alt

সাময়িকী

হেমন্ত পদাবলি

: বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু
নির্মলেন্দু গুণ

একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো

মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;

একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,

একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে

একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।

একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,

কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,

ট্রেনের টিকিট কেটে

একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।

একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি

কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।

একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে

পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

জীবন-মদিরা কিছু কষ্টসুখ
হাসান হাফিজ

হেমন্ত ঋতুর বুকে আছে মৃদু সম্মোহন

থোকা থোকা বিষণœতা

মনোকষ্ট সূক্ষ্মচিড়, অনাত্মীয় হাহাকার

এই বোধ উপলব্ধ হয়েছে যে মানুষের

তিনি জীবনের কবি, ধানসিড়ি নদীটির কবি।

হেমন্ত ঋতুর সঙ্গে যোগ আছে সায়াহ্নের

নিঃসঙ্গ আগুনে পুড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে

ক্ষীণকটি নদীগন্ধা স্মৃতিস্বপ্ন বয়ে বয়ে

কাঁঠালপাতার মায়া ছেড়েছুড়ে কোন্ দূরে চলে যায়

অতীন্দ্রিয় আকাশে ও

বনান্তরে মায়াচ্ছন্ন হিজল ছায়ায়

জাগতিক মানুষের সাধ্য নাই

জলরঙে সে ছবিটি সুনিপুণ আঁকে

এই দুঃখ পরাভব কষ্ট আর ঊনতার

গ্লানিপুঁজ সারাজন্ম বুকে চেপে থাকে

এই কষ্ট বেদনার মধ্যে আছে অন্তর্হিত

লুকোনোচুরোনো কিছু গোপন সুখের ঘ্রাণ

একইসঙ্গে আলুথালু যৎকিঞ্চিৎ জীবন-মদিরা।

পাখিদের অশ্রুবিন্দু
আবদুর রাজ্জাক

এমত হেমন্তকাল, কুয়াশাভর্তি জাহাজ ডুবে যায় নির্ঘুম রাতে,

মুহুর্মুহু জেগে ওঠে জল, নীলাভ ছড়িয়ে পড়ে

মনতল বৃক্ষসমূহে।

স্তব্ধতার কিছু নীল আমাকে প্লাবিত করে, ধীর নিমজ্জিত

হয়ে যায় পূর্ণিমা প্রহর, আমি শরতের মাধুর্য ছেড়ে পরবাসে,

একটি দু’টি করে ঝরে পড়ে অশোক পাতা।

কী করুণ সেই পাতাঝরার হাহাকার, নিমজ্জিত বেদনার পাশে

আসবুজ এক কুলগাছ, কুয়াশাবৃত্ত কুলগাছসমূহের মধু

সংগ্রহকালে ভ্রমরদের কোনো সংঘাত হয় না।

কুলগাছসমূহ সহসাই মেলে ধরে প্রলোভিত ফুল, শত শত ডানার

গন্ধবহ সুগন্ধ উড্ডয়ন

ছড়িয়ে যায় শঙ্কামুক্ত শুভ্র বাতাসে।

পাখিদের এতোগুলো ভালোবাসা তোমার জন্য জমায়িত রয়েছে,

হায় তুমিও এই অশুভ শরতে, ধারণ করেছো পাখিদের অশ্রুবিন্দু।

আমি প্রায়শ স্বপ্নের ভেতর কুয়াশামাখা ঝিরি নারিকেল পাতা-

ডানামেলা প্রাচীন কলমীলতার দীপ্র অমরতা এক।

হেমন্তের পাখি
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

দ্বৈত দেশ। ঋতু সংকট, কিছুটা হাহাকার

কিছুটা ছক্কা আর খানিকটা চার।

চার ঋতুর বৈচিত্র্যে হেমন্ত নেই।

মিসিং, সে মন তো নেই।

স্বদেশে রেখে এসেছি- ষড়ঋতুর সৌন্দর্য ‘মুগ্ধ’ হেমন্ত

তুমি সেই মুগ্ধতা আমার! যে মন তো-

মানে না, অস্থির থাকে-

কোথা থেকে যেনো হেমন্তের পাখি ডাকে।

দৃশ্যান্তর
মাসুদ খান

দীর্ঘগ্রীব ওই রাজহাঁস- হেলেদুলে চলছে সবার আগে-আগে-

ওটাই প্রধান গ্যাংস্টার, হংসবাহিনীর।

সামনে ফণা তুলে আছে শঙ্খচূড় সাপ।

তার ওই সুন্দর উদ্যত ফণাভঙ্গি-

সে-তো আর কিছু নয়,

যেন তার অব্যর্থ বিষের এক সারোগেট বিজ্ঞাপন।

আর, সব কিছুর ওপর কড়া নজর রাখছে

ঘুরে ঘুরে উড়তে-থাকা এক বাজপাখি।

নিচে অঙ্কুরিত জম্বি-পিপীলিকাজাত

অগণিত মাশরুম।

সেই ছবিটা
রাজা হাসান

হেমন্ত শেষ হয়ে এলো। গাছে গাছে নেমে আসছে স্তব্ধতা।

অনেকদিন আমাদের দেখা হয় না।

মনে হয় নিজেকে যথেচ্ছাচারে ভাসিয়ে দিই।

এই গোঁজামিল, টানটান হিসাবের মধ্যে ভীষণ ক্লান্ত লাগে।

অনেক তর্ক, অনেক একনিষ্ঠ পক্ষপাত,

তারপরেও দেখি টেবিলে আমি একা।

ওরা এসেছিলো বেলুন হাতে ফুরফুরে মেজাজে,

বেলুন উড়িয়ে ফিরে গেছে খেলার আহ্লাদে।

হেমন্ত বিকেল সন্ধ্যায় অস্পষ্টতায় ঢাকা পড়ে যাই,

সংশয়ে ছেঁড়াখোঁড়া হয়তো কিছু খুঁজি।

ঝাপসা কাচের প্রতিচ্ছবিতে হেমন্তকাল শেষ হয়ে আসে...

হেমন্তের বার্তা
তুষার গায়েন

হেমন্ত ভালো লাগে, পদে পদে এত অনিশ্চয়তা

ক্ষণে ক্ষণে এত রূপবদল তার, কখন সে নিয়ে আসে

কোন উপহার, কে জানে! পরাক্রান্ত সূর্যের উদ্ভাস-

উত্তাপ কেড়ে নিয়ে শুধু আলোর বিস্তার, নিস্তেজ রোদ

হলুদ লাল খয়েরী পাতার পর, সন্ধ্যা নামে প্রৌঢ়ার

নিঃসঙ্গতা নিয়ে, বছরাধিক কাল জুড়ে হাতে বোনা

উলের সোয়েটার। এত নিরুদ্বেগ, চুপচাপ চারদিক

যেতে হবে চশমার দোকান বন্ধ হবার আগে-

রাস্তার ওপাশে কবরস্থান, স্তূপীকৃত ঝরা পাতা মেপল, বার্চ

কখন যে বাতাস লাগে সোনা ও তামার বনে, উড়ে উড়ে

চক্রাকারে জড়ায় দু’পা, বাতাসে উজান ঠেলে পথচলা দায়

সহসা তেরছা বৃষ্টির ছাট, অন্ধকার, ধারাল বাতাস

অপ্রস্তুত ভিজে যাওয়া কোনো বাড়ির কার্নিশের নিচে

অনাহূত দাঁড়াবার আগে- ধারাপাত, ব্যর্থতার সব

দায়ভার উড়িয়ে নেবার মন্ত্রধ্বনি অমোঘ বর্ষণে ঝরে...

সাদা সন্ত্রাস আসার আগে অহংকারী যে-শাসক

হেমন্ত সংকেত উপেক্ষা করে, বরফের জঙ্গিনৃত্য

অবশ্যম্ভাবী তাকে উৎখাত করে থাকে।

প্রতিরোধহীন আমি
তাপস গায়েন

পৌরাণিক কাল থেকে উড়ছে প্রজাপতি,

জাগছে আকাশ, ছিন্নভিন্ন মেঘ

এই রাত দীর্ঘ প্রতিরোধের,

দাঁড়িয়ে রয়েছে নক্ষত্রের দল-

তবু, এই হেমন্তে পাতা ঝরে, যেভাবে মহাকালব্যাপী

যুদ্ধে ঝরে পড়ে শিশু, নারী আর সাহসী পুরুষ

আমি নই একাকী, যেভাবে তুমিও নও দূরবর্তী

ঘুম ও জাগরণের মাঝে সমুদ্রে ভাসমান আমি,

জেগে আছি রৌদ্রময় দ্বীপান্তরে

আর নারী, যে তুমি আমার না হয়েও অনন্য

এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ, উন্মুখ-

যেন আন্তঃমহানগরীয় এক যাত্রী

বাতাস ভেদ করে জাগছে দেশত্যাগী মানুষের ভিড়

পানশালার নির্জনতায় আমিই আমার উৎসব,

আর আমাকে প্রত্যক্ষ করে

জেগে আছে শ্মশান...

অবরোধ
চয়ন শায়েরী

হিসেবি তোমার মতো বিমর্ষ আকাশ

কুয়াশার মেঘে ঢাকা আকাশের মুখ

এই অঘ্রানের রাতে চেনা-জানা তারা

নক্ষত্রবাড়ির কথা বেমালুম ভুলে

ভুল করে পথহারা- ধ্রুবতা সন্ধানে;

ধ্রুবতা কখনো স্থির কিছু নয় মোটে

সভ্যতার সংকটে যেমন সত্যতা

বিবর্তিত হতে হতে হয়েছে আশঙ্কা-

আমাদের বেঁচে থাকা বস্তুত এখন

অনুগামী নয় মোটে নিজের ইচ্ছার;

কুয়াশার দেয়ালের পরতে পরতে

সব তারা দিশাহারা অঘ্রানের রাতে;

প্রলম্বিত বিড়ম্বনা- কুয়াশায় সূর্য

ওত পেতে আছে- যেন রাজনীতিবিদ

ভোর হতে দেবে না তো বিপ্লবের রাতে

অসহিষ্ণু অবরোধ আকাশের পথে-

রাজনীতিক কুয়াশা শীতনিদ্রা ডাকে

আমাদের জীবনের হেমন্তের ভোরে।

আমার হেমন্ত
ইকবাল হোসেন বুলবুল

সে কী মাতালতা

সে কী মহা সুখে

আমার সুখেরা ছিল বুক খোলা হেমন্তের দেশে

শিশিরের চুমো

ছাতিমের গোপন ইশারা

আমার সময় রাখতো পাগল দিবারাত্রি সারা

পাগল এ মন

কাঁদেনি এমন

শুনো কান পেতে;

নষ্টের আঁধার

কেড়ে নিচ্ছে সব

যা ছিলো এ দেশে।

হেমন্তের চিঠি
আলম হোসেন

চিঠি আমি তাকেই দিলাম

হেমন্তের সকালে নরম রোদে

চায়ের কাপে চুমু দিয়ে যে আমাকে করবে স্মরণ

মুড়ির মোয়ায় কামড় দিয়ে

জিহ্বা কাটলে করবে মনে

আমিও তার নিয়েছি নাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

ছাতিম তলায় মাদুর পেতে

শিউলি মালা গাঁথতে গাঁথতে

যে দেখবে আমার ছবি

নতুন ধানের পিঠা খেতে

শুকবে আমার শরীরের ঘ্রাণ

চিঠি আমি তাকেই দিলাম

কলেজ গেটে কামাল মামার

চালতার আচার কামরাঙ্গা ঝাল ভোলেনি যে

নকশি পিঠায় সংগোপনে

লিখেছে যে আমার নাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

আমার চিঠি বুকের ভাঁজে

লুকিয়ে রেখে স্মৃতির জলে

সাঁতার কেটে ভাববে যেজন

আমরা দুজন বন্ধু ছিলাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

হেমন্তের সন্ধ্যা
ভাগ্যধন বড়ুয়া

হেমন্তের সন্ধ্যায় ঘুরতে খুব ভালো লাগে

শহরে নয়, শহরতলি কিংবা গ্রামে

একা নয়, প্রিয়জনের সঙ্গে

কথা বলতে বলতে,

টং দোকানে এক চুমুক চা খেতে খেতে

নদীর পাড়ে বসে নীল আকাশ দেখা আনন্দ অনুঘটক

শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে প্রকাশ করে জীবন সুন্দর।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে রাত শুরু

