গৌতম গুহ রায়
১৯৬৮’র ৪ অক্টোবর আমার জন্মশহরের এক প্লাবন-প্রলয় রাত। সেই প্লাবনের চিহ্ন অনেক বছর আমার শহরের মাটিতে রয়ে গিয়েছিলো। এর বছর দশেক পরে আমার বাবা তাঁর নষ্ট বুকসেলফ থেকে একদিন একটি বন্যার পলিমাখা বই বের করে দিলেন। প্রথম কয়েকটি পাতা নদীর রুপালি পলিমাটিতে পুরু হয়ে ছিল তখনো, বিপন্ন মানুষের অসহায় হনন রাতের চিহ্ন। বইটি ছিল ফিওদর দস্তয়েভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। দস্তয়েভস্কির সঙ্গে আমার সেই আলাপ যদিও খুব একটা এগোয়নি, তবে পলিমাখা বইটা রয়ে গেছে। সদ্য কিশোরের মনে ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির ডার্কও ড্রামাটিক জীবনকথার প্রতিফলন নিয়েই তাঁর উপন্যাসগুলো, চরিত্রের প্রতি সেই প্রাথমিক আলাপের টান তবুও কোথাও রয়ে গিয়েছিলো।
১৮৩৯-এ ১৮ বছরের কিশোর দস্তয়েভস্কি তাঁর দাদা মিখাইলকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, “Man is a mystery : if you spend your entire life trying to puzzle it out, then do not say that you have wasted your time. I occupy myself with this mystery, because I want to be a man” সাম্প্রতিক কালের নিরিখে এক চিরশ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক তাঁর যাবতীয় কর্মকা- মানুষের এই রহস্যময় চরিত্রের খোঁজে অতিবাহিত করেছিলেন। এই কারণেই হয়তো দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে কোনো নৈসর্গিক বর্ণনা বা ল্যান্ডস্কেপের দেখা মেলে না। তাঁর সৃজন বিশ্বের চরিত্রেরা সমসাময়িক সময়ের নাগরিক সমাজের দ্বন্দ্বদীর্ণ মানুষ। “The Russian novelist first discovered the real face of the hero of our Ôtroubled timeÕÑ the Ôman from undergroundÕ : this new Hamlet is struck by the infirmity of doubt, poisoned by reflection, doomed to a lack of will and inertia. He is tragically alone and divided in two; he has the consciousness of an Ôharassed mouseÕ.Ó (DostoevsKz : His life and Work, by Konstantin Mochulsky)।
আমার বাবার হাত থেকে রুপালি বন্যার পলিমাখা ‘অপরাধ ও শাস্তি’ প্রাপ্তির কয়েক বছর পরে আমার প্রকৃত আলাপ হয় ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের রহস্যময় মননের দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে, তাঁর সাহিত্যই এই সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিলো। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর হাতে এলো ‘ব্র্রাদার কারমাজোভ’; অনেকের মতে বিশ্বসাহিত্যর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি এই উপন্যাসটি। এটি দস্তয়েভস্কির লেখা অন্তিম উপন্যাস, এটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্র তিন মাস পরেই দস্তয়েভস্কির প্রয়াণ ঘটে। জীবনের অন্তিম সময়কাল তাঁর চূড়ান্ত পরিশ্রমকৃত এই শৈল্পিক কা-ের শরীর নির্মাণে তিনি নিজেকে ব্যাপ্ত রাখেন। যদিও গোটা জীবনই তিনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের আবরণ উন্মোচনের কাজ করে গেছেন, ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ তাঁর এই কাজের চূড়ান্ত প্রকাশ, যার মধ্যে একজন সাহিত্যিকের গোটা শিল্প জীবনের ‘অর্গানিক ইউনিটি’ ধরা থাকে। তাঁর চিন্তা, চেতনা, সৃজনভাবনার জগতটা একপাত্রে ধরা থাকে আখ্যানের এই বিস্তৃত জমিতে। সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক জগতের নানা রহস্যময় আলো-আঁধারি নিয়ে আর কোনো লেখকের লেখায় দস্তয়েভস্কির মতো এমন নির্মোহ বয়ান পাওয়া যায় না। মনস্তত্ত্ব জগতের অবিসংবাদী বয়ানকার সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘দ্য মোস্ট সিগনিফিক্যান্ট নভেল ইন ওয়ার্ল্ড লিটারেচার’। ‘ইউলিসিস’ ¯্রষ্টা জেমস জয়েস দস্তয়েভস্কিকে অন্য সবার থেকে এগিয়ে রাখতেন তাঁর সাহিত্যের ভেতরের ‘উন্মাদনাগ্রস্ত এনার্জি’র জন্য।
রুশ সাহিত্যে দস্তয়েভস্কি তাঁর আগমন-মুহূর্তে তুলনীয় ছিলেন প্রকৃতিবাদী গোগলের সঙ্গে। কিন্তু ১৮৪৫ ও তার পরবর্তী প্রায় অর্ধশতক ধরে ক্রমশ তিনি রুশ তথা বিশ্বসাহিত্যেই এক স্বতন্ত্র ধারার সংযোজন ঘটান। যে সময় ব্যক্তি মানুষের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণের বাস্তববাদী বয়ান রচিত হচ্ছিলো, দস্তয়েভস্কি সেখান থেকে অনেকটা দূরতম প্রান্তে মানুষের মানসিক মানচিত্রের জটিল রেখাসমূহের স্বতন্ত্র বয়ান লিখছিলেন। তিনি পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যে ব্যক্তি মানুষের চিরন্তন অসংগতি, দ্বৈত বোধ, দ্বৈত সত্তা, সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের নিরন্তর দ্বিধা ও টানাপোড়েন, ধর্মীয় নৈতিকতা- ব্যক্তি ও সামাজিক, এই সমস্ত বিষয়ের বাস্তবতার শেকড়ে পাঠককে নিয়ে যান, সাহিত্যে এভাবে জীবনকে দেখানোর কাজে তিনিই প্রাথমিক স্রষ্টা ছিলেন বলা হয়, এখানেই তাঁর সঙ্গে বিরোধ বাঁধে তৎকালীন মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকদের। দস্তয়েভস্কির সমস্ত উপন্যাসেই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতের বহুস্থরীয় বিন্যাসের খোঁজ পাওয়া যায়। মন ও হৃদয়ের দ্বন্দ্ব তাঁকেও প্রতিনিয়ত আক্রান্ত করেছে, এর প্রভাবে দস্তয়েভস্কির মধ্যে আমরা দেখি যে সেখানে প্রকট এক দ্বৈতসত্ত্বা জাগ্রতভাবে বিরাজমান। একদিকে তাঁর মধ্যে সক্রিয় নাস্তিকতা, অপরদিকে ঐতিহ্যগতভাবে আস্তিক্যের টানাপোড়ন এক আলো-আঁধারির জন্ম নিয়েছিল। এই সংশয়ের নির্মাণেই তাঁর উপন্যাসগুলি অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
জলপাইগুড়ি শহরের কেন্দ্রের ‘মুর্শিদাবাদ হাউস’-এ এক শীতের বিকালে আমাকে ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ড্রারগ্রাউন্ড’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন কবি শামসের আনোয়ার, সাল ১৯৮৪। এরপর নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম ‘নোটস ফ্রম দ্য অন্ডারগ্রাউন্ড’, এরপর আবারো আলমারি থেকে নামানো সেই ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। অন্তরে আমি তখন আইনস্টাইনের সেই কথার ধ্বনি অনুভব করতে পারি, ‘যদি ফিজিক্স বুঝতে চাও, তাহলে দস্তয়েভস্কি পড়ো’। বুঝতে পারি কেনো আন্দ্রে জিদ তাঁকে রেমব্র্রার মতোই মহৎ চিত্রকর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দার্শনিক নীটশের সঙ্গে দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণকে নৈকট্যে রাখেন অনেক আলোচক। নীটশে নিজেই বলেছিলেন, ‘দস্তয়েভস্কি, একমাত্র একজনই মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমাকে কিছু শিখিয়েছেন”। যদিও দুজনে মানসিকতায় দুই মেরুর বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু দুজনেই (কনফেশান) আত্ম-বয়ান শ্রবণ করা পুরোহিত বা যাজকদের সেই স্তরভুক্ত ছিলেন তাঁরা, যাদের অন্তঃদৃষ্টির পর্দায় মানবপ্রকৃতির কিছু গভীর অনুভূতি ধরা পড়তো।
এই আড্ডায় শ্যামল সিংহ দস্তয়েভস্কিকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যখন বন্দুকের ট্রিগার তোমার খুলি লক্ষ্য করে ধরা হয় তখনই তোমার শ্রেষ্ঠ লেখাটি জন্ম নেয়’। শুধু এই উপন্যাসটি নয় দস্তয়েভস্কি তাঁর প্রতিটি আখ্যানেই সামাজিক মানুষের, আমাদের নৈতিক মানদ-ের পাপ পুণ্য বোধ, ন্যায় অন্যায়ের মানদ- নতুন উন্মেষে স্বতন্ত্র এক জগতের সামনে দাঁড় করান। তাঁর সাহিত্যের চরিত্রগুলো আমাদের অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করে, আমাদের স্থিতাবস্থাকে আক্রমণ করে। এই আয়ুধ ছড়িয়ে আছে তাঁর ‘নোটস ফ্রম দ্য অন্ডারগ্রাউন্ড’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘দি ইটারনাল হাসব্যান্ড’, ‘দ্যাল্যান্ডলেডি’, ‘ইডিয়ট’, ‘ব্র্রাদারস কারামাজোভ’-এ।
বাংলা ভাষায় আধুনিক সাহিত্য আলোচনায় যার ভূমিকাকে কখনই অস্বীকার করা যাবে না তিনি নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসু। তিনি আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের যাত্রাস্থল প্রসঙ্গে দুজনের নাম উল্লেখ করেছেন, এই দুজনেই ২০২১-এ দুশ’তে পড়লেন। একজন কবিতায় বোদলেয়ার, অন্যজন কথাসাহিত্যে দস্তয়েভস্কি। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘...গদ্য ও পদ্যের বিভাগ অনুসারে, যদি আমাদের বেছে নিতে হয়, তাহলে, নিঃসন্দেহে, এই দুজনেরই নাম করবো আমরা: একজন ‘ল ফ্লুর দ্যু মাল’-এর কবি, অন্যজন রাসকোলনিকভ, প্রিন্স মিশকিন ও কারমাজোভদের ¯্রষ্টা। ...শুধু এটুকু বলে সরে যাবো যে টলস্টয় যেন বিরাট, প্রাচীন ও রহস্যময় এক বিগ্রহ, যার সামনে দাঁড়ালে ভক্তিতে ও ভয়ে আমাদের মাথা নুয়ে আসে, আর দস্তয়েভস্কিকে দেখামাত্র আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠি- ‘দ্যাখো, এই যে মানুষ’। এই প্রভেদের জন্যই না বললেও চলে, আধুনিক কালে দস্তয়েভস্কির আবেদন বেশি ব্যাপক ও তীব্র্র।
দস্তয়েভস্কির সৃজনের বিশ্বে প্রবেশের আগে তাঁর শেকড়ের পরিচয় নেওয়া প্রয়োজন, লেখকের বিচরণ ক্ষেত্রের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ নেওয়া প্রয়োজন। আজকের রাশিয়ার পূর্ব মানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বেলারুশ। এই বেলারুশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল দস্তয়েভো। এই দস্তয়েভোর বিস্তীর্ণ ভূসম্পত্তির মালিকানা দানিলো ইরতিশ্চের হাতে চলে যায় ১৫০৬ নাগাদ। সেই থেকে নিজেকে স্থান নামের সঙ্গে জুড়ে নেন। নতুন নামে পরিচিত হন, দানিলো দস্তয়েভস্কি। অর্থাৎ দস্তয়েভ গ্রামের দানিলো। বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠির নামের সঙ্গেই স্থান নামের সংযুক্তি থাকে, আমাদের দক্ষিণ ভারতে বা উর্দু কবিদের নামে স্থান নাম যুক্ত থাকার উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। শায়ের লুধিয়ানভি, মজরু সুলতানপুরি নাম বুঝিয়ে দেয় তাঁদের শেকড় কোথায়, এ শিল্পীর পরিচিত নাম। কিন্তু দানিলোর ক্ষেত্রে তাঁর গ্রামের নাম পদবী হিসাবেই যুক্ত হয়ে যায়। নিজেদের বংশগত পেশা ধর্মীয় পুরোহিত বললেও আসলে তাঁদের রক্তে বহমান ছিলো তাতার দস্যুর রক্ত। পরবর্তীতে দস্তয়েভস্কির পূর্বপুরুষেরা ইউক্রেনে চলে আসেন। এই বংশধারার কয়েক প্রজন্ম পরে এক দস্তয়েভস্কি বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে লিখলেন, ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি। মাদস্তয়েস্কাভায়া মারিয়া ফিওদোরভার কোল আলো করে মস্কোতে ১৮২১-এর ১১ নভেম্বর (সেদেশের ক্যালেন্ডারের তারিখ ৩০ অক্টোবর) জন্ম নেন দস্তয়েভস্কি। মস্কোর যে দাতব্য হাসপাতালে ফিওদরের জন্ম হয় তাঁর বাবা মিখাইল আন্দ্রেভিচ দস্তয়েভস্কি সেই হাসপাতেলেরই চিকিৎসক ছিলেন। ছাত্রাবস্তাতেই আন্দ্রেভিচ দস্তয়েভস্কি ইউক্রেন থেকে মস্কোতে চলে এসেছিলেন। এই শিশু ফিওদর দস্তয়েভস্কি পরবর্তীতে বিশ্বের প্রধানতম সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। ১৭০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প ও উপন্যাস। দস্তয়েভস্কির লেখা গল্পের সংখ্যা ১৭টি এবং উপন্যাসের সংখ্যা ১৬টি। এর বাইরেও নানা ধরনের লেখালেখি রয়েছে এই মহান সাহিত্য ¯্রষ্ঠার। প্রাথমিকভাবে তিনি অনুবাদের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশের কাজ শুরু করেছিলেন। যদিও এর আগে সাহিত্যচর্চায় তাঁর সলতে পাকানো পর্বে তিনি দুটি ঐতিহাসিক নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন, ১৮৪০-৪১ নাগাদ। এর আগের বছর, ১৯৩৯-এ তাঁর বাবা মারা যান বা খুন হন। ‘মারিয়া স্ট্যার্ট’ ও ‘বরিস গোদুনভ’ নামে যে দুটি ঐতিহাসিক নাটক লিখতে চেয়েছিলেন সে দুটি আর শেষ করা হয়নি দস্তয়েভস্কির। এর তিন বছর পরে তিনি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক হন। এই সময়েই তিনি অনুবাদ করলেন ‘অনারে দ্য বালজাক’, তখন তিনি ২৩ বছরের তরুণ। এরপর ফসারি নাটক ‘ইউজেনি গ্রান্দে’র অনুবাদ করেন। বালজাকের এই ফরাসি নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৩৩ নাগাদ। দস্তয়েভস্কি বালজাক ছাড়াও শিলার, জর্জ স্যান্ডসহ অনেকের সাহিত্য ইংরাজি থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
“Eugenie Grandet-এর পত্রিকা Reperture Ponteon-এর ১৮৪৪-এর জুন ও জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত হলো বালজাকের অনুবাদ। এছাড়াও ভাল ও মন্দের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত উপজীব্য অজ¯্র প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। দস্তয়েভস্কির ডায়েরি ও চিঠিও উচ্চমানের সাহিত্য হিসাবে স্বীকৃত।
দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস ‘পুয়োর ফোক’ থেকে ‘দ্য ব্র্রাদারস কারমাজভ’, ‘দ্য ডাবল, ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর মতো বেশ কিছু পাঠক চর্চিত উপন্যাসের মধ্য থেকে অনেকেই কিছুটা এগিয়ে রাখেন তাঁর ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’কে। ১৮৬৬তে প্রকশিত এই উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাসের অন্যতম। এক কুসীদজীবীর হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে এই উপন্যাসের নির্মাণ। হত্যাকারী হিসাবে উঠে এসেছে রাস্কলনিকভের নাম, কেন সে এই হত্যা করলো? পাপ কাকে বলে? সমাজ, আইন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নিয়মের গন্ডি কতটা? এই রাস্কলনিকভের নিজেকে নিজেরই বৃত্তে জড়িয়ে রাখা, এমন নানা জটিল মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত চিত্রণের আখ্যান বিশ্বসাহিত্যের প্রধানতম উপন্যাস এই ‘অপরাধ ও শাস্তি’। ঈশ্বর নিয়ে এক স্বতন্ত্র বয়ান তাঁর উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। ঈশ্বর প্রশ্নে তিনি এক দ্বিধাগ্রস্ত সময় অতিবাহিত করেন, তাঁর লেখা এই বার্তাই দেয় যে, মানুষের মানসিক কৃতদাসত্বই তাকে ধর্মের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের দিকে নিয়ে যায়। ১৮৭০-এ সে আপেলন মাইকভকে এক পত্র লিখেছিলেন যে, ‘The main question, which has tormented me consciously or unconsciously throughout my entire lifeÑ the existence of God’. দস্তয়েভস্কির সমস্ত ‘হিরো’ই ঈশ্বর কতৃক উৎপীড়িত এবং তাঁরা প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এই ঈশ্বর চেতানা, অস্তিবাদ তাঁদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভিত রচিত করে।এখানে অস্তিবাদ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাইছি, সমকালীন সাহিত্যে অস্তিবাদ নতুন হলেও এর শেকড় রয়েছে হিব্রু সাহিত্য ও জার্মান কল্পরমাবাদ বা রোমান্টিসিজমের মধ্যে। জার্মান দার্শনিক এডমুন্ড হুসালের ফোনোমেনোলজি থেকে আধুনিক কালে অস্তিবাদের পুনঃপ্রকাশ, তবে সোরেন কিয়ের্কেগাদের চিন্তায় এই অস্তিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রথম পরিলক্ষিত হয়েছিল, কিয়েকেগার্দকেই তাই অস্তিবাদের আদিগুরু বলে মেনে নেওয়া যায়।
দার্শনিক ভিক্টর শক্লভস্কি লিখেছেন যে দস্তয়েভস্কির সমকালকে না জেনে থাকলে তাঁকে জানা যায় না। রাসকোলনিকভ কেন অত উঁচুর থেকে অত ভারি এক অস্ত্র দিয়ে ওই বৃদ্ধা মহিলাকে এমনভাবে আঘাত করল যে তার গলা কতোকটা মুরগির মত ঝুলে পড়েছিল? কেন সেই মহিলাকে কুড়ুল দিয়ে খুন করেছিল?... এই অপরাধের পেছনে কী কারণ রয়েছে? দস্তয়েভস্কি কেন প্রথাগত গোয়েন্দা গল্পের ধারা অবলম্বন করলেন না? কে অপরাধ করেছে সে প্রশ্ন না তুলে কেন তিনি তাঁর পরিবর্তে প্রশ্ন তুললেন অপরাধ কী?
‘কুঠার’ বা কুড়ুল ছিল কৃষকদের একমাত্র অস্ত্র। সেরনিভস্কির হাতে কুড়ুল তুলে নেওয়ার কথা বলে ‘দ্য পজেড’ উপন্যাসে কুঠারের উল্লেখ আছে। ‘দ্য কারমাজভ ব্র্রাদার্স’ উপন্যাসে ইভানের সামনে শয়তান এসে উপস্থিত হয় আর বলে যে সে ঠা-ায় জমে যাচ্ছে। সে একটা সুট আর বো-টাই পড়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল (আর তার বিশাল একটা কুকুরের লেজও ছিল)। সে ইভানকে বলে যে বাইরে সাইবেরিয়ার মতো ঠা-া, যে সাইবেরিয়াতে মেয়েরা মজা করে পুরুষদের ঠা-া কুড়ুলের গাটে চুমু খাওয়ার, যাতে পুরুষদের ঠোঁট জমে যায়। ইভান কারমাজভ এত রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কী ধরনের কুড়–ল?’ শয়তান উত্তর দিয়েছিল, “একটা কুড়ুলের যদি যথেষ্ট প্রাথমিক গতিবেগ থাকে, তাহলে সে কুড়ুল পৃথিবীর এক উপগ্রহে পরিণত হবে, আর দিনপঞ্জিকাগুলো আমাদের জানাবে কোন সময়ে সেই কুড়ুল উঠবে আর কোন সময়ে সেই কুড়ুল নামবে।” সময়ের এই অবিনশ্বর কুড়ুল দস্তয়েভস্কির চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো এই ‘কুড়ুল’ মোটিফ হাতে নিয়ে সঞ্চারমান। ১৮৬৪তে লেখা দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর অন্তিম অংশে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য দেখি আমরা, একটি আদর্শ যুক্তিবাদী সমাজের গঠন সম্ভব হলেও সে সামজেও কিন্তু সেরকম ব্যক্তি পাওয়া যাবে, যিনি সমস্ত ধরনের যুক্তিবাদিতাকে ছুঁড়ে ফেলে নির্বোধের স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের কথা বলবেন। দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে ধর্মবিশ্বাস ও অর্থের অভাব প্রাথমিক জীবনে তাঁকে যেভাবে তাড়িত করেছে তার প্রভাব তাঁর সমস্ত লেখাতেই ছাপ রেখেছে, সেই অভিজ্ঞতাকেই যেন তিনি পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করেছেন, বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন।
কেবলমাত্র ব্যক্তি জীবনেই তিনি আক্রান্ত হননি বা বিপর্যয়ের মোকাবিলা করেন নি, সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর মূল্যায়নেও তাঁকে নানাভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭১-এ তিনি তাঁর প্রবাসকাল সমাপ্ত করে ফিরে আসেন। ‘ব্র্রাদার কার্মাজভ’-এর পর তাঁকে রুশী পাঠকদের একাংশ রক্ষণশীল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা বলে অভিহিত করতে থাকেন। ১৮৬৪তে জার্মানির কাগজে কাউন্ট মিলচিওর দি ভোগে-এ এক প্রবন্ধে তাঁকে কারাগারের দুঃখবাদী, পাগলা আশ্রমের শেক্সপিয়ার, তাঁর নিগ্রহ ধর্মের প্রবক্তা বলে অভিহিত করেন। ভোগ-এর মতে ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ ছাড়া অন্যগুলো অপাঠ্য। আর এক আলোচক এমিল হ্যানিকুইন দস্তয়েভস্কির যুক্তি বর্জন, পাগলামি বিষয়ের উল্লাস, বোকামি, নষ্টামিকে তুলে ধরে দস্তয়েভস্কির মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করেন। ড্যানিশ সমালোচক দেখান যে দস্তয়েভস্কি ‘অস্পৃশ্যদের নৈতিকতা ও দাসদের নৈতিকতা’র প্রচার চালাচ্ছেন।
এর এক দশক পরে, ১৮৮০-র ৮ জুন, তাঁর পুশকিন বিষয়ক বক্তৃতার পর দস্তয়েভস্কির অনুগামীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে, বিখ্যাত পপুলিস্ট নিকলো মিখাইলোভস্কি সূত্র সন্ধানী হয়ে বললেন, ‘দস্তয়েভস্কি এক নিষ্ঠুর প্রতিভা, এক স্যাডিস্ট, যিনি নিগ্রহ উপভোগ করেন, প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থা তৈরি করে অত্যাচারীদের ও অত্যাচারকারীকে।... তিনি আমাদের সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণিয়, সবচেয়ে টিপিকাল। বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে দেখাতে ভুলে গেছেন’।
বিগত শতকেও দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষের এই আলোচনা চলতে থাকে। রুশী প্রতীকবাদী দিমিত্রি মোরেজকভস্কি তুলনামূলক আলোচনায় দস্তয়েভস্কি প্রসঙ্গে লিখেন যে তিনি বাস্তববাদী নন, প্রতীকবাদী। তিনি সমাজ পরিস্থিতি বর্ণনা করেন না, বরং হাজির করেন আইডিয়ার ট্রাজেডি। তিনি নব্য এক ধর্মের প্রফেট, শিল্প জগতে। কিন্তু ইমেজ পরিকল্পিত, তাঁর সাহিত্যের অভিমুখ অধঃগামী এবং অতি নাটকীয়তায় পূর্ণ। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)
গৌতম গুহ রায়
বৃহস্পতিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৪
১৯৬৮’র ৪ অক্টোবর আমার জন্মশহরের এক প্লাবন-প্রলয় রাত। সেই প্লাবনের চিহ্ন অনেক বছর আমার শহরের মাটিতে রয়ে গিয়েছিলো। এর বছর দশেক পরে আমার বাবা তাঁর নষ্ট বুকসেলফ থেকে একদিন একটি বন্যার পলিমাখা বই বের করে দিলেন। প্রথম কয়েকটি পাতা নদীর রুপালি পলিমাটিতে পুরু হয়ে ছিল তখনো, বিপন্ন মানুষের অসহায় হনন রাতের চিহ্ন। বইটি ছিল ফিওদর দস্তয়েভস্কির ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। দস্তয়েভস্কির সঙ্গে আমার সেই আলাপ যদিও খুব একটা এগোয়নি, তবে পলিমাখা বইটা রয়ে গেছে। সদ্য কিশোরের মনে ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির ডার্কও ড্রামাটিক জীবনকথার প্রতিফলন নিয়েই তাঁর উপন্যাসগুলো, চরিত্রের প্রতি সেই প্রাথমিক আলাপের টান তবুও কোথাও রয়ে গিয়েছিলো।
১৮৩৯-এ ১৮ বছরের কিশোর দস্তয়েভস্কি তাঁর দাদা মিখাইলকে একটি চিঠিতে লেখেন যে, “Man is a mystery : if you spend your entire life trying to puzzle it out, then do not say that you have wasted your time. I occupy myself with this mystery, because I want to be a man” সাম্প্রতিক কালের নিরিখে এক চিরশ্রেষ্ঠ মনস্তাত্ত্বিক তাঁর যাবতীয় কর্মকা- মানুষের এই রহস্যময় চরিত্রের খোঁজে অতিবাহিত করেছিলেন। এই কারণেই হয়তো দস্তয়েভস্কির উপন্যাসে কোনো নৈসর্গিক বর্ণনা বা ল্যান্ডস্কেপের দেখা মেলে না। তাঁর সৃজন বিশ্বের চরিত্রেরা সমসাময়িক সময়ের নাগরিক সমাজের দ্বন্দ্বদীর্ণ মানুষ। “The Russian novelist first discovered the real face of the hero of our Ôtroubled timeÕÑ the Ôman from undergroundÕ : this new Hamlet is struck by the infirmity of doubt, poisoned by reflection, doomed to a lack of will and inertia. He is tragically alone and divided in two; he has the consciousness of an Ôharassed mouseÕ.Ó (DostoevsKz : His life and Work, by Konstantin Mochulsky)।
আমার বাবার হাত থেকে রুপালি বন্যার পলিমাখা ‘অপরাধ ও শাস্তি’ প্রাপ্তির কয়েক বছর পরে আমার প্রকৃত আলাপ হয় ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের রহস্যময় মননের দ্বান্দ্বিকতার সঙ্গে, তাঁর সাহিত্যই এই সেতুবন্ধন ঘটিয়েছিলো। ঘটনাটি ঘটে যাওয়ার পর হাতে এলো ‘ব্র্রাদার কারমাজোভ’; অনেকের মতে বিশ্বসাহিত্যর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাহিত্যকীর্তি এই উপন্যাসটি। এটি দস্তয়েভস্কির লেখা অন্তিম উপন্যাস, এটি প্রকাশিত হওয়ার মাত্র তিন মাস পরেই দস্তয়েভস্কির প্রয়াণ ঘটে। জীবনের অন্তিম সময়কাল তাঁর চূড়ান্ত পরিশ্রমকৃত এই শৈল্পিক কা-ের শরীর নির্মাণে তিনি নিজেকে ব্যাপ্ত রাখেন। যদিও গোটা জীবনই তিনি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক রহস্যের আবরণ উন্মোচনের কাজ করে গেছেন, ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ তাঁর এই কাজের চূড়ান্ত প্রকাশ, যার মধ্যে একজন সাহিত্যিকের গোটা শিল্প জীবনের ‘অর্গানিক ইউনিটি’ ধরা থাকে। তাঁর চিন্তা, চেতনা, সৃজনভাবনার জগতটা একপাত্রে ধরা থাকে আখ্যানের এই বিস্তৃত জমিতে। সাহিত্যে মনস্তাত্ত্বিক জগতের নানা রহস্যময় আলো-আঁধারি নিয়ে আর কোনো লেখকের লেখায় দস্তয়েভস্কির মতো এমন নির্মোহ বয়ান পাওয়া যায় না। মনস্তত্ত্ব জগতের অবিসংবাদী বয়ানকার সিগমুন্ড ফ্রয়েড এই বই সম্পর্কে বলেছেন, ‘দ্য মোস্ট সিগনিফিক্যান্ট নভেল ইন ওয়ার্ল্ড লিটারেচার’। ‘ইউলিসিস’ ¯্রষ্টা জেমস জয়েস দস্তয়েভস্কিকে অন্য সবার থেকে এগিয়ে রাখতেন তাঁর সাহিত্যের ভেতরের ‘উন্মাদনাগ্রস্ত এনার্জি’র জন্য।
রুশ সাহিত্যে দস্তয়েভস্কি তাঁর আগমন-মুহূর্তে তুলনীয় ছিলেন প্রকৃতিবাদী গোগলের সঙ্গে। কিন্তু ১৮৪৫ ও তার পরবর্তী প্রায় অর্ধশতক ধরে ক্রমশ তিনি রুশ তথা বিশ্বসাহিত্যেই এক স্বতন্ত্র ধারার সংযোজন ঘটান। যে সময় ব্যক্তি মানুষের অভ্যন্তরীণ সম্পর্কের প্রকৃতি নির্ধারণের বাস্তববাদী বয়ান রচিত হচ্ছিলো, দস্তয়েভস্কি সেখান থেকে অনেকটা দূরতম প্রান্তে মানুষের মানসিক মানচিত্রের জটিল রেখাসমূহের স্বতন্ত্র বয়ান লিখছিলেন। তিনি পূর্ব ইউরোপের সাহিত্যে ব্যক্তি মানুষের চিরন্তন অসংগতি, দ্বৈত বোধ, দ্বৈত সত্তা, সমাজ ও ব্যক্তি মানুষের নিরন্তর দ্বিধা ও টানাপোড়েন, ধর্মীয় নৈতিকতা- ব্যক্তি ও সামাজিক, এই সমস্ত বিষয়ের বাস্তবতার শেকড়ে পাঠককে নিয়ে যান, সাহিত্যে এভাবে জীবনকে দেখানোর কাজে তিনিই প্রাথমিক স্রষ্টা ছিলেন বলা হয়, এখানেই তাঁর সঙ্গে বিরোধ বাঁধে তৎকালীন মার্ক্সীয় তাত্ত্বিকদের। দস্তয়েভস্কির সমস্ত উপন্যাসেই মানুষের মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের ঘাত-প্রতিঘাতের বহুস্থরীয় বিন্যাসের খোঁজ পাওয়া যায়। মন ও হৃদয়ের দ্বন্দ্ব তাঁকেও প্রতিনিয়ত আক্রান্ত করেছে, এর প্রভাবে দস্তয়েভস্কির মধ্যে আমরা দেখি যে সেখানে প্রকট এক দ্বৈতসত্ত্বা জাগ্রতভাবে বিরাজমান। একদিকে তাঁর মধ্যে সক্রিয় নাস্তিকতা, অপরদিকে ঐতিহ্যগতভাবে আস্তিক্যের টানাপোড়ন এক আলো-আঁধারির জন্ম নিয়েছিল। এই সংশয়ের নির্মাণেই তাঁর উপন্যাসগুলি অত্যুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে।
জলপাইগুড়ি শহরের কেন্দ্রের ‘মুর্শিদাবাদ হাউস’-এ এক শীতের বিকালে আমাকে ফিওদর দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ড্রারগ্রাউন্ড’ পড়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন কবি শামসের আনোয়ার, সাল ১৯৮৪। এরপর নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম ‘নোটস ফ্রম দ্য অন্ডারগ্রাউন্ড’, এরপর আবারো আলমারি থেকে নামানো সেই ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। অন্তরে আমি তখন আইনস্টাইনের সেই কথার ধ্বনি অনুভব করতে পারি, ‘যদি ফিজিক্স বুঝতে চাও, তাহলে দস্তয়েভস্কি পড়ো’। বুঝতে পারি কেনো আন্দ্রে জিদ তাঁকে রেমব্র্রার মতোই মহৎ চিত্রকর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। দার্শনিক নীটশের সঙ্গে দস্তয়েভস্কির সাহিত্যের চরিত্র নির্মাণকে নৈকট্যে রাখেন অনেক আলোচক। নীটশে নিজেই বলেছিলেন, ‘দস্তয়েভস্কি, একমাত্র একজনই মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে আমাকে কিছু শিখিয়েছেন”। যদিও দুজনে মানসিকতায় দুই মেরুর বাসিন্দা ছিলেন। কিন্তু দুজনেই (কনফেশান) আত্ম-বয়ান শ্রবণ করা পুরোহিত বা যাজকদের সেই স্তরভুক্ত ছিলেন তাঁরা, যাদের অন্তঃদৃষ্টির পর্দায় মানবপ্রকৃতির কিছু গভীর অনুভূতি ধরা পড়তো।
এই আড্ডায় শ্যামল সিংহ দস্তয়েভস্কিকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ‘যখন বন্দুকের ট্রিগার তোমার খুলি লক্ষ্য করে ধরা হয় তখনই তোমার শ্রেষ্ঠ লেখাটি জন্ম নেয়’। শুধু এই উপন্যাসটি নয় দস্তয়েভস্কি তাঁর প্রতিটি আখ্যানেই সামাজিক মানুষের, আমাদের নৈতিক মানদ-ের পাপ পুণ্য বোধ, ন্যায় অন্যায়ের মানদ- নতুন উন্মেষে স্বতন্ত্র এক জগতের সামনে দাঁড় করান। তাঁর সাহিত্যের চরিত্রগুলো আমাদের অন্যভাবে ভাবতে বাধ্য করে, আমাদের স্থিতাবস্থাকে আক্রমণ করে। এই আয়ুধ ছড়িয়ে আছে তাঁর ‘নোটস ফ্রম দ্য অন্ডারগ্রাউন্ড’, ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘দি ইটারনাল হাসব্যান্ড’, ‘দ্যাল্যান্ডলেডি’, ‘ইডিয়ট’, ‘ব্র্রাদারস কারামাজোভ’-এ।
বাংলা ভাষায় আধুনিক সাহিত্য আলোচনায় যার ভূমিকাকে কখনই অস্বীকার করা যাবে না তিনি নিঃসন্দেহে বুদ্ধদেব বসু। তিনি আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের যাত্রাস্থল প্রসঙ্গে দুজনের নাম উল্লেখ করেছেন, এই দুজনেই ২০২১-এ দুশ’তে পড়লেন। একজন কবিতায় বোদলেয়ার, অন্যজন কথাসাহিত্যে দস্তয়েভস্কি। বুদ্ধদেব বসু লিখেছেন, ‘...গদ্য ও পদ্যের বিভাগ অনুসারে, যদি আমাদের বেছে নিতে হয়, তাহলে, নিঃসন্দেহে, এই দুজনেরই নাম করবো আমরা: একজন ‘ল ফ্লুর দ্যু মাল’-এর কবি, অন্যজন রাসকোলনিকভ, প্রিন্স মিশকিন ও কারমাজোভদের ¯্রষ্টা। ...শুধু এটুকু বলে সরে যাবো যে টলস্টয় যেন বিরাট, প্রাচীন ও রহস্যময় এক বিগ্রহ, যার সামনে দাঁড়ালে ভক্তিতে ও ভয়ে আমাদের মাথা নুয়ে আসে, আর দস্তয়েভস্কিকে দেখামাত্র আমরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে বলে উঠি- ‘দ্যাখো, এই যে মানুষ’। এই প্রভেদের জন্যই না বললেও চলে, আধুনিক কালে দস্তয়েভস্কির আবেদন বেশি ব্যাপক ও তীব্র্র।
দস্তয়েভস্কির সৃজনের বিশ্বে প্রবেশের আগে তাঁর শেকড়ের পরিচয় নেওয়া প্রয়োজন, লেখকের বিচরণ ক্ষেত্রের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণ নেওয়া প্রয়োজন। আজকের রাশিয়ার পূর্ব মানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল বেলারুশ। এই বেলারুশের পশ্চিমাঞ্চলের একটি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল দস্তয়েভো। এই দস্তয়েভোর বিস্তীর্ণ ভূসম্পত্তির মালিকানা দানিলো ইরতিশ্চের হাতে চলে যায় ১৫০৬ নাগাদ। সেই থেকে নিজেকে স্থান নামের সঙ্গে জুড়ে নেন। নতুন নামে পরিচিত হন, দানিলো দস্তয়েভস্কি। অর্থাৎ দস্তয়েভ গ্রামের দানিলো। বিশ্বের অনেক জনগোষ্ঠির নামের সঙ্গেই স্থান নামের সংযুক্তি থাকে, আমাদের দক্ষিণ ভারতে বা উর্দু কবিদের নামে স্থান নাম যুক্ত থাকার উদাহরণ প্রচুর রয়েছে। শায়ের লুধিয়ানভি, মজরু সুলতানপুরি নাম বুঝিয়ে দেয় তাঁদের শেকড় কোথায়, এ শিল্পীর পরিচিত নাম। কিন্তু দানিলোর ক্ষেত্রে তাঁর গ্রামের নাম পদবী হিসাবেই যুক্ত হয়ে যায়। নিজেদের বংশগত পেশা ধর্মীয় পুরোহিত বললেও আসলে তাঁদের রক্তে বহমান ছিলো তাতার দস্যুর রক্ত। পরবর্তীতে দস্তয়েভস্কির পূর্বপুরুষেরা ইউক্রেনে চলে আসেন। এই বংশধারার কয়েক প্রজন্ম পরে এক দস্তয়েভস্কি বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাস নতুন করে লিখলেন, ফিওদর মিখাইলোভিচ দস্তয়েভস্কি। মাদস্তয়েস্কাভায়া মারিয়া ফিওদোরভার কোল আলো করে মস্কোতে ১৮২১-এর ১১ নভেম্বর (সেদেশের ক্যালেন্ডারের তারিখ ৩০ অক্টোবর) জন্ম নেন দস্তয়েভস্কি। মস্কোর যে দাতব্য হাসপাতালে ফিওদরের জন্ম হয় তাঁর বাবা মিখাইল আন্দ্রেভিচ দস্তয়েভস্কি সেই হাসপাতেলেরই চিকিৎসক ছিলেন। ছাত্রাবস্তাতেই আন্দ্রেভিচ দস্তয়েভস্কি ইউক্রেন থেকে মস্কোতে চলে এসেছিলেন। এই শিশু ফিওদর দস্তয়েভস্কি পরবর্তীতে বিশ্বের প্রধানতম সাহিত্যিক হয়ে উঠেছিলেন। ১৭০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর গল্প ও উপন্যাস। দস্তয়েভস্কির লেখা গল্পের সংখ্যা ১৭টি এবং উপন্যাসের সংখ্যা ১৬টি। এর বাইরেও নানা ধরনের লেখালেখি রয়েছে এই মহান সাহিত্য ¯্রষ্ঠার। প্রাথমিকভাবে তিনি অনুবাদের মাধ্যমে সাহিত্য জগতে প্রবেশের কাজ শুরু করেছিলেন। যদিও এর আগে সাহিত্যচর্চায় তাঁর সলতে পাকানো পর্বে তিনি দুটি ঐতিহাসিক নাটক লিখতে শুরু করেছিলেন, ১৮৪০-৪১ নাগাদ। এর আগের বছর, ১৯৩৯-এ তাঁর বাবা মারা যান বা খুন হন। ‘মারিয়া স্ট্যার্ট’ ও ‘বরিস গোদুনভ’ নামে যে দুটি ঐতিহাসিক নাটক লিখতে চেয়েছিলেন সে দুটি আর শেষ করা হয়নি দস্তয়েভস্কির। এর তিন বছর পরে তিনি মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং-এ স্নাতক হন। এই সময়েই তিনি অনুবাদ করলেন ‘অনারে দ্য বালজাক’, তখন তিনি ২৩ বছরের তরুণ। এরপর ফসারি নাটক ‘ইউজেনি গ্রান্দে’র অনুবাদ করেন। বালজাকের এই ফরাসি নাটকটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৮৩৩ নাগাদ। দস্তয়েভস্কি বালজাক ছাড়াও শিলার, জর্জ স্যান্ডসহ অনেকের সাহিত্য ইংরাজি থেকে রুশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন।
“Eugenie Grandet-এর পত্রিকা Reperture Ponteon-এর ১৮৪৪-এর জুন ও জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত হলো বালজাকের অনুবাদ। এছাড়াও ভাল ও মন্দের সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সংঘাত উপজীব্য অজ¯্র প্রবন্ধ রয়েছে তাঁর। দস্তয়েভস্কির ডায়েরি ও চিঠিও উচ্চমানের সাহিত্য হিসাবে স্বীকৃত।
দস্তয়েভস্কির প্রথম উপন্যাস ‘পুয়োর ফোক’ থেকে ‘দ্য ব্র্রাদারস কারমাজভ’, ‘দ্য ডাবল, ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর মতো বেশ কিছু পাঠক চর্চিত উপন্যাসের মধ্য থেকে অনেকেই কিছুটা এগিয়ে রাখেন তাঁর ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’কে। ১৮৬৬তে প্রকশিত এই উপন্যাসটি বিশ্বসাহিত্যের সর্বাধিক আলোচিত উপন্যাসের অন্যতম। এক কুসীদজীবীর হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্রে রেখে এই উপন্যাসের নির্মাণ। হত্যাকারী হিসাবে উঠে এসেছে রাস্কলনিকভের নাম, কেন সে এই হত্যা করলো? পাপ কাকে বলে? সমাজ, আইন, সংস্কারের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা নিয়মের গন্ডি কতটা? এই রাস্কলনিকভের নিজেকে নিজেরই বৃত্তে জড়িয়ে রাখা, এমন নানা জটিল মনস্তাত্ত্বিক ঘাত-প্রতিঘাত চিত্রণের আখ্যান বিশ্বসাহিত্যের প্রধানতম উপন্যাস এই ‘অপরাধ ও শাস্তি’। ঈশ্বর নিয়ে এক স্বতন্ত্র বয়ান তাঁর উপন্যাসের মধ্য দিয়ে ব্যক্ত হয়। ঈশ্বর প্রশ্নে তিনি এক দ্বিধাগ্রস্ত সময় অতিবাহিত করেন, তাঁর লেখা এই বার্তাই দেয় যে, মানুষের মানসিক কৃতদাসত্বই তাকে ধর্মের আধ্যাত্মিক কেন্দ্রের দিকে নিয়ে যায়। ১৮৭০-এ সে আপেলন মাইকভকে এক পত্র লিখেছিলেন যে, ‘The main question, which has tormented me consciously or unconsciously throughout my entire lifeÑ the existence of God’. দস্তয়েভস্কির সমস্ত ‘হিরো’ই ঈশ্বর কতৃক উৎপীড়িত এবং তাঁরা প্রত্যেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, এই ঈশ্বর চেতানা, অস্তিবাদ তাঁদের বিশ্বাস অবিশ্বাসের ভিত রচিত করে।এখানে অস্তিবাদ প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাইছি, সমকালীন সাহিত্যে অস্তিবাদ নতুন হলেও এর শেকড় রয়েছে হিব্রু সাহিত্য ও জার্মান কল্পরমাবাদ বা রোমান্টিসিজমের মধ্যে। জার্মান দার্শনিক এডমুন্ড হুসালের ফোনোমেনোলজি থেকে আধুনিক কালে অস্তিবাদের পুনঃপ্রকাশ, তবে সোরেন কিয়ের্কেগাদের চিন্তায় এই অস্তিবাদের মৌল বৈশিষ্ট্য প্রথম পরিলক্ষিত হয়েছিল, কিয়েকেগার্দকেই তাই অস্তিবাদের আদিগুরু বলে মেনে নেওয়া যায়।
দার্শনিক ভিক্টর শক্লভস্কি লিখেছেন যে দস্তয়েভস্কির সমকালকে না জেনে থাকলে তাঁকে জানা যায় না। রাসকোলনিকভ কেন অত উঁচুর থেকে অত ভারি এক অস্ত্র দিয়ে ওই বৃদ্ধা মহিলাকে এমনভাবে আঘাত করল যে তার গলা কতোকটা মুরগির মত ঝুলে পড়েছিল? কেন সেই মহিলাকে কুড়ুল দিয়ে খুন করেছিল?... এই অপরাধের পেছনে কী কারণ রয়েছে? দস্তয়েভস্কি কেন প্রথাগত গোয়েন্দা গল্পের ধারা অবলম্বন করলেন না? কে অপরাধ করেছে সে প্রশ্ন না তুলে কেন তিনি তাঁর পরিবর্তে প্রশ্ন তুললেন অপরাধ কী?
‘কুঠার’ বা কুড়ুল ছিল কৃষকদের একমাত্র অস্ত্র। সেরনিভস্কির হাতে কুড়ুল তুলে নেওয়ার কথা বলে ‘দ্য পজেড’ উপন্যাসে কুঠারের উল্লেখ আছে। ‘দ্য কারমাজভ ব্র্রাদার্স’ উপন্যাসে ইভানের সামনে শয়তান এসে উপস্থিত হয় আর বলে যে সে ঠা-ায় জমে যাচ্ছে। সে একটা সুট আর বো-টাই পড়ে বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছিল (আর তার বিশাল একটা কুকুরের লেজও ছিল)। সে ইভানকে বলে যে বাইরে সাইবেরিয়ার মতো ঠা-া, যে সাইবেরিয়াতে মেয়েরা মজা করে পুরুষদের ঠা-া কুড়ুলের গাটে চুমু খাওয়ার, যাতে পুরুষদের ঠোঁট জমে যায়। ইভান কারমাজভ এত রেগে গিয়েছিলেন যে, তিনি নিজেই নিজের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘কী ধরনের কুড়–ল?’ শয়তান উত্তর দিয়েছিল, “একটা কুড়ুলের যদি যথেষ্ট প্রাথমিক গতিবেগ থাকে, তাহলে সে কুড়ুল পৃথিবীর এক উপগ্রহে পরিণত হবে, আর দিনপঞ্জিকাগুলো আমাদের জানাবে কোন সময়ে সেই কুড়ুল উঠবে আর কোন সময়ে সেই কুড়ুল নামবে।” সময়ের এই অবিনশ্বর কুড়ুল দস্তয়েভস্কির চারপাশে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলো এই ‘কুড়ুল’ মোটিফ হাতে নিয়ে সঞ্চারমান। ১৮৬৪তে লেখা দস্তয়েভস্কির ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর অন্তিম অংশে মানুষের চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য দেখি আমরা, একটি আদর্শ যুক্তিবাদী সমাজের গঠন সম্ভব হলেও সে সামজেও কিন্তু সেরকম ব্যক্তি পাওয়া যাবে, যিনি সমস্ত ধরনের যুক্তিবাদিতাকে ছুঁড়ে ফেলে নির্বোধের স্বেচ্ছাচারী জীবনযাপনের কথা বলবেন। দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে ধর্মবিশ্বাস ও অর্থের অভাব প্রাথমিক জীবনে তাঁকে যেভাবে তাড়িত করেছে তার প্রভাব তাঁর সমস্ত লেখাতেই ছাপ রেখেছে, সেই অভিজ্ঞতাকেই যেন তিনি পুনর্বিবেচনার চেষ্টা করেছেন, বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন।
কেবলমাত্র ব্যক্তি জীবনেই তিনি আক্রান্ত হননি বা বিপর্যয়ের মোকাবিলা করেন নি, সাহিত্যিক হিসাবে তাঁর মূল্যায়নেও তাঁকে নানাভাবে নস্যাৎ করার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯৭১-এ তিনি তাঁর প্রবাসকাল সমাপ্ত করে ফিরে আসেন। ‘ব্র্রাদার কার্মাজভ’-এর পর তাঁকে রুশী পাঠকদের একাংশ রক্ষণশীল ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দর্শনের প্রবক্তা বলে অভিহিত করতে থাকেন। ১৮৬৪তে জার্মানির কাগজে কাউন্ট মিলচিওর দি ভোগে-এ এক প্রবন্ধে তাঁকে কারাগারের দুঃখবাদী, পাগলা আশ্রমের শেক্সপিয়ার, তাঁর নিগ্রহ ধর্মের প্রবক্তা বলে অভিহিত করেন। ভোগ-এর মতে ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ ছাড়া অন্যগুলো অপাঠ্য। আর এক আলোচক এমিল হ্যানিকুইন দস্তয়েভস্কির যুক্তি বর্জন, পাগলামি বিষয়ের উল্লাস, বোকামি, নষ্টামিকে তুলে ধরে দস্তয়েভস্কির মূল দৃষ্টিভঙ্গিকে অস্বীকার করেন। ড্যানিশ সমালোচক দেখান যে দস্তয়েভস্কি ‘অস্পৃশ্যদের নৈতিকতা ও দাসদের নৈতিকতা’র প্রচার চালাচ্ছেন।
এর এক দশক পরে, ১৮৮০-র ৮ জুন, তাঁর পুশকিন বিষয়ক বক্তৃতার পর দস্তয়েভস্কির অনুগামীর সংখ্যা বেড়ে যায়। কিন্তু এর বিপরীত ঘটনাও ঘটে, বিখ্যাত পপুলিস্ট নিকলো মিখাইলোভস্কি সূত্র সন্ধানী হয়ে বললেন, ‘দস্তয়েভস্কি এক নিষ্ঠুর প্রতিভা, এক স্যাডিস্ট, যিনি নিগ্রহ উপভোগ করেন, প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থা তৈরি করে অত্যাচারীদের ও অত্যাচারকারীকে।... তিনি আমাদের সময়ের সবচেয়ে আকর্ষণিয়, সবচেয়ে টিপিকাল। বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে দেখাতে ভুলে গেছেন’।
বিগত শতকেও দস্তয়েভস্কিকে নিয়ে পক্ষে বিপক্ষের এই আলোচনা চলতে থাকে। রুশী প্রতীকবাদী দিমিত্রি মোরেজকভস্কি তুলনামূলক আলোচনায় দস্তয়েভস্কি প্রসঙ্গে লিখেন যে তিনি বাস্তববাদী নন, প্রতীকবাদী। তিনি সমাজ পরিস্থিতি বর্ণনা করেন না, বরং হাজির করেন আইডিয়ার ট্রাজেডি। তিনি নব্য এক ধর্মের প্রফেট, শিল্প জগতে। কিন্তু ইমেজ পরিকল্পিত, তাঁর সাহিত্যের অভিমুখ অধঃগামী এবং অতি নাটকীয়তায় পূর্ণ। (আগামী সংখ্যায় পড়ুন)