই প্রকাশিত হতে শুরু করে। তাঁর এই লেখাগুলোতে তিনি তাঁর সময়কে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। সে সময়ের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাবলি ও নানা উত্থানপতন ভাঙচুরের কথা, আন্দোলন-সংগ্রামের কথা তাঁর লেখায় জায়গা পেয়েছে। তিনি অত্যন্ত আবেগ নিয়ে লেখা শুরু করলেও তাকে নিয়ন্ত্রণও করেছেন।
হাসনাত ছিলেন একজন প্রচ- শিল্প সমঝদার মানুষ। সংবাদ এবং কালি ও কলমের সম্পাদনায় এর স্পষ্ট স্বাক্ষর রয়েছে। তিনি নিজেও অনেক শিল্প সমালোচনা লিখেছেন। তাঁর শিল্প সমালোচনায়ও প্রতিভার স্বাক্ষর লক্ষ্যণীয় ছিলো। তাঁর সম্পাদনার মাধ্যমে অনেক শিল্প সমালোচককেও আমরা চিনতে পারি, যারা সংবাদ, কালি ও কলমে লিখেছেন। সমসাময়িক অনেক শিল্পীই ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধুজন।
এরপর হাসনাতের কবিতার কথা বলি, তিনি খুব অল্প লিখেছেন, তবে তাঁর কবিতাও আমি অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে পাঠ করি।
সম্পাদনায় হাসনাত ছিলেন নৈর্ব্যক্তিক, কিন্তু কবিতায় ছিলেন তার বিপরীত। এখানে তাঁর ব্যক্তিগত সুখদুঃখ, আবেগ, মান-অভিমান জায়গা করে নিত। অর্থাৎ তাকে আরো ব্যাপকভাবে খুঁজে পাওয়া যেত কবিতায়।
ব্যক্তিগত জীবনে হাসনাতের মতো এত বিনয়ী, রুচি¯িœগ্ধ ভদ্র মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। তাঁর চলাফেরা অন্যের সঙ্গে আচার ব্যবহার ও জীবনযাপন ছিলো অসাধারণ ব্যক্তিত্বপূর্ণ।
হাসনাত শুরু থেকেই রাজনীতির মানুষ ছিলেন। তিনি সমাজতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। ছাত্র জীবন থেকেই ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ভারতে চলে যান। এবং সেখান থেকে পার্টির পক্ষে কাজ করেন।
হাসনাতের আর একটি ব্যাপার উল্লেখ করতে চাই। চিত্তরঞ্জন সাহা ‘সাহিত্যপত্র’ নামে যে পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, সেখানে সভাপতি হিসেবে আমার নাম ছাপা হতো, আর হাসনাত ছিলেন সম্পাদনা পরিষদে। যদিও সেখানে তাঁর নাম ছাপা হতো না। সেখানেও হাসনাত অত্যন্ত আগ্রহ ও কর্মতৎপরতার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন।
মোট কথা, সব কিছু ছাপিয়ে হাসনাতের সম্পাদনার অসাধারণত্ব ছিলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ও চোখে পড়ার মতো। তাঁর মতো এমন সম্পাদক সচরাচর চোখে পড়ে না। শ্রুতিলিখনÑ সাময়িকী প্রতিবেদক