বাবুল আনোয়ার
শামসুর রাহমানের কবিতায় নানা দিকের সম্মিলন পরিদৃষ্ট হয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি কবিতা নিয়েই থেকেছেন। কবিতা নিয়ে এই যে মগ্নতা ও পরিচর্যা, তা তাঁকে কবিতার নানা দিগন্ত উন্মোচনে পথ দেখিয়েছে। নিরলসভাবে কবিতার বৈভব ছড়িয়েছেন।তিনি কবিতার আধুনিক মনন ও সৃষ্টিশীলতার বাতিঘর। তাঁর কবিতার বিষয় ও ব্যঞ্জনা গ্রাম থেকে শহর, ঘিঞ্জি গলি থেকে রাজপথ, পুরাণ থেকে আধুনিক ইতিহাস, আন্দোলন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা,মায়ের কোল,স্বদেশ থেকে বৈশ্বিক ম-লে সমানভাবে বিস্তৃত। শামসুর রাহমানের কবিতা জীবন ও জগতের নিপুণ চিত্রায়ন, কাব্যিক শিল্পকলা, কালের অনন্য কল্লোল।
শামসুর রাহমান প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে জীবনের যে বোধ ও ব্যাপ্তিকে ধারণ করেন পরবর্তীকালে তা আরও সম্প্রসারিত হয়। এ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রটির ধরনও অনেকাংশে পাল্টে যায়। প্রথমদিকের কবিতাসমূহে তিনি স্বপ্ন, বাস্তবতাকে রোমান্টিকতার আদলে প্রকাশে প্রলুদ্ধ হন। এর সাথে প্রকৃতি,জীবনের নিবিড় পাঠ, টানাপোড়েন, মানবিকতা, বিরোধ বড় হয়ে দেখা দেয়। তিনি মানবীয় আশা-আকাক্সক্ষাকে কবিতায় তুলে ধরতে তৎপর হয়ে ওঠেন। প্রথম দিকের লেখা ‘প্রথম গান,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যসমূহে তা চোখে পড়ে। যেমন : “আমার বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে/ চেয়ারে, টেবিলে আর খাটে / দুঃখ তার লেখে নাম।/ ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি / ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়” (দুঃখ, রৌদ্র করোটিতে)। তাঁর দৃষ্টির গভীরতা ও পর্যবেক্ষণে যাপিত জীবনের দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান অনুষঙ্গসমূহকে কবিতায় তুলে ধরেন আশ্চর্য কুশলতায়।
শামসুর রাহমান স্বদেশ,স্বকাল ও সময়কে তাঁর কবিতায় মেলে ধরেছেন। যে কোনো বিরূপ সময়, বিপন্নতা যখনই স্বদেশ ও সমাজের বুকে আঘাত হেনেছে, তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কবি মানসের এ অনড় নীতিগত অবস্থান তাঁর কবিতাকে মানবিকতার সুমহান আদর্শে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। এ ঐশ্বর্যময়তা তাঁর কবিতার অমিয় শক্তি ও চিরকালীন বৈভব। নিজ বাসভূমে,বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয় নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যসমূহে তাঁর এ প্রবণতা সৃষ্টির ধারায় বেগবান হয়েছে। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তার প্রাণের স্পন্দন হয়ে ধ্বনিত হয়েছে কবিতায়। এ মাহাত্ম্য জাতীয় জীবন থেকে বৈশ্বিক পরিম-লেও সমানভাবে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দেশ,কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের অনড়, অনাদি স্বপ্নকে তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন অবলীলায়। এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তার টেলিমেকাস, ইকারুস, চাঁদ সওদাগর, এ্যাকিলিসের মতো বিষয়গুলোতে। জাতীয় ক্ষেত্রে আসাদের শার্টকে ‘প্রাণের পতাকা’ হিসাবে জাতির বিক্ষুদ্ধ মননকে ধারণ করেছেন:
‘উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/ আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে।/ চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/ আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক;/ আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।” (আসাদের শার্ট, নিজ বাসভূমে)। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, ইতিহাস তার কবিতায় নানাভাবে ধ্বনিত। তিনি অনড়,অনাদি মানবিক স্বপ্নকে কবিতায় ধারণ করেছেন অবলীলায়। এ ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অপরিমেয় ত্যাগ, বেঁচে থাকার দুর্নিবার শপথ তাঁর কবিতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে: “তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা-মাতার লাশের ওপর।” (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, বন্দী শিবির থেকে)
কখনো আবার নাগরিক জীবনের অতি সাধারণ বিষয়সমূহকে তিনিনিপুণভাবে কবিতার অনুষঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। যেমন চাদর, কাক, পথের কুকুর, মোমবাতি, ল্যাম্পপোস্ট ইত্যাদি। এ ধরনের শব্দাবলির প্রয়োগ, প্রয়াস কবিতায় তার আগে খুব বেশি পরিদৃষ্ট হয় নি। এখানে তিনি আলাদা কুশীলবের ভূমিকায় নতুন শব্দের সংযোজন ঘটিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘শামসুর রাহমান আমাদের নগর স্বভাবী আধুনিক কবি মানসিকতায় লিরিক্যাল মেজাজ প্রবর্তনের প্রথম প্রয়াসী।’ শামসুর রাহমান কবিতায় লোকজ শব্দ ও বিষয়াবলি সংযোজনের ক্ষেত্রেও সাবলীল ও সংযমী। মৃত্তিকামগ্ন মানুষের জীবন, স্বদেশের চেনা-জানা পরিবেশ, প্রকৃতি থেকেও তিনি কবিতার জন্য অজ¯্র উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।তার কবিতায় লোকজ শব্দাবলির প্রয়োগের সাথে মিথ,ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে:“ঝিঁঝির কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে/ উন্মন-মনে হরিণের মতো দাঁতে ছিঁড়ি ঘাস,/ হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ / তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে, সোনালী অলস মৌমাছিদের/পাখাÑ গুঞ্জনে জ্বলে ওঠে মন, হাজার হাজর বছরের ঢের/ (রূপালী স্নান, প্রথম গান,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে) এমনি তার অনেক কবিতায় লোকজ শব্দ,উপমা, প্রতীকের সাথে নগর জীবন আবহের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। পাল্কি, বেনারসি শাড়ি, কলস সাঁঝ, দিঘি, বেনেবউ পাখি প্রভৃতি লোকজ শব্দাবলি তার কবিতার নির্মাণ কৌশলে শিল্পময় হয়ে ওঠে। কমবেশি সব ধরনের কবিতায় তিনি নাগরিক অনুষঙ্গের সাথে লোকজ উপাদানের সমন্বয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পটভূমিতে লেখা তার কালজয়ী কয়েকটিকবিতায় তার গভীর প্রসারিত শিল্পচেতনা যুগ চেতনার বাহনে রূপান্তরিত হয়েছে। স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য। এসব কবিতায় বর্ণিত ব্যক্তিবর্গ, দৃশ্যপট আমাদের চেনাজানা পরিবেশ ও জনপদ থেকে আহৃত। এভাব তিনি লোক জীবনের নানা চাওয়া, অভীক্ষাকেশিল্পের সম্ভারে তুলে ধরেছেন।
মাতৃবন্দনা, মায়ের প্রতি সহজাত অনুরাগ, মাকে কাছে থেকে দেখার অনুভূতিকে তিনি কবিতায় চিত্রায়িত করেন অনবদ্য গাঁথুনিতে। মাকে তিনি দেখেন বাঙালি জীবনের চিরায়ত আবরণ, মাতৃত্বের গভীর, প্রসারিত বেষ্টনে। মায়ের অব্যক্ত কথামালা, অন্তর্গত অনুভবের আর্তি ধ্বনিময় ওঠে কবিতায় তার: “কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি। / সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/ আমাকে ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনে পড়ে না।”
“যেন তার সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে / রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের / গ্রন্থিল শরীর থেকে কালভাদ্রে সুর নয়, শুধু/ ন্যাপথলিনের তীব্র গন্ধ ভেসে আসে!” (কখনো আমার মাকে,বিধ্বস্ত নীলিমা)
শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয় ও অনুষঙ্গ জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষণের উদ্ভাস। এ উদ্ভাসই অসীমের সীমানাকে স্পর্শ করে। মানব অনুভূতিকে তিনি সহজেই কবিতায় ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এসবের সম্মিলন পরিশীলিত শিল্প আঙ্গিকে তার কবিতাকে অজর করে তোলে। সমান্তরালভাবে তা বাংলা কবিতার সৌকর্য ও আভিজাত্য সম্প্রাসারিত করেছে। সময়, সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, নির্মাণ কৌশলের নিজস্ব ভঙ্গি তাকে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাবুল আনোয়ার
বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর ২০২৪
শামসুর রাহমানের কবিতায় নানা দিকের সম্মিলন পরিদৃষ্ট হয়। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি কবিতা নিয়েই থেকেছেন। কবিতা নিয়ে এই যে মগ্নতা ও পরিচর্যা, তা তাঁকে কবিতার নানা দিগন্ত উন্মোচনে পথ দেখিয়েছে। নিরলসভাবে কবিতার বৈভব ছড়িয়েছেন।তিনি কবিতার আধুনিক মনন ও সৃষ্টিশীলতার বাতিঘর। তাঁর কবিতার বিষয় ও ব্যঞ্জনা গ্রাম থেকে শহর, ঘিঞ্জি গলি থেকে রাজপথ, পুরাণ থেকে আধুনিক ইতিহাস, আন্দোলন, সংগ্রাম, স্বাধীনতা,মায়ের কোল,স্বদেশ থেকে বৈশ্বিক ম-লে সমানভাবে বিস্তৃত। শামসুর রাহমানের কবিতা জীবন ও জগতের নিপুণ চিত্রায়ন, কাব্যিক শিল্পকলা, কালের অনন্য কল্লোল।
শামসুর রাহমান প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে জীবনের যে বোধ ও ব্যাপ্তিকে ধারণ করেন পরবর্তীকালে তা আরও সম্প্রসারিত হয়। এ সম্প্রসারণের ক্ষেত্রটির ধরনও অনেকাংশে পাল্টে যায়। প্রথমদিকের কবিতাসমূহে তিনি স্বপ্ন, বাস্তবতাকে রোমান্টিকতার আদলে প্রকাশে প্রলুদ্ধ হন। এর সাথে প্রকৃতি,জীবনের নিবিড় পাঠ, টানাপোড়েন, মানবিকতা, বিরোধ বড় হয়ে দেখা দেয়। তিনি মানবীয় আশা-আকাক্সক্ষাকে কবিতায় তুলে ধরতে তৎপর হয়ে ওঠেন। প্রথম দিকের লেখা ‘প্রথম গান,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’, ‘রৌদ্র করোটিতে’, ‘বিধ্বস্ত নীলিমা, ‘নিরালোকে দিব্যরথ’ কাব্যসমূহে তা চোখে পড়ে। যেমন : “আমার বারান্দায় ঘরের চৌকাঠে/ চেয়ারে, টেবিলে আর খাটে / দুঃখ তার লেখে নাম।/ ছাদের কার্নিশ, খড়খড়ি / ফ্রেমের বার্নিশ আর মেঝের ধুলোয়” (দুঃখ, রৌদ্র করোটিতে)। তাঁর দৃষ্টির গভীরতা ও পর্যবেক্ষণে যাপিত জীবনের দৃশ্যমান, অদৃশ্যমান অনুষঙ্গসমূহকে কবিতায় তুলে ধরেন আশ্চর্য কুশলতায়।
শামসুর রাহমান স্বদেশ,স্বকাল ও সময়কে তাঁর কবিতায় মেলে ধরেছেন। যে কোনো বিরূপ সময়, বিপন্নতা যখনই স্বদেশ ও সমাজের বুকে আঘাত হেনেছে, তিনি দ্বিধাহীন চিত্তে তার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। কবি মানসের এ অনড় নীতিগত অবস্থান তাঁর কবিতাকে মানবিকতার সুমহান আদর্শে ঐশ্বর্যময় করে তুলেছে। এ ঐশ্বর্যময়তা তাঁর কবিতার অমিয় শক্তি ও চিরকালীন বৈভব। নিজ বাসভূমে,বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয় নাও ঘাতক কাঁটা কাব্যসমূহে তাঁর এ প্রবণতা সৃষ্টির ধারায় বেগবান হয়েছে। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা তার প্রাণের স্পন্দন হয়ে ধ্বনিত হয়েছে কবিতায়। এ মাহাত্ম্য জাতীয় জীবন থেকে বৈশ্বিক পরিম-লেও সমানভাবে পরিব্যাপ্ত হয়েছে। দেশ,কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষের অনড়, অনাদি স্বপ্নকে তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন অবলীলায়। এর প্রতিফলন লক্ষ করা যায় তার টেলিমেকাস, ইকারুস, চাঁদ সওদাগর, এ্যাকিলিসের মতো বিষয়গুলোতে। জাতীয় ক্ষেত্রে আসাদের শার্টকে ‘প্রাণের পতাকা’ হিসাবে জাতির বিক্ষুদ্ধ মননকে ধারণ করেছেন:
‘উড়ছে, উড়ছে অবিরাম/ আমাদের হৃদয়ের রৌদ্র-ঝলসিত প্রতিধ্বনিময় মাঠে।/ চৈতন্যের প্রতিটি মোর্চায়।/ আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা/ সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখ- বস্ত্র মানবিক;/ আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।” (আসাদের শার্ট, নিজ বাসভূমে)। জাতির আশা-আকাক্সক্ষা, ইতিহাস তার কবিতায় নানাভাবে ধ্বনিত। তিনি অনড়,অনাদি মানবিক স্বপ্নকে কবিতায় ধারণ করেছেন অবলীলায়। এ ধারাবাহিকতায় স্বাধিকার ও স্বাধীনতা সংগ্রামের অপরিমেয় ত্যাগ, বেঁচে থাকার দুর্নিবার শপথ তাঁর কবিতায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে: “তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা,/ সাকিনা বিবির কপাল ভাঙলো,/ সিঁথির সিদুর মুছে গেল হরিদাসীর।/ তুমি আসবে বলে, হে স্বাধীনতা/ অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতা-মাতার লাশের ওপর।” (তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা, বন্দী শিবির থেকে)
কখনো আবার নাগরিক জীবনের অতি সাধারণ বিষয়সমূহকে তিনিনিপুণভাবে কবিতার অনুষঙ্গ হিসাবে বেছে নিয়েছেন। যেমন চাদর, কাক, পথের কুকুর, মোমবাতি, ল্যাম্পপোস্ট ইত্যাদি। এ ধরনের শব্দাবলির প্রয়োগ, প্রয়াস কবিতায় তার আগে খুব বেশি পরিদৃষ্ট হয় নি। এখানে তিনি আলাদা কুশীলবের ভূমিকায় নতুন শব্দের সংযোজন ঘটিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে কবি আল মাহমুদ বলেন, ‘শামসুর রাহমান আমাদের নগর স্বভাবী আধুনিক কবি মানসিকতায় লিরিক্যাল মেজাজ প্রবর্তনের প্রথম প্রয়াসী।’ শামসুর রাহমান কবিতায় লোকজ শব্দ ও বিষয়াবলি সংযোজনের ক্ষেত্রেও সাবলীল ও সংযমী। মৃত্তিকামগ্ন মানুষের জীবন, স্বদেশের চেনা-জানা পরিবেশ, প্রকৃতি থেকেও তিনি কবিতার জন্য অজ¯্র উপকরণ সংগ্রহ করেছেন।তার কবিতায় লোকজ শব্দাবলির প্রয়োগের সাথে মিথ,ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিস্ময়কর সমন্বয় ঘটেছে:“ঝিঁঝির কোরাসে স্তব্ধ, বিগত রাত মনে করে/ উন্মন-মনে হরিণের মতো দাঁতে ছিঁড়ি ঘাস,/ হাজার যুগের তারার উৎস ঐ যে আকাশ / তাকে ডেকে আনি হৃদয়ের কাছে, সোনালী অলস মৌমাছিদের/পাখাÑ গুঞ্জনে জ্বলে ওঠে মন, হাজার হাজর বছরের ঢের/ (রূপালী স্নান, প্রথম গান,দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে) এমনি তার অনেক কবিতায় লোকজ শব্দ,উপমা, প্রতীকের সাথে নগর জীবন আবহের প্রতিফলন লক্ষ করা যায়। পাল্কি, বেনারসি শাড়ি, কলস সাঁঝ, দিঘি, বেনেবউ পাখি প্রভৃতি লোকজ শব্দাবলি তার কবিতার নির্মাণ কৌশলে শিল্পময় হয়ে ওঠে। কমবেশি সব ধরনের কবিতায় তিনি নাগরিক অনুষঙ্গের সাথে লোকজ উপাদানের সমন্বয় করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার পটভূমিতে লেখা তার কালজয়ী কয়েকটিকবিতায় তার গভীর প্রসারিত শিল্পচেতনা যুগ চেতনার বাহনে রূপান্তরিত হয়েছে। স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা উল্লেখযোগ্য। এসব কবিতায় বর্ণিত ব্যক্তিবর্গ, দৃশ্যপট আমাদের চেনাজানা পরিবেশ ও জনপদ থেকে আহৃত। এভাব তিনি লোক জীবনের নানা চাওয়া, অভীক্ষাকেশিল্পের সম্ভারে তুলে ধরেছেন।
মাতৃবন্দনা, মায়ের প্রতি সহজাত অনুরাগ, মাকে কাছে থেকে দেখার অনুভূতিকে তিনি কবিতায় চিত্রায়িত করেন অনবদ্য গাঁথুনিতে। মাকে তিনি দেখেন বাঙালি জীবনের চিরায়ত আবরণ, মাতৃত্বের গভীর, প্রসারিত বেষ্টনে। মায়ের অব্যক্ত কথামালা, অন্তর্গত অনুভবের আর্তি ধ্বনিময় ওঠে কবিতায় তার: “কখনো আমার মাকে গান গাইতে শুনিনি। / সেই কবে শিশু রাতে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে/ আমাকে ঘুম পাড়াতেন কি না আজ মনে পড়ে না।”
“যেন তার সব গান দুঃখ-জাগানিয়া কোনো কাঠের সিন্দুকে / রেখেছেন বন্ধ করে আজীবন, এখন তাদের / গ্রন্থিল শরীর থেকে কালভাদ্রে সুর নয়, শুধু/ ন্যাপথলিনের তীব্র গন্ধ ভেসে আসে!” (কখনো আমার মাকে,বিধ্বস্ত নীলিমা)
শামসুর রাহমানের কবিতার বিষয় ও অনুষঙ্গ জীবনের নিবিড় পর্যবেক্ষণের উদ্ভাস। এ উদ্ভাসই অসীমের সীমানাকে স্পর্শ করে। মানব অনুভূতিকে তিনি সহজেই কবিতায় ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। আর এসবের সম্মিলন পরিশীলিত শিল্প আঙ্গিকে তার কবিতাকে অজর করে তোলে। সমান্তরালভাবে তা বাংলা কবিতার সৌকর্য ও আভিজাত্য সম্প্রাসারিত করেছে। সময়, সচেতনতা, দৃষ্টিভঙ্গির গভীরতা, নির্মাণ কৌশলের নিজস্ব ভঙ্গি তাকে আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে।