alt

সাময়িকী

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

আবুল কাসেম

: বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

২০১৩ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে এফডিআই-এর উদ্দেশ্যে জাইকার অর্থায়নে জাপানে যাই এবং প্রায় দেড়-দুইমাস সেখানে অবস্থান করি। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় কিয়োটো প্রিফেকচারের উজি সিটিতে। উজি অত্যন্ত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক আধ্যাত্মিক নগরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এলাইড ফোর্স সমস্ত জাপানকে বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও উজিতে কোনো আক্রমণ করেনি। তাই সেখানে প্রাচীন আমলের বিশেষ নকশার বাড়িঘরগুলো এখনো তাদের স্থাপত্যিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘স্বপ্ন’ কবিতার প্রাচীন ভারতের উজ্জয়িনী নগরীর মতোই যেন উজির কাব্যচিত্র। এই উজি নগরীতে উজি নদীর তীরে ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ মিউজিয়াম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন বিশ্ব সাহিত্যেও প্রথম উপন্যাস, ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ ‘দ্য টেল অব গঞ্জির’ শেষ দশ অধ্যায় লেখা হয়েছে এই উজির পটভূমিতে। উপন্যাসটি চুয়ান্ন অধ্যায়ের। উজিতে গেঞ্জি মিউজিয়ামটি স্থাপন করা হয়েছে এই কারণেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে মুরাসাকি শিকিবুর এবং তার ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ উপন্যাসের কথা শুনেছিলাম। তবে জাপানের নাটক ‘কাবুকি’ কিংবা ‘নো’ সম্পর্কে যতটা ধারণা ছিল ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ সম্পর্কে ততটা ছিল না। আমার উজিতে অবস্থান এবং মিউজিয়ামে যাতায়াত আমাকে মুরাসাকি এবং উপন্যাসটি সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। উপন্যাসটি সম্পর্কে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা নোবেল বক্তৃতায় বলেন, ‘গেঞ্জি উপন্যাস জাপানি সাহিত্যের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে আছে। আমাদের আজকের দিনেও এমন কোনো উপন্যাস নেই এর সঙ্গে যার তুলনা করা চলে। আমার কাছে খুবই অলৌকিক মনে হয় একাদশ শতকে এমন একটি আধুনিক সাহিত্য রচিত হয়েছে।’

উপন্যাসের কেন্দ্রে আছেন মুরাসাকি শিকিবু, কিন্তু উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তার সময়ের তিনিসহ চারজন কবি-ঔপন্যাসিকের গল্প নিয়ে। অন্য তিনজন হলেন কবি ইঝোমি শিকিবু, কবি আকাঝুমি ইমন এবং কবি সেই শোনাগন। মুরাসাকি শিকিবুও কবি ছিলেন। এদের চারজনের অন্য পরিচয় রয়েছে। এরা সবাই সম্রাজ্ঞী দু’জনের দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং’ ছিলেন। সম্রাট ইচিজোর দুজন সম্রাজ্ঞী ছিলেনÑ সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং সম্রাজ্ঞী শোশি। এরা দু’জনই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারে ছিলেন সেই শোনাগন, আর সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে ছিলেন বাকি তিন জন, অবশ্য এক সঙ্গে নয়, কবি ইঝোমি শিকিবু মাঝখানে চাকরিটা ছেড়ে দেন। তিনি তার গভর্নর স্বামী মিচিসাদাকে ত্যাগ করে প্রথমে প্রিন্স তামেতাকার প্রেমে পড়েন। স্বপ্ন সঞ্চরণ রোগে তামেতাকার মৃত্যু হলে তার ছোটভাই অতসুমিচির প্রেমে পড়েন। এই প্রেমকে কেন্দ্র করে তার লেখা ডায়েরি জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছে।

অভিজাত এবং সমৃদ্ধ হেইয়ান সাম্রাজ্যে তখন ডায়েরি লেখার চল ছিল। কয়েকজন নারী-লেখিকার ডায়েরি ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। একটি আত্মজীবনীমূলক ডায়েরি ‘কাগেরো নিক্কি’ (৯৫৪-৯৭৪)। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। ডায়েরি লেখিকার স্বামী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বামী সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘যে একাকিত্বের বেদনা ও দুঃখ আমি নদী পথে যাত্রাকালে পেয়েছি, অনুভব করেছি, তার তুলনা হয় না। তিনি নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, অন্যের দুঃখের কথা ভাবার সময় তার হয় না। কোনো কোনো ডায়েরি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য গ্রন্থের কাজ করেছে। যেমন গেঞ্জি উপন্যাসের শেষ দশ অধ্যায় মুরাসাকি লিখেছিলেন কিনা- এ নিয়ে আধুনিক কালের গবেষকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলে ‘লেডি সারসিনার নিক্কি’ নামের এক ডায়েরি সে বিতর্কের অবসানে এগিয়ে আসে। একাদশ শতকের বিশ বা ত্রিশের দশকে লেখা এ ডায়েরিতে লেখিকা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, তিনি গেঞ্জি মনোগাতারির সবগুলো স্ক্রল পেয়ে গেছেন। মুরাসাকিও ডায়েরি লিখতেন। ১০০৭ থেকে ১০১০ সাল পর্যন্ত ডায়েরি লিখেছেন তিনি। সে সময়কার সামাজিক কুসংস্কার, রাজকীয় অনুষ্ঠানাদি এবং লেখিকার ব্যক্তি জীবনের দুর্লভ কথা রয়েছে। ডায়েরিতে এক জায়গায় অন্য তিনজন কবি সম্পর্কেও লিখেছেন। বলেছেন, ‘ইমনের কবিতা অত্যন্ত সন্তোষজনক। তার বিবিধ কবিতাও আমাদের আনন্দ দেয়। যারা কবিতা লেখে তাদের কোমরগুলো সমস্তই ভাঙ্গা। তবুও যারা অসীম ও স্বউচ্চ এবং আত্মাভিমানী তারা আমাদের দরদ ও অনুকম্পার দাবি রাখে।’ ইঝোমি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আকর্ষণীয়ভাবে আবির্ভূত, তবে আচরণ অনুচিত (কারণ বহু প্রেম এবং রাজনীতি)। স্বাচ্ছন্দ্যে বুদ্ধির ঝলকানি দিয়ে কবিতা লেখে।তার ক্ষুদ্র কথায়ও সুগন্ধ থাকে। অন্যের কবিতার ওপর রায় দেয়ার কথা সে ভাবেনা।’ সেই শোনাগন সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি খুবই অহংকারী। নিজেকে মূল্যবান মনে করেন। অথচ তিনি নিখুঁত নন। যিনি প্রতিভাময়ী তাকেই তার নিজেকে সংযত করা উচিত। এ রকম বেপরোয়া এবং নিরর্থক ব্যক্তি কী করে সুখে দিন শেষ করতে পারবে?’ তার জীবনটা শেষের দিকে আসলেই সুখের ছিল না। উপন্যাসে সেসব কথা আছে।

সেইশোনাগনের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে ভালো ছিল না তার জন্য দায়ী আসলে সেইশোনাগনই। অহংকার ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র তাকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায় এবং একটি খল চরিত্রে পরিণত করে। তবে তিনি একজন প্রতিভাধর কবি ও লেখক। তার ‘পিলোবুক’ বিখ্যাত বই। শুধু জাপানে নয়, জাপানের বাইরেও। তার মেয়েলি এবং কবিঈর্ষা সত্ত্বেও মুরাসাকি তার দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন। অবশ্য এই সেইশোনাগনের জন্যই মুরাসাকির সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে আসা।

সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারকে উজ্জ্বল করে রাখেন কবি সেইশোনাগন। সম্রাটসহ সকলের কাছেই তার প্রশংসা। তাতে করে দরবার এবং সাম্রাজ্যে তেইশির ভাবমূর্তি আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। সম্রাজ্ঞী শোশি বালিকা বয়সী। তার দরবার আলোকিত করার মতো কোনো কবি নক্ষত্র নেই। তাই হীনমন্যতায় ভুগছেন। তার বাবা মিচিনাগা ছিলেন মন্ত্রী। তার বাড়িতে ছিলেন কবি আকাঝুমি ইমন। কন্যার দরবার আলোকিত করবার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কবি সেইশোনাগনের কাছে ইমন কিছুই না। বাবা মিচিনাগা ইঝোমি শিকিবুকে নিয়ে এলেন। ইঝোমি অনেক বড় কবি। কিন্তু তিনি বালিকা সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে দরবার ছেড়ে চলে যান। মিচিনাগাকে কন্যা শোশি চূড়ান্তভাবে বলেছিলেন যদি সেইশোনাগনের চাইতে বড় কবি কাউকে না আনা যায় তাহলে... মন্ত্রী বাবা তাতে ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ প্রাসাদ রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে হলে কন্যাকে শক্তিশালী সম্রাজ্ঞী হতে হবে। শুধু কবি দিয়ে হবে না। কবির অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে, তার কন্যাকে শিখিয়ে পড়িয়ে ঋদ্ধ এক মহীয়ষীতে পরিণত করতে হবে ঠিক তার বোন সেনশির মতোÑ যিনি সম্রাটের মাতা। মিচিনাগা নিজেও কবি। কুটনৈতিক বুদ্ধি এবং জ্ঞান গরিমায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি জানতে পারলেন ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ নামে একটি মনোগাতারির লেখিকার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। তিনি তার লেখা পাঠ করে খুবই অভিভূত হয়ে গেলেন। কারণ সম্রাটের দরবারী পটভূমির এই লেখায় তা-ই আছেÑ যা তিনি ভবিষ্যৎ লেডি-ইনওয়েটিং এর মধ্যে খুঁজছেন।

প্রথমে মুরাসাকি আসতে চাইলেন না। কিছুদিন হলো তার স্বামী মারা গেছেন। শিশু কন্যাকে নিয়ে বিশাল সম্পদ আর ঘরবাড়ি সামলাচ্ছেন। গেঞ্জি মনোগাতারি লিখছেন। সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর দরবার সম্পর্কে তার ভালো ধারণা আছে। তার বাবা এবং স্বামী দুজনই সম্রাটের দরবারে অনুষ্ঠান বিভাগের অধিকর্তা এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। মন্ত্রী একজন জহুরি, রতœ চেনেন। লেগে রইলেন। এক সময় মুরাসাকিকে কন্যার দরবারে নিয়ে আসতে পারলেন। মন্ত্রী মিচিনাগার সঙ্গে মুরাসাকির প্রেম ছিল।কিন্তু মুরাসাকি অত্যন্ত সংযমী ছিলেন। চরিত্রের দিক থেকে ইঝোমি শিকিবুর ঠিক উল্টোটা। সংযমের প্রেমই সুন্দরÑ তা-ই লালন করেছেন সম্রাজ্ঞীর দরবারে অবস্থানের সবটা সময়জুড়ে। একজন শক্তিশালী মন্ত্রীর কাছে, তার প্রভাব বলয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলা খুবই কঠিন। সব খারাপ মানুষের মধ্যেই ভালো কিছু দিক থাকে, নিষ্পাপ একটা অঞ্চল, বাস্তবে মিচিনাগার মধ্যে তা ছিল। তিনি প্রেমের প্রতি, মুরাসাকির আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

ইঝোমির জীবনটা আগাগোড়াই ভোগবাদী। কিন্তু তার মানবিক দিকে কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিবাদী, পদে পদে তার প্রতিবাদী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে। আর তিনি যা কিছু করেছেন প্রেমের জন্য ভালোবাসার জন্য করেছেন। সবকিছুর মধ্যে দৃঢ়তা ছিল। সংগ্রামশীল এক নারী তিনি। তার ধর্মবিশ্বাসও ছিল। উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ না।

ইমন এবং সেইশোনাগন চরিত্র দু’টিতে ভিন্ন মেজাজের পরিচয় আছে। ইতিহাসে চরিত্রগুলো এরকমই। আমি বৈশিষ্ট্যে পূর্ণমাত্রাযুক্ত করেছি। চারটি চরিত্রের মধ্যে এরা দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ। ইমন সকলের বড়। তাই মুরাসাকি এবং ইঝোমি তাকে মান্য করে চলেন। সেইসোনাগনও অশ্রদ্ধা করেন না। তবে স্বভাবের কারণে হয়ত তার ব্যবহার শিষ্টতার মাত্রা অতিক্রম করে। ইমন দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রীপরিবারের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমলাতান্ত্রিক জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ইতিহাসবিদাও। ‘এইগা মনোগাতারি’ তার লেখা ইতিহাসগ্রন্থ। মন্ত্রী পরিবারের প্রতি লেখার পক্ষপাতিত্ব আছে বলে তার সমালোচনাও আছেÑ বিশেষ করে সম্রাটের মাতা সেনসি তাকে অনুগত লেখক বলেছেন। অনুগত বা পক্ষপাতিত্বমূলক লেখা আমলাতান্ত্রিক চরিত্র পায়। বলতে পরেন সুবিধাবাদী লেখক চরিত্র।

কিন্তু ব্যর্থ প্রেমে দগ্ধ তিনিও। কষ্টটা তার মাতা পিতার ছাড়াছাড়িতেও। যার কাছে বড় হয়েছেন, তিনি তার বায়োলজিক্যাল ফাদার নন। ভালোবেসেও প্রতারণার শিকার হয়েছেন।বিয়ে তো ভালো পাত্রের সঙ্গেই হয়েছিল। স্বামী ছিলেন কনফুসিয়ান স্কলার। পরে গভর্নরও হয়েছেন। তারপরও কবিতাগুলোয় দীর্ঘশ্বাস। প্রথম প্রেমের কথা কখনোই ভুলতে পারেননি।

সেইসোনাগনের একাধিক বিয়ে এবং বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াবার কথা আছে উপন্যাসে।বাস্তবেও তা ছিল। সম্রাজ্ঞী কিংবা সম্রাটের দরবারে যাকে প্রথম স্বামী বলে পরিচয় দিতেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। তাকে প্রতারিত করে পরে বিয়ে করেন এমন এক প্রভাবশালীকে যিনি তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করবেন বলে ধারণা করেছিলেন। বাস্তবে ঠিক উল্টোটাই হয়েছে।

একজন শর্ক্তিশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে টেকা মুশকিলÑ যেখানে বৈরিতা মন্ত্রীকন্যা সম্রাজ্ঞীকে পর্যন্ত বিপর্যয়ে ফেলে দেয়। তার হিসাবে ভুল ছিল। তবে শেষে নতুন সম্রাটের আনুকূল্য পেয়েছেন। সুবিধাবাদী চরিত্রগুলো একসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সেট হয়ে যায়। নতুন সম্রাট সানজু এর সম্রাজ্ঞী তাকে প্রশ্রয় দেন। তাদের দরবারেও তো কবির দরকার ছিল, হোক না বিতর্কিত। শত্রুর তো মিত্রই হয়। এ ধরনের সমীকরণ এখন যেমন আছে, তখনও তেমনই ছিল।

কবি মুরাসাকি এবং ইঝোমি সে সুযোগ নিলেন না। কারণ এরা দু’জনই ছিলেন ভিন্ন মুদ্রার মানুষÑ যারা সুযোগ নয়, অধিকার চান। আপোস করেন না, নিজের জন্য না, অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও না। দেখুন, সত্যিকার কবি-লেখকের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পর্ক সব সময়ই হয় সাংঘর্ষিক। এদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাদের ভেতর যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে প্রাক্তন সম্রাট ইচিজোর অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে নতুন সম্রাট এবং মন্ত্রীকে যোগ দিতে না দিয়ে। এটি তাদের মস্তবড় প্রতিবাদী অর্জন।

প্রচুর পড়তে হয়েছে আমাকে। নির্মিতির জন্য বেশ মাথা ঘামাতেও হয়েছে। আবুল কাসেম ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র কথা এসেছে।বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহনামা’ ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ উপন্যাসের সমসামিয়ক। দুটোই সম্রাটদের দরবার কেন্দ্রিক। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘ধ্রুপদি সাহিত্য হিসেবে এ দুটো মহাগ্রন্থের তুলনামূলক পাঠ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। ‘শাহনামা’ আমি পড়েছিলাম অন্য একটা উদ্দেশ্যে। ভারত থেকে আমার ‘মসনদ’ উপন্যাসটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আলীবর্দী খান ‘শাহনামা’-চর্চা করতেন, নিজে কপি করে পছন্দের ব্যক্তিদের উপহার দিতেন। বিশেষ বিশেষ অংশ আবৃত্তি করতেন। উপন্যাসে ব্যাপারগুলো আমি এনেছি। ‘শিকিবু’ উপন্যাসে তা এসেছে সম্রাট মাতা সেনসির অতি উঁচুদরের সাহিত্য রুচির প্রেক্ষাপটে। মুরাসাকিকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসের জন্যই। তিনি শাহনামা নিয়ে কথা বলতেন তার সঙ্গে এবং কিয়োটো ছেড়ে যাবার সময় শাহনামা গ্রন্থটি তাঁকেই দিয়ে যান। সেনসি গ্রন্থটি পেয়েছিলাম চীনা এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে।

চীন-জাপান এবং পারস্যের মধ্যে তখন বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ছিল বিদগ্ধ সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে যোগাযোগও। সে সময় চীনের ব্যালাড পয়েট বাইযুয়ী বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। চীনা ভাষা জানা মুরাসাকি সম্রাজ্ঞী শোশিকে বাইযুয়ীর কাব্য পাঠ করে শোনাতেনÑ হয়ত সেনসিকেও শুনিয়েছেন।

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

tab

সাময়িকী

যেভাবে লেখা হলো ‘শিকিবু’

আবুল কাসেম

বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

২০১৩ সালে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান হিসেবে এফডিআই-এর উদ্দেশ্যে জাইকার অর্থায়নে জাপানে যাই এবং প্রায় দেড়-দুইমাস সেখানে অবস্থান করি। প্রথমে আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় কিয়োটো প্রিফেকচারের উজি সিটিতে। উজি অত্যন্ত প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক আধ্যাত্মিক নগরী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এলাইড ফোর্স সমস্ত জাপানকে বিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপে পরিণত করলেও উজিতে কোনো আক্রমণ করেনি। তাই সেখানে প্রাচীন আমলের বিশেষ নকশার বাড়িঘরগুলো এখনো তাদের স্থাপত্যিক ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে। রবীন্দ্রনাথের ‘কল্পনা’ কাব্যের ‘স্বপ্ন’ কবিতার প্রাচীন ভারতের উজ্জয়িনী নগরীর মতোই যেন উজির কাব্যচিত্র। এই উজি নগরীতে উজি নদীর তীরে ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ মিউজিয়াম। আপনি নিশ্চয়ই জানেন বিশ্ব সাহিত্যেও প্রথম উপন্যাস, ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ ‘দ্য টেল অব গঞ্জির’ শেষ দশ অধ্যায় লেখা হয়েছে এই উজির পটভূমিতে। উপন্যাসটি চুয়ান্ন অধ্যায়ের। উজিতে গেঞ্জি মিউজিয়ামটি স্থাপন করা হয়েছে এই কারণেই। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালে মুরাসাকি শিকিবুর এবং তার ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ উপন্যাসের কথা শুনেছিলাম। তবে জাপানের নাটক ‘কাবুকি’ কিংবা ‘নো’ সম্পর্কে যতটা ধারণা ছিল ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ সম্পর্কে ততটা ছিল না। আমার উজিতে অবস্থান এবং মিউজিয়ামে যাতায়াত আমাকে মুরাসাকি এবং উপন্যাসটি সম্পর্কে উৎসাহী করে তোলে। উপন্যাসটি সম্পর্কে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ঔপন্যাসিক কাওয়াবাতা নোবেল বক্তৃতায় বলেন, ‘গেঞ্জি উপন্যাস জাপানি সাহিত্যের সর্বোচ্চ চূড়া স্পর্শ করে আছে। আমাদের আজকের দিনেও এমন কোনো উপন্যাস নেই এর সঙ্গে যার তুলনা করা চলে। আমার কাছে খুবই অলৌকিক মনে হয় একাদশ শতকে এমন একটি আধুনিক সাহিত্য রচিত হয়েছে।’

উপন্যাসের কেন্দ্রে আছেন মুরাসাকি শিকিবু, কিন্তু উপন্যাসটি লেখা হয়েছে তার সময়ের তিনিসহ চারজন কবি-ঔপন্যাসিকের গল্প নিয়ে। অন্য তিনজন হলেন কবি ইঝোমি শিকিবু, কবি আকাঝুমি ইমন এবং কবি সেই শোনাগন। মুরাসাকি শিকিবুও কবি ছিলেন। এদের চারজনের অন্য পরিচয় রয়েছে। এরা সবাই সম্রাজ্ঞী দু’জনের দরবারে লেডি-ইন-ওয়েটিং’ ছিলেন। সম্রাট ইচিজোর দুজন সম্রাজ্ঞী ছিলেনÑ সম্রাজ্ঞী তেইশি এবং সম্রাজ্ঞী শোশি। এরা দু’জনই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারে ছিলেন সেই শোনাগন, আর সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে ছিলেন বাকি তিন জন, অবশ্য এক সঙ্গে নয়, কবি ইঝোমি শিকিবু মাঝখানে চাকরিটা ছেড়ে দেন। তিনি তার গভর্নর স্বামী মিচিসাদাকে ত্যাগ করে প্রথমে প্রিন্স তামেতাকার প্রেমে পড়েন। স্বপ্ন সঞ্চরণ রোগে তামেতাকার মৃত্যু হলে তার ছোটভাই অতসুমিচির প্রেমে পড়েন। এই প্রেমকে কেন্দ্র করে তার লেখা ডায়েরি জগৎ বিখ্যাত হয়ে আছে।

অভিজাত এবং সমৃদ্ধ হেইয়ান সাম্রাজ্যে তখন ডায়েরি লেখার চল ছিল। কয়েকজন নারী-লেখিকার ডায়েরি ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদা লাভ করেছে। একটি আত্মজীবনীমূলক ডায়েরি ‘কাগেরো নিক্কি’ (৯৫৪-৯৭৪)। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম হিসেবে বিবেচিত। ডায়েরি লেখিকার স্বামী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। স্বামী সম্পর্কে এক জায়গায় লিখেছেন, ‘যে একাকিত্বের বেদনা ও দুঃখ আমি নদী পথে যাত্রাকালে পেয়েছি, অনুভব করেছি, তার তুলনা হয় না। তিনি নিজেকে নিয়ে এত ব্যস্ত থাকেন যে, অন্যের দুঃখের কথা ভাবার সময় তার হয় না। কোনো কোনো ডায়েরি ঐতিহাসিক প্রামাণ্য গ্রন্থের কাজ করেছে। যেমন গেঞ্জি উপন্যাসের শেষ দশ অধ্যায় মুরাসাকি লিখেছিলেন কিনা- এ নিয়ে আধুনিক কালের গবেষকদের মধ্যে বিভক্তি দেখা দিলে ‘লেডি সারসিনার নিক্কি’ নামের এক ডায়েরি সে বিতর্কের অবসানে এগিয়ে আসে। একাদশ শতকের বিশ বা ত্রিশের দশকে লেখা এ ডায়েরিতে লেখিকা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে বলেন, তিনি গেঞ্জি মনোগাতারির সবগুলো স্ক্রল পেয়ে গেছেন। মুরাসাকিও ডায়েরি লিখতেন। ১০০৭ থেকে ১০১০ সাল পর্যন্ত ডায়েরি লিখেছেন তিনি। সে সময়কার সামাজিক কুসংস্কার, রাজকীয় অনুষ্ঠানাদি এবং লেখিকার ব্যক্তি জীবনের দুর্লভ কথা রয়েছে। ডায়েরিতে এক জায়গায় অন্য তিনজন কবি সম্পর্কেও লিখেছেন। বলেছেন, ‘ইমনের কবিতা অত্যন্ত সন্তোষজনক। তার বিবিধ কবিতাও আমাদের আনন্দ দেয়। যারা কবিতা লেখে তাদের কোমরগুলো সমস্তই ভাঙ্গা। তবুও যারা অসীম ও স্বউচ্চ এবং আত্মাভিমানী তারা আমাদের দরদ ও অনুকম্পার দাবি রাখে।’ ইঝোমি সম্পর্কে লিখেছেন, ‘আকর্ষণীয়ভাবে আবির্ভূত, তবে আচরণ অনুচিত (কারণ বহু প্রেম এবং রাজনীতি)। স্বাচ্ছন্দ্যে বুদ্ধির ঝলকানি দিয়ে কবিতা লেখে।তার ক্ষুদ্র কথায়ও সুগন্ধ থাকে। অন্যের কবিতার ওপর রায় দেয়ার কথা সে ভাবেনা।’ সেই শোনাগন সম্পর্কে বলেন, ‘তিনি খুবই অহংকারী। নিজেকে মূল্যবান মনে করেন। অথচ তিনি নিখুঁত নন। যিনি প্রতিভাময়ী তাকেই তার নিজেকে সংযত করা উচিত। এ রকম বেপরোয়া এবং নিরর্থক ব্যক্তি কী করে সুখে দিন শেষ করতে পারবে?’ তার জীবনটা শেষের দিকে আসলেই সুখের ছিল না। উপন্যাসে সেসব কথা আছে।

সেইশোনাগনের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে ভালো ছিল না তার জন্য দায়ী আসলে সেইশোনাগনই। অহংকার ও প্রাসাদ ষড়যন্ত্র তাকে বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যায় এবং একটি খল চরিত্রে পরিণত করে। তবে তিনি একজন প্রতিভাধর কবি ও লেখক। তার ‘পিলোবুক’ বিখ্যাত বই। শুধু জাপানে নয়, জাপানের বাইরেও। তার মেয়েলি এবং কবিঈর্ষা সত্ত্বেও মুরাসাকি তার দুঃসময়ে এগিয়ে এসেছেন। অবশ্য এই সেইশোনাগনের জন্যই মুরাসাকির সম্রাজ্ঞী শোশির দরবারে আসা।

সম্রাজ্ঞী তেইশির দরবারকে উজ্জ্বল করে রাখেন কবি সেইশোনাগন। সম্রাটসহ সকলের কাছেই তার প্রশংসা। তাতে করে দরবার এবং সাম্রাজ্যে তেইশির ভাবমূর্তি আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। সম্রাজ্ঞী শোশি বালিকা বয়সী। তার দরবার আলোকিত করার মতো কোনো কবি নক্ষত্র নেই। তাই হীনমন্যতায় ভুগছেন। তার বাবা মিচিনাগা ছিলেন মন্ত্রী। তার বাড়িতে ছিলেন কবি আকাঝুমি ইমন। কন্যার দরবার আলোকিত করবার জন্য তাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো। কিন্তু কোনো কাজ হলো না। কবি সেইশোনাগনের কাছে ইমন কিছুই না। বাবা মিচিনাগা ইঝোমি শিকিবুকে নিয়ে এলেন। ইঝোমি অনেক বড় কবি। কিন্তু তিনি বালিকা সম্রাজ্ঞীর সঙ্গে মানিয়ে উঠতে না পেরে দরবার ছেড়ে চলে যান। মিচিনাগাকে কন্যা শোশি চূড়ান্তভাবে বলেছিলেন যদি সেইশোনাগনের চাইতে বড় কবি কাউকে না আনা যায় তাহলে... মন্ত্রী বাবা তাতে ভয় পেয়ে গেলেন। কারণ প্রাসাদ রাজনীতিতে প্রভাব খাটাতে হলে কন্যাকে শক্তিশালী সম্রাজ্ঞী হতে হবে। শুধু কবি দিয়ে হবে না। কবির অগাধ জ্ঞান থাকতে হবে, তার কন্যাকে শিখিয়ে পড়িয়ে ঋদ্ধ এক মহীয়ষীতে পরিণত করতে হবে ঠিক তার বোন সেনশির মতোÑ যিনি সম্রাটের মাতা। মিচিনাগা নিজেও কবি। কুটনৈতিক বুদ্ধি এবং জ্ঞান গরিমায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি জানতে পারলেন ‘গেঞ্জি মনোগাতারি’ নামে একটি মনোগাতারির লেখিকার সুনাম ছড়িয়ে পড়ছে সর্বত্র। তিনি তার লেখা পাঠ করে খুবই অভিভূত হয়ে গেলেন। কারণ সম্রাটের দরবারী পটভূমির এই লেখায় তা-ই আছেÑ যা তিনি ভবিষ্যৎ লেডি-ইনওয়েটিং এর মধ্যে খুঁজছেন।

প্রথমে মুরাসাকি আসতে চাইলেন না। কিছুদিন হলো তার স্বামী মারা গেছেন। শিশু কন্যাকে নিয়ে বিশাল সম্পদ আর ঘরবাড়ি সামলাচ্ছেন। গেঞ্জি মনোগাতারি লিখছেন। সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞীর দরবার সম্পর্কে তার ভালো ধারণা আছে। তার বাবা এবং স্বামী দুজনই সম্রাটের দরবারে অনুষ্ঠান বিভাগের অধিকর্তা এবং ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ছিলেন। মন্ত্রী একজন জহুরি, রতœ চেনেন। লেগে রইলেন। এক সময় মুরাসাকিকে কন্যার দরবারে নিয়ে আসতে পারলেন। মন্ত্রী মিচিনাগার সঙ্গে মুরাসাকির প্রেম ছিল।কিন্তু মুরাসাকি অত্যন্ত সংযমী ছিলেন। চরিত্রের দিক থেকে ইঝোমি শিকিবুর ঠিক উল্টোটা। সংযমের প্রেমই সুন্দরÑ তা-ই লালন করেছেন সম্রাজ্ঞীর দরবারে অবস্থানের সবটা সময়জুড়ে। একজন শক্তিশালী মন্ত্রীর কাছে, তার প্রভাব বলয়ে নিজেকে রক্ষা করে চলা খুবই কঠিন। সব খারাপ মানুষের মধ্যেই ভালো কিছু দিক থাকে, নিষ্পাপ একটা অঞ্চল, বাস্তবে মিচিনাগার মধ্যে তা ছিল। তিনি প্রেমের প্রতি, মুরাসাকির আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

ইঝোমির জীবনটা আগাগোড়াই ভোগবাদী। কিন্তু তার মানবিক দিকে কোনো ঘাটতি নেই। প্রতিবাদী, পদে পদে তার প্রতিবাদী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের পরিচয় মেলে। আর তিনি যা কিছু করেছেন প্রেমের জন্য ভালোবাসার জন্য করেছেন। সবকিছুর মধ্যে দৃঢ়তা ছিল। সংগ্রামশীল এক নারী তিনি। তার ধর্মবিশ্বাসও ছিল। উচ্ছন্নে যাওয়া মানুষ না।

ইমন এবং সেইশোনাগন চরিত্র দু’টিতে ভিন্ন মেজাজের পরিচয় আছে। ইতিহাসে চরিত্রগুলো এরকমই। আমি বৈশিষ্ট্যে পূর্ণমাত্রাযুক্ত করেছি। চারটি চরিত্রের মধ্যে এরা দুজন বয়োজ্যেষ্ঠ। ইমন সকলের বড়। তাই মুরাসাকি এবং ইঝোমি তাকে মান্য করে চলেন। সেইসোনাগনও অশ্রদ্ধা করেন না। তবে স্বভাবের কারণে হয়ত তার ব্যবহার শিষ্টতার মাত্রা অতিক্রম করে। ইমন দীর্ঘদিন ধরে মন্ত্রীপরিবারের সঙ্গে যুক্ত থেকে আমলাতান্ত্রিক জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। তিনি ইতিহাসবিদাও। ‘এইগা মনোগাতারি’ তার লেখা ইতিহাসগ্রন্থ। মন্ত্রী পরিবারের প্রতি লেখার পক্ষপাতিত্ব আছে বলে তার সমালোচনাও আছেÑ বিশেষ করে সম্রাটের মাতা সেনসি তাকে অনুগত লেখক বলেছেন। অনুগত বা পক্ষপাতিত্বমূলক লেখা আমলাতান্ত্রিক চরিত্র পায়। বলতে পরেন সুবিধাবাদী লেখক চরিত্র।

কিন্তু ব্যর্থ প্রেমে দগ্ধ তিনিও। কষ্টটা তার মাতা পিতার ছাড়াছাড়িতেও। যার কাছে বড় হয়েছেন, তিনি তার বায়োলজিক্যাল ফাদার নন। ভালোবেসেও প্রতারণার শিকার হয়েছেন।বিয়ে তো ভালো পাত্রের সঙ্গেই হয়েছিল। স্বামী ছিলেন কনফুসিয়ান স্কলার। পরে গভর্নরও হয়েছেন। তারপরও কবিতাগুলোয় দীর্ঘশ্বাস। প্রথম প্রেমের কথা কখনোই ভুলতে পারেননি।

সেইসোনাগনের একাধিক বিয়ে এবং বিয়েবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াবার কথা আছে উপন্যাসে।বাস্তবেও তা ছিল। সম্রাজ্ঞী কিংবা সম্রাটের দরবারে যাকে প্রথম স্বামী বলে পরিচয় দিতেন, তার সঙ্গে তার বিয়ে হয়নি। তাকে প্রতারিত করে পরে বিয়ে করেন এমন এক প্রভাবশালীকে যিনি তার ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে কাজ করবেন বলে ধারণা করেছিলেন। বাস্তবে ঠিক উল্টোটাই হয়েছে।

একজন শর্ক্তিশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে টেকা মুশকিলÑ যেখানে বৈরিতা মন্ত্রীকন্যা সম্রাজ্ঞীকে পর্যন্ত বিপর্যয়ে ফেলে দেয়। তার হিসাবে ভুল ছিল। তবে শেষে নতুন সম্রাটের আনুকূল্য পেয়েছেন। সুবিধাবাদী চরিত্রগুলো একসময় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে সেট হয়ে যায়। নতুন সম্রাট সানজু এর সম্রাজ্ঞী তাকে প্রশ্রয় দেন। তাদের দরবারেও তো কবির দরকার ছিল, হোক না বিতর্কিত। শত্রুর তো মিত্রই হয়। এ ধরনের সমীকরণ এখন যেমন আছে, তখনও তেমনই ছিল।

কবি মুরাসাকি এবং ইঝোমি সে সুযোগ নিলেন না। কারণ এরা দু’জনই ছিলেন ভিন্ন মুদ্রার মানুষÑ যারা সুযোগ নয়, অধিকার চান। আপোস করেন না, নিজের জন্য না, অন্যের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও না। দেখুন, সত্যিকার কবি-লেখকের সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্রের সম্পর্ক সব সময়ই হয় সাংঘর্ষিক। এদের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। তাদের ভেতর যে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ তারই বিস্ফোরণ ঘটেছে প্রাক্তন সম্রাট ইচিজোর অন্তেষ্টিক্রিয়ার অনুষ্ঠানে নতুন সম্রাট এবং মন্ত্রীকে যোগ দিতে না দিয়ে। এটি তাদের মস্তবড় প্রতিবাদী অর্জন।

প্রচুর পড়তে হয়েছে আমাকে। নির্মিতির জন্য বেশ মাথা ঘামাতেও হয়েছে। আবুল কাসেম ফেরদৌসীর ‘শাহনামা’র কথা এসেছে।বিশ্ববিখ্যাত মহাকাব্য ‘শাহনামা’ ‘দ্য টেল অব গেঞ্জি’ উপন্যাসের সমসামিয়ক। দুটোই সম্রাটদের দরবার কেন্দ্রিক। বিশ্বের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ‘ধ্রুপদি সাহিত্য হিসেবে এ দুটো মহাগ্রন্থের তুলনামূলক পাঠ সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত। ‘শাহনামা’ আমি পড়েছিলাম অন্য একটা উদ্দেশ্যে। ভারত থেকে আমার ‘মসনদ’ উপন্যাসটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। এ উপন্যাসের গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র আলীবর্দী খান ‘শাহনামা’-চর্চা করতেন, নিজে কপি করে পছন্দের ব্যক্তিদের উপহার দিতেন। বিশেষ বিশেষ অংশ আবৃত্তি করতেন। উপন্যাসে ব্যাপারগুলো আমি এনেছি। ‘শিকিবু’ উপন্যাসে তা এসেছে সম্রাট মাতা সেনসির অতি উঁচুদরের সাহিত্য রুচির প্রেক্ষাপটে। মুরাসাকিকে তিনি খুব পছন্দ করতেন, ‘গেঞ্জি’ উপন্যাসের জন্যই। তিনি শাহনামা নিয়ে কথা বলতেন তার সঙ্গে এবং কিয়োটো ছেড়ে যাবার সময় শাহনামা গ্রন্থটি তাঁকেই দিয়ে যান। সেনসি গ্রন্থটি পেয়েছিলাম চীনা এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে।

চীন-জাপান এবং পারস্যের মধ্যে তখন বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ছিল বিদগ্ধ সাহিত্যানুরাগীদের মধ্যে যোগাযোগও। সে সময় চীনের ব্যালাড পয়েট বাইযুয়ী বিশ্ববিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। চীনা ভাষা জানা মুরাসাকি সম্রাজ্ঞী শোশিকে বাইযুয়ীর কাব্য পাঠ করে শোনাতেনÑ হয়ত সেনসিকেও শুনিয়েছেন।

back to top