গৌতম গুহ রায়
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দস্তয়েভস্কির কাছে নারীর ভালোবাসা ও পুরুষের ভালোবাসা ভিন্ন ধরনের। মানব চরিত্রের অদ্ভুত এই রহস্যময়তা! এই পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নের জটিল ধাঁধার উত্তর খুঁজেছেন দস্তয়েভস্কি, তাঁর সমস্ত উপন্যাসেই তিনি জটিল এই রহস্যময়তার ছায়া রেখেছেন। ‘ব্র্রাদার্স কারমাজভ’-এ দেখি, গ্রুশেংকা বাবা ও ছেলে দুজনকেই নিয়ে খেলছে। তাঁর মন সেদিনও জুড়ে আছে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক, যে তাঁকে একদিন ঠকিয়েছিলো। এদিকে কারমাজভদের বড় ভাই দিমিত্রি গ্রুশেংকাকে পাওয়ার জন্য পাগল। সে কোথাও গ্রুশেনংকাকে না পেয়ে তাঁদের বাসায় যায়, সেখানেও তাকে পায়নি। কিন্তু ওই রাতেই খুন হয় ফিওদর কার্মাজভ, দিমিত্রির বাবা। ঘটনার রাতেই দিমিত্রির সঙ্গে সংঘাত হয় বৃদ্ধ পরিচারক গ্রেগরির। রক্তাক্ত দিমিত্রি আশ্রয় নিতে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যান গ্রুশেংকার কাছে। পুলিশ যখন দিমিত্রিকে গ্রেপ্তার করে তখন গ্রুশেংকা অনুভব করে যে, তাকেই সে ভালোবাসে এবং তার এই অবস্থার জন্য সেই দায়ী। আমরা আবার ‘প্রেমের’ জটিল রহস্যময়তা নিয়ে দস্তয়েভস্কির অসাধারণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে পরিচিত হই। এর আগে আমরা দেখেছি ‘দি ইডিয়ট’ উপন্যাসে রগোজিন ভালোবাসতো নাস্তাসিয়াকে, নাস্তাসিয়া এবং আগালাইয়া দুজনেই ভালবাসতো মিশকিনকে। আমরা অন্য একটি উপন্যাসিকা ‘দি ইনসাল্টেড এন্ড হিউমিলিয়েটেড’-এ দেখি ভানিয়া ভালোবাসে নাতাশাকে, নাতাশা ভালোবাসে আলিওশাকে, আলিওশা ভালোবাসে কাতিয়াকে। এভাবে জটিল বুনন রচিত হয় তাঁর আখ্যানে। পূর্বে আলোচ্য আখ্যানের ক্লাইমেক্স পর্বে আমরা দেখি যে দিমিত্রির অন্তরের ভালোবাসার জগৎকেচিনতে পেরে গ্রুশেংকার মনে পরিতাপ জন্মে, তিনি প্রায়শ্চিত্ত করার কথা ভাবতে থাকেন। এদিকে দিমিত্রি প্রাথমিকভাবে অপরাধী সাব্যস্ত হন। দিমিত্রির কাছ থেকে পুলিশ প্রচুর অর্থ উদ্ধার করে, যে অর্থ আসলে কাতেরিনা দিয়েছিলো, যথাস্থানে পৌঁছে না দিয়ে সে সেই অর্থ নিজের কাছেই রেখেছিলো। আসলে দিমিত্রি চেয়েছিলো কাতেরিনার এই অর্থের সাহায্যে নিয়ে গ্রুশেংকাকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবে, নতুন জীবনের খোঁজে। কিন্তু এক দেউলিয়ার কাছে এতো টাকা কী করে এলো সেটাই পুলিশের কাছে বড় জিজ্ঞাসা হয়ে উঠলো এবং দিমিত্রির বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেলো। আদালতে কাতরিনা প্রথমে দিমিত্রির হয়েই সাক্ষ্য দিয়েছিলো। সেই সময় কাতারিনার ধারণা ছিলো যে ইভান দিমিত্রিকে ঈর্ষা করে এবং তাই দিমিত্রির পরিত্রাতা হতে চেয়েছে সে। সে মনে করেছিলো যে ইভান মহান, তাই সে দাদা দিমিত্রিকে বাঁচাতে নিজের কাঁধে অপরাধের দায় নিচ্ছে। এই সময় সে তাই ইভানের পক্ষে দাঁড়ায়। এদিকে দিমিত্রি যে সম্পূর্ণ নির্দোষ সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলো ইভান। ইভান জানতে পারেন যে আসল হত্যাকারী ফিওদরের অবৈধ সন্তান স্মেরদিয়াকভ। কিন্তু স্মেরদিয়াকভওই হত্যার ঘটনা স্বীকার করলেও জানান যে নৈতিক দিক থেকে এই হত্যার জন্য দায়ী ইভান, সম্পত্তির লোভে ফিওদরকে হত্যার করতে চাইছিলো ইভান, সেই টাকা চুরির দায় দিমিত্রির উপর চাপিয়ে দিতে চাইছিলো সে। স্মেরদিয়াকভ প্রকৃত সত্যটা, ইভানের ভূমিকা প্রকাশ করার পরই ইভান মনস্তাত্ত্বিকভাবে অস্থির হয়ে পড়ে, উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকে। স্মেরদিয়াকভ জানায় যে ইভানই তার মধ্যে ফিওদরকে হত্যা করার প্রেরণা সৃষ্টি করে। হত্যার রাতে পরিকল্পিতভাবেই নিজেকে সরিয়ে নেন ইভান, কারণ ইভান থাকলে সে এই হত্যা করতে পারতো না। আমরা এই উপন্যাসের এক পর্বে দেখি যে এই ইভানই আলিওশাকে শুনিয়েছিলেন ‘দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর’, অনেকের কাছেই এই পর্বটি বিশ্বসাহিত্যের রহস্যাকীর্ণ সৃজন। দস্তয়েভস্কির এই মহা-উপন্যাসের নানা অংশের প্রভাব পরবর্তীকালের অনেক মহান সাহিত্যিকের লেখায় পড়েছে। এই ‘দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর’ অংশটির প্রভাবে প্রভাবিত ফ্রান্স কাফকা লিখেছিলেন আর এক অমর সাহিত্য ‘দ্য ট্রায়াল’-এর এক রহস্যময় অধ্যায় ‘ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’।
দস্তয়েভস্কি তাঁর এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর শেষ পর্বে এক বহুস্তরীয় জটিল ঘটনা প্রবাহের নকশিকাঁথা বুনেছেন। ইভান এই উপন্যাসের প্রতিনায়ক, সে নিজের বাবাকে হত্যা করে, সেই হত্যার দায় দাদার উপর চাপিয়ে দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলো। এই ঘটনার স্বীকারোক্তির পরেই সে আত্মঘাতী হয়। আদালতে ইভান সমস্ত দোষ স্বীকার করে। সে ভেবেছিলো যে শয়তান তাকে করায়ত্ত করে রেখেছে তার কবল থেকে মুক্তির এটাই একমাত্র পথ। কিন্তু তার ফল হয় বিপরীত, সে অসুস্থ বলে আদালত তার কথাকে বিশ্বাস করে না। এদিকে আদালতে কাতলিনা একটি চিঠি পেশ করে যেখানে দিমিত্রি নেশার ঘোরে তাঁর বাবাকে, ফিওদরকে হত্যার পরিকল্পনার কথা লিখেছে। আদালত দিমিত্রিকে শাস্তি দেয়। দিমিত্রি নিজের ভুল বুঝতে পারে, নির্বাসনে যাওয়ার আগে সে কাতারিনার কাছে ক্ষমা চাইতে চায়। কিন্তু এই সময় তাঁদের মধ্যে আকস্মিকভাবে হাজির হয় গ্রুশেংকা। গ্রুশেংকা ক্ষমা করতে পারে না কাতারিনাকে।
জীবনের আলো-ছায়ার খেলার রহস্য খুঁজে বেড়ানো লেখক দস্তয়েভস্কি লক্ষ করে দেখেন যে, মানুষ তার খামখেয়ালিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসে। মানুষ মন থেকে মেনে নেয় না কোনো বিধির বিধান, নিয়মনীতি। সে চায় নিজেকেই বেঁধে রাখা যুক্তিবুদ্ধির চক্রব্যূহ থেকে বেড়িয়ে আসতে। মানুষের চরিত্রের অভ্যন্তরের এই দানবীয় প্রবণতাকে লক্ষ্য করে তার দস্যু অপর-আত্মাটিকেই বাইরে বের করে আনতে চেয়েছেন। মনে রাখতে হবে এই সময় দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে দুটো মার্মান্তিক ঘটনা, সহোদর মিখাইল ও স্ত্রী মারিয়ার মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন দস্তয়েভস্কি। শারীরিকভাবেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, মৃগীর সঙ্গে অর্শ ও ক্রনিক আমাশা একসঙ্গে তাঁকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। অর্থাভাব ও নানা অসুবিধায় ততদিনে ‘এপোখ’ বন্ধ হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় তিনি শুরু করলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ লেখা। দুবছরের মধ্যেই এটি লেখা শেষ করে ফেললেন। সেই কথায় পরে আসছি, এখন তাঁর ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’-এর কথাই বলছি।
১৮৬৮-র ডিসেম্বরে তিনি ফ্লরেন্স থেকে তাঁর লেখক বন্ধু মাইকভকে লিখেছিলেন যে তিনি ‘নাস্তিকতা’কে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখবার কথা ভাবছেন। বেশ দীর্ঘ হবে এই উপন্যাসটি, এবং এটি লিখে দেখবেন পাঠকের কেউ তাঁর ঈশ্বরের উপর আস্থা থেকে সরে আসেন কি না এবং এটি তাঁর চূড়ান্ত লেখা বা অন্তিম উপন্যাস হবে। দস্তয়েভস্কির নানা চিঠিতে আপনজনকে এই উপন্যাসের পরিকল্পনার আভাস দিয়েছিলেন। বোঝা যায় যে, এই উপন্যাসের কথা তিনি গভীরভাবে ভেবে চলছেন। কিন্তু বাস্তবে এই ‘মহা-উপন্যাস’টি লেখা শুরু করেন অনেক বছর পরে, ১৮৭৮ সনে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে লেখেন। শেষ হয় তাঁর মৃত্যুর মাস তিনেক আগে। চার খ-ে বিভক্ত, প্রতি খ-ে তিনটি পর্ব, সব মিলিয়ে এই উপন্যাসের অধ্যায় সংখ্যা প্রায় একশ, ৯৬টি। দীর্ঘ এই উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বের আলাদা আলদা নামকরণ করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া এই হত্যাকেন্দ্রিক বিপন্নতার ও আত্মজিজ্ঞাসার আখ্যানের শেষ পর্বটি পাঠককে দ্যোদুল্যমান সামাজিক নীতি অবস্থানসমূহের প্রতি জিজ্ঞাসামুখর করে তোলে, নীতির নৈতিকতা আক্রান্ত হয়। ব্যক্তির মানসিক জটিলতা দস্তয়েভস্কি কী গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন তার স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায় উপসংহারের প্রথম দুটি অধ্যায়ে। এর আগে অষ্টম পর্বে খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। নবম অধ্যায়ে সেই খুনের তদন্ত গুরু হয়। একাদশ পর্বেই ভান জানতে পারেন যে খুন দিমিত্রি নয়, স্মেরদিয়াকভ করেছে, কিন্তু করে থাকলেও পিতৃ হন্তা সে নিজে, ইভান, স্মেরদিয়াকভ মাত্র তার অস্ত্র। কারণ, ইভানের কাছে সে শিখেছে যে, আত্মাহীন ঈশ্বরবিমুখ জগতে যা খুশি করা যায়, সৎ অসৎ আপেক্ষিক বিষয় মাত্র। আবার স্মেরদিয়াকভের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার মাথা গুলিয়ে যায়, যখন সে বলে যে তাদের দুজনের মধ্যে অদৃশ্য একজন কেউ বসে থাকেন, যিনিই ঈশ্বর। সে ক্রমশ দুঃস্বপ্নের অধীনে চলে যায়, স্বপ্ন তার ‘ইভিল’ বা শত্রু হয়ে ওঠে। স্মেরদিয়াকভের আত্মহত্যাও তাঁকে অনেক জিজ্ঞাসার সামনে ফেলে দেয়, আক্রমণ করে তাঁর মানসিক স্থিতাবস্থাকে। এদিকে আমরা উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে দেখি যে কাতারিনা ইভানভনার সাক্ষ্যে দিমিত্রি দোষীও সাব্যস্ত হন। হাসপাতালের কয়েদি ওয়ার্ডে শুয়ে অসুস্থ দিমিত্রি একবার কাতেরিনাকে দেখতে চান। এই পর্বে ভালোবাসার শক্তি ওরহস্যময়তার সঙ্গে পরিচয় করান দস্তেয়ভস্কি।
ফায়ারিং স্কোয়াডের মৃত্যু ও জীবনের তীব্র্র শূন্যতা ও ত্রাসের কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা গোটা জীবন দস্তয়েভস্কিকে ভূতগ্রস্ত করে রেখেছিল। আসলে শাসক জার এই বিপ্লবীদের ‘ছদ্ম হত্যার’ নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁদের মৃত্যু ভয়ের স্বাদ দিতে চাচ্ছিলো। এমন একাধিক বাস্তব অভিজ্ঞতা যে ব্যক্তির জীবনকে বহুবর্ণে রঞ্জিত করেছে তার ছাপ তাঁর সৃজনে থাকবেই। এই ঘটনার পর দস্তয়েভস্কি সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন। এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রবল মানসিক আঘাত পান, ক্রমে মৃগী রোগাক্রান্ত হন।
গোটা জীবন এমন নানা ঘাতপ্রতিঘাতে এগোতে হয়েছে তাঁকে, যে জীবন আমাদের কাছে ‘চূড়ান্ত নাটকীয়’ বলে চিহ্নিত হবে। এমনকি, তাঁর বাবার মৃত্যুও। সম্ভবত নিজের চাকরের বা ভূমিদাসের হাতে খুন হন তিনি, প্রবল অসহিষ্ণু ও সন্দেহপ্রবণ মানুষটার মৃত্যুও পুত্রের উপর প্রভাব ফেলেছিলো। গোটা জীবন তিনি ছিলেন ‘ইভিল’ ও ‘গুড’-এর নিষ্ঠুরদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই তাই হত্যা ও মৃত্যুর উপাখ্যান। যেমন পূর্বে উল্লিখিত এই ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ উপন্যাসটি। এখানে একটা খুন হয়- পিতৃ হত্যা। তিন ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ ভাই, অবৈধ সন্তান সেই পিতার। খুন হন ভয়ানক রকমের একটি কুৎসিত চরিত্র ফিওদর কারমাজভ। আখ্যানে দেখি সমাজ ও বিচার ব্যবস্থা বড় ছেলে দিমিত্রিকে খুনী সাব্যস্ত করতে চাইছে। বিচার ব্যবস্থার কতটা পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বেচ্ছাচারী হতে পারে তা দুশ বছর আগেই দস্তয়েভস্কি লিখে গেছেন এখানে। এই উপন্যাসে উল্লিখিত পিতৃহত্যার গূঢ়ৈষণাকে মনস্তত্ত্ববিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মৃগীরোগের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁর নিজের বাবার মৃত্যুজনিত আঘাত তাঁকে গোটা জীবন বইতে হয়েছে। বন্ধু স্ত্রাখগভকে দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন যে সারা জীবন তিনি তাঁর বাবার বিভীষিকাময় মৃত্যুকে বহন করছেন, এই মৃত্যু বা হত্যার বিশ্লেষণ করে চলেছেন। আমরা দেখতে পাই মূল উপন্যাসের বাবা ফিওদর কার্মাজভের মধ্যে তাঁর নিজের বাবার চরিত্রের ছায়া প্রবেশ করিয়েছিলেন। ঘটনা ক্রমে দেখছি যে ফিওদরকে যে হত্যা করেছিল তিনিও স্নায়ু রোগের রোগী ছিলেন, মৃগী রোগের মতোই। যে মানসিক যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হন।
ফ্রাঞ্জ কাফকা দস্তয়েভস্কিকে বলেছিলেন তাঁর ‘রক্তের আত্মীয়’। কাফকার অপর জগতের ভিত্তি ছিলো দস্তয়েভস্কির মনোজগতের রহস্যময় আলো-আঁধারের নির্মম বয়ান। প্রায় চার লক্ষ শব্দের উপন্যাস এই ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’ মানুষের মনের আলো-আঁধারির এমন বহুস্তরীয় নির্মাণ। পাঠকের কাছে আবেদন, একবার, আরো একবার পড়ুন বইটি। বিশ্ব সাহিত্যের মহত্ত্বম এই কীর্তিকে। বাখতিনকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, “শিল্পের ইতিহাসে যারা মহত্ত্বম উদ্ভাবক, দস্তয়েভস্কি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শিল্পভাবনায় তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। এই ধারাই হচ্ছে পলিফনিক বা ‘বহুস্বরিক’। এই বইটি সেই বহুস্বরিক এক ‘মারাত্মক’ আখ্যান। দস্তয়েভস্কি এখানে দেখাতে চেয়েছেন শুভ ও অশুভ বোধ মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দুভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর ইংরাজি অনুবাদক রিচার্ড পেভিয়ার একে আনন্দের পাঠ বলেছেন, কিন্তু এর স্তরে স্তরে রয়েছে বিষাদ, হত্যা, অবিশ্বাস, লোভের মারাত্মক আনন্দহীনতার আখ্যান। বইটিতে নানা বিভাগে বহুস্তরীয় স্বর উচ্চকিত, লেখক বা কথকের স্বর ছাপিয়ে গেছে সেই স্বর। ‘ব্র্রাদারস কার্মাজভ’ উপন্যাসে ঘটে যাওয়া পিতৃ হত্যার সঙ্গে দস্তয়েভস্কির বাবার শোচনীয় মৃত্যু বা হত্যার ঘটনা, তাঁর মৃগীরোগের যোগাযোগের ব্যাপারটি মনস্তত্ত্বের দার্শনিক ফ্রয়েডের নজর এড়ায়নি। ফ্রয়েড তাঁর ‘দস্তয়েভস্কি ও স্বর্গোদ্যান’ প্রবন্ধে এই নিয়ে আলোচনা করেন। “তখন তাঁর বয়স আঠারো। অর্থাৎ বালক ফিওদর একজন স্বৈরাচারী ব্যক্তির মৃত্যুর প্রত্যাশায় ছিল, আর সেই ঘৃণিত ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয়- তারই জন্মদাতা পিতা। সেই আকাক্সিক্ষত ঘটনাটি যখন সংঘটিত হয় তখন নিজের হাতে তা না ঘটালেও একটা অপরাধবোধ তার মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে।” (শিল্প যখন আত্মকথন/অরুণ সোম)
দস্তয়েভস্কিকে পক্ষে ও বিপক্ষে সাহিত্য সমালোচকদের আক্রমণ ও প্রশংসা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ডব্র্রোলেউবভ-এর মতো আলোচকেরা তাঁর মানুষের প্রতি সামাজিক দুঃখবোধ ও করুণাকে স্বাগত জানালেও তাঁর উপন্যাসের শিল্পগুণকে অভিনন্দিত করতে চান নি। দিমিত্রি পিসারভ-এর মতো সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেছিলেন ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসে বিপ্লবীদের আক্রমণ করা হয়েছে। দস্তয়েভস্কির মানবতার ও শৈল্পিক শক্তির প্রশংসা করলেও তাঁর নিহিলিজমবিরোধী বার্তা প্রতিহত করতে চান, যুক্তি ছিল এই যে রাসকলনিকভের তত্ত্বসমূহ তৎকালীন বিপ্লবী তরুণদের সঙ্গে একেবারেই মেলে না এবং ‘রাসকলনিকভের রুগ্ণতার শেকড় মগজে নয়, পকেটেই ছিল’। রাশিয়ার তৎকালীন র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবীরা দস্তয়েভস্কির বিরুদ্ধে চলে যান, বিখ্যাত পপুলিস্ট নিকলে মিখাইলোভস্কি (১৮৪২-১৯০৪) বলেছিলেন, ‘দস্তয়েভস্কি এক নিষ্ঠুর প্রতিভা, এক স্যাডিস্ট, যিনি নিগ্রহ উপভোগ করেন, প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থা তৈরি করে অত্যাচারকারী ও অত্যাচারীদের।”
সামাজিক ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন দস্তয়েভস্কিকে অশান্ত করতো। এই সময়ই তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সাহিত্য আলোচক আলেকজান্দার এ গ্রিগরিয়েভের। বড় ভাই মিখাইলকে নিয়ে তাঁরা দুজনে মিলে প্রকাশ করতে শুরু করেন ‘ভ্র্যমিয়া’ বা ‘সময়’ নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকায় তিনি ও তাঁর সাথীরা সেই সময়ের ঘটানসমূহের উপর বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখতে থাকেন। ১৯৬২তে এই ‘ভ্র্যমিয়া’তেই প্রকাশিত হয়েছিলো দস্তয়েভস্কির প্রধান উপন্যাস ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত’-র প্রথম কিস্তি। এই সময় লেখালেখির জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন দস্তয়েভস্কি, প্রতিদিন গড়ে ৫০ পৃষ্ঠা লিখতে হতো তাঁকে। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘হাউস অভ দ্য ডেড’ নভেলটি। দস্তয়েভস্কি এই কাগজে খোলাখুলি তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে লিখেছিলেন যে, সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত দেশজ জাতীয় সংস্কৃতির উপর। সামাজিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাচীন ভূমিদাস প্রথা সম্পূর্ণভাবে সমাজ থেকে তুলে ফেলা উচিৎ। সমাজে ক্রমশ জাকিয়ে বসা অভিজাত শ্রেণি ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রোধ করা দরকার। দস্তয়েভস্কি ও তাঁর সাথী গ্রিগোরিয়েভ বা দার্শনিক সাথী নিকোলাই স্ত্রাখভেরা ভেবেছিলেন যে রাশিয়ার নিজস্ব রাস্তায় তার সামাজিক বিকাশ ঘটলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের নেতিবাচক দিকগুলো, পুঁজিবাদের অমনাবিক ও নির্মম আগ্রাসী চেহারা রাশিয়া এড়াতে পারবে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকার এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের আলোচনা ও সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে ১৮৬৩তে ‘ভ্র্যমিয়া’ নিষিদ্ধ করে দেয়। এই সময়ই দস্তয়েভস্কি বিদেশ ভ্রমণে যান। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালিতে ঘুরে বেড়ান। এই যাত্রাতেই ফ্রান্সের পলিনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দেশে ফিরে আসার পর ১৮৬৪তে সরকারি অনুমতি মিললে দুই ভাই এরপর প্রকাশ করেন ‘ঈপক’ বা এপোখ নামে আর একটি পত্রিকা, এপোখ মানে যুগ। এরপর দস্তয়েভস্কির জীবনে আবার আঘাত নেমে আসে। দু বছরের মধ্যেই মারা যান স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভানা। এর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর সাথী ও ভাই মিখাইল দস্তয়েভস্কি। বড় ভাই মিখাইলের মৃত্যুর পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় আর্থিক ও পারিবারিক চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর্থিক চাপটাও অসহনীয় হয়ে ওঠে, প্রথমা স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে পাশা, দাদা মিখাইলের পরিবার এবং অন্যান্য পারিবারিক দায়িত্ব পালনের চাপ তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে। (চলবে)
গৌতম গুহ রায়
শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪
(পূর্ব প্রকাশের পর)
দস্তয়েভস্কির কাছে নারীর ভালোবাসা ও পুরুষের ভালোবাসা ভিন্ন ধরনের। মানব চরিত্রের অদ্ভুত এই রহস্যময়তা! এই পারস্পরিক সম্পর্কের রসায়নের জটিল ধাঁধার উত্তর খুঁজেছেন দস্তয়েভস্কি, তাঁর সমস্ত উপন্যাসেই তিনি জটিল এই রহস্যময়তার ছায়া রেখেছেন। ‘ব্র্রাদার্স কারমাজভ’-এ দেখি, গ্রুশেংকা বাবা ও ছেলে দুজনকেই নিয়ে খেলছে। তাঁর মন সেদিনও জুড়ে আছে তাঁর প্রাক্তন প্রেমিক, যে তাঁকে একদিন ঠকিয়েছিলো। এদিকে কারমাজভদের বড় ভাই দিমিত্রি গ্রুশেংকাকে পাওয়ার জন্য পাগল। সে কোথাও গ্রুশেনংকাকে না পেয়ে তাঁদের বাসায় যায়, সেখানেও তাকে পায়নি। কিন্তু ওই রাতেই খুন হয় ফিওদর কার্মাজভ, দিমিত্রির বাবা। ঘটনার রাতেই দিমিত্রির সঙ্গে সংঘাত হয় বৃদ্ধ পরিচারক গ্রেগরির। রক্তাক্ত দিমিত্রি আশ্রয় নিতে দিগি¦দিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটে যান গ্রুশেংকার কাছে। পুলিশ যখন দিমিত্রিকে গ্রেপ্তার করে তখন গ্রুশেংকা অনুভব করে যে, তাকেই সে ভালোবাসে এবং তার এই অবস্থার জন্য সেই দায়ী। আমরা আবার ‘প্রেমের’ জটিল রহস্যময়তা নিয়ে দস্তয়েভস্কির অসাধারণ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে পরিচিত হই। এর আগে আমরা দেখেছি ‘দি ইডিয়ট’ উপন্যাসে রগোজিন ভালোবাসতো নাস্তাসিয়াকে, নাস্তাসিয়া এবং আগালাইয়া দুজনেই ভালবাসতো মিশকিনকে। আমরা অন্য একটি উপন্যাসিকা ‘দি ইনসাল্টেড এন্ড হিউমিলিয়েটেড’-এ দেখি ভানিয়া ভালোবাসে নাতাশাকে, নাতাশা ভালোবাসে আলিওশাকে, আলিওশা ভালোবাসে কাতিয়াকে। এভাবে জটিল বুনন রচিত হয় তাঁর আখ্যানে। পূর্বে আলোচ্য আখ্যানের ক্লাইমেক্স পর্বে আমরা দেখি যে দিমিত্রির অন্তরের ভালোবাসার জগৎকেচিনতে পেরে গ্রুশেংকার মনে পরিতাপ জন্মে, তিনি প্রায়শ্চিত্ত করার কথা ভাবতে থাকেন। এদিকে দিমিত্রি প্রাথমিকভাবে অপরাধী সাব্যস্ত হন। দিমিত্রির কাছ থেকে পুলিশ প্রচুর অর্থ উদ্ধার করে, যে অর্থ আসলে কাতেরিনা দিয়েছিলো, যথাস্থানে পৌঁছে না দিয়ে সে সেই অর্থ নিজের কাছেই রেখেছিলো। আসলে দিমিত্রি চেয়েছিলো কাতেরিনার এই অর্থের সাহায্যে নিয়ে গ্রুশেংকাকে নিয়ে সে পালিয়ে যাবে, নতুন জীবনের খোঁজে। কিন্তু এক দেউলিয়ার কাছে এতো টাকা কী করে এলো সেটাই পুলিশের কাছে বড় জিজ্ঞাসা হয়ে উঠলো এবং দিমিত্রির বিরুদ্ধে অপরাধের প্রমাণ হিসাবে দাঁড়িয়ে গেলো। আদালতে কাতরিনা প্রথমে দিমিত্রির হয়েই সাক্ষ্য দিয়েছিলো। সেই সময় কাতারিনার ধারণা ছিলো যে ইভান দিমিত্রিকে ঈর্ষা করে এবং তাই দিমিত্রির পরিত্রাতা হতে চেয়েছে সে। সে মনে করেছিলো যে ইভান মহান, তাই সে দাদা দিমিত্রিকে বাঁচাতে নিজের কাঁধে অপরাধের দায় নিচ্ছে। এই সময় সে তাই ইভানের পক্ষে দাঁড়ায়। এদিকে দিমিত্রি যে সম্পূর্ণ নির্দোষ সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়েছিলো ইভান। ইভান জানতে পারেন যে আসল হত্যাকারী ফিওদরের অবৈধ সন্তান স্মেরদিয়াকভ। কিন্তু স্মেরদিয়াকভওই হত্যার ঘটনা স্বীকার করলেও জানান যে নৈতিক দিক থেকে এই হত্যার জন্য দায়ী ইভান, সম্পত্তির লোভে ফিওদরকে হত্যার করতে চাইছিলো ইভান, সেই টাকা চুরির দায় দিমিত্রির উপর চাপিয়ে দিতে চাইছিলো সে। স্মেরদিয়াকভ প্রকৃত সত্যটা, ইভানের ভূমিকা প্রকাশ করার পরই ইভান মনস্তাত্ত্বিকভাবে অস্থির হয়ে পড়ে, উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকে। স্মেরদিয়াকভ জানায় যে ইভানই তার মধ্যে ফিওদরকে হত্যা করার প্রেরণা সৃষ্টি করে। হত্যার রাতে পরিকল্পিতভাবেই নিজেকে সরিয়ে নেন ইভান, কারণ ইভান থাকলে সে এই হত্যা করতে পারতো না। আমরা এই উপন্যাসের এক পর্বে দেখি যে এই ইভানই আলিওশাকে শুনিয়েছিলেন ‘দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর’, অনেকের কাছেই এই পর্বটি বিশ্বসাহিত্যের রহস্যাকীর্ণ সৃজন। দস্তয়েভস্কির এই মহা-উপন্যাসের নানা অংশের প্রভাব পরবর্তীকালের অনেক মহান সাহিত্যিকের লেখায় পড়েছে। এই ‘দ্য গ্রান্ড ইনকুইজিটর’ অংশটির প্রভাবে প্রভাবিত ফ্রান্স কাফকা লিখেছিলেন আর এক অমর সাহিত্য ‘দ্য ট্রায়াল’-এর এক রহস্যময় অধ্যায় ‘ইন দ্য ক্যাথিড্রাল’।
দস্তয়েভস্কি তাঁর এই জটিল মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর শেষ পর্বে এক বহুস্তরীয় জটিল ঘটনা প্রবাহের নকশিকাঁথা বুনেছেন। ইভান এই উপন্যাসের প্রতিনায়ক, সে নিজের বাবাকে হত্যা করে, সেই হত্যার দায় দাদার উপর চাপিয়ে দিয়ে অর্থ আত্মসাৎ করতে চেয়েছিলো। এই ঘটনার স্বীকারোক্তির পরেই সে আত্মঘাতী হয়। আদালতে ইভান সমস্ত দোষ স্বীকার করে। সে ভেবেছিলো যে শয়তান তাকে করায়ত্ত করে রেখেছে তার কবল থেকে মুক্তির এটাই একমাত্র পথ। কিন্তু তার ফল হয় বিপরীত, সে অসুস্থ বলে আদালত তার কথাকে বিশ্বাস করে না। এদিকে আদালতে কাতলিনা একটি চিঠি পেশ করে যেখানে দিমিত্রি নেশার ঘোরে তাঁর বাবাকে, ফিওদরকে হত্যার পরিকল্পনার কথা লিখেছে। আদালত দিমিত্রিকে শাস্তি দেয়। দিমিত্রি নিজের ভুল বুঝতে পারে, নির্বাসনে যাওয়ার আগে সে কাতারিনার কাছে ক্ষমা চাইতে চায়। কিন্তু এই সময় তাঁদের মধ্যে আকস্মিকভাবে হাজির হয় গ্রুশেংকা। গ্রুশেংকা ক্ষমা করতে পারে না কাতারিনাকে।
জীবনের আলো-ছায়ার খেলার রহস্য খুঁজে বেড়ানো লেখক দস্তয়েভস্কি লক্ষ করে দেখেন যে, মানুষ তার খামখেয়ালিকে প্রশ্রয় দিতে ভালোবাসে। মানুষ মন থেকে মেনে নেয় না কোনো বিধির বিধান, নিয়মনীতি। সে চায় নিজেকেই বেঁধে রাখা যুক্তিবুদ্ধির চক্রব্যূহ থেকে বেড়িয়ে আসতে। মানুষের চরিত্রের অভ্যন্তরের এই দানবীয় প্রবণতাকে লক্ষ্য করে তার দস্যু অপর-আত্মাটিকেই বাইরে বের করে আনতে চেয়েছেন। মনে রাখতে হবে এই সময় দস্তয়েভস্কির ব্যক্তি জীবনে দুটো মার্মান্তিক ঘটনা, সহোদর মিখাইল ও স্ত্রী মারিয়ার মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। একেবারে ভেঙ্গে পড়লেন দস্তয়েভস্কি। শারীরিকভাবেও গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, মৃগীর সঙ্গে অর্শ ও ক্রনিক আমাশা একসঙ্গে তাঁকে বিপর্যস্ত করে ফেলে। অর্থাভাব ও নানা অসুবিধায় ততদিনে ‘এপোখ’ বন্ধ হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় তিনি শুরু করলেন কালজয়ী উপন্যাস ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ লেখা। দুবছরের মধ্যেই এটি লেখা শেষ করে ফেললেন। সেই কথায় পরে আসছি, এখন তাঁর ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’-এর কথাই বলছি।
১৮৬৮-র ডিসেম্বরে তিনি ফ্লরেন্স থেকে তাঁর লেখক বন্ধু মাইকভকে লিখেছিলেন যে তিনি ‘নাস্তিকতা’কে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখবার কথা ভাবছেন। বেশ দীর্ঘ হবে এই উপন্যাসটি, এবং এটি লিখে দেখবেন পাঠকের কেউ তাঁর ঈশ্বরের উপর আস্থা থেকে সরে আসেন কি না এবং এটি তাঁর চূড়ান্ত লেখা বা অন্তিম উপন্যাস হবে। দস্তয়েভস্কির নানা চিঠিতে আপনজনকে এই উপন্যাসের পরিকল্পনার আভাস দিয়েছিলেন। বোঝা যায় যে, এই উপন্যাসের কথা তিনি গভীরভাবে ভেবে চলছেন। কিন্তু বাস্তবে এই ‘মহা-উপন্যাস’টি লেখা শুরু করেন অনেক বছর পরে, ১৮৭৮ সনে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে লেখেন। শেষ হয় তাঁর মৃত্যুর মাস তিনেক আগে। চার খ-ে বিভক্ত, প্রতি খ-ে তিনটি পর্ব, সব মিলিয়ে এই উপন্যাসের অধ্যায় সংখ্যা প্রায় একশ, ৯৬টি। দীর্ঘ এই উপন্যাসটির প্রতিটি পর্বের আলাদা আলদা নামকরণ করেছেন লেখক। ধীরে ধীরে এগিয়ে যাওয়া এই হত্যাকেন্দ্রিক বিপন্নতার ও আত্মজিজ্ঞাসার আখ্যানের শেষ পর্বটি পাঠককে দ্যোদুল্যমান সামাজিক নীতি অবস্থানসমূহের প্রতি জিজ্ঞাসামুখর করে তোলে, নীতির নৈতিকতা আক্রান্ত হয়। ব্যক্তির মানসিক জটিলতা দস্তয়েভস্কি কী গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন তার স্বাক্ষর দেখতে পাওয়া যায় উপসংহারের প্রথম দুটি অধ্যায়ে। এর আগে অষ্টম পর্বে খুনের ঘটনা ঘটে গেছে। নবম অধ্যায়ে সেই খুনের তদন্ত গুরু হয়। একাদশ পর্বেই ভান জানতে পারেন যে খুন দিমিত্রি নয়, স্মেরদিয়াকভ করেছে, কিন্তু করে থাকলেও পিতৃ হন্তা সে নিজে, ইভান, স্মেরদিয়াকভ মাত্র তার অস্ত্র। কারণ, ইভানের কাছে সে শিখেছে যে, আত্মাহীন ঈশ্বরবিমুখ জগতে যা খুশি করা যায়, সৎ অসৎ আপেক্ষিক বিষয় মাত্র। আবার স্মেরদিয়াকভের সঙ্গে সাক্ষাৎ হলে তার মাথা গুলিয়ে যায়, যখন সে বলে যে তাদের দুজনের মধ্যে অদৃশ্য একজন কেউ বসে থাকেন, যিনিই ঈশ্বর। সে ক্রমশ দুঃস্বপ্নের অধীনে চলে যায়, স্বপ্ন তার ‘ইভিল’ বা শত্রু হয়ে ওঠে। স্মেরদিয়াকভের আত্মহত্যাও তাঁকে অনেক জিজ্ঞাসার সামনে ফেলে দেয়, আক্রমণ করে তাঁর মানসিক স্থিতাবস্থাকে। এদিকে আমরা উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে দেখি যে কাতারিনা ইভানভনার সাক্ষ্যে দিমিত্রি দোষীও সাব্যস্ত হন। হাসপাতালের কয়েদি ওয়ার্ডে শুয়ে অসুস্থ দিমিত্রি একবার কাতেরিনাকে দেখতে চান। এই পর্বে ভালোবাসার শক্তি ওরহস্যময়তার সঙ্গে পরিচয় করান দস্তেয়ভস্কি।
ফায়ারিং স্কোয়াডের মৃত্যু ও জীবনের তীব্র্র শূন্যতা ও ত্রাসের কয়েক ঘণ্টার অভিজ্ঞতা গোটা জীবন দস্তয়েভস্কিকে ভূতগ্রস্ত করে রেখেছিল। আসলে শাসক জার এই বিপ্লবীদের ‘ছদ্ম হত্যার’ নাটকের মধ্য দিয়ে তাঁদের মৃত্যু ভয়ের স্বাদ দিতে চাচ্ছিলো। এমন একাধিক বাস্তব অভিজ্ঞতা যে ব্যক্তির জীবনকে বহুবর্ণে রঞ্জিত করেছে তার ছাপ তাঁর সৃজনে থাকবেই। এই ঘটনার পর দস্তয়েভস্কি সাইবেরিয়ায় নির্বাসিত হন। এই ভয়ানক অভিজ্ঞতার প্রতিক্রিয়ায় তিনি প্রবল মানসিক আঘাত পান, ক্রমে মৃগী রোগাক্রান্ত হন।
গোটা জীবন এমন নানা ঘাতপ্রতিঘাতে এগোতে হয়েছে তাঁকে, যে জীবন আমাদের কাছে ‘চূড়ান্ত নাটকীয়’ বলে চিহ্নিত হবে। এমনকি, তাঁর বাবার মৃত্যুও। সম্ভবত নিজের চাকরের বা ভূমিদাসের হাতে খুন হন তিনি, প্রবল অসহিষ্ণু ও সন্দেহপ্রবণ মানুষটার মৃত্যুও পুত্রের উপর প্রভাব ফেলেছিলো। গোটা জীবন তিনি ছিলেন ‘ইভিল’ ও ‘গুড’-এর নিষ্ঠুরদ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত। তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই তাই হত্যা ও মৃত্যুর উপাখ্যান। যেমন পূর্বে উল্লিখিত এই ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’ উপন্যাসটি। এখানে একটা খুন হয়- পিতৃ হত্যা। তিন ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ ভাই, অবৈধ সন্তান সেই পিতার। খুন হন ভয়ানক রকমের একটি কুৎসিত চরিত্র ফিওদর কারমাজভ। আখ্যানে দেখি সমাজ ও বিচার ব্যবস্থা বড় ছেলে দিমিত্রিকে খুনী সাব্যস্ত করতে চাইছে। বিচার ব্যবস্থার কতটা পক্ষপাতদুষ্ট ও স্বেচ্ছাচারী হতে পারে তা দুশ বছর আগেই দস্তয়েভস্কি লিখে গেছেন এখানে। এই উপন্যাসে উল্লিখিত পিতৃহত্যার গূঢ়ৈষণাকে মনস্তত্ত্ববিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড তাঁর মৃগীরোগের কারণ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে তাঁর নিজের বাবার মৃত্যুজনিত আঘাত তাঁকে গোটা জীবন বইতে হয়েছে। বন্ধু স্ত্রাখগভকে দস্তয়েভস্কি বলেছিলেন যে সারা জীবন তিনি তাঁর বাবার বিভীষিকাময় মৃত্যুকে বহন করছেন, এই মৃত্যু বা হত্যার বিশ্লেষণ করে চলেছেন। আমরা দেখতে পাই মূল উপন্যাসের বাবা ফিওদর কার্মাজভের মধ্যে তাঁর নিজের বাবার চরিত্রের ছায়া প্রবেশ করিয়েছিলেন। ঘটনা ক্রমে দেখছি যে ফিওদরকে যে হত্যা করেছিল তিনিও স্নায়ু রোগের রোগী ছিলেন, মৃগী রোগের মতোই। যে মানসিক যন্ত্রণায় শেষ পর্যন্ত আত্মঘাতী হন।
ফ্রাঞ্জ কাফকা দস্তয়েভস্কিকে বলেছিলেন তাঁর ‘রক্তের আত্মীয়’। কাফকার অপর জগতের ভিত্তি ছিলো দস্তয়েভস্কির মনোজগতের রহস্যময় আলো-আঁধারের নির্মম বয়ান। প্রায় চার লক্ষ শব্দের উপন্যাস এই ‘ব্র্রাদার কারমাজভ’ মানুষের মনের আলো-আঁধারির এমন বহুস্তরীয় নির্মাণ। পাঠকের কাছে আবেদন, একবার, আরো একবার পড়ুন বইটি। বিশ্ব সাহিত্যের মহত্ত্বম এই কীর্তিকে। বাখতিনকে উদ্ধৃত করে বলা যায়, “শিল্পের ইতিহাসে যারা মহত্ত্বম উদ্ভাবক, দস্তয়েভস্কি তাঁদের মধ্যে অন্যতম। শিল্পভাবনায় তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দিয়েছিলেন। এই ধারাই হচ্ছে পলিফনিক বা ‘বহুস্বরিক’। এই বইটি সেই বহুস্বরিক এক ‘মারাত্মক’ আখ্যান। দস্তয়েভস্কি এখানে দেখাতে চেয়েছেন শুভ ও অশুভ বোধ মানুষের মধ্যে একই সঙ্গে দুভাবে আত্মপ্রকাশ করে ‘ব্র্রাদারস কারমাজভ’-এর ইংরাজি অনুবাদক রিচার্ড পেভিয়ার একে আনন্দের পাঠ বলেছেন, কিন্তু এর স্তরে স্তরে রয়েছে বিষাদ, হত্যা, অবিশ্বাস, লোভের মারাত্মক আনন্দহীনতার আখ্যান। বইটিতে নানা বিভাগে বহুস্তরীয় স্বর উচ্চকিত, লেখক বা কথকের স্বর ছাপিয়ে গেছে সেই স্বর। ‘ব্র্রাদারস কার্মাজভ’ উপন্যাসে ঘটে যাওয়া পিতৃ হত্যার সঙ্গে দস্তয়েভস্কির বাবার শোচনীয় মৃত্যু বা হত্যার ঘটনা, তাঁর মৃগীরোগের যোগাযোগের ব্যাপারটি মনস্তত্ত্বের দার্শনিক ফ্রয়েডের নজর এড়ায়নি। ফ্রয়েড তাঁর ‘দস্তয়েভস্কি ও স্বর্গোদ্যান’ প্রবন্ধে এই নিয়ে আলোচনা করেন। “তখন তাঁর বয়স আঠারো। অর্থাৎ বালক ফিওদর একজন স্বৈরাচারী ব্যক্তির মৃত্যুর প্রত্যাশায় ছিল, আর সেই ঘৃণিত ব্যক্তিটি অন্য কেউ নয়- তারই জন্মদাতা পিতা। সেই আকাক্সিক্ষত ঘটনাটি যখন সংঘটিত হয় তখন নিজের হাতে তা না ঘটালেও একটা অপরাধবোধ তার মনের মধ্যে বাসা বাঁধতে পারে।” (শিল্প যখন আত্মকথন/অরুণ সোম)
দস্তয়েভস্কিকে পক্ষে ও বিপক্ষে সাহিত্য সমালোচকদের আক্রমণ ও প্রশংসা মোকাবিলা করতে হয়েছে। ডব্র্রোলেউবভ-এর মতো আলোচকেরা তাঁর মানুষের প্রতি সামাজিক দুঃখবোধ ও করুণাকে স্বাগত জানালেও তাঁর উপন্যাসের শিল্পগুণকে অভিনন্দিত করতে চান নি। দিমিত্রি পিসারভ-এর মতো সাহিত্য সমালোচকেরা মনে করেছিলেন ‘ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট’ উপন্যাসে বিপ্লবীদের আক্রমণ করা হয়েছে। দস্তয়েভস্কির মানবতার ও শৈল্পিক শক্তির প্রশংসা করলেও তাঁর নিহিলিজমবিরোধী বার্তা প্রতিহত করতে চান, যুক্তি ছিল এই যে রাসকলনিকভের তত্ত্বসমূহ তৎকালীন বিপ্লবী তরুণদের সঙ্গে একেবারেই মেলে না এবং ‘রাসকলনিকভের রুগ্ণতার শেকড় মগজে নয়, পকেটেই ছিল’। রাশিয়ার তৎকালীন র্যাডিক্যাল বুদ্ধিজীবীরা দস্তয়েভস্কির বিরুদ্ধে চলে যান, বিখ্যাত পপুলিস্ট নিকলে মিখাইলোভস্কি (১৮৪২-১৯০৪) বলেছিলেন, ‘দস্তয়েভস্কি এক নিষ্ঠুর প্রতিভা, এক স্যাডিস্ট, যিনি নিগ্রহ উপভোগ করেন, প্রচলিত ব্যবস্থার সমর্থক, যে ব্যবস্থা তৈরি করে অত্যাচারকারী ও অত্যাচারীদের।”
সামাজিক ও রাজনৈতিক দমন-পীড়ন দস্তয়েভস্কিকে অশান্ত করতো। এই সময়ই তাঁর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় সাহিত্য আলোচক আলেকজান্দার এ গ্রিগরিয়েভের। বড় ভাই মিখাইলকে নিয়ে তাঁরা দুজনে মিলে প্রকাশ করতে শুরু করেন ‘ভ্র্যমিয়া’ বা ‘সময়’ নামে একটি পত্রিকা। এই পত্রিকায় তিনি ও তাঁর সাথীরা সেই সময়ের ঘটানসমূহের উপর বিশ্লেষণাত্মক লেখা লিখতে থাকেন। ১৯৬২তে এই ‘ভ্র্যমিয়া’তেই প্রকাশিত হয়েছিলো দস্তয়েভস্কির প্রধান উপন্যাস ‘লাঞ্ছিত নিপীড়িত’-র প্রথম কিস্তি। এই সময় লেখালেখির জন্য অসম্ভব পরিশ্রম করতেন দস্তয়েভস্কি, প্রতিদিন গড়ে ৫০ পৃষ্ঠা লিখতে হতো তাঁকে। এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত হয়েছিল তাঁর ‘হাউস অভ দ্য ডেড’ নভেলটি। দস্তয়েভস্কি এই কাগজে খোলাখুলি তাঁর অভিমত ব্যক্ত করে লিখেছিলেন যে, সমকালীন রাজনৈতিক আন্দোলনের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত দেশজ জাতীয় সংস্কৃতির উপর। সামাজিকভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত প্রাচীন ভূমিদাস প্রথা সম্পূর্ণভাবে সমাজ থেকে তুলে ফেলা উচিৎ। সমাজে ক্রমশ জাকিয়ে বসা অভিজাত শ্রেণি ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে রোধ করা দরকার। দস্তয়েভস্কি ও তাঁর সাথী গ্রিগোরিয়েভ বা দার্শনিক সাথী নিকোলাই স্ত্রাখভেরা ভেবেছিলেন যে রাশিয়ার নিজস্ব রাস্তায় তার সামাজিক বিকাশ ঘটলে পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে ঘটে যাওয়া বিপ্লবের নেতিবাচক দিকগুলো, পুঁজিবাদের অমনাবিক ও নির্মম আগ্রাসী চেহারা রাশিয়া এড়াতে পারবে। কিন্তু পরবর্তীতে সরকার এই পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের আলোচনা ও সমালোচনা সহ্য করতে না পেরে ১৮৬৩তে ‘ভ্র্যমিয়া’ নিষিদ্ধ করে দেয়। এই সময়ই দস্তয়েভস্কি বিদেশ ভ্রমণে যান। ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইতালিতে ঘুরে বেড়ান। এই যাত্রাতেই ফ্রান্সের পলিনার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। দেশে ফিরে আসার পর ১৮৬৪তে সরকারি অনুমতি মিললে দুই ভাই এরপর প্রকাশ করেন ‘ঈপক’ বা এপোখ নামে আর একটি পত্রিকা, এপোখ মানে যুগ। এরপর দস্তয়েভস্কির জীবনে আবার আঘাত নেমে আসে। দু বছরের মধ্যেই মারা যান স্ত্রী মারিয়া দিমিত্রিয়েভানা। এর কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় তাঁর সাথী ও ভাই মিখাইল দস্তয়েভস্কি। বড় ভাই মিখাইলের মৃত্যুর পর পত্রিকাটি বন্ধ হয়ে যায়। এই সময় আর্থিক ও পারিবারিক চাপে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। আর্থিক চাপটাও অসহনীয় হয়ে ওঠে, প্রথমা স্ত্রীর প্রথম পক্ষের ছেলে পাশা, দাদা মিখাইলের পরিবার এবং অন্যান্য পারিবারিক দায়িত্ব পালনের চাপ তাঁকে বিপর্যস্ত করে তোলে। (চলবে)