তারাগুলো জেগে জেগে কার্তিকের জমানো গল্প বলে

কালপুরুষ যেখানে গতকাল একটু আড়ালে ছিল,

আজ হাজির!

সাদা জ্যোৎস্না ঘুম কেড়ে নেয়,

ফিরিয়ে দেয় গত হেমন্তের স্মৃতি;

কেয়াজু পাড়ার তারাভরা আকাশ!

কার্তিকের করতলে কতো রাত হয়েছে গত

গোলক ঘূর্ণনে ফেলে আসা ক্ষণ ছোট ছোট দ্বীপ

কোমল হেমন্ত সন্ধ্যা নদীতীরে তোমার অপেক্ষায়

এসো,শীত আসার আগে মাতামুহুরির পাড়ে

আরেকটু জমাই গল্প ভবিষ্যতের ডেরায়...

হেমন্ত ইদানীং
মাহফুজ আল-হোসেন

শিশিরের ছানি পড়া চোখে আজকাল লাল ছাড়া অন্য কোনো রঙ ধরা পড়ে না বলেই বালখিল্য ফাল্গুনের চারিত্রিক সনদ ইদানীং হেমন্তই বিলাচ্ছে;

খালি পায়ে কাচের ওপরে হেঁটে যাওয়ার সময় সুতীক্ষè ধারগুলোকে সুখানুভূতির প্রসন্ন সবুজ ঘাস ভেবে হুটহাট হুইটম্যানের কাছে ফিরতেই পারো;

বরং, ধুলোমাখা চৈতন্যের আগাপাশতলা জুড়ে কুয়াশার প্রলেপ দিয়ে দাও- দেখবে অকস্মাৎ অরণ্যের পোস্টম্যান এসে ভাঁজভাঙা কবিতার লেফাফা দিয়ে গেছে!

নিজল মেঘের গান
মতিন রায়হান

নিজল মেঘের গান কে শুনেছে? ভিজি আমি নিত্য!

যে খোঁজে জলের ধারা পাই তাকে প্রভাতের রাগে;

মৃদুমন্দ বাতাসের রং কে দেখেছে? কে ছুঁয়েছে তার

জলগন্ধী হৃদয়কুহর? কংলাক থেকে লুসাই পর্বত

আহা, কী বিস্তৃত সবুজের ঢেউ, সমুদ্র কোথায়? দেখি,

হেমন্তের নিজল মেঘের ডানা; সকালের সোনাঝরা

রোদ আর চিত্তহরা উদাসী চিম্বাল, ডাকে দূরের চিম্বুক!

আমি রোদে-মেঘে ভিজি, ভিজাই হৃদয়! আচ্ছা,

জনকোলাহল ছেড়ে মাঝেমধ্যে মন কেন ছুটে যায়

পাহাড় ও সমুদ্রের কাছে? অটল পাহাড় কথা বলে

কোন্ সে ভাষায়? রুইলুই পাড়া, জানো তুমি? জানো

নিপুণা জুলিরা? সমতলের মানুষ কী খোঁজে চটুল

চোখে? টের পাও জুম্ম নারী? তুলোট মেঘের মতো

মুহূর্তে ভিজিয়ে দাও পর্যটকী মন! তোমাদের সারল্যে

কে ভেজে, তা জানি না! তবে বাঁচে যে কবির চিত্ত!

নিজল মেঘের গান কে শুনেছে? ভিজি আমি নিত্য!

চিম্বাল : লুসাই শব্দ। এর অর্থ রংধনু।

জুম্ম : শব্দটি এসেছে পাহাড়িদের জুম চাষ থেকে।

জুম্ম মানে পাহাড়ের অধিবাসী।

হেমন্তিকা
মুশাররাত

কেন যেন তার মুগ্ধ দ্যুতি শেষ হয় না

নিঃশেষ করে কমলা রোদটা মাখা হয় না

ঘন মেঘের কালি মনের ক্যানভাস ছেয়ে যায়

গোলাপী বিকেলও তোমাকে ভেবে চমকায়

শিহরন জাগায় বৃষ্টি, বকুলের গন্ধ নিতে

কালোর মাঝেও আলো খুঁজে নেই নক্ষত্রের রাতে

হিমঝুরিতে দেব কাঞ্চনের দেখা মেলে না

এ যেন ঠিক ভালোবাসার আগে ভালো লাগা,পূর্বাভাস

হিম হিম ছোঁয়া, পৌষী মেয়েকে বুকে টেনে নেবার অস্ফুট স্বাদ

প্রকাশ্যে আসুক, সহাস্যে সাজুক প্রেম-প্রকৃতি বা সোনালি আমন

কামিনীর ডাকে হেমন্তিকার মন্থিত রূপের আস্ফালন

নরম কোমল শিউলী যেন কিশোরী হাতের তালু

তলানীতে যাক জল- খাল, বিলে, মৃত্তিকার যৌবন আলুথালু

বকফুল ফোটে, কী যে মায়া জোটে

আধো কুয়াশায়- লাজ ভাঙা বৌ;

হালকা ঘিয়ের আঁচল যেমন

সতেজ ঘাসে, ধীরে ধীরে হাসে, ঝিকিমিকি শিশির

স্নাত শরীরে, বৃক্ষেরও যেন উন্মন মন

প্রথম প্রেমের ছোঁয়া যেন

এই ‘হৈমন্তী’, রবিরও যেমন।

আমার হেমন্ত
যাকিয়া সুমি সেতু

হিমঝুরি ফুলের দেশে হেমন্তের চিঠি

শিশিরের পাতা জুড়েই নবান্নের ঘ্রাণ

মধুগন্ধীপিঠে, শালুকখৈ, এলাচবাতাসা

শখের চুড়ি, বাউলগান, কৃষ্ণবাঁশি রাতভর

নীল কুয়াশা থেকে, হেমন্ত এসে ঢেলে দেয়

খুশির হলুদ, মাঠভরে কৃষকের সোনাধানে

চুনকড়ি, চিত্রা, মহানন্দা, কর্ণঝরা, লোনা

সব জলেই হেমন্তের নরম রোদের চিঠি

বণিক, বন্দর আর বারাঙ্গনা ভালোবাসা-

ব্রাহ্মবৈবর্ত পুরাণও- কামরূপে কথা বলে

রঙধনু সূর্যচিত্র খুলে, চেয়ে থাকি সারাদিন

বনমেঘে, শস্য বুনে আমিও হেমন্ত-রূপকথা

আহা হেমন্ত! মৃন্ময়ী- কার্তিক লাবণ্যপ্রভা

মৌর্য-শুঙ্গ-পাথরপাতা পেরিয়ে এসেছো

বোধনের পর দুর্গাঠাকুরকে ভাসিয়ে চুপিচুপি

তোমার শিশিরে ভিজেছে বঙ্গ, গৌড়,সমতট,

হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, রাঢ়, পু-্র, বারিন্দ্রী

আরও ডোম, কোল, হাড়ি, চ-াল বাংলায়

তুমি আসো গভীর গহন হতে, আমার হেমন্ত-

দুপুর
সুবীর সরকার

আসলে তো মেঘের দুপুর।

দানাশষ্য ভিজে যাওয়া দুপুর।

দূরে সরে যাওয়া নদী।

দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া

বন্দর।

তদন্ত সাপেক্ষ বিষয় নিয়ে কথা বলি

না

শরীরে আলস্য জড়িয়ে এস্কিমোদের দেশের

ছবি দেখি

সতর্কতা ভেঙে গেলে

চিমনি থেকে ছাই উড়ে

এদিকে ধান তামাকের গল্প।

শিকার আর শিকারির গল্প।

জন্মান্তর থেকে উড়ে আসে

রুমাল।

হেমন্তের জন্মকাব্য
প্রণব মজুমদার

চাইলেই কি মুছে দেওয়া যায় সব?

প্রথম আলোর মাহেন্দ্রক্ষণের কলরব!

হেমন্তের অমাবস্যার রাত্রিভূমে প্রাণের কোলাহল,

গোলায় ওঠা সুগন্ধি কনকতারা হলুদাভ ধানের উৎসব

মধ্য অগ্রহায়ণে নিঝুম রাতের প্রাণবন্ত সম্মিলিত আবেগ কিংবা

রতœগর্ভা নীলিমার সপ্তম আত্মজার গগণভেদী প্রথম চিৎকার!

ফেলে আসা গতকাল; না ভুলে যাওয়া যায় না!

উদ্ভাসিত প্রভায় তাকে আবৃত করা যায় না।

পারছি কি ভুলে যেতে সেইসব দিনরাত্রি?

আমি আমার জন্মের কথা বলছি;

আমার মায়ের বেদনার কথা বলছি,

নাড়িছেঁড়া রক্তাক্ত গর্ভ আঘাতের মর্ম কথার বর্ণন করছি।

আঁতুড়ঘরে ধাত্রী সুবেশী সগৌরবে মাকে বলেছিলেন

জন্মের এ আসরে নীলু, এতো দেখি-

নারায়ণ দেবতার মতো ভূমিষ্ঠ হলো তোমার পুত্র দৌলত!

গর্ভ থেকে আনা শিশুদান শেষে পাল বাজারের গিরিশ সাহার প্যারাডাইসের

কাঁচা সন্দেশ ও মচমচে নিমকির ভোজনে ধাত্রীর উচ্ছ্বসিত আবদার

আর নবী স্টোরের ফারুকের ধবধবে সুতি শাড়ির বায়না।

আঁতুড়ঘর মাতৃমঙ্গলের ফেলে আসা মায়ের মুখে

তারুণ্যে শোনা সোনালি দিনের স্মৃতিপদ্য-

পড়ন্ত বিকেলে তা আনন্দ আলোর মতো

নেত্রাভিমুখে জ্বলজ্বল করে এখনও;

অমুছনীয় স্বর্ণময় অতীত তাতো আমার গৌরবের বর্তমান

হেমন্তে তাই আমার জন্মের মুহূর্তগুলো কী করে যাই ভুলে?

অনিবার্য মৃত্যুর মতো জন্মও সত্য; তা নিয়েই তো আগামী।

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

ছবি

স্বপ্ন অথবা বিপন্ন বিস্ময়

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

ছাতিম যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ

ছবি

সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ

ছবি

সমকালিক ঘটনাবলির রূপকার

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

রূপান্তরিত

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

tab

সাময়িকী

হেমন্ত পদাবলি

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

পূর্ণিমার মধ্যে মৃত্যু
নির্মলেন্দু গুণ

একদিন চাঁদ উঠবে না, সকাল দুপুরগুলো

মৃতচিহ্নে স্থির হয়ে রবে;

একদিন অন্ধকার সারা বেলা প্রিয় বন্ধু হবে,

একদিন সারাদিন সূর্য উঠবে না।

একদিন চুল কাটতে যাব না সেলুনে

একদিন নিদ্রাহীন চোখে পড়বে ধুলো।

একদিন কালো চুলগুলো খ’সে যাবে,

কিছুতেই গন্ধরাজ ফুল ফুটবে না।

একদিন জনসংখ্যা কম হবে এ শহরে,

ট্রেনের টিকিট কেটে

একটি মানুষ কাশবনে গ্রামে ফিরবে না।

একদিন পরাজিত হবো।

একদিন কোথাও যাব না, শূন্যস্থানে তুমি

কিম্বা অন্য কেউ বসে থেকে বাড়াবে বয়স।

একদিন তোমাকে শাসন করা অসম্ভব ভেবে

পূর্ণিমার রাত্রে মরে যাব।

একদিন সারাদিন কোথাও যাব না।

জীবন-মদিরা কিছু কষ্টসুখ
হাসান হাফিজ

হেমন্ত ঋতুর বুকে আছে মৃদু সম্মোহন

থোকা থোকা বিষণœতা

মনোকষ্ট সূক্ষ্মচিড়, অনাত্মীয় হাহাকার

এই বোধ উপলব্ধ হয়েছে যে মানুষের

তিনি জীবনের কবি, ধানসিড়ি নদীটির কবি।

হেমন্ত ঋতুর সঙ্গে যোগ আছে সায়াহ্নের

নিঃসঙ্গ আগুনে পুড়ে ক্ষয়ে ক্ষয়ে

ক্ষীণকটি নদীগন্ধা স্মৃতিস্বপ্ন বয়ে বয়ে

কাঁঠালপাতার মায়া ছেড়েছুড়ে কোন্ দূরে চলে যায়

অতীন্দ্রিয় আকাশে ও

বনান্তরে মায়াচ্ছন্ন হিজল ছায়ায়

জাগতিক মানুষের সাধ্য নাই

জলরঙে সে ছবিটি সুনিপুণ আঁকে

এই দুঃখ পরাভব কষ্ট আর ঊনতার

গ্লানিপুঁজ সারাজন্ম বুকে চেপে থাকে

এই কষ্ট বেদনার মধ্যে আছে অন্তর্হিত

লুকোনোচুরোনো কিছু গোপন সুখের ঘ্রাণ

একইসঙ্গে আলুথালু যৎকিঞ্চিৎ জীবন-মদিরা।

পাখিদের অশ্রুবিন্দু
আবদুর রাজ্জাক

এমত হেমন্তকাল, কুয়াশাভর্তি জাহাজ ডুবে যায় নির্ঘুম রাতে,

মুহুর্মুহু জেগে ওঠে জল, নীলাভ ছড়িয়ে পড়ে

মনতল বৃক্ষসমূহে।

স্তব্ধতার কিছু নীল আমাকে প্লাবিত করে, ধীর নিমজ্জিত

হয়ে যায় পূর্ণিমা প্রহর, আমি শরতের মাধুর্য ছেড়ে পরবাসে,

একটি দু’টি করে ঝরে পড়ে অশোক পাতা।

কী করুণ সেই পাতাঝরার হাহাকার, নিমজ্জিত বেদনার পাশে

আসবুজ এক কুলগাছ, কুয়াশাবৃত্ত কুলগাছসমূহের মধু

সংগ্রহকালে ভ্রমরদের কোনো সংঘাত হয় না।

কুলগাছসমূহ সহসাই মেলে ধরে প্রলোভিত ফুল, শত শত ডানার

গন্ধবহ সুগন্ধ উড্ডয়ন

ছড়িয়ে যায় শঙ্কামুক্ত শুভ্র বাতাসে।

পাখিদের এতোগুলো ভালোবাসা তোমার জন্য জমায়িত রয়েছে,

হায় তুমিও এই অশুভ শরতে, ধারণ করেছো পাখিদের অশ্রুবিন্দু।

আমি প্রায়শ স্বপ্নের ভেতর কুয়াশামাখা ঝিরি নারিকেল পাতা-

ডানামেলা প্রাচীন কলমীলতার দীপ্র অমরতা এক।

হেমন্তের পাখি
সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল

দ্বৈত দেশ। ঋতু সংকট, কিছুটা হাহাকার

কিছুটা ছক্কা আর খানিকটা চার।

চার ঋতুর বৈচিত্র্যে হেমন্ত নেই।

মিসিং, সে মন তো নেই।

স্বদেশে রেখে এসেছি- ষড়ঋতুর সৌন্দর্য ‘মুগ্ধ’ হেমন্ত

তুমি সেই মুগ্ধতা আমার! যে মন তো-

মানে না, অস্থির থাকে-

কোথা থেকে যেনো হেমন্তের পাখি ডাকে।

দৃশ্যান্তর
মাসুদ খান

দীর্ঘগ্রীব ওই রাজহাঁস- হেলেদুলে চলছে সবার আগে-আগে-

ওটাই প্রধান গ্যাংস্টার, হংসবাহিনীর।

সামনে ফণা তুলে আছে শঙ্খচূড় সাপ।

তার ওই সুন্দর উদ্যত ফণাভঙ্গি-

সে-তো আর কিছু নয়,

যেন তার অব্যর্থ বিষের এক সারোগেট বিজ্ঞাপন।

আর, সব কিছুর ওপর কড়া নজর রাখছে

ঘুরে ঘুরে উড়তে-থাকা এক বাজপাখি।

নিচে অঙ্কুরিত জম্বি-পিপীলিকাজাত

অগণিত মাশরুম।

সেই ছবিটা
রাজা হাসান

হেমন্ত শেষ হয়ে এলো। গাছে গাছে নেমে আসছে স্তব্ধতা।

অনেকদিন আমাদের দেখা হয় না।

মনে হয় নিজেকে যথেচ্ছাচারে ভাসিয়ে দিই।

এই গোঁজামিল, টানটান হিসাবের মধ্যে ভীষণ ক্লান্ত লাগে।

অনেক তর্ক, অনেক একনিষ্ঠ পক্ষপাত,

তারপরেও দেখি টেবিলে আমি একা।

ওরা এসেছিলো বেলুন হাতে ফুরফুরে মেজাজে,

বেলুন উড়িয়ে ফিরে গেছে খেলার আহ্লাদে।

হেমন্ত বিকেল সন্ধ্যায় অস্পষ্টতায় ঢাকা পড়ে যাই,

সংশয়ে ছেঁড়াখোঁড়া হয়তো কিছু খুঁজি।

ঝাপসা কাচের প্রতিচ্ছবিতে হেমন্তকাল শেষ হয়ে আসে...

হেমন্তের বার্তা
তুষার গায়েন

হেমন্ত ভালো লাগে, পদে পদে এত অনিশ্চয়তা

ক্ষণে ক্ষণে এত রূপবদল তার, কখন সে নিয়ে আসে

কোন উপহার, কে জানে! পরাক্রান্ত সূর্যের উদ্ভাস-

উত্তাপ কেড়ে নিয়ে শুধু আলোর বিস্তার, নিস্তেজ রোদ

হলুদ লাল খয়েরী পাতার পর, সন্ধ্যা নামে প্রৌঢ়ার

নিঃসঙ্গতা নিয়ে, বছরাধিক কাল জুড়ে হাতে বোনা

উলের সোয়েটার। এত নিরুদ্বেগ, চুপচাপ চারদিক

যেতে হবে চশমার দোকান বন্ধ হবার আগে-

রাস্তার ওপাশে কবরস্থান, স্তূপীকৃত ঝরা পাতা মেপল, বার্চ

কখন যে বাতাস লাগে সোনা ও তামার বনে, উড়ে উড়ে

চক্রাকারে জড়ায় দু’পা, বাতাসে উজান ঠেলে পথচলা দায়

সহসা তেরছা বৃষ্টির ছাট, অন্ধকার, ধারাল বাতাস

অপ্রস্তুত ভিজে যাওয়া কোনো বাড়ির কার্নিশের নিচে

অনাহূত দাঁড়াবার আগে- ধারাপাত, ব্যর্থতার সব

দায়ভার উড়িয়ে নেবার মন্ত্রধ্বনি অমোঘ বর্ষণে ঝরে...

সাদা সন্ত্রাস আসার আগে অহংকারী যে-শাসক

হেমন্ত সংকেত উপেক্ষা করে, বরফের জঙ্গিনৃত্য

অবশ্যম্ভাবী তাকে উৎখাত করে থাকে।

প্রতিরোধহীন আমি
তাপস গায়েন

পৌরাণিক কাল থেকে উড়ছে প্রজাপতি,

জাগছে আকাশ, ছিন্নভিন্ন মেঘ

এই রাত দীর্ঘ প্রতিরোধের,

দাঁড়িয়ে রয়েছে নক্ষত্রের দল-

তবু, এই হেমন্তে পাতা ঝরে, যেভাবে মহাকালব্যাপী

যুদ্ধে ঝরে পড়ে শিশু, নারী আর সাহসী পুরুষ

আমি নই একাকী, যেভাবে তুমিও নও দূরবর্তী

ঘুম ও জাগরণের মাঝে সমুদ্রে ভাসমান আমি,

জেগে আছি রৌদ্রময় দ্বীপান্তরে

আর নারী, যে তুমি আমার না হয়েও অনন্য

এয়ারপোর্টে অপেক্ষমাণ, উন্মুখ-

যেন আন্তঃমহানগরীয় এক যাত্রী

বাতাস ভেদ করে জাগছে দেশত্যাগী মানুষের ভিড়

পানশালার নির্জনতায় আমিই আমার উৎসব,

আর আমাকে প্রত্যক্ষ করে

জেগে আছে শ্মশান...

অবরোধ
চয়ন শায়েরী

হিসেবি তোমার মতো বিমর্ষ আকাশ

কুয়াশার মেঘে ঢাকা আকাশের মুখ

এই অঘ্রানের রাতে চেনা-জানা তারা

নক্ষত্রবাড়ির কথা বেমালুম ভুলে

ভুল করে পথহারা- ধ্রুবতা সন্ধানে;

ধ্রুবতা কখনো স্থির কিছু নয় মোটে

সভ্যতার সংকটে যেমন সত্যতা

বিবর্তিত হতে হতে হয়েছে আশঙ্কা-

আমাদের বেঁচে থাকা বস্তুত এখন

অনুগামী নয় মোটে নিজের ইচ্ছার;

কুয়াশার দেয়ালের পরতে পরতে

সব তারা দিশাহারা অঘ্রানের রাতে;

প্রলম্বিত বিড়ম্বনা- কুয়াশায় সূর্য

ওত পেতে আছে- যেন রাজনীতিবিদ

ভোর হতে দেবে না তো বিপ্লবের রাতে

অসহিষ্ণু অবরোধ আকাশের পথে-

রাজনীতিক কুয়াশা শীতনিদ্রা ডাকে

আমাদের জীবনের হেমন্তের ভোরে।

আমার হেমন্ত
ইকবাল হোসেন বুলবুল

সে কী মাতালতা

সে কী মহা সুখে

আমার সুখেরা ছিল বুক খোলা হেমন্তের দেশে

শিশিরের চুমো

ছাতিমের গোপন ইশারা

আমার সময় রাখতো পাগল দিবারাত্রি সারা

পাগল এ মন

কাঁদেনি এমন

শুনো কান পেতে;

নষ্টের আঁধার

কেড়ে নিচ্ছে সব

যা ছিলো এ দেশে।

হেমন্তের চিঠি
আলম হোসেন

চিঠি আমি তাকেই দিলাম

হেমন্তের সকালে নরম রোদে

চায়ের কাপে চুমু দিয়ে যে আমাকে করবে স্মরণ

মুড়ির মোয়ায় কামড় দিয়ে

জিহ্বা কাটলে করবে মনে

আমিও তার নিয়েছি নাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

ছাতিম তলায় মাদুর পেতে

শিউলি মালা গাঁথতে গাঁথতে

যে দেখবে আমার ছবি

নতুন ধানের পিঠা খেতে

শুকবে আমার শরীরের ঘ্রাণ

চিঠি আমি তাকেই দিলাম

কলেজ গেটে কামাল মামার

চালতার আচার কামরাঙ্গা ঝাল ভোলেনি যে

নকশি পিঠায় সংগোপনে

লিখেছে যে আমার নাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

আমার চিঠি বুকের ভাঁজে

লুকিয়ে রেখে স্মৃতির জলে

সাঁতার কেটে ভাববে যেজন

আমরা দুজন বন্ধু ছিলাম

চিঠি আমি তাকেই দিলাম।

হেমন্তের সন্ধ্যা
ভাগ্যধন বড়ুয়া

হেমন্তের সন্ধ্যায় ঘুরতে খুব ভালো লাগে

শহরে নয়, শহরতলি কিংবা গ্রামে

একা নয়, প্রিয়জনের সঙ্গে

কথা বলতে বলতে,

টং দোকানে এক চুমুক চা খেতে খেতে

নদীর পাড়ে বসে নীল আকাশ দেখা আনন্দ অনুঘটক

শীতল হাওয়া শরীর ছুঁয়ে প্রকাশ করে জীবন সুন্দর।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসলে রাত শুরু

তারাগুলো জেগে জেগে কার্তিকের জমানো গল্প বলে

কালপুরুষ যেখানে গতকাল একটু আড়ালে ছিল,

আজ হাজির!

সাদা জ্যোৎস্না ঘুম কেড়ে নেয়,

ফিরিয়ে দেয় গত হেমন্তের স্মৃতি;

কেয়াজু পাড়ার তারাভরা আকাশ!

কার্তিকের করতলে কতো রাত হয়েছে গত

গোলক ঘূর্ণনে ফেলে আসা ক্ষণ ছোট ছোট দ্বীপ

কোমল হেমন্ত সন্ধ্যা নদীতীরে তোমার অপেক্ষায়

এসো,শীত আসার আগে মাতামুহুরির পাড়ে

আরেকটু জমাই গল্প ভবিষ্যতের ডেরায়...

হেমন্ত ইদানীং
মাহফুজ আল-হোসেন

শিশিরের ছানি পড়া চোখে আজকাল লাল ছাড়া অন্য কোনো রঙ ধরা পড়ে না বলেই বালখিল্য ফাল্গুনের চারিত্রিক সনদ ইদানীং হেমন্তই বিলাচ্ছে;

খালি পায়ে কাচের ওপরে হেঁটে যাওয়ার সময় সুতীক্ষè ধারগুলোকে সুখানুভূতির প্রসন্ন সবুজ ঘাস ভেবে হুটহাট হুইটম্যানের কাছে ফিরতেই পারো;

বরং, ধুলোমাখা চৈতন্যের আগাপাশতলা জুড়ে কুয়াশার প্রলেপ দিয়ে দাও- দেখবে অকস্মাৎ অরণ্যের পোস্টম্যান এসে ভাঁজভাঙা কবিতার লেফাফা দিয়ে গেছে!

নিজল মেঘের গান
মতিন রায়হান

নিজল মেঘের গান কে শুনেছে? ভিজি আমি নিত্য!

যে খোঁজে জলের ধারা পাই তাকে প্রভাতের রাগে;

মৃদুমন্দ বাতাসের রং কে দেখেছে? কে ছুঁয়েছে তার

জলগন্ধী হৃদয়কুহর? কংলাক থেকে লুসাই পর্বত

আহা, কী বিস্তৃত সবুজের ঢেউ, সমুদ্র কোথায়? দেখি,

হেমন্তের নিজল মেঘের ডানা; সকালের সোনাঝরা

রোদ আর চিত্তহরা উদাসী চিম্বাল, ডাকে দূরের চিম্বুক!

আমি রোদে-মেঘে ভিজি, ভিজাই হৃদয়! আচ্ছা,

জনকোলাহল ছেড়ে মাঝেমধ্যে মন কেন ছুটে যায়

পাহাড় ও সমুদ্রের কাছে? অটল পাহাড় কথা বলে

কোন্ সে ভাষায়? রুইলুই পাড়া, জানো তুমি? জানো

নিপুণা জুলিরা? সমতলের মানুষ কী খোঁজে চটুল

চোখে? টের পাও জুম্ম নারী? তুলোট মেঘের মতো

মুহূর্তে ভিজিয়ে দাও পর্যটকী মন! তোমাদের সারল্যে

কে ভেজে, তা জানি না! তবে বাঁচে যে কবির চিত্ত!

নিজল মেঘের গান কে শুনেছে? ভিজি আমি নিত্য!

চিম্বাল : লুসাই শব্দ। এর অর্থ রংধনু।

জুম্ম : শব্দটি এসেছে পাহাড়িদের জুম চাষ থেকে।

জুম্ম মানে পাহাড়ের অধিবাসী।

হেমন্তিকা
মুশাররাত

কেন যেন তার মুগ্ধ দ্যুতি শেষ হয় না

নিঃশেষ করে কমলা রোদটা মাখা হয় না

ঘন মেঘের কালি মনের ক্যানভাস ছেয়ে যায়

গোলাপী বিকেলও তোমাকে ভেবে চমকায়

শিহরন জাগায় বৃষ্টি, বকুলের গন্ধ নিতে

কালোর মাঝেও আলো খুঁজে নেই নক্ষত্রের রাতে

হিমঝুরিতে দেব কাঞ্চনের দেখা মেলে না

এ যেন ঠিক ভালোবাসার আগে ভালো লাগা,পূর্বাভাস

হিম হিম ছোঁয়া, পৌষী মেয়েকে বুকে টেনে নেবার অস্ফুট স্বাদ

প্রকাশ্যে আসুক, সহাস্যে সাজুক প্রেম-প্রকৃতি বা সোনালি আমন

কামিনীর ডাকে হেমন্তিকার মন্থিত রূপের আস্ফালন

নরম কোমল শিউলী যেন কিশোরী হাতের তালু

তলানীতে যাক জল- খাল, বিলে, মৃত্তিকার যৌবন আলুথালু

বকফুল ফোটে, কী যে মায়া জোটে

আধো কুয়াশায়- লাজ ভাঙা বৌ;

হালকা ঘিয়ের আঁচল যেমন

সতেজ ঘাসে, ধীরে ধীরে হাসে, ঝিকিমিকি শিশির

স্নাত শরীরে, বৃক্ষেরও যেন উন্মন মন

প্রথম প্রেমের ছোঁয়া যেন

এই ‘হৈমন্তী’, রবিরও যেমন।

আমার হেমন্ত
যাকিয়া সুমি সেতু

হিমঝুরি ফুলের দেশে হেমন্তের চিঠি

শিশিরের পাতা জুড়েই নবান্নের ঘ্রাণ

মধুগন্ধীপিঠে, শালুকখৈ, এলাচবাতাসা

শখের চুড়ি, বাউলগান, কৃষ্ণবাঁশি রাতভর

নীল কুয়াশা থেকে, হেমন্ত এসে ঢেলে দেয়

খুশির হলুদ, মাঠভরে কৃষকের সোনাধানে

চুনকড়ি, চিত্রা, মহানন্দা, কর্ণঝরা, লোনা

সব জলেই হেমন্তের নরম রোদের চিঠি

বণিক, বন্দর আর বারাঙ্গনা ভালোবাসা-

ব্রাহ্মবৈবর্ত পুরাণও- কামরূপে কথা বলে

রঙধনু সূর্যচিত্র খুলে, চেয়ে থাকি সারাদিন

বনমেঘে, শস্য বুনে আমিও হেমন্ত-রূপকথা

আহা হেমন্ত! মৃন্ময়ী- কার্তিক লাবণ্যপ্রভা

মৌর্য-শুঙ্গ-পাথরপাতা পেরিয়ে এসেছো

বোধনের পর দুর্গাঠাকুরকে ভাসিয়ে চুপিচুপি

তোমার শিশিরে ভিজেছে বঙ্গ, গৌড়,সমতট,

হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, রাঢ়, পু-্র, বারিন্দ্রী

আরও ডোম, কোল, হাড়ি, চ-াল বাংলায়

তুমি আসো গভীর গহন হতে, আমার হেমন্ত-

দুপুর
সুবীর সরকার

আসলে তো মেঘের দুপুর।

দানাশষ্য ভিজে যাওয়া দুপুর।

দূরে সরে যাওয়া নদী।

দূরে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া

বন্দর।

তদন্ত সাপেক্ষ বিষয় নিয়ে কথা বলি

না

শরীরে আলস্য জড়িয়ে এস্কিমোদের দেশের

ছবি দেখি

সতর্কতা ভেঙে গেলে

চিমনি থেকে ছাই উড়ে

এদিকে ধান তামাকের গল্প।

শিকার আর শিকারির গল্প।

জন্মান্তর থেকে উড়ে আসে

রুমাল।

হেমন্তের জন্মকাব্য
প্রণব মজুমদার

চাইলেই কি মুছে দেওয়া যায় সব?

প্রথম আলোর মাহেন্দ্রক্ষণের কলরব!

হেমন্তের অমাবস্যার রাত্রিভূমে প্রাণের কোলাহল,

গোলায় ওঠা সুগন্ধি কনকতারা হলুদাভ ধানের উৎসব

মধ্য অগ্রহায়ণে নিঝুম রাতের প্রাণবন্ত সম্মিলিত আবেগ কিংবা

রতœগর্ভা নীলিমার সপ্তম আত্মজার গগণভেদী প্রথম চিৎকার!

ফেলে আসা গতকাল; না ভুলে যাওয়া যায় না!

উদ্ভাসিত প্রভায় তাকে আবৃত করা যায় না।

পারছি কি ভুলে যেতে সেইসব দিনরাত্রি?

আমি আমার জন্মের কথা বলছি;

আমার মায়ের বেদনার কথা বলছি,

নাড়িছেঁড়া রক্তাক্ত গর্ভ আঘাতের মর্ম কথার বর্ণন করছি।

আঁতুড়ঘরে ধাত্রী সুবেশী সগৌরবে মাকে বলেছিলেন

জন্মের এ আসরে নীলু, এতো দেখি-

নারায়ণ দেবতার মতো ভূমিষ্ঠ হলো তোমার পুত্র দৌলত!

গর্ভ থেকে আনা শিশুদান শেষে পাল বাজারের গিরিশ সাহার প্যারাডাইসের

কাঁচা সন্দেশ ও মচমচে নিমকির ভোজনে ধাত্রীর উচ্ছ্বসিত আবদার

আর নবী স্টোরের ফারুকের ধবধবে সুতি শাড়ির বায়না।

আঁতুড়ঘর মাতৃমঙ্গলের ফেলে আসা মায়ের মুখে

তারুণ্যে শোনা সোনালি দিনের স্মৃতিপদ্য-

পড়ন্ত বিকেলে তা আনন্দ আলোর মতো

নেত্রাভিমুখে জ্বলজ্বল করে এখনও;

অমুছনীয় স্বর্ণময় অতীত তাতো আমার গৌরবের বর্তমান

হেমন্তে তাই আমার জন্মের মুহূর্তগুলো কী করে যাই ভুলে?

অনিবার্য মৃত্যুর মতো জন্মও সত্য; তা নিয়েই তো আগামী।

back to top