রফিকুন নবী
৮২তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর বহুমুখী কাজের কারণেই বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র
একজন। দীর্ঘ ছয় দশকের শিল্পচর্চায় তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের চিত্রকলার ব্যাপক ভুবন। র’নবী নামে তাঁর টোকাই সিরিজের কাজগুলো দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া তাঁর জলরঙের ছবি ও অন্যান্য কাজে তিনি গণমানুষের আকাক্সক্ষা ও সুখ-দুঃখকে তুলে ধরেছেন। বর্ষীয়ান এই চিত্রশিল্পীর আজ ৮২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো আজকের ‘সংবাদ সাময়িকী’তে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ওবায়েদ আকাশ
ওবায়েদ আকাশ: আপনি কেন চিত্রকলার প্রতি আগ্রহী হলেন? দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে কি মনে হয় আপনার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?
রফিকুন নবী: আমি যে খুব আগ্রহী ছিলাম, সেটা বলা যাবে না। বাবা পুলিশের লোক ছিলেন, ছবি আঁকতেন, তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁর বড় ছেলেকে ছবি আঁকা শেখাবেন। সেখান থেকেই আগ্রহী হলাম। আমি স্কুলে থাকতে ছবি আঁকতাম। এটা ছাত্র-শিক্ষকরা জানতেন, স্কুলের সব ধরনের আর্ট ডিজাইনের কাজে আমাকে ডাকা হতো। সবাই জানতেন, আমি ছবি আঁকি। স্কুল থেকে একটা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেটার অঙ্গ সজ্জা, ছবি আঁকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাকে দেয়া হতো। আমিই আঁকতাম। ১৯৪৮ সালে আর্ট কলেজ হলো ঢাকায়। আমাকে ১৯৫৯ সালে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেয়া হলো, শাহবাগে, বর্তমানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। বাবার আগ্রহ, আমার আগ্রহ, শিক্ষকদের আগ্রহ- সব মিলে আমার শিল্প চর্চা শুরু।
আর আমার স্বপ্ন পূরণের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার বাবার স্বপ্ন। আমার বাবা আমাকে শিল্পী হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখতেন। আমি যখন শিল্পী হিসেবে বেশ নামধাম করেছি, বাবা তখন পরপারে চলে গেলেন। বলা যায় কিছুটা তো তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছেই। তবে, তাঁর তো আর স্বপ্নের শেষ ছিল না। ছেলেকে শিল্পী বানাতে গিয়ে বাবাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যেহেতু শিল্পকলার মধ্যে কোনো সম্ভাবনা নাই, তাই তিনি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নানা কথা শুনতেন যে, আমাকে কেন চারুকলায় ভর্তি করানো হলো। বাবা আমাকে চিত্রশিল্পী বানানোকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন।
ও. আ. : আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের চিত্রকলায় এমন কোনো শূন্যস্থান রয়েছে, যেখানে কাজ করা হয়নি?
র. ন. : আসলে কোনো দিকেই কাজ করা হয় নাই। যা করা উচিত ছিল, যা হওয়া উচিত ছিল, তা হয় নাই। শিল্পীদের তো ভাবনার শেষ নাই। চিত্রকলাটা এখনো কতিপয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। তৃণমূলের সবার কাছে পৌঁছে নাই। গণমানুষের কাছে পৌঁছে নাই।
ও. আ. : সারা বিশে^র চিত্রকলার সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পকলাকে আপনি কোথায় স্থান দিতে চান?
র. ন. : আমাদের চিত্রকলার অবস্থান উন্নত বিশে^র চিত্রকলার কাছে উল্লেখ করার মতো না। গ্লোবালি আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের সম্পর্কে বাইরের শিল্পীরা তেমন কিছুই জানেন না। তবে আমাদের সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। তরুণরা আমন্ত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে তারা সারা বিশে^র খোঁজখবর রাখতে পারছে। বিভিন্ন বড় বড় এক্সিবিশনে তারা অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বড় শিল্পীদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। এখনকার নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা ততটা পিছিয়ে নেই। মানের দিক দিয়েও প্রায় সমান সমান।
ও. আ. : রাষ্ট্রের বা সমাজের প্রতি শিল্পের যে দায় রয়েছে, সেটা আপনি বিশ^াস করেন? সেই দিক থেকে সেই দায়টি আপনি কীভাবে শোধ করতে চেয়েছেন?
র. ন. : অবশ্যই বিশ^াস করি। আমাদের দায় শোধের ব্যাপারগুলো মানুষ বুঝতে পারে না। শুধু ছবি আঁকাই তো বড় ব্যাপার না। সিরামিক, হ্যান্ডিক্রাফটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ হচ্ছে। আমি হয়তো করি না, কিন্তু বাংলাদেশের প্রচুর শিল্পী এ কাজগুলো করে দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে প্রচুর রেভিনিউ আসছে। এগুলো একরকম। আর একটা দিক আছে। আমরা দেশ-কাল সম্পর্কে ভাবি। যখন ঝড় জলোচ্ছ্বাস বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তখন কিন্তু শিল্পীরাই সবার আগে এগিয়ে আসেন মানুষের পাশে। শিল্পীরা মানুষের পাশে থেকে কাজ করছেন। কিন্তু সেটা তাঁরা প্রচারে বিশ^াসী নন। তাই এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এগুলো আসে দায়বদ্ধতা থেকে। এগুলো শিক্ষা থেকে হয়। ১৯৪৭-এর আগে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে প্রকাশ করেছিলেন। এটা তো তাঁর দায়বদ্ধতারই একটা দিক। শিল্পীরা এসব প্রচারে বিশ^াসী নন। গ্রামে যে হস্তশিল্প, সেগুলো তো আর্টের মধ্যেই পড়ে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কাজ। এই পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা- এগুলো শিল্পীরা বাঁচিয়ে রাখেন। মানুষের গায়ের জামার নকশাও যে পরিবর্তন করা উচিত সেটাও শিল্পীরা ভাবেন। আবার খাদ্য সংস্কৃতির কথা যদি বলি, আমরা ভাত খাই, ডাল খাই, মাছ খাই, পোলাও বিরিয়ানি খাই। কত কিছু খাই। তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমরা ডাল-ভাতই খাই। এগুলোও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
ও. আ. : আপনার বিখ্যাত টোকাই কার্টুনটি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এই কার্টুনটি করতে গিয়ে আপন কি সে সময়ের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত নাকি ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ চিন্তা থেকে কাজটি করেছিলেন?
র. ন. : সময়ের প্রয়োজন এবং সামাজিক অবস্থানের প্রয়োজনে টোকাই এঁকেছি। আমি ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ কথাটায় বিশ^াসী নই। আমি ছবি আঁকলাম মানুষ বুঝল না, ধরতে পারল না, এটা আমার পছন্দ নয়।
ও. আ. : টোকাইয়ের বাইরে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা আপনার কথা বলতে গেলেই প্রথমে টোকাইয়ের কথাটা মাথায় রাখি। এতে কি আপনার মনে হয় আপনাকে আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি?
র. ন. : ব্যাপারটা এখন সবাই জানে যে, আমি অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেছি। শুধু টোকাই নয়। এখন সাবাই জানছে, আমার বিপুল কাজের এলাকা সম্পর্কে। টোকাইয়ের সঙ্গে আরো কাজ আছে। সেটা ছাপা হয় র’নবী স্বাক্ষরে। ছাপা হলে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল মানুষ সেটা সম্পর্কে জানতে পারেন। এভাবে টোকাই ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। টোকাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আঁকা কার্টুন। যে কারণে এটার কথা বেশি বেশি জানে সকলে।
ও. আ. : টোকাইয়ের বাইরে আপনার অন্য কাজগুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা কেমন বলে আপনি মনে করেন?
র. ন. : যারা প্রদর্শনী দেখেন না, তারা জানেন না। কিন্তু যারা দেখেন তারা জানেন আমাদের কাজ সম্পর্কে। যারা শিল্প ভালবাসেন, পত্রপত্রিকায় নিউজ ফিচার লেখেন, তারা মনোযোগ দিয়ে প্রদর্শনী দেখেন এবং সকলে জানেন আমার নানামুখী কাজের কথা। আমার ভাগ্য ভাল, সবাই টোকাই সম্পর্কে জানেন, র’নবীর কথা জানেন। সবাই জানেন র’নবী একজন শিল্পী তিনি টোকাই কার্টুন সিরিজ এঁকেছেন। আবার অন্য ছবি দেখে তারা বুঝে যান, এই র’নবীই রফিকুন নবী। তাঁরা তখন বুঝতে পারেন, এঁরা দুজনই একই ব্যক্তি। এই শিল্পীর কাজের ব্যাপ্তি অনেক। র’নবী বা রফিকুন নবী শুধু কার্টুন আঁকেন না; তিনি বিপুল ক্যানভাসে কাজ করেন।
আমি তিনটি ফেজে কাজ করি। এগুলো হচ্ছে প্রথমত আমার কার্টুন, দ্বিতীয়ত প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ-ইলাস্ট্রেশন এবং তৃতীয়ত আমার ছবি। ওয়াটার কালার, বা বিভিন্ন মাধ্যমে আমার বড় বড় ছবি। আমার কার্টুন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কী হচ্ছে তাতে কিছু যায় আসে না। আঁকাআঁকি করে দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারাটাই বড় ব্যাপার। যেমন জয়নুলের ছবি। তিনি তাঁর নিজের দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। আমার ক্ষেত্রে এ কথা বলার সময় এখনো আমার আসেনি। তবে, শিল্পীরা কখনো বলতে পারেন না, এটা আমার সবচেয়ে সেরা কাজ। কারণ শিল্পী সব সময় অতৃপ্ত থাকেন। এই অতৃপ্তিই তাঁকে দিয়ে নতুন একটি কাজ করিয়ে নেয়। যেমন: পিকাসো মারা যারা যাবার আগে বলে গেলেন, “যা করতে চাইলাম তা হলো না”। সঙ্গীতের ব্যাপারেও কিন্তু তাই। সঙ্গীতশিল্পীদের অতৃপ্তির কারণে আমরা নতুন নুতন সঙ্গীত পাই।
ও. আ. : আপনি পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে পুরান ঢাকায় বসবাস ও পড়াশোনা শুরু করেছেন। তার আগে আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছিলেন। শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। গ্রাম এবং শহরের মধ্যে একটা বৈপরীত্য থাকেই। শিল্প চর্চার জন্য গ্রাম এবং শহর কোনটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
র. ন. : আমার কার্টুন কিন্তু শহর কেন্দ্রিক। কিন্তু ছবি গ্রাম সম্পর্কিত। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীবনাচার, গ্রামের মানুষ, তাদের সমস্যা প্রভৃতি আমার ছবির কেন্দ্রে থাকে। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহর দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
ও. আ. : যতদূর জানি আপনি বিদেশে তিনটি ও দেশে ১৫টির মতো একক চিত্রপ্রদর্শনী করেছেন। আর গ্রুপ এক্সিবিশন করেছেন অসংখ্য। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কি বলবেন, দর্শক আপনার কোন ধরনের কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী?
র. ন. : দর্শকের আগ্রহ তো বুঝি না। সেটা নিয়ে আমি ভাবিও না। যেটা আমার হাতে আসে, যেটা আমার জানা আছে, সেটা নিয়েই কাজ করি। ট্যোটাল রিয়ালিস্টিকের মধ্যে যাই না। আবার সম্পূর্ণ এবস্ট্রাক্টও না আমার কাজ। এই দুটোর মাঝামাঝি থাকি। এটাই আমার স্টাইল। আধা বিমূর্ত আধা মূর্ত- আমার স্টাইল।
ও. আ. : আপনি গ্রিস সরকারের বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। এই প্রাচীন সভ্যতার দেশে, আদি শিল্পের ভূমিতে আপনার অবস্থানকালে শিল্প সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে যদি আমাদের শোনাতেন-
র. ন. : প্রাচীন গ্রিস আর আজকের গ্রিস এক কথা নয়। প্রাচীনের সাথে মডার্ন গ্রিসের কোনো মিল নাই। ওরা অনেক দূরে চলে এসেছে। ইওরোপের গরিব দেশগুলোর একটা গ্রিস। ওদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল ছিল না। আমি যখন যাই সরকার বিরোধী আন্দোলন চলছিল। পোস্টগ্রাজুয়েট করতে গিয়েছিলাম। আমার ছিল নিরীক্ষাধর্মী কাজ। নিরীক্ষার বিষয় ছিল কাঠ খোদাই। আমি সারাক্ষণ মগ্ন থাকতাম, কী করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যায়।
ও. আ. : কাজটি করতে গিয়ে আপনি কি ওদের কাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন?
র. ন. : ঠিক তা নয়, তবে টেকনিকের ব্যাপারটা ছিল। যা আমি ফলো করি নাই। শিল্পীদের মধ্যে ইনডিভিজ্যুয়ালিটি তো থাকেই। যে কারণে আমি ওদের থেকে কিছু গ্রহণ করিনি। তবে কিছু শিক্ষা নিয়েছি।
ও. আ. : আমার তো মনে হয় এথেন্সের শিল্পকলার সঙ্গে আমাদের শিল্পকলার পার্থক্য ব্যাপক। তারা তো সাধারণত নগ্ন মানব-মানবীর অবয়ব নিয়ে প্রচুর কাজ করেন, যাকে ন্যুড স্টাডি বলে। এবং তাতে যে আবহ তৈরি হয়, তা বিশে^র বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমাদের শিল্পকলার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না কেন? কিংবা আপনি যদি গ্রিসের শিল্পচর্চা নিয়ে নতুন কিছু বলতে চান।
র. ন. : ওয়েস্টে ন্যুড স্টাঢি করে। মডেলও পায়। ওদের ক্লাসেই মডেল থাকে। আবার ব্যক্তিগত স্টুডিওতেও থাকে। এটা আমাদের সমাজে নাই। শিল্পী হতে গেলে যে ন্যুড স্টাডি মাস্ট; এটা আমি মনে করি না। ওয়েস্টে ন্যুড স্টাডি মাস্ট। সাবজেক্টই থাকে বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের ন্যুড স্টাডি করার বাধ্যবাধকতা নাই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন, একটা ন্যুড আঁকা আর একটা গাছ আঁকা একই কথা। অর্থাৎ একটি মানব দেহ আর একটি গাছের চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রে তুলে ধরা। আমাদের কাজ আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেই করতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা এ বিবেচনায় ভাল কাজ করছেন।
ও. আ. : আমাদের আর্ট ইনস্টিটিউটগুলো সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই। একজন শিল্পী তৈরির ক্ষেত্রে তারা কি যথার্থ কাজ করছে?
র. ন. : এখনকার ব্যাপারটা ভিন্ন। একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে এখন তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্ব বেশি। তরুণরা সেগুলোই বেশি গ্রহণ করছে এবং তারা ব্যাপক শিল্পকলার ভুবনে প্রবেশ করছে। এখন শুধু আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষার ওপর নির্ভর করার সময় নয়। নেট দুনিয়া সারা বিশ^কে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। সেসব গ্রহণ করতে হবে।
ও. আ. : আপনি দীর্ঘদিন শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেছেন। এ সম্পর্কিত আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
র. ন. : এই যে এত ছাত্র- এটা একটি বিরাট এচিভমেন্ট। ওরা যে আমাদের কাছ থেকে কিছু শিখল, বলল যে, স্যারের কাছ থেকে এটা শিখেছি। এটা শিক্ষক জীবনের বড় প্রাপ্তি। যেমন কাজী গিয়াস, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মনিরুল ইসলাম আমার ছাত্র। ওদের কথা ভাবতেই ভাল লাগে। শিক্ষক হিসেবে এটা আনন্দের ব্যাপার। আমি কোনো দিন চারুকলার শিক্ষক হতে চাইনি। নিজের এত জ্ঞান আছে বলে মনে করি না। আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি নাই। নিজের শিল্প চর্চায় মগ্ন থাকতে চেষ্টা করেছি।
ও. আ. : যেসব ছাত্রছাত্রী এখন শিল্পকলায় ভর্তি হচ্ছেন, আপনাদের সময়ের সঙ্গে তাদের একটা পার্থক্য নিশ্চয় চোখে পড়ে। এ নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কিনা।
র. ন. : পার্থক্য অনেক। আমারা ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছি। অনেকে হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে। সদ্য কিশোর-উত্তীর্ণ অল্পবয়সী শিক্ষার্থীরা চারুকলায় পড়তাম। শিক্ষকরা আমাদের হাতেনাতে শিখাতেন। এখন তো ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আসে। একটু পরিপক্ব হয়েই আসে। তারা অনেক ম্যাচিউরড হয়ে আসে। এক্ষেত্রে ওরা অনেক অগ্রসর। ওদের মতো আমাদের অগ্রসর হতে পাঁচ বছর সময় লাগত। স্বাভাবিকভাবেই ওদের সুবিধাটা একটু বেশি।
ও. আ. : বাংলাদেশের অধিকাংশ বিখ্যাত শিল্পী বিশে^র বিভিন্ন দেশে তাঁদের একক চিত্র প্রদর্শনী করে থাকেন। আমাদের শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যম- যেমন সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, নাটক প্রভৃতি ঐভাবে দেশের বাইরে সুযোগ পায় না। এর কারণ হিসেবে আপনি কী মনে করেন।
র. ন. : বিষয়টা এরকম নয়। আমাদের বাউল, নাটক, গান, নাচ বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণ পাচ্ছে। বাঙালি কমিউনিটির লোকেরাই বেশি ডাকছে, তবে বিদেশিদের সম্পৃক্ততা আছে। আমাদের চিত্রপ্রদর্শনী সাধারণত বিদেশি গ্যালারিতে করি। তবে এখন বাঙালিরাও অনেক গ্যালারির মালিক। ওদের গ্যালারিতেও প্রদর্শনী হয়।
ও. আ. : কবিতার সঙ্গে চিত্রকলার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সেটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
র. ন. : ব্যাপারটা তো এক। সবাই যেমন কবি হয় না, শিল্পীও সবাই হয় না। অনেকে বেঁচে থাকার জন্য শিল্প করেন। অনেকে শিল্পের প্রতি অনুরাগ-ভালবাসা থেকে শিল্পচর্চা করেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। যার গলা ভাল তিনি ভাল করেন। কবিতায় যেমন শব্দ চয়ন, উপমা, চিত্রকল্পের ব্যবহার করেন কবিরা, চেষ্টা করেন কে কত আধুনিক হতে পারে, ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন। ক্রিয়েটিভ কাজগুলো অধিকাংশ একই ধরনের হয়ে থাকে।
ও. আ. : আপনার শিল্পী জীবনে গুরুস্থানীয় কাদের অবদানকে স্বীকার করতে চান। তাঁরা কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?
র. ন. : গুরু তো অনেক রকমের। সরাসরি শিক্ষক যাঁরা তাঁরা এক ধরনের। আবার অনেকে আছেন অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু তাঁদেরকে আমি দেখিও নাই। অনেকে লালনকে দেখেনও নাই। কিন্তু লালনগীতি যারা গায়, তাদের মধ্যে লালনের ভাবটা এসে যায়। যে কারণে আমরা ভাবশিস্য হয়ে যাই। যেমন আমি পিকাসোকে কখনো দেখি নাই; কিন্তু আমি তাঁর ভাবশিস্য।
ও. আ. : আপনার জীবনে বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষীদের সম্পর্কে জানতে চাই। তাঁদের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমাদের যদি কিছু জানান-
র. ন. : বন্ধুত্ব বলতে কিছুটা অগ্রজ কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, মুর্তজা বশীর- এঁরা আমার ঘনিষ্ঠ। আবার জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ- এঁরা সব চাইতে বড় শিল্পী। শুধু যে তাঁদের মান্যিগণ্যি করি তাই না, তাঁদের ছত্রছায়ায় নিজেকে নির্মাণ করেছি।
ও. আ. : এবার তরুণদের সম্পর্কে কিছু বলুন-
র. ন. : তারা অনেক অনেক ইনোভেটিভ। তারা যন্ত্রকে অনেক আপন করে নিতে পারে। তারা অনেক এগিয়েছে। থ্রী ডি, এআই-এর মতো মাধ্যমে তারা কাজ করতে পারছে। সময় তাদের সে সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের নিয়ে আশাবাদী না হবার কোনো কারণ নাই। তারা আমাদের শিল্পের নতুন যাত্রাপথের সন্ধান দিবে বলে বিশ^াস করি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪
রফিকুন নবী
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
৮২তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি
বাংলাদেশের চিত্রকলার ইতিহাসে শিল্পী রফিকুন নবী তাঁর বহুমুখী কাজের কারণেই বিশিষ্ট ও স্বতন্ত্র
একজন। দীর্ঘ ছয় দশকের শিল্পচর্চায় তিনি সমৃদ্ধ করেছেন আমাদের চিত্রকলার ব্যাপক ভুবন। র’নবী নামে তাঁর টোকাই সিরিজের কাজগুলো দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করে। এছাড়া তাঁর জলরঙের ছবি ও অন্যান্য কাজে তিনি গণমানুষের আকাক্সক্ষা ও সুখ-দুঃখকে তুলে ধরেছেন। বর্ষীয়ান এই চিত্রশিল্পীর আজ ৮২তম জন্মদিন। এ উপলক্ষে তাঁর একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো আজকের ‘সংবাদ সাময়িকী’তে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন ওবায়েদ আকাশ
ওবায়েদ আকাশ: আপনি কেন চিত্রকলার প্রতি আগ্রহী হলেন? দীর্ঘ জীবন পাড়ি দিয়ে কি মনে হয় আপনার সে স্বপ্ন পূরণ হয়েছে?
রফিকুন নবী: আমি যে খুব আগ্রহী ছিলাম, সেটা বলা যাবে না। বাবা পুলিশের লোক ছিলেন, ছবি আঁকতেন, তাঁর ইচ্ছা ছিল তাঁর বড় ছেলেকে ছবি আঁকা শেখাবেন। সেখান থেকেই আগ্রহী হলাম। আমি স্কুলে থাকতে ছবি আঁকতাম। এটা ছাত্র-শিক্ষকরা জানতেন, স্কুলের সব ধরনের আর্ট ডিজাইনের কাজে আমাকে ডাকা হতো। সবাই জানতেন, আমি ছবি আঁকি। স্কুল থেকে একটা দেয়াল পত্রিকা প্রকাশিত হতো। সেটার অঙ্গ সজ্জা, ছবি আঁকার সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমাকে দেয়া হতো। আমিই আঁকতাম। ১৯৪৮ সালে আর্ট কলেজ হলো ঢাকায়। আমাকে ১৯৫৯ সালে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দেয়া হলো, শাহবাগে, বর্তমানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে। বাবার আগ্রহ, আমার আগ্রহ, শিক্ষকদের আগ্রহ- সব মিলে আমার শিল্প চর্চা শুরু।
আর আমার স্বপ্ন পূরণের চেয়ে বড় ব্যাপার হলো আমার বাবার স্বপ্ন। আমার বাবা আমাকে শিল্পী হিসেবে দেখার স্বপ্ন দেখতেন। আমি যখন শিল্পী হিসেবে বেশ নামধাম করেছি, বাবা তখন পরপারে চলে গেলেন। বলা যায় কিছুটা তো তাঁর স্বপ্ন পূরণ হয়েছেই। তবে, তাঁর তো আর স্বপ্নের শেষ ছিল না। ছেলেকে শিল্পী বানাতে গিয়ে বাবাকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে। যেহেতু শিল্পকলার মধ্যে কোনো সম্ভাবনা নাই, তাই তিনি আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে নানা কথা শুনতেন যে, আমাকে কেন চারুকলায় ভর্তি করানো হলো। বাবা আমাকে চিত্রশিল্পী বানানোকে একটা চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়েছিলেন।
ও. আ. : আপনার কি মনে হয় বাংলাদেশের চিত্রকলায় এমন কোনো শূন্যস্থান রয়েছে, যেখানে কাজ করা হয়নি?
র. ন. : আসলে কোনো দিকেই কাজ করা হয় নাই। যা করা উচিত ছিল, যা হওয়া উচিত ছিল, তা হয় নাই। শিল্পীদের তো ভাবনার শেষ নাই। চিত্রকলাটা এখনো কতিপয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। তৃণমূলের সবার কাছে পৌঁছে নাই। গণমানুষের কাছে পৌঁছে নাই।
ও. আ. : সারা বিশে^র চিত্রকলার সঙ্গে বাংলাদেশের শিল্পকলাকে আপনি কোথায় স্থান দিতে চান?
র. ন. : আমাদের চিত্রকলার অবস্থান উন্নত বিশে^র চিত্রকলার কাছে উল্লেখ করার মতো না। গ্লোবালি আমরা অনেক পিছিয়ে আছি। আমাদের সম্পর্কে বাইরের শিল্পীরা তেমন কিছুই জানেন না। তবে আমাদের সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। তরুণরা আমন্ত্রিত হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। তথ্য প্রযুক্তির কল্যাণে তারা সারা বিশে^র খোঁজখবর রাখতে পারছে। বিভিন্ন বড় বড় এক্সিবিশনে তারা অংশ নেয়ার সুযোগ পাচ্ছে। বড় শিল্পীদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র তৈরি হচ্ছে। এখনকার নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা ততটা পিছিয়ে নেই। মানের দিক দিয়েও প্রায় সমান সমান।
ও. আ. : রাষ্ট্রের বা সমাজের প্রতি শিল্পের যে দায় রয়েছে, সেটা আপনি বিশ^াস করেন? সেই দিক থেকে সেই দায়টি আপনি কীভাবে শোধ করতে চেয়েছেন?
র. ন. : অবশ্যই বিশ^াস করি। আমাদের দায় শোধের ব্যাপারগুলো মানুষ বুঝতে পারে না। শুধু ছবি আঁকাই তো বড় ব্যাপার না। সিরামিক, হ্যান্ডিক্রাফটসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ হচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ হচ্ছে। আমি হয়তো করি না, কিন্তু বাংলাদেশের প্রচুর শিল্পী এ কাজগুলো করে দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এর মাধ্যমে প্রচুর রেভিনিউ আসছে। এগুলো একরকম। আর একটা দিক আছে। আমরা দেশ-কাল সম্পর্কে ভাবি। যখন ঝড় জলোচ্ছ্বাস বন্যা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসে, তখন কিন্তু শিল্পীরাই সবার আগে এগিয়ে আসেন মানুষের পাশে। শিল্পীরা মানুষের পাশে থেকে কাজ করছেন। কিন্তু সেটা তাঁরা প্রচারে বিশ^াসী নন। তাই এগুলো মানুষের কাছে পৌঁছায় না। এগুলো আসে দায়বদ্ধতা থেকে। এগুলো শিক্ষা থেকে হয়। ১৯৪৭-এর আগে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন সেই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকে প্রকাশ করেছিলেন। এটা তো তাঁর দায়বদ্ধতারই একটা দিক। শিল্পীরা এসব প্রচারে বিশ^াসী নন। গ্রামে যে হস্তশিল্প, সেগুলো তো আর্টের মধ্যেই পড়ে। এগুলোকে বাঁচিয়ে রাখা আমাদের কাজ। এই পহেলা বৈশাখের ঐতিহ্য, নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা- এগুলো শিল্পীরা বাঁচিয়ে রাখেন। মানুষের গায়ের জামার নকশাও যে পরিবর্তন করা উচিত সেটাও শিল্পীরা ভাবেন। আবার খাদ্য সংস্কৃতির কথা যদি বলি, আমরা ভাত খাই, ডাল খাই, মাছ খাই, পোলাও বিরিয়ানি খাই। কত কিছু খাই। তবে শেষ পর্যন্ত কিন্তু আমরা ডাল-ভাতই খাই। এগুলোও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি।
ও. আ. : আপনার বিখ্যাত টোকাই কার্টুনটি দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে। এই কার্টুনটি করতে গিয়ে আপন কি সে সময়ের রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত নাকি ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ চিন্তা থেকে কাজটি করেছিলেন?
র. ন. : সময়ের প্রয়োজন এবং সামাজিক অবস্থানের প্রয়োজনে টোকাই এঁকেছি। আমি ‘আর্ট ফর আর্ট সেক’ কথাটায় বিশ^াসী নই। আমি ছবি আঁকলাম মানুষ বুঝল না, ধরতে পারল না, এটা আমার পছন্দ নয়।
ও. আ. : টোকাইয়ের বাইরে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। কিন্তু আমরা আপনার কথা বলতে গেলেই প্রথমে টোকাইয়ের কথাটা মাথায় রাখি। এতে কি আপনার মনে হয় আপনাকে আমরা ঠিক বুঝতে পারিনি?
র. ন. : ব্যাপারটা এখন সবাই জানে যে, আমি অনেক ক্ষেত্রে কাজ করেছি। শুধু টোকাই নয়। এখন সাবাই জানছে, আমার বিপুল কাজের এলাকা সম্পর্কে। টোকাইয়ের সঙ্গে আরো কাজ আছে। সেটা ছাপা হয় র’নবী স্বাক্ষরে। ছাপা হলে অনেক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। বিপুল মানুষ সেটা সম্পর্কে জানতে পারেন। এভাবে টোকাই ছড়িয়ে পড়েছে সর্বত্র। টোকাই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আঁকা কার্টুন। যে কারণে এটার কথা বেশি বেশি জানে সকলে।
ও. আ. : টোকাইয়ের বাইরে আপনার অন্য কাজগুলো সম্পর্কে মানুষের ধারণা কেমন বলে আপনি মনে করেন?
র. ন. : যারা প্রদর্শনী দেখেন না, তারা জানেন না। কিন্তু যারা দেখেন তারা জানেন আমাদের কাজ সম্পর্কে। যারা শিল্প ভালবাসেন, পত্রপত্রিকায় নিউজ ফিচার লেখেন, তারা মনোযোগ দিয়ে প্রদর্শনী দেখেন এবং সকলে জানেন আমার নানামুখী কাজের কথা। আমার ভাগ্য ভাল, সবাই টোকাই সম্পর্কে জানেন, র’নবীর কথা জানেন। সবাই জানেন র’নবী একজন শিল্পী তিনি টোকাই কার্টুন সিরিজ এঁকেছেন। আবার অন্য ছবি দেখে তারা বুঝে যান, এই র’নবীই রফিকুন নবী। তাঁরা তখন বুঝতে পারেন, এঁরা দুজনই একই ব্যক্তি। এই শিল্পীর কাজের ব্যাপ্তি অনেক। র’নবী বা রফিকুন নবী শুধু কার্টুন আঁকেন না; তিনি বিপুল ক্যানভাসে কাজ করেন।
আমি তিনটি ফেজে কাজ করি। এগুলো হচ্ছে প্রথমত আমার কার্টুন, দ্বিতীয়ত প্রচ্ছদ, অলঙ্করণ-ইলাস্ট্রেশন এবং তৃতীয়ত আমার ছবি। ওয়াটার কালার, বা বিভিন্ন মাধ্যমে আমার বড় বড় ছবি। আমার কার্টুন নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে কী হচ্ছে তাতে কিছু যায় আসে না। আঁকাআঁকি করে দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করতে পারাটাই বড় ব্যাপার। যেমন জয়নুলের ছবি। তিনি তাঁর নিজের দেশের মানুষের হৃদয় স্পর্শ করেছেন। আমার ক্ষেত্রে এ কথা বলার সময় এখনো আমার আসেনি। তবে, শিল্পীরা কখনো বলতে পারেন না, এটা আমার সবচেয়ে সেরা কাজ। কারণ শিল্পী সব সময় অতৃপ্ত থাকেন। এই অতৃপ্তিই তাঁকে দিয়ে নতুন একটি কাজ করিয়ে নেয়। যেমন: পিকাসো মারা যারা যাবার আগে বলে গেলেন, “যা করতে চাইলাম তা হলো না”। সঙ্গীতের ব্যাপারেও কিন্তু তাই। সঙ্গীতশিল্পীদের অতৃপ্তির কারণে আমরা নতুন নুতন সঙ্গীত পাই।
ও. আ. : আপনি পঞ্চাশের দশকে ঢাকায় এসে পুরান ঢাকায় বসবাস ও পড়াশোনা শুরু করেছেন। তার আগে আপনি চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছিলেন। শৈশব কেটেছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। গ্রাম এবং শহরের মধ্যে একটা বৈপরীত্য থাকেই। শিল্প চর্চার জন্য গ্রাম এবং শহর কোনটাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন?
র. ন. : আমার কার্টুন কিন্তু শহর কেন্দ্রিক। কিন্তু ছবি গ্রাম সম্পর্কিত। গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, জীবনাচার, গ্রামের মানুষ, তাদের সমস্যা প্রভৃতি আমার ছবির কেন্দ্রে থাকে। সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে গ্রাম এবং শহর দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
ও. আ. : যতদূর জানি আপনি বিদেশে তিনটি ও দেশে ১৫টির মতো একক চিত্রপ্রদর্শনী করেছেন। আর গ্রুপ এক্সিবিশন করেছেন অসংখ্য। আপনার অভিজ্ঞতা থেকে কি বলবেন, দর্শক আপনার কোন ধরনের কাজের প্রতি বেশি আগ্রহী?
র. ন. : দর্শকের আগ্রহ তো বুঝি না। সেটা নিয়ে আমি ভাবিও না। যেটা আমার হাতে আসে, যেটা আমার জানা আছে, সেটা নিয়েই কাজ করি। ট্যোটাল রিয়ালিস্টিকের মধ্যে যাই না। আবার সম্পূর্ণ এবস্ট্রাক্টও না আমার কাজ। এই দুটোর মাঝামাঝি থাকি। এটাই আমার স্টাইল। আধা বিমূর্ত আধা মূর্ত- আমার স্টাইল।
ও. আ. : আপনি গ্রিস সরকারের বৃত্তি নিয়ে গিয়েছিলেন পড়াশোনা করতে। এই প্রাচীন সভ্যতার দেশে, আদি শিল্পের ভূমিতে আপনার অবস্থানকালে শিল্প সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা সংক্ষেপে যদি আমাদের শোনাতেন-
র. ন. : প্রাচীন গ্রিস আর আজকের গ্রিস এক কথা নয়। প্রাচীনের সাথে মডার্ন গ্রিসের কোনো মিল নাই। ওরা অনেক দূরে চলে এসেছে। ইওরোপের গরিব দেশগুলোর একটা গ্রিস। ওদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভাল ছিল না। আমি যখন যাই সরকার বিরোধী আন্দোলন চলছিল। পোস্টগ্রাজুয়েট করতে গিয়েছিলাম। আমার ছিল নিরীক্ষাধর্মী কাজ। নিরীক্ষার বিষয় ছিল কাঠ খোদাই। আমি সারাক্ষণ মগ্ন থাকতাম, কী করে নতুন কিছু উদ্ভাবন করা যায়।
ও. আ. : কাজটি করতে গিয়ে আপনি কি ওদের কাজ দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন?
র. ন. : ঠিক তা নয়, তবে টেকনিকের ব্যাপারটা ছিল। যা আমি ফলো করি নাই। শিল্পীদের মধ্যে ইনডিভিজ্যুয়ালিটি তো থাকেই। যে কারণে আমি ওদের থেকে কিছু গ্রহণ করিনি। তবে কিছু শিক্ষা নিয়েছি।
ও. আ. : আমার তো মনে হয় এথেন্সের শিল্পকলার সঙ্গে আমাদের শিল্পকলার পার্থক্য ব্যাপক। তারা তো সাধারণত নগ্ন মানব-মানবীর অবয়ব নিয়ে প্রচুর কাজ করেন, যাকে ন্যুড স্টাডি বলে। এবং তাতে যে আবহ তৈরি হয়, তা বিশে^র বেশিরভাগ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আমাদের শিল্পকলার ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যায় না কেন? কিংবা আপনি যদি গ্রিসের শিল্পচর্চা নিয়ে নতুন কিছু বলতে চান।
র. ন. : ওয়েস্টে ন্যুড স্টাঢি করে। মডেলও পায়। ওদের ক্লাসেই মডেল থাকে। আবার ব্যক্তিগত স্টুডিওতেও থাকে। এটা আমাদের সমাজে নাই। শিল্পী হতে গেলে যে ন্যুড স্টাডি মাস্ট; এটা আমি মনে করি না। ওয়েস্টে ন্যুড স্টাডি মাস্ট। সাবজেক্টই থাকে বাধ্যতামূলক। কিন্তু আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি ভিন্ন। আমাদের ন্যুড স্টাডি করার বাধ্যবাধকতা নাই। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন বলতেন, একটা ন্যুড আঁকা আর একটা গাছ আঁকা একই কথা। অর্থাৎ একটি মানব দেহ আর একটি গাছের চিত্র পুঙ্খানুপুঙ্খ চিত্রে তুলে ধরা। আমাদের কাজ আমাদের পরিবেশ পরিস্থিতি বিবেচনা করেই করতে হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরা এ বিবেচনায় ভাল কাজ করছেন।
ও. আ. : আমাদের আর্ট ইনস্টিটিউটগুলো সম্পর্কে আপনার বক্তব্য শুনতে চাই। একজন শিল্পী তৈরির ক্ষেত্রে তারা কি যথার্থ কাজ করছে?
র. ন. : এখনকার ব্যাপারটা ভিন্ন। একাডেমিক শিক্ষার চেয়ে এখন তথ্য প্রযুক্তির গুরুত্ব বেশি। তরুণরা সেগুলোই বেশি গ্রহণ করছে এবং তারা ব্যাপক শিল্পকলার ভুবনে প্রবেশ করছে। এখন শুধু আর্ট ইনস্টিটিউটের শিক্ষার ওপর নির্ভর করার সময় নয়। নেট দুনিয়া সারা বিশ^কে হাতের মুঠোয় নিয়ে এসেছে। সেসব গ্রহণ করতে হবে।
ও. আ. : আপনি দীর্ঘদিন শিল্পকলার শিক্ষক হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক কাজ করেছেন। এ সম্পর্কিত আপনার অভিজ্ঞতা জানতে চাই।
র. ন. : এই যে এত ছাত্র- এটা একটি বিরাট এচিভমেন্ট। ওরা যে আমাদের কাছ থেকে কিছু শিখল, বলল যে, স্যারের কাছ থেকে এটা শিখেছি। এটা শিক্ষক জীবনের বড় প্রাপ্তি। যেমন কাজী গিয়াস, শাহাবুদ্দিন আহমেদ, মনিরুল ইসলাম আমার ছাত্র। ওদের কথা ভাবতেই ভাল লাগে। শিক্ষক হিসেবে এটা আনন্দের ব্যাপার। আমি কোনো দিন চারুকলার শিক্ষক হতে চাইনি। নিজের এত জ্ঞান আছে বলে মনে করি না। আমি নিজেকে যোগ্য মনে করি নাই। নিজের শিল্প চর্চায় মগ্ন থাকতে চেষ্টা করেছি।
ও. আ. : যেসব ছাত্রছাত্রী এখন শিল্পকলায় ভর্তি হচ্ছেন, আপনাদের সময়ের সঙ্গে তাদের একটা পার্থক্য নিশ্চয় চোখে পড়ে। এ নিয়ে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কিনা।
র. ন. : পার্থক্য অনেক। আমারা ম্যাট্রিক পাস করে ভর্তি হয়েছি। অনেকে হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায় আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছে। সদ্য কিশোর-উত্তীর্ণ অল্পবয়সী শিক্ষার্থীরা চারুকলায় পড়তাম। শিক্ষকরা আমাদের হাতেনাতে শিখাতেন। এখন তো ইন্টারমিডিয়েট পাস করে আসে। একটু পরিপক্ব হয়েই আসে। তারা অনেক ম্যাচিউরড হয়ে আসে। এক্ষেত্রে ওরা অনেক অগ্রসর। ওদের মতো আমাদের অগ্রসর হতে পাঁচ বছর সময় লাগত। স্বাভাবিকভাবেই ওদের সুবিধাটা একটু বেশি।
ও. আ. : বাংলাদেশের অধিকাংশ বিখ্যাত শিল্পী বিশে^র বিভিন্ন দেশে তাঁদের একক চিত্র প্রদর্শনী করে থাকেন। আমাদের শিল্পের অন্য কোনো মাধ্যম- যেমন সাহিত্য, সঙ্গীত, নৃত্যকলা, নাটক প্রভৃতি ঐভাবে দেশের বাইরে সুযোগ পায় না। এর কারণ হিসেবে আপনি কী মনে করেন।
র. ন. : বিষয়টা এরকম নয়। আমাদের বাউল, নাটক, গান, নাচ বিভিন্ন দেশে পারফর্ম করার জন্য আমন্ত্রণ পাচ্ছে। বাঙালি কমিউনিটির লোকেরাই বেশি ডাকছে, তবে বিদেশিদের সম্পৃক্ততা আছে। আমাদের চিত্রপ্রদর্শনী সাধারণত বিদেশি গ্যালারিতে করি। তবে এখন বাঙালিরাও অনেক গ্যালারির মালিক। ওদের গ্যালারিতেও প্রদর্শনী হয়।
ও. আ. : কবিতার সঙ্গে চিত্রকলার একটা আত্মীয়তার সম্পর্ক আছে। সেটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
র. ন. : ব্যাপারটা তো এক। সবাই যেমন কবি হয় না, শিল্পীও সবাই হয় না। অনেকে বেঁচে থাকার জন্য শিল্প করেন। অনেকে শিল্পের প্রতি অনুরাগ-ভালবাসা থেকে শিল্পচর্চা করেন। সঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তাই। যার গলা ভাল তিনি ভাল করেন। কবিতায় যেমন শব্দ চয়ন, উপমা, চিত্রকল্পের ব্যবহার করেন কবিরা, চেষ্টা করেন কে কত আধুনিক হতে পারে, ছবি আঁকার ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তেমন। ক্রিয়েটিভ কাজগুলো অধিকাংশ একই ধরনের হয়ে থাকে।
ও. আ. : আপনার শিল্পী জীবনে গুরুস্থানীয় কাদের অবদানকে স্বীকার করতে চান। তাঁরা কীভাবে আপনাকে প্রভাবিত করেছেন?
র. ন. : গুরু তো অনেক রকমের। সরাসরি শিক্ষক যাঁরা তাঁরা এক ধরনের। আবার অনেকে আছেন অনুপ্রাণিত করেন। কিন্তু তাঁদেরকে আমি দেখিও নাই। অনেকে লালনকে দেখেনও নাই। কিন্তু লালনগীতি যারা গায়, তাদের মধ্যে লালনের ভাবটা এসে যায়। যে কারণে আমরা ভাবশিস্য হয়ে যাই। যেমন আমি পিকাসোকে কখনো দেখি নাই; কিন্তু আমি তাঁর ভাবশিস্য।
ও. আ. : আপনার জীবনে বন্ধু, শুভাকাক্সক্ষীদের সম্পর্কে জানতে চাই। তাঁদের সঙ্গে আপনার ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমাদের যদি কিছু জানান-
র. ন. : বন্ধুত্ব বলতে কিছুটা অগ্রজ কাইয়ুম চৌধুরী, কাজী আবদুল বাসেত, মুর্তজা বশীর- এঁরা আমার ঘনিষ্ঠ। আবার জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান, সফিউদ্দিন আহমেদ- এঁরা সব চাইতে বড় শিল্পী। শুধু যে তাঁদের মান্যিগণ্যি করি তাই না, তাঁদের ছত্রছায়ায় নিজেকে নির্মাণ করেছি।
ও. আ. : এবার তরুণদের সম্পর্কে কিছু বলুন-
র. ন. : তারা অনেক অনেক ইনোভেটিভ। তারা যন্ত্রকে অনেক আপন করে নিতে পারে। তারা অনেক এগিয়েছে। থ্রী ডি, এআই-এর মতো মাধ্যমে তারা কাজ করতে পারছে। সময় তাদের সে সুযোগ করে দিয়েছে। তাদের নিয়ে আশাবাদী না হবার কোনো কারণ নাই। তারা আমাদের শিল্পের নতুন যাত্রাপথের সন্ধান দিবে বলে বিশ^াস করি।
সাক্ষাৎকার গ্রহণ: ২৫ নভেম্বর ২০২৪