মুনীর সিরাজ
জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনা
জ্যাজ সঙ্গীত মূলত যন্ত্রসঙ্গীত। ১৯২০ সালের পরই জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের ধারার মতো জ্যাজ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় আফ্রিকান দাসরা নিউ অরালিয়ন্সে একটি বিশেষ বাজারে জড়ো হতো। স্থানটি আফ্রিকান নৃত্যের জন্য প্রখ্যাত ছিল এবং স্থানটির নাম রাখা হয়েছিল কঙ্গো স্কয়ার। ১৮৮৬ সালের মধ্যে আটলান্টিক দাস ব্যবসায় উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৪ লক্ষ আফ্রিকান নিয়ে এসেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকা থেকেই এই আফ্রিকানদের ধরে আনা হয়েছিল। খেতেখামারে কারখানায় বিভিন্ন ধরনের মজুরের কাজ করা এই দাসগণ তাদের দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দ করার জন্য অদ্ভুত ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এই নতুন ধরনের সঙ্গীত উদ্ভাবন শুরু করে। এ যন্ত্রসমূহ ছিল ড্যাশ বোর্ড (কাপড় কাঁচার জন্য ব্যবহৃত) ওয়াশট্যাব, জগ, টিনের বাক্স- যা কাঠ বা হাড় দিয়ে পিটিয়ে শব্দ করা হতো এবং ব্যারেলের মুখে পশুর চামড়া এঁটে তাকে ড্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফসল তোলার মৌসুমে বেশ কয়েক দিন এ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উৎসব উদ্যাপিত হতো। তবে জ্যাজ সঙ্গীত ক্রমশ ইউরোপীয় সঙ্গীতের সাথে মিলিত হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সহজতর আফ্রিকান ধারাই টিকে থাকে এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতের জটিল বিষয়গুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
জ্যাজ সঙ্গীতের যন্ত্রসমূহের ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে। আধুনিক জ্যাজ সঙ্গীতে ব্যবহৃত যন্ত্রসমূহ হচ্ছে (১) ডাবল ব্যাস (২) ড্রাম (৩) গিটার- সাধারণ এবং ইলেকট্রিক (৪) পিয়ানো (৫) স্যাক্সোফোন (৬) ট্রাম্পেট (৭) ক্লারিনেট (৮) ট্রমবোন (৯) টুবা (১০) ভাইব্রেশন (১১) হ্যামন্ড অরগ্যান (১২) হারমোনিকা (১৩) ঢোল বা ড্রাম এবং আরো বহুবিধ বাদ্য যন্ত্র।
ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জ্যাজ একটি সঙ্গীত ধারার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা বহুধা বিস্তৃত হয়ে বিভিন্ন ধারা উপধারার বিশাল সঙ্গীত প্রবাহে বিস্তৃতি লাভ করে। বিভিন্ন ধারা উপধারার এই জ্যাজু সঙ্গীত Cool Jazz, Hard Bop Jazz, Modal Jazz, Bebop Jazz, Fru Jazz, Avant Grad Jazz, Fussion Jazz ইত্যাদি বহু নামে পরিচিতি লাভ করে তাদের স্বকীয় গুণ সংরক্ষণ করেই।
জ্যাজ এমনি এক সঙ্গীত ধারা যাতে প্রতিটি যন্ত্রের স্বর সুর একত্রিত হয়ে একের সাথে অপরের ধ্বনি সমন্বিত হয়ে সামঞ্জস্য রক্ষা করে উচ্চারিত হয়। আবার প্রতিটি যন্ত্রের স্বর এই সমন্বিত ধ্বনি তরঙ্গের মধ্যে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়েই উচ্চারিত হয়। এই অপূর্ব সংমিশ্রণ শুধু জ্যাজ সঙ্গীতেই সম্ভব করে তুলেছিল আফ্রিকান আমেরিকান শিল্পীগণ। আবার সঙ্গীত পরিবেশনার সময় প্রত্যেক যন্ত্রবিদ ভিন্ন ভিন্নভাবে তার নিজের যন্ত্রের সঙ্গীত এমনভাবে পরিবেশন করেন, যাতে অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গীত তরঙ্গের ভিত্তির উপর শিল্পীর নিজের যন্ত্রটির স্বকীয়তা প্রকাশিত হতে পারে।
তবে জ্যাজ সঙ্গীতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে Improvisation বা তাৎক্ষণিক উদ্ভাবিত স্বর ব্যাঞ্জনা। এই Jazz Improvisation এবং কন্ঠ জ্যাজ সঙ্গীত সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয়াই এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
জ্যাজ সংগীতের তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন : জ্যাজ ইম্প্রোভাইজেশনকে জ্যাজ সঙ্গীতের প্রাণ বলা যায়। ইম্প্রোভাইজেশন কথাটার অর্থ তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন বা রচনা। তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনে বাদক যখন তারযন্ত্র পিয়ানো বা ডাবল ব্যাস বাজাতে থাকেন, তখন হঠাৎই তিনি ভিন্ন একটা সুর যন্ত্রস্বরে যোগ করে দিয়ে সংগীতের আবহ তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন। এই পরিবর্তন কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার কারণেই যন্ত্র শিল্পী তা করতে সক্ষম হন। এতে উপস্থিত শ্রোতৃম-লী আবেগ আপ্লুত হয়ে ওঠেন। জ্যাজের এই তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা অন্য যে কোনো সঙ্গীতের তুলনা বিচারে অতুলনীয় বটে।
জ্যাজ সঙ্গীত রচনা এবং তাৎক্ষণিক জ্যাজ সৃষ্টি একটি অন্যটির ঠিক উল্টো মনে হতে পারে। কিন্তু জ্যাজ সঙ্গীতে এই তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনে এক অনন্যতা নিয়ে আসা হয়। এটা অভিনব বটে। সঙ্গীত সৃষ্টিশীলতার এ এক অনন্য উদাহরণ।
একটা ভুল ধারণা থাকতে পারে যে জ্যাজ ইম্প্রোভাইজেশন হঠাৎ করে হাওয়া থেকে পাওয়ার মতো ব্যাপার। পূর্ব নির্ধারিত কোনো জ্যাজ সঙ্গীতের স্বর ব্যঞ্জনা ব্যতিরেকে অনির্ধারিতভাবেই চলমান সঙ্গীতে হঠাৎ পরিবর্তিত সুর-স্বর সংমিশ্রণ করা হয় এবং জ্যাজ বাদকগণ এ পরিবর্তনের সাথে সম্মিলিতভাবে তাৎক্ষণিক সংযুক্ত হয়ে সংঙ্গীত পরিবেশনার আবহ বদলে দেন। এতে শ্রোতা উদ্দীপিত হয়ে ওঠেন এবং মনের প্রবল আনন্দে এই পরিবর্তিত আবহে ভাসতে থাকেন। ঐ মুহূর্তে শিল্পীগণ প্রকৃতই তাৎক্ষণিকভাবে জটিল জ্যাজ সৃষ্টি করে চলেছেন এবং প্রত্যেক যন্ত্রবাদক তার নিজের যন্ত্রের স্বর অন্য সকল যন্ত্রবাদকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলেছেন। গিটার পিয়ানো ব্যাস ড্রাম ট্রমবোন বাঁশি স্যাক্সোফোন প্রতিটি যন্ত্রে তার নিজস্বতা রক্ষা করেই জ্যাজ শিল্পীগণ জ্যাজ সঙ্গীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাৎক্ষণিকভাবে সদ্য রচনার সাথে যুক্ত হয়ে প্রত্যেকে তাঁর যন্ত্র বাজিয়ে চলেন এবং সঙ্গীত তখন তার নিজের গতিতেই অগ্রসর হতে থাকে। বস্তুত এই অগ্রসরমান তাৎক্ষণিক জ্যাজ উদ্ভাবিত যন্ত্রসঙ্গীত সেকেন্ডের ভগ্নাংশে মস্তিষ্ক থেকে নিঃসরিত হয়ে সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। এ সঙ্গীতের অভাবনীয় সৃষ্টি এবং অগ্রসরমানতা যা মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যায় এবং তা জ্যাজ সঙ্গীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব: ২০১৩ সাল থেকে জার্সি সিটির কৃষকদের বাজার (Farmers Market)-এ জ্যাজ উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৯ মে থেকে ০২ জুন ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব পালিত হয় বিশাল হাডসন নদীর পারে ‘এক্সচেঞ্জ প্লেস’ নামক স্থানে নিউইয়র্ক শহরের ঠিক উল্টো দিকে। কালক্রমে ‘রিভারভিউ জ্যাজ’ প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব’। এই প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের জন্য প্রতি বছর বিনামূল্যে উন্মুক্ত জ্যাজ পরিবেশন করেন। হাজার হাজার মানুষ এই জ্যাজ উৎসবে যোগদান করে। জার্সি সিটির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে এই জ্যাজ সঙ্গীত পরিবশেন করা হয়।
কিছুদিন ধরে জার্সি সিটিতে থাকার সুবাদে এক্সচেঞ্জ প্লেস-এ সরাসরি এই জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনায় যোগ দিয়েছিলাম। তিনটি অনুষ্ঠানে আমি সশরীরে উপস্থিত ছিলাম। শিল্পীদের স্যাক্সোফোন, ট্রমবোন, বাঁশি, ড্রাম এবং অন্যান্য জ্যাজ যন্ত্র সহকারে জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করে আনন্দিত হয়েছিলাম নিজেকে এক নতুন সঙ্গীতধারার সাথে যুক্ত করতে পেরে। যন্ত্রের শিল্পীরা একটি অনুষ্ঠানে একটি সঙ্গীত পরিবেশনার আবহে নির্ভর করে একে একে স্যাক্সোফোন, ট্রমবোন, বাঁশি ইত্যাদি বাজানোর কারিশমা পরিবেশন করল বিভিন্ন যন্ত্রের বাজানোর বিভিন্নতা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী ধ্রুপদী পর্যায়ের সঙ্গীত ধারা হিসেবে জ্যাজ এখন স্বীকৃত সঙ্গীত শিল্প। প্রায় বিশ হাজার দর্শক ¯্রােতা এক্সচেঞ্জ প্ল্রেসের এই জ্যাজ উৎসব উপভোগ করেন।
শ্রেষ্ঠ জ্যাজ সঙ্গীত শিল্পী: জ্যাজ এর শ্রেষ্ঠ শিল্পী কে, কারা বা কতজন তা হিসেব করে নিরূপণ করা কঠিন। শতাব্দীব্যাপী জ্যাজকে এক উচ্চমানের সঙ্গীতশিল্প হিসেবে পৌঁছে দিতে যারা সফলতা অর্জন করেছেন তাঁদের দীর্ঘ তালিকা দেয়া কঠিন। বহু যন্ত্রের বহু শিল্পী বহু সুরে-বাদ্যে (Polyrythm) যে জ্যাজ সৃষ্টি করেছেন, তা আবার বহুশিল্পীর উপস্থিতিতে সমন্বিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়, এ বিষয়টা অভিনবই বটে। বহু শিল্পীর একত্রে জ্যাজ পরিবেশন করা এবং একই সাথে প্রত্যেক শিল্পীই তার স্বাধীন সত্তা নিয়েই উপস্থিত, এমন সঙ্গীত পরিবেশন ধারণার মধ্যে আসা কঠিন, কারণ আমরা জ্যাজ শুনে অভ্যস্ত নই।
অসংখ্য জ্যাজ শিল্পীর মধ্যে তবুও কোনো কোনো শিল্পীকে ব্যতিক্রম বলাই যায় তাদের উদ্ভাবনী গুণের কারণে। লুইস আর্মস্ট্রং জ্যাজ শিল্পের প্রথম তারকা। তাকেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্যাজ শিল্পী বলে অভিহিত করা হয়। তিনিই জ্যাজ সঙ্গীতের সুরের নৈপুণ্য এবং জ্যাজ পরিবেশনায় প্রকরণ (Style)- এর পথ সৃষ্টি ও নির্মাণ করে যান, যার উপর ভিত্তি করেই জ্যাজ সঙ্গীত যুক্তরাষ্ট্রে ও বিশ^ব্যাপী এক নতুন ধারার সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর জীবনকাল আগস্ট ৪, ১৯০১ থেকে জুলাই ৬, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। মানুষ তাকে স্যাচমো, স্যাচ, পপ ইত্যাদি প্রিয় নামে ডাকতে ভালোবাসত। নিউ অরলিয়েন্সেই লুইস আর্মস্ট্রং এর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ঊনসত্তর বছর বয়সে তিনি নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্যাজ সঙ্গীতের সর্বকালের রাজা বলে পরিচিত পল হোয়াইটম্যান। জন্ম মার্চ ১৮৯০, ডেনভার কালোরেডো, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যু ডিসেম্বর ২৯, ১৯৬৭, ডোলস টাউন, পেনসিলভ্যানিয়া। তিনি ছিলেন একজন ব্যান্ড লিডার এবং তিনি জ্যাজ যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনার এমন এক প্রকরণ সৃষ্টি করেন, যা ১৯২০-৩০ সময়কালের মধ্যে জ্যাজ সঙ্গীতকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাঁর উদ্ভাবিত জ্যাজ সঙ্গীত ও পরিবেশনা জ্যাজ এর মূল ধারার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে এই শিল্পকে একটি উচ্চমার্গীয় শিল্প সঙ্গীতধারায় পরিণত করেন। এছাড়াও বিরাট সংখ্যক জ্যাজ শিল্পীদের মধ্য থেকে প্রথম সারির কয়েকজন জ্যাজ শিল্পীর নাম উল্লেখ করা হলো।
১. ডিজি জিলেসপি (১৯১৭-১৯৭০), ২. মাইলস ডেভিড (১৯১৭-১৯৯৩), ৩. জন কোলট্রেন (১৯২৬-১৯৬৭), ৪. বিলি হুইলার (১৯১৫-১৯৫৯), ৫. ডিকি বার্লিংটন (১৮৯৯-১৯৭৪), ৬. চার্র্লি পার্কার (১৯২০-১৯৫৫) এবং ৭. এলা ফিটজ্যারেল্ড (১৯১৭-১৯৯৬)
মূল্যায়ন : জ্যাজ সঙ্গীতের জন্ম আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ১৮৮৬ সালের মধ্যে চার লক্ষ আফ্রিকান দাসশ্রমিক আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। খেতে খামারে ঘর বাড়িতে কাজ করা এই আফ্রিকান দাসরা বিশেষ করে ধান তোলার মৌসুমে কঙ্গো স্কয়ারে নৃত্য গীতে আনন্দে মেতে উঠতো। সে সমস্ত অদ্ভুত যনন্ত্রপাতি দিয়ে জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো, তা প্রাথমিক আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথাকথিত যন্ত্রসমূহ থেকেই জ্যাজ পরিবেশনার জন্য অতি উন্নত মানের বাদ্যযন্ত্রসমূহের সৃষ্টি হয় এবং জ্যাজ সঙ্গীতের সৃষ্টিশীলতা বহুধা বিস্তৃত হয়ে এক নতুন সঙ্গীত ধারায় পরিণত হয়। এর সাথে নানা উপধারা যুক্ত হয়ে জ্যাজ সঙ্গীতের যে বিশাল বিস্তৃতি তা অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা যে আফ্রিকান আমেরিকানরা জ্যাজ সঙ্গীতকে এক ধ্রুপদী শিল্পে পরিবর্তন করেন, তাঁরা তাদের অস্তিত্বের দৃঢ় অবস্থান প্রমাণের জন্য আমেরিকায় সাহিত্যে চিত্রশিল্পে ভাষায় কবিতায় বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে নিজেদের যে সংষ্কৃতি ধারার সৃষ্টি করেন, জ্যাজ সঙ্গীত তারই অন্যতম অংশ। সে অর্থে কালো মানুষদের নিজস্ব ঘোষণায় জ্যাজ অবশ্যই প্রতিবাদী শিল্প।
জ্যাজ-এর তাল লয়ের সুরেলা উচ্চারণ মানুষের মনকে শান্ত আনন্দময় এবং ¯œায়ু দৌর্বল্য দূর করতে সাহায্য করে। জ্যাজ-এর তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা মানুষের হৃদয়কে প্রভাবিত এবং উজ্জীবিত করে এবং সমৃদ্ধ করে পপ, হিপহপ এবং মুক্তধারার র্যাপ সঙ্গীত শিল্পকে।
টিএস এলিয়ট, কার্ল স্যান্ডবার্গ এবং ই.ই কিউমিংস এর মতো বিশ^ব্যাপী পরিচিত কবিরা জ্যাজ কবিতা প্রণয়ন করেন। জ্যাজ সঙ্গীতের প্রয়োজনে মেয়েদের পোশাকে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসে। মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীনতচেতা হয়ে ওঠেন, ছোট কাপড় পরা শুরু করেন, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা শুরু করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যাজ কণ্ঠ সঙ্গীত জ্যাজ সঙ্গীতে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সে কণ্ঠ সঙ্গীতেও তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন সংযুক্ত হয়।
বর্তমানে জ্যাজ বিশ^ব্যাপী এমন এক সঙ্গীত শিল্পধারায় পরিণত হয়েছে- যা বিশ্ব-সঙ্গীতশিল্পধারাসমূহকে এক নতুন উচ্চতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।
মুনীর সিরাজ
জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনা
বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫
জ্যাজ সঙ্গীত মূলত যন্ত্রসঙ্গীত। ১৯২০ সালের পরই জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের ধারার মতো জ্যাজ সঙ্গীত প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকায় আফ্রিকান দাসরা নিউ অরালিয়ন্সে একটি বিশেষ বাজারে জড়ো হতো। স্থানটি আফ্রিকান নৃত্যের জন্য প্রখ্যাত ছিল এবং স্থানটির নাম রাখা হয়েছিল কঙ্গো স্কয়ার। ১৮৮৬ সালের মধ্যে আটলান্টিক দাস ব্যবসায় উত্তর আমেরিকায় প্রায় ৪ লক্ষ আফ্রিকান নিয়ে এসেছিল। পশ্চিম আফ্রিকার কঙ্গো নদীর অববাহিকা থেকেই এই আফ্রিকানদের ধরে আনা হয়েছিল। খেতেখামারে কারখানায় বিভিন্ন ধরনের মজুরের কাজ করা এই দাসগণ তাদের দুঃখ কষ্ট ভুলে আনন্দ করার জন্য অদ্ভুত ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এই নতুন ধরনের সঙ্গীত উদ্ভাবন শুরু করে। এ যন্ত্রসমূহ ছিল ড্যাশ বোর্ড (কাপড় কাঁচার জন্য ব্যবহৃত) ওয়াশট্যাব, জগ, টিনের বাক্স- যা কাঠ বা হাড় দিয়ে পিটিয়ে শব্দ করা হতো এবং ব্যারেলের মুখে পশুর চামড়া এঁটে তাকে ড্রাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। ফসল তোলার মৌসুমে বেশ কয়েক দিন এ সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে উৎসব উদ্যাপিত হতো। তবে জ্যাজ সঙ্গীত ক্রমশ ইউরোপীয় সঙ্গীতের সাথে মিলিত হতে থাকে। বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই সহজতর আফ্রিকান ধারাই টিকে থাকে এবং ইউরোপীয় সঙ্গীতের জটিল বিষয়গুলি পরিত্যক্ত হয়ে যায়।
জ্যাজ সঙ্গীতের যন্ত্রসমূহের ক্রমশ উন্নতি ঘটতে থাকে। আধুনিক জ্যাজ সঙ্গীতে ব্যবহৃত যন্ত্রসমূহ হচ্ছে (১) ডাবল ব্যাস (২) ড্রাম (৩) গিটার- সাধারণ এবং ইলেকট্রিক (৪) পিয়ানো (৫) স্যাক্সোফোন (৬) ট্রাম্পেট (৭) ক্লারিনেট (৮) ট্রমবোন (৯) টুবা (১০) ভাইব্রেশন (১১) হ্যামন্ড অরগ্যান (১২) হারমোনিকা (১৩) ঢোল বা ড্রাম এবং আরো বহুবিধ বাদ্য যন্ত্র।
ক্রমান্বয়ে যুক্তরাষ্ট্রে জ্যাজ একটি সঙ্গীত ধারার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা বহুধা বিস্তৃত হয়ে বিভিন্ন ধারা উপধারার বিশাল সঙ্গীত প্রবাহে বিস্তৃতি লাভ করে। বিভিন্ন ধারা উপধারার এই জ্যাজু সঙ্গীত Cool Jazz, Hard Bop Jazz, Modal Jazz, Bebop Jazz, Fru Jazz, Avant Grad Jazz, Fussion Jazz ইত্যাদি বহু নামে পরিচিতি লাভ করে তাদের স্বকীয় গুণ সংরক্ষণ করেই।
জ্যাজ এমনি এক সঙ্গীত ধারা যাতে প্রতিটি যন্ত্রের স্বর সুর একত্রিত হয়ে একের সাথে অপরের ধ্বনি সমন্বিত হয়ে সামঞ্জস্য রক্ষা করে উচ্চারিত হয়। আবার প্রতিটি যন্ত্রের স্বর এই সমন্বিত ধ্বনি তরঙ্গের মধ্যে তার নিজস্ব স্বকীয়তা নিয়েই উচ্চারিত হয়। এই অপূর্ব সংমিশ্রণ শুধু জ্যাজ সঙ্গীতেই সম্ভব করে তুলেছিল আফ্রিকান আমেরিকান শিল্পীগণ। আবার সঙ্গীত পরিবেশনার সময় প্রত্যেক যন্ত্রবিদ ভিন্ন ভিন্নভাবে তার নিজের যন্ত্রের সঙ্গীত এমনভাবে পরিবেশন করেন, যাতে অন্যান্য যন্ত্রের সঙ্গীত তরঙ্গের ভিত্তির উপর শিল্পীর নিজের যন্ত্রটির স্বকীয়তা প্রকাশিত হতে পারে।
তবে জ্যাজ সঙ্গীতের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে Improvisation বা তাৎক্ষণিক উদ্ভাবিত স্বর ব্যাঞ্জনা। এই Jazz Improvisation এবং কন্ঠ জ্যাজ সঙ্গীত সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয়াই এ নিবন্ধের মূল উদ্দেশ্য।
জ্যাজ সংগীতের তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন : জ্যাজ ইম্প্রোভাইজেশনকে জ্যাজ সঙ্গীতের প্রাণ বলা যায়। ইম্প্রোভাইজেশন কথাটার অর্থ তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন বা রচনা। তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনে বাদক যখন তারযন্ত্র পিয়ানো বা ডাবল ব্যাস বাজাতে থাকেন, তখন হঠাৎই তিনি ভিন্ন একটা সুর যন্ত্রস্বরে যোগ করে দিয়ে সংগীতের আবহ তাৎক্ষণিক পরিবর্তন করে উদ্দীপনার সৃষ্টি করেন। এই পরিবর্তন কোনো পূর্ব-প্রস্তুতি ছাড়াই উপস্থিত বুদ্ধিমত্তার কারণেই যন্ত্র শিল্পী তা করতে সক্ষম হন। এতে উপস্থিত শ্রোতৃম-লী আবেগ আপ্লুত হয়ে ওঠেন। জ্যাজের এই তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা অন্য যে কোনো সঙ্গীতের তুলনা বিচারে অতুলনীয় বটে।
জ্যাজ সঙ্গীত রচনা এবং তাৎক্ষণিক জ্যাজ সৃষ্টি একটি অন্যটির ঠিক উল্টো মনে হতে পারে। কিন্তু জ্যাজ সঙ্গীতে এই তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনে এক অনন্যতা নিয়ে আসা হয়। এটা অভিনব বটে। সঙ্গীত সৃষ্টিশীলতার এ এক অনন্য উদাহরণ।
একটা ভুল ধারণা থাকতে পারে যে জ্যাজ ইম্প্রোভাইজেশন হঠাৎ করে হাওয়া থেকে পাওয়ার মতো ব্যাপার। পূর্ব নির্ধারিত কোনো জ্যাজ সঙ্গীতের স্বর ব্যঞ্জনা ব্যতিরেকে অনির্ধারিতভাবেই চলমান সঙ্গীতে হঠাৎ পরিবর্তিত সুর-স্বর সংমিশ্রণ করা হয় এবং জ্যাজ বাদকগণ এ পরিবর্তনের সাথে সম্মিলিতভাবে তাৎক্ষণিক সংযুক্ত হয়ে সংঙ্গীত পরিবেশনার আবহ বদলে দেন। এতে শ্রোতা উদ্দীপিত হয়ে ওঠেন এবং মনের প্রবল আনন্দে এই পরিবর্তিত আবহে ভাসতে থাকেন। ঐ মুহূর্তে শিল্পীগণ প্রকৃতই তাৎক্ষণিকভাবে জটিল জ্যাজ সৃষ্টি করে চলেছেন এবং প্রত্যেক যন্ত্রবাদক তার নিজের যন্ত্রের স্বর অন্য সকল যন্ত্রবাদকের সাথে সামঞ্জস্য রেখে চলেছেন। গিটার পিয়ানো ব্যাস ড্রাম ট্রমবোন বাঁশি স্যাক্সোফোন প্রতিটি যন্ত্রে তার নিজস্বতা রক্ষা করেই জ্যাজ শিল্পীগণ জ্যাজ সঙ্গীত স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাৎক্ষণিকভাবে সদ্য রচনার সাথে যুক্ত হয়ে প্রত্যেকে তাঁর যন্ত্র বাজিয়ে চলেন এবং সঙ্গীত তখন তার নিজের গতিতেই অগ্রসর হতে থাকে। বস্তুত এই অগ্রসরমান তাৎক্ষণিক জ্যাজ উদ্ভাবিত যন্ত্রসঙ্গীত সেকেন্ডের ভগ্নাংশে মস্তিষ্ক থেকে নিঃসরিত হয়ে সঙ্গীতে রূপান্তরিত হয়। এ সঙ্গীতের অভাবনীয় সৃষ্টি এবং অগ্রসরমানতা যা মাইক্রোসেকেন্ডের মধ্যেই ঘটে যায় এবং তা জ্যাজ সঙ্গীতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব: ২০১৩ সাল থেকে জার্সি সিটির কৃষকদের বাজার (Farmers Market)-এ জ্যাজ উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২৯ মে থেকে ০২ জুন ২০২৪ পর্যন্ত পাঁচ দিনব্যাপী জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব পালিত হয় বিশাল হাডসন নদীর পারে ‘এক্সচেঞ্জ প্লেস’ নামক স্থানে নিউইয়র্ক শহরের ঠিক উল্টো দিকে। কালক্রমে ‘রিভারভিউ জ্যাজ’ প্রতিষ্ঠানটির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ‘জার্সি সিটি জ্যাজ উৎসব’। এই প্রতিষ্ঠান জনসাধারণের জন্য প্রতি বছর বিনামূল্যে উন্মুক্ত জ্যাজ পরিবেশন করেন। হাজার হাজার মানুষ এই জ্যাজ উৎসবে যোগদান করে। জার্সি সিটির বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ঘুরে এই জ্যাজ সঙ্গীত পরিবশেন করা হয়।
কিছুদিন ধরে জার্সি সিটিতে থাকার সুবাদে এক্সচেঞ্জ প্লেস-এ সরাসরি এই জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনায় যোগ দিয়েছিলাম। তিনটি অনুষ্ঠানে আমি সশরীরে উপস্থিত ছিলাম। শিল্পীদের স্যাক্সোফোন, ট্রমবোন, বাঁশি, ড্রাম এবং অন্যান্য জ্যাজ যন্ত্র সহকারে জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশনা প্রত্যক্ষ করে আনন্দিত হয়েছিলাম নিজেকে এক নতুন সঙ্গীতধারার সাথে যুক্ত করতে পেরে। যন্ত্রের শিল্পীরা একটি অনুষ্ঠানে একটি সঙ্গীত পরিবেশনার আবহে নির্ভর করে একে একে স্যাক্সোফোন, ট্রমবোন, বাঁশি ইত্যাদি বাজানোর কারিশমা পরিবেশন করল বিভিন্ন যন্ত্রের বাজানোর বিভিন্নতা নিয়ে। বিশ্বব্যাপী ধ্রুপদী পর্যায়ের সঙ্গীত ধারা হিসেবে জ্যাজ এখন স্বীকৃত সঙ্গীত শিল্প। প্রায় বিশ হাজার দর্শক ¯্রােতা এক্সচেঞ্জ প্ল্রেসের এই জ্যাজ উৎসব উপভোগ করেন।
শ্রেষ্ঠ জ্যাজ সঙ্গীত শিল্পী: জ্যাজ এর শ্রেষ্ঠ শিল্পী কে, কারা বা কতজন তা হিসেব করে নিরূপণ করা কঠিন। শতাব্দীব্যাপী জ্যাজকে এক উচ্চমানের সঙ্গীতশিল্প হিসেবে পৌঁছে দিতে যারা সফলতা অর্জন করেছেন তাঁদের দীর্ঘ তালিকা দেয়া কঠিন। বহু যন্ত্রের বহু শিল্পী বহু সুরে-বাদ্যে (Polyrythm) যে জ্যাজ সৃষ্টি করেছেন, তা আবার বহুশিল্পীর উপস্থিতিতে সমন্বিতভাবে উপস্থাপনা করা যায়, এ বিষয়টা অভিনবই বটে। বহু শিল্পীর একত্রে জ্যাজ পরিবেশন করা এবং একই সাথে প্রত্যেক শিল্পীই তার স্বাধীন সত্তা নিয়েই উপস্থিত, এমন সঙ্গীত পরিবেশন ধারণার মধ্যে আসা কঠিন, কারণ আমরা জ্যাজ শুনে অভ্যস্ত নই।
অসংখ্য জ্যাজ শিল্পীর মধ্যে তবুও কোনো কোনো শিল্পীকে ব্যতিক্রম বলাই যায় তাদের উদ্ভাবনী গুণের কারণে। লুইস আর্মস্ট্রং জ্যাজ শিল্পের প্রথম তারকা। তাকেই সর্বকালের শ্রেষ্ঠ জ্যাজ শিল্পী বলে অভিহিত করা হয়। তিনিই জ্যাজ সঙ্গীতের সুরের নৈপুণ্য এবং জ্যাজ পরিবেশনায় প্রকরণ (Style)- এর পথ সৃষ্টি ও নির্মাণ করে যান, যার উপর ভিত্তি করেই জ্যাজ সঙ্গীত যুক্তরাষ্ট্রে ও বিশ^ব্যাপী এক নতুন ধারার সঙ্গীত হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে। তাঁর জীবনকাল আগস্ট ৪, ১৯০১ থেকে জুলাই ৬, ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। মানুষ তাকে স্যাচমো, স্যাচ, পপ ইত্যাদি প্রিয় নামে ডাকতে ভালোবাসত। নিউ অরলিয়েন্সেই লুইস আর্মস্ট্রং এর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা। ঊনসত্তর বছর বয়সে তিনি নিউইয়র্কে মৃত্যুবরণ করেন।
জ্যাজ সঙ্গীতের সর্বকালের রাজা বলে পরিচিত পল হোয়াইটম্যান। জন্ম মার্চ ১৮৯০, ডেনভার কালোরেডো, আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্র। মৃত্যু ডিসেম্বর ২৯, ১৯৬৭, ডোলস টাউন, পেনসিলভ্যানিয়া। তিনি ছিলেন একজন ব্যান্ড লিডার এবং তিনি জ্যাজ যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনার এমন এক প্রকরণ সৃষ্টি করেন, যা ১৯২০-৩০ সময়কালের মধ্যে জ্যাজ সঙ্গীতকে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে নিয়ে যেতে সাহায্য করে। তাঁর উদ্ভাবিত জ্যাজ সঙ্গীত ও পরিবেশনা জ্যাজ এর মূল ধারার সাথে সংমিশ্রিত হয়ে এই শিল্পকে একটি উচ্চমার্গীয় শিল্প সঙ্গীতধারায় পরিণত করেন। এছাড়াও বিরাট সংখ্যক জ্যাজ শিল্পীদের মধ্য থেকে প্রথম সারির কয়েকজন জ্যাজ শিল্পীর নাম উল্লেখ করা হলো।
১. ডিজি জিলেসপি (১৯১৭-১৯৭০), ২. মাইলস ডেভিড (১৯১৭-১৯৯৩), ৩. জন কোলট্রেন (১৯২৬-১৯৬৭), ৪. বিলি হুইলার (১৯১৫-১৯৫৯), ৫. ডিকি বার্লিংটন (১৮৯৯-১৯৭৪), ৬. চার্র্লি পার্কার (১৯২০-১৯৫৫) এবং ৭. এলা ফিটজ্যারেল্ড (১৯১৭-১৯৯৬)
মূল্যায়ন : জ্যাজ সঙ্গীতের জন্ম আফ্রিকার কঙ্গো অববাহিকা থেকে। অষ্টাদশ শতাব্দীর ১৮৮৬ সালের মধ্যে চার লক্ষ আফ্রিকান দাসশ্রমিক আমেরিকায় নিয়ে আসা হয়। খেতে খামারে ঘর বাড়িতে কাজ করা এই আফ্রিকান দাসরা বিশেষ করে ধান তোলার মৌসুমে কঙ্গো স্কয়ারে নৃত্য গীতে আনন্দে মেতে উঠতো। সে সমস্ত অদ্ভুত যনন্ত্রপাতি দিয়ে জ্যাজ সঙ্গীত পরিবেশন করা হতো, তা প্রাথমিক আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে। এই তথাকথিত যন্ত্রসমূহ থেকেই জ্যাজ পরিবেশনার জন্য অতি উন্নত মানের বাদ্যযন্ত্রসমূহের সৃষ্টি হয় এবং জ্যাজ সঙ্গীতের সৃষ্টিশীলতা বহুধা বিস্তৃত হয়ে এক নতুন সঙ্গীত ধারায় পরিণত হয়। এর সাথে নানা উপধারা যুক্ত হয়ে জ্যাজ সঙ্গীতের যে বিশাল বিস্তৃতি তা অল্প কথায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধা যে আফ্রিকান আমেরিকানরা জ্যাজ সঙ্গীতকে এক ধ্রুপদী শিল্পে পরিবর্তন করেন, তাঁরা তাদের অস্তিত্বের দৃঢ় অবস্থান প্রমাণের জন্য আমেরিকায় সাহিত্যে চিত্রশিল্পে ভাষায় কবিতায় বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে নিজেদের যে সংষ্কৃতি ধারার সৃষ্টি করেন, জ্যাজ সঙ্গীত তারই অন্যতম অংশ। সে অর্থে কালো মানুষদের নিজস্ব ঘোষণায় জ্যাজ অবশ্যই প্রতিবাদী শিল্প।
জ্যাজ-এর তাল লয়ের সুরেলা উচ্চারণ মানুষের মনকে শান্ত আনন্দময় এবং ¯œায়ু দৌর্বল্য দূর করতে সাহায্য করে। জ্যাজ-এর তাৎক্ষণিক উদ্ভাবনী ক্ষমতা মানুষের হৃদয়কে প্রভাবিত এবং উজ্জীবিত করে এবং সমৃদ্ধ করে পপ, হিপহপ এবং মুক্তধারার র্যাপ সঙ্গীত শিল্পকে।
টিএস এলিয়ট, কার্ল স্যান্ডবার্গ এবং ই.ই কিউমিংস এর মতো বিশ^ব্যাপী পরিচিত কবিরা জ্যাজ কবিতা প্রণয়ন করেন। জ্যাজ সঙ্গীতের প্রয়োজনে মেয়েদের পোশাকে বিপুল পরিবর্তন নিয়ে আসে। মেয়েরা আগের চেয়ে অনেক স্বাধীনতচেতা হয়ে ওঠেন, ছোট কাপড় পরা শুরু করেন, ঘর থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীনভাবে চলাফেরা শুরু করেন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জ্যাজ কণ্ঠ সঙ্গীত জ্যাজ সঙ্গীতে নতুন মাত্রা যোগ করে এবং সে কণ্ঠ সঙ্গীতেও তাৎক্ষণিক উদ্ভাবন সংযুক্ত হয়।
বর্তমানে জ্যাজ বিশ^ব্যাপী এমন এক সঙ্গীত শিল্পধারায় পরিণত হয়েছে- যা বিশ্ব-সঙ্গীতশিল্পধারাসমূহকে এক নতুন উচ্চতায় তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে।