alt

সাময়িকী

অস্কার ওয়াইল্ড : সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিত রূপকার

যাকিয়া সুমি সেতু

: বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

অস্কার ওয়াইল্ড

অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০) ছিলেন ভিক্টোরীয় যুগের এক বিস্ময়কর সাহিত্যিক প্রতিভা। তাঁর শিল্পবিশ্ব সৌন্দর্য এবং বেদনাÑ অপূর্ব সমন্বয়ে অনুশীলনশীল। ইবসেনের প্রভাব আবেশ মুক্ত ওয়াইল্ডের সৃষ্টিশীলতা যেমন রূপবাদের (Aestheticism) গৌরবময়তায় ছিল স্পষ্ট, তেমনি ছিল সমাজের প্রতি গভীর পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণে সুচিন্তিত, স্থিতপ্রজ্ঞ। ওয়াইল্ড একইসঙ্গে নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং শিল্প, সমাজ, নৈতিকতা, দার্শনিকতার গভীর সঞ্চারক। তবে আইরিশ ওয়াইল্ডের সাহিত্যিক জীবন ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমীÑ তাঁর চমকপ্রদ বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসী চিন্তা, সময়ের প্রথাগত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যের আধিপত্যকে প্রকাশ করেছিলেন। একইসঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি এবং বেদনার অনুষঙ্গও তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকারে অনির্বাণ দ্যুতিতে প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাঁর সাহিত্য এবং নাটকগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত বেদনা, সৌন্দর্যের প্রত্যয় এবং মানবজীবনের অতলান্তিক জটিলতা অন্তর্লীন হয়ে এক অনবদ্য শিল্প সৃজন করেছে। আলবেয়ার ক্যামু অস্কার ওয়াইল্ড সম্পর্কে বলেন : “Art and philosophy, to Wilde, were always related to the sensation of beauty and the recognition of suffering. He saw beauty as a sublime lie and suffering as the ultimate truth of existence.”

অস্কার ওয়াইল্ড ১৮৫৪ সালের ১৬ অক্টোবর আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। শহরটি প্রধানত লিফি নদী দ্বারা বিভক্ত, পূর্ব অংশ মিশেছে আইরিশ সাগরে এবং অন্যতম “উইকলো মাউন্টেইন” নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। অস্কারের সাহিত্যকর্মে এই ডাবলিনের প্রভাব, পর্যবেক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। ডাবলিনের “মেরিয়ন স্কয়ার” পার্কটি, যেখানে অস্কার ওয়াইল্ডের মূর্তি আছে, তাও অস্কারের কল্পনাকে উজ্জীবিত করত, যার উপস্থিতি একাধিক সাহিত্যকর্মে রয়েছে। ডাবলিনেই তাঁর শৈশব, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, শিক্ষার পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের ভিত্তি গ্রন্থিত। তাঁর বাবা আইরিশ স্যার উইলিয়াম ওয়াইল্ড ছিলেন একজন খ্যাতিমান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও লেখক, আর মা জেন ফ্রান্সেসকা ওয়াইল্ড ছিলেন একজন কবি এবং আইরিশ জাতীয়তাবাদী।

এই প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সৃজনশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে ওয়াইল্ডের জ্ঞানচর্চা এবং সাহিত্যচর্চার পরিবেশ ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, রুচি এবং উচ্চাকাক্সক্ষায় প্রভাববিদ্ধ। তাঁর ছাত্রজীবন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ, ডাবলিন কলেজ, ম্যাগডালেন কলেজ এবং অক্সফোর্ডে কাটে। এখানে তিনি নান্দনিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন, এবং তাঁর চিরাচরিত ছন্দোময়তা ও সৌন্দর্যের অন্তর্গূঢ় দর্শন গড়ে তোলেন।

অক্সফোর্ডে তাঁর শিক্ষাজীবনের সময়, ওয়াইল্ড রূপবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। এই আন্দোলন সৌন্দর্য এবং রূপের সাধনাকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল তিনি। ওয়াইল্ডের রূপবাদ ছিল ‘art for art’s sake’ অর্থাৎ শিল্প শুধুমাত্র শিল্পের জন্য, এর কোনো নৈতিক বা সামাজিক দায়িত্ব নেই। এই দর্শন ওয়াইল্ডের সাহিত্যিক কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা “The Picture of Dorian Gray” (১৮৯০)-এ প্রকাশ পায় দীপ্ততায়। এখানে ডোরিয়ান তার চিরযৌবন ধরে রাখতে নিজের আত্মা বিসর্জন দেয়, যা তার অন্তর্নিহিত পাপ এবং নৈতিক পতনের প্রতীক। এই উপন্যাসে ওয়াইল্ডের দর্শন এবং নান্দনিকতা চমৎকারভাবে আলোড়িত হয়ে ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর এই সৃষ্টিতত্ত্বে সৌন্দর্য এবং বেদনার মধ্যকার বিরোধ গভীরভাবে প্রতিফলিত করেন। তাঁর এই রূপবাদী দর্শন শুধুমাত্র “The Picture of Dorian Gray”-এ সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মেই প্রবাহিত হয়েছে, যেখানে তিনি সৌন্দর্য এবং বেদনার মধ্যকার সম্পর্ককে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ওয়াইল্ডের জন্য, শিল্প ছিল মানব অস্তিত্বের সীমারেখার বাইরে একটি বিশুদ্ধ নান্দনিক অভিজ্ঞতা, যা জীবনের জটিলতা এবং নৈতিক দ্বিধার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। তাঁর রূপবাদী আদর্শ তাঁকে কেবল সাহিত্যিকভাবে নয়, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়ানো একজন বিদ্রোহী দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

অস্কার ওয়াইল্ডের নান্দনিক দর্শন তাঁর প্রবন্ধ “The Decay of Lying”-এ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও প্রখরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে ওয়াইল্ড যুক্তি প্রদান করেন যে, শিল্প কেবল জীবনের অনুকরণ নয়, বরং কল্পনার মধ্য দিয়েজীবনের গভীর ও প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত করে। তাঁর মতে, কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে শিল্প এমন এক সত্যকে আবিষ্কার করে যা জীবনের বাস্তবতায় পৌঁছাতে সক্ষম নয়। তাঁর নাটক ও উপন্যাসগুলোতে এই দর্শন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে সৌন্দর্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং জীবনের অন্তর্নিহিত জটিলতা প্রকাশ পায়। “The Picture of Dorian Gray”-এর পাশাপাশি তাঁর বহুল আলোচিত নাটক “Salomé” কামনা এবং নিষিদ্ধ ইচ্ছার অন্ধকারময়দিকগুলোকে অসাধারণভাবে উদ্ভাসিত। “Salomé” নাটকে তাঁর বিখ্যাত সংলাপ “I will kiss thy mouth, Jokanaan” নিষিদ্ধ আকাক্সক্ষার ভয়াবহতা এবং সৌন্দর্যের মোহময়প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সংলাপের মাধ্যমে ওয়াইল্ড সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা এবং নিষিদ্ধ ইচ্ছার মধ্যে বিদ্যমান বিপরীতধর্মী টানাপোড়েনকে আলোকিত করেছেন, যা মানবচরিত্রের জটিল মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা এবং কামনার বিধ্বংসী শক্তিকেই প্রতিফলিত করে। এই নাটক ও প্রবন্ধে তিনি শিল্পের মধ্যে সৌন্দর্য, কল্পনা, এবং মানবজীবনের গভীরতম আকাক্সক্ষাগুলোর এক অভিন্ন মিলন ঘটিয়ে, এক অসামান্য নন্দনতাত্ত্বিক জগৎ তৈরি করেছেন, যা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

অস্কার ওয়াইল্ডের সমাজবিদ্রোহী মনোভাব তাঁর নাটকসমূহে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, বিশেষ করে “Lady Windermere’s Fan’, ‘An Ideal Husband”, এবং “A Woman of No Importance”-এ। এসব নাটকে তিনি ভিক্টোরীয় যুগের সামাজিক প্রথা ও মূল্যবোধের অসাড়তা এবং ভ-ামির ওপর গভীরভাবে তীক্ষè সমালোচনা করেছেন। “Lady Windermere’s Fan” নাটকে, মহিলাদের সামাজিক অবস্থান এবং পিতৃপ্রধান সমাজের দ্বিচারিতা তুলে ধরে নারীদের অধিকার, সংগ্রাম চিত্রায়ণ করেন। অন্যদিকে, “An Ideal Husband” নাটকে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে একত্রিত করে ক্ষমতার ভ-ামি এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। “A Woman of No Importance” নাটকেও নারীর স্বাধীনতা এবং সমাজের দ্বিচারিতা নিয়েগভীর চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে। তবে, তাঁর সবচেয়েবিখ্যাত নাটক “The Importance of Being Earnest” (১৮৯৫) ভিক্টোরীয় সমাজের মিথ্যাচার এবং সামাজিক ভ-ামির তীব্র সমালোচনার উদ্ভাসন। এখানে তিনি জীবনের নৈতিক জটিলতা এবং মানব সম্পর্কের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “The truth is rarely pure and never simple”, তাঁর সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয়থিম হিসেবে নৈতিক জটিলতার গুরুত্বকে চিত্রিত করে। ফলে, ওয়াইল্ডের নাটকগুলো শুধুমাত্র বিনোদন নয়; বরং সমাজের প্রতি তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রতিফলন। যার প্রবর্তনায় সমাজে সচেতনতাবোধ শিল্পিত হবে এবং ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে অনিবার্য হয়ে।

ওয়াইল্ডের ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেদনায় পূর্ণ এক মহা ট্র্যাজেডির কাহিনী। তাঁর সামাজিক উত্থান এবং পতন অসামাজিক সম্পর্ক এবং সেজন্য কঠোর নিপীড়নের কারাবাস, তাঁকে এমন এক অবস্থানে দাঁড় করায় যেখানে বেদনার মহিমা এবং সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়িত্ব একই সঙ্গে মূর্ত হয়। অথচ ওয়াইল্ড তাঁর প্রতিভা এবং ঝলমলে ব্যক্তিত্বের জন্য লন্ডনের এলিট মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। তবে, লর্ড আলফ্রেড ডগলাস বোসির সাথে তাঁর সম্পর্ক, তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। বোসির বাবা, মারকুইস অফ কুইন্সবেরি, প্রকাশ্যে ওয়াইল্ডকে “সোডোমাইট হিসেবে পরিচিত” বলে অভিযুক্ত করেন, যা ওয়াইল্ডকে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু ওয়াইল্ডের মামলাটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে ওয়াইল্ড নিজেই “অশ্লীলতা” অভিযোগে বিচারাধীন হয়ে পড়েন, তাঁর সমকামী সম্পর্কের জন্য। ওয়াইল্ডকে দুবছরের কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেওয়া হয়, যা তাঁর স্বাস্থ্য এবং মনের অবস্থাকে ভেঙে দিয়েছিল চূড়ান্তভাবে। এটি ছিল একসময় লন্ডনের সামাজিক কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অস্কার ওয়াইল্ড নামে এক সৃজনশীল ব্যক্তির উজ্জ্বল জীবনের, শিল্প-সততার কঠোর পতন। আর এই ধস, জীবনবোধের গভীরতা, গ্লানি, হতাশা ব্যাপ্ত হয়েছিল আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন পেরিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস অবধি।

ওয়াইল্ডের বিচার এবং কারাবাস শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি হিসেবে নয়, বরং ভিক্টোরিয়ান সমাজের দমনমূলক প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বিবৃতি। কারাবাসে থাকার সময় ওয়াইল্ড তাঁর মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতাগুলো “De Profundis” (১৯০৫)-এ বিশদভাবে তুলে ধরেন। এই রচনা ওয়াইল্ডের গভীর আত্মবিশ্লেষণ এবং বেদনার শিল্পিত প্রকাশ, যা তাঁকে দার্শনিক এবং মানসিকভাবে আরও পরিণত করে তোলে। এটা ছিল বোসির প্রতি লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি, যেখানে তিনি কষ্ট, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁর চিন্তাধারাগুলো তুলে ধরেন। শুধু তাই নয়, এটি ওয়াইল্ডের অন্যতম ব্যক্তিগত এবং মননশীল কাজও, যা তাঁর আবেগ এবং দার্শনিক সংগ্রামকে আন্দোলিত করে গভীরতর প্রকাশ ব্যাপ্ততায়। “De Profundis”-এ তিনি তাঁর মানসিক যন্ত্রণা এবং সমাজের প্রতি তাঁর দর্শনকে প্রকাশ করে লেখেন : “I think that the greatest tragedies of life are not the ones we suffer, but the ones we cause others to suffer.”

অস্কার ওয়াইল্ড কারাগারে থাকার সময়ই তাঁর বিখ্যাত কবিতা “The Ballad of Reading Gaol” (১৮৯৮) লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতাটি তাঁর কারাগারের অভিজ্ঞতা এবং একজন বন্দীর ফাঁসি দেখার স্মৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। এটি তাঁর জীবনের এক গভীর ট্র্যাজেডি এবং মানবিক অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। এই কবিতায় মানবজীবনের কঠোর বাস্তবতা এবং বেদনার নীল অনুভূতিগুলো প্রবলভাবে বিপ্রতীপ অপরতার সন্ধান করে এবং মানুষের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং বেদনার অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। এই দীর্ঘ কবিতার লাইনগুলো ওয়াইল্ডের দার্শনিক এবং নৈতিক গভীরতায় মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত বিষাদ এবং সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরেন। কবিতার অন্যতম বিখ্যাত কিছু লাইন : “Yet each man kills the thing he/ loves,/ By each let this be heard,/ Some do it with a bitter look,/ Some with a flattering word,/ The coward does it with a kiss,/ The brave man with a sword!”

১৮৯৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অস্কার ওয়াইল্ড ফ্রান্সে চলে যান। অস্কার ওয়াইল্ড তার জীবনের শেষ দিনগুলো ফ্রান্সের প্যারিসে “LÕHôtel” নামে একটি হোটেলে কাটিয়েছিলেন। এই হোটেলটি প্যারিসের “Rue des Beaux-Arts”-এ অবস্থিত। ওয়াইল্ড এখানে খুবই কষ্টকর পরিস্থিতিতে ছিলেন, আর্থিক দুরবস্থা ও শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এখানে তিনি তাঁর জীবনের বাকি সময়টুকু একপ্রকার অপ্রচার এবং দরিদ্রতার মধ্যে কাটান। নীরস, অর্থহীন জীবনে প্রতিনিয়ত তিনি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন এবং কারাবাসের মানসিক ক্ষত তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল মনের গভীরে অভ্রান্তভাবে। ফলে অস্কার ওয়াইল্ড মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হন এবং মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। L’Hôtel-এর ১৬ নম্বর ঘরে ১৯০০ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। বর্তমানে, এই হোটেলটি পর্যটকদের জন্য ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে পরিচিত, এবং সেই ঘরটি বিশেষভাবে অস্কার ওয়াইল্ডের স্মৃতিতেই সংরক্ষিত রয়েছে। প্রকৃতঅর্থে তাঁর মৃত্যু ছিল একটি দুঃখজনক সমাপ্তি, যিনি একসময় সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শিল্পের অধিকারের সীমানা নিয়ে। ওয়াইল্ডকে “Père Lachaise” গোরস্থানে সমাধীস্থ করা হয় এবং তাঁর সম্মানার্থে কবরটিতে, ভাস্কর জ্যাকব এপস্টেইন দ্বারা নকশা করেন।

অস্কার ওয়াইল্ডের সাহিত্যকর্ম, এবং তাঁর প্রভাব আজও নন্দিত, অপরিসীম। তাঁর নাটকগুলো এখনও সারা বিশ্বে মঞ্চস্থ হয়, এবং উপন্যাস “The Picture of Dorian Gray” গথিক সাহিত্যের এক অনন্য কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। ওয়াইল্ডের রসিকতা, এবং সামাজিক সমালোচনা অসংখ্য লেখককে অনুপ্রাণিত করে- জর্জ বার্নার্ড শ থেকে শুরু করে আধুনিক নাট্যকার টম স্টপার্ড পর্যন্ত। ওয়াইল্ডকে LGBTQ+ সম্প্রদায়ের একজন আইকন হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, যিনি কঠোর সামাজিক নিপীড়নের মুখেও তাঁর জীবন এবং সম্পর্কের প্রতি অবিচল থেকেছেন। ওয়াইল্ডের জীবন এবং সাহিত্যকর্ম আমাদের শেখায় যে সৌন্দর্য এবং বেদনা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এবং শিল্পের মাধ্যমে আমরা জীবনের গভীরতা এবং মানবিক দুর্বলতাগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি।

অস্কার ওয়াইল্ড একবার বলেছিলেন, “We are all in the gutter, but some of us are looking at the stars.” এই উক্তির মাধ্যমে তিনি সৌন্দর্য, বেদনা, এবং মানবজীবনের অম্লান সত্যগুলোকে দৃঢ়করে তুলেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও জীবন সেই অন্বেষণের পথে নিয়েযায়, যেখানে সৌন্দর্য ও বেদনা চিরকালীন এক শিল্পরূপ ধারণ করে। ওয়াইল্ডের সাহিত্য শুধু তাঁর নিজস্ব সময়কালকে নয়, বরং নিঃসময়ের যুগপৎ সত্তার গভীরেও চিরন্তনভাবে সময়প্রবাহকে অনন্ত করে তোলে। সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুমের ভাষায়, “To Wilde, beauty was the highest form of art, but it was fleeting, and with that transience came tragedy. Wilde’s life and works show us that beauty is often paired with suffering, a recognition that enhances the aesthetic experience.” অস্কার ওয়াইল্ডের ১৭০তম জন্মদিনে তিনি আজও তাই স্মরণীয়, প্রাসঙ্গিক- আপন শিল্প-প্রত্যয়ে, শিল্প-স্বভাবের জনকরূপে।

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

রূপান্তরিত

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

ছবি

দোজখের ঘাম

ছবি

‘ব্যাস’ সম্পর্কে কিছু অনিবার্য কথা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

সমর সেন : কেন প্রাসঙ্গিক

ছবি

কবিতার রাজপুত্র

ছবি

কথা কম কাজ বেশি

ছবি

সম্পাদনার পেশাদারিত্ব ও আবুল হাসনাত

ছবি

সৈয়দ আবদুস সাদিক শোক-পঙ্ক্তি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

প্রসঙ্গ : লেখকের বুদ্ধিবৃৃত্তিক দায় ও দর্শনের খোঁজে

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অর্বাচীন নোঙর

ছবি

যে কবিতায় শামসুর রাহমানকে চিনেছি

ছবি

শামসুর রাহমানের রাজনীতির কবিতা, কবিতার রাজনীতি

ছবি

জীবনানন্দ দাশ: শুশ্রƒষার আশ্রয়ঘর

ছবি

আহমদ ছফা ও অলাতচক্র

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দ্য হোয়াইট বুক

ছবি

হান কাঙের ৫টি কবিতা

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

ছোট ছোট ঘটনাই আমার অনুপ্রেরণা-হান কাং

ছবি

হান কাংয়ের প্রগাঢ় কাব্যিক গদ্য

ছবি

নার্গিস-উদ্যানে নজরুল তর্ক

ছবি

শহীদ কাদরীর কবি হয়ে ওঠা

ছবি

মাথার ওপর ছাতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

অমিয়ভূষণ : ধ্রুপদীয়া আর স্ববিরোধের সমন্বয়

ছবি

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র স্বাতন্ত্র্য ও শ্রেষ্ঠত্ব

ছবি

মার্কেস ও আমার বিস্ময়

tab

সাময়িকী

অস্কার ওয়াইল্ড : সৌন্দর্য ও বেদনার শিল্পিত রূপকার

যাকিয়া সুমি সেতু

অস্কার ওয়াইল্ড

বৃহস্পতিবার, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

অস্কার ওয়াইল্ড (১৮৫৪-১৯০০) ছিলেন ভিক্টোরীয় যুগের এক বিস্ময়কর সাহিত্যিক প্রতিভা। তাঁর শিল্পবিশ্ব সৌন্দর্য এবং বেদনাÑ অপূর্ব সমন্বয়ে অনুশীলনশীল। ইবসেনের প্রভাব আবেশ মুক্ত ওয়াইল্ডের সৃষ্টিশীলতা যেমন রূপবাদের (Aestheticism) গৌরবময়তায় ছিল স্পষ্ট, তেমনি ছিল সমাজের প্রতি গভীর পর্যালোচনামূলক বিশ্লেষণে সুচিন্তিত, স্থিতপ্রজ্ঞ। ওয়াইল্ড একইসঙ্গে নাট্যকার, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং শিল্প, সমাজ, নৈতিকতা, দার্শনিকতার গভীর সঞ্চারক। তবে আইরিশ ওয়াইল্ডের সাহিত্যিক জীবন ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমীÑ তাঁর চমকপ্রদ বুদ্ধিমত্তা এবং সাহসী চিন্তা, সময়ের প্রথাগত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সৌন্দর্যের আধিপত্যকে প্রকাশ করেছিলেন। একইসঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনের ট্র্যাজেডি এবং বেদনার অনুষঙ্গও তাঁর সাহিত্যিক উত্তরাধিকারে অনির্বাণ দ্যুতিতে প্রতিষ্ঠিত। ফলে তাঁর সাহিত্য এবং নাটকগুলোর মধ্যে ব্যক্তিগত বেদনা, সৌন্দর্যের প্রত্যয় এবং মানবজীবনের অতলান্তিক জটিলতা অন্তর্লীন হয়ে এক অনবদ্য শিল্প সৃজন করেছে। আলবেয়ার ক্যামু অস্কার ওয়াইল্ড সম্পর্কে বলেন : “Art and philosophy, to Wilde, were always related to the sensation of beauty and the recognition of suffering. He saw beauty as a sublime lie and suffering as the ultimate truth of existence.”

অস্কার ওয়াইল্ড ১৮৫৪ সালের ১৬ অক্টোবর আয়ারল্যান্ডের ডাবলিনে জন্মগ্রহণ করেন। শহরটি প্রধানত লিফি নদী দ্বারা বিভক্ত, পূর্ব অংশ মিশেছে আইরিশ সাগরে এবং অন্যতম “উইকলো মাউন্টেইন” নিরিবিলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে। অস্কারের সাহিত্যকর্মে এই ডাবলিনের প্রভাব, পর্যবেক্ষণ স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত। ডাবলিনের “মেরিয়ন স্কয়ার” পার্কটি, যেখানে অস্কার ওয়াইল্ডের মূর্তি আছে, তাও অস্কারের কল্পনাকে উজ্জীবিত করত, যার উপস্থিতি একাধিক সাহিত্যকর্মে রয়েছে। ডাবলিনেই তাঁর শৈশব, সাহিত্যের প্রতি অনুরাগ, শিক্ষার পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের ভিত্তি গ্রন্থিত। তাঁর বাবা আইরিশ স্যার উইলিয়াম ওয়াইল্ড ছিলেন একজন খ্যাতিমান চক্ষু বিশেষজ্ঞ ও লেখক, আর মা জেন ফ্রান্সেসকা ওয়াইল্ড ছিলেন একজন কবি এবং আইরিশ জাতীয়তাবাদী।

এই প্রজ্ঞাপূর্ণ ও সৃজনশীল পরিবারে জন্ম নেওয়ার ফলে ওয়াইল্ডের জ্ঞানচর্চা এবং সাহিত্যচর্চার পরিবেশ ছিল নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়, রুচি এবং উচ্চাকাক্সক্ষায় প্রভাববিদ্ধ। তাঁর ছাত্রজীবন ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ, ডাবলিন কলেজ, ম্যাগডালেন কলেজ এবং অক্সফোর্ডে কাটে। এখানে তিনি নান্দনিক আন্দোলনের সাথে পরিচিত হন, এবং তাঁর চিরাচরিত ছন্দোময়তা ও সৌন্দর্যের অন্তর্গূঢ় দর্শন গড়ে তোলেন।

অক্সফোর্ডে তাঁর শিক্ষাজীবনের সময়, ওয়াইল্ড রূপবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রধান প্রবক্তা হয়ে ওঠেন। এই আন্দোলন সৌন্দর্য এবং রূপের সাধনাকে জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা করেছিল তিনি। ওয়াইল্ডের রূপবাদ ছিল ‘art for art’s sake’ অর্থাৎ শিল্প শুধুমাত্র শিল্পের জন্য, এর কোনো নৈতিক বা সামাজিক দায়িত্ব নেই। এই দর্শন ওয়াইল্ডের সাহিত্যিক কাজের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল এবং তাঁর অন্যতম বিখ্যাত রচনা “The Picture of Dorian Gray” (১৮৯০)-এ প্রকাশ পায় দীপ্ততায়। এখানে ডোরিয়ান তার চিরযৌবন ধরে রাখতে নিজের আত্মা বিসর্জন দেয়, যা তার অন্তর্নিহিত পাপ এবং নৈতিক পতনের প্রতীক। এই উপন্যাসে ওয়াইল্ডের দর্শন এবং নান্দনিকতা চমৎকারভাবে আলোড়িত হয়ে ফুটে ওঠে। তিনি তাঁর এই সৃষ্টিতত্ত্বে সৌন্দর্য এবং বেদনার মধ্যকার বিরোধ গভীরভাবে প্রতিফলিত করেন। তাঁর এই রূপবাদী দর্শন শুধুমাত্র “The Picture of Dorian Gray”-এ সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মেই প্রবাহিত হয়েছে, যেখানে তিনি সৌন্দর্য এবং বেদনার মধ্যকার সম্পর্ককে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ওয়াইল্ডের জন্য, শিল্প ছিল মানব অস্তিত্বের সীমারেখার বাইরে একটি বিশুদ্ধ নান্দনিক অভিজ্ঞতা, যা জীবনের জটিলতা এবং নৈতিক দ্বিধার ঊর্ধ্বে অবস্থান করে। তাঁর রূপবাদী আদর্শ তাঁকে কেবল সাহিত্যিকভাবে নয়, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিপরীতে দাঁড়ানো একজন বিদ্রোহী দার্শনিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।

