পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
পৃথিবীজুড়ে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়া মানুষ বাঙালি ছাড়াও আরও অসংখ্য আছে। তাঁদের মধ্যে অনন্য একজন হলেন বৃটিশ কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে যাঁর আগ্রহ গবেষণার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রকট ছিলো। ১৯৫১ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে মৃত্যুকে আলিঙ্গনও করেন নভেম্বরের ১১ তারিখ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি না রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ে বাংলা শিখেছেন, না বাংলা সাহিত্যকে ভালোবেসে বাংলা শিখেছেন। তাঁর ভাষ্যে তিনি বাংলা শিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেমে পড়ে। বাঙালির অবিস্মরণীয় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধই উইলিয়াম রাদিচেকে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ কারণেই তিনি লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে বাঙালি অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের নিকট শিখে নেন বাংলা এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে ঐ প্রতিষ্ঠানেই বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে অধ্যাপনায় ব্রতী ছিলেন। তাঁর বাংলা ভাষা শিক্ষাকে পোক্ত করে তোলেন সুজাতা চৌধুরী, যিনি তাঁর পুরোনো বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস সুকান্ত চৌধুরীর মা। উইলিয়াম রাদিচে কলকাতা সল্টলেকে তাদের বাসায় অনেকবার আসা-যাওয়া করার সুবাদে মহীয়সী সুজাতা চৌধুরীর নৈকট্য লাভ করেন। তিনি তাঁর সাথে বিন্দুমাত্র ইংরেজিতে কথা না বলে সর্বদা বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং রাদিচের ভাঙা ভাঙা বাংলাকে ঠিক করে দিয়ে মমতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ফলে এই বিষয়টা তাঁর জন্যে যেমন শিক্ষণের পূর্ণতা এনে দেয় তেমনি বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁকে অনুরাগীও করে তোলে। উইলিয়াম রাদিচে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে গুজরাট রায়টে নিহতদের এবং সুজাতা চৌধুরীর স্মরণসভায় আহমেদাবাদের রবীন্দ্রভবনে প্রদত্ত বক্তব্যে একথা বেশ বিনয় ও উচ্ছ্বাসের সাথে উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রভবনের অবস্থান হলো স¤্রাট শাহজাহানের প্রাসাদ শাহীবাগ এর পেছনের আঙিনায়। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জেলা জজ হিসেবে ১৮৭৮ সালে আহমেদাবাদে কর্মরত ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ চার মাস তাঁর কাছে ছিলেন। মেজদার বাসভবন ছিলো স¤্রাট শাহজাহানের শাহীবাগ প্রাসাদে। স¤্রাট শাহজাহানের শাহীবাগ দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ উপন্যাসের প্লট মাথায় তৈরি করেন। স্মরণসভায় উইলিয়াম রাদিচে বাংলা শিক্ষণের পটভূমি বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকট করে তোলেন। ধীরে ধীরে বৃটিশ প-িত উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রনাথে মগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর এ মগ্নতা আমাদের গোলা ভরানো সৃজনশস্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। রাদিচের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ পাশ্চাত্যে আরও বিস্তৃত হতে শুরু করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবিত ও মৃত, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা ছোটগল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কণিকা, লিখন, স্ফুলিঙ্গ কাব্যহ্রন্থত্রয়ও রাদিচের অনুবাদে পশ্চিমা পাঠকের হাতে পৌঁছায়। তিনি পেঙ্গুইন প্রকাশনী হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত কবিতা ও নির্বাচিত ছোটগল্পের অনূদিত সংকলন প্রকাশ করেন। ‘গীতাঞ্জলি’ গ্রন্থের অনূদিত মূল পা-ুলিপির উপরও উইলিয়াম রাদিচে কিছু গবেষণাধর্মী কাজ সম্পন্ন করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আখ্যানকাব্য ‘দেবতার গ্রাস’ উইলিয়াম রাদিচের অনুবাদে ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’ শিরোনামে নৃত্যনাট্যে রূপলাভ করেÑ যাকে অপেরা লিব্রেটোর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর সংগীতায়োজন করেছেন পরম বীর। ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’ নৃত্যনাট্যের দুটো দৃশ্য। দৃশ্য-১ এ মৈত্র মহাশয়, মোক্ষদা ও রাখালসহ অন্যান্য তীর্থযাত্রী নৌকায় আরোহণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যখন স্থান সংকুলান হবে না ভেবে মোক্ষদা নাছোড়বান্দা রাখালকে ক্রুদ্ধ হয়ে ভুল করে সাগরে ছেড়ে আসার কথা বলে ফেলে। বায়ু অনুকূল হলে নৌকা যখন ছাড়ে তখন অর্কেস্ট্রায় নৌযাত্রার সুর বাজানো হয়। এভাবে দৃশ্য-১-এর সমাপ্তি ঘটে। দৃশ্য-২-এর সূচনা হয় তীর্থস্নান শেষে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে জোয়ারের প্রতীক্ষায়। মাঝপথে সমুদ্ররুদ্র হয়ে ওঠে, বাতাস ক্রমশ ঝড়ে পরিণত হয় এবং মাঝির কথার প্রেক্ষিতে সবাই যার যার অতিরিক্ত বোঝা সাগরে ফেলে দেয়। এতেও সমুদ্র তার রুদ্র রূপ ত্যাগ না করায় সবাই মোক্ষদাকে চেপে ধরে যাতে প্রতিশ্রুত রাখালকে সমুদ্রে বিসর্জন দেয়। ডুবন্ত রাখালের বাঁচার আকুতি দেখে শেষেমেশ মৈত্র মহাশয়ের হুঁশ জাগ্রত হয় এবং রাখালকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে তিনিও সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। এভাবেই শেষ হয় উইলিয়াম রাদিচের অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’কবিতার অপেরা লিব্রেটোর মঞ্চায়ন।
রাদিচের অধ্যয়নে আরও অনন্য হয়ে উঠেছেন কবিগুরুরবীন্দ্রনাথ। পরবাস সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা রবীন্দ্রনাথকে অধ্যয়নে উইলিয়াম রাদিচের নিবিড় ধ্যানমগ্নতার কথা জানতে পারি। ‘রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের মহত্ত্ব’ শিরোনামে লেখায় তিনি কবি রবীন্দ্রনাথকে কবিতার নানা কারিগরি দিক থেকে অবলোকন করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করতে গিয়ে রাদিচে যেভাবে রবি অধ্যয়নে ব্রতী ছিলেন, তাতে তার মনে হয়েছে, জমিদারি,সমাজ সংস্কার, কৃষি ভাবনা, স্বদেশি রাজনীতি, প্রেম কিংবা দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত বেশি মাতামাতি হয়েছে তাতে কবি রবীন্দ্রনাথ আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত মহত্ত্ব থেকে। কবিতায় ভাবের গভীরতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ থেকে তার মনে হয়েছে, কবিগুরু আসলে প্রেরিত পুরুষ ব্যতীত আর কেউ নন। তাঁর কাব্যে প্রোফেটিক এক্সপ্রেশান এতো বেশি প্রকট ও দ্যুতিময় যে, নিবিড় অধ্যয়নে কবিকে স্বর্গেরপ্রতিনিধি বলেই তিনি মেনেছেন। আরেক উক্তিতে তিনি কবি রবীন্দ্রনাথকে জার্মানিতে যিশুর চেয়ে অধিক চর্চিত বলে ইঙ্গিত করেছেন।
রবীন্দ্রকাব্যের গবেষণায় রাদিচে উপলব্ধি করেছেন, তিনি কবিতায় যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার পরিধি, গভীরতা ও বিস্তার ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহারে অতিশয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাই অনুবাদের ক্ষেত্রে রাদিচেও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, ধ্রুপদী শব্দকে ধ্রুপদী শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বৃক্ষ-বন্দনা’ কবিতার কথা উল্লেখ করেন যা তিনি ‘ইন প্রেইজ অব ট্রিজ’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। কবিতাটিতে সংস্কৃত উদ্ভূত তৎসম জাতীয় ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহার দেখে উইলিয়াম রাদিচে অনুবাদের ক্ষেত্রে ল্যাটিন উদ্ভূত ইংরেজি শব্দ দ্বারা সেগুলোর ভাষান্তর করেছেন। যেমন : প্রোফাউন্ড, রেসট্রেইন, পেইশেন্স, ট্রাঙ্কুইল, জুভিনেসেন্ট, ওমনি-ভিক্টোরিয়াস ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পংক্তিবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য তাকে আপ্লুত করেছে। পংক্তির ক্ষেত্রে কবিগুরু গ্যাপ বা অন্তর রাখতে পছন্দ করতেন যাতে কবিতার ভাব পুরোপুরি মেলে ধরা যায়। উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রকাব্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করে ‘মরণ মিলন’ এবং ‘বধূ’ কবিতা দুটির কথা উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্তবক বিন্যাসও রাদিচেকে প্রভাবিত করেছে। ‘পক্ষী মানব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তিন পংক্তির স্তবক বিন্যাস দেখিয়েছেন যাতে কখক সজ্জায় অন্ত্যমিলের প্রয়োগ রয়েছে। রাদিচে সেঔ অনুকরণে নিজের কিছু কবিতায় এভাবে স্তবক বিন্যাস করে আনন্দ লাভ করেছেন। এই উদাহরণে তিনি রবীন্দ্রনাথের বীর পুরুষ কবিতাকেও রেখেছেন।
কিছু কিছু কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে রাদিচের মনে হয়েছে, কবিতাগুলো যেন শাড়ির মতন। তের হাত শাড়ি যেমন বিস্তৃত হয়ে সৌন্দর্যের দ্যোতনা তৈরি করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার পংক্তিকে তিনি একটার পর একটা সাজিয়ে আঠা দিয়ে লাগিয়ে শাড়ির মতো লম্বা করে প্রমাণ করেছেন কবিতার সারস্বত বহমানতাকে। তার ভাষায় এ জাতীয় কবিতাগুলোকে ‘শাড়ি কবিতা’ বলা যায়। কিছু কিছু রবীন্দ্রকাব্যে উইলিয়াম রাদিচে তবলার তালের সন্ধান পেয়েছেন। এরকম কবিতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ‘তপোভঙ্গ’ নামক কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন যাতে নটরাজ শিবের নাচের মুদ্রার মতো ব্যঞ্জনায় কবিতা এগিয়ে গেছে।
রবীন্দ্রকাব্যে রসবোধের ঘাটতি ছিলো না কোথাও। তাঁর কবিতার আঙ্গিকে রসবোধের নহর যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। রাদিচের ভাষায় ‘ফাঁকি’, যা অনুবাদে ‘ডিসেপশন’, কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যে রসবোধ ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের নান্দনিকতা তৈরি করেছেন তাতে কবি হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কবিতায় যে বোধ তৈরি করার মুন্সিয়ানা কবিগুরু দেখিয়েছেন তাতে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর বহুল পঠিত শিশুতোষ কবিতা ‘তালগাছ’-এর কথা রাদিচে উদাহরণ হিসেবে কাছে টানেন। এতে তালগাছকে গাছ নয় বরং একজন শিশু হিসেবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতার সন্ধান দিতে গিয়ে রাদিচে কবিগুরুর কণিকা, লেখন ও স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থত্রয়ের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থত্রয়ে রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণ বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় পেয়ে গ্রন্থগুলো বাংলা থেকে ধীরে ধীরে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তোলেন।
কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে যে ব্রত নিয়ে নিবিড় মমতায় রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদের মাধ্যমে উৎখনন করেছেন তা অনুসরণীয়। তার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ নিছক বাঙালির হয়ে রইলেন না, বরং তিনি হয়ে উঠলেন সারা পৃথিবীর পাঠযোগ্য মহান কবি। রবীন্দ্রকাব্যের কারিগরি দিক নিয়ে গবেষকের তপস্যায় উইলিয়াম রাদিচে ছাড়া আর কেউ আলোচনা করেননি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়লেও তিনি নিজে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের পর বাংলা ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্যে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
কবিতার কারিগর তথা কবিতার বিশ্বকর্মা রবীন্দ্রনাথকে রাদিচে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথেরই দুটো চরণ নিজের মধ্যে লালন করে। তিনি এই চরণযুগলেই যেন নিজেকে সমর্পণ করে বলেছেন,
‘পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়
পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়’।
পীযূষ কান্তি বড়ুয়া
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
পৃথিবীজুড়ে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়া মানুষ বাঙালি ছাড়াও আরও অসংখ্য আছে। তাঁদের মধ্যে অনন্য একজন হলেন বৃটিশ কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে যাঁর আগ্রহ গবেষণার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রকট ছিলো। ১৯৫১ সালের ১১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করা কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে মৃত্যুকে আলিঙ্গনও করেন নভেম্বরের ১১ তারিখ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে। তিনি না রবীন্দ্রনাথের প্রেমে পড়ে বাংলা শিখেছেন, না বাংলা সাহিত্যকে ভালোবেসে বাংলা শিখেছেন। তাঁর ভাষ্যে তিনি বাংলা শিখেছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রেমে পড়ে। বাঙালির অবিস্মরণীয় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধই উইলিয়াম রাদিচেকে বাংলা ভাষার পঠন-পাঠনে উদ্বুদ্ধ করেছে। এ কারণেই তিনি লন্ডনের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল এন্ড আফ্রিকান স্টাডিজে বাঙালি অধ্যাপক তারাপদ মুখোপাধ্যায়ের নিকট শিখে নেন বাংলা এবং তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে পরবর্তী সময়ে ঐ প্রতিষ্ঠানেই বাংলা বিভাগে সিনিয়র লেকচারার হিসেবে অধ্যাপনায় ব্রতী ছিলেন। তাঁর বাংলা ভাষা শিক্ষাকে পোক্ত করে তোলেন সুজাতা চৌধুরী, যিনি তাঁর পুরোনো বন্ধু যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইমেরিটাস সুকান্ত চৌধুরীর মা। উইলিয়াম রাদিচে কলকাতা সল্টলেকে তাদের বাসায় অনেকবার আসা-যাওয়া করার সুবাদে মহীয়সী সুজাতা চৌধুরীর নৈকট্য লাভ করেন। তিনি তাঁর সাথে বিন্দুমাত্র ইংরেজিতে কথা না বলে সর্বদা বাংলা ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং রাদিচের ভাঙা ভাঙা বাংলাকে ঠিক করে দিয়ে মমতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। ফলে এই বিষয়টা তাঁর জন্যে যেমন শিক্ষণের পূর্ণতা এনে দেয় তেমনি বাংলা সাহিত্যের প্রতি তাঁকে অনুরাগীও করে তোলে। উইলিয়াম রাদিচে ২০০৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে গুজরাট রায়টে নিহতদের এবং সুজাতা চৌধুরীর স্মরণসভায় আহমেদাবাদের রবীন্দ্রভবনে প্রদত্ত বক্তব্যে একথা বেশ বিনয় ও উচ্ছ্বাসের সাথে উল্লেখ করেন। রবীন্দ্রভবনের অবস্থান হলো স¤্রাট শাহজাহানের প্রাসাদ শাহীবাগ এর পেছনের আঙিনায়। উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথের মেজদাদা সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন জেলা জজ হিসেবে ১৮৭৮ সালে আহমেদাবাদে কর্মরত ছিলেন তখন রবীন্দ্রনাথ চার মাস তাঁর কাছে ছিলেন। মেজদার বাসভবন ছিলো স¤্রাট শাহজাহানের শাহীবাগ প্রাসাদে। স¤্রাট শাহজাহানের শাহীবাগ দেখেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’ উপন্যাসের প্লট মাথায় তৈরি করেন। স্মরণসভায় উইলিয়াম রাদিচে বাংলা শিক্ষণের পটভূমি বলতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর অনুরাগ প্রকট করে তোলেন। ধীরে ধীরে বৃটিশ প-িত উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রনাথে মগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁর এ মগ্নতা আমাদের গোলা ভরানো সৃজনশস্যে সমৃদ্ধ করে তোলে। রাদিচের অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ ক্রমশ পাশ্চাত্যে আরও বিস্তৃত হতে শুরু করেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের জীবিত ও মৃত, পোস্টমাস্টার, কাবুলিওয়ালা ছোটগল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। কণিকা, লিখন, স্ফুলিঙ্গ কাব্যহ্রন্থত্রয়ও রাদিচের অনুবাদে পশ্চিমা পাঠকের হাতে পৌঁছায়। তিনি পেঙ্গুইন প্রকাশনী হতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্বাচিত কবিতা ও নির্বাচিত ছোটগল্পের অনূদিত সংকলন প্রকাশ করেন। ‘গীতাঞ্জলি’ গ্রন্থের অনূদিত মূল পা-ুলিপির উপরও উইলিয়াম রাদিচে কিছু গবেষণাধর্মী কাজ সম্পন্ন করেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আখ্যানকাব্য ‘দেবতার গ্রাস’ উইলিয়াম রাদিচের অনুবাদে ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’ শিরোনামে নৃত্যনাট্যে রূপলাভ করেÑ যাকে অপেরা লিব্রেটোর আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এর সংগীতায়োজন করেছেন পরম বীর। ‘স্ন্যাচড বাই দ্য গডস’ নৃত্যনাট্যের দুটো দৃশ্য। দৃশ্য-১ এ মৈত্র মহাশয়, মোক্ষদা ও রাখালসহ অন্যান্য তীর্থযাত্রী নৌকায় আরোহণের ঘটনা বর্ণিত হয়েছে যখন স্থান সংকুলান হবে না ভেবে মোক্ষদা নাছোড়বান্দা রাখালকে ক্রুদ্ধ হয়ে ভুল করে সাগরে ছেড়ে আসার কথা বলে ফেলে। বায়ু অনুকূল হলে নৌকা যখন ছাড়ে তখন অর্কেস্ট্রায় নৌযাত্রার সুর বাজানো হয়। এভাবে দৃশ্য-১-এর সমাপ্তি ঘটে। দৃশ্য-২-এর সূচনা হয় তীর্থস্নান শেষে প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে জোয়ারের প্রতীক্ষায়। মাঝপথে সমুদ্ররুদ্র হয়ে ওঠে, বাতাস ক্রমশ ঝড়ে পরিণত হয় এবং মাঝির কথার প্রেক্ষিতে সবাই যার যার অতিরিক্ত বোঝা সাগরে ফেলে দেয়। এতেও সমুদ্র তার রুদ্র রূপ ত্যাগ না করায় সবাই মোক্ষদাকে চেপে ধরে যাতে প্রতিশ্রুত রাখালকে সমুদ্রে বিসর্জন দেয়। ডুবন্ত রাখালের বাঁচার আকুতি দেখে শেষেমেশ মৈত্র মহাশয়ের হুঁশ জাগ্রত হয় এবং রাখালকে বাঁচানোর অভিপ্রায়ে তিনিও সমুদ্রে ঝাঁপ দেন। এভাবেই শেষ হয় উইলিয়াম রাদিচের অনূদিত রবীন্দ্রনাথের ‘দেবতার গ্রাস’কবিতার অপেরা লিব্রেটোর মঞ্চায়ন।
রাদিচের অধ্যয়নে আরও অনন্য হয়ে উঠেছেন কবিগুরুরবীন্দ্রনাথ। পরবাস সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর এক বক্তব্যের সূত্র ধরে আমরা রবীন্দ্রনাথকে অধ্যয়নে উইলিয়াম রাদিচের নিবিড় ধ্যানমগ্নতার কথা জানতে পারি। ‘রবীন্দ্রনাথের কবিত্বের মহত্ত্ব’ শিরোনামে লেখায় তিনি কবি রবীন্দ্রনাথকে কবিতার নানা কারিগরি দিক থেকে অবলোকন করেছেন। রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদ করতে গিয়ে রাদিচে যেভাবে রবি অধ্যয়নে ব্রতী ছিলেন, তাতে তার মনে হয়েছে, জমিদারি,সমাজ সংস্কার, কৃষি ভাবনা, স্বদেশি রাজনীতি, প্রেম কিংবা দার্শনিক রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে যত বেশি মাতামাতি হয়েছে তাতে কবি রবীন্দ্রনাথ আড়ালে পড়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রকৃত মহত্ত্ব থেকে। কবিতায় ভাবের গভীরতা ও আধ্যাত্মিকতার প্রকাশ থেকে তার মনে হয়েছে, কবিগুরু আসলে প্রেরিত পুরুষ ব্যতীত আর কেউ নন। তাঁর কাব্যে প্রোফেটিক এক্সপ্রেশান এতো বেশি প্রকট ও দ্যুতিময় যে, নিবিড় অধ্যয়নে কবিকে স্বর্গেরপ্রতিনিধি বলেই তিনি মেনেছেন। আরেক উক্তিতে তিনি কবি রবীন্দ্রনাথকে জার্মানিতে যিশুর চেয়ে অধিক চর্চিত বলে ইঙ্গিত করেছেন।
রবীন্দ্রকাব্যের গবেষণায় রাদিচে উপলব্ধি করেছেন, তিনি কবিতায় যে ভাষা ব্যবহার করেছেন তার পরিধি, গভীরতা ও বিস্তার ব্যাপক। রবীন্দ্রনাথ কবিতায় ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহারে অতিশয় সিদ্ধহস্ত ছিলেন। তাই অনুবাদের ক্ষেত্রে রাদিচেও যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন, ধ্রুপদী শব্দকে ধ্রুপদী শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে। এ প্রসঙ্গে তিনি রবীন্দ্রনাথের ‘বৃক্ষ-বন্দনা’ কবিতার কথা উল্লেখ করেন যা তিনি ‘ইন প্রেইজ অব ট্রিজ’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন। কবিতাটিতে সংস্কৃত উদ্ভূত তৎসম জাতীয় ধ্রুপদী শব্দের ব্যবহার দেখে উইলিয়াম রাদিচে অনুবাদের ক্ষেত্রে ল্যাটিন উদ্ভূত ইংরেজি শব্দ দ্বারা সেগুলোর ভাষান্তর করেছেন। যেমন : প্রোফাউন্ড, রেসট্রেইন, পেইশেন্স, ট্রাঙ্কুইল, জুভিনেসেন্ট, ওমনি-ভিক্টোরিয়াস ইত্যাদি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতায় পংক্তিবিন্যাসের বৈশিষ্ট্য তাকে আপ্লুত করেছে। পংক্তির ক্ষেত্রে কবিগুরু গ্যাপ বা অন্তর রাখতে পছন্দ করতেন যাতে কবিতার ভাব পুরোপুরি মেলে ধরা যায়। উইলিয়াম রাদিচে রবীন্দ্রকাব্যে এ বিষয়টি উল্লেখ করে ‘মরণ মিলন’ এবং ‘বধূ’ কবিতা দুটির কথা উল্লেখ করেছেন। রবীন্দ্রনাথের স্তবক বিন্যাসও রাদিচেকে প্রভাবিত করেছে। ‘পক্ষী মানব’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ তিন পংক্তির স্তবক বিন্যাস দেখিয়েছেন যাতে কখক সজ্জায় অন্ত্যমিলের প্রয়োগ রয়েছে। রাদিচে সেঔ অনুকরণে নিজের কিছু কবিতায় এভাবে স্তবক বিন্যাস করে আনন্দ লাভ করেছেন। এই উদাহরণে তিনি রবীন্দ্রনাথের বীর পুরুষ কবিতাকেও রেখেছেন।
কিছু কিছু কবিতার অনুবাদ করতে গিয়ে রাদিচের মনে হয়েছে, কবিতাগুলো যেন শাড়ির মতন। তের হাত শাড়ি যেমন বিস্তৃত হয়ে সৌন্দর্যের দ্যোতনা তৈরি করে, তেমনি রবীন্দ্রনাথের কিছু কবিতার পংক্তিকে তিনি একটার পর একটা সাজিয়ে আঠা দিয়ে লাগিয়ে শাড়ির মতো লম্বা করে প্রমাণ করেছেন কবিতার সারস্বত বহমানতাকে। তার ভাষায় এ জাতীয় কবিতাগুলোকে ‘শাড়ি কবিতা’ বলা যায়। কিছু কিছু রবীন্দ্রকাব্যে উইলিয়াম রাদিচে তবলার তালের সন্ধান পেয়েছেন। এরকম কবিতার উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি ‘তপোভঙ্গ’ নামক কবিতার কথা উল্লেখ করেছেন যাতে নটরাজ শিবের নাচের মুদ্রার মতো ব্যঞ্জনায় কবিতা এগিয়ে গেছে।
রবীন্দ্রকাব্যে রসবোধের ঘাটতি ছিলো না কোথাও। তাঁর কবিতার আঙ্গিকে রসবোধের নহর যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে। রাদিচের ভাষায় ‘ফাঁকি’, যা অনুবাদে ‘ডিসেপশন’, কবিতায় রবীন্দ্রনাথ যে রসবোধ ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের নান্দনিকতা তৈরি করেছেন তাতে কবি হিসেবে তাঁর মহত্ত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ। কবিতায় যে বোধ তৈরি করার মুন্সিয়ানা কবিগুরু দেখিয়েছেন তাতে তিনি অদ্বিতীয়। তাঁর বহুল পঠিত শিশুতোষ কবিতা ‘তালগাছ’-এর কথা রাদিচে উদাহরণ হিসেবে কাছে টানেন। এতে তালগাছকে গাছ নয় বরং একজন শিশু হিসেবে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক বিচক্ষণতার সন্ধান দিতে গিয়ে রাদিচে কবিগুরুর কণিকা, লেখন ও স্ফুলিঙ্গ কাব্যগ্রন্থত্রয়ের কথা বলেছেন। এই গ্রন্থত্রয়ে রবীন্দ্রনাথের বিচক্ষণ বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় পেয়ে গ্রন্থগুলো বাংলা থেকে ধীরে ধীরে ইংরেজিতে অনুবাদ করে তোলেন।
কবি ও অনুবাদক উইলিয়াম রাদিচে যে ব্রত নিয়ে নিবিড় মমতায় রবীন্দ্রনাথকে অনুবাদের মাধ্যমে উৎখনন করেছেন তা অনুসরণীয়। তার অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ নিছক বাঙালির হয়ে রইলেন না, বরং তিনি হয়ে উঠলেন সারা পৃথিবীর পাঠযোগ্য মহান কবি। রবীন্দ্রকাব্যের কারিগরি দিক নিয়ে গবেষকের তপস্যায় উইলিয়াম রাদিচে ছাড়া আর কেউ আলোচনা করেননি। মুক্তিযুদ্ধের কারণে বাংলা ভাষার প্রেমে পড়লেও তিনি নিজে রবীন্দ্রনাথকে আবিষ্কারের পর বাংলা ভাষা শেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্যে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
কবিতার কারিগর তথা কবিতার বিশ্বকর্মা রবীন্দ্রনাথকে রাদিচে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রবীন্দ্রনাথেরই দুটো চরণ নিজের মধ্যে লালন করে। তিনি এই চরণযুগলেই যেন নিজেকে সমর্পণ করে বলেছেন,
‘পথের প্রান্তে আমার তীর্থ নয়
পথের দুধারে আছে মোর দেবালয়’।