ইকরাম কবীর
আজ ৭ নভেম্বর, ফরাসি লেখক, দার্শনিক, নাট্যকার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলবেয়ার কামুর ১১১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৫৭ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসাবে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই বিরল প্রতিভাধর লেখকের অসামান্য উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এর একটি আলোচনা মুদ্রণের মাধ্যমে জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি ‘সংবাদ সাময়িকী’র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
আলব্যের কামুর উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’ যখন প্রথম পড়েছিলাম, প্রধান চরিত্র ম্যোরসোকে সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছিল। অনেক ভাবিয়েছিল। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের পর কোনো চরিত্র এতো বেশি ভাবালো। একই সাথে সূর্যেরপ্রভাব নিয়ে ম্যোরসোর অসহিষ্ণু আচরণও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ এমন এক সাহিত্যকর্ম যেখানে সূর্য এবং প্রকৃতি প্রধান চরিত্রের মানসিক যাত্রার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করেছে। কামুর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামনে এমন এক জগতের দরজা খুলে দিয়েছে, যেখানে সূর্য শুধু আকাশ থেকে আসা আলোর উৎস নয়, বরং ম্যোরসোর আবেগ, দ্বন্দ্ব এবং সমাজের প্রতি তার বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে আমরা দেখতে পাই।
কামুর লেখা একেবারেই অন্য রকম। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মেলে না। সূর্যেরপ্রতীকী ব্যবহার যা ম্যোরসোর অভিজ্ঞতার একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে গেঁথে যায় তার প্রতিফলন আমরা পুরো উপন্যাসে দেখতে পাই। ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এর ঘটনা প্রবাহের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সূর্য ম্যোরসোর জন্য এক রকম অত্যাচারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মায়ের শেষকৃত্যের দিনেই প্রথম সূর্যের এই প্রভাব আমরা বেশ গভীরভাবে বুঝতে পারি। কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ম্যোরসো সূর্যের তাপ এবং আলোকে বিরক্তিকর বলে মনে করে। সূর্যের তীব্রতা অনাকাক্সিক্ষতভাবে তার মনের ওপর চেপে বসতে দেখা যায়। এখানে সূর্য শুধুই শারীরিক বিরক্তিই তৈরি করে না, মানসিক চাপের প্রতীক হিসেবেও সূর্যটা কাজ করে- যা ম্যোরসোর মনকে অস্থির করে তোলে।
মায়ের শেষকৃত্যের দিনটা ম্যোরসোর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন, কারণ এই দিনেই সে মৃত্যুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে শোকের পরিবর্তে সে সূর্যের তীব্র তাপ ও কড়া আলোকে অনুভব করতে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। সে শোক প্রকাশ করতে চায় তবে এই তাপ তার পথে এক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কামু লিখছেন- “সূর্যটা মাথার ওপরে ছিল, তাপ এতটাই তীব্র ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথার খুলিটা ফেটে যাবে।” এই অনুভূতি ম্যোরসোর ভেতরের অস্থিরতা এবং তার অনুভূতির অসংলগ্নতাকেই প্রকাশ করে। কামু এখানে সূর্যের তাপের মাধ্যমে ম্যোরসোর মনের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং মানসিক চাপকে তুলে ধরেছেন, যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে।
মায়ের শেষকৃত্যে যাওয়ার সময় এবং শেষকৃত্যের সময় সূর্যের যে শক্তি ম্যোরসো অনুভব করে, তা আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করে যখন সে সমুদ্র সৈকতে এক আরব যুবককে খুন করে। এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই হত্যাকা-ের ঘটনাটা সূর্যের তীব্রপ্রভাবের ফলেই ঘটে। ঘটনাটা ঘটে এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সমুদের পাড়ে, যেখানে সূর্য তীব্রভাবে জ্বলছিল। সূর্যের আলো ম্যোরসোর চোখে এমনভাবে পড়ে যে সে আর কিছু দেখতে পায় না। কামু লিখছেন- “সূর্যের তাপে আমার কপাল ফেটে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল... আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না, তবুও সূর্যের আলো আমাকে আটকে রেখেছিল।”
এই দৃশ্যে সূর্য ম্যোরসোর মনে একটি বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা তাকে নিজস্ব ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচনা দেয়।
ম্যোরসোর হাতের পিস্তল এবং সূর্যের আলো একসাথে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য চাপ সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত সে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এখানে সূর্যকে আমরা এক নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র হিসেবে দেখি- যা ম্যোরসোর মনোবৃত্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বোঝা যায় যে, ম্যোরসো নিজে হত্যার দায় স্বীকার করলেও, সূর্য এবং তার তাপের প্রভাব সে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বলে পাঠক মনে করেন। সূর্য এখানে এক প্রতীকী উপাদান হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যা ম্যোরসোর মানসিক অবস্থার জটিলতাকে আমাদের কাছে তুলে ধরে।
‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’ উপন্যাসে সূর্যের আলো এবং অন্ধকারের ব্যবহার হয়েছে দুই রকমভাবে। সূর্য যেমন ম্যোরসোর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি রাতের অন্ধকারে সে কিছুটা শান্তি খুঁজে পায়। রাতে যখন সূর্যের তাপ আর থাকে না, ম্যোরসো তখন নিজের চিন্তাভাবনার মধ্যে ডুবে যেতে পারে এবং নিজের জীবন ও অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে পারে। উপন্যাসের শুরু থেকেই আমরা দেখি এই আলো ও অন্ধকার ম্যোরসোর জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্যের আলো তাকে অস্থির করে, আর রাতের অন্ধকার তাকে এক ধরনের মুক্তি দেয়। কামু এখানে সূর্যের মাধ্যমে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক, অনুভূতির বিপরীতধর্মী দিক এবং মানুষের জীবনের জটিলতাকেও তুলে ধরেছেন বলে মনে হয়।
সূর্য ও প্রকৃতির মাধ্যমে কামু ম্যোরসোর মানসিক অবস্থাকে যেমনটা ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি আবার সমাজের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। ম্যোরসো প্রকৃতির মাঝে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সমাজে নয়। সে সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যের আলো, কিংবা রাতের নীরবতা উপভোগ করে। কিন্তু যখনই সে মানুষের সংস্পর্শে আসে, তখনই সে সামাজিক মূল্যবোধ ও বিচারবোধের চাপ অনুভব করে। তার বিচারের সময়ও দেখা যায়, আদালত তার কর্মের বিচার না করে, তার অনুভূতিহীনতাকে অপরাধ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রকৃতির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা এবং সমাজের সাথে তার দূরত্ব কেবল তার চরিত্রকে নয়, বরং সব মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও সমাজের অবহেলার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এখানে কামু প্রশ্ন তুলেছেন- মানুষ কিপ্রকৃতির অংশ, নাকি সে কৃত্রিম সামাজিক কাঠামোর মধ্যে আটকে পড়েছে?
কামুর অ্যাবসার্ডিজমের দর্শনের অন্যতম একটা দিক হচ্ছে জীবনের অর্থহীনতা এবং সেই অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কীভাবে তার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে। এই উপন্যাসে সূর্যকে জীবনের অর্থহীনতা এবং অনিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে আমরা দেখতে পারি। সূর্যের উপস্থিতি ম্যোরসোর জীবনে এক ধরনের নির্দয় শক্তি হিসেবে কাজ করে যা তাকে তার আবেগ ও অন্যান্য অনুভূতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। হত্যা করার সময় সূর্যের তাপ তার জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। কামুর মতে, এই রকম অভিজ্ঞতা মানুষকে তার জীবনের অর্থহীনতার মুখোমুখি করে এবং এই অর্থহীনতার মধ্যে দিয়েই সে আবার জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করতে চায়।
ম্যোরসোর জীবনের এই অধ্যায়গুলো আমাদের শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা সূর্য ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হই, যা আমাদের মনের অবস্থা এবং সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে। ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ সূর্য কেবল প্রকৃতির একটা অংশ নয়, এটা মানুষের আবেগ, সিদ্ধান্ত ও জীবনের অর্থহীনতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়।
সূর্য এখানে শুধু একটা বাহ্যিক শক্তি নয়, এটা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার প্রতীকী রূপও দেখিয়ে দেয়। ম্যোরসোর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সূর্য তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করে। তার রাগ, হতাশা এবং অনুভূতির সংকটকে আরও প্রভাবিত করে। ম্যোরসোর চরিত্রের দ্বিধা ও মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা বুঝতে হলে সূযের্র এই ভূমিকা গভীরভাবে অনুধাবন করলে আরও ভালো করে ম্যোরসোকে বোঝা যাবে।
এই উপন্যাসে সূর্য এবং প্রকৃতির ব্যবহার আমাদের জীবনের অস্থিরতারও প্রতিফলন। সূর্য ম্যোরসোর জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাকে এমন সব কাজ করতে বাধ্য করে যা সে নিজেও বোঝে না। সূর্যের তাপ এবং আলো ম্যোরসোর অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার একাকীত্ব এবং সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই প্রতীকী উপাদানগুলো আমাদের জীবনের চিরন্তন প্রশ্নগুলোকে নতুনভাবে চিন্তা করতে আমাদের শেখায়।
এই গল্পে প্রকৃতি এবং সূর্যের উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা প্রকৃতির সাথে কতটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের মন ও শরীরের প্রতিক্রিয়া প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় এবং কখনও কখনও আমাদের আবেগ ও চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কামু তার এই উপন্যাসে প্রকৃতির মাধ্যমে যে জটিলতা তুলে ধরেছেন, তা আমাদের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে নতুন করে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়।
ইকরাম কবীর
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪
আজ ৭ নভেম্বর, ফরাসি লেখক, দার্শনিক, নাট্যকার, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আলবেয়ার কামুর ১১১তম জন্মবার্ষিকী। ১৯৫৭ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে দ্বিতীয় কনিষ্ঠতম ব্যক্তি হিসাবে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। এই বিরল প্রতিভাধর লেখকের অসামান্য উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এর একটি আলোচনা মুদ্রণের মাধ্যমে জন্মবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি ‘সংবাদ সাময়িকী’র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন।
আলব্যের কামুর উপন্যাস ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’ যখন প্রথম পড়েছিলাম, প্রধান চরিত্র ম্যোরসোকে সবচেয়ে বেশি মনে ধরেছিল। অনেক ভাবিয়েছিল। শেক্সপিয়ারের হ্যামলেটের পর কোনো চরিত্র এতো বেশি ভাবালো। একই সাথে সূর্যেরপ্রভাব নিয়ে ম্যোরসোর অসহিষ্ণু আচরণও ছিল চোখে পড়ার মতো। এ এমন এক সাহিত্যকর্ম যেখানে সূর্য এবং প্রকৃতি প্রধান চরিত্রের মানসিক যাত্রার প্রতিফলন হিসেবে কাজ করেছে। কামুর দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের সামনে এমন এক জগতের দরজা খুলে দিয়েছে, যেখানে সূর্য শুধু আকাশ থেকে আসা আলোর উৎস নয়, বরং ম্যোরসোর আবেগ, দ্বন্দ্ব এবং সমাজের প্রতি তার বিদ্রোহের প্রতীক হিসেবে আমরা দেখতে পাই।
কামুর লেখা একেবারেই অন্য রকম। প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে মেলে না। সূর্যেরপ্রতীকী ব্যবহার যা ম্যোরসোর অভিজ্ঞতার একেবারে কেন্দ্রে গিয়ে গেঁথে যায় তার প্রতিফলন আমরা পুরো উপন্যাসে দেখতে পাই। ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এর ঘটনা প্রবাহের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সূর্য ম্যোরসোর জন্য এক রকম অত্যাচারী শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়। মায়ের শেষকৃত্যের দিনেই প্রথম সূর্যের এই প্রভাব আমরা বেশ গভীরভাবে বুঝতে পারি। কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে ম্যোরসো সূর্যের তাপ এবং আলোকে বিরক্তিকর বলে মনে করে। সূর্যের তীব্রতা অনাকাক্সিক্ষতভাবে তার মনের ওপর চেপে বসতে দেখা যায়। এখানে সূর্য শুধুই শারীরিক বিরক্তিই তৈরি করে না, মানসিক চাপের প্রতীক হিসেবেও সূর্যটা কাজ করে- যা ম্যোরসোর মনকে অস্থির করে তোলে।
মায়ের শেষকৃত্যের দিনটা ম্যোরসোর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ দিন, কারণ এই দিনেই সে মৃত্যুর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়। কিন্তু মায়ের মৃত্যুতে শোকের পরিবর্তে সে সূর্যের তীব্র তাপ ও কড়া আলোকে অনুভব করতে বেশি মনোযোগী হয়ে পড়ে। সে শোক প্রকাশ করতে চায় তবে এই তাপ তার পথে এক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কামু লিখছেন- “সূর্যটা মাথার ওপরে ছিল, তাপ এতটাই তীব্র ছিল যে মনে হচ্ছিল মাথার খুলিটা ফেটে যাবে।” এই অনুভূতি ম্যোরসোর ভেতরের অস্থিরতা এবং তার অনুভূতির অসংলগ্নতাকেই প্রকাশ করে। কামু এখানে সূর্যের তাপের মাধ্যমে ম্যোরসোর মনের ভেতরের দ্বন্দ্ব এবং মানসিক চাপকে তুলে ধরেছেন, যা সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার মানসিকতাকে প্রতিফলিত করে।
মায়ের শেষকৃত্যে যাওয়ার সময় এবং শেষকৃত্যের সময় সূর্যের যে শক্তি ম্যোরসো অনুভব করে, তা আরও বেশি প্রভাব বিস্তার করে যখন সে সমুদ্র সৈকতে এক আরব যুবককে খুন করে। এই উপন্যাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই হত্যাকা-ের ঘটনাটা সূর্যের তীব্রপ্রভাবের ফলেই ঘটে। ঘটনাটা ঘটে এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনের সমুদের পাড়ে, যেখানে সূর্য তীব্রভাবে জ্বলছিল। সূর্যের আলো ম্যোরসোর চোখে এমনভাবে পড়ে যে সে আর কিছু দেখতে পায় না। কামু লিখছেন- “সূর্যের তাপে আমার কপাল ফেটে পড়ার মত অবস্থা হয়েছিল... আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না, তবুও সূর্যের আলো আমাকে আটকে রেখেছিল।”
এই দৃশ্যে সূর্য ম্যোরসোর মনে একটি বিরোধী শক্তি হিসেবে কাজ করে, যা তাকে নিজস্ব ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করতে প্ররোচনা দেয়।
ম্যোরসোর হাতের পিস্তল এবং সূর্যের আলো একসাথে এক ধরনের অপ্রতিরোধ্য চাপ সৃষ্টি করে, যা শেষ পর্যন্ত সে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এখানে সূর্যকে আমরা এক নৈর্ব্যক্তিক চরিত্র হিসেবে দেখি- যা ম্যোরসোর মনোবৃত্তির ওপর গভীর প্রভাব ফেলে। বোঝা যায় যে, ম্যোরসো নিজে হত্যার দায় স্বীকার করলেও, সূর্য এবং তার তাপের প্রভাব সে এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছে বলে পাঠক মনে করেন। সূর্য এখানে এক প্রতীকী উপাদান হিসেবে প্রতীয়মান হয়, যা ম্যোরসোর মানসিক অবস্থার জটিলতাকে আমাদের কাছে তুলে ধরে।
‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’ উপন্যাসে সূর্যের আলো এবং অন্ধকারের ব্যবহার হয়েছে দুই রকমভাবে। সূর্য যেমন ম্যোরসোর জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি রাতের অন্ধকারে সে কিছুটা শান্তি খুঁজে পায়। রাতে যখন সূর্যের তাপ আর থাকে না, ম্যোরসো তখন নিজের চিন্তাভাবনার মধ্যে ডুবে যেতে পারে এবং নিজের জীবন ও অস্তিত্ব নিয়ে ভাবতে পারে। উপন্যাসের শুরু থেকেই আমরা দেখি এই আলো ও অন্ধকার ম্যোরসোর জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তকে নিয়ন্ত্রণ করে। সূর্যের আলো তাকে অস্থির করে, আর রাতের অন্ধকার তাকে এক ধরনের মুক্তি দেয়। কামু এখানে সূর্যের মাধ্যমে জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে সম্পর্ক, অনুভূতির বিপরীতধর্মী দিক এবং মানুষের জীবনের জটিলতাকেও তুলে ধরেছেন বলে মনে হয়।
সূর্য ও প্রকৃতির মাধ্যমে কামু ম্যোরসোর মানসিক অবস্থাকে যেমনটা ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনি আবার সমাজের সঙ্গে তার বিচ্ছিন্নতার প্রতিফলন দেখিয়েছেন। ম্যোরসো প্রকৃতির মাঝে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে, সমাজে নয়। সে সমুদ্রের ঢেউ, সূর্যের আলো, কিংবা রাতের নীরবতা উপভোগ করে। কিন্তু যখনই সে মানুষের সংস্পর্শে আসে, তখনই সে সামাজিক মূল্যবোধ ও বিচারবোধের চাপ অনুভব করে। তার বিচারের সময়ও দেখা যায়, আদালত তার কর্মের বিচার না করে, তার অনুভূতিহীনতাকে অপরাধ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়। প্রকৃতির সাথে তার ঘনিষ্ঠতা এবং সমাজের সাথে তার দূরত্ব কেবল তার চরিত্রকে নয়, বরং সব মানুষের বিচ্ছিন্নতা ও সমাজের অবহেলার প্রতীক হিসেবে কাজ করে। এখানে কামু প্রশ্ন তুলেছেন- মানুষ কিপ্রকৃতির অংশ, নাকি সে কৃত্রিম সামাজিক কাঠামোর মধ্যে আটকে পড়েছে?
কামুর অ্যাবসার্ডিজমের দর্শনের অন্যতম একটা দিক হচ্ছে জীবনের অর্থহীনতা এবং সেই অর্থহীনতার মুখোমুখি হয়ে মানুষ কীভাবে তার অস্তিত্বকে সংজ্ঞায়িত করে। এই উপন্যাসে সূর্যকে জীবনের অর্থহীনতা এবং অনিশ্চয়তার প্রতীক হিসেবে আমরা দেখতে পারি। সূর্যের উপস্থিতি ম্যোরসোর জীবনে এক ধরনের নির্দয় শক্তি হিসেবে কাজ করে যা তাকে তার আবেগ ও অন্যান্য অনুভূতির দিকে টেনে নিয়ে যায়। হত্যা করার সময় সূর্যের তাপ তার জন্য সহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে এবং সে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারায়। কামুর মতে, এই রকম অভিজ্ঞতা মানুষকে তার জীবনের অর্থহীনতার মুখোমুখি করে এবং এই অর্থহীনতার মধ্যে দিয়েই সে আবার জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে বের করতে চায়।
ম্যোরসোর জীবনের এই অধ্যায়গুলো আমাদের শেখায় যে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আমরা সূর্য ও প্রকৃতির বিভিন্ন প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি হই, যা আমাদের মনের অবস্থা এবং সিদ্ধান্তগুলোকে প্রভাবিত করে। ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ সূর্য কেবল প্রকৃতির একটা অংশ নয়, এটা মানুষের আবেগ, সিদ্ধান্ত ও জীবনের অর্থহীনতার প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গির জন্ম দেয়।
সূর্য এখানে শুধু একটা বাহ্যিক শক্তি নয়, এটা আমাদের মনস্তাত্ত্বিক অভিজ্ঞতার প্রতীকী রূপও দেখিয়ে দেয়। ম্যোরসোর জীবনের প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সূর্য তার মানসিক অবস্থা পরিবর্তন করে। তার রাগ, হতাশা এবং অনুভূতির সংকটকে আরও প্রভাবিত করে। ম্যোরসোর চরিত্রের দ্বিধা ও মনস্তাত্ত্বিক যন্ত্রণা বুঝতে হলে সূযের্র এই ভূমিকা গভীরভাবে অনুধাবন করলে আরও ভালো করে ম্যোরসোকে বোঝা যাবে।
এই উপন্যাসে সূর্য এবং প্রকৃতির ব্যবহার আমাদের জীবনের অস্থিরতারও প্রতিফলন। সূর্য ম্যোরসোর জীবনকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করে এবং তাকে এমন সব কাজ করতে বাধ্য করে যা সে নিজেও বোঝে না। সূর্যের তাপ এবং আলো ম্যোরসোর অন্তর্দ্বন্দ্ব, তার একাকীত্ব এবং সমাজের প্রচলিত রীতিনীতির বিরুদ্ধে তার বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এই প্রতীকী উপাদানগুলো আমাদের জীবনের চিরন্তন প্রশ্নগুলোকে নতুনভাবে চিন্তা করতে আমাদের শেখায়।
এই গল্পে প্রকৃতি এবং সূর্যের উপস্থিতি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা প্রকৃতির সাথে কতটা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আমাদের মন ও শরীরের প্রতিক্রিয়া প্রকৃতির পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয় এবং কখনও কখনও আমাদের আবেগ ও চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। কামু তার এই উপন্যাসে প্রকৃতির মাধ্যমে যে জটিলতা তুলে ধরেছেন, তা আমাদের জীবনের বিভিন্ন মুহূর্তে নতুন করে উপলব্ধি করার সুযোগ করে দেয়।