alt

সাময়িকী

ফিওদর দস্তয়েভস্কি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

গৌতম গুহ রায়

: বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা ঘটে ম্যক্সিম গোর্কি যখন দস্তয়েভস্কির লেখালেখিকে আক্রমণ করলেন। ১৯০৫-এ গোর্কি দস্তয়েভস্কিকে ‘রাশিয়ার অশুভ প্রতিভা’ বলে উল্লেখ করেন এবং তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যাচারীদের কাছে আত্মসমর্পণকারী হিসাবে উল্লেখ করেন। এরপর স্টালিনীয় জামানায় দস্তয়েভস্কির উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, সেটা দস্তয়েভস্কির দুদিকের ভিন্ন মূল্যায়ন। একদিকে ‘পুয়োর ফোক’, ‘ক্রাইম এন্ড পামিশমেন্ট’ প্রভৃতি শুভ ও প্রগতিবাদী সাহিত্য বলে গ্রহণ করা হলো,অন্যদিকে ‘ব্র্রাদার্স কারমাজভ’ ‘ইডিয়ট’ প্রভৃতিকে অপসাহিত্য বা নষ্ট সাহিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়। বিখ্যাত মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক গেয়র্গ লুকাচ একটি প্রবন্ধে দস্তয়েভস্কির প্রবৃত্তিমনস্ক সহানুভূতি ও মুখরআদর্শ-এর দ্বন্দের কথা তোলেন কিন্তু দস্তয়েভস্কি তাঁর যে বিশাল সাহিত্য সম্ভারের মনবিক অনুভবের গভীর বৌদ্ধিক দায়বোধের পরিচয় রেখে একজন সার্থক শিল্পী হিসাবে পরিগণিত হন তার উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন। এমনকি বিখ্যাত তাত্ত্বিক এম.এম. বাখতিন তাঁর বই ‘দস্তয়েভস্কির রচনার সমাস্যা’ (১৯১৯)-এ লিখেছেন যে, দস্তয়েভস্কি এক বিশেষ ধরনে পলিফোনিক নোভেলতৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ উপন্যাসের নানা স্বরের শরিক, একটাকেও লেখকের স্বর বলা যাবে না। বাখতিন বলেন যে, ‘যাবতীয় সংজ্ঞা, যাবতীয় দৃষ্টিকোণ আসছে সংলাপ থেকে। দস্তয়েভস্কির পৃথিবীতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’।

ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মের কিছুদিন আগেই রাশিয়ার উপর দিয়ে রাজনৈতিক ও সামজিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। তাঁর জন্মের ৯ বছর আগে নেপোলিয়ন তাঁর রাজকীয় সেনানিয়ে রাশিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের সত্তর বছর আগেই, ১৮৪৭ সালে দস্তয়েভস্কি ‘পেত্রাশেভস্কি সার্কেল’ নামে এক সোসালিস্ট ভাবনার রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেন। এরপর তিনি একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থায় নাম লেখান। ১৮৪৯এ গ্রেপ্তার হন। আট মাস জেল খাটার পর জার শাসনের বিচারে তাঁদের ২১ জনের মৃত্যুদ- দেওয়া হয় ‘মারাত্মক রাজদ্রোহিতার’ অপরাধে। ১৮৪৯এর ২৯শেএপ্রিল থেকে নভেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত চলে এই তদন্ত ও বিচার। ১৮৪৯এর ২২ ডিসেম্বর নির্ধারিত হয় সেই সাজা কার্যকরী করার তারিখ। ১৮৪৯এর ডিসেম্বরের শীতের দুপুর, তখন তিনি ২৮ বছরের তরুণ। তাদের পুরো দলটাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করানো হয়। তিন জন করে প্রতি রো বা সারিতে, রাষ্ট্রীয় নির্দেশে এঁদের একে একে হত্যা করা হবে। দ্বিতীয় সারিতে দস্তয়েভস্কি। ট্রিগার তৈরি। এমন সময় খবর আসে জার এঁদের প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন। দস্তয়েভস্কি ও তাঁর সাথীরা প্রাণে বাঁচলেন, বিশ্বসাহিত্যের এক ক্ষণজন্মালেখকের পুনর্জন্ম হলো। ২৪ ডিসেম্বর রাত্রে দস্তয়েভস্কিসহ অন্যদের সাইবেরিয়া নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই বয়সে মাথার উপর নেমে আসা এই নির্বাসন তাঁকে আঘাত দিলেও তিনি মনের বল হারাননি। দাদা মিখাইলকে চিঠিতে লিখেছিলেনÑ ‘আমি হতাশ হইনি, ভেঙ্গে পড়িনি। ...লিখবার শক্তি ও লেখনি হাতে থাকলে পনের বছর সময়টাকেও ভালোভাবে কাটানো যাবে।’ এরপর সাইবেরিয়ার জেলবন্দী জীবন তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছেও। প্রচ- অমানুষিক নিপীড়ন তাঁকে এখানে সহ্য করতে হয়েছে। ‘House of the Dead’-এ এই অসহনীয় যন্ত্রণার ছাপ পাওয়া যায়। এখানে দস্তয়েভস্কিকে অনেক সময় বিশ্রী আবহাওয়া, বৃষ্টিতে, ঘন কুয়াশায় কাজ করতে হয়েছেÑ এমন ঠান্ডায় যে জমে থাক্র উপক্রম। তাঁকে অন্যান্য বেশ কয়েকজন কায়েদির সঙ্গে একটা পুরোনো নড়বড়ে ঘরে থাকতে হয়েছে।শীতে অসম্ভব ঠা-া আর গরমে খুব গরম সেই আস্থানা। মেঝেতে পুরু নোংরা। ছোট জানালা দিয়ে আলো প্রায় আস্তেই পারেনা, ফলে দস্তয়েভস্কির পড়াশোনার সুযোগ ছিলোই না প্রায়। ছাঁদ দিয়ে জল পড়ে ঘরটা ভিজে থাকতো, সেই ঘরের মধ্যেই কাপড় কাঁচতে হতো। ছাড়পোকার ও মশার কামড়, আন্যান্য কায়েদিদের মধ্যে ঝগরা, মারপিট দস্তয়েভস্কির জীবনে নরক যন্ত্রণা এনে দিয়েছিলো। এই অমস্ক জেলে তিনি দেখেছিলেন কয়েদি ইলিনস্কিকে। পিতৃ হত্যার দায়ে জেল খাটছিলো সে। দস্তয়েভস্কি তাকে দেখে নিজের পিতার খুন হওয়ার কথা মনে করতেন। এই ইলিনয়স্কি থেকেই তিনি ভেবে নিয়েছিলেন ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’এর দিমিত্রি চরিত্রটি। ১৮৮০তে প্রকাশিত ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ দস্তয়েভস্কির মুখ্য সৃষ্টি হিসাবে স্বীকৃত। সেই সময়ের স্বদেশ, তার সামাজিক বিপন্নতার কথা, বিপন্ন ব্যক্তির কথা দস্তয়েভস্কি তাঁর আখ্যানে তুলে এনেছেন। দুই প্রজন্ম, এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি পরিবারকেন্দ্রিক হলেও আসলে এটি গোটা দেশের বা ইউরোপের তৎকালীন বাস্তবতা।

‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর মূল বিষয় তিন পুত্র ও পিতৃ হত্যার ঘটনা, এই হত্যাকে কেন্দ্র করেই এক প্রজন্মের আত্মজিজ্ঞাসা ও মানসিক ঘাত প্রতিঘাতের আখ্যান।এই উপন্যাসটি লিখবার পরিকল্পনা বেশ কিছুদিন আগেই শুরু করেছিলেন দস্তয়েভস্কি। চার বছর এই সশ্রম কারাবাসের পর ১৮৫৪তে মুক্তি না তাঁকে দিয়ে সাইবেরিয়ারই সেমিয়াপালাতিনস্ক-এ সাধারণ সেনা হিসাবে কাজ করার নির্দেশ আসে। এই অবস্থায় দু বছর কাটে তাঁর। এই সময় তিনি গৃহশিক্ষকতাও করেন। এই সময়কাল দস্তয়েভস্কির জীবনে ঘটনাবহুল সময়। ১৮৫৬’র অক্টোবরে তাঁকে সেনা বিভাগেরই অফিসার হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর পরের বছর, ১৮৫৭র ৭ ফেব্রুয়ারি সেনা অফিসার থাকাকালীনই সেখানকার প্রাদেশিক শুল্ক অফিসারের বিধবা স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভানাকে বিয়ে করেন। এই নানা ঘটনার মধ্যেও দস্তয়েভস্কি তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যান। এবছরই প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আঙ্কেল ড্রিম’, বছর শেষে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ভিলেজ অফ স্তেপাঞ্চিকোভা এন্ড ইটস ইনহ্যাবিটয়ানটস’। এরপর ১৮৫৯-এ অসুস্থ হয়ে পড়েন ও সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। সেমিয়াপালাতিনস্ক থেকে চলে আসেন ‘তভের’-এ। এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর ভাই মিখাইলের, এক দশক পরে মুখোমুখি দুইভাই।এবছরই, ১৮৫৯-এর জুলাই মাসে তিনিরাজধানী শহর পিটার্সবুর্গে বসবাসের অনুমতি পান। ডিসেম্বরে চলে আসেন পিটার্সবুর্গে। কিন্তু এই সময় তাঁকে পুলিশি নজরদারিতে থাকতে হয়।

১৮৪৫ সালে দস্তয়েভস্কি লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পুয়োর ফোক’ বা ‘বিয়েদনিয়ে লিউদি’। এর আগেই তিনি অনুবাদ করেছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক বালজাকের উপন্যাস ‘অয়জেনি গ্রান্দে’ (Eugenie Grandet)। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রথম উপন্যাসেও আমরা দেখি ইউরোপীয় কথাসাহিত্যের পরম্পরা থেকেই রসদ নিয়ে শুরু করতে চাইছেন দস্তয়েভস্কি। মানবসমাজের সামাজিক অসাম্য ও ক্ষমতাকৃত অবদমনকেসাহিত্যের কেন্দ্রে রেখে তাঁর যাত্রা শুরু করা। পরিবর্তনশীল সমাজের চেহারা ও তার গতিপ্রকৃতি নিয়েই সেই সময়ের ইউরোপীয় আখ্যান বিশ্ব। প্রখ্যাত রুশ সাহিত্য-আলোচক ভিসারিওন বেলিনস্কি (১৮১১-৪৮)দস্তয়েভস্কির ‘পুয়োর ফোক’ প্রসঙ্গে প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, ‘সম্মান ওগৌরব এই লেখকের প্রতি যার লেখনী চিলেকোঠা ও নীচু ভিতের মানুষ হয়েও ঝলমলে অট্টালিকার মানুষজনকে দেখিয়ে বলেছিলেনÑ ‘দেখো এরাও মানুষ, এরাও তোমার ভাই বন্ধু। ’কিন্তু এর পরের বই ‘দ্বৈত’ তাঁকে এতটাই হতাশ করল যে দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে এক অসাধারণ উক্তি করলেন, যেটি চিরকালের সেরা উক্তি হয়ে থাকলো, ‘দস্তয়েভস্কি হয় অপমানিত ও আহতের প্রতি মায়া প্রকাশী সাথী কিংবা অপার্থিব স্বপ্নের রূপকার অথবা রুগ্ণ আত্মার ব্যবচ্ছেদক’।

‘বেদনিইয়েল্যুদি’ বা ‘পুয়োর ফোক’, বাংলায় করলে ‘দরিদ্রের আখ্যানে’-এআমরা দেখি একই বাড়ির দুই ভাড়াটিয়া প্রৌঢ় মকর আলেক্সিইভিচ ও তরুণী ভারভারা আলেক্সিয়েভের মধ্যে পত্র বিনিময়। এই চিঠির মাধ্যমে তাঁদের সম্পর্কের উন্মোচন হয় এবং সামাজিকআপাত অবক্ষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ হতে থাকে। দুই ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন রুচির ও সময়ের মানুষ উভয়ের বিপন্নতার খোঁজ পায় ও একে অন্যকে সাহায্য করতে চায়। এই ‘অসম’ ভালোবাসার সম্পর্কেরস্বাদ পাঠক উপভোগ করেন চিঠিগুলোর মধ্য দিয়ে।প্রাচীরের এধার ওধার, দুপাশের দুই অসমবয়সী মানুষের চিঠি চালাচালি হয়, কিন্তু একে অন্যের বাসায় গেলে নিন্দার ঝড় ওঠে।রান্নাঘরের মাঝে প্রাচীর আড়াল করা ছোট্ট ঘর বানিয়ে তাতে থাকেন মকর, চিঠিতে লেখেন, ‘দালানের ওপারেই আমার জানালার ওপারেই তোমার জানালা। দালানটা এতই নিকটবর্তী যে আমি সেটা অতিক্রম করলেই তোমাকে দেখতে পাই। আমার মতো হতভাগ্যের এতেই আনন্দ।’ ক্রমশ এই অসম সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেশীর কানাঘুষো করতে থাকে, এর প্রভাব তাদের সম্পর্কেও পড়ে। চিঠিগুলো ধরে রাখে এই অসম সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার দুই প্রাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এখানে দেখা যায় যে মকর আলেক্সিওভিচ তার ভালোবাসার কথা ও শব্দ আহরণ করেন কিছুটা জনপ্রিয় ও নিচু তলার সাহিত্য থেকে, যেমন আমাদের বটতলার সাহিত্য, কিন্তু তার প্রেমিকা তাকে জানাতে চান ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের রস, পুশকিন থেকে গোগল থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে সেই দিকে তাকে আকর্ষিত করতে চান।মকরের এখানে তাই অকপট স্বীকারোক্তি, ‘...চিঠির এই সব উপমা আমি নিয়েছি ওই বইটা থেকে।’ দস্তয়েভস্কি তাঁর আখ্যানে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভাজনকে তুলে ধরেছেন। মধ্যবিত্তের ‘আভিজাত্য’কে বজায় রাখতে নিম্নবিত্তের কী অপরিসীম প্রচেষ্টা তার কথা তুলে ধরেছেন লেখক।চা পানের সামর্থ্য না থাকলেও তাকে সেই ব্যবস্থা করতে হয়, মকর চিঠিতে লেখেন সেকথা, ‘ভারিংকা, ঠাট বজায় রাখতেই আমাকে চা পান করতে হয়’। একদিন এই অসম সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, যা ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু মকর সেটা সহজে মানতে পারে না। ‘শেষ চিঠি’ লিখেও সে লেখে যে, তিনি ভারিংকাকে চিঠি লিখেই যাবেন। দরিদ্র মধ্যবিত্ততার এই সংকটময় অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা জেদি জীবনস্পৃহার এই আবিষ্কারে উপন্যাসের ইতিহাসে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিসত্তার বিশ্লেষণে দস্তয়েভস্কি-র প্রথম উপন্যাসই এমন একটা পদক্ষেপ হয়ে রইল যা হয়তো আজও বিকাশশীল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে দরিদ্র-মধ্যবিত্ততার ক্রমাগত দ্বন্দ্বে উপমান হতে পারে।

দস্তয়েভস্কির সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। রুশ ভাষায় রাসকোলনিকভ শব্দের মূলে রয়েছে ‘রাসকোল’-এর অর্থ দ্বিধাবিভক্ত বা ভঙ্গুর, এই অর্থে রাসকোলনিকভ মানে দ্বিধাবিভক্ত মনের মানুষ বা ভেঙ্গে পড়া মানুষ। আমরা এখানেও দেখি এক দ্বিধাবিভক্ত মানুষকে বা দ্বৈত চরিত্রের মানুষকে। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র তৃতীয় পর্বের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা দেখি যে দিমিত্রি প্রকোফিচকে রাজুমিখিন বলছেন যে, রোদিওনকে সে দেড় বছর ধরে চেনে। ‘একটু মনমরা, বিষণœ, মেজাজি, দেমাগিও। সম্প্রতি সে সন্দেহবাতিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার মনটা দরাজ, কখনও কখনওনিজের মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলে। কখনো মনে হয় সে ভীষণ রকমের অমানুষিক ও অনুভূতিহীন। সত্যি কথা বলতে কী তার মধ্যে ঠিক যেন দুটি পরস্পরবিরোধী চরিত্র পালা করে সক্রিয় থাকে’।উপন্যাসের চরিত্রের নামকরণ নিয়ে সচেতন থাকতেন দস্তয়েভস্কি, নামের মধ্যেই রেখে দিতেন বিভিন্ন চরিত্রেরআভাস।রুশ ভাষার প-িত অরুণ সোম উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র চরিত্র প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, ‘রুশ উপন্যাসের রস গ্রহণের পক্ষে একটা বড় অন্তরায় উপন্যাসে উল্লিখিত ব্যক্তিনাম’। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে রুশ ব্যক্তিনামের মাঝখানের শব্দটি পিতৃপরিচয়জ্ঞাপকÑ পিতৃনামের অপভ্রংশ, শেষ অংশটি পদবী, স্ত্রীলিঙ্গে স্ত্রীবাচক প্রত্যয়যোগে তার রূপান্তর ঘটে। সম্পর্কের তফাতে নামের সম্বোধন বদলায়। এইউপন্যাসে আমরা পাই মার্থালাদভ নামে এক চরিত্রকে, ‘মার্থালাদভ মানে একধনের জেলী জাতীয় মিষ্টি। উপন্যাসের চরিত্রটির সঙ্গে তার স্বভাবগত মিল আছে’। আর এক চরিত্রের নাম লুজিন বা লিজা, লুজা মানে বৃষ্টির জল, জমা জল। চরিত্রটির স্বভাব জল ঘোলা করা তাই নামটি মিলে গেছে। উল্লিখিত ‘রাজুমিখিন’ নাম প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘রাজউম’ মানে বুদ্ধিবিবেচনা, বিচক্ষণতা, উপন্যাসের চরিত্রের সংগে এখানেও সাযুজ্য দেখা যায়। ‘লেবেজিয়াতিœকভ’-এর ‘লেবেজিত’ মানে হীন তোষামোদকারী। অরুণ সোম এই চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘হয়তো দস্তয়েভস্কি একে এমন একটি চরিত্র ধরেই ভেবেছিলেন, পরে নিজেই সরে যান’। এভাবে আমরা দেখি একটি উপন্যাসের আখ্যান থেকে তার চরিত্র, তার আবহ, স্থান নামÑ সর্বত্র স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে নির্মাণ করে গেছেন দস্তয়েভস্কি। দস্তয়েভস্কির ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত ব্যক্তি-জীবনের দিকে তাকালে তাঁর সাহিত্যনির্মাণঘরানার উৎসমূলের কাছে যাওয়া যাবে।দস্তয়েভস্কির জীবনের যাপন যাত্রাপথ খুবই এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত ছিলো।মদ্যপান করতেন, মদের মতোই জুয়া খেলার নেশায় মত্ত থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তুর্গেনভ লিখেছিলেন ‘দস্তয়েভস্কিÑ দ্য সাদ অব রাশিয়া’। এর ফলে জীবনের অনেকটা সময় নিদারুণ আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে। এই অর্থকষ্ট শাপেবর হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্যের জন্য। আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্য দ্রুত লিখতেন, সম্পাদকের তাগিদ মেনে সেই লেখা সময়ের মধ্যেই জমা দিতেন যাতে টাকাটা দ্রুত হাতে আসে। অনেক সমালোচকের বক্তব্য এর ফলেতাঁর লেখায় ‘প্রচুর কথার সমাহার’, আমার কাছে আবার এই ‘প্রচুর কথা’ অতিরিক্ত প্রাপ্তি। জেমস জয়েস দস্তয়েভস্কিকে ভায়োলেন্ট বা সহিংস ধাঁচের লেখক বলেছেন, যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের তিনি কথাকার সেই মনস্তত্ত্বের কারবারি ফ্রয়েড বলেছেন যে, লেখক দস্তয়েভস্কিই আমাদের মানবমনের মনস্তাত্ত্বিক ঝড়ঝঞ্ঝার প্রথম বড়মাপের বয়ানকারী।নিৎসে দস্তয়েভস্কি প্রসঙ্গে লিখেছিলে যে, ‘দস্তয়েভস্কিই একমাত্র মনস্তত্ববিদ, যার কাছ থেকে আমি কিছু শিখেছি’। এই ভায়োলেন্স ঢুকে আছেতাঁর অন্য গদ্যের মতো ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এও।দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে একের পর এক নাটকীয়তা ও ব্যক্তি জীবনের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ছিলো তাঁর লেখার চরিত্রগুলোতে। সেই নাটকীয় বাঁক আমরা ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর মতো ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এও পাই।

আনা গ্রিগোরিয়েভনাকে বিয়ে করার পর কিছুটা সুখের দেখা পেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। ১৮৭৩-এ আনা তাঁর প্রকাশক হলে আর্থিক দিক দিয়েও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসে। এই সময় তিন বছর ধরে লিখে শেষ করলেন ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’। নিজের জীবনের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।প্রায় ৮০০ পাতার এই উপন্যাস ১২টি বুক বা বিভাগে বিন্যস্ত। মোট চারটি পর্ব এবং একটি দীর্ঘ উপসংহার রয়েছে এই উপন্যাসে। গির্জার পুরোহিতের পাঠ নেওয়া আলিয়োশা কারমাজভ, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ইভান কারমাজভ এবং সৈনিক দিমিত্রি কারমাজভ নামের তিন ভাইকে নিয়ে এইউপন্যাসের বিস্তার, কেন্দ্রে তাঁদের বাবা ফিওদর। সূচনাতেই আমরা দেখি কারমাজভ পরিবারের অন্তর্কলহের কাহিনি। বাবা ফিওদর কারমাজভ এবং তার প্রথম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান দিমিত্রি কারমাজভ একজনই নারীর প্রতি আসক্ত। এই নারীর নাম গ্রুশেংকা। বাবার সঙ্গে দিমিত্রির ‘দা কুড়াল’ সম্পর্ক। চারদিকে সে বলে বেড়ায় যে সে যদি সুযোগ পেতো তবে তার এই বাবাকে সে হত্যা করতো। এই জানোয়ারটা, ফিওদর শুধু মাত্র তার মায়ের যাবতীয় সম্পত্তির দখলই নেয়নি দিমিত্রির শৈশবকেও তছনছ করে দিয়েছে। দিমিত্রিকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে সেই অর্থে তারই প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাইছে। এমন বাবা তাই তার কাছে ঘৃণ্য পুরুষ।দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসে দেখি যে ফিওদর কারমাজভ একটি শয়তানের মতো চরিত্রের মানুষ, ভালো কিছু সে সহ্যই করতে পারে না, সুন্দর যা কিছু তাকেই সে ব্যঙ্গ করে। পিতা ও পুত্রের মধ্যে ‘সম্পর্কের’ এই টানাটানি অন্তে আমরা দেখি অমানবিক বাবা ফিওদর খুন হয়ে যান, খুনি কে তা নিয়ে রহস্যময় আলোছায়ার খেলা চলে। শেষে আমরা দেখি যে দিমিত্রির ভেতর রয়েছে এক পবিত্র মন, যে মনের দুর্বলতা সুন্দরের প্রতি, মহতের প্রতি। যে গ্রুশেংকাকে নিয়ে দুজনের টানাটানি সেই নারীর প্রতি ফিওদরের লালসা ও লোভ, অন্যদিকে, দিমিত্রির মনে তারপ্রতি রয়েছে শুদ্ধ ভালোবাসা। এদিকে দিমিত্রিকে ভালোবাসে কাতারিনা। একসময় সে দিমিত্রির বাগদত্তা ছিলো। কাতারিনা ও দিমিত্রির সম্পর্কটাও খুব মর্মস্পর্শী। দস্তয়েভস্কির উপন্যাসগুলোয় আমরা দেখি মানুষের চরিত্রের নানা রহস্যময়তার পাশাপাশি ভালোবাসার সম্পর্কের নানা স্তরের প্রকাশ। যেমন ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’। (চলবে)

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

ছবি

স্বপ্ন অথবা বিপন্ন বিস্ময়

ছবি

ছাতিম যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ

ছবি

সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ

ছবি

সমকালিক ঘটনাবলির রূপকার

ছবি

হেমন্ত পদাবলি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

রূপান্তরিত

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

tab

সাময়িকী

ফিওদর দস্তয়েভস্কি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

গৌতম গুহ রায়

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

(পূর্ব প্রকাশের পর)

সবচেয়ে দুঃখের ঘটনা ঘটে ম্যক্সিম গোর্কি যখন দস্তয়েভস্কির লেখালেখিকে আক্রমণ করলেন। ১৯০৫-এ গোর্কি দস্তয়েভস্কিকে ‘রাশিয়ার অশুভ প্রতিভা’ বলে উল্লেখ করেন এবং তাঁকে প্রতিক্রিয়াশীল ও অত্যাচারীদের কাছে আত্মসমর্পণকারী হিসাবে উল্লেখ করেন। এরপর স্টালিনীয় জামানায় দস্তয়েভস্কির উপর অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এতে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে যায়, সেটা দস্তয়েভস্কির দুদিকের ভিন্ন মূল্যায়ন। একদিকে ‘পুয়োর ফোক’, ‘ক্রাইম এন্ড পামিশমেন্ট’ প্রভৃতি শুভ ও প্রগতিবাদী সাহিত্য বলে গ্রহণ করা হলো,অন্যদিকে ‘ব্র্রাদার্স কারমাজভ’ ‘ইডিয়ট’ প্রভৃতিকে অপসাহিত্য বা নষ্ট সাহিত্য বলে চিহ্নিত করা হয়। বিখ্যাত মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক গেয়র্গ লুকাচ একটি প্রবন্ধে দস্তয়েভস্কির প্রবৃত্তিমনস্ক সহানুভূতি ও মুখরআদর্শ-এর দ্বন্দের কথা তোলেন কিন্তু দস্তয়েভস্কি তাঁর যে বিশাল সাহিত্য সম্ভারের মনবিক অনুভবের গভীর বৌদ্ধিক দায়বোধের পরিচয় রেখে একজন সার্থক শিল্পী হিসাবে পরিগণিত হন তার উল্লেখ থেকে বিরত থাকেন। এমনকি বিখ্যাত তাত্ত্বিক এম.এম. বাখতিন তাঁর বই ‘দস্তয়েভস্কির রচনার সমাস্যা’ (১৯১৯)-এ লিখেছেন যে, দস্তয়েভস্কি এক বিশেষ ধরনে পলিফোনিক নোভেলতৈরি করেছিলেন, অর্থাৎ উপন্যাসের নানা স্বরের শরিক, একটাকেও লেখকের স্বর বলা যাবে না। বাখতিন বলেন যে, ‘যাবতীয় সংজ্ঞা, যাবতীয় দৃষ্টিকোণ আসছে সংলাপ থেকে। দস্তয়েভস্কির পৃথিবীতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’।

ফিওদর দস্তয়েভস্কির জন্মের কিছুদিন আগেই রাশিয়ার উপর দিয়ে রাজনৈতিক ও সামজিক বিপর্যয় ঘটে গেছে। তাঁর জন্মের ৯ বছর আগে নেপোলিয়ন তাঁর রাজকীয় সেনানিয়ে রাশিয়া থেকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। রাশিয়ার বলশেভিক বিপ্লবের সত্তর বছর আগেই, ১৮৪৭ সালে দস্তয়েভস্কি ‘পেত্রাশেভস্কি সার্কেল’ নামে এক সোসালিস্ট ভাবনার রাজনৈতিক সংগঠনে যোগ দেন। এরপর তিনি একটি গোপন বিপ্লবী সংস্থায় নাম লেখান। ১৮৪৯এ গ্রেপ্তার হন। আট মাস জেল খাটার পর জার শাসনের বিচারে তাঁদের ২১ জনের মৃত্যুদ- দেওয়া হয় ‘মারাত্মক রাজদ্রোহিতার’ অপরাধে। ১৮৪৯এর ২৯শেএপ্রিল থেকে নভেম্বরের ১৬ তারিখ পর্যন্ত চলে এই তদন্ত ও বিচার। ১৮৪৯এর ২২ ডিসেম্বর নির্ধারিত হয় সেই সাজা কার্যকরী করার তারিখ। ১৮৪৯এর ডিসেম্বরের শীতের দুপুর, তখন তিনি ২৮ বছরের তরুণ। তাদের পুরো দলটাকে ফায়ারিং স্কোয়াডে দাঁড় করানো হয়। তিন জন করে প্রতি রো বা সারিতে, রাষ্ট্রীয় নির্দেশে এঁদের একে একে হত্যা করা হবে। দ্বিতীয় সারিতে দস্তয়েভস্কি। ট্রিগার তৈরি। এমন সময় খবর আসে জার এঁদের প্রাণভিক্ষা দিয়েছেন। দস্তয়েভস্কি ও তাঁর সাথীরা প্রাণে বাঁচলেন, বিশ্বসাহিত্যের এক ক্ষণজন্মালেখকের পুনর্জন্ম হলো। ২৪ ডিসেম্বর রাত্রে দস্তয়েভস্কিসহ অন্যদের সাইবেরিয়া নির্বাসনে পাঠানো হয়। এই বয়সে মাথার উপর নেমে আসা এই নির্বাসন তাঁকে আঘাত দিলেও তিনি মনের বল হারাননি। দাদা মিখাইলকে চিঠিতে লিখেছিলেনÑ ‘আমি হতাশ হইনি, ভেঙ্গে পড়িনি। ...লিখবার শক্তি ও লেখনি হাতে থাকলে পনের বছর সময়টাকেও ভালোভাবে কাটানো যাবে।’ এরপর সাইবেরিয়ার জেলবন্দী জীবন তাঁকে অনেক কিছু দিয়েছেও। প্রচ- অমানুষিক নিপীড়ন তাঁকে এখানে সহ্য করতে হয়েছে। ‘House of the Dead’-এ এই অসহনীয় যন্ত্রণার ছাপ পাওয়া যায়। এখানে দস্তয়েভস্কিকে অনেক সময় বিশ্রী আবহাওয়া, বৃষ্টিতে, ঘন কুয়াশায় কাজ করতে হয়েছেÑ এমন ঠান্ডায় যে জমে থাক্র উপক্রম। তাঁকে অন্যান্য বেশ কয়েকজন কায়েদির সঙ্গে একটা পুরোনো নড়বড়ে ঘরে থাকতে হয়েছে।শীতে অসম্ভব ঠা-া আর গরমে খুব গরম সেই আস্থানা। মেঝেতে পুরু নোংরা। ছোট জানালা দিয়ে আলো প্রায় আস্তেই পারেনা, ফলে দস্তয়েভস্কির পড়াশোনার সুযোগ ছিলোই না প্রায়। ছাঁদ দিয়ে জল পড়ে ঘরটা ভিজে থাকতো, সেই ঘরের মধ্যেই কাপড় কাঁচতে হতো। ছাড়পোকার ও মশার কামড়, আন্যান্য কায়েদিদের মধ্যে ঝগরা, মারপিট দস্তয়েভস্কির জীবনে নরক যন্ত্রণা এনে দিয়েছিলো। এই অমস্ক জেলে তিনি দেখেছিলেন কয়েদি ইলিনস্কিকে। পিতৃ হত্যার দায়ে জেল খাটছিলো সে। দস্তয়েভস্কি তাকে দেখে নিজের পিতার খুন হওয়ার কথা মনে করতেন। এই ইলিনয়স্কি থেকেই তিনি ভেবে নিয়েছিলেন ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’এর দিমিত্রি চরিত্রটি। ১৮৮০তে প্রকাশিত ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ দস্তয়েভস্কির মুখ্য সৃষ্টি হিসাবে স্বীকৃত। সেই সময়ের স্বদেশ, তার সামাজিক বিপন্নতার কথা, বিপন্ন ব্যক্তির কথা দস্তয়েভস্কি তাঁর আখ্যানে তুলে এনেছেন। দুই প্রজন্ম, এদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব একটি পরিবারকেন্দ্রিক হলেও আসলে এটি গোটা দেশের বা ইউরোপের তৎকালীন বাস্তবতা।

‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর মূল বিষয় তিন পুত্র ও পিতৃ হত্যার ঘটনা, এই হত্যাকে কেন্দ্র করেই এক প্রজন্মের আত্মজিজ্ঞাসা ও মানসিক ঘাত প্রতিঘাতের আখ্যান।এই উপন্যাসটি লিখবার পরিকল্পনা বেশ কিছুদিন আগেই শুরু করেছিলেন দস্তয়েভস্কি। চার বছর এই সশ্রম কারাবাসের পর ১৮৫৪তে মুক্তি না তাঁকে দিয়ে সাইবেরিয়ারই সেমিয়াপালাতিনস্ক-এ সাধারণ সেনা হিসাবে কাজ করার নির্দেশ আসে। এই অবস্থায় দু বছর কাটে তাঁর। এই সময় তিনি গৃহশিক্ষকতাও করেন। এই সময়কাল দস্তয়েভস্কির জীবনে ঘটনাবহুল সময়। ১৮৫৬’র অক্টোবরে তাঁকে সেনা বিভাগেরই অফিসার হিসাবে পদোন্নতি দেয়া হয়। এর পরের বছর, ১৮৫৭র ৭ ফেব্রুয়ারি সেনা অফিসার থাকাকালীনই সেখানকার প্রাদেশিক শুল্ক অফিসারের বিধবা স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভানাকে বিয়ে করেন। এই নানা ঘটনার মধ্যেও দস্তয়েভস্কি তাঁর লেখালেখি চালিয়ে যান। এবছরই প্রকাশিত হয় তাঁর ‘আঙ্কেল ড্রিম’, বছর শেষে প্রকাশিত হয় ‘দ্য ভিলেজ অফ স্তেপাঞ্চিকোভা এন্ড ইটস ইনহ্যাবিটয়ানটস’। এরপর ১৮৫৯-এ অসুস্থ হয়ে পড়েন ও সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা দেন। সেমিয়াপালাতিনস্ক থেকে চলে আসেন ‘তভের’-এ। এখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর ভাই মিখাইলের, এক দশক পরে মুখোমুখি দুইভাই।এবছরই, ১৮৫৯-এর জুলাই মাসে তিনিরাজধানী শহর পিটার্সবুর্গে বসবাসের অনুমতি পান। ডিসেম্বরে চলে আসেন পিটার্সবুর্গে। কিন্তু এই সময় তাঁকে পুলিশি নজরদারিতে থাকতে হয়।

১৮৪৫ সালে দস্তয়েভস্কি লিখলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘পুয়োর ফোক’ বা ‘বিয়েদনিয়ে লিউদি’। এর আগেই তিনি অনুবাদ করেছিলেন ফরাসি সাহিত্যিক বালজাকের উপন্যাস ‘অয়জেনি গ্রান্দে’ (Eugenie Grandet)। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর প্রথম উপন্যাসেও আমরা দেখি ইউরোপীয় কথাসাহিত্যের পরম্পরা থেকেই রসদ নিয়ে শুরু করতে চাইছেন দস্তয়েভস্কি। মানবসমাজের সামাজিক অসাম্য ও ক্ষমতাকৃত অবদমনকেসাহিত্যের কেন্দ্রে রেখে তাঁর যাত্রা শুরু করা। পরিবর্তনশীল সমাজের চেহারা ও তার গতিপ্রকৃতি নিয়েই সেই সময়ের ইউরোপীয় আখ্যান বিশ্ব। প্রখ্যাত রুশ সাহিত্য-আলোচক ভিসারিওন বেলিনস্কি (১৮১১-৪৮)দস্তয়েভস্কির ‘পুয়োর ফোক’ প্রসঙ্গে প্রশংসা করে লিখেছিলেন যে, ‘সম্মান ওগৌরব এই লেখকের প্রতি যার লেখনী চিলেকোঠা ও নীচু ভিতের মানুষ হয়েও ঝলমলে অট্টালিকার মানুষজনকে দেখিয়ে বলেছিলেনÑ ‘দেখো এরাও মানুষ, এরাও তোমার ভাই বন্ধু। ’কিন্তু এর পরের বই ‘দ্বৈত’ তাঁকে এতটাই হতাশ করল যে দস্তয়েভস্কি সম্পর্কে এক অসাধারণ উক্তি করলেন, যেটি চিরকালের সেরা উক্তি হয়ে থাকলো, ‘দস্তয়েভস্কি হয় অপমানিত ও আহতের প্রতি মায়া প্রকাশী সাথী কিংবা অপার্থিব স্বপ্নের রূপকার অথবা রুগ্ণ আত্মার ব্যবচ্ছেদক’।

