alt

সাময়িকী

স্বপ্ন অথবা বিপন্ন বিস্ময়

এমরান কবির

: বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

মাহিনুর আর কিরন মজুমদার রুমমেট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাহিনুর ফিজিক্সে পড়ে। কিরন মজুমদার সোসিওলজিতে। মিতা ছাত্রাবাসের ৩০৫ নাম্বার রুমে থাকে তারা। কিরন মজুমদার আগে থেকেই এখানে থাকে। মাহিনুর এসেছে পরে।

মাহিনুর এসে মেসে থাকতে চাইলে ম্যানেজারও একটু বিব্রত হয়েছিল। কারণ একমাত্র কিরন মজুমদারের রুম ছাড়া অন্য কোনো রুমে সিট খালি নেই। আর কিরন যে প্রকৃতির ছেলে মাহিনুরের সাথে টিউনিং হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম। কিরন রাত জাগে। প্রচুর সিগারেট খায়। কথা বেশি বলে। কেমন একটু অস্বাভাবিক আচরণ তার। এদিকে তার আবার রাজনৈতিক কানেকশানও আছে। এসব মিলিয়ে তাকে এখানে রাখাও যেমন বিব্রতকর, চলে যেতে বলাও বিপদজ্জনক। কী আর করা। ম্যানেজার নিরুপায়।

মাহিনুর এলে তার পুরো ইন্টারভিউ নেবার পর একটা ফরম ধরিয়ে দিলো ম্যানেজার। বলল পনেরদিন পর যোগাযোগ করবেন। পনেরদিন পর মাহিনুর এসে যোগাযোগ করলো অনেকটা বিরক্ত হয়েই। আরে বাবা মেসে উঠব তার মধ্যে এত কাহিনী কেন?

ম্যানেজার সরি বলল। জানালো তথ্যগুলো নিকটস্থ থানায় দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই এখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা পাকা হলো। মিতা ছাত্রাবাসের পলিসি এরকমই।

মাহিনুর ভাবল, ওরে সর্বনাশ! মেসে থাকতে হলেও এত কিছু! একটু স্বস্তিও পেল। কারণ নিশ্চিন্তভাবে থাকা যাবে। হিজিবিজি কিছু নেই।

একটু পর ম্যানেজার তাঁর মনটা খুব খারাপ করে দিলো। বলল আপনার একটু কষ্ট হবে। কারণ কিরন নামের ছেলেটার ভেতরে কিছু অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে। আপনাকে শীঘ্রই অন্যরুমে পাঠানো হবে। কিছুদিন মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।

মাহিনুর মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হলো না। আরে কিরন তো শুধু সিগারেটই খায় না। নিয়মিত গাঁজা খায়। গাঁজা খেয়ে সারারাত বকবক করে। ফিজিক্সের মতো সাবজেক্টে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। গাঁজার গন্ধ আর বকবকানিতে পড়াই হয় না। হইচই করে। চিৎকার করে মমতাজের গান গায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। এই গানের প্যারোডিও করে। সেটা খবুই অশ্লীল। এটা ওটা অর্ডার করে। মাঝে মাঝে টাকা ধার নেয়। ফেরত দেয় না একবারও।

কিছুদিন পরই মাহিনুরের সাথে তার লেগে গেল। কিন্তু মেসের সবাই কিরণের পক্ষে নিল। আহত অভিমান নিয়ে মাহিনুর সিদ্ধান্ত নিল মেস চেঞ্জ করবে।

একদিন দুপুরে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। কিরণ নেই। মাহিনুর স্বপ্নে দেখল তাকে কে যেন একটা পলিথিনের ভেতরে তুলেছে। পলিথিন চুপসে গিয়ে তার শরীরে লেগে যাচ্ছে। চাপ দিচ্ছে প্রচ-। চোখে মুখে নাকে এমন চাপ দিচ্ছে যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। হাঁসফাঁস করতে করতেই সে শুনতে পেলো কী যেন ফেটে যাচ্ছে প্রচ- শব্দসহ।

মাহিনুরের ঘুম ভেঙে গেল। ঘেমে টেমে এক জবুথবু অবস্থা। দরজায় টোকা দিচ্ছে কে যেন। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দরোজা খুলে দিলো। কিরন এসেছে। খুব বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘কতক্ষণ ধরে টোকা দিচ্ছি! এরকম মড়ার মতো ঘুমালে হয়! যত্তসব।’

কিরন রুমে ঢুকল। মাহিনুর বিছানায় বসে দেখতে পেল মেঝেতে একটা পলিথিন পড়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে কখানো ফুলে উঠছে কখনো চুপসে যাচ্ছে। কিরন সেই পলিথিন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো।

দুই

সপ্তাহ খানেক পর এক রাতে মাহিনুর আর কিরণ যথারীতি ঘুমাচ্ছিল। মাহিনুর স্বপ্নে দেখল কে যেন তাকে বালিশ চাপা দিয়ে মারছে। বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে সে চিৎকার দিচ্ছে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। অশুরের শক্তি নিয়ে হন্তারক তাঁকে হত্যা করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাহিনুরও বাঁচার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। একসময় ঘুম ভেঙে গেল মাহিনুরের। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ মেলে তাকাতেও ভয় লাগছে। বুঁজলেও ভয়। ঘুম ও স্বপ্নের রেশ কাটতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। তারপর দেখলো জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে। মাহিনুর একটু স্বস্তি অনুভব করল।

আরেকটু ফর্সা হয়ে এলে সে লক্ষ্য করল কিরণের মুখের উপরে বালিশ। বালিশ সরিয়ে তাকে ডাকতে লাগলো। কিরণ কোনো সাড়া দিলো না। তার গা ঠা-া হয়ে গেছে। সে মারা গেছে।

মেসের অন্য সদস্যরা এলো। ম্যানেজার, মালিক, পরিচিতজন, ক্লাসমেট সবাই এলো। সব শেষে এলো পুলিশ। মাহিনুরকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো।

তিন

ছাড়া পেয়ে মাহিনুর মেসে ফিরলো না। চলে গেলো গ্রামের বাড়ি। সিদ্ধান্ত নিলো ওখানে কিছুদিন থাকার। একটা সেমিস্টার মিস হলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কোর্ট তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া গেছে কিরণ মারা গেছে ঘুমের ভেতরে হার্ট অ্যাটাকে।

সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে থাকলো রীতিমতো। বেড়াতে থাকলো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। ঘুরতে থাকলো এখানে সেখানে। সে দেখলো আস্তে আস্তে স¦াভাবিক হয়ে আসছে তাঁর জীবন-মনন।

এরকম ঘুরতে ঘুরতে একদিন লক্ষ করলো সে এমন এক জায়গায় ঘুরছে যে-জায়গাটি খুব পরিচিত। কিন্তু নামটি সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। গাছপালা চেনা, রাস্তা চেনা, আশেপাশের বাড়িঘর চেনা। কিন্তু নামটা সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে সে এক ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলো। এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চেনা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শুনতে পেলো সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ। সময়টা সন্ধ্যা সন্ধ্যা। সে আশেপাশে লক্ষ্য করতে লাগলো কান্নাটা আসছে কোন দিক থেকে। দেখতে পেল রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে কিন্তু বৃক্ষরাজি দ্বারা কম ঘনত্ব বিশিষ্ট একটা জায়গায় সামান্য আলোর রেখা। সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ তখনও চলছে। সে আলোটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখল ওটা একটা কুপি বাতি। দরোজার ফাঁক দিয়ে যার সামান্য অংশই দেখা যাচ্ছে মাত্র। বাতাস লেগে লেগে মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা শিখাটি আলোর ঢেউ সৃষ্টি করছে। মাহিনুর ওই আলোর রেখা ধরে এগুতে থাকলো। আলোটি ক্রমশ উজ্জ্বলতর হতে থাকলো। কান্নার আওয়াজও তীব্রতর হয়ে তার কানে বাজতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতে সে বাহিরের দরোজার সামনে এসে হাজির হলো। ততক্ষণ সন্ধ্যা আরো গাঢ় হয়েছে। মাহিনুর সাহস করে দরোজাটা আরো খুলে ফেলল। দেখলো বারান্দায় এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর স্বজনরা কাঁদছে। সদ্যমৃত ব্যক্তিটির শিয়রের পাশে বাতিটি জ্বালানো। মৃত ব্যক্তিটিকে সে চেনে। কিন্তু নাম মনে করতে পারছে না। আরো আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাঁকে লক্ষ্য করছে না। সে একে একে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ যেন তাকে দেখছেই না। মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে কান্নারত সবাইকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কারো নাম সে মনে করতে পারছে না। বয়স্ক এক মহিলাকে সে দেখলো। যার মুখের দিকে তাকাতেই এক গভীর মায়ায় বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। সম্ভবত উনি মৃতের স্ত্রী। তাঁকে কত যে আপন লাগলো!কিন্তু তিনিও চিনতে পারলেন না।

মাহিনুর অগত্যা আশেপাশে তাকাতে লাগলো। ঘর বারান্দা সবকিছু তাঁর চেনা। কিন্তু এটা কোন বাড়ি সে মনে করতে পারছে না। সামান্য হাট করা একটা ঘরের দরোজা দিয়ে সে ভেতরে তাকালো। এবং অতিশয় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো বারান্দায় সদ্য মৃত এক ব্যক্তিকে ঘিরে সম্মিলিত এই কান্নার আওয়াজের ভেতরেও এক যুবক নিশ্চিতভাবে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে। সে দরোজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরোজা খোলার শব্দও তাঁর কানে বাজল।

এবং সে অনুভব করতে লাগলো কেউ তাকে কান্না করতে করতে ঝাঁকাচ্ছে। মাহিনুর ধড়ফড় করে উঠে দেখলো ছোটবোন সাবিহা চিৎকার করে কাঁদছে। আসলে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। ছোটবোনকাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাইয়া, বাবা নেই।’

মাহিনুর হতভম্বের মতো বের হয়ে এলো। দেখলো স্বপ্নে দেখা ওই দৃশ্যের বাস্তব মঞ্চায়ন যেন। শিয়রের পাশে সেই কুপি বাতি। বাবার পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া। তাঁকে ঘিরে সম্মিলিত আহাজারি।

চার

মাহিনুরের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগলো। তাঁর কয়েকটি সেমিস্টার ড্রপ হয়ে গেল।

কিছুদিন পর একদিন সে এক বন্ধুর বাসায় গেল। সদ্য বিবাহিত বন্ধুর সাথে গল্প করলে মনটা ভালো হয়ে উঠবে এই আশায়। বাসায় গিয়ে দেখলো বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী বাহিরে বের হচ্ছে। মাহিনুর খুব বিব্রত বোধ করল। বলল,‘তাহলে আজ আর বসব না। অন্যদিন আসব।’

কিন্তু মাহিনুরের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী রাজি হলো না। বন্ধু বলল, ‘তেমন কোনো জরুরি কাজ না। হালকা পাতলা কেনাকাটা ছিল আর কি। তুই বোস। তোর ভাবির সাথে গল্প কর। আমি একাই বের হই। একটু পরই ফিরবো।’

মাহিনুর কিছুতেই রাজি হতে চাচ্ছিল না। সে বারবার সরি বলছিল এই অসময়ে আসার জন্য।

কিন্তু নাছোড়াবান্দা বন্ধু আর তাঁর স্ত্রীর জন্য তাঁকে থাকতেই হলো।

সোফায় বসে টুকটাক কথা বলল বন্ধুর স্ত্রীর সাথে। মাহিনুরের আড়ষ্টতা কিছুতেই কাটছিল না। একসময় বন্ধুর স্ত্রী উঠে গেল। আপ্যায়নের প্রস্তুতি আরকি।

মাহিনুর বসে থাকতে থাকতে হালকা ঘুমের ভেতরে চলে গেল মুহূর্তেই। আবার একটি স্বপ্ন দেখল। দেখলÑ এই শহরেরই এক জায়গায় একটি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে খুব চেষ্টা করছে আহত অথবা নিহত ব্যক্তিটিকে দেখতে। কিন্তু পারছে না। উৎসুক মানুষজনকে ঠেলে সে ভেতরে ঢুকতেই পারছে না।

বন্ধুর স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল মাহিনুরের। হতভম্ব হয়ে সে বন্ধুর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বন্ধুর স্ত্রী বলল, ‘আরে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন না-কি। ইশ আপনার ঘুম ভেঙে দিলাম। সরি।’

মাহিনুর একটু ইতস্তত করতে লাগলো। বলল, ‘ভাবি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আমাকে এখুনি উঠতে হবে। কাজটা সেরে আমি আসব।’

বন্ধুর স্ত্রী হায় হায় করে উঠল,‘বলেন কী! আপনার যত কাজই থাকুক আপনি এখন যেতে পারবেন না। নাস্তা খাবেন, আপনার বন্ধু আসবে তারপর যাবেন। তাও কাজ সেরে ফিরে আসতে হবে। আজ আমরা একসাথে খাবো।’

মাহিনুর একটু অভদ্রর মতোই আচরণ করে ফেলল। বলল, ‘সরি ভাবি, আমাকে এখুনই উঠতে হবে।’

বলেই হন হন করে বের হয়ে গেল।

বের হয়ে সে হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন। এলোমেলো। তাঁর ভেতরে কোথায় যেন কী হয়ে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেছে তা টের পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় হয়েছে, কী হয়েছে তা বুঝতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে সে আবিষ্কার করে একটি সড়ক দুর্ঘটনা। তখনই একটু আগে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে তাঁর। সে ভিড় ঠেলে ঠেলে দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির কাছে যায়। মুখ দেখে আঁতকে ওঠে। আহত বা নিহত ব্যক্তিটি আর কেউ নয় তাঁরই বন্ধু। যার বাসা থেকে একটু আগে সে চলে এসেছে। মাহিনুর একটা কাগজে ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লেখে। বলে, ‘এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। আর এই হলো তার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার।’ উপস্থিত একজনের হাতে কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে সে চলে যায়।

পাঁচ

মাহিনুর আর ফিরলো না। পেছনের সবকিছু ফেলে সে চলে গেল। তার মা ছিল, বোন ছিল। কারো কথা সে ভাবল না। সে শুধু ভাবল যাকে সে ভালোবাসছে সে-ই মারা যাচ্ছে। তাও আবার স্বপ্নের মাধ্যমে জানান দিয়ে। সে অপবিত্র হয়ে গেছে। সে এখন তার ভালোবাসার মানুষদের সাথে থাকলে তারাও মারা যাবে।

মাহিনুরেরফিজিক্স কমপ্লিটও করা হলো না। সে চলে গেল বহুদূরে। সব স্বজন ছেড়ে।

ছেড়ে নিজেকেও।

ছয়

গল্পটি আমার নয়। আমি লিখিনি এটা। এমনকি আমার মাথায় আসেওনি এরকম কোনো থিম। গল্পটি বলেছিল আমার এক সাবেক সহকর্মীÑ তাজনুর। গল্পটি শোনার পর আমি স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম। মাহিনুরের মর্মান্তিক পরিণতি আমাকে খুব আক্রান্ত করেছিল। তাজনুর আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল মাহিনুরের এরকম হওয়ার কারণ কী। মাহিনুর তো একসময় নিজেকে অপবিত্র ভাবতে শুরু করেছিল। মানুষ কি কখনো অপবিত্র হয়?

তাজনুরের প্রশ্নটি বারবার আমার মননে-হৃদয়ে-মস্তিষ্কে অনুরণন তুলল। সত্যিই একটা বড় প্রশ্ন মানুষ কি কখনো অপবিত্র হয়? আমি স্পষ্ট করে তাজনুরকে বলি, ‘মানুষ কখনো অপবিত্র হয় না।’

তাজনুর আমাকে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে মাহিনুরের এরকম হওয়ার কারণ কী?’

আমি তাজনুরকে বলি, ‘মাহিনুরেরস্বপ্নগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা জাগতিক। এই স্বপ্ন সবাই দেখে। বৈষয়িক উন্নতি এর কেন্দ্রে থাকে। মাহিনুরের সেই জাগতিক স্বপ্নটি ব্যর্থ হলো। তাঁর ফিজিক্স কমপ্লিট করা হলো না। সে দূরে চলে গেল। কিন্তু মানুষ বেশি দূর যেতে পারে না। তাঁর শৃঙ্খল থাকেই। কোনো না কোনোভাবে সে আবদ্ধ হবেই। বিদ্ধ হবেই। মায়ায়, ভালোবাসায় বা আঘাতে। অন্যদিকে সে ঘুমের ভেতরে যে-স্বপ্ন দেখলো তা তাঁর জাগতিক জীবনে ভয়ঙ্কররূপে প্রভাবিত করল। তাঁকে তছনছ করে দিলো। মাহিনুরের ছিল প্রিকগনিশন অব ড্রিম। কিছু মানুষের এই ক্ষমতা থাকে। তাঁরা স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক কিছুর ইঙ্গিত পান। ভালো কিছু ঘটতে থাকলে তিনি পুলকিত বোধ করেন। মানুষর জীবন তো শুধু ভালো দিয়েই পূর্ণ হয় না। খারাপও থাকে। সেই খারাপের ইঙ্গিত যখন তিনি ক্রমাগত পেতে থাকেন এবং বাস্তবে তা ঘটতেই থাকে তখন তাঁর জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। মাহিনুরের জীবনটা ওই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এর সঠিক কারণ আসলে বলা মুশকিল। এটা খুবই রহস্যময়। অব্যাখ্যায়।’

তাজনুরকে একটু হালকা মনে হলো। মানুষ জীবনের ঘটনা শেয়ার করলে হালকা বোধ করে।

আমাদের গল্প শেষ হলে আমরা দু’জন দু’দিকে চলে যাই। যে যার গন্তব্যে। যেতে যেতে ভাবি আমিই কি মাহিনুর কিংবা তাজনুর! না-কি তাজনুরই মাহিনুর! আমরা যে কে, আমরা আসলে জানি না।

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

একজন গফুর মল্লিক

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

ছাতিম যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ

ছবি

সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ

ছবি

সমকালিক ঘটনাবলির রূপকার

ছবি

হেমন্ত পদাবলি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

রূপান্তরিত

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

tab

সাময়িকী

স্বপ্ন অথবা বিপন্ন বিস্ময়

এমরান কবির

বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪

মাহিনুর আর কিরন মজুমদার রুমমেট। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মাহিনুর ফিজিক্সে পড়ে। কিরন মজুমদার সোসিওলজিতে। মিতা ছাত্রাবাসের ৩০৫ নাম্বার রুমে থাকে তারা। কিরন মজুমদার আগে থেকেই এখানে থাকে। মাহিনুর এসেছে পরে।

মাহিনুর এসে মেসে থাকতে চাইলে ম্যানেজারও একটু বিব্রত হয়েছিল। কারণ একমাত্র কিরন মজুমদারের রুম ছাড়া অন্য কোনো রুমে সিট খালি নেই। আর কিরন যে প্রকৃতির ছেলে মাহিনুরের সাথে টিউনিং হবার সম্ভাবনা একেবারেই কম। কিরন রাত জাগে। প্রচুর সিগারেট খায়। কথা বেশি বলে। কেমন একটু অস্বাভাবিক আচরণ তার। এদিকে তার আবার রাজনৈতিক কানেকশানও আছে। এসব মিলিয়ে তাকে এখানে রাখাও যেমন বিব্রতকর, চলে যেতে বলাও বিপদজ্জনক। কী আর করা। ম্যানেজার নিরুপায়।

মাহিনুর এলে তার পুরো ইন্টারভিউ নেবার পর একটা ফরম ধরিয়ে দিলো ম্যানেজার। বলল পনেরদিন পর যোগাযোগ করবেন। পনেরদিন পর মাহিনুর এসে যোগাযোগ করলো অনেকটা বিরক্ত হয়েই। আরে বাবা মেসে উঠব তার মধ্যে এত কাহিনী কেন?

ম্যানেজার সরি বলল। জানালো তথ্যগুলো নিকটস্থ থানায় দেয়া হয়েছিল। সেখান থেকে গ্রিন সিগন্যাল পাওয়ার পরই এখানে তাঁর থাকার ব্যবস্থা পাকা হলো। মিতা ছাত্রাবাসের পলিসি এরকমই।

মাহিনুর ভাবল, ওরে সর্বনাশ! মেসে থাকতে হলেও এত কিছু! একটু স্বস্তিও পেল। কারণ নিশ্চিন্তভাবে থাকা যাবে। হিজিবিজি কিছু নেই।

একটু পর ম্যানেজার তাঁর মনটা খুব খারাপ করে দিলো। বলল আপনার একটু কষ্ট হবে। কারণ কিরন নামের ছেলেটার ভেতরে কিছু অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে। আপনাকে শীঘ্রই অন্যরুমে পাঠানো হবে। কিছুদিন মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন।

মাহিনুর মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু হলো না। আরে কিরন তো শুধু সিগারেটই খায় না। নিয়মিত গাঁজা খায়। গাঁজা খেয়ে সারারাত বকবক করে। ফিজিক্সের মতো সাবজেক্টে অনেক পড়াশোনা করতে হয়। গাঁজার গন্ধ আর বকবকানিতে পড়াই হয় না। হইচই করে। চিৎকার করে মমতাজের গান গায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। বুকটা ফাইট্টা যায়। এই গানের প্যারোডিও করে। সেটা খবুই অশ্লীল। এটা ওটা অর্ডার করে। মাঝে মাঝে টাকা ধার নেয়। ফেরত দেয় না একবারও।

কিছুদিন পরই মাহিনুরের সাথে তার লেগে গেল। কিন্তু মেসের সবাই কিরণের পক্ষে নিল। আহত অভিমান নিয়ে মাহিনুর সিদ্ধান্ত নিল মেস চেঞ্জ করবে।

একদিন দুপুরে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। কিরণ নেই। মাহিনুর স্বপ্নে দেখল তাকে কে যেন একটা পলিথিনের ভেতরে তুলেছে। পলিথিন চুপসে গিয়ে তার শরীরে লেগে যাচ্ছে। চাপ দিচ্ছে প্রচ-। চোখে মুখে নাকে এমন চাপ দিচ্ছে যে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। হাঁসফাঁস করতে করতেই সে শুনতে পেলো কী যেন ফেটে যাচ্ছে প্রচ- শব্দসহ।

মাহিনুরের ঘুম ভেঙে গেল। ঘেমে টেমে এক জবুথবু অবস্থা। দরজায় টোকা দিচ্ছে কে যেন। সে তড়িঘড়ি করে উঠে দরোজা খুলে দিলো। কিরন এসেছে। খুব বিরক্ত হয়ে সে বলল, ‘কতক্ষণ ধরে টোকা দিচ্ছি! এরকম মড়ার মতো ঘুমালে হয়! যত্তসব।’

কিরন রুমে ঢুকল। মাহিনুর বিছানায় বসে দেখতে পেল মেঝেতে একটা পলিথিন পড়ে আছে। ফ্যানের বাতাসে কখানো ফুলে উঠছে কখনো চুপসে যাচ্ছে। কিরন সেই পলিথিন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিম মেরে বসে থাকলো।

দুই

সপ্তাহ খানেক পর এক রাতে মাহিনুর আর কিরণ যথারীতি ঘুমাচ্ছিল। মাহিনুর স্বপ্নে দেখল কে যেন তাকে বালিশ চাপা দিয়ে মারছে। বাঁচার জন্য মরিয়া হয়ে সে চিৎকার দিচ্ছে। কিন্তু কোনো শব্দ বের হচ্ছে না। অশুরের শক্তি নিয়ে হন্তারক তাঁকে হত্যা করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মাহিনুরও বাঁচার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। একসময় ঘুম ভেঙে গেল মাহিনুরের। ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। ভয়ে গলা শুকিয়ে কাঠ। চোখ মেলে তাকাতেও ভয় লাগছে। বুঁজলেও ভয়। ঘুম ও স্বপ্নের রেশ কাটতে সময় লাগলো কিছুক্ষণ। তারপর দেখলো জানালা দিয়ে ভোরের আলো ঢুকছে। মাহিনুর একটু স্বস্তি অনুভব করল।

