alt

সাময়িকী

একজন গফুর মল্লিক

মুহাম্মদ বরকত আলী

: শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

যাত্রীশূন্য প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। খানখানাপুর রেলওয়ে স্টেশন, রাজবাড়ী। এখানে মাঝেমধ্যেই আসি। লেখালেখির জন্য গল্প খুঁজতে কিংবা অবসর যাপনে; যেকোনো একটা অথবা দুটোই হতে পারে। কখনো কখনো চুপচাপ একলা বসে যাত্রীদের আসা যাওয়া দেখি। আবার কখনো ইচ্ছে হলে ট্রেন ধরে কারণে কিংবা অকারণে চলে যায় অজানা গন্তব্যে। যেখানে জীবনের গল্প গিজগিজ করে। শত শত মানুষের জীবনের গল্প। আমি গল্পের মানুষ বলে সব গল্পই যে লিখতে পারব তা কিন্তু নয়। কত শত জীবনের গল্প আড়ালে আবডালে থেকে যায় তার হিসেব কি কেউ রাখে? নাকি সব জীবনের গল্প সবাই জানে? যে জীবনের গল্পগুলো সাহিত্যের শব্দে নানা রঙে রঙ লাগিয়ে পাঠকের সামনে আসে কাগজের পাতায় কালো হরফে; সে জীবনের জন্য হায় আফসোস করি, দুঃখপ্রকাশ করি। মাঝে মাঝে দুমড়ে মুচড়ে যায়। চোখের কোনে জল আসে। দীর্ঘশ^াস ফেলে বলে উঠি, আহারে জীবন। অথচ কত শত জীবনের গল্প অজানা থেকে যায়। চর্মচোখ পর্দার বাইরে থেকে যায় অসংখ্য জীবন। তাতে লাগে না সাহিত্যের রঙ, জীবনের রঙ। সাদা কালো জীবনগুলো কখনো কখনো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায় নিজেদের রাঙা পথে। সে জীবনের জন্য আফসোস করার কেউ থাকে না। ঠিক এমন-ই একটা জীবন পেয়েছি। কত সহজ-সরল, স্বাভাবিক জীবন। স্বাভাবিক দৃষ্টির খুব কাছে অথচ ভিতরে কত নিষ্ঠুর নির্মম করুণ বাস্তবতা।

গতকাল ট্রেনে উঠেছিলাম গল্পের খোঁজে। অথচ গল্পই আমাকে খুঁজে নিল। জীবন যুদ্ধের ডামাডোল বাজিয়ে কাঁপা কাঁপা সুরে গেয়ে উঠল জীবনের গান, ‘‘টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে...।” ছুটে চলেছে ট্রেন শত শত মানুষের গন্তব্যের পথ ধরে ফণা-তোলা সাপের মতো একেবেঁকে। রেললাইনের পাতের সাথে লোহার চাকার ঠকাস ঠকাস শব্দ যেন সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ। দু’পাশে সিটে বসে থাকা যাত্রীদের কেউ কিনল টেস্টি হজমি, কেউ কিনল নারকেলের নাড়–, কেউবা আবার ভাজা বাদাম। অচেনা অজানা যাত্রী তাদের প্রয়োজনে কিনল নাকি একজন বৃদ্ধকে সাহায্যের জন্য কিনতে হয় তাই কিনল; তা বোঝার মত কি সাধ্য আছে আমার? আমিতো শুধু দেখে যেতে পারি। শুনে যেতে পারি। আর পারি রঙ ঢং করে জীবনের আঁকাবাঁকা পথের খুঁচরো হিসেবগুলো তুলে ধরতে। এর চে’ বেশি সাধ থাকলেও সাধ্য নেই আমার। আন্দাজ করে এতটুকু বলতে পারি যে, দু’পয়সার যা বিক্রি হলো তাতে মনে হলো জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া বীর সেনা তিঁনি। তাঁর হয়ত এতটুকু চাওয়া। তিনবেলার দুবেলা দু’মুঠো ডাল ভাতের ব্যবস্থা হলেই খুশি।

রেলস্টেশনে এসে থামল। তিঁনিও নেমে পড়বেন বলে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমার উদ্দেশ্য যেহেতু গল্পের পিছনে ছোটা আর তাই স্বভাবত আমিও তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে পিছু নিলাম। রেল থেকে নামার সময় বুঝলাম তিনি অন্ধ। হাত বাড়িয়ে দিলাম। কাঁপা কাঁপা হাত রাখলেন আমার হাতে। খুব ধীরে নামলেন তিনি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘সম্মানিত সুধী, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ আমিও ভদ্রতার সহিত বললাম, ‘এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’ তিঁনি খুব ধীরে একটা পা সামনের দিকে বাড়ালেন। পরের পা বাড়ানোর শক্তি জোগাতে কিছুটা সময় নিলেন। বললাম, ‘আপনারতো অনেক সময় লাগে হাটতে। আর এই বয়সে এখনো ব্যবসা করছেন, কেন? আপনার কেউ নেই?’ তিঁনি মৃদু হেসে বললেন, ‘জি¦, আছে, আমার স্ত্রী আছে। আর কেউ নেই। দুজনের খাবার জোগাতে ব্যবসা তো করতেই হবে, জনাব।’

Ñ‘আপনার চোখে দেখেন না কত দিন?’

-‘জন্ম থেকেই।’

গল্প জমাতে চেষ্টা করলাম। দুজনে এগিয়ে গেলাম একটা বেঞ্চের দিকে। বেঞ্চে বসিয়ে দিলাম ওনাকে। কৌটা থেকে নারকেলের দুটো নাড়– হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে দেখুন। ভাববেন না উপকার করেছেন বলে প্রতিদান দিচ্ছি। ধরে নিন এটা ব্যবসার জন্য বিজ্ঞাপন দিলাম। এবার খেয়ে বলুন আমার এত বছরের ব্যবসার হাত কেমন?’

নাড়– নিতে আপত্তি করলাম না। কারণ এটা আমারও গল্পের বিনিয়োগ। নাড়– খেতে খেতে গল্পের সূচনা ধরে টান দিলাম।

Ñ‘অন্ধ হয়েও ব্যবসা করছেন, অনেকেই তো হাত পাতে?

-‘সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে আমার হাত, পা নিখুঁত করে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায় তাহলে মানুষের কাছে হাত পাতবো কেন?’

Ñ‘ব্যবসা শুরু করলেন কীভাবে?’

Ñ‘সে অনেক কথা। তখন আর কত হবে...।’ একটু ভেবে বললেন, ‘এগার হবে। পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। ছিল না মানে বলতে পারেন অন্য কোনো কাজ পারতাম না। অন্ধ বলে ইস্কুলের হেড মাস্টার ভর্তি নিল না। তখনও অন্ধদের পড়ার ইস্কুল চালু হয়নি। পাড়ার ছেলেরা যখন ইস্কুলে যেত আমি তখন একা একা বাড়িতে থাকতাম। আমাদের বাড়ির উঠানে একটা নারকেল গাছ ছিল। খেলার ছলনায় মাঝে মাঝে নারকেল গাছে উঠলাম। মা বকতো। আমার কাছে নারকেল গাছে ওঠা মানে এক ধরনের খেলা। একা একা খেলার এই একটাই মাধ্যম ছিল। গ্রামে অনেকেই জেনে গেল যে আমি অন্ধ হয়েও নারকেল গাছে উঠতে পারি। এটা গ্রামের মানুষের কাছে একটা বিশেষ ব্যাপার হয়ে উঠল। লোকেরা এটাকে আমার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ভাবত। আমার বেশ ভালো লাগত। একদিন সফদের চাচা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। বললেন, নারকেল গাছে উঠতে পারবি? পারবো কি পারবো নাÑ এসব সাত পাঁচ না বলে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পেরে দিলাম। আমাকে দুটো ঝুনো পাকা নারকেল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দুুটো নারকেল তোর।’ নারকেল হাতে বাড়ি ঢুকতেই মা রেগে গেলেন। বাবা বেঁচে নেই। আমার একলা ঘরে মা ছিল। সেদিন মা খুব করে বকেছিল। মাকে বললাম নারকেলের নাড়– বাড়িয়ে দিতে। দুটো নারকেলের যা নাড়– হলো তা নিয়ে বের হলাম স্টেশনে। ব্যাস, সেদিন থেকেই আমার ব্যবসা শুরু। কতজন বলেছে ভিক্ষা করতে। হাত পা থাকতে ভিক্ষা কেনে করব? এরপর থেকে নারকেল গাছে ওঠার জন্য আমার খুব নাম ডাক হলো। যার প্রয়োজন হতো ডেকে নিয়ে যেত। নারকেল পেড়ে দিতাম। বিনিময়ে নারকেল দিত। সেই নারকেল থেকে নাড়– করে স্টেশনে, ট্রেনে বিক্রি করি। বলা যায় সেই থেকে ব্যবসার পুঁজিও হলো। সাথে যুক্ত হলো টেস্টি হজমি আর বাদাম ভাজা।’ একটানা কথাগুলো বলে থামলেন।

ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল। যাত্রীরা নামবে। বেচা বিক্রি করবেন। উনি উঠে দাঁড়ালেন, ‘জনাব, আজ উঠি। বেচা বিক্রি করতে হবে’Ñ টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে? হাঁক ছেড়ে কাঁপা কাঁপা শরীরে খুব কষ্টে পা ফেলে মিলিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে।

এভাবেই আবদুল গফুর মাল্লিককে আবিষ্কার করলাম। শুরু হলো নতুন এক জীবনের গল্প।

আজ সকালে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছি। বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব নেহাত কম নয়। প্রথমে পায়ে হাটা পথ, এরপর রিক্সা পথ শেষ করে বাস ধরতে হয়। পাক্কা তিন ঘণ্টার কম না। প্ল্যাটফর্মে হারেস আলীর চায়ের দোকানে এক কাপ লাল চা সাথে এক পিচ কাটা পাউরুটি আগুনে তাতিয়ে দিতে বললাম। হারেস আলীর সাথে আমার পুরনো সম্পর্ক। সে কবিতা লেখে। ছোটকাল থেকেই কবিতা লেখে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে সাপ্তাহিক কবিতার পাতায় তার কবিতা বের হয়। সে একজন চাওয়ালা হয়েও কবিতা লিখছে আর সেই কবিতা প্রকাশ হচ্ছে দৈনিক পত্রিকার পাতায়। এজন্য তার নিজের জন্য গর্ব হয়। পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া কবিতাগুলো সংগ্রহের জন্য হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে নেয়। নিজের কবিতা কাটিং করে দোকানের এক পাশে যতœ করে দেওয়াল পত্রিকার মতো টাঙ্গিয়ে রাখে। দেওয়াল পত্রিকার শিরোনাম দিয়েছে, ‘‘একজন চাওয়ালা কবি হারেস আলীর প্রকাশিত কবিতা।’’ কোনো ট্রেনযাত্রী যদি তার দোকানে চা খেতে খেতে তার কবিতা পড়ে প্রশংসা করে তবে তার জন্য চা ফ্রী। খুশি হয়ে কবি হারেস আলী বিনয়ের সাথে বলেন, ‘‘আমার কবিতা পড়ার জইন্নি ধন্যবাদ। চায়ের দাম দিয়া লইজ্জা দিবেন না।’’ আমিও স্বভাবত প্রথম দিন তার দেওয়াল পত্রিকা থেকে পড়ে ফেলি কয়েকটা কবিতা। ব্যাস, চা ফ্রী। এই হলো কবি হারেস আলী। আর এভাবেই একদিন হারেস ও তার কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে আমার।

হারেস আলী পাউরুটির পিচটা সাইকেলের একটা পুরনো স্পোকে ঢুকিয়ে কেটলিটা নামিয়ে জ¦লন্ত আগুনে ধরল।

Ñ ‘স্যার, আইজ এত সকাল সকাল চলি আসলেন যে? গল্প কি পছন্দ হইচে? তাকে নি-ই আমি কিন্তু একটা কবিতা লিখিছি, স্যার। একটা পত্রিকায় বের হইছিল।’

হারেস আমাকে স্যার ডাকে। আমি বারবার করে বলেছি, ‘কবি হারেস আলী, আপনি আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমি কোনো অফিসের বড় বস বা কর্তাব্যক্তি নই যে আমাকে স্যার ডাকা লাগবে।’ কিন্তু কী আর করার কবি মানুষের এক কথা, ‘আপনি লেখক মানুষ, আপনাকে স্যার না ডাইকলি আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। আমি পাইরবু না, স্যার। আমাকে মাফ করি দেন।’ এরপর থেকে আর নিষেধ করিনি। এতে যদি সে আনন্দ পায় তো পাক না। মানুষকে কষ্ট দেওয়া যতটা না সহজ ঠিক ততোটাই কঠিন কাউকে আনন্দ দেওয়া। কিছু না করেই যদি কেউ আনন্দ পায় তাতে আপত্তি থাকাটা অনুচিত।

এর মধ্যেই ট্রেনের বাঁশি বেঁজে উঠল। রাজবাড়ী এক্সপ্রেস-১ এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে। শুরু হলো আগন্তুক মানুষের ওঠানামা। আজ যাত্রীসংখ্যা খুব কম। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ছাত্ররা আন্দোলন করছে। বৈষম্য বিরোধীছাত্র আন্দোলন। প্রায় সব জেলাতে ছাত্রদের আন্দোলন চলছে। কিছু কিছু জেলাতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত বন্ধ হয়েছে। যাদের খুব জরুরি তারা ছাড়া অন্যরা বের হচ্ছে না। এরই মধ্যে অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে পথ ধরে চলে এসেছে আমার গল্প আবদুল গফুর মল্লিক। এক হাতে বয়াম ভর্তি নারকেলের নাড়–, অন্য হাতে টেস্টি হজমি আর ভাজা বাদামের কিছু প্যাকেট ঝোলানো। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে এক পা দু’পা ফেলে ধীরে এগিয়ে এলেন, Ñ‘টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে?’ কবি হারেস চায়ের কাপে টুংটাং শব্দের ঝড় তুলে বলল, ‘যান স্যার, আপনার গল্প চইলি এইচে।’

চায়ের কাপটা রেখে ছুঁটে গেলাম আমার গল্পের কাছে। হাত ধরে ফাঁকা জায়গায় বুঝে টেনে নিলাম। আমার হাতের স্পর্শে তিনি বললেন, ‘কে, লেখক?’ আমি শুধু ‘হু’ উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুঝলেন কীভাবে?’

উনি কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার জন্য এযাৎকালে কেউ এভাবে অপেক্ষা করেনি। একমাত্র আপনিই অপেক্ষা করবেন সেটা জানা কথা।’

Ñ‘কেন জানা কথা? অন্য কেউ হতে পারতো।’

Ñ‘পারতো না। কারণ যে কেউ প্রথম দেখায় বুঝতে পারবে না আমি অন্ধ। আচমকা এসে হাত ধরবে না। গতকাল হারেস আপনার ব্যাপারে বলেছে আমাকে।’

উঠে পড়লেন আবদুল গফুর মল্লিক। বললেন এখন বেচাবিক্রির সময়। অনুগ্রহ করে আমাকে ছেড়ে দিন। বিকেলে কথা হবে। এই বলে চলে গেলেন যাত্রীদের মধ্যে। যদিও যাত্রীদের তেমন একটা ভিড় নেই। ফাঁকা স্টেশন আজ। প্রতিদিনের এত এত ভিড়ের মানুষগুলো হঠাৎ নাই হয়ে গেছে।

আজ সারাদিন কবি হারেসের দোকান পাহারা দিচ্ছি বলা চলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়নি। কবি হারেসের দোকানের দেওয়ালে টাঙানো কবিতা থেকে একটা একটা কবিতা পাঠ করেছি আর এজন্য কবি হারেস চা আর বিস্কুট ফ্রী দিয়েছে। স্থানীয় একটা দৈনিকে আজ একটা নতুন কবিতা প্রকাশ পেয়েছে তার। এ নিয়ে কবি হারেস পত্রিকাটা আমাকে পাঁচবার দেখিয়েছে। নিজেও বেশ কয়েকবার আবৃত্তি করে দোকানের খদ্দেরকে শুনিয়েছে। আজ যাত্রী কম থাকায় চায়ের দোকান যেন হয়ে উঠেছে সাহিত্যের স্ব-আড্ডাখানা। আড্ডাখানার কবি সে একাই। কবিরা আবেগপ্রবণ হয়। একটু সুযোগ পেলেই জমে থাকা সমস্ত আবেগ ঢেলে দেয়। কোন পাত্রে দিচ্ছে সেদিকে কোনো নজর থাকে না। প্রয়োজন নেই তার মূল্যায়ন। সে নিজেই নিজের আলোচক। তবে সমালোচনা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই। সে শুধু প্রশংসা শুনতে চায়।

পড়ন্ত বিকেল। যাত্রী শূন্য স্টেশন। দোকানে এলেন আবদুল গফুর মল্লিক। বিকেলের তীব্র রোদে উত্তাপে তাঁর অবস্থা কাহিল। হাতে থাকা নারকেলের নাড়–র অবস্থা বলে দেয় আজ বেচাবিক্রি সুবিধাজনক নয়।

Ñ‘বেচাবিক্রি কেমন হলো?’

আবদুল গফুর মল্লিক আমার গলার স্বর শুনে বললেন, ‘আপনি এখনো আছেন?’

Ñ‘জি¦। আছি।’

এবার তিনি শুকনো মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, ‘আজ বেচা বিক্রি একদম হয়নি। যাত্রী কম। আন্দোলনের জন্য ক’দিন থেকেই বেচাবিক্রি কম। তবুও টুকটাক হচ্ছিল। আজ একদম নেই বললেই চলে।’

Ñ‘দুপুরে কিছু খেয়েছেন?’

Ñ‘হ্যাঁ। আল্লাহপাক এক গ্লাস পানি খাইয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। পানি আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বড় নেয়ামত।’

কবি হারেস পত্রিকাটা মেলে ধরে বললেন, ‘চাচা, আজ আমার কবিতা ছাপানো হইছে। আপনিতো পড়তে পারবেন না। আপনার পক্ষে আমি পইড়া শুনায়। বিনিময়ে এক কাপ চা আর একখান রুটি।’

কবি হারেস আলী তার স্ব-রচিত কবিতা পাঠ করে শোনালেন। আবদুল গফুর মল্লিক নিজ কানে কবিতা শোনার বিনিময়ে পেলেন একটা রুটি সাথে এক কাপ চা।

আমার গল্পের ইতি টানতে ছুটে চলেছি জীবন গল্পের পিছে পিছে। কত শত গল্পের হাতছানি, করুণ চাহনিকে অবজ্ঞা অবহেলা করে একনাগাড়ে ছুটে চলেছি আমার গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আবদুল গফুর মল্লিকের পিছনে।

আবদুল গফুর মল্লিক ক্লান্ত শরীরে ছোট শিশুটির মতো এক পা দু পা ফেলে হেঁটে এগিয়ে গেলেন তার সুখের নীড়ে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটা সারাদিন বয়ে বেরিয়েছে নাড়–র বৈয়াম আর বাদামের প্যাকেটগুলো। বিক্রি না হওয়া নাড়– আর বাদামের প্যাকেটগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসা যে কত কষ্টের, কত বেদনার আর কত ওজনের তা সহজে বহন করা অন্ধ আবদুল গফুর মল্লিক ছাড়া মনুষ্যকুলের কোনো প্রাণ তা বুঝবে না।

অন্ধ স্বামীর অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা স্ত্রী এগিয়ে এসে নাড়–র বৈয়াম আর বাদামের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে স্বামীর ভার কিছুটা কমিয়ে দিল। অন্ধ স্বামীর চোখের আলো হয়ে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিল বাড়ির উঠান অব্দি।

নাড়– আর বাদামের অবস্থা দেখে স্ত্রী বুঝে নিল আজ বেচাবিক্রি হয়নি। স্বভাবত অন্য স্ত্রীদের মতো স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল না, কেন বেচাবিক্রি হয়নি? চাল-ডাল কই? আজ যে বাড়িতে চাল-ডাল তরিতরকারি নেইÑ সে খেয়াল কি আছে? এমন কোনো প্রশ্ন করল না স্ত্রী। ‘হাত মুখ ধুয়ে আসেন’, এতটুকু বলে ঘরে ঢুকল।

আবদুল গফুর মল্লিক হাতড়াতে হাতড়াতে টিউবওয়েল থেকে হাত মুখে পানি ছিটিয়ে এসে বসল ঘরের রোয়াকে। হাত মুখ মুছতে মুছতে হাঁক ছাড়ল স্বাভাবিক স্বরে, ‘কই গো, খেতে দাও। বড্ড খিদে পেয়েছে।’

এতক্ষণে স্বামী সেবা সব প্রস্তুতি শেষ করেছে স্ত্রী। একটা খালি প্লেট সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজের সামনে একটা প্লেট নিয়ে বসে পড়ল।

আবদুল গফুর মল্লিক শূন্য প্লেটে হাত বুলিয়ে হাওয়া ভর্তি মুষ্ঠি মুখের কাছে ধরে খাওয়ার ভঙ্গিতে মুখ নেড়ে নেড়ে জানান দিল খাদ্যের আয়োজন বেশ ভালো হয়েছে। পাশে থাকা পানির গ্লাস হাতড়ে পানি ঢাললো মুখের গহব্বরে। স্ত্রী তেমাথা হয়ে বসে হাত নেড়ে নেড়ে হাওয়া গুছিয়ে তৃপ্তির সাথে খেতে লাগল। কারো কোনো অভিমান নেই, অভিযোগ নেই।

Ñ‘আজকের খাবারটা বড়ই স্বাদ হয়েছে, বৌ।’ আবদুল গফুর মল্লিক বলল।

স্ত্রী এক গ্লাস পানি চালান করে হাত চাটতে চাটতে বলল, ‘হু।’

আবদুল গফুর মল্লিক খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আসো আল্লাহপাকের দরবারে গুনাহ মাফ চেয়ে শুকরিয়া আদায় করি।’

দুজনে আসমানের দিকে হাত তুলে ধরল।

Ñ‘হে মহান সৃষ্টিকর্তা, আপনার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। আপনার দয়ায় আমরা সুস্থ আছি। আপনার করুণায় বেঁচে আছি। আপনি আমাদের সুস্থ রাখেন। আমিন।’

স্ত্রী মাটিতে বসে পা দুখানা সামনে মেলে দিয়ে চৌকির তলা থেকে পানের বাটাটা বের করে দু’খিলি পান প্রস্তুত করে একটা নিজের মুখে গুঁজে দিল আর একটা আবদুল গফুরের দিকে এগিয়ে দিল।

ওরা দুজনের তৃপ্তির সাথে পান চিবাতে চিবাতে সারাদিনের খোশগল্পে মেতে উঠল। গল্পে উঠে এল কবি হারেসের জীবনের গল্প। যে গল্পে নেই কোনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ। এখানে সব কিছুই যেন স্বাভাবিক।

আমি শুধু আড়াল থেকে দেখে গেলাম নদীর ¯্রােতে ছুটে চলা শেওলার মতো দুটি জীবনের বয়ে চলা।

ছবি

কবিতা পড়া, কবিতা লেখা

ছবি

‘ধুলোয় সব মলিন’, পাঠকের কথা

ছবি

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কয়েকটি অনুগল্প

সাময়িকী কবিতা

ছবি

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

ছবি

জাঁ জোসেফ রাবেয়ারিভেলোর কবিতা

ছবি

সিকদার আমিনুল হকের গদ্য

ছবি

সিকদার আমিনুল হককে লেখা অগ্রজ ও খ্যাতিমান লেখক-সম্পাদকের চিঠি

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি: রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

অগ্রবীজের ‘অনুবাদ সাহিত্য’ সংখ্যা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

গোপন কথা

ছবি

র’নবীর টোকাই-কথন

ছবি

শিল্পচর্চায় তরুণ প্রজন্ম অনেক বেশি ইনোভেটিভ

ছবি

শামসুর রাহমানের কবিতা বৈভব ও বহুমাত্রিকতা

ছবি

উইলিয়াম রাদিচের অধ্যয়নে অনন্য রবীন্দ্রনাথ

দিলারা হাফিজের কবিতা

ছবি

অবরুদ্ধ বর্ণমালার শৃঙ্খলমুক্তি

ছবি

আহমদুল কবির স্মরণে

ছবি

আহমদুল কবিরের সদাশয়তা

ছবি

রবীন্দ্রসংগীতের অপাপভূমি

ছবি

স্বপ্ন অথবা বিপন্ন বিস্ময়

ছবি

রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

ছাতিম যেন হেমন্তেরই গায়ের গন্ধ

ছবি

সমরেশ মজুমদার স্মারকগ্রন্থ

ছবি

সমকালিক ঘটনাবলির রূপকার

ছবি

হেমন্ত পদাবলি

ছবি

আমার রমণীর ফল

ছবি

রূপান্তরিত

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আমেরিকার কবিতাকাশে এক স্বতন্ত্র নক্ষত্র

ছবি

কবি বেলাল চৌধুরী কাছ থেকে দেখা

ছবি

ফিওদর দস্তয়েভস্কি রুগ্ণ আত্মার কথোয়াল

ছবি

কামুর ‘দ্য স্ট্রেইঞ্জার’-এ প্রকৃতি ও সূর্য

tab

সাময়িকী

একজন গফুর মল্লিক

মুহাম্মদ বরকত আলী

শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪

যাত্রীশূন্য প্ল্যাটফর্মের বেঞ্চে বসে আছি। খানখানাপুর রেলওয়ে স্টেশন, রাজবাড়ী। এখানে মাঝেমধ্যেই আসি। লেখালেখির জন্য গল্প খুঁজতে কিংবা অবসর যাপনে; যেকোনো একটা অথবা দুটোই হতে পারে। কখনো কখনো চুপচাপ একলা বসে যাত্রীদের আসা যাওয়া দেখি। আবার কখনো ইচ্ছে হলে ট্রেন ধরে কারণে কিংবা অকারণে চলে যায় অজানা গন্তব্যে। যেখানে জীবনের গল্প গিজগিজ করে। শত শত মানুষের জীবনের গল্প। আমি গল্পের মানুষ বলে সব গল্পই যে লিখতে পারব তা কিন্তু নয়। কত শত জীবনের গল্প আড়ালে আবডালে থেকে যায় তার হিসেব কি কেউ রাখে? নাকি সব জীবনের গল্প সবাই জানে? যে জীবনের গল্পগুলো সাহিত্যের শব্দে নানা রঙে রঙ লাগিয়ে পাঠকের সামনে আসে কাগজের পাতায় কালো হরফে; সে জীবনের জন্য হায় আফসোস করি, দুঃখপ্রকাশ করি। মাঝে মাঝে দুমড়ে মুচড়ে যায়। চোখের কোনে জল আসে। দীর্ঘশ^াস ফেলে বলে উঠি, আহারে জীবন। অথচ কত শত জীবনের গল্প অজানা থেকে যায়। চর্মচোখ পর্দার বাইরে থেকে যায় অসংখ্য জীবন। তাতে লাগে না সাহিত্যের রঙ, জীবনের রঙ। সাদা কালো জীবনগুলো কখনো কখনো দেখেও না দেখার ভান করে চলে যায় নিজেদের রাঙা পথে। সে জীবনের জন্য আফসোস করার কেউ থাকে না। ঠিক এমন-ই একটা জীবন পেয়েছি। কত সহজ-সরল, স্বাভাবিক জীবন। স্বাভাবিক দৃষ্টির খুব কাছে অথচ ভিতরে কত নিষ্ঠুর নির্মম করুণ বাস্তবতা।

গতকাল ট্রেনে উঠেছিলাম গল্পের খোঁজে। অথচ গল্পই আমাকে খুঁজে নিল। জীবন যুদ্ধের ডামাডোল বাজিয়ে কাঁপা কাঁপা সুরে গেয়ে উঠল জীবনের গান, ‘‘টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে...।” ছুটে চলেছে ট্রেন শত শত মানুষের গন্তব্যের পথ ধরে ফণা-তোলা সাপের মতো একেবেঁকে। রেললাইনের পাতের সাথে লোহার চাকার ঠকাস ঠকাস শব্দ যেন সাপের ফোঁস ফোঁস শব্দ। দু’পাশে সিটে বসে থাকা যাত্রীদের কেউ কিনল টেস্টি হজমি, কেউ কিনল নারকেলের নাড়–, কেউবা আবার ভাজা বাদাম। অচেনা অজানা যাত্রী তাদের প্রয়োজনে কিনল নাকি একজন বৃদ্ধকে সাহায্যের জন্য কিনতে হয় তাই কিনল; তা বোঝার মত কি সাধ্য আছে আমার? আমিতো শুধু দেখে যেতে পারি। শুনে যেতে পারি। আর পারি রঙ ঢং করে জীবনের আঁকাবাঁকা পথের খুঁচরো হিসেবগুলো তুলে ধরতে। এর চে’ বেশি সাধ থাকলেও সাধ্য নেই আমার। আন্দাজ করে এতটুকু বলতে পারি যে, দু’পয়সার যা বিক্রি হলো তাতে মনে হলো জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়া বীর সেনা তিঁনি। তাঁর হয়ত এতটুকু চাওয়া। তিনবেলার দুবেলা দু’মুঠো ডাল ভাতের ব্যবস্থা হলেই খুশি।

রেলস্টেশনে এসে থামল। তিঁনিও নেমে পড়বেন বলে সামনে এগিয়ে গেলেন। আমার উদ্দেশ্য যেহেতু গল্পের পিছনে ছোটা আর তাই স্বভাবত আমিও তাঁর ছায়াসঙ্গী হয়ে পিছু নিলাম। রেল থেকে নামার সময় বুঝলাম তিনি অন্ধ। হাত বাড়িয়ে দিলাম। কাঁপা কাঁপা হাত রাখলেন আমার হাতে। খুব ধীরে নামলেন তিনি। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, ‘সম্মানিত সুধী, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।’ আমিও ভদ্রতার সহিত বললাম, ‘এটা আমার নৈতিক দায়িত্ব।’ তিঁনি খুব ধীরে একটা পা সামনের দিকে বাড়ালেন। পরের পা বাড়ানোর শক্তি জোগাতে কিছুটা সময় নিলেন। বললাম, ‘আপনারতো অনেক সময় লাগে হাটতে। আর এই বয়সে এখনো ব্যবসা করছেন, কেন? আপনার কেউ নেই?’ তিঁনি মৃদু হেসে বললেন, ‘জি¦, আছে, আমার স্ত্রী আছে। আর কেউ নেই। দুজনের খাবার জোগাতে ব্যবসা তো করতেই হবে, জনাব।’

Ñ‘আপনার চোখে দেখেন না কত দিন?’

-‘জন্ম থেকেই।’

গল্প জমাতে চেষ্টা করলাম। দুজনে এগিয়ে গেলাম একটা বেঞ্চের দিকে। বেঞ্চে বসিয়ে দিলাম ওনাকে। কৌটা থেকে নারকেলের দুটো নাড়– হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খেয়ে দেখুন। ভাববেন না উপকার করেছেন বলে প্রতিদান দিচ্ছি। ধরে নিন এটা ব্যবসার জন্য বিজ্ঞাপন দিলাম। এবার খেয়ে বলুন আমার এত বছরের ব্যবসার হাত কেমন?’

নাড়– নিতে আপত্তি করলাম না। কারণ এটা আমারও গল্পের বিনিয়োগ। নাড়– খেতে খেতে গল্পের সূচনা ধরে টান দিলাম।

Ñ‘অন্ধ হয়েও ব্যবসা করছেন, অনেকেই তো হাত পাতে?

-‘সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে আমার হাত, পা নিখুঁত করে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায় তাহলে মানুষের কাছে হাত পাতবো কেন?’

Ñ‘ব্যবসা শুরু করলেন কীভাবে?’

Ñ‘সে অনেক কথা। তখন আর কত হবে...।’ একটু ভেবে বললেন, ‘এগার হবে। পাড়ার ছেলেদের সাথে খেলা করা ছাড়া কোনো কাজ ছিল না। ছিল না মানে বলতে পারেন অন্য কোনো কাজ পারতাম না। অন্ধ বলে ইস্কুলের হেড মাস্টার ভর্তি নিল না। তখনও অন্ধদের পড়ার ইস্কুল চালু হয়নি। পাড়ার ছেলেরা যখন ইস্কুলে যেত আমি তখন একা একা বাড়িতে থাকতাম। আমাদের বাড়ির উঠানে একটা নারকেল গাছ ছিল। খেলার ছলনায় মাঝে মাঝে নারকেল গাছে উঠলাম। মা বকতো। আমার কাছে নারকেল গাছে ওঠা মানে এক ধরনের খেলা। একা একা খেলার এই একটাই মাধ্যম ছিল। গ্রামে অনেকেই জেনে গেল যে আমি অন্ধ হয়েও নারকেল গাছে উঠতে পারি। এটা গ্রামের মানুষের কাছে একটা বিশেষ ব্যাপার হয়ে উঠল। লোকেরা এটাকে আমার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ভাবত। আমার বেশ ভালো লাগত। একদিন সফদের চাচা আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন তার বাড়িতে। বললেন, নারকেল গাছে উঠতে পারবি? পারবো কি পারবো নাÑ এসব সাত পাঁচ না বলে নারকেল গাছে উঠে নারকেল পেরে দিলাম। আমাকে দুটো ঝুনো পাকা নারকেল হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘এই দুুটো নারকেল তোর।’ নারকেল হাতে বাড়ি ঢুকতেই মা রেগে গেলেন। বাবা বেঁচে নেই। আমার একলা ঘরে মা ছিল। সেদিন মা খুব করে বকেছিল। মাকে বললাম নারকেলের নাড়– বাড়িয়ে দিতে। দুটো নারকেলের যা নাড়– হলো তা নিয়ে বের হলাম স্টেশনে। ব্যাস, সেদিন থেকেই আমার ব্যবসা শুরু। কতজন বলেছে ভিক্ষা করতে। হাত পা থাকতে ভিক্ষা কেনে করব? এরপর থেকে নারকেল গাছে ওঠার জন্য আমার খুব নাম ডাক হলো। যার প্রয়োজন হতো ডেকে নিয়ে যেত। নারকেল পেড়ে দিতাম। বিনিময়ে নারকেল দিত। সেই নারকেল থেকে নাড়– করে স্টেশনে, ট্রেনে বিক্রি করি। বলা যায় সেই থেকে ব্যবসার পুঁজিও হলো। সাথে যুক্ত হলো টেস্টি হজমি আর বাদাম ভাজা।’ একটানা কথাগুলো বলে থামলেন।

ট্রেনের বাঁশি বেজে উঠল। যাত্রীরা নামবে। বেচা বিক্রি করবেন। উনি উঠে দাঁড়ালেন, ‘জনাব, আজ উঠি। বেচা বিক্রি করতে হবে’Ñ টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে? হাঁক ছেড়ে কাঁপা কাঁপা শরীরে খুব কষ্টে পা ফেলে মিলিয়ে গেলেন ভিড়ের মধ্যে।

এভাবেই আবদুল গফুর মাল্লিককে আবিষ্কার করলাম। শুরু হলো নতুন এক জীবনের গল্প।

আজ সকালে নাস্তা না করেই বেরিয়ে পড়েছি। বাড়ি থেকে স্টেশনের দূরত্ব নেহাত কম নয়। প্রথমে পায়ে হাটা পথ, এরপর রিক্সা পথ শেষ করে বাস ধরতে হয়। পাক্কা তিন ঘণ্টার কম না। প্ল্যাটফর্মে হারেস আলীর চায়ের দোকানে এক কাপ লাল চা সাথে এক পিচ কাটা পাউরুটি আগুনে তাতিয়ে দিতে বললাম। হারেস আলীর সাথে আমার পুরনো সম্পর্ক। সে কবিতা লেখে। ছোটকাল থেকেই কবিতা লেখে। স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে সাপ্তাহিক কবিতার পাতায় তার কবিতা বের হয়। সে একজন চাওয়ালা হয়েও কবিতা লিখছে আর সেই কবিতা প্রকাশ হচ্ছে দৈনিক পত্রিকার পাতায়। এজন্য তার নিজের জন্য গর্ব হয়। পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া কবিতাগুলো সংগ্রহের জন্য হকারের কাছ থেকে পত্রিকা কিনে নেয়। নিজের কবিতা কাটিং করে দোকানের এক পাশে যতœ করে দেওয়াল পত্রিকার মতো টাঙ্গিয়ে রাখে। দেওয়াল পত্রিকার শিরোনাম দিয়েছে, ‘‘একজন চাওয়ালা কবি হারেস আলীর প্রকাশিত কবিতা।’’ কোনো ট্রেনযাত্রী যদি তার দোকানে চা খেতে খেতে তার কবিতা পড়ে প্রশংসা করে তবে তার জন্য চা ফ্রী। খুশি হয়ে কবি হারেস আলী বিনয়ের সাথে বলেন, ‘‘আমার কবিতা পড়ার জইন্নি ধন্যবাদ। চায়ের দাম দিয়া লইজ্জা দিবেন না।’’ আমিও স্বভাবত প্রথম দিন তার দেওয়াল পত্রিকা থেকে পড়ে ফেলি কয়েকটা কবিতা। ব্যাস, চা ফ্রী। এই হলো কবি হারেস আলী। আর এভাবেই একদিন হারেস ও তার কবিতার সাথে পরিচয় ঘটে আমার।

হারেস আলী পাউরুটির পিচটা সাইকেলের একটা পুরনো স্পোকে ঢুকিয়ে কেটলিটা নামিয়ে জ¦লন্ত আগুনে ধরল।

Ñ ‘স্যার, আইজ এত সকাল সকাল চলি আসলেন যে? গল্প কি পছন্দ হইচে? তাকে নি-ই আমি কিন্তু একটা কবিতা লিখিছি, স্যার। একটা পত্রিকায় বের হইছিল।’

হারেস আমাকে স্যার ডাকে। আমি বারবার করে বলেছি, ‘কবি হারেস আলী, আপনি আমাকে স্যার ডাকবেন না। আমি কোনো অফিসের বড় বস বা কর্তাব্যক্তি নই যে আমাকে স্যার ডাকা লাগবে।’ কিন্তু কী আর করার কবি মানুষের এক কথা, ‘আপনি লেখক মানুষ, আপনাকে স্যার না ডাইকলি আমার নিজেকে অপরাধী মনে হবে। আমি পাইরবু না, স্যার। আমাকে মাফ করি দেন।’ এরপর থেকে আর নিষেধ করিনি। এতে যদি সে আনন্দ পায় তো পাক না। মানুষকে কষ্ট দেওয়া যতটা না সহজ ঠিক ততোটাই কঠিন কাউকে আনন্দ দেওয়া। কিছু না করেই যদি কেউ আনন্দ পায় তাতে আপত্তি থাকাটা অনুচিত।

এর মধ্যেই ট্রেনের বাঁশি বেঁজে উঠল। রাজবাড়ী এক্সপ্রেস-১ এসে দাঁড়াল প্ল্যাটফর্মে। শুরু হলো আগন্তুক মানুষের ওঠানামা। আজ যাত্রীসংখ্যা খুব কম। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। ছাত্ররা আন্দোলন করছে। বৈষম্য বিরোধীছাত্র আন্দোলন। প্রায় সব জেলাতে ছাত্রদের আন্দোলন চলছে। কিছু কিছু জেলাতে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়েছে। সাধারণ যাত্রীদের যাতায়াত বন্ধ হয়েছে। যাদের খুব জরুরি তারা ছাড়া অন্যরা বের হচ্ছে না। এরই মধ্যে অন্তর্দৃষ্টির সাহায্যে পথ ধরে চলে এসেছে আমার গল্প আবদুল গফুর মল্লিক। এক হাতে বয়াম ভর্তি নারকেলের নাড়–, অন্য হাতে টেস্টি হজমি আর ভাজা বাদামের কিছু প্যাকেট ঝোলানো। কাঁপা কাঁপা শরীর নিয়ে এক পা দু’পা ফেলে ধীরে এগিয়ে এলেন, Ñ‘টেস্টি হজমি, নারকেলের নাড়–, বাদাম ভাজা লাগবে?’ কবি হারেস চায়ের কাপে টুংটাং শব্দের ঝড় তুলে বলল, ‘যান স্যার, আপনার গল্প চইলি এইচে।’

চায়ের কাপটা রেখে ছুঁটে গেলাম আমার গল্পের কাছে। হাত ধরে ফাঁকা জায়গায় বুঝে টেনে নিলাম। আমার হাতের স্পর্শে তিনি বললেন, ‘কে, লেখক?’ আমি শুধু ‘হু’ উত্তর দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বুঝলেন কীভাবে?’

উনি কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললেন, ‘আমার জন্য এযাৎকালে কেউ এভাবে অপেক্ষা করেনি। একমাত্র আপনিই অপেক্ষা করবেন সেটা জানা কথা।’

Ñ‘কেন জানা কথা? অন্য কেউ হতে পারতো।’

Ñ‘পারতো না। কারণ যে কেউ প্রথম দেখায় বুঝতে পারবে না আমি অন্ধ। আচমকা এসে হাত ধরবে না। গতকাল হারেস আপনার ব্যাপারে বলেছে আমাকে।’

উঠে পড়লেন আবদুল গফুর মল্লিক। বললেন এখন বেচাবিক্রির সময়। অনুগ্রহ করে আমাকে ছেড়ে দিন। বিকেলে কথা হবে। এই বলে চলে গেলেন যাত্রীদের মধ্যে। যদিও যাত্রীদের তেমন একটা ভিড় নেই। ফাঁকা স্টেশন আজ। প্রতিদিনের এত এত ভিড়ের মানুষগুলো হঠাৎ নাই হয়ে গেছে।

আজ সারাদিন কবি হারেসের দোকান পাহারা দিচ্ছি বলা চলে। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়নি। কবি হারেসের দোকানের দেওয়ালে টাঙানো কবিতা থেকে একটা একটা কবিতা পাঠ করেছি আর এজন্য কবি হারেস চা আর বিস্কুট ফ্রী দিয়েছে। স্থানীয় একটা দৈনিকে আজ একটা নতুন কবিতা প্রকাশ পেয়েছে তার। এ নিয়ে কবি হারেস পত্রিকাটা আমাকে পাঁচবার দেখিয়েছে। নিজেও বেশ কয়েকবার আবৃত্তি করে দোকানের খদ্দেরকে শুনিয়েছে। আজ যাত্রী কম থাকায় চায়ের দোকান যেন হয়ে উঠেছে সাহিত্যের স্ব-আড্ডাখানা। আড্ডাখানার কবি সে একাই। কবিরা আবেগপ্রবণ হয়। একটু সুযোগ পেলেই জমে থাকা সমস্ত আবেগ ঢেলে দেয়। কোন পাত্রে দিচ্ছে সেদিকে কোনো নজর থাকে না। প্রয়োজন নেই তার মূল্যায়ন। সে নিজেই নিজের আলোচক। তবে সমালোচনা সহ্য করার মতো ক্ষমতা তার নেই। সে শুধু প্রশংসা শুনতে চায়।

পড়ন্ত বিকেল। যাত্রী শূন্য স্টেশন। দোকানে এলেন আবদুল গফুর মল্লিক। বিকেলের তীব্র রোদে উত্তাপে তাঁর অবস্থা কাহিল। হাতে থাকা নারকেলের নাড়–র অবস্থা বলে দেয় আজ বেচাবিক্রি সুবিধাজনক নয়।

Ñ‘বেচাবিক্রি কেমন হলো?’

আবদুল গফুর মল্লিক আমার গলার স্বর শুনে বললেন, ‘আপনি এখনো আছেন?’

Ñ‘জি¦। আছি।’

এবার তিনি শুকনো মুখে এক চিলতে হাসির রেখা ফুটিয়ে বললেন, ‘আজ বেচা বিক্রি একদম হয়নি। যাত্রী কম। আন্দোলনের জন্য ক’দিন থেকেই বেচাবিক্রি কম। তবুও টুকটাক হচ্ছিল। আজ একদম নেই বললেই চলে।’

Ñ‘দুপুরে কিছু খেয়েছেন?’

Ñ‘হ্যাঁ। আল্লাহপাক এক গ্লাস পানি খাইয়েছেন। শুকুর আলহামদুলিল্লাহ। পানি আল্লাহপাকের পক্ষ থেকে বান্দার জন্য এক বড় নেয়ামত।’

কবি হারেস পত্রিকাটা মেলে ধরে বললেন, ‘চাচা, আজ আমার কবিতা ছাপানো হইছে। আপনিতো পড়তে পারবেন না। আপনার পক্ষে আমি পইড়া শুনায়। বিনিময়ে এক কাপ চা আর একখান রুটি।’

কবি হারেস আলী তার স্ব-রচিত কবিতা পাঠ করে শোনালেন। আবদুল গফুর মল্লিক নিজ কানে কবিতা শোনার বিনিময়ে পেলেন একটা রুটি সাথে এক কাপ চা।

আমার গল্পের ইতি টানতে ছুটে চলেছি জীবন গল্পের পিছে পিছে। কত শত গল্পের হাতছানি, করুণ চাহনিকে অবজ্ঞা অবহেলা করে একনাগাড়ে ছুটে চলেছি আমার গল্পের হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা আবদুল গফুর মল্লিকের পিছনে।

আবদুল গফুর মল্লিক ক্লান্ত শরীরে ছোট শিশুটির মতো এক পা দু পা ফেলে হেঁটে এগিয়ে গেলেন তার সুখের নীড়ে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া মানুষটা সারাদিন বয়ে বেরিয়েছে নাড়–র বৈয়াম আর বাদামের প্যাকেটগুলো। বিক্রি না হওয়া নাড়– আর বাদামের প্যাকেটগুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসা যে কত কষ্টের, কত বেদনার আর কত ওজনের তা সহজে বহন করা অন্ধ আবদুল গফুর মল্লিক ছাড়া মনুষ্যকুলের কোনো প্রাণ তা বুঝবে না।

অন্ধ স্বামীর অপেক্ষায় চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা স্ত্রী এগিয়ে এসে নাড়–র বৈয়াম আর বাদামের প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে স্বামীর ভার কিছুটা কমিয়ে দিল। অন্ধ স্বামীর চোখের আলো হয়ে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিল বাড়ির উঠান অব্দি।

নাড়– আর বাদামের অবস্থা দেখে স্ত্রী বুঝে নিল আজ বেচাবিক্রি হয়নি। স্বভাবত অন্য স্ত্রীদের মতো স্বামীকে জিজ্ঞাসা করল না, কেন বেচাবিক্রি হয়নি? চাল-ডাল কই? আজ যে বাড়িতে চাল-ডাল তরিতরকারি নেইÑ সে খেয়াল কি আছে? এমন কোনো প্রশ্ন করল না স্ত্রী। ‘হাত মুখ ধুয়ে আসেন’, এতটুকু বলে ঘরে ঢুকল।

আবদুল গফুর মল্লিক হাতড়াতে হাতড়াতে টিউবওয়েল থেকে হাত মুখে পানি ছিটিয়ে এসে বসল ঘরের রোয়াকে। হাত মুখ মুছতে মুছতে হাঁক ছাড়ল স্বাভাবিক স্বরে, ‘কই গো, খেতে দাও। বড্ড খিদে পেয়েছে।’

এতক্ষণে স্বামী সেবা সব প্রস্তুতি শেষ করেছে স্ত্রী। একটা খালি প্লেট সামনে এগিয়ে দিয়ে নিজের সামনে একটা প্লেট নিয়ে বসে পড়ল।

আবদুল গফুর মল্লিক শূন্য প্লেটে হাত বুলিয়ে হাওয়া ভর্তি মুষ্ঠি মুখের কাছে ধরে খাওয়ার ভঙ্গিতে মুখ নেড়ে নেড়ে জানান দিল খাদ্যের আয়োজন বেশ ভালো হয়েছে। পাশে থাকা পানির গ্লাস হাতড়ে পানি ঢাললো মুখের গহব্বরে। স্ত্রী তেমাথা হয়ে বসে হাত নেড়ে নেড়ে হাওয়া গুছিয়ে তৃপ্তির সাথে খেতে লাগল। কারো কোনো অভিমান নেই, অভিযোগ নেই।

Ñ‘আজকের খাবারটা বড়ই স্বাদ হয়েছে, বৌ।’ আবদুল গফুর মল্লিক বলল।

স্ত্রী এক গ্লাস পানি চালান করে হাত চাটতে চাটতে বলল, ‘হু।’

আবদুল গফুর মল্লিক খাওয়া শেষ করে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলে বলল, আলহামদুলিল্লাহ। আসো আল্লাহপাকের দরবারে গুনাহ মাফ চেয়ে শুকরিয়া আদায় করি।’

দুজনে আসমানের দিকে হাত তুলে ধরল।

Ñ‘হে মহান সৃষ্টিকর্তা, আপনার দরবারে লাখো কোটি শুকরিয়া। আপনার দয়ায় আমরা সুস্থ আছি। আপনার করুণায় বেঁচে আছি। আপনি আমাদের সুস্থ রাখেন। আমিন।’

স্ত্রী মাটিতে বসে পা দুখানা সামনে মেলে দিয়ে চৌকির তলা থেকে পানের বাটাটা বের করে দু’খিলি পান প্রস্তুত করে একটা নিজের মুখে গুঁজে দিল আর একটা আবদুল গফুরের দিকে এগিয়ে দিল।

ওরা দুজনের তৃপ্তির সাথে পান চিবাতে চিবাতে সারাদিনের খোশগল্পে মেতে উঠল। গল্পে উঠে এল কবি হারেসের জীবনের গল্প। যে গল্পে নেই কোনো পাওয়া না পাওয়ার হিসেব নিকেশ। এখানে সব কিছুই যেন স্বাভাবিক।

আমি শুধু আড়াল থেকে দেখে গেলাম নদীর ¯্রােতে ছুটে চলা শেওলার মতো দুটি জীবনের বয়ে চলা।

back to top