alt

সাময়িকী

একটি ভাঙ্গা থালা

রুহুল আমিন বাচ্চু

: বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

আমিতো পেডের ভুহে হাত বাড়াই বাবা, আমারতো কেউ নাই... চোখ দু’টি কোটর শূন্য, বাঁ পা’টা খাটো, ডান হাতের কবজি অবধি দু’ফালি, বাম হাতে-তিনটি আঙ্গুল কাটা। নিত্যদিন দেখি লোকটি স্টেডিয়াম চত্বরে বাম হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা মেলে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছে।

ঢাকা স্টেডিয়াম চত্বর পার হয়ে যাওয়াটা আমার নিত্যদিনের অংশ। বহু বছর ধরে লোকটাকে একই ভাষায় ভিক্ষে চাইতে দেখছি। লোকটাকে প্রথম দেখা থেকে আমি সহ্য করতে পারিনি। মনে হতো বিগত জীবনে লোকটি ডাকাত ছিল। তার কাল কুচকুচে শরীরে চকচকে শক্ত পেশীর বাঁধন। দু’চোখের গর্তে ভয়ঙ্কর শূন্যতা। খসখসে গলায় কর্কশ আর্তি যা অন্তত আমার মন গলাতে পারেনি। আমার ধারণা লোকটি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে পাবলিকের মাইরে হাত-পা, চোখ খুইয়ে চৌদ্দ বছর সাজা খেটে ভিখেরি সেজেছে। লোকটাকে কেউ সাহায্য করতে দেখলে আমার রাগ হতো, যেমন রাগ হয় ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষুককে কেউ সাহায্য করতে দেখলে।

আসলে বর্তমান সময়ে খ্যাপা মন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে না। সময় তাড়া দিচ্ছে অর্থ আর ঐশ্বর্যের দিকে।

দেশ স্বাধীন হলো বলে অনেক সম্ভার আজ হাতের মুঠোয়। কাঠের চেয়ারের পরিবর্তে অফিসে রিভলভিং চেয়ার চতুর্দিকে কাচ লাগানো একক চেম্বার মেঝেতে সুদৃশ্য কার্পেট। চলাচলের জন্য সরকারি পয়সায় গাড়ি-ড্রাইভার। ইয়েস স্যারের কল্যাণে আজ অনেক কিছু হাতের মুঠোয়। গাড়ি নিয়ে গ্রামে গেলে দু’দশজন ঘিরে ধরে, অসুবিধার কথা জানায়। কিছু নোট বিলিয়ে দেয়ার মাঝে যে জমিদারি মেজাজ জন্মে আগে জানা ছিল না।

অথচ, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছ’আনা হালি ডিম বেচে কলেজের বেতন দিতাম। প্যান্ট, শার্ট বলতে দু’জোড়া ছিল না, চামড়ার জুতো ছিল বাবার বেতনের অধরা মূল্যে।

অনেকদিন পর স্টেডিয়াম চত্বর পার হচ্ছি, হঠাৎ চলার গতি থেমে গেল, এদিক ওদিক তাকিয়ে সে ভিক্ষুকটাকে দেখলাম না। চলার পথে এমন অনেক কিছুই আছে- নাই হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার ভাবনার সুযোগ মনকে দিলাম না, এগিয়ে চল্লাম।

অফিসে কাল বোর্ড মিটিং-ভাবনার সময় নাই। বোর্ড মেম্বারদের সব ফাইল পাঠানো হয়নি। বোর্ড মিটিং মানে রীতিমতো ভোজের আয়োজন। গত বোর্ড মিটিং-এ বারজন বোর্ড মেম্বার খেয়েছেন অর্ধলক্ষ টাকা। এ খরচের হিসাব কেউ দেখে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই তো সব কিছুই বেহিসেবী হাতের মুঠোয়। সেই আমিও এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। সুসময়কে নিয়ন্ত্রণ করছি ইয়েস স্যারের কল্যাণে।

গতকালের বোর্ড মিটিং-এর পর আজ তেমন কাজ নেই। হঠাৎ মনে হলো ড্রাইভার আসবে না আগেই জানিয়েছিল। ছোট মেয়েটি স্কুলে। ড্রাইভারের খবর সে জানে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আধা ঘণ্টা পর ওর স্কুল ছুটি হবে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে বনশ্রী ওর আইডল স্কুলের সামনে হাজির হলাম। ততোক্ষণে স্কুল ছুটির বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। মেয়ের স্কুল গেটে ব্রেক কষলাম। দারোয়ান এগিয়ে এলো, বল্লাম স্কুল কখন ছুটি হয়েছে? আমার মেয়ে শম্পা ক্লাস সেভেনে পড়ে-

দারোয়ানের চেহারায় হতাশা, জানালো ভেতরে কেউ নেই। মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকবার হর্ন বাজালাম। শেষে গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম।

রামপুরা খালের পাড় দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। দেখি কৃষ্ণচূড়ার গাছের আড়ালে মেয়েটি বসে বসে কারো গল্প শুনছে। আরেকটু স্পষ্ট হতেই দেখি সেই ভাঙ্গা থালার ভিক্ষুকটা। আমার মেয়েটি বিশ্রী লোকটার মুখোমুখি বসে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। পথে যেতে যেতে শম্পা একাধিকবার কী যেন বলতে চাইলো। ওকে থামিয়ে দিলাম। বাসায় ফিরে ওর মাকে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলাম। শম্পা ওর মাকে কিছু বলতে চাইলো। ওর পাকামোতে মা আরো কঠোর হলো।

মাস খানেক পর আবার শম্পাকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম। কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটির গোড়ায় তাকালাম। শম্পা আমার দৃষ্টি ফলো করে বলল, বাবা লোকটার ভীষণ অসুখ। পাশের বস্তিতে থাকে। মনে হয় বাঁচবে না। শম্পার গলা ভিজে এলো; আমি হতবাক। যে মেয়েটি একটি বিড়াল দেখে খাটে লাফিয়ে ওঠে, সে কিনা ভীষণ দর্শন একজন ভিখেরির জন্য মায়া দেখাচ্ছে-

‘যাবে বাবা, লোকটাকে দেখতে?’

ওর কথায় অবাক হই। কী করে ও সাহস পেল আমাকে এ প্রস্তাব দিতে! শম্পার গ- পেরিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার কঠোর দৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলে নিল।

বছর শেষ। ওর মা ওর স্কুল ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আশ্চর্য রকমের কিছু একটা পেয়ে ঘর মাথায় তুলল। আমি দৌড়ে গেলাম। মা মেয়েতে কাড়াকাড়ি একটা ডাইরি নিয়ে। আমাকে দেখে দু’জনেই নিষ্ক্রিয় হলো। স্ত্রী কালো রঙের পকেট ডাইরিটি আমার হাতে তুলে দিল।

চামড়ার কভার থাকায় তেলচিটে পাতাগুলো অনেকটা অস্পষ্ট। হরফগুলো চটকে গেলেও পড়া যায়।

উনিশ শ’ একাত্তর পঁচিশে মার্চ দিয়ে শুরু। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের শেষ চারটি লাইন প্রথম পাতায়। তারপর পাতায় পাতায় দিনলিপি।

‘জুন ১৫, ১৯৭১ আমিশাপাড়া হয়ে- নৌকায় বজরা, কানকিরহাট, বেলুনিয়া হয়ে আগরতলা...’ আমিতো লাফিয়ে উঠি-। গায়ের লোমকূপ সব খাড়া হয়ে যায়, মস্তিষ্ক বেয়ে শীতল ¯্রােত নামতে থাকে মেরুদ- বেয়ে। পরের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকি দ্রুত। শেষ পাতার একটি সাক্ষর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মোহাম্মদ শাজাহান, বীর প্রতীক। সাজু ভাই বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার অতীত তীব্রভাবে আমার অস্তিত্বে নাড়া দেয়। আমাদের কমান্ডার সাজু ভাই। চাটখিল, রামগঞ্জ ক্যাম্প থেকে প্রায়ই আমরা অপারেশন চালাতাম মল্লিকা দিঘিরপাড়, চৌধুরীর হাট, চন্দ্রগঞ্জ। যুদ্ধের উন্মাদনা আমাদের ঘিরে থাকতো সব সময়। অগ্রনায়ক সাজু ভাই সবার আগে।

নভেম্বরের শেষে চন্দ্রগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ করতে গিয়ে সাজু ভাই আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। তার উপর চলে পাক আর্মি রাজাকারদের নির্যাতন। পরের খবর আমার জানা ছিল না। তার বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্তির খবর পত্রিকাতে পেয়েছি। মেয়েকে নিয়ে ড্রাইভ করে চলে এলাম সেই বস্তিতে। একজন জানালো মানুষটা গতকাল মারা গেছে। আপন কেউ ছিল না বলে আঞ্জুমানে লাশটি নিয়ে গেছে। সাজু ভাইয়ের পরিত্যক্ত নোংরা বস্তিতে বসে পড়লাম। আগেই জানতাম, রাজাকারেরা তার স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের মেরে ফেলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।

আমার মেয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে। আমার চোখে দু’ফোঁটা জল দেখে ও হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে।

বাবা, বাবা, বাবা তুমিও তো মুক্তিযোদ্ধা, কোনোদিন তো তোমাদের যুদ্ধের কথা শোনাওনি। আমরা তো জানি না কী করে তোমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছ? সাজু আংকেল আমাকে জানিয়েছে- অনেক-অনেক যুদ্ধের কথা শম্পা বলতেই থাকে, বাবা তোমার তো কত কিছু, সাজু আংকেলের কিছুই নেই কেন? মনে মনে ভাবলাম আমারতো সময় নেই, ‘টাইম ইজ মানি। চোখের সাম নে ভেসে উঠলো সাজু ভাইয়ের আর্তি; আমি তো পেডের ভুহে হাত বাড়াই বাবা আমার তো কেউ নেই।’

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

tab

সাময়িকী

একটি ভাঙ্গা থালা

রুহুল আমিন বাচ্চু

বৃহস্পতিবার, ০৯ জানুয়ারী ২০২৫

আমিতো পেডের ভুহে হাত বাড়াই বাবা, আমারতো কেউ নাই... চোখ দু’টি কোটর শূন্য, বাঁ পা’টা খাটো, ডান হাতের কবজি অবধি দু’ফালি, বাম হাতে-তিনটি আঙ্গুল কাটা। নিত্যদিন দেখি লোকটি স্টেডিয়াম চত্বরে বাম হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালা মেলে দাঁড়িয়ে ভিক্ষে করছে।

ঢাকা স্টেডিয়াম চত্বর পার হয়ে যাওয়াটা আমার নিত্যদিনের অংশ। বহু বছর ধরে লোকটাকে একই ভাষায় ভিক্ষে চাইতে দেখছি। লোকটাকে প্রথম দেখা থেকে আমি সহ্য করতে পারিনি। মনে হতো বিগত জীবনে লোকটি ডাকাত ছিল। তার কাল কুচকুচে শরীরে চকচকে শক্ত পেশীর বাঁধন। দু’চোখের গর্তে ভয়ঙ্কর শূন্যতা। খসখসে গলায় কর্কশ আর্তি যা অন্তত আমার মন গলাতে পারেনি। আমার ধারণা লোকটি ডাকাতি করতে গিয়ে ধরা খেয়ে পাবলিকের মাইরে হাত-পা, চোখ খুইয়ে চৌদ্দ বছর সাজা খেটে ভিখেরি সেজেছে। লোকটাকে কেউ সাহায্য করতে দেখলে আমার রাগ হতো, যেমন রাগ হয় ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষুককে কেউ সাহায্য করতে দেখলে।

আসলে বর্তমান সময়ে খ্যাপা মন অনেক কিছুই সহ্য করতে পারে না। সময় তাড়া দিচ্ছে অর্থ আর ঐশ্বর্যের দিকে।

দেশ স্বাধীন হলো বলে অনেক সম্ভার আজ হাতের মুঠোয়। কাঠের চেয়ারের পরিবর্তে অফিসে রিভলভিং চেয়ার চতুর্দিকে কাচ লাগানো একক চেম্বার মেঝেতে সুদৃশ্য কার্পেট। চলাচলের জন্য সরকারি পয়সায় গাড়ি-ড্রাইভার। ইয়েস স্যারের কল্যাণে আজ অনেক কিছু হাতের মুঠোয়। গাড়ি নিয়ে গ্রামে গেলে দু’দশজন ঘিরে ধরে, অসুবিধার কথা জানায়। কিছু নোট বিলিয়ে দেয়ার মাঝে যে জমিদারি মেজাজ জন্মে আগে জানা ছিল না।

অথচ, দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে ছ’আনা হালি ডিম বেচে কলেজের বেতন দিতাম। প্যান্ট, শার্ট বলতে দু’জোড়া ছিল না, চামড়ার জুতো ছিল বাবার বেতনের অধরা মূল্যে।

অনেকদিন পর স্টেডিয়াম চত্বর পার হচ্ছি, হঠাৎ চলার গতি থেমে গেল, এদিক ওদিক তাকিয়ে সে ভিক্ষুকটাকে দেখলাম না। চলার পথে এমন অনেক কিছুই আছে- নাই হয়ে যায়। দ্বিতীয়বার ভাবনার সুযোগ মনকে দিলাম না, এগিয়ে চল্লাম।

অফিসে কাল বোর্ড মিটিং-ভাবনার সময় নাই। বোর্ড মেম্বারদের সব ফাইল পাঠানো হয়নি। বোর্ড মিটিং মানে রীতিমতো ভোজের আয়োজন। গত বোর্ড মিটিং-এ বারজন বোর্ড মেম্বার খেয়েছেন অর্ধলক্ষ টাকা। এ খরচের হিসাব কেউ দেখে না। দেশ স্বাধীন হয়েছে বলেই তো সব কিছুই বেহিসেবী হাতের মুঠোয়। সেই আমিও এখন গাড়ি-বাড়ির মালিক। সুসময়কে নিয়ন্ত্রণ করছি ইয়েস স্যারের কল্যাণে।

গতকালের বোর্ড মিটিং-এর পর আজ তেমন কাজ নেই। হঠাৎ মনে হলো ড্রাইভার আসবে না আগেই জানিয়েছিল। ছোট মেয়েটি স্কুলে। ড্রাইভারের খবর সে জানে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম আধা ঘণ্টা পর ওর স্কুল ছুটি হবে। নিজেই গাড়ি ড্রাইভ করে বনশ্রী ওর আইডল স্কুলের সামনে হাজির হলাম। ততোক্ষণে স্কুল ছুটির বিশ মিনিট পেরিয়ে গেছে। মেয়ের স্কুল গেটে ব্রেক কষলাম। দারোয়ান এগিয়ে এলো, বল্লাম স্কুল কখন ছুটি হয়েছে? আমার মেয়ে শম্পা ক্লাস সেভেনে পড়ে-

দারোয়ানের চেহারায় হতাশা, জানালো ভেতরে কেউ নেই। মনের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। এদিক ওদিক তাকিয়ে কয়েকবার হর্ন বাজালাম। শেষে গাড়ি পার্ক করে নেমে পড়লাম।

রামপুরা খালের পাড় দিয়ে কিছুটা এগিয়ে গেলাম। দেখি কৃষ্ণচূড়ার গাছের আড়ালে মেয়েটি বসে বসে কারো গল্প শুনছে। আরেকটু স্পষ্ট হতেই দেখি সেই ভাঙ্গা থালার ভিক্ষুকটা। আমার মেয়েটি বিশ্রী লোকটার মুখোমুখি বসে আছে। নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। পথে যেতে যেতে শম্পা একাধিকবার কী যেন বলতে চাইলো। ওকে থামিয়ে দিলাম। বাসায় ফিরে ওর মাকে কিছুক্ষণ বকাঝকা করলাম। শম্পা ওর মাকে কিছু বলতে চাইলো। ওর পাকামোতে মা আরো কঠোর হলো।

মাস খানেক পর আবার শম্পাকে স্কুল থেকে আনতে গেলাম। কৌতূহল দৃষ্টি নিয়ে কৃষ্ণচূড়া গাছটির গোড়ায় তাকালাম। শম্পা আমার দৃষ্টি ফলো করে বলল, বাবা লোকটার ভীষণ অসুখ। পাশের বস্তিতে থাকে। মনে হয় বাঁচবে না। শম্পার গলা ভিজে এলো; আমি হতবাক। যে মেয়েটি একটি বিড়াল দেখে খাটে লাফিয়ে ওঠে, সে কিনা ভীষণ দর্শন একজন ভিখেরির জন্য মায়া দেখাচ্ছে-

‘যাবে বাবা, লোকটাকে দেখতে?’

ওর কথায় অবাক হই। কী করে ও সাহস পেল আমাকে এ প্রস্তাব দিতে! শম্পার গ- পেরিয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। আমার কঠোর দৃষ্টি দেখে নিজেকে সামলে নিল।

বছর শেষ। ওর মা ওর স্কুল ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আশ্চর্য রকমের কিছু একটা পেয়ে ঘর মাথায় তুলল। আমি দৌড়ে গেলাম। মা মেয়েতে কাড়াকাড়ি একটা ডাইরি নিয়ে। আমাকে দেখে দু’জনেই নিষ্ক্রিয় হলো। স্ত্রী কালো রঙের পকেট ডাইরিটি আমার হাতে তুলে দিল।

চামড়ার কভার থাকায় তেলচিটে পাতাগুলো অনেকটা অস্পষ্ট। হরফগুলো চটকে গেলেও পড়া যায়।

উনিশ শ’ একাত্তর পঁচিশে মার্চ দিয়ে শুরু। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণের শেষ চারটি লাইন প্রথম পাতায়। তারপর পাতায় পাতায় দিনলিপি।

‘জুন ১৫, ১৯৭১ আমিশাপাড়া হয়ে- নৌকায় বজরা, কানকিরহাট, বেলুনিয়া হয়ে আগরতলা...’ আমিতো লাফিয়ে উঠি-। গায়ের লোমকূপ সব খাড়া হয়ে যায়, মস্তিষ্ক বেয়ে শীতল ¯্রােত নামতে থাকে মেরুদ- বেয়ে। পরের পাতাগুলো ওল্টাতে থাকি দ্রুত। শেষ পাতার একটি সাক্ষর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ মোহাম্মদ শাজাহান, বীর প্রতীক। সাজু ভাই বলে চিৎকার দিয়ে উঠি। আমার অতীত তীব্রভাবে আমার অস্তিত্বে নাড়া দেয়। আমাদের কমান্ডার সাজু ভাই। চাটখিল, রামগঞ্জ ক্যাম্প থেকে প্রায়ই আমরা অপারেশন চালাতাম মল্লিকা দিঘিরপাড়, চৌধুরীর হাট, চন্দ্রগঞ্জ। যুদ্ধের উন্মাদনা আমাদের ঘিরে থাকতো সব সময়। অগ্রনায়ক সাজু ভাই সবার আগে।

নভেম্বরের শেষে চন্দ্রগঞ্জ আর্মি ক্যাম্প আক্রমণ করতে গিয়ে সাজু ভাই আহত অবস্থায় ধরা পড়ে। তার উপর চলে পাক আর্মি রাজাকারদের নির্যাতন। পরের খবর আমার জানা ছিল না। তার বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্তির খবর পত্রিকাতে পেয়েছি। মেয়েকে নিয়ে ড্রাইভ করে চলে এলাম সেই বস্তিতে। একজন জানালো মানুষটা গতকাল মারা গেছে। আপন কেউ ছিল না বলে আঞ্জুমানে লাশটি নিয়ে গেছে। সাজু ভাইয়ের পরিত্যক্ত নোংরা বস্তিতে বসে পড়লাম। আগেই জানতাম, রাজাকারেরা তার স্ত্রী-পুত্র কন্যাদের মেরে ফেলে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল।

আমার মেয়ে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদতে থাকে। আমার চোখে দু’ফোঁটা জল দেখে ও হাউ মাউ করে কেঁদে ওঠে।

বাবা, বাবা, বাবা তুমিও তো মুক্তিযোদ্ধা, কোনোদিন তো তোমাদের যুদ্ধের কথা শোনাওনি। আমরা তো জানি না কী করে তোমরা দেশটাকে স্বাধীন করেছ? সাজু আংকেল আমাকে জানিয়েছে- অনেক-অনেক যুদ্ধের কথা শম্পা বলতেই থাকে, বাবা তোমার তো কত কিছু, সাজু আংকেলের কিছুই নেই কেন? মনে মনে ভাবলাম আমারতো সময় নেই, ‘টাইম ইজ মানি। চোখের সাম নে ভেসে উঠলো সাজু ভাইয়ের আর্তি; আমি তো পেডের ভুহে হাত বাড়াই বাবা আমার তো কেউ নেই।’

back to top