অস্কার ওয়াইল্ডের নান্দনিক দর্শন তাঁর প্রবন্ধ “The Decay of Lying”-এ অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও প্রখরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে ওয়াইল্ড যুক্তি প্রদান করেন যে, শিল্প কেবল জীবনের অনুকরণ নয়, বরং কল্পনার মধ্য দিয়েজীবনের গভীর ও প্রকৃত সত্য উদ্ভাসিত করে। তাঁর মতে, কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতার মাধ্যমে শিল্প এমন এক সত্যকে আবিষ্কার করে যা জীবনের বাস্তবতায় পৌঁছাতে সক্ষম নয়। তাঁর নাটক ও উপন্যাসগুলোতে এই দর্শন অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, যেখানে সৌন্দর্যের প্রতি গভীর আকর্ষণ এবং জীবনের অন্তর্নিহিত জটিলতা প্রকাশ পায়। “The Picture of Dorian Gray”-এর পাশাপাশি তাঁর বহুল আলোচিত নাটক “Salomé” কামনা এবং নিষিদ্ধ ইচ্ছার অন্ধকারময়দিকগুলোকে অসাধারণভাবে উদ্ভাসিত। “Salomé” নাটকে তাঁর বিখ্যাত সংলাপ “I will kiss thy mouth, Jokanaan” নিষিদ্ধ আকাক্সক্ষার ভয়াবহতা এবং সৌন্দর্যের মোহময়প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সংলাপের মাধ্যমে ওয়াইল্ড সৌন্দর্যের পরাকাষ্ঠা এবং নিষিদ্ধ ইচ্ছার মধ্যে বিদ্যমান বিপরীতধর্মী টানাপোড়েনকে আলোকিত করেছেন, যা মানবচরিত্রের জটিল মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা এবং কামনার বিধ্বংসী শক্তিকেই প্রতিফলিত করে। এই নাটক ও প্রবন্ধে তিনি শিল্পের মধ্যে সৌন্দর্য, কল্পনা, এবং মানবজীবনের গভীরতম আকাক্সক্ষাগুলোর এক অভিন্ন মিলন ঘটিয়ে, এক অসামান্য নন্দনতাত্ত্বিক জগৎ তৈরি করেছেন, যা তাঁর সমগ্র সাহিত্যকর্মের অন্তর্নিহিত দার্শনিক ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়।

অস্কার ওয়াইল্ডের সমাজবিদ্রোহী মনোভাব তাঁর নাটকসমূহে সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে, বিশেষ করে “Lady Windermere’s Fan’, ‘An Ideal Husband”, এবং “A Woman of No Importance”-এ। এসব নাটকে তিনি ভিক্টোরীয় যুগের সামাজিক প্রথা ও মূল্যবোধের অসাড়তা এবং ভ-ামির ওপর গভীরভাবে তীক্ষè সমালোচনা করেছেন। “Lady Windermere’s Fan” নাটকে, মহিলাদের সামাজিক অবস্থান এবং পিতৃপ্রধান সমাজের দ্বিচারিতা তুলে ধরে নারীদের অধিকার, সংগ্রাম চিত্রায়ণ করেন। অন্যদিকে, “An Ideal Husband” নাটকে রাজনৈতিক এবং ব্যক্তিগত জীবনকে একত্রিত করে ক্ষমতার ভ-ামি এবং নৈতিক দায়বদ্ধতার প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। “A Woman of No Importance” নাটকেও নারীর স্বাধীনতা এবং সমাজের দ্বিচারিতা নিয়েগভীর চিন্তা প্রকাশিত হয়েছে। তবে, তাঁর সবচেয়েবিখ্যাত নাটক “The Importance of Being Earnest” (১৮৯৫) ভিক্টোরীয় সমাজের মিথ্যাচার এবং সামাজিক ভ-ামির তীব্র সমালোচনার উদ্ভাসন। এখানে তিনি জীবনের নৈতিক জটিলতা এবং মানব সম্পর্কের অন্তর্নিহিত অসঙ্গতির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তাঁর বিখ্যাত উক্তি, “The truth is rarely pure and never simple”, তাঁর সাহিত্যকর্মের কেন্দ্রীয়থিম হিসেবে নৈতিক জটিলতার গুরুত্বকে চিত্রিত করে। ফলে, ওয়াইল্ডের নাটকগুলো শুধুমাত্র বিনোদন নয়; বরং সমাজের প্রতি তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গির একটি প্রতিফলন। যার প্রবর্তনায় সমাজে সচেতনতাবোধ শিল্পিত হবে এবং ভাবনার নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে অনিবার্য হয়ে।

ওয়াইল্ডের ব্যক্তিগত জীবন ছিল বেদনায় পূর্ণ এক মহা ট্র্যাজেডির কাহিনী। তাঁর সামাজিক উত্থান এবং পতন অসামাজিক সম্পর্ক এবং সেজন্য কঠোর নিপীড়নের কারাবাস, তাঁকে এমন এক অবস্থানে দাঁড় করায় যেখানে বেদনার মহিমা এবং সৌন্দর্যের ক্ষণস্থায়িত্ব একই সঙ্গে মূর্ত হয়। অথচ ওয়াইল্ড তাঁর প্রতিভা এবং ঝলমলে ব্যক্তিত্বের জন্য লন্ডনের এলিট মহলে জনপ্রিয় ছিলেন। তবে, লর্ড আলফ্রেড ডগলাস বোসির সাথে তাঁর সম্পর্ক, তাঁকে শেষ পর্যন্ত ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। বোসির বাবা, মারকুইস অফ কুইন্সবেরি, প্রকাশ্যে ওয়াইল্ডকে “সোডোমাইট হিসেবে পরিচিত” বলে অভিযুক্ত করেন, যা ওয়াইল্ডকে তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করতে প্ররোচিত করে। কিন্তু ওয়াইল্ডের মামলাটি চরমভাবে ব্যর্থ হয়। ফলে ওয়াইল্ড নিজেই “অশ্লীলতা” অভিযোগে বিচারাধীন হয়ে পড়েন, তাঁর সমকামী সম্পর্কের জন্য। ওয়াইল্ডকে দুবছরের কঠোর পরিশ্রমের শাস্তি দেওয়া হয়, যা তাঁর স্বাস্থ্য এবং মনের অবস্থাকে ভেঙে দিয়েছিল চূড়ান্তভাবে। এটি ছিল একসময় লন্ডনের সামাজিক কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা অস্কার ওয়াইল্ড নামে এক সৃজনশীল ব্যক্তির উজ্জ্বল জীবনের, শিল্প-সততার কঠোর পতন। আর এই ধস, জীবনবোধের গভীরতা, গ্লানি, হতাশা ব্যাপ্ত হয়েছিল আয়ারল্যান্ডের ডাবলিন পেরিয়ে ফ্রান্সের প্যারিস অবধি।

ওয়াইল্ডের বিচার এবং কারাবাস শুধু ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি হিসেবে নয়, বরং ভিক্টোরিয়ান সমাজের দমনমূলক প্রকৃতির বিরুদ্ধে একটি বৃহত্তর সাংস্কৃতিক বিবৃতি। কারাবাসে থাকার সময় ওয়াইল্ড তাঁর মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতাগুলো “De Profundis” (১৯০৫)-এ বিশদভাবে তুলে ধরেন। এই রচনা ওয়াইল্ডের গভীর আত্মবিশ্লেষণ এবং বেদনার শিল্পিত প্রকাশ, যা তাঁকে দার্শনিক এবং মানসিকভাবে আরও পরিণত করে তোলে। এটা ছিল বোসির প্রতি লেখা একটি দীর্ঘ চিঠি, যেখানে তিনি কষ্ট, ভালোবাসা এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি তাঁর চিন্তাধারাগুলো তুলে ধরেন। শুধু তাই নয়, এটি ওয়াইল্ডের অন্যতম ব্যক্তিগত এবং মননশীল কাজও, যা তাঁর আবেগ এবং দার্শনিক সংগ্রামকে আন্দোলিত করে গভীরতর প্রকাশ ব্যাপ্ততায়। “De Profundis”-এ তিনি তাঁর মানসিক যন্ত্রণা এবং সমাজের প্রতি তাঁর দর্শনকে প্রকাশ করে লেখেন : “I think that the greatest tragedies of life are not the ones we suffer, but the ones we cause others to suffer.”

অস্কার ওয়াইল্ড কারাগারে থাকার সময়ই তাঁর বিখ্যাত কবিতা “The Ballad of Reading Gaol” (১৮৯৮) লিখেছিলেন। এই দীর্ঘ কবিতাটি তাঁর কারাগারের অভিজ্ঞতা এবং একজন বন্দীর ফাঁসি দেখার স্মৃতি থেকে অনুপ্রাণিত। এটি তাঁর জীবনের এক গভীর ট্র্যাজেডি এবং মানবিক অনুভূতির প্রতিচ্ছবি। এই কবিতায় মানবজীবনের কঠোর বাস্তবতা এবং বেদনার নীল অনুভূতিগুলো প্রবলভাবে বিপ্রতীপ অপরতার সন্ধান করে এবং মানুষের অন্তর্নিহিত দুর্বলতা এবং বেদনার অভিজ্ঞতাকে প্রতিফলিত করে। এই দীর্ঘ কবিতার লাইনগুলো ওয়াইল্ডের দার্শনিক এবং নৈতিক গভীরতায় মানুষের জীবনের অন্তর্নিহিত বিষাদ এবং সম্পর্কের জটিলতাকে তুলে ধরেন। কবিতার অন্যতম বিখ্যাত কিছু লাইন : “Yet each man kills the thing he/ loves,/ By each let this be heard,/ Some do it with a bitter look,/ Some with a flattering word,/ The coward does it with a kiss,/ The brave man with a sword!”

১৮৯৭ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর অস্কার ওয়াইল্ড ফ্রান্সে চলে যান। অস্কার ওয়াইল্ড তার জীবনের শেষ দিনগুলো ফ্রান্সের প্যারিসে “LÕHôtel” নামে একটি হোটেলে কাটিয়েছিলেন। এই হোটেলটি প্যারিসের “Rue des Beaux-Arts”-এ অবস্থিত। ওয়াইল্ড এখানে খুবই কষ্টকর পরিস্থিতিতে ছিলেন, আর্থিক দুরবস্থা ও শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছিলেন। এখানে তিনি তাঁর জীবনের বাকি সময়টুকু একপ্রকার অপ্রচার এবং দরিদ্রতার মধ্যে কাটান। নীরস, অর্থহীন জীবনে প্রতিনিয়ত তিনি স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছিলেন এবং কারাবাসের মানসিক ক্ষত তাঁকে কষ্ট দিচ্ছিল মনের গভীরে অভ্রান্তভাবে। ফলে অস্কার ওয়াইল্ড মেনিনজাইটিসে আক্রান্ত হন এবং মাত্র ৪৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। L’Hôtel-এর ১৬ নম্বর ঘরে ১৯০০ সালের ৩০ নভেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়। বর্তমানে, এই হোটেলটি পর্যটকদের জন্য ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে একটি উল্লেখযোগ্য স্থান হিসেবে পরিচিত, এবং সেই ঘরটি বিশেষভাবে অস্কার ওয়াইল্ডের স্মৃতিতেই সংরক্ষিত রয়েছে। প্রকৃতঅর্থে তাঁর মৃত্যু ছিল একটি দুঃখজনক সমাপ্তি, যিনি একসময় সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন শিল্পের অধিকারের সীমানা নিয়ে। ওয়াইল্ডকে “Père Lachaise” গোরস্থানে সমাধীস্থ করা হয় এবং তাঁর সম্মানার্থে কবরটিতে, ভাস্কর জ্যাকব এপস্টেইন দ্বারা নকশা করেন।

অস্কার ওয়াইল্ডের সাহিত্যকর্ম, এবং তাঁর প্রভাব আজও নন্দিত, অপরিসীম। তাঁর নাটকগুলো এখনও সারা বিশ্বে মঞ্চস্থ হয়, এবং উপন্যাস “The Picture of Dorian Gray” গথিক সাহিত্যের এক অনন্য কীর্তি হিসেবে স্বীকৃত। ওয়াইল্ডের রসিকতা, এবং সামাজিক সমালোচনা অসংখ্য লেখককে অনুপ্রাণিত করে- জর্জ বার্নার্ড শ থেকে শুরু করে আধুনিক নাট্যকার টম স্টপার্ড পর্যন্ত। ওয়াইল্ডকে LGBTQ+ সম্প্রদায়ের একজন আইকন হিসেবেও বিবেচনা করা হয়, যিনি কঠোর সামাজিক নিপীড়নের মুখেও তাঁর জীবন এবং সম্পর্কের প্রতি অবিচল থেকেছেন। ওয়াইল্ডের জীবন এবং সাহিত্যকর্ম আমাদের শেখায় যে সৌন্দর্য এবং বেদনা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, এবং শিল্পের মাধ্যমে আমরা জীবনের গভীরতা এবং মানবিক দুর্বলতাগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে পারি।

অস্কার ওয়াইল্ড একবার বলেছিলেন, “We are all in the gutter, but some of us are looking at the stars.” এই উক্তির মাধ্যমে তিনি সৌন্দর্য, বেদনা, এবং মানবজীবনের অম্লান সত্যগুলোকে দৃঢ়করে তুলেছেন। তাঁর সাহিত্যকর্ম ও জীবন সেই অন্বেষণের পথে নিয়েযায়, যেখানে সৌন্দর্য ও বেদনা চিরকালীন এক শিল্পরূপ ধারণ করে। ওয়াইল্ডের সাহিত্য শুধু তাঁর নিজস্ব সময়কালকে নয়, বরং নিঃসময়ের যুগপৎ সত্তার গভীরেও চিরন্তনভাবে সময়প্রবাহকে অনন্ত করে তোলে। সমালোচক হ্যারল্ড ব্লুমের ভাষায়, “To Wilde, beauty was the highest form of art, but it was fleeting, and with that transience came tragedy. Wilde’s life and works show us that beauty is often paired with suffering, a recognition that enhances the aesthetic experience.” অস্কার ওয়াইল্ডের ১৭০তম জন্মদিনে তিনি আজও তাই স্মরণীয়, প্রাসঙ্গিক- আপন শিল্প-প্রত্যয়ে, শিল্প-স্বভাবের জনকরূপে।

back to top