আরেকটু ফর্সা হয়ে এলে সে লক্ষ্য করল কিরণের মুখের উপরে বালিশ। বালিশ সরিয়ে তাকে ডাকতে লাগলো। কিরণ কোনো সাড়া দিলো না। তার গা ঠা-া হয়ে গেছে। সে মারা গেছে।

মেসের অন্য সদস্যরা এলো। ম্যানেজার, মালিক, পরিচিতজন, ক্লাসমেট সবাই এলো। সব শেষে এলো পুলিশ। মাহিনুরকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেলো।

তিন

ছাড়া পেয়ে মাহিনুর মেসে ফিরলো না। চলে গেলো গ্রামের বাড়ি। সিদ্ধান্ত নিলো ওখানে কিছুদিন থাকার। একটা সেমিস্টার মিস হলে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। কোর্ট তাঁকে ছেড়ে দিয়েছে। কারণ পোস্টমর্টেম রিপোর্টে পাওয়া গেছে কিরণ মারা গেছে ঘুমের ভেতরে হার্ট অ্যাটাকে।

সে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে থাকলো রীতিমতো। বেড়াতে থাকলো আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। ঘুরতে থাকলো এখানে সেখানে। সে দেখলো আস্তে আস্তে স¦াভাবিক হয়ে আসছে তাঁর জীবন-মনন।

এরকম ঘুরতে ঘুরতে একদিন লক্ষ করলো সে এমন এক জায়গায় ঘুরছে যে-জায়গাটি খুব পরিচিত। কিন্তু নামটি সে কিছুতেই মনে করতে পারছে না। গাছপালা চেনা, রাস্তা চেনা, আশেপাশের বাড়িঘর চেনা। কিন্তু নামটা সে কিছুতেই মনে করতে পারলো না। হাঁটতে হাঁটতে সে এক ঘন জঙ্গলের দিকে যেতে থাকলো। এর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া চেনা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ শুনতে পেলো সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ। সময়টা সন্ধ্যা সন্ধ্যা। সে আশেপাশে লক্ষ্য করতে লাগলো কান্নাটা আসছে কোন দিক থেকে। দেখতে পেল রাস্তা থেকে বেশ ভেতরে কিন্তু বৃক্ষরাজি দ্বারা কম ঘনত্ব বিশিষ্ট একটা জায়গায় সামান্য আলোর রেখা। সম্মিলিত কান্নার আওয়াজ তখনও চলছে। সে আলোটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখল ওটা একটা কুপি বাতি। দরোজার ফাঁক দিয়ে যার সামান্য অংশই দেখা যাচ্ছে মাত্র। বাতাস লেগে লেগে মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠা শিখাটি আলোর ঢেউ সৃষ্টি করছে। মাহিনুর ওই আলোর রেখা ধরে এগুতে থাকলো। আলোটি ক্রমশ উজ্জ্বলতর হতে থাকলো। কান্নার আওয়াজও তীব্রতর হয়ে তার কানে বাজতে থাকলো। হাঁটতে হাঁটতে সে বাহিরের দরোজার সামনে এসে হাজির হলো। ততক্ষণ সন্ধ্যা আরো গাঢ় হয়েছে। মাহিনুর সাহস করে দরোজাটা আরো খুলে ফেলল। দেখলো বারান্দায় এক মৃত ব্যক্তিকে নিয়ে তাঁর স্বজনরা কাঁদছে। সদ্যমৃত ব্যক্তিটির শিয়রের পাশে বাতিটি জ্বালানো। মৃত ব্যক্তিটিকে সে চেনে। কিন্তু নাম মনে করতে পারছে না। আরো আশ্চর্যের বিষয় কেউ তাঁকে লক্ষ্য করছে না। সে একে একে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে কিন্তু কেউ যেন তাকে দেখছেই না। মৃত ব্যক্তিকে ঘিরে কান্নারত সবাইকে তার চেনা চেনা মনে হচ্ছে কিন্তু কারো নাম সে মনে করতে পারছে না। বয়স্ক এক মহিলাকে সে দেখলো। যার মুখের দিকে তাকাতেই এক গভীর মায়ায় বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠলো। সম্ভবত উনি মৃতের স্ত্রী। তাঁকে কত যে আপন লাগলো!কিন্তু তিনিও চিনতে পারলেন না।

মাহিনুর অগত্যা আশেপাশে তাকাতে লাগলো। ঘর বারান্দা সবকিছু তাঁর চেনা। কিন্তু এটা কোন বাড়ি সে মনে করতে পারছে না। সামান্য হাট করা একটা ঘরের দরোজা দিয়ে সে ভেতরে তাকালো। এবং অতিশয় আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলো বারান্দায় সদ্য মৃত এক ব্যক্তিকে ঘিরে সম্মিলিত এই কান্নার আওয়াজের ভেতরেও এক যুবক নিশ্চিতভাবে গভীর ঘুম ঘুমাচ্ছে। সে দরোজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো। দরোজা খোলার শব্দও তাঁর কানে বাজল।

এবং সে অনুভব করতে লাগলো কেউ তাকে কান্না করতে করতে ঝাঁকাচ্ছে। মাহিনুর ধড়ফড় করে উঠে দেখলো ছোটবোন সাবিহা চিৎকার করে কাঁদছে। আসলে মাহিনুর ঘুমাচ্ছিল। ছোটবোনকাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘ভাইয়া, বাবা নেই।’

মাহিনুর হতভম্বের মতো বের হয়ে এলো। দেখলো স্বপ্নে দেখা ওই দৃশ্যের বাস্তব মঞ্চায়ন যেন। শিয়রের পাশে সেই কুপি বাতি। বাবার পরনে হালকা ঘিয়ে রঙের ফতুয়া। তাঁকে ঘিরে সম্মিলিত আহাজারি।

চার

মাহিনুরের স্বাভাবিক হতে বেশ সময় লাগলো। তাঁর কয়েকটি সেমিস্টার ড্রপ হয়ে গেল।

কিছুদিন পর একদিন সে এক বন্ধুর বাসায় গেল। সদ্য বিবাহিত বন্ধুর সাথে গল্প করলে মনটা ভালো হয়ে উঠবে এই আশায়। বাসায় গিয়ে দেখলো বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী বাহিরে বের হচ্ছে। মাহিনুর খুব বিব্রত বোধ করল। বলল,‘তাহলে আজ আর বসব না। অন্যদিন আসব।’

কিন্তু মাহিনুরের বন্ধু এবং বন্ধুর স্ত্রী রাজি হলো না। বন্ধু বলল, ‘তেমন কোনো জরুরি কাজ না। হালকা পাতলা কেনাকাটা ছিল আর কি। তুই বোস। তোর ভাবির সাথে গল্প কর। আমি একাই বের হই। একটু পরই ফিরবো।’

মাহিনুর কিছুতেই রাজি হতে চাচ্ছিল না। সে বারবার সরি বলছিল এই অসময়ে আসার জন্য।

কিন্তু নাছোড়াবান্দা বন্ধু আর তাঁর স্ত্রীর জন্য তাঁকে থাকতেই হলো।

সোফায় বসে টুকটাক কথা বলল বন্ধুর স্ত্রীর সাথে। মাহিনুরের আড়ষ্টতা কিছুতেই কাটছিল না। একসময় বন্ধুর স্ত্রী উঠে গেল। আপ্যায়নের প্রস্তুতি আরকি।

মাহিনুর বসে থাকতে থাকতে হালকা ঘুমের ভেতরে চলে গেল মুহূর্তেই। আবার একটি স্বপ্ন দেখল। দেখলÑ এই শহরেরই এক জায়গায় একটি অ্যাকসিডেন্ট হয়েছে। সে খুব চেষ্টা করছে আহত অথবা নিহত ব্যক্তিটিকে দেখতে। কিন্তু পারছে না। উৎসুক মানুষজনকে ঠেলে সে ভেতরে ঢুকতেই পারছে না।

বন্ধুর স্ত্রীর ডাকে ঘুম ভেঙে গেল মাহিনুরের। হতভম্ব হয়ে সে বন্ধুর স্ত্রীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলো। বন্ধুর স্ত্রী বলল, ‘আরে আপনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন না-কি। ইশ আপনার ঘুম ভেঙে দিলাম। সরি।’

মাহিনুর একটু ইতস্তত করতে লাগলো। বলল, ‘ভাবি, আমি ভুলে গিয়েছিলাম যে আমার একটা জরুরি কাজ আছে। আমাকে এখুনি উঠতে হবে। কাজটা সেরে আমি আসব।’

বন্ধুর স্ত্রী হায় হায় করে উঠল,‘বলেন কী! আপনার যত কাজই থাকুক আপনি এখন যেতে পারবেন না। নাস্তা খাবেন, আপনার বন্ধু আসবে তারপর যাবেন। তাও কাজ সেরে ফিরে আসতে হবে। আজ আমরা একসাথে খাবো।’

মাহিনুর একটু অভদ্রর মতোই আচরণ করে ফেলল। বলল, ‘সরি ভাবি, আমাকে এখুনই উঠতে হবে।’

বলেই হন হন করে বের হয়ে গেল।

বের হয়ে সে হাঁটতে থাকে উদ্দেশ্যহীন। এলোমেলো। তাঁর ভেতরে কোথায় যেন কী হয়ে গেছে। কিছু একটা হয়ে গেছে তা টের পাচ্ছে। কিন্তু কোথায় হয়েছে, কী হয়েছে তা বুঝতে পারছে না। হাঁটতে হাঁটতে সে আবিষ্কার করে একটি সড়ক দুর্ঘটনা। তখনই একটু আগে দেখা স্বপ্নের কথা মনে পড়ে তাঁর। সে ভিড় ঠেলে ঠেলে দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির কাছে যায়। মুখ দেখে আঁতকে ওঠে। আহত বা নিহত ব্যক্তিটি আর কেউ নয় তাঁরই বন্ধু। যার বাসা থেকে একটু আগে সে চলে এসেছে। মাহিনুর একটা কাগজে ঠিকানা ও ফোন নাম্বার লেখে। বলে, ‘এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। আর এই হলো তার ঠিকানা ও ফোন নাম্বার।’ উপস্থিত একজনের হাতে কাগজটি ধরিয়ে দিয়ে সে চলে যায়।

পাঁচ

মাহিনুর আর ফিরলো না। পেছনের সবকিছু ফেলে সে চলে গেল। তার মা ছিল, বোন ছিল। কারো কথা সে ভাবল না। সে শুধু ভাবল যাকে সে ভালোবাসছে সে-ই মারা যাচ্ছে। তাও আবার স্বপ্নের মাধ্যমে জানান দিয়ে। সে অপবিত্র হয়ে গেছে। সে এখন তার ভালোবাসার মানুষদের সাথে থাকলে তারাও মারা যাবে।

মাহিনুরেরফিজিক্স কমপ্লিটও করা হলো না। সে চলে গেল বহুদূরে। সব স্বজন ছেড়ে।

ছেড়ে নিজেকেও।

ছয়

গল্পটি আমার নয়। আমি লিখিনি এটা। এমনকি আমার মাথায় আসেওনি এরকম কোনো থিম। গল্পটি বলেছিল আমার এক সাবেক সহকর্মীÑ তাজনুর। গল্পটি শোনার পর আমি স্তব্ধ হয়ে পড়েছিলাম। মাহিনুরের মর্মান্তিক পরিণতি আমাকে খুব আক্রান্ত করেছিল। তাজনুর আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করছিল মাহিনুরের এরকম হওয়ার কারণ কী। মাহিনুর তো একসময় নিজেকে অপবিত্র ভাবতে শুরু করেছিল। মানুষ কি কখনো অপবিত্র হয়?

তাজনুরের প্রশ্নটি বারবার আমার মননে-হৃদয়ে-মস্তিষ্কে অনুরণন তুলল। সত্যিই একটা বড় প্রশ্ন মানুষ কি কখনো অপবিত্র হয়? আমি স্পষ্ট করে তাজনুরকে বলি, ‘মানুষ কখনো অপবিত্র হয় না।’

তাজনুর আমাকে প্রশ্ন করে, ‘তাহলে মাহিনুরের এরকম হওয়ার কারণ কী?’

আমি তাজনুরকে বলি, ‘মাহিনুরেরস্বপ্নগুলোকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। একটা জাগতিক। এই স্বপ্ন সবাই দেখে। বৈষয়িক উন্নতি এর কেন্দ্রে থাকে। মাহিনুরের সেই জাগতিক স্বপ্নটি ব্যর্থ হলো। তাঁর ফিজিক্স কমপ্লিট করা হলো না। সে দূরে চলে গেল। কিন্তু মানুষ বেশি দূর যেতে পারে না। তাঁর শৃঙ্খল থাকেই। কোনো না কোনোভাবে সে আবদ্ধ হবেই। বিদ্ধ হবেই। মায়ায়, ভালোবাসায় বা আঘাতে। অন্যদিকে সে ঘুমের ভেতরে যে-স্বপ্ন দেখলো তা তাঁর জাগতিক জীবনে ভয়ঙ্কররূপে প্রভাবিত করল। তাঁকে তছনছ করে দিলো। মাহিনুরের ছিল প্রিকগনিশন অব ড্রিম। কিছু মানুষের এই ক্ষমতা থাকে। তাঁরা স্বপ্নের মাধ্যমে অনেক কিছুর ইঙ্গিত পান। ভালো কিছু ঘটতে থাকলে তিনি পুলকিত বোধ করেন। মানুষর জীবন তো শুধু ভালো দিয়েই পূর্ণ হয় না। খারাপও থাকে। সেই খারাপের ইঙ্গিত যখন তিনি ক্রমাগত পেতে থাকেন এবং বাস্তবে তা ঘটতেই থাকে তখন তাঁর জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে। মাহিনুরের জীবনটা ওই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। এর সঠিক কারণ আসলে বলা মুশকিল। এটা খুবই রহস্যময়। অব্যাখ্যায়।’

তাজনুরকে একটু হালকা মনে হলো। মানুষ জীবনের ঘটনা শেয়ার করলে হালকা বোধ করে।

আমাদের গল্প শেষ হলে আমরা দু’জন দু’দিকে চলে যাই। যে যার গন্তব্যে। যেতে যেতে ভাবি আমিই কি মাহিনুর কিংবা তাজনুর! না-কি তাজনুরই মাহিনুর! আমরা যে কে, আমরা আসলে জানি না।

back to top