alt

সাময়িকী

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

মোহাম্মদ হোসাইন

: বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

নব্বইয়ের প্রথম দিকে উপবন এক্সপ্রেসে ঢাকা থেকে সিলেট আসছি। সাথে কবিবন্ধু শিউল মনজুর। কেন যেন মনটা বিষণœ আমার। হঠাৎ শিউল বললেন, আপনার জন্য একটা বই এনেছিÑ বলেই হাতে তুলে দিলেনÑ ‘সতত ডানার মানুষ’, লেখকÑ সিকদার আমিনুল হক। মনে পড়ে গেল তাঁর ‘দূরের কার্নিশ’, ‘তিন পাপড়ির ফুল’ আর ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’র কথা। সেই আশির দশক থেকেই আমি তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক। তাঁর কবিতায় কোথায় যেন আলাদা একটা মেসেজ, একটা ম্যাজিক রয়েছে। আর ‘সতত ডানার মানুষ’র কবিতাগুলো যেন একেবারেই ভিন্ন স্বর, ভিন্ন স্বাদ আর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের নতুন পঙ্ক্তিমালা। তন্ময় হয়ে পড়তে লাগলামÑ সতত ডানার মানুষ। প্রতিটি পঙ্ক্তিই যেন আমার, আমাদের। টানাগদ্যের এমন ভিন্ন স্টাইল, ভিন্ন উপমা, চিত্রকল্প আর আঙ্গিক এবং সতত বিচ্ছুরণের এমন কবিতা এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনে করতে পারিনি। এক নিঃশ্বাসে পড়তে পড়তে কখন যে সিলেট এসে পৌঁছেছি বুঝতেই পারিনি। ভোর হয়ে এসেছে, ট্রেন থেকে নামছে যাত্রীরা নানান বয়সের, নানান রঙের। ভোরের মিষ্টি বাতাস চারপাশে মমতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তখনও আমার মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছেÑ সিকদার আমিনুল হক, সতত ডানার মানুষ। কে এই সতত ডানার মানুষ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আমাকে মোহাবিষ্ট করে বারবার ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত হতে থাকলÑ

“সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না; কেউ কেউ ফেলে।” কিংবা “মেয়েরা যখন তাদের বাসি পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দ্যায়, হ্যাঁ, তখুনি ভোর।” অথবা “চুম্বন তো একটি মীমাংসার মাঝামাঝি সমাধান।” কত সহজ আর কত সাবলীল তাঁর উচ্চারণ যা মর্মভেদ করে চলে যায় বোধের গভীরে। এক্ষেত্রে সিকদার যেন একাকি পরিব্রাজক। বলছেন, “কত একা ছিলাম আমি। শৈশবে। বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। কিছুই আমি হারাই নি সেই পর্যন্ত; এমন যে দূরের নক্ষত্র, তারাও নীলিমার মধ্যস্থতায় আমার সঙ্গে কথা বলত।” কোথাও বলছেন, “একা থাকার স্বভাব নিয়ে আমি জন্মেছি।”

সব কবিই বোধ করি মূলত একা। কিন্তু সিকদার যেন বড্ড বেশি একা। ‘স্বাগতম’ কবিতায় লিখছেন, “বস্তুত এখন আমি খুব একা। এই একাকিত্ব/ চট করে পাওয়া নয়/ বলা যায়/ ধীমান মস্তিষ্কে/ করেছি শীতের চাষ। বরফের মতো শাদা তুলো/ উড়ে যায় চারদিকে”Ñ

ঘুরেফিরেই এসেছে তাঁর কবিতায় প্রেম, নারী, সৌন্দর্য, রোমান্টিকতা, দেশাত্ববোধ, যৌনতা। কিন্তু, যৌনতাকে কবি কতটা শিল্পবোধের রসে সিক্ত করেছেন তা বোঝা যায় যখন লেখেন, “কিন্তু কবির কল্পনা, যা কামনার মতো ঘর্মাক্ত;/ রূপসী মেয়েরা সেলাই করবে / সেই জামা সারাদিন। তাদের ঘুম/ বনেদি বাড়ির বিড়ালের মতো চিত্রিত ও মূল্যবান/ সময় লাগে না, ঘুমের বাড়ি আর পায়চারি ছাড়াই/ ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্তর্বাস খোলার পরপরই।”

অসম্ভব কল্পনাপ্রবণ কবি কখনও কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়ন করার চেষ্টা করেছেন কবিতায়, কখনওবা বাস্তবকে করে তুলেছেন অধিবাস্তব কিংবা পরাবাস্তব জিজ্ঞাসায়। বারবার নিজেকেই আবিষ্কারে মত্ত থেকেছেন তিনি। একটি মহৎ কবিতার জন্য আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছেন প্রেমে-অপ্রেমে, বিরহে, বঞ্চনায়, অতলান্ত গভীর মনস্বিতায়। আর এজন্যই কবি সিকদার আমিনুল হক বলতে পেরেছেন, “কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মত পবিত্র।” আর এভাবেই তিনি তাঁর কবিতার স্বরটিকে স্বাতন্ত্র্য করে তোলেন, করে তোলেন আলোর অধিষ্ঠান।

সিকদার আমিনুল হকÑ মহৎ কবিতা নির্মাণের একনিষ্ঠ কারিগর। সমাজ বাস্তবতা তাঁকেও পীড়িত করেছে বহুবার। চারপাশের ডামাডোল, হইচই, উচ্চৈঃস্বর কখনও তাঁকে ছুঁতে পারে নি। কবি যেন সমাহিত সর্বদা কবিতার কাছেই, নির্জনতার কাছেই। নাগরিক জীবন তাঁকে এতটুকু বদলে দেয় নি বা দিতে পারে নি। বাজারি কবিতার ভিড়েও কখনও তিনি নিজেকে সঁপে দেন নি। সৎ থেকেছেন নিজের কাছে, কবিতার কাছে। দশকে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। তাইতো বলছেন, “আমাদের মুদ্রা আর নৃত্যের নিজস্ব বৃত্ত/ দশক হিসাবে তার বিচার হবে নাÑ/ কার সামনে ছিল ছায়াচ্ছন্ন পানের বরজ/ সাঁওতালি নাচ/ আর/ ফ্যাক্টরির ভাঙা চাঁদ/ তার কোনো হিসাব হবে না।”

বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো এমন সংবেদনশীল কবি আর দ্বিতীয় কেউ আছেন বা ছিলেন আমার জানা নেই। তাঁর কবিতায় রয়েছে অসাধারণ সব চিত্রকল্প, রূপক, প্রতীক আর উপমার অনবদ্য উপস্থাপন। তিনি যখন বলেন, “তোমার জন্যই এত কিছু করা/ বালিতে প’ড়ে ঘন হয় শান্ত কুয়োতলা/ আমি ও কবিতা নকশা বুনেছি ঢের রহস্যের”। সত্যিই তিনি কবিতার প্রতিটি পরতে পরতে রহস্যের আর বিমূর্ত চেতনার ছবি এঁকেছেন। কখনও কখনও কবিতায় করেছেন দ্বান্দ্বিকতার অপূর্ব রূপায়ন; ভেঙ্গেছেন আবার গড়েছেন অনিবার্য আকস্মিকতায় !

বিশ্বসাহিত্যের পরিম-লেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি ভ্রমন করেছেন নানান দেশ। কাব্যপিপাসাই তাঁকে আত্মস্থ করতে শিখিয়েছে নানান ভাষা; কবিতার মোহন সুন্দর। সিকদার নির্দ্বিধায় অবগাহন করেছেন ফরাসি কাব্যে, মসনবিতে, ওমর খৈয়াম কিংবা জালাল উদ্দিন রুমিতে। আবার কখনও কখনও দার্শনিক দেকার্তে কিংবা র?্যাবোঁও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে দারুণভাবে। তিনি কবিতায় একটি নিজস্ব স্টাইল বা ঘরানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কতটা সাহসী আর অন্তর্ভেদী হলে বলা যায়Ñ “নারীর রহস্যের জানালা খুলেই আমি ঈশ্বরের মুখ দেখতে পাই। দুঃখ আর আনন্দকে এত পাশাপাশি উজ্জীবিত রাখতে প্রকৃতিতে আর কেউ পারে না বলে নারীই বোধ হয় ঈশ্বরের কাছাকাছি।” এরকম অসংখ্য অমর পঙ্ক্তি সিকদার আমিনুল হক আমাদের জন্য রেখে গেছেন।

কবিতায় যেমন সিকদার আমিনুল হক অনন্য তেমনি কাব্যের নামকরণেও অসম্ভব ব্যতিক্রম তিনি। যেমনÑ দুরের কার্নিশ, তিন পাপড়ির ফুল, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা, বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে, সতত ডানার মানুষ, সুপ্রভাত হে বারান্দা, কাফকার জামা কিংবা লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল, সুলতা আমার এলসা, পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল, বিষণœ তাতার, ঈশিতার অন্ধকার শুয়ে আছেÑ ইত্যাদি সব অম্লান, অজ্ঞেয় কাব্য সম্ভার।

সিকদার নিভৃতচারী ছিলেন বটে কিন্তু তারচে’বেশি ছিলেন লক্ষ্যভেদী। লক্ষ্য ছিল তাঁর স্থির। শুদ্ধ কবিতার প্রতি, শিল্প সৌন্দর্যের প্রতি ছিল তাঁর অনিবার্য পক্ষপাত। তাইতো তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা। কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি। আবার অনেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলেছেন ফরাসি কবি। কিন্তু সিকদার আমিনুল হক বরাবরই থেকেছেন নির্মোহ, আত্মমগ্ন, অন্তর্লীন, মিতবাক আর আধ্যাত্মচেতনায় নিমগ্ন গভীর!

প্রত্যেক কবিকেই দেখা যায় কোনো না কোনো মানস প্রতিমার কাছে সমর্পিত থাকতে। কবি জীবনানন্দ যেমন ছিলেন বনলতা সেনের কাছে, সুনীল তাঁর নীরার কাছে কিংবা বিনয় গায়ত্রীর কাছে। তেমনি, সিকদারও কি ছিলেন তাঁর সুলতার কাছে? নইলে কী করে তিনি উচ্চারণ করেন, “সুলতা, সুলতা জানে ভালো/ আকাশে মেঘÑ/ দিঘিতে কেন হাঁস,/ সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো/কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!”

অথবাÑ

চাচ্ছি সুলতাকে আমি, সাড়া দেয় এলসা। আরাগঁ

আমাকে তুমি দোষ দেবে; কিন্তু নেই পাপ!

এমন অজস্র পঙ্ক্তি সিকদারের কবিতায় সুলতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। ভাবনায়, রূপকল্পে তিনি যেমন অসাধারণ কাব্যময়তার সৃষ্টি করেছেন তেমনি নিরন্তর রক্তক্ষরণের পরও কবিতাকেই করেছেন সর্বশেষ আশ্রয়। সতত ডানায় ভর করে উড়েছেন, উড়িয়েছেন সবাইকে।

দৃঢ় চিত্তে বলেছেন, ‘ছয়টি ঋতুর সব পথে আমি ঘুরব। চপ্পল হারিয়ে আমি হাঁটবো পাশাপাশি বাগানের সবুজ ঘাসে’

যতদিন বাংলা কবিতা থাকবে, ততদিন কবি সিকদার আমিনুল হকও বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে সতত ডানার মানুষ হয়ে।

ছবি

সম্পত্তি বিতর্ক: কেন পদত্যাগ করতে হলো টিউলিপ সিদ্দিককে

ছবি

রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা ফেব্রুয়ারিতে

ছবি

মধুসূদনের সাহিত্যে নৈরাশ্যবাদ

ছবি

বিদূষী নবনীতা বনাম মানুষ নবনীতা

ছবি

দুটি অণুগল্প

ছবি

উপমা-চিত্রে দ্যোতনার সঞ্চারণ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রয়োজনে ডাক দিও

ছবি

মাকারিও

ছবি

আমার সহযাত্রী

ছবি

নাগিব মাহফুজের নির্বাচিত ১০ স্বপ্ন

ছবি

একটি ভাঙ্গা থালা

বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের কবিতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাদশা আকবর

ছবি

নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও প্রতিরোধ এবং পুনর্জাগরণের প্রতীক নগুগি ওয়া থিয়াঙ্গ’ও

ছবি

সাহিত্যের ভবিষ্যৎ

ছবি

হৃদয় প্রক্ষালক কবি বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর

ছবি

বহুবাচনিকতা ও শিল্পের নন্দন

ছবি

সেদিন দু’দ- এই বাংলার তীর

ছবি

বিকল্প জীবন

সাময়িকী কবিতা

ছবি

হার না মানা নারী জীবনের উপাখ্যান

ছবি

কাজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা

ছবি

‘যে-কোনো দেশে ভাল সাহিত্য-অনুবাদক খুব কম’

ছবি

দ্য ওয়েস্ট ল্যান্ড-এর কবি এলিয়ট

ছবি

আর এক সুন্দর সকালবেলায়

ছবি

আবার নরকুম্ভির ও মডার্নিজম

ছবি

আত্মজীবনীর আত্মপ্রকাশ প্রসঙ্গে

ছবি

আসাদের অঙ্ক

ছবি

র্যাঁবোর কবিতায় প্রতীকী জীবনের ছায়া

ছবি

ভাষা সংস্কৃতি সাক্ষরতা

ছবি

হাবীবুল্লাহ সিরাজীর কবিতার আভিজাত্য

ছবি

চেশোয়া মিওশ-এর কবিতা

ছবি

সিলভিয়া প্লাথের মৃত্যু, নিঃসঙ্গতা ও আত্মবিনাশ

ছবি

সমসাময়িক মার্কিনি ‘সহস্রাব্দের কণ্ঠস্বর’

tab

সাময়িকী

মহত্ত্বর কবি সিকদার আমিনুল হক

মোহাম্মদ হোসাইন

বৃহস্পতিবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪

নব্বইয়ের প্রথম দিকে উপবন এক্সপ্রেসে ঢাকা থেকে সিলেট আসছি। সাথে কবিবন্ধু শিউল মনজুর। কেন যেন মনটা বিষণœ আমার। হঠাৎ শিউল বললেন, আপনার জন্য একটা বই এনেছিÑ বলেই হাতে তুলে দিলেনÑ ‘সতত ডানার মানুষ’, লেখকÑ সিকদার আমিনুল হক। মনে পড়ে গেল তাঁর ‘দূরের কার্নিশ’, ‘তিন পাপড়ির ফুল’ আর ‘বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে’র কথা। সেই আশির দশক থেকেই আমি তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠক। তাঁর কবিতায় কোথায় যেন আলাদা একটা মেসেজ, একটা ম্যাজিক রয়েছে। আর ‘সতত ডানার মানুষ’র কবিতাগুলো যেন একেবারেই ভিন্ন স্বর, ভিন্ন স্বাদ আর স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যের নতুন পঙ্ক্তিমালা। তন্ময় হয়ে পড়তে লাগলামÑ সতত ডানার মানুষ। প্রতিটি পঙ্ক্তিই যেন আমার, আমাদের। টানাগদ্যের এমন ভিন্ন স্টাইল, ভিন্ন উপমা, চিত্রকল্প আর আঙ্গিক এবং সতত বিচ্ছুরণের এমন কবিতা এর আগে কোথাও পড়েছি বলে মনে করতে পারিনি। এক নিঃশ্বাসে পড়তে পড়তে কখন যে সিলেট এসে পৌঁছেছি বুঝতেই পারিনি। ভোর হয়ে এসেছে, ট্রেন থেকে নামছে যাত্রীরা নানান বয়সের, নানান রঙের। ভোরের মিষ্টি বাতাস চারপাশে মমতার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে কিন্তু তখনও আমার মাথার ভিতরে ঘুরপাক খাচ্ছেÑ সিকদার আমিনুল হক, সতত ডানার মানুষ। কে এই সতত ডানার মানুষ? নিজেই নিজেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলাম। আমাকে মোহাবিষ্ট করে বারবার ভেতরে ভেতরে উচ্চারিত হতে থাকলÑ

“সব নারী আমাদের ভাবনায় ফেলে না; কেউ কেউ ফেলে।” কিংবা “মেয়েরা যখন তাদের বাসি পোশাকগুলি শরীর থেকে একে একে খুলে ফেলে দ্যায়, হ্যাঁ, তখুনি ভোর।” অথবা “চুম্বন তো একটি মীমাংসার মাঝামাঝি সমাধান।” কত সহজ আর কত সাবলীল তাঁর উচ্চারণ যা মর্মভেদ করে চলে যায় বোধের গভীরে। এক্ষেত্রে সিকদার যেন একাকি পরিব্রাজক। বলছেন, “কত একা ছিলাম আমি। শৈশবে। বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত। কিছুই আমি হারাই নি সেই পর্যন্ত; এমন যে দূরের নক্ষত্র, তারাও নীলিমার মধ্যস্থতায় আমার সঙ্গে কথা বলত।” কোথাও বলছেন, “একা থাকার স্বভাব নিয়ে আমি জন্মেছি।”

সব কবিই বোধ করি মূলত একা। কিন্তু সিকদার যেন বড্ড বেশি একা। ‘স্বাগতম’ কবিতায় লিখছেন, “বস্তুত এখন আমি খুব একা। এই একাকিত্ব/ চট করে পাওয়া নয়/ বলা যায়/ ধীমান মস্তিষ্কে/ করেছি শীতের চাষ। বরফের মতো শাদা তুলো/ উড়ে যায় চারদিকে”Ñ

ঘুরেফিরেই এসেছে তাঁর কবিতায় প্রেম, নারী, সৌন্দর্য, রোমান্টিকতা, দেশাত্ববোধ, যৌনতা। কিন্তু, যৌনতাকে কবি কতটা শিল্পবোধের রসে সিক্ত করেছেন তা বোঝা যায় যখন লেখেন, “কিন্তু কবির কল্পনা, যা কামনার মতো ঘর্মাক্ত;/ রূপসী মেয়েরা সেলাই করবে / সেই জামা সারাদিন। তাদের ঘুম/ বনেদি বাড়ির বিড়ালের মতো চিত্রিত ও মূল্যবান/ সময় লাগে না, ঘুমের বাড়ি আর পায়চারি ছাড়াই/ ঝাঁপিয়ে পড়ে অন্তর্বাস খোলার পরপরই।”

অসম্ভব কল্পনাপ্রবণ কবি কখনও কল্পনাকে বাস্তবে রূপায়ন করার চেষ্টা করেছেন কবিতায়, কখনওবা বাস্তবকে করে তুলেছেন অধিবাস্তব কিংবা পরাবাস্তব জিজ্ঞাসায়। বারবার নিজেকেই আবিষ্কারে মত্ত থেকেছেন তিনি। একটি মহৎ কবিতার জন্য আকণ্ঠ নিমজ্জিত থেকেছেন প্রেমে-অপ্রেমে, বিরহে, বঞ্চনায়, অতলান্ত গভীর মনস্বিতায়। আর এজন্যই কবি সিকদার আমিনুল হক বলতে পেরেছেন, “কবিতাকে থাকতে দাও একা, অস্পষ্ট আর পরস্ত্রীর মত পবিত্র।” আর এভাবেই তিনি তাঁর কবিতার স্বরটিকে স্বাতন্ত্র্য করে তোলেন, করে তোলেন আলোর অধিষ্ঠান।

সিকদার আমিনুল হকÑ মহৎ কবিতা নির্মাণের একনিষ্ঠ কারিগর। সমাজ বাস্তবতা তাঁকেও পীড়িত করেছে বহুবার। চারপাশের ডামাডোল, হইচই, উচ্চৈঃস্বর কখনও তাঁকে ছুঁতে পারে নি। কবি যেন সমাহিত সর্বদা কবিতার কাছেই, নির্জনতার কাছেই। নাগরিক জীবন তাঁকে এতটুকু বদলে দেয় নি বা দিতে পারে নি। বাজারি কবিতার ভিড়েও কখনও তিনি নিজেকে সঁপে দেন নি। সৎ থেকেছেন নিজের কাছে, কবিতার কাছে। দশকে বিশ্বাস ছিল না তাঁর। তাইতো বলছেন, “আমাদের মুদ্রা আর নৃত্যের নিজস্ব বৃত্ত/ দশক হিসাবে তার বিচার হবে নাÑ/ কার সামনে ছিল ছায়াচ্ছন্ন পানের বরজ/ সাঁওতালি নাচ/ আর/ ফ্যাক্টরির ভাঙা চাঁদ/ তার কোনো হিসাব হবে না।”

বাংলা সাহিত্যে তাঁর মতো এমন সংবেদনশীল কবি আর দ্বিতীয় কেউ আছেন বা ছিলেন আমার জানা নেই। তাঁর কবিতায় রয়েছে অসাধারণ সব চিত্রকল্প, রূপক, প্রতীক আর উপমার অনবদ্য উপস্থাপন। তিনি যখন বলেন, “তোমার জন্যই এত কিছু করা/ বালিতে প’ড়ে ঘন হয় শান্ত কুয়োতলা/ আমি ও কবিতা নকশা বুনেছি ঢের রহস্যের”। সত্যিই তিনি কবিতার প্রতিটি পরতে পরতে রহস্যের আর বিমূর্ত চেতনার ছবি এঁকেছেন। কখনও কখনও কবিতায় করেছেন দ্বান্দ্বিকতার অপূর্ব রূপায়ন; ভেঙ্গেছেন আবার গড়েছেন অনিবার্য আকস্মিকতায় !

বিশ্বসাহিত্যের পরিম-লেও ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। তিনি ভ্রমন করেছেন নানান দেশ। কাব্যপিপাসাই তাঁকে আত্মস্থ করতে শিখিয়েছে নানান ভাষা; কবিতার মোহন সুন্দর। সিকদার নির্দ্বিধায় অবগাহন করেছেন ফরাসি কাব্যে, মসনবিতে, ওমর খৈয়াম কিংবা জালাল উদ্দিন রুমিতে। আবার কখনও কখনও দার্শনিক দেকার্তে কিংবা র?্যাবোঁও তাঁকে অনুপ্রাণিত করেছে দারুণভাবে। তিনি কবিতায় একটি নিজস্ব স্টাইল বা ঘরানা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। কতটা সাহসী আর অন্তর্ভেদী হলে বলা যায়Ñ “নারীর রহস্যের জানালা খুলেই আমি ঈশ্বরের মুখ দেখতে পাই। দুঃখ আর আনন্দকে এত পাশাপাশি উজ্জীবিত রাখতে প্রকৃতিতে আর কেউ পারে না বলে নারীই বোধ হয় ঈশ্বরের কাছাকাছি।” এরকম অসংখ্য অমর পঙ্ক্তি সিকদার আমিনুল হক আমাদের জন্য রেখে গেছেন।

কবিতায় যেমন সিকদার আমিনুল হক অনন্য তেমনি কাব্যের নামকরণেও অসম্ভব ব্যতিক্রম তিনি। যেমনÑ দুরের কার্নিশ, তিন পাপড়ির ফুল, পারাবত এই প্রাচীরের শেষ কবিতা, বহুদিন উপেক্ষায় বহুদিন অন্ধকারে, সতত ডানার মানুষ, সুপ্রভাত হে বারান্দা, কাফকার জামা কিংবা লোর্কাকে যেদিন ওরা নিয়ে গেল, সুলতা আমার এলসা, পাত্রে তুমি প্রতিদিন জল, বিষণœ তাতার, ঈশিতার অন্ধকার শুয়ে আছেÑ ইত্যাদি সব অম্লান, অজ্ঞেয় কাব্য সম্ভার।

সিকদার নিভৃতচারী ছিলেন বটে কিন্তু তারচে’বেশি ছিলেন লক্ষ্যভেদী। লক্ষ্য ছিল তাঁর স্থির। শুদ্ধ কবিতার প্রতি, শিল্প সৌন্দর্যের প্রতি ছিল তাঁর অনিবার্য পক্ষপাত। তাইতো তিনি আর সবার চেয়ে আলাদা। কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন বাংলা সাহিত্যের শুদ্ধতম কবি। আবার অনেকে ঠাট্টা-বিদ্রুপ করে বলেছেন ফরাসি কবি। কিন্তু সিকদার আমিনুল হক বরাবরই থেকেছেন নির্মোহ, আত্মমগ্ন, অন্তর্লীন, মিতবাক আর আধ্যাত্মচেতনায় নিমগ্ন গভীর!

প্রত্যেক কবিকেই দেখা যায় কোনো না কোনো মানস প্রতিমার কাছে সমর্পিত থাকতে। কবি জীবনানন্দ যেমন ছিলেন বনলতা সেনের কাছে, সুনীল তাঁর নীরার কাছে কিংবা বিনয় গায়ত্রীর কাছে। তেমনি, সিকদারও কি ছিলেন তাঁর সুলতার কাছে? নইলে কী করে তিনি উচ্চারণ করেন, “সুলতা, সুলতা জানে ভালো/ আকাশে মেঘÑ/ দিঘিতে কেন হাঁস,/ সুলতা জানে, সুলতা জানে ভালো/কবিরা কেন নারীর ক্রীতদাস!”

অথবাÑ

চাচ্ছি সুলতাকে আমি, সাড়া দেয় এলসা। আরাগঁ

আমাকে তুমি দোষ দেবে; কিন্তু নেই পাপ!

এমন অজস্র পঙ্ক্তি সিকদারের কবিতায় সুলতাকে আশ্রয় করে রচিত হয়েছে। ভাবনায়, রূপকল্পে তিনি যেমন অসাধারণ কাব্যময়তার সৃষ্টি করেছেন তেমনি নিরন্তর রক্তক্ষরণের পরও কবিতাকেই করেছেন সর্বশেষ আশ্রয়। সতত ডানায় ভর করে উড়েছেন, উড়িয়েছেন সবাইকে।

দৃঢ় চিত্তে বলেছেন, ‘ছয়টি ঋতুর সব পথে আমি ঘুরব। চপ্পল হারিয়ে আমি হাঁটবো পাশাপাশি বাগানের সবুজ ঘাসে’

যতদিন বাংলা কবিতা থাকবে, ততদিন কবি সিকদার আমিনুল হকও বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে সতত ডানার মানুষ হয়ে।

back to top