আলবার্তো মোরাভিয়ার গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
আমার কাছে গোপন কথা বলবেন না! আমার নিজেরই একটা গোপন কথা আছেÑ এবং তা এমন ধরনের যে, আপনার বিবেককে দুঃস্বপ্নের মতো ভারাক্রান্ত করে তুলবে।
আমি একজন ট্রাক চালক। বসন্তের এক সুন্দর সকালে আমি রোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যাম্পাগনানোর কাছে খনি থেকে ট্রাকভর্তি লাভা-পাথর নিয়ে যাচ্ছিলাম এবং মোটর বাইকে চড়ে উল্টো দিক থেকে আসা এক ব্যক্তির সামনে গিয়ে পড়ি। জায়গাটি পুরনো ক্যাসিয়া সড়কের কিলোমিটার ২৫ দিক-চিহ্নের কাছে ছিল। লোকটির কোনো দোষ ছিল না। একটা গাড়ির পাশ কেটে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে রাস্তার উল্টো দিকে যাচ্ছিলাম, আর দ্রুতগতিতে চলছিলাম; তিনি ডানদিকে ছিলেন, যেদিকে তার চলার কথা ছিল, এবং ধীর গতিতে যাচ্ছিলেন। ট্রাকটি তাকে এত জোরে আঘাত করেছিল যে, আমি বাতাসে কালো কিছু উড়ে যাওয়ার এবং তারপর ডেইজি ক্ষেতের নরম শুভ্রতার মাঝে পড়ে গিয়ে স্থির হওয়ার দৃশ্য দেখার সময় পাইনি। মোটর বাইকটা রাস্তার উল্টোদিকে পড়ে ছিল এবং চাকাগুলো বাতাসে উড়ছিল, মৃত পোকার মতো।
আমি মাথা নিচু করে প্রচ- দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যাই। আমি রোমের রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে উঠানে পৌঁছে ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে রাখি।
পরদিন সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল: তেতাল্লিশ বছর বয়সী অমুক নামের একজন ভদ্রলোককে, পেশায় একজন চাকরিজীবী, ক্যাসিয়া রোডের কিলোমিটার ২৫ দিক-চিহ্নের কাছে চাপা দেওয়া হয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ তিনি মারা যান। তিনি স্ত্রী এবং কয়েকজন ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন। কে বা কারা তাকে আঘাত করেছে, তা কেউ জানে না। দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর গাড়ি না থামিয়ে চালক কাপুরুষের মতো ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। সংবাদপত্রের খবর ঠিক এটাই বলেছিল: একজন কাপুরুষের মতো। যদিও এই তিনটি শব্দ আমার মস্তিষ্কে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, কিন্তু একজন মানুষের মৃত্যুর খবর করতে চার লাইনের বেশি জায়গা লাগেনি।
পরের কয়েকদিন আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনি। আমি জানি যে, আমি একজন ট্রাকচালক মাত্র, কিন্তু ট্রাকচালকদের বিবেক নেইÑ এমন দাবি কে করতে পারে? একজন ট্রাকচালক তার নিজের ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে চিন্তা করার জন্য অনেক সময় পায়, যেমন স্টিয়ারিংয়ের পেছনে দীর্ঘ সময় অথবা ট্রাকের মধ্যে ঘুমানোর জায়গায় শুয়ে থাকার সময়। আর যখন, আমার ক্ষেত্রে, সেই ব্যক্তিগত কাজটি সব কিছুই হওয়া উচিত নয়, তখন চিন্তাভাবনা করার কাজটি সত্যিই বেশ কঠিন হতে পারে।
বিশেষ করে একটা জিনিস আমাকে অনবরত জ্বালাতন করছিল। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কেন আমি থামলাম না, কেন আমি বেচারাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম না। দৃশ্যটি বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই গাড়িটি অতিক্রম করার আগে আমার দূরত্ব পরিমাপ করা উচিত ছিল; অনুভব করা দরকার ছিল যে, আমার পা অ্যাক্সিলেটরে জোরে চাপ দিচ্ছে। তখন লোকটার শরীর আমার গাড়ির সামনের কাঁচের ওপর উড়ে আসত... এবং সেই মুহূর্তে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে দৃশ্যটি আটকে দেব, যেমন সিনেমায় করা হয়। আমি ভাবতাম, ‘এখন, গাড়ির ব্রেক আটকে গেছে, লাফ দিতে হবে, দৌঁড়ে গিয়ে, তাকে তুলতে হবে, ট্রাকের বিছানায় শুইয়ে সান্তো স্পিরিতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে...’
কিন্তু বেচারা আপনারা, সত্যি বড্ড বোকা, আবার স্বপ্ন দেখছেন। আমি থামিনি, সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই, বর্শাবিদ্ধ ষাঁড়ের মতো মাথা নিচু করে। দীর্ঘ কাহিনী সংক্ষিপ্ত করার জন্য বলতে হয়, আমি ব্রেকে চাপ দেওয়ার পরিবর্তে অ্যাক্সিলেটরে পা রাখার মুহূর্তটি সম্পর্কে যত বেশি চিন্তা করেছি, ততই আমার কাছে তা জটিল হয়ে উঠেছে। কাপুরুষতাÑ এই শব্দটা সঠিক ছিল। কিন্তু যে মানুষটির সাহস আছে, অথবা অন্তত বোঝে যে সে সাহসী, সে কেন এক মুহূর্তের সতর্কবার্তা ছাড়াই কাপুরুষে পরিণত হয়? এটা আমাকে হোঁচট খাইয়েছে। তবুও শীতল কঠিন সত্য ছিল: মৃত লোকটি সত্যিই মারা গিয়েছিল; দুর্ঘটনার সেই বিশেষ মুহূর্তে যখন আমি থামতে পারতাম, কিন্তু সেই সুযোগ চলে গেছে এবং এখন আরও দূরে তলিয়ে যাচ্ছে, যা কেউ কখনই ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে না। অধিকন্তু আমি অমর কেউ ছিলাম না যে, ঐ গাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আরেক অমর ব্যক্তি যে একজন লোককে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিল।
দুর্ঘটনার কথা ভেবে আমি অনেক রাত জেগে কাটিয়েছি। আমি বিষণœ ও নীরব হয়ে যাই। কিছুদিন পরে আমার আশেপাশের এবং কাজের পরে লোকজন সবাই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়: কেউই খুন করার পরে আনন্দে থাকা একজনের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় না। তাই আমি আমার গোপন বিষয়টি এমনভাবে বহন করে চলেছি যেন এটি একটি গরম হীরা, যা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে অর্পণ করতে পারবে না বা কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে না।
তারপর, বেশ কিছুদিন পর, আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা ক্রমশ কমিয়ে দেই এবং আমি বলতে পারি যে, এমন একটি সময় এসেছিল যখন আমি এ সম্পর্কে মোটেও চিন্তা করিনি। কিন্তু গোপন বিষয়টি তখনো আমার ভেতরে গভীরভাবে লুকিয়ে ছিল এবং আমার বিবেককে ভারাক্রান্ত করেছিল, এমনকি জীবনকে উপভোগ করা থেকে আমাকে বিরত রেখেছিল। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে, ঘটনাটি যদি কাউকে বলতে পারতাম, তবে আমি আরও ভালো বোধ করতাম। আমি ঘটনার স্বীকৃতির খোঁজ করিনিÑ তবে বুঝতে পেরেছি যে, আমি যা করেছি তার জন্য কোনো ক্ষমা নেইÑ কিন্তু আমি যদি আমার এই গোপন বিষয়টি কাউকে বলতে পারতাম, তাহলে আমি দুর্ঘটনার বিষয়টি অন্য কারোর ওপর চাপিয়ে দিতে পারতাম, যিনি আমাকে দোষ বহন করতে সাহায্য করতেন। কিন্তু কাকে বলব? আমার আশেপাশের বন্ধুদের কাছে? তাদের চিন্তা করার অন্য অনেক বিষয় ছিল। আমার পরিবারের কাছে?
আমার মতো কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের কেউ ছিল না। আমার মেয়ে বন্ধু? তিনি যুক্তিবাদী হতে পারতেন। কারণ, সবাই জানে, মহিলারা পুরুষদের বুঝতে এবং তাদের প্রয়োজনের সময় সহানুভূতি জানাতে সক্ষম। তবে দুর্ভাগ্য যে, আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল না।
দুই.
মে মাসের কোনো এক রোববার এক মেয়ের সঙ্গে আমি রোমের রাস্তায় হাঁটছিলাম। মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে বেশ অনেক দিন আগে, যখন আমি তাকে এবং তার বান্ধবীকে ট্রাকে তুলে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলাম। মেয়েটি আমাকে তার নাম ও ঠিকানা বলেছিল। আর তারপর আমি তাকে কয়েকবার দেখেছি। আমরা একজন আরেকজনের সান্নিধ্য উপভোগ করেছি। মেয়েটি একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে, সে আমাকে পছন্দ করে এবং আমার সঙ্গে বাইরে কোথাও যেতে রাজি আছে।
তার নাম ছিল আইরিস। সে ছিল একজন ধনবতী মহিলার ব্যক্তিগত আয়া। সেই মহিলার বাড়িতে আরও কয়েকজন কাজের মানুষ ছিল। আমি শুরু থেকেই তার গম্ভীর ছোট্ট ডিম্বাকৃতি মুখ এবং বড় বড় দুঃখী ধূসর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। সংক্ষেপে বলতে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার জন্য এখানে শুধু মেয়েটি রয়েছে। আমাদের চারপাশে উঁচু থামের এক্সপোজিশন গ্রাউন্ডে এক কাপ কফি পান করার পর অবশেষে সে তার লাজুক, নীরব এবং মৃদু উপায়ে সেন্ট পল’স তোরণের অদূরে একটি তৃণভূমিতে আমার সঙ্গে যেতে এবং বসতে রাজি হয়। সেই তৃণভূমি থেকে টাইবার নদী এবং নদীর উল্টো তীরে অবস্থিত সারিবদ্ধ নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িগুলোর এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়।
আমি লক্ষ্য করি যে, আমাদের চারপাশে ঘাসের মধ্যে অসংখ্য ডেইজি ফুল ফুটে রয়েছে; আর এক ঝলকের মতো মনে পড়ে যায় সেই অন্যসব ডেইজি ফুলের নরম শুভ্রতার মাঝে, মাত্র এক মাস আগে, আমি যাকে মেরে ফেলেছি, নিথর এবং মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি জানি না আমার মধ্যে কী ঘটে গেল। কিন্তু হঠাৎ আমি তাকে আমার গোপন কথা বলার ইচ্ছেটা ধরে রাখতে পারলাম না। আমি যদি তাকে বলি, আমি ভাবলাম, তবে হয়তো আমি আমার বুকের বোঝা থেকে মুক্তি পাব। মেয়েটি সেই ধরনের হতবুদ্ধি, খালি মাথার অন্যসব মেয়েদের মতো নয়। কেউ যদি সেসব মেয়েদের কাছে কোনো গোপন কথা বলে এবং তারা তা ছড়িয়ে দেয়, তাহলে সে আগের চেয়ে খারাপ বোধ করবে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই প্রচ- ধিক্কার দিবে। সে একজন চমৎকার, বোধগম্য মেয়ে। তার মুখের বিষণœ ছোট্ট চেহারা যদি কিছু বোঝায়, তবে তা অবশ্যই বেশ রুক্ষ আঘাত ছিল। বরফ ভাঙার জন্য, আমি তাকে ইতস্তত না করে সরাসরি বললাম:
‘এ নিয়ে কী ভাবছ, আইরিস?’
হাই থামানোর জন্য সে শুধু হাত তুলে দম বন্ধ করে। সম্ভবত সে ক্লান্ত ছিল। সে বলল, ‘কিছু না।’
তার এই এড়িয়ে যাওয়া জবাবে আমি নিজেকে হতাশ হতে দিইনি। সুতরাং তৎক্ষণাৎ আমি কথা বলা শুরু করি। ‘আইরিস, তুমি জানো আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, তাই না? আমার মনে হয় তোমার কাছ থেকে আমার কোনো কিছু গোপন করা উচিত নয়। তোমাকে আমার সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে। আইরিস, আমার একটা গোপন কথা আছে।’
মেয়েটি নদীর উল্টো দিকের উঁচু দালানের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরোটা সময় সে তার থুতনিতে ছোট্ট লাল ফুসকুড়িতে আঙ্গুল বোলাচ্ছিল, সদ্যজাত একটা ছোট্ট ফুসকুড়ি।
‘কী গোপন কথা?’ সে জিজ্ঞেস করে।
অনেক চেষ্টা করে বললাম, ‘আমি এক লোককে খুন করেছি।’
আইরিস একটুও নড়াচড়া করল না, বরং নিজের থুতনিতে আলতো করে খোঁচাতে থাকে। তারপর তার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে, যেন সে শেষপর্যন্ত বুঝতে পেরেছে। ‘তুমি একজন মানুষকে খুন করেছ? আর তুমি এমন স্বাভাবিকভাবে কথাটা আমাকে বললে?’
‘এছাড়া আমার কাছে তুমি আর কী আশা করো যে, তোমাকে অন্যভাবে বলব?’
আইরিস কিছু বলল না। মনে হচ্ছিল সে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি এগিয়ে যাই। ‘এসো, জিনিসটি সোজা করে রাখি। আমি তাকে খুন করতে চাইনি।’
হঠাৎ সে পেয়েছে, যা চেয়েছিল: একটা দীর্ঘ চিকন ঘাস। সে ঘাস ছিঁড়ে তার মুখে পুড়ে এবং চিবুতে শুরু করে, খুবই চিন্তিত ভঙ্গিমায়। তারপর, ত্বরিৎ গতিতে, কোনো কিছু না লুকিয়ে আমি তাকে দুর্ঘটনার পুরো কাহিনি বলি, এমনকি আমার কাপুরুষতার বিষয়টিও উল্লেখ করি।
নিজেকে সামলাতে না পারার জন্য আমার ভেতর ভাঙচুর হয়, কিন্তু এরই মধ্যে আমি স্বস্তি বোধ করতে শুরু করি। আমি উপসংহার টেনে বললাম:
‘এখন বলো, তুমি এসব নিয়ে কী ভাবছ।’
সে অনবরত ঘাসের ডগা চিবুতে থাকে এবং একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না।
আমি নাছোড় বান্দার মতো পীড়াপীড়ি করি। ‘আমি বাজি ধরতে পারি তুমি এখন আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
আমি দেখলাম সে ঘাড় দুলিয়ে শ্রাগ করল, হালকাভাবে। তারপর বলল, ‘আমি কেন তোমার সামনে দাঁড়াতে পারব না।’
‘ঠিক আছে, আমি জানি না। যাহোক, আমিই বেচারার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
‘আর এ বিষয়টা তোমাকে বিরক্ত করে?’
‘হ্যাঁ। ভয়ঙ্করভাবে। হঠাৎ আমার গলা শক্ত হয়ে যায় এবং নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন গলার মধ্যে কান্নার শক্ত গিঁট লেগেছে। ‘আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি আর বাঁচতে পারছি না। কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না, যদি সে নিজেকে কাপুরুষ মনে করে।’
‘দুর্ঘটনার খবর কি সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। খবরটি চার লাইন জুড়ে ছিল। শুধু এটুকু উল্লেখ করেছে যে, সে খুন হয়েছে এবং কে করেছে, তা কেউ জানে না।’
হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে, ‘এখন সময় কত?’
‘পাঁচটা পনেরো।’
আবারও নীরবতা নেমে আসে। ‘শোনো, আইরিস, তোমার মনের মধ্যে কী ঘুরপাক খাচ্ছে, তা জানার জন্য একজন মানুষকে কী করতে হবে?’
আইরিস ঘাসের সরু ডগা মুখের এক পাশ থেকে অন্য পাশে নিয়ে খোলাখুলিভাবে বলল, ‘আচ্ছা, তোমাকে যদি জানতেই হয়, আমার মাথায় কিছু নেই। আমি ভালো অনুভব করছি এবং আমি কোনো কিছু নিয়ে ভাবছি না।’
আমি আমার কান দু’টিকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি প্রতিবাদ করি। ‘এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই তুমি কিছু একটা নিয়ে ভাবছ। আমি নিশ্চিত।’
আমি তার হাসি দেখতে পেলাম, ম্লান। ‘ঠিক আছে, আসলে আমি কিছু একটা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু আমি যদি তোমাকে বলি, তুমি কখনো তা বিশ্বাস করবে না।’
কিছুটা আশা নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তা কি আমাকে নিয়ে ছিল?’
‘হায় ঈশ্বর, না! আমার ভাবনার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই!’
‘তাহলে কী?’
সে মন্থর গতিতে বলল, ‘এটি এমন একটি বিষয়, যা কেবল মহিলারাই ভাবে। আমি আমার জুতার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম যে, জুতার মধ্যে ফুটো রয়েছে। আমি ভাবছিলাম ভায়া কোলা ডি রিয়েনজোতে বিশাল মূল্য হ্রাস চলছে। আমাকে আগামীকাল সেখানে যেতে হবে এবং নিজের জন্য এক জোড়া নতুন জুতা কিনব। সেখানে... তুমি কী এখন সন্তুষ্ট?’
এবার আমি শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে চুপ করে থাকি। আমার মুখ কালো এবং বিষণœ। সে তা লক্ষ্য করে এবং অবাক হয়ে মিষ্টি গলায় বলল: ‘ওহ, প্রিয়তম! তুমি পাগল নও, তাই না?’
আমি না বলে থাকতে পারলাম না: ‘অবশ্যই, আমি পাগল। বদ্ধ পাগল। এখানে আমি তোমাকে আমার জীবনের গোপন কথা বলেছি এবং তা তোমার কাছে এতই গুরুত্বহীন যে, আমি ভেবে পাই না কেন নিজের মধ্যে বিষয়টা চেপে রাখিনি!’
আমার কথায় সে কিছুটা বিরক্ত হয়। ‘না’, সে বলল, ‘আমি খুশি হয়েছি যে, তুমি আমাকে দুর্ঘটনার কথা বলেছ। সত্যিই, বিষয়টা আমার মনে দাগ কেটেছে।’
‘আচ্ছা, কী ধরনের দাগ কেটেছে?’
সে বিষয়টা একটু সময়ের জন্য ভেবে দেখল, তারপর দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা, আমি দুঃখিত, তোমার সঙ্গে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ছিল!’
‘তোমার কী শুধু এটুকুই বলার আছে?’
‘আমিও তাই মনে করি’, সে তার চিবুকের ফুসকুড়ি আঙুল দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘দুর্ঘটনার জন্য কেবল তোমার বিরক্ত হওয়া উচিত।’
‘কেন?’
‘বেশ, তা তো তুমি নিজেই বলেছ। তাকে সাহায্য করার জন্য তোমার গাড়ি থামানো উচিত ছিল, কিন্তু তুমি থামাওনি।’
‘আর সেই জন্য তুমি কি মনে করো আমি একজন কাপুরুষ?’
‘কাপুরুষ? বেশ, হ্যাঁ... এবং তারপর না। যাহোক, এমন ঘটনা যে কারোর জীবনে ঘটতে পারে।’
‘কিন্তু এইমাত্র তুমি বললে আমার গাড়ি থামানো উচিত ছিল!’
‘অবশ্যই তোমার উচিত ছিল, কিন্তু তুমি তা করোনি...’
সেই মুহূর্তে দেখলাম আইরিস ডেইজি ফুলের মাঝে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওহ, দেখো! কী অদ্ভুত সুন্দর!’
এটি ছিল পোকা, সবুজ এবং সোনালি রঙের গুবরে পোকা, ডেইজি ফুলের সাদা পাপড়ির ওপর বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি যেন শূন্য হয়ে গেছিÑ যে গোপন কথা নিয়ে আমি এতক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তা বসন্তের বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সূর্যের আলোয় জোড়ায় জোড়ায় উড়ে বেড়ানো সাদা প্রজাপতির মতো হালকাভাবে ভেসে গেছে।
তবুও আমি শেষ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু বলো আইরিস, তোমার মতে আমার পক্ষে থামা ঠিক ছিল, নাকি ভুল?’
‘তুমি একদিকে ঠিক ছিলে এবং অন্যদিকে ভুল ছিলে। অবশ্যই তোমার থামা উচিত ছিল। মোটের ওপর, তুমি তার কাছে ছুটে গিয়েছিলে। কিন্তু, অন্যদিকে, তুমি থাকলে তার কী লাভ হতো? সে তো ততক্ষণে মারা গেছে এবং তুমি সম্ভবত একধরনের ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়তে। তুমি ঠিক এবং ভুল উভয়ই ছিলে।’
এ কথাগুলো বলার পর আমার মাথায় একটা চিন্তা চকিতে খেলে যায়। ‘এখানেই আইরিসের সঙ্গে শেষ। আমি আর কখনো তাকে বাইরে নিয়ে যাব না। আমি ভেবেছিলাম সে তীক্ষè, বুদ্ধিমতি, বোধগম্য মেয়ে। বরং সে আসলে অর্ধেক বুদ্ধিমতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢের হয়েছে।’ আমি পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠলাম।
আমি বললাম, ‘চলো, যাওয়া যাক। তা না হলে সিনেমার জন্য দেরি হয়ে যাবে।’
একবার থিয়েটারের অভ্যন্তরে, অন্ধকারে, সে তার হাতটি আমার হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় এবং জোর করে তার আঙ্গুল দিয়ে আমার আমার আঙ্গুল চেপে ধরে। আমি বাধা দেইনি। ছবিটি ছিল একটি প্রেমের গল্প, আবেগপ্রবণ, সত্যিকারের বিয়োগান্তক। শেষে যখন আলো জ্বলে ওঠে, তখন দেখলাম তার বড় বড় ধূসর চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে এবং তার গাল ভেজা। ‘আমি সহ্য করতে পারি না’, সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল: ‘এ ধরনের ছবি আমাকে সবসময় অশ্রুসিক্ত করে।’
তারপর আমরা একটি পানশালায় ঢুকে কফির অর্ডার করি। সে আমার এত কাছে চেপে বসে যে, আমাদের শরীর একে অন্যের সঙ্গে স্পর্শ করে। এসপ্রেসো মেশিন থেকে বাষ্প বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সে মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি জানো যে, আমি তোমাকে সত্যিই পছন্দ করি, তাই না?’ তার সেই বিশাল সুন্দর চোখ দুটি আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে।
আমার জবাব দিতে ইচ্ছে করছিল: ‘ঠিক আছে। তুমি সত্যিই আমাকে পছন্দ করো, কিন্তু তুমি আমাকে আমার গোপনীয়তার সমস্ত ওজন একা বহন করতে বলো!’ কিন্তু তার বদলে আমি কিছুই বলিনি।
এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, তার কাছ থেকে, অন্য সবার মতো, আমি কেবল স্নেহ চাইতে পারি, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমিও তোমাকে অনেক পছন্দ করি।’
কিন্তু ততক্ষণে সে আমার কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। সে পানশালার পেছনের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং চিবুকের ছোট্ট লাল ফুসকুড়িতে মগ্ন, উদ্বিগ্নভাবে আঙ্গুল বোলাতে থাকে।
গল্পসূত্র:
‘গোপন কথা’ গল্পটি আলবার্তো মোরাভিয়ার ইংরেজিতে ‘দ্য সেক্রেট’ গল্পের অনুবাদ। ইতালীয় ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হেলেনে ক্যান্তারেলা। ইংরেজিতে গল্পটি ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনে ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফেটিশ’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লেখক পরিচিতি
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত ইতালীয় লেখক আলবার্তো মোরাভিয়া (আসল নাম আলবার্তো পিনচারলে) ১৯০৭ সালে রোমে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মের মূল বিষয় মানসিক শুষ্কতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বুর্জোয়া অস্তিত্বের অবক্ষয় ও ভ-ামি, আধুনিক যৌনতা বা দাম্পত্য প্রেমের নিরর্থকতা। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হলো আগোস্তিনো (১৯৯৪); লা রোমানা (১৯৪৭), লা ডিসুবিদিয়েনজা (১৯৪৮), ইল কনফর্মিস্তা (১৯৫১), লা চোচারা (১৯৫৭) এবং লা নোইয়া (১৯৬০)। তাঁর ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে র্যাকোন্তি রোমানি (১৯৫৪), নুওভি র্যাকোন্তি রোমানি (১৯৫৯), র্যাকোন্তি ডি আলবার্তো মোরাভিয়া (১৯৬৮), ইল পারাদিসো (১৯৭০) এবং বোহ (১৯৭৬)। লেখালেখির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি সম্মানিত পুরস্কার লাভ করেন, যেমন ‘কোরিয়েরে লম্বার্ডো’ পুরস্কার (১৯৪৫), ‘স্ট্রেগা প্রাইজ’ (১৯৫২) এবং ‘ভিয়ারেজিও’ পুরস্কার (১৯৬১)। তাঁর অনেক বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর অনেক উপন্যাস ও ছোটগল্পের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, যেমন ‘টু উইমেন’, ‘দ্য কনফর্মিস্ট’, ‘বোরডোম’ এবং ‘দ্য এম্পটি ক্যানভাস’। তিনি বিশ্বব্যাপী লেখকদের সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল-এর সভাপতি ছিলেন (১৯৫৯-১৯৬২)। এছাড়া তিনি তুরিনে কিছু সময়ের জন্য সাংবাদিক এবং লন্ডনে বিদেশি সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন এবং তার ভ্রমণবিষয়ক লেখায় ভারত, চীন ও আফ্রিকার ব্যতিক্রমী মানের গ্রন্থ রয়েছে। তিনি ১৯৯০ সালে মারা যান।
আলবার্তো মোরাভিয়ার গল্প
অনুবাদ: ফজল হাসান
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
আমার কাছে গোপন কথা বলবেন না! আমার নিজেরই একটা গোপন কথা আছেÑ এবং তা এমন ধরনের যে, আপনার বিবেককে দুঃস্বপ্নের মতো ভারাক্রান্ত করে তুলবে।
আমি একজন ট্রাক চালক। বসন্তের এক সুন্দর সকালে আমি রোমে নিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যাম্পাগনানোর কাছে খনি থেকে ট্রাকভর্তি লাভা-পাথর নিয়ে যাচ্ছিলাম এবং মোটর বাইকে চড়ে উল্টো দিক থেকে আসা এক ব্যক্তির সামনে গিয়ে পড়ি। জায়গাটি পুরনো ক্যাসিয়া সড়কের কিলোমিটার ২৫ দিক-চিহ্নের কাছে ছিল। লোকটির কোনো দোষ ছিল না। একটা গাড়ির পাশ কেটে যাওয়ার পর আমি অনেকক্ষণ ধরে রাস্তার উল্টো দিকে যাচ্ছিলাম, আর দ্রুতগতিতে চলছিলাম; তিনি ডানদিকে ছিলেন, যেদিকে তার চলার কথা ছিল, এবং ধীর গতিতে যাচ্ছিলেন। ট্রাকটি তাকে এত জোরে আঘাত করেছিল যে, আমি বাতাসে কালো কিছু উড়ে যাওয়ার এবং তারপর ডেইজি ক্ষেতের নরম শুভ্রতার মাঝে পড়ে গিয়ে স্থির হওয়ার দৃশ্য দেখার সময় পাইনি। মোটর বাইকটা রাস্তার উল্টোদিকে পড়ে ছিল এবং চাকাগুলো বাতাসে উড়ছিল, মৃত পোকার মতো।
আমি মাথা নিচু করে প্রচ- দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে পালিয়ে যাই। আমি রোমের রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে উঠানে পৌঁছে ট্রাক থেকে মাল নামিয়ে রাখি।
পরদিন সংবাদপত্রে খবর বেরিয়েছিল: তেতাল্লিশ বছর বয়সী অমুক নামের একজন ভদ্রলোককে, পেশায় একজন চাকরিজীবী, ক্যাসিয়া রোডের কিলোমিটার ২৫ দিক-চিহ্নের কাছে চাপা দেওয়া হয়েছে এবং তৎক্ষণাৎ তিনি মারা যান। তিনি স্ত্রী এবং কয়েকজন ছেলেমেয়ে রেখে গেছেন। কে বা কারা তাকে আঘাত করেছে, তা কেউ জানে না। দুর্ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর গাড়ি না থামিয়ে চালক কাপুরুষের মতো ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। সংবাদপত্রের খবর ঠিক এটাই বলেছিল: একজন কাপুরুষের মতো। যদিও এই তিনটি শব্দ আমার মস্তিষ্কে এক গভীর ক্ষত তৈরি করেছে, কিন্তু একজন মানুষের মৃত্যুর খবর করতে চার লাইনের বেশি জায়গা লাগেনি।
পরের কয়েকদিন আমি আর কিছুই ভাবতে পারিনি। আমি জানি যে, আমি একজন ট্রাকচালক মাত্র, কিন্তু ট্রাকচালকদের বিবেক নেইÑ এমন দাবি কে করতে পারে? একজন ট্রাকচালক তার নিজের ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে চিন্তা করার জন্য অনেক সময় পায়, যেমন স্টিয়ারিংয়ের পেছনে দীর্ঘ সময় অথবা ট্রাকের মধ্যে ঘুমানোর জায়গায় শুয়ে থাকার সময়। আর যখন, আমার ক্ষেত্রে, সেই ব্যক্তিগত কাজটি সব কিছুই হওয়া উচিত নয়, তখন চিন্তাভাবনা করার কাজটি সত্যিই বেশ কঠিন হতে পারে।
বিশেষ করে একটা জিনিস আমাকে অনবরত জ্বালাতন করছিল। আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না কেন আমি থামলাম না, কেন আমি বেচারাকে সাহায্য করার চেষ্টা করলাম না। দৃশ্যটি বারবার আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। সেই গাড়িটি অতিক্রম করার আগে আমার দূরত্ব পরিমাপ করা উচিত ছিল; অনুভব করা দরকার ছিল যে, আমার পা অ্যাক্সিলেটরে জোরে চাপ দিচ্ছে। তখন লোকটার শরীর আমার গাড়ির সামনের কাঁচের ওপর উড়ে আসত... এবং সেই মুহূর্তে আমি ইচ্ছাকৃতভাবে দৃশ্যটি আটকে দেব, যেমন সিনেমায় করা হয়। আমি ভাবতাম, ‘এখন, গাড়ির ব্রেক আটকে গেছে, লাফ দিতে হবে, দৌঁড়ে গিয়ে, তাকে তুলতে হবে, ট্রাকের বিছানায় শুইয়ে সান্তো স্পিরিতো হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে...’
কিন্তু বেচারা আপনারা, সত্যি বড্ড বোকা, আবার স্বপ্ন দেখছেন। আমি থামিনি, সোজা গাড়ি চালিয়ে চলে যাই, বর্শাবিদ্ধ ষাঁড়ের মতো মাথা নিচু করে। দীর্ঘ কাহিনী সংক্ষিপ্ত করার জন্য বলতে হয়, আমি ব্রেকে চাপ দেওয়ার পরিবর্তে অ্যাক্সিলেটরে পা রাখার মুহূর্তটি সম্পর্কে যত বেশি চিন্তা করেছি, ততই আমার কাছে তা জটিল হয়ে উঠেছে। কাপুরুষতাÑ এই শব্দটা সঠিক ছিল। কিন্তু যে মানুষটির সাহস আছে, অথবা অন্তত বোঝে যে সে সাহসী, সে কেন এক মুহূর্তের সতর্কবার্তা ছাড়াই কাপুরুষে পরিণত হয়? এটা আমাকে হোঁচট খাইয়েছে। তবুও শীতল কঠিন সত্য ছিল: মৃত লোকটি সত্যিই মারা গিয়েছিল; দুর্ঘটনার সেই বিশেষ মুহূর্তে যখন আমি থামতে পারতাম, কিন্তু সেই সুযোগ চলে গেছে এবং এখন আরও দূরে তলিয়ে যাচ্ছে, যা কেউ কখনই ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে না। অধিকন্তু আমি অমর কেউ ছিলাম না যে, ঐ গাড়ির পাশ দিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু আরেক অমর ব্যক্তি যে একজন লোককে খুন করে পালিয়ে গিয়েছিল।
দুর্ঘটনার কথা ভেবে আমি অনেক রাত জেগে কাটিয়েছি। আমি বিষণœ ও নীরব হয়ে যাই। কিছুদিন পরে আমার আশেপাশের এবং কাজের পরে লোকজন সবাই আমার কাছ থেকে দূরে সরে যায়: কেউই খুন করার পরে আনন্দে থাকা একজনের সঙ্গে সময় কাটাতে চায় না। তাই আমি আমার গোপন বিষয়টি এমনভাবে বহন করে চলেছি যেন এটি একটি গরম হীরা, যা কেউ কাউকে বিশ্বাস করে অর্পণ করতে পারবে না বা কোথাও লুকিয়ে রাখতে পারবে না।
তারপর, বেশ কিছুদিন পর, আমি বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করা ক্রমশ কমিয়ে দেই এবং আমি বলতে পারি যে, এমন একটি সময় এসেছিল যখন আমি এ সম্পর্কে মোটেও চিন্তা করিনি। কিন্তু গোপন বিষয়টি তখনো আমার ভেতরে গভীরভাবে লুকিয়ে ছিল এবং আমার বিবেককে ভারাক্রান্ত করেছিল, এমনকি জীবনকে উপভোগ করা থেকে আমাকে বিরত রেখেছিল। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে, ঘটনাটি যদি কাউকে বলতে পারতাম, তবে আমি আরও ভালো বোধ করতাম। আমি ঘটনার স্বীকৃতির খোঁজ করিনিÑ তবে বুঝতে পেরেছি যে, আমি যা করেছি তার জন্য কোনো ক্ষমা নেইÑ কিন্তু আমি যদি আমার এই গোপন বিষয়টি কাউকে বলতে পারতাম, তাহলে আমি দুর্ঘটনার বিষয়টি অন্য কারোর ওপর চাপিয়ে দিতে পারতাম, যিনি আমাকে দোষ বহন করতে সাহায্য করতেন। কিন্তু কাকে বলব? আমার আশেপাশের বন্ধুদের কাছে? তাদের চিন্তা করার অন্য অনেক বিষয় ছিল। আমার পরিবারের কাছে?
আমার মতো কুড়িয়ে পাওয়া মানুষের কেউ ছিল না। আমার মেয়ে বন্ধু? তিনি যুক্তিবাদী হতে পারতেন। কারণ, সবাই জানে, মহিলারা পুরুষদের বুঝতে এবং তাদের প্রয়োজনের সময় সহানুভূতি জানাতে সক্ষম। তবে দুর্ভাগ্য যে, আমার কোনো মেয়ে বন্ধু ছিল না।
দুই.
মে মাসের কোনো এক রোববার এক মেয়ের সঙ্গে আমি রোমের রাস্তায় হাঁটছিলাম। মেয়েটির সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে বেশ অনেক দিন আগে, যখন আমি তাকে এবং তার বান্ধবীকে ট্রাকে তুলে গন্তব্যে পৌঁছে দিয়েছিলাম। মেয়েটি আমাকে তার নাম ও ঠিকানা বলেছিল। আর তারপর আমি তাকে কয়েকবার দেখেছি। আমরা একজন আরেকজনের সান্নিধ্য উপভোগ করেছি। মেয়েটি একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিয়েছিল যে, সে আমাকে পছন্দ করে এবং আমার সঙ্গে বাইরে কোথাও যেতে রাজি আছে।
তার নাম ছিল আইরিস। সে ছিল একজন ধনবতী মহিলার ব্যক্তিগত আয়া। সেই মহিলার বাড়িতে আরও কয়েকজন কাজের মানুষ ছিল। আমি শুরু থেকেই তার গম্ভীর ছোট্ট ডিম্বাকৃতি মুখ এবং বড় বড় দুঃখী ধূসর চোখের দিকে তাকিয়ে মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। সংক্ষেপে বলতে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার জন্য এখানে শুধু মেয়েটি রয়েছে। আমাদের চারপাশে উঁচু থামের এক্সপোজিশন গ্রাউন্ডে এক কাপ কফি পান করার পর অবশেষে সে তার লাজুক, নীরব এবং মৃদু উপায়ে সেন্ট পল’স তোরণের অদূরে একটি তৃণভূমিতে আমার সঙ্গে যেতে এবং বসতে রাজি হয়। সেই তৃণভূমি থেকে টাইবার নদী এবং নদীর উল্টো তীরে অবস্থিত সারিবদ্ধ নতুন অ্যাপার্টমেন্ট বাড়িগুলোর এক অপূর্ব দৃশ্য দেখা যায়।
আমি লক্ষ্য করি যে, আমাদের চারপাশে ঘাসের মধ্যে অসংখ্য ডেইজি ফুল ফুটে রয়েছে; আর এক ঝলকের মতো মনে পড়ে যায় সেই অন্যসব ডেইজি ফুলের নরম শুভ্রতার মাঝে, মাত্র এক মাস আগে, আমি যাকে মেরে ফেলেছি, নিথর এবং মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। আমি জানি না আমার মধ্যে কী ঘটে গেল। কিন্তু হঠাৎ আমি তাকে আমার গোপন কথা বলার ইচ্ছেটা ধরে রাখতে পারলাম না। আমি যদি তাকে বলি, আমি ভাবলাম, তবে হয়তো আমি আমার বুকের বোঝা থেকে মুক্তি পাব। মেয়েটি সেই ধরনের হতবুদ্ধি, খালি মাথার অন্যসব মেয়েদের মতো নয়। কেউ যদি সেসব মেয়েদের কাছে কোনো গোপন কথা বলে এবং তারা তা ছড়িয়ে দেয়, তাহলে সে আগের চেয়ে খারাপ বোধ করবে এবং নিজের নির্বুদ্ধিতার জন্য নিজেকেই প্রচ- ধিক্কার দিবে। সে একজন চমৎকার, বোধগম্য মেয়ে। তার মুখের বিষণœ ছোট্ট চেহারা যদি কিছু বোঝায়, তবে তা অবশ্যই বেশ রুক্ষ আঘাত ছিল। বরফ ভাঙার জন্য, আমি তাকে ইতস্তত না করে সরাসরি বললাম:
‘এ নিয়ে কী ভাবছ, আইরিস?’
হাই থামানোর জন্য সে শুধু হাত তুলে দম বন্ধ করে। সম্ভবত সে ক্লান্ত ছিল। সে বলল, ‘কিছু না।’
তার এই এড়িয়ে যাওয়া জবাবে আমি নিজেকে হতাশ হতে দিইনি। সুতরাং তৎক্ষণাৎ আমি কথা বলা শুরু করি। ‘আইরিস, তুমি জানো আমি তোমাকে অনেক পছন্দ করি, তাই না? আমার মনে হয় তোমার কাছ থেকে আমার কোনো কিছু গোপন করা উচিত নয়। তোমাকে আমার সম্পর্কে সবকিছু জানতে হবে। আইরিস, আমার একটা গোপন কথা আছে।’
মেয়েটি নদীর উল্টো দিকের উঁচু দালানের দিকে তাকিয়ে থাকে। পুরোটা সময় সে তার থুতনিতে ছোট্ট লাল ফুসকুড়িতে আঙ্গুল বোলাচ্ছিল, সদ্যজাত একটা ছোট্ট ফুসকুড়ি।
‘কী গোপন কথা?’ সে জিজ্ঞেস করে।
অনেক চেষ্টা করে বললাম, ‘আমি এক লোককে খুন করেছি।’
আইরিস একটুও নড়াচড়া করল না, বরং নিজের থুতনিতে আলতো করে খোঁচাতে থাকে। তারপর তার সমস্ত শরীর কাঁপতে শুরু করে, যেন সে শেষপর্যন্ত বুঝতে পেরেছে। ‘তুমি একজন মানুষকে খুন করেছ? আর তুমি এমন স্বাভাবিকভাবে কথাটা আমাকে বললে?’
‘এছাড়া আমার কাছে তুমি আর কী আশা করো যে, তোমাকে অন্যভাবে বলব?’
আইরিস কিছু বলল না। মনে হচ্ছিল সে মাটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে। আমি এগিয়ে যাই। ‘এসো, জিনিসটি সোজা করে রাখি। আমি তাকে খুন করতে চাইনি।’
হঠাৎ সে পেয়েছে, যা চেয়েছিল: একটা দীর্ঘ চিকন ঘাস। সে ঘাস ছিঁড়ে তার মুখে পুড়ে এবং চিবুতে শুরু করে, খুবই চিন্তিত ভঙ্গিমায়। তারপর, ত্বরিৎ গতিতে, কোনো কিছু না লুকিয়ে আমি তাকে দুর্ঘটনার পুরো কাহিনি বলি, এমনকি আমার কাপুরুষতার বিষয়টিও উল্লেখ করি।
নিজেকে সামলাতে না পারার জন্য আমার ভেতর ভাঙচুর হয়, কিন্তু এরই মধ্যে আমি স্বস্তি বোধ করতে শুরু করি। আমি উপসংহার টেনে বললাম:
‘এখন বলো, তুমি এসব নিয়ে কী ভাবছ।’
সে অনবরত ঘাসের ডগা চিবুতে থাকে এবং একটাও শব্দ উচ্চারণ করল না।
আমি নাছোড় বান্দার মতো পীড়াপীড়ি করি। ‘আমি বাজি ধরতে পারি তুমি এখন আমার সামনে দাঁড়াতে পারবে না।’
আমি দেখলাম সে ঘাড় দুলিয়ে শ্রাগ করল, হালকাভাবে। তারপর বলল, ‘আমি কেন তোমার সামনে দাঁড়াতে পারব না।’
‘ঠিক আছে, আমি জানি না। যাহোক, আমিই বেচারার মৃত্যুর জন্য দায়ী।’
‘আর এ বিষয়টা তোমাকে বিরক্ত করে?’
‘হ্যাঁ। ভয়ঙ্করভাবে। হঠাৎ আমার গলা শক্ত হয়ে যায় এবং নাড়াতে কষ্ট হচ্ছিল, যেন গলার মধ্যে কান্নার শক্ত গিঁট লেগেছে। ‘আমার মনে হচ্ছিল যে, আমি আর বাঁচতে পারছি না। কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না, যদি সে নিজেকে কাপুরুষ মনে করে।’
‘দুর্ঘটনার খবর কি সংবাদপত্রে বেরিয়েছিল?’
‘হ্যাঁ। খবরটি চার লাইন জুড়ে ছিল। শুধু এটুকু উল্লেখ করেছে যে, সে খুন হয়েছে এবং কে করেছে, তা কেউ জানে না।’
হঠাৎ সে জিজ্ঞেস করে, ‘এখন সময় কত?’
‘পাঁচটা পনেরো।’
আবারও নীরবতা নেমে আসে। ‘শোনো, আইরিস, তোমার মনের মধ্যে কী ঘুরপাক খাচ্ছে, তা জানার জন্য একজন মানুষকে কী করতে হবে?’
আইরিস ঘাসের সরু ডগা মুখের এক পাশ থেকে অন্য পাশে নিয়ে খোলাখুলিভাবে বলল, ‘আচ্ছা, তোমাকে যদি জানতেই হয়, আমার মাথায় কিছু নেই। আমি ভালো অনুভব করছি এবং আমি কোনো কিছু নিয়ে ভাবছি না।’
আমি আমার কান দু’টিকে বিশ্বাস করতে পারছি না। আমি প্রতিবাদ করি। ‘এ হতে পারে না। নিশ্চয়ই তুমি কিছু একটা নিয়ে ভাবছ। আমি নিশ্চিত।’
আমি তার হাসি দেখতে পেলাম, ম্লান। ‘ঠিক আছে, আসলে আমি কিছু একটা নিয়ে ভাবছি। কিন্তু আমি যদি তোমাকে বলি, তুমি কখনো তা বিশ্বাস করবে না।’
কিছুটা আশা নিয়ে আমি জিজ্ঞেস করি, ‘তা কি আমাকে নিয়ে ছিল?’
‘হায় ঈশ্বর, না! আমার ভাবনার সঙ্গে তোমার কোনো সম্পর্ক নেই!’
‘তাহলে কী?’
সে মন্থর গতিতে বলল, ‘এটি এমন একটি বিষয়, যা কেবল মহিলারাই ভাবে। আমি আমার জুতার দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম যে, জুতার মধ্যে ফুটো রয়েছে। আমি ভাবছিলাম ভায়া কোলা ডি রিয়েনজোতে বিশাল মূল্য হ্রাস চলছে। আমাকে আগামীকাল সেখানে যেতে হবে এবং নিজের জন্য এক জোড়া নতুন জুতা কিনব। সেখানে... তুমি কী এখন সন্তুষ্ট?’
এবার আমি শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে চুপ করে থাকি। আমার মুখ কালো এবং বিষণœ। সে তা লক্ষ্য করে এবং অবাক হয়ে মিষ্টি গলায় বলল: ‘ওহ, প্রিয়তম! তুমি পাগল নও, তাই না?’
আমি না বলে থাকতে পারলাম না: ‘অবশ্যই, আমি পাগল। বদ্ধ পাগল। এখানে আমি তোমাকে আমার জীবনের গোপন কথা বলেছি এবং তা তোমার কাছে এতই গুরুত্বহীন যে, আমি ভেবে পাই না কেন নিজের মধ্যে বিষয়টা চেপে রাখিনি!’
আমার কথায় সে কিছুটা বিরক্ত হয়। ‘না’, সে বলল, ‘আমি খুশি হয়েছি যে, তুমি আমাকে দুর্ঘটনার কথা বলেছ। সত্যিই, বিষয়টা আমার মনে দাগ কেটেছে।’
‘আচ্ছা, কী ধরনের দাগ কেটেছে?’
সে বিষয়টা একটু সময়ের জন্য ভেবে দেখল, তারপর দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বলল, ‘আচ্ছা, আমি দুঃখিত, তোমার সঙ্গে এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। নিশ্চয়ই ভয়ঙ্কর ছিল!’
‘তোমার কী শুধু এটুকুই বলার আছে?’
‘আমিও তাই মনে করি’, সে তার চিবুকের ফুসকুড়ি আঙুল দিয়ে নাড়াতে নাড়াতে বলল, ‘দুর্ঘটনার জন্য কেবল তোমার বিরক্ত হওয়া উচিত।’
‘কেন?’
‘বেশ, তা তো তুমি নিজেই বলেছ। তাকে সাহায্য করার জন্য তোমার গাড়ি থামানো উচিত ছিল, কিন্তু তুমি থামাওনি।’
‘আর সেই জন্য তুমি কি মনে করো আমি একজন কাপুরুষ?’
‘কাপুরুষ? বেশ, হ্যাঁ... এবং তারপর না। যাহোক, এমন ঘটনা যে কারোর জীবনে ঘটতে পারে।’
‘কিন্তু এইমাত্র তুমি বললে আমার গাড়ি থামানো উচিত ছিল!’
‘অবশ্যই তোমার উচিত ছিল, কিন্তু তুমি তা করোনি...’
সেই মুহূর্তে দেখলাম আইরিস ডেইজি ফুলের মাঝে কোনো কিছুর দিকে তাকিয়ে আছে। ‘ওহ, দেখো! কী অদ্ভুত সুন্দর!’
এটি ছিল পোকা, সবুজ এবং সোনালি রঙের গুবরে পোকা, ডেইজি ফুলের সাদা পাপড়ির ওপর বিশ্রাম নিচ্ছিল। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি যেন শূন্য হয়ে গেছিÑ যে গোপন কথা নিয়ে আমি এতক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করেছি, তা বসন্তের বাতাসে অদৃশ্য হয়ে গেছে, সূর্যের আলোয় জোড়ায় জোড়ায় উড়ে বেড়ানো সাদা প্রজাপতির মতো হালকাভাবে ভেসে গেছে।
তবুও আমি শেষ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কিন্তু বলো আইরিস, তোমার মতে আমার পক্ষে থামা ঠিক ছিল, নাকি ভুল?’
‘তুমি একদিকে ঠিক ছিলে এবং অন্যদিকে ভুল ছিলে। অবশ্যই তোমার থামা উচিত ছিল। মোটের ওপর, তুমি তার কাছে ছুটে গিয়েছিলে। কিন্তু, অন্যদিকে, তুমি থাকলে তার কী লাভ হতো? সে তো ততক্ষণে মারা গেছে এবং তুমি সম্ভবত একধরনের ভয়ানক পরিস্থিতিতে পড়তে। তুমি ঠিক এবং ভুল উভয়ই ছিলে।’
এ কথাগুলো বলার পর আমার মাথায় একটা চিন্তা চকিতে খেলে যায়। ‘এখানেই আইরিসের সঙ্গে শেষ। আমি আর কখনো তাকে বাইরে নিয়ে যাব না। আমি ভেবেছিলাম সে তীক্ষè, বুদ্ধিমতি, বোধগম্য মেয়ে। বরং সে আসলে অর্ধেক বুদ্ধিমতি ছাড়া আর কিছুই নয়। ঢের হয়েছে।’ আমি পায়ের ওপর দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠলাম।
আমি বললাম, ‘চলো, যাওয়া যাক। তা না হলে সিনেমার জন্য দেরি হয়ে যাবে।’
একবার থিয়েটারের অভ্যন্তরে, অন্ধকারে, সে তার হাতটি আমার হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় এবং জোর করে তার আঙ্গুল দিয়ে আমার আমার আঙ্গুল চেপে ধরে। আমি বাধা দেইনি। ছবিটি ছিল একটি প্রেমের গল্প, আবেগপ্রবণ, সত্যিকারের বিয়োগান্তক। শেষে যখন আলো জ্বলে ওঠে, তখন দেখলাম তার বড় বড় ধূসর চোখ অশ্রুতে ভরে গেছে এবং তার গাল ভেজা। ‘আমি সহ্য করতে পারি না’, সে রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলল: ‘এ ধরনের ছবি আমাকে সবসময় অশ্রুসিক্ত করে।’
তারপর আমরা একটি পানশালায় ঢুকে কফির অর্ডার করি। সে আমার এত কাছে চেপে বসে যে, আমাদের শরীর একে অন্যের সঙ্গে স্পর্শ করে। এসপ্রেসো মেশিন থেকে বাষ্প বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে সে মৃদু স্বরে বলল, ‘তুমি জানো যে, আমি তোমাকে সত্যিই পছন্দ করি, তাই না?’ তার সেই বিশাল সুন্দর চোখ দুটি আমার দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে।
আমার জবাব দিতে ইচ্ছে করছিল: ‘ঠিক আছে। তুমি সত্যিই আমাকে পছন্দ করো, কিন্তু তুমি আমাকে আমার গোপনীয়তার সমস্ত ওজন একা বহন করতে বলো!’ কিন্তু তার বদলে আমি কিছুই বলিনি।
এখন আমি বুঝতে পেরেছি যে, তার কাছ থেকে, অন্য সবার মতো, আমি কেবল স্নেহ চাইতে পারি, এর চেয়ে বেশি কিছু নয়।
আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমিও তোমাকে অনেক পছন্দ করি।’
কিন্তু ততক্ষণে সে আমার কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছে। সে পানশালার পেছনের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এবং চিবুকের ছোট্ট লাল ফুসকুড়িতে মগ্ন, উদ্বিগ্নভাবে আঙ্গুল বোলাতে থাকে।
গল্পসূত্র:
‘গোপন কথা’ গল্পটি আলবার্তো মোরাভিয়ার ইংরেজিতে ‘দ্য সেক্রেট’ গল্পের অনুবাদ। ইতালীয় ভাষা থেকে গল্পটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন হেলেনে ক্যান্তারেলা। ইংরেজিতে গল্পটি ‘দ্য আটলান্টিক’ ম্যাগাজিনে ১৯৫৮ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পরে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ফেটিশ’ ছোটগল্প সংকলনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
লেখক পরিচিতি
বিংশ শতাব্দীর অন্যতম বিশ্বনন্দিত ইতালীয় লেখক আলবার্তো মোরাভিয়া (আসল নাম আলবার্তো পিনচারলে) ১৯০৭ সালে রোমে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সাংবাদিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক এবং চলচ্চিত্র সমালোচক। তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মের মূল বিষয় মানসিক শুষ্কতা, সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, বুর্জোয়া অস্তিত্বের অবক্ষয় ও ভ-ামি, আধুনিক যৌনতা বা দাম্পত্য প্রেমের নিরর্থকতা। তাঁর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস হলো আগোস্তিনো (১৯৯৪); লা রোমানা (১৯৪৭), লা ডিসুবিদিয়েনজা (১৯৪৮), ইল কনফর্মিস্তা (১৯৫১), লা চোচারা (১৯৫৭) এবং লা নোইয়া (১৯৬০)। তাঁর ছোটগল্প সংকলনের মধ্যে রয়েছে র্যাকোন্তি রোমানি (১৯৫৪), নুওভি র্যাকোন্তি রোমানি (১৯৫৯), র্যাকোন্তি ডি আলবার্তো মোরাভিয়া (১৯৬৮), ইল পারাদিসো (১৯৭০) এবং বোহ (১৯৭৬)। লেখালেখির জন্য তিনি বেশ কয়েকটি সম্মানিত পুরস্কার লাভ করেন, যেমন ‘কোরিয়েরে লম্বার্ডো’ পুরস্কার (১৯৪৫), ‘স্ট্রেগা প্রাইজ’ (১৯৫২) এবং ‘ভিয়ারেজিও’ পুরস্কার (১৯৬১)। তাঁর অনেক বই বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। এছাড়া তাঁর অনেক উপন্যাস ও ছোটগল্পের কাহিনীর ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে, যেমন ‘টু উইমেন’, ‘দ্য কনফর্মিস্ট’, ‘বোরডোম’ এবং ‘দ্য এম্পটি ক্যানভাস’। তিনি বিশ্বব্যাপী লেখকদের সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনাল-এর সভাপতি ছিলেন (১৯৫৯-১৯৬২)। এছাড়া তিনি তুরিনে কিছু সময়ের জন্য সাংবাদিক এবং লন্ডনে বিদেশি সংবাদদাতা ছিলেন। তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন এবং তার ভ্রমণবিষয়ক লেখায় ভারত, চীন ও আফ্রিকার ব্যতিক্রমী মানের গ্রন্থ রয়েছে। তিনি ১৯৯০ সালে মারা যান।