‘বেদনিইয়েল্যুদি’ বা ‘পুয়োর ফোক’, বাংলায় করলে ‘দরিদ্রের আখ্যানে’-এআমরা দেখি একই বাড়ির দুই ভাড়াটিয়া প্রৌঢ় মকর আলেক্সিইভিচ ও তরুণী ভারভারা আলেক্সিয়েভের মধ্যে পত্র বিনিময়। এই চিঠির মাধ্যমে তাঁদের সম্পর্কের উন্মোচন হয় এবং সামাজিকআপাত অবক্ষয়ের বিস্তারিত বর্ণনা লিপিবদ্ধ হতে থাকে। দুই ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন রুচির ও সময়ের মানুষ উভয়ের বিপন্নতার খোঁজ পায় ও একে অন্যকে সাহায্য করতে চায়। এই ‘অসম’ ভালোবাসার সম্পর্কেরস্বাদ পাঠক উপভোগ করেন চিঠিগুলোর মধ্য দিয়ে।প্রাচীরের এধার ওধার, দুপাশের দুই অসমবয়সী মানুষের চিঠি চালাচালি হয়, কিন্তু একে অন্যের বাসায় গেলে নিন্দার ঝড় ওঠে।রান্নাঘরের মাঝে প্রাচীর আড়াল করা ছোট্ট ঘর বানিয়ে তাতে থাকেন মকর, চিঠিতে লেখেন, ‘দালানের ওপারেই আমার জানালার ওপারেই তোমার জানালা। দালানটা এতই নিকটবর্তী যে আমি সেটা অতিক্রম করলেই তোমাকে দেখতে পাই। আমার মতো হতভাগ্যের এতেই আনন্দ।’ ক্রমশ এই অসম সম্পর্ক নিয়ে প্রতিবেশীর কানাঘুষো করতে থাকে, এর প্রভাব তাদের সম্পর্কেও পড়ে। চিঠিগুলো ধরে রাখে এই অসম সম্পর্ককে টিকিয়ে রাখার দুই প্রাণের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা। এখানে দেখা যায় যে মকর আলেক্সিওভিচ তার ভালোবাসার কথা ও শব্দ আহরণ করেন কিছুটা জনপ্রিয় ও নিচু তলার সাহিত্য থেকে, যেমন আমাদের বটতলার সাহিত্য, কিন্তু তার প্রেমিকা তাকে জানাতে চান ক্লাসিক্যাল সাহিত্যের রস, পুশকিন থেকে গোগল থেকে তিনি উদ্ধৃতি দিয়ে সেই দিকে তাকে আকর্ষিত করতে চান।মকরের এখানে তাই অকপট স্বীকারোক্তি, ‘...চিঠির এই সব উপমা আমি নিয়েছি ওই বইটা থেকে।’ দস্তয়েভস্কি তাঁর আখ্যানে সামাজিক স্তরবিন্যাসের বিভাজনকে তুলে ধরেছেন। মধ্যবিত্তের ‘আভিজাত্য’কে বজায় রাখতে নিম্নবিত্তের কী অপরিসীম প্রচেষ্টা তার কথা তুলে ধরেছেন লেখক।চা পানের সামর্থ্য না থাকলেও তাকে সেই ব্যবস্থা করতে হয়, মকর চিঠিতে লেখেন সেকথা, ‘ভারিংকা, ঠাট বজায় রাখতেই আমাকে চা পান করতে হয়’। একদিন এই অসম সম্পর্ক ভেঙ্গে যায়, যা ছিলো স্বাভাবিক। কিন্তু মকর সেটা সহজে মানতে পারে না। ‘শেষ চিঠি’ লিখেও সে লেখে যে, তিনি ভারিংকাকে চিঠি লিখেই যাবেন। দরিদ্র মধ্যবিত্ততার এই সংকটময় অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা জেদি জীবনস্পৃহার এই আবিষ্কারে উপন্যাসের ইতিহাসে ইতিহাসের প্রেক্ষিতে ব্যক্তিসত্তার বিশ্লেষণে দস্তয়েভস্কি-র প্রথম উপন্যাসই এমন একটা পদক্ষেপ হয়ে রইল যা হয়তো আজও বিকাশশীল বা উত্তর-ঔপনিবেশিক দেশে দরিদ্র-মধ্যবিত্ততার ক্রমাগত দ্বন্দ্বে উপমান হতে পারে।

দস্তয়েভস্কির সবচেয়ে আলোচিত উপন্যাস ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’। রুশ ভাষায় রাসকোলনিকভ শব্দের মূলে রয়েছে ‘রাসকোল’-এর অর্থ দ্বিধাবিভক্ত বা ভঙ্গুর, এই অর্থে রাসকোলনিকভ মানে দ্বিধাবিভক্ত মনের মানুষ বা ভেঙ্গে পড়া মানুষ। আমরা এখানেও দেখি এক দ্বিধাবিভক্ত মানুষকে বা দ্বৈত চরিত্রের মানুষকে। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র তৃতীয় পর্বের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে আমরা দেখি যে দিমিত্রি প্রকোফিচকে রাজুমিখিন বলছেন যে, রোদিওনকে সে দেড় বছর ধরে চেনে। ‘একটু মনমরা, বিষণœ, মেজাজি, দেমাগিও। সম্প্রতি সে সন্দেহবাতিক হয়ে উঠেছে। কিন্তু তার মনটা দরাজ, কখনও কখনওনিজের মনের ভাব প্রকাশ করে ফেলে। কখনো মনে হয় সে ভীষণ রকমের অমানুষিক ও অনুভূতিহীন। সত্যি কথা বলতে কী তার মধ্যে ঠিক যেন দুটি পরস্পরবিরোধী চরিত্র পালা করে সক্রিয় থাকে’।উপন্যাসের চরিত্রের নামকরণ নিয়ে সচেতন থাকতেন দস্তয়েভস্কি, নামের মধ্যেই রেখে দিতেন বিভিন্ন চরিত্রেরআভাস।রুশ ভাষার প-িত অরুণ সোম উদাহরণ দিয়ে এ বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। ‘অপরাধ ও শাস্তি’র চরিত্র প্রসঙ্গে লিখেছেন যে, ‘রুশ উপন্যাসের রস গ্রহণের পক্ষে একটা বড় অন্তরায় উপন্যাসে উল্লিখিত ব্যক্তিনাম’। স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে রুশ ব্যক্তিনামের মাঝখানের শব্দটি পিতৃপরিচয়জ্ঞাপকÑ পিতৃনামের অপভ্রংশ, শেষ অংশটি পদবী, স্ত্রীলিঙ্গে স্ত্রীবাচক প্রত্যয়যোগে তার রূপান্তর ঘটে। সম্পর্কের তফাতে নামের সম্বোধন বদলায়। এইউপন্যাসে আমরা পাই মার্থালাদভ নামে এক চরিত্রকে, ‘মার্থালাদভ মানে একধনের জেলী জাতীয় মিষ্টি। উপন্যাসের চরিত্রটির সঙ্গে তার স্বভাবগত মিল আছে’। আর এক চরিত্রের নাম লুজিন বা লিজা, লুজা মানে বৃষ্টির জল, জমা জল। চরিত্রটির স্বভাব জল ঘোলা করা তাই নামটি মিলে গেছে। উল্লিখিত ‘রাজুমিখিন’ নাম প্রসঙ্গে বলা যায়, ‘রাজউম’ মানে বুদ্ধিবিবেচনা, বিচক্ষণতা, উপন্যাসের চরিত্রের সংগে এখানেও সাযুজ্য দেখা যায়। ‘লেবেজিয়াতিœকভ’-এর ‘লেবেজিত’ মানে হীন তোষামোদকারী। অরুণ সোম এই চরিত্র সম্পর্কে লিখেছেন যে, ‘হয়তো দস্তয়েভস্কি একে এমন একটি চরিত্র ধরেই ভেবেছিলেন, পরে নিজেই সরে যান’। এভাবে আমরা দেখি একটি উপন্যাসের আখ্যান থেকে তার চরিত্র, তার আবহ, স্থান নামÑ সর্বত্র স্বতন্ত্র চিহ্ন রেখে নির্মাণ করে গেছেন দস্তয়েভস্কি। দস্তয়েভস্কির ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত ব্যক্তি-জীবনের দিকে তাকালে তাঁর সাহিত্যনির্মাণঘরানার উৎসমূলের কাছে যাওয়া যাবে।দস্তয়েভস্কির জীবনের যাপন যাত্রাপথ খুবই এলোমেলো ও অনিয়ন্ত্রিত ছিলো।মদ্যপান করতেন, মদের মতোই জুয়া খেলার নেশায় মত্ত থাকতেন। তাঁর মৃত্যুর পর তুর্গেনভ লিখেছিলেন ‘দস্তয়েভস্কিÑ দ্য সাদ অব রাশিয়া’। এর ফলে জীবনের অনেকটা সময় নিদারুণ আর্থিক কষ্টের মধ্য দিয়ে চলতে হয়েছে তাঁকে। এই অর্থকষ্ট শাপেবর হয়েছিল বিশ্ব সাহিত্যের জন্য। আর্থিক চাহিদা মেটানোর জন্য দ্রুত লিখতেন, সম্পাদকের তাগিদ মেনে সেই লেখা সময়ের মধ্যেই জমা দিতেন যাতে টাকাটা দ্রুত হাতে আসে। অনেক সমালোচকের বক্তব্য এর ফলেতাঁর লেখায় ‘প্রচুর কথার সমাহার’, আমার কাছে আবার এই ‘প্রচুর কথা’ অতিরিক্ত প্রাপ্তি। জেমস জয়েস দস্তয়েভস্কিকে ভায়োলেন্ট বা সহিংস ধাঁচের লেখক বলেছেন, যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের তিনি কথাকার সেই মনস্তত্ত্বের কারবারি ফ্রয়েড বলেছেন যে, লেখক দস্তয়েভস্কিই আমাদের মানবমনের মনস্তাত্ত্বিক ঝড়ঝঞ্ঝার প্রথম বড়মাপের বয়ানকারী।নিৎসে দস্তয়েভস্কি প্রসঙ্গে লিখেছিলে যে, ‘দস্তয়েভস্কিই একমাত্র মনস্তত্ববিদ, যার কাছ থেকে আমি কিছু শিখেছি’। এই ভায়োলেন্স ঢুকে আছেতাঁর অন্য গদ্যের মতো ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এও।দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে একের পর এক নাটকীয়তা ও ব্যক্তি জীবনের আর্থিক ও সামাজিক প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ প্রতিফলন ছিলো তাঁর লেখার চরিত্রগুলোতে। সেই নাটকীয় বাঁক আমরা ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’, ‘নোটস ফ্রম দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড’-এর মতো ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এও পাই।

আনা গ্রিগোরিয়েভনাকে বিয়ে করার পর কিছুটা সুখের দেখা পেয়েছিলেন দস্তয়েভস্কি। ১৮৭৩-এ আনা তাঁর প্রকাশক হলে আর্থিক দিক দিয়েও কিছুটা স্বাচ্ছন্দ্য আসে। এই সময় তিন বছর ধরে লিখে শেষ করলেন ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’। নিজের জীবনের দ্বন্দ্ব ও বৈপরীত্য এখানে প্রতিফলিত হয়েছে।প্রায় ৮০০ পাতার এই উপন্যাস ১২টি বুক বা বিভাগে বিন্যস্ত। মোট চারটি পর্ব এবং একটি দীর্ঘ উপসংহার রয়েছে এই উপন্যাসে। গির্জার পুরোহিতের পাঠ নেওয়া আলিয়োশা কারমাজভ, ঈশ্বরে অবিশ্বাসী ইভান কারমাজভ এবং সৈনিক দিমিত্রি কারমাজভ নামের তিন ভাইকে নিয়ে এইউপন্যাসের বিস্তার, কেন্দ্রে তাঁদের বাবা ফিওদর। সূচনাতেই আমরা দেখি কারমাজভ পরিবারের অন্তর্কলহের কাহিনি। বাবা ফিওদর কারমাজভ এবং তার প্রথম স্ত্রীর একমাত্র সন্তান দিমিত্রি কারমাজভ একজনই নারীর প্রতি আসক্ত। এই নারীর নাম গ্রুশেংকা। বাবার সঙ্গে দিমিত্রির ‘দা কুড়াল’ সম্পর্ক। চারদিকে সে বলে বেড়ায় যে সে যদি সুযোগ পেতো তবে তার এই বাবাকে সে হত্যা করতো। এই জানোয়ারটা, ফিওদর শুধু মাত্র তার মায়ের যাবতীয় সম্পত্তির দখলই নেয়নি দিমিত্রির শৈশবকেও তছনছ করে দিয়েছে। দিমিত্রিকে তার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করে সেই অর্থে তারই প্রেমিকাকে বিয়ে করতে চাইছে। এমন বাবা তাই তার কাছে ঘৃণ্য পুরুষ।দস্তয়েভস্কির এই উপন্যাসে দেখি যে ফিওদর কারমাজভ একটি শয়তানের মতো চরিত্রের মানুষ, ভালো কিছু সে সহ্যই করতে পারে না, সুন্দর যা কিছু তাকেই সে ব্যঙ্গ করে। পিতা ও পুত্রের মধ্যে ‘সম্পর্কের’ এই টানাটানি অন্তে আমরা দেখি অমানবিক বাবা ফিওদর খুন হয়ে যান, খুনি কে তা নিয়ে রহস্যময় আলোছায়ার খেলা চলে। শেষে আমরা দেখি যে দিমিত্রির ভেতর রয়েছে এক পবিত্র মন, যে মনের দুর্বলতা সুন্দরের প্রতি, মহতের প্রতি। যে গ্রুশেংকাকে নিয়ে দুজনের টানাটানি সেই নারীর প্রতি ফিওদরের লালসা ও লোভ, অন্যদিকে, দিমিত্রির মনে তারপ্রতি রয়েছে শুদ্ধ ভালোবাসা। এদিকে দিমিত্রিকে ভালোবাসে কাতারিনা। একসময় সে দিমিত্রির বাগদত্তা ছিলো। কাতারিনা ও দিমিত্রির সম্পর্কটাও খুব মর্মস্পর্শী। দস্তয়েভস্কির উপন্যাসগুলোয় আমরা দেখি মানুষের চরিত্রের নানা রহস্যময়তার পাশাপাশি ভালোবাসার সম্পর্কের নানা স্তরের প্রকাশ। যেমন ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’। (চলবে)

back to top