পিয়াস মজিদ
একটি কার্টুন চরিত্র কতটা মানবীয় আবেদন সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়- শীত ঋতুতে পাঠক চিঠি দিয়ে টোকাইয়ের গায়ে গরম কাপড় পরানোর জন্য র’নবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
১৯৭৮-এর মে মাসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার পাতায় রফিকুন নবী বা র’নবীর টোকাইয়ের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। মধ্য নব্বইয়ে বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েক মাসের জন্য টোকাইয়ের দেখা পাইনি আমরা। তারপর আবার সাপ্তাহিক ২০০০-এ প্রকাশ শুরু তার। কয়েক বছর পর আবার অনিয়মিত হয়ে পড়ে বাংলা কার্টুনের এ জনপ্রিয় চরিত্র। এরপর থেকে চকিত দেখা মেলে টোকাইয়ের; বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। টোকাই চরিত্রটি কেবল বাংলাদেশের ছিন্নভাগ্য শিশু-কিশোরদের প্রতীক হয়ে ওঠেনি; একই সঙ্গে তা প্রতারক সমাজ-সভ্যতার মুখে এক কৌতুকি চপেটাঘাতও বটে।
এ দেশের শহর গ্রামগঞ্জ তো বটেই বাংলাদেশের বাইরে বিদেশেও শিশুশ্রম নিরোধসহ নানা প্রসঙ্গে টোকাই আসে উদাহরণ হিসেবে। শিল্পানুরাগী মানুষের কাছে টোকাই এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, এই কার্টুন চরিত্রের রজতজয়ন্তী উদযাপনও করেছেন তারা। কার্টুনবিশ্বে এ এক ঘটনা বটে! রফিকুন নবী এই ঐতিহাসিক ব্যঙ্গচরিত্র অবলম্বনে বচ্, হোগার্থ, দসিঁয়ে, গইয়া, হকুসাই প্রমুখ শিল্পীর মতো চিত্রকর্মেও হাত দিয়েছেন। ফলত আমরা পেয়েছি টোকাই সিরিজের বেশ কিছু জলরঙ-চিত্র। শৈল্পিক পরোক্ষতায় টোকইয়ের ধার মোটেও কমেনি বরং এখানে টোকাই আরও নীরব দার্ঢ্যে প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত The Comics Journal পত্রিকার On Tokaii শীর্ষক মূল্যায়নমূলক রচনায় সাংবাদিক জন এ লেন্ট বলেন- I knwe a small boy called Mokka, who was sick because of liver problems. Mokka always sat in front of my door, his stomach big, holding his longyi. He always asked. ‘What time is it?’ After I had known him six to eight months, he vanished. I got the protrait of ‘Tokaii’ from that boy,
Ranabi kept the drawing simple- ‘a illustrative, a bit realistic for our general readers who do not have aesthetic richness.’ He said that if he had used modern drawing, the readers would not have identified with Tokii.
...
A downtrodden street boy with no family. no food, nothing. He is an ideal character protraying maû children of Bangladesh.’
এ লেখা থেকে জানা যায় পাঠক টোকাইয়ের সঙ্গে শুরু থেকে এতোটা একাত্ম যে, তারা প্রচুর পত্র দেয় টোকাইয়ের ¯্রষ্টাকে, মতামত দেয় এমনকি তারা নিজেদের পছন্দানুযায়ী বিষয়ও দেয় টোকাইয়ের জন্য। পাঠকদের দেয়া এইসব বিষয় হয়তো কার্টুনের জন্য যথাযথ থাকে না সবসময়, কিন্তু পাঠকের একাত্মতার বিষয়টি টোকাইয়ের সর্বত্রগামিতারই সাক্ষ্যবহ।
টোকাইয়ের হুল ফোটানো বক্তব্যে তারা যেন তাদের সংগুপ্ত কথামালা বাক্সময় দেখে। পাঠকই বলেন- টোকাইকে শুধু রাজধানী ঢাকায় আবদ্ধ রাখলে চলবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। একটি কার্টুন চরিত্র কতটা মানবীয় আবেদন সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়- শীত ঋতুতে পাঠক চিঠি দিয়ে টোকাইয়ের গায়ে গরম কাপড় পরানোর জন্য র’নবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এভাবে টোকাই হয়ে ওঠেন অভূতপূর্ব সমাজসত্যের প্রতীক। টোকাইয়ের মাধ্যমে পাঠককে অনেক অজানা বিষয়ে জানানো গেছে সহজভাবে আর ক্রমে বাংলাদেশের অনেক মানুষ টোকাইয়ের হাত দিয়ে হয়ে উঠেছেন কার্টুন-সাক্ষর।
টোকাই দেখে দুই সাহেব গোছের লোক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে ‘মাঝে মধ্যে মনে হয়... জন্মেই ভুল করেছি’। অতঃপর সগোত্রীয় একজনের সঙ্গে টোকাই শেয়ার করে তার ভাবনা ‘বুঝলি না...? উনা গো লাইনে উনাগো দুঃখ’। দুঃখের খবরের সমান্তরালে যেন চাপা হাসি সঞ্চার করে যায় টোকাই।
খবর আসে ‘আজকাল টিচাররাও তাদের পরীক্ষায় নকল করা শুরু করেছেন।’
টোকাইয়ের নির্বিকার মন্তব্য ‘ছাত্রগো কাছে দিনে দিনে শিখতাছে’।
সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের চিত্র স্পষ্ট হয় এই ইংরেজি টোকাইভাষ্যে-
What’s the difference between rich and the poor?!
প্রশ্নের উত্তরে টোকাইয়ের জবাব- Peacock and crow!!
টোকাই এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তথাকথিত মানবীয় সমাজের ধনী-গরিবের অবস্থান।
টোকাই সমাজসৃষ্ট তাই সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েও রাজনীতি সম্পর্কে ত্যক্ত তখনকার ভাবনা তো এমনই হবে-
Not getting aûthing to pass time.
-Ok!!! Then Involve in Politics.
মূল্যবৃদ্ধির সময়ে এক ব্যক্তির হাহুতাশ- ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তো... তাই চিন্তায় আছি। তোর চিন্তা-ভাবনা কি?’
টোকাইয়ের চিন্তা এমনই দার্শনিক- ‘নিজেরই দাম নেই। ভাবুম... কেমনে...’
নিজেকে এলেবেলে একজন হিসেবে জাহির করে টোকাই এভাবে দেখিয়ে দেয় সময় ও সমাজের যৌথ ফাঁপা চেহারা।
‘তোর কি কিছুই থাকতে নেই। মান... রাগ... অভিমান!!’
এমন সুবোধ প্রশ্নের কেমন শাণিত জবাব টোকাইয়ের-
‘থাকলেই বা দেখামু কাগো!!’
ডাস্টবিনের পাশে বসে কুকুরের কথা শুনে টোকাই বলে ‘মানুষরে আমার খুব ডর’
কুকুর সায় দিয়ে বলে- ‘আমারও।’
মন্তব্য নি®প্রয়োজন।
টোকাই বুদ্ধিবৃত্তির ধার ধারে না; কারণ সময়টা যে ভীষণ কমিক্যাল। বাস্তব আর কার্টুনের মাঝে টোকাইয়ের বাস করা সমাজে কোনো ফারাক নেই। তাই টোকাই এতটা স্বাভাবিক ঠেকে পাঠকের কাছে। বিচিত্রা ও ২০০০ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী জানাচ্ছেন, টোকাই একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রার ‘ম্যান অব দি ইয়ার’ নির্বাচিত হয়। সরকারি ভাষ্যে, নথিতে, এমনকি নতুন শব্দ হিসেবে বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেও স্থান করে নিয়েছে টোকাই। এই অভিধানে টোকাই-এর অর্থ করা হয়েছে-
স্থায়ী ঠিকানা ও পরিচিতিহীন পথে বেড়ানো অনাথ নিঃস্ব ছেলে-ছোকড়া যারা পথের ধারে ফেলা জঞ্জাল থেকে পরিত্যক্ত শিশি-বোতল কিংবা কাগজের টুকরা সংগ্রহ করে, এমনকি খাদ্য কুড়িয়ে খায়; টোকায় বা টোকানোর কাজ করে যে।
টোকাইয়ের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসও। শাহাদত চৌধুরী আরো জানাচ্ছেন- একাত্তরের পিতা-মাতাহীন একটি বেঁচে থাকা শিশুই টোকাই, শহীদ পিতা-মাতার শেষ চিহ্ন। ত্রিশ লাখ শহীদের যে কোনো এক দম্পতি হতে পারে টোকাইয়ের পিতা-মাতা। একাত্তরের রিক্ত বাংলাদেশের প্রতীক টোকাই। যে ছবিটি দেখা যায় মৃত মায়ের পাশে বসে কাঁদছে একটি শিশু। হতে পারে সেটাই টোকাই। একাত্তরের বেদনা টোকাই। একাত্তরের প্রতিরোধের প্রতীক টোকাই। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের নাম টোকাই।
টোকাইয়ের ¯্রষ্টা র’নবী জীবনে বেড়ে ওঠার একটা সময় কাটিয়েছেন পুরান ঢাকায়। তাই টোকাইয়ের বোলচালে ঢাকাইয়া রঙ্গরসিকতার প্রভাবও দুর্লক্ষ্য নয়। টোকাই প্রতিষ্ঠিত ভাষাকাঠামোর সমান্তরালে বহমান লোকবয়ানকে কণ্ঠে ধারণ করে শত দুঃখের মাঝেও প্রাণ খুলে হাসতে জানে। চিত্রসমালোচক সৈয়দ আজিজুল হক সঙ্গতই টোকাইকে দেখেন ‘উইট হিউমার ও উইজডমের সমাহার’ হিসেবে।
এভাবে ছিন্নমূল টোকাই হয়ে ওঠে সমকালীন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির সুনিপুণ ভাষ্যকার। পার্কের বেঞ্চিতে, ডাস্টবিনের ময়লার স্তূপে, ব্যারিকেডের ধারে কিংবা রাজপথে লাইটপোস্টের নিচে টোকাইকে দেখা যায়। বস্তা কাঁধে করে টোকাই যেন সমাজের নেতি-নিয়তির মতো অনড় দাঁড়িয়ে থাকে যার বয়সের কোনো বৃদ্ধি-লয় নেই। ক্লান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে টোকাই ঘুমায়; সমাজ যেমনভাবে অসঙ্গতি-অন্যায়-দুরাচার দেখে কমিক্যালি ঘুমিয়ে থাকে।
পিয়াস মজিদ
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
একটি কার্টুন চরিত্র কতটা মানবীয় আবেদন সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়- শীত ঋতুতে পাঠক চিঠি দিয়ে টোকাইয়ের গায়ে গরম কাপড় পরানোর জন্য র’নবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন।
১৯৭৮-এর মে মাসে সাপ্তাহিক বিচিত্রার পাতায় রফিকুন নবী বা র’নবীর টোকাইয়ের আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ। মধ্য নব্বইয়ে বিচিত্রা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কয়েক মাসের জন্য টোকাইয়ের দেখা পাইনি আমরা। তারপর আবার সাপ্তাহিক ২০০০-এ প্রকাশ শুরু তার। কয়েক বছর পর আবার অনিয়মিত হয়ে পড়ে বাংলা কার্টুনের এ জনপ্রিয় চরিত্র। এরপর থেকে চকিত দেখা মেলে টোকাইয়ের; বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। টোকাই চরিত্রটি কেবল বাংলাদেশের ছিন্নভাগ্য শিশু-কিশোরদের প্রতীক হয়ে ওঠেনি; একই সঙ্গে তা প্রতারক সমাজ-সভ্যতার মুখে এক কৌতুকি চপেটাঘাতও বটে।
এ দেশের শহর গ্রামগঞ্জ তো বটেই বাংলাদেশের বাইরে বিদেশেও শিশুশ্রম নিরোধসহ নানা প্রসঙ্গে টোকাই আসে উদাহরণ হিসেবে। শিল্পানুরাগী মানুষের কাছে টোকাই এতটাই জনপ্রিয় হয়েছে যে, এই কার্টুন চরিত্রের রজতজয়ন্তী উদযাপনও করেছেন তারা। কার্টুনবিশ্বে এ এক ঘটনা বটে! রফিকুন নবী এই ঐতিহাসিক ব্যঙ্গচরিত্র অবলম্বনে বচ্, হোগার্থ, দসিঁয়ে, গইয়া, হকুসাই প্রমুখ শিল্পীর মতো চিত্রকর্মেও হাত দিয়েছেন। ফলত আমরা পেয়েছি টোকাই সিরিজের বেশ কিছু জলরঙ-চিত্র। শৈল্পিক পরোক্ষতায় টোকইয়ের ধার মোটেও কমেনি বরং এখানে টোকাই আরও নীরব দার্ঢ্যে প্রতিভাসিত হয়ে ওঠে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত The Comics Journal পত্রিকার On Tokaii শীর্ষক মূল্যায়নমূলক রচনায় সাংবাদিক জন এ লেন্ট বলেন- I knwe a small boy called Mokka, who was sick because of liver problems. Mokka always sat in front of my door, his stomach big, holding his longyi. He always asked. ‘What time is it?’ After I had known him six to eight months, he vanished. I got the protrait of ‘Tokaii’ from that boy,
Ranabi kept the drawing simple- ‘a illustrative, a bit realistic for our general readers who do not have aesthetic richness.’ He said that if he had used modern drawing, the readers would not have identified with Tokii.
...
A downtrodden street boy with no family. no food, nothing. He is an ideal character protraying maû children of Bangladesh.’
এ লেখা থেকে জানা যায় পাঠক টোকাইয়ের সঙ্গে শুরু থেকে এতোটা একাত্ম যে, তারা প্রচুর পত্র দেয় টোকাইয়ের ¯্রষ্টাকে, মতামত দেয় এমনকি তারা নিজেদের পছন্দানুযায়ী বিষয়ও দেয় টোকাইয়ের জন্য। পাঠকদের দেয়া এইসব বিষয় হয়তো কার্টুনের জন্য যথাযথ থাকে না সবসময়, কিন্তু পাঠকের একাত্মতার বিষয়টি টোকাইয়ের সর্বত্রগামিতারই সাক্ষ্যবহ।
টোকাইয়ের হুল ফোটানো বক্তব্যে তারা যেন তাদের সংগুপ্ত কথামালা বাক্সময় দেখে। পাঠকই বলেন- টোকাইকে শুধু রাজধানী ঢাকায় আবদ্ধ রাখলে চলবে না, তাকে ছড়িয়ে দিতে হবে সবখানে। একটি কার্টুন চরিত্র কতটা মানবীয় আবেদন সৃষ্টি করেছে তার প্রমাণ হিসেবে বলা যায়- শীত ঋতুতে পাঠক চিঠি দিয়ে টোকাইয়ের গায়ে গরম কাপড় পরানোর জন্য র’নবীকে অনুরোধ জানিয়েছেন। এভাবে টোকাই হয়ে ওঠেন অভূতপূর্ব সমাজসত্যের প্রতীক। টোকাইয়ের মাধ্যমে পাঠককে অনেক অজানা বিষয়ে জানানো গেছে সহজভাবে আর ক্রমে বাংলাদেশের অনেক মানুষ টোকাইয়ের হাত দিয়ে হয়ে উঠেছেন কার্টুন-সাক্ষর।
টোকাই দেখে দুই সাহেব গোছের লোক নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে ‘মাঝে মধ্যে মনে হয়... জন্মেই ভুল করেছি’। অতঃপর সগোত্রীয় একজনের সঙ্গে টোকাই শেয়ার করে তার ভাবনা ‘বুঝলি না...? উনা গো লাইনে উনাগো দুঃখ’। দুঃখের খবরের সমান্তরালে যেন চাপা হাসি সঞ্চার করে যায় টোকাই।
খবর আসে ‘আজকাল টিচাররাও তাদের পরীক্ষায় নকল করা শুরু করেছেন।’
টোকাইয়ের নির্বিকার মন্তব্য ‘ছাত্রগো কাছে দিনে দিনে শিখতাছে’।
সামাজিক শ্রেণিবৈষম্যের চিত্র স্পষ্ট হয় এই ইংরেজি টোকাইভাষ্যে-
What’s the difference between rich and the poor?!
প্রশ্নের উত্তরে টোকাইয়ের জবাব- Peacock and crow!!
টোকাই এভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় তথাকথিত মানবীয় সমাজের ধনী-গরিবের অবস্থান।
টোকাই সমাজসৃষ্ট তাই সমাজের অধিকাংশ মানুষ যখন রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়েও রাজনীতি সম্পর্কে ত্যক্ত তখনকার ভাবনা তো এমনই হবে-
Not getting aûthing to pass time.
-Ok!!! Then Involve in Politics.
মূল্যবৃদ্ধির সময়ে এক ব্যক্তির হাহুতাশ- ‘জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে তো... তাই চিন্তায় আছি। তোর চিন্তা-ভাবনা কি?’
টোকাইয়ের চিন্তা এমনই দার্শনিক- ‘নিজেরই দাম নেই। ভাবুম... কেমনে...’
নিজেকে এলেবেলে একজন হিসেবে জাহির করে টোকাই এভাবে দেখিয়ে দেয় সময় ও সমাজের যৌথ ফাঁপা চেহারা।
‘তোর কি কিছুই থাকতে নেই। মান... রাগ... অভিমান!!’
এমন সুবোধ প্রশ্নের কেমন শাণিত জবাব টোকাইয়ের-
‘থাকলেই বা দেখামু কাগো!!’
ডাস্টবিনের পাশে বসে কুকুরের কথা শুনে টোকাই বলে ‘মানুষরে আমার খুব ডর’
কুকুর সায় দিয়ে বলে- ‘আমারও।’
মন্তব্য নি®প্রয়োজন।
টোকাই বুদ্ধিবৃত্তির ধার ধারে না; কারণ সময়টা যে ভীষণ কমিক্যাল। বাস্তব আর কার্টুনের মাঝে টোকাইয়ের বাস করা সমাজে কোনো ফারাক নেই। তাই টোকাই এতটা স্বাভাবিক ঠেকে পাঠকের কাছে। বিচিত্রা ও ২০০০ পত্রিকার প্রয়াত সম্পাদক শাহাদত চৌধুরী জানাচ্ছেন, টোকাই একবার সাপ্তাহিক বিচিত্রার ‘ম্যান অব দি ইয়ার’ নির্বাচিত হয়। সরকারি ভাষ্যে, নথিতে, এমনকি নতুন শব্দ হিসেবে বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানেও স্থান করে নিয়েছে টোকাই। এই অভিধানে টোকাই-এর অর্থ করা হয়েছে-
স্থায়ী ঠিকানা ও পরিচিতিহীন পথে বেড়ানো অনাথ নিঃস্ব ছেলে-ছোকড়া যারা পথের ধারে ফেলা জঞ্জাল থেকে পরিত্যক্ত শিশি-বোতল কিংবা কাগজের টুকরা সংগ্রহ করে, এমনকি খাদ্য কুড়িয়ে খায়; টোকায় বা টোকানোর কাজ করে যে।
টোকাইয়ের জন্মপ্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাসও। শাহাদত চৌধুরী আরো জানাচ্ছেন- একাত্তরের পিতা-মাতাহীন একটি বেঁচে থাকা শিশুই টোকাই, শহীদ পিতা-মাতার শেষ চিহ্ন। ত্রিশ লাখ শহীদের যে কোনো এক দম্পতি হতে পারে টোকাইয়ের পিতা-মাতা। একাত্তরের রিক্ত বাংলাদেশের প্রতীক টোকাই। যে ছবিটি দেখা যায় মৃত মায়ের পাশে বসে কাঁদছে একটি শিশু। হতে পারে সেটাই টোকাই। একাত্তরের বেদনা টোকাই। একাত্তরের প্রতিরোধের প্রতীক টোকাই। বেঁচে থাকার নিরন্তর সংগ্রামের নাম টোকাই।
টোকাইয়ের ¯্রষ্টা র’নবী জীবনে বেড়ে ওঠার একটা সময় কাটিয়েছেন পুরান ঢাকায়। তাই টোকাইয়ের বোলচালে ঢাকাইয়া রঙ্গরসিকতার প্রভাবও দুর্লক্ষ্য নয়। টোকাই প্রতিষ্ঠিত ভাষাকাঠামোর সমান্তরালে বহমান লোকবয়ানকে কণ্ঠে ধারণ করে শত দুঃখের মাঝেও প্রাণ খুলে হাসতে জানে। চিত্রসমালোচক সৈয়দ আজিজুল হক সঙ্গতই টোকাইকে দেখেন ‘উইট হিউমার ও উইজডমের সমাহার’ হিসেবে।
এভাবে ছিন্নমূল টোকাই হয়ে ওঠে সমকালীন বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতির সুনিপুণ ভাষ্যকার। পার্কের বেঞ্চিতে, ডাস্টবিনের ময়লার স্তূপে, ব্যারিকেডের ধারে কিংবা রাজপথে লাইটপোস্টের নিচে টোকাইকে দেখা যায়। বস্তা কাঁধে করে টোকাই যেন সমাজের নেতি-নিয়তির মতো অনড় দাঁড়িয়ে থাকে যার বয়সের কোনো বৃদ্ধি-লয় নেই। ক্লান্ত হয়ে মাঝেমধ্যে টোকাই ঘুমায়; সমাজ যেমনভাবে অসঙ্গতি-অন্যায়-দুরাচার দেখে কমিক্যালি ঘুমিয়ে থাকে।