alt

সাময়িকী

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

আবু তাহের সরফরাজ

: বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

মহাবিশ্বের অনন্ত বিস্তৃতির মতোই মানুষের অন্তর্জগৎ। প্রতিমুহূর্তে সেই জগতে বিচিত্র অনুভূতি অন্তর্লীন ¯্রােতের মতো উঠছে, আবার ভেঙে পড়ছে। ভাঙা-গড়ার এই দোলাচালেই ছন্দিত মানুষের জীবন। এই জীবন মানুষের আকাক্সক্ষার বহুবর্ণিল সৌন্দর্যে রাঙানো। এই জীবন মানুষের অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি দ্বারা নির্মিত। এই জীবনে প্রত্যেক মানুষই তার নিজের জগতের স¤্রাট। স্বপ্ন-কল্পনার বিচিত্র এই জগৎ সম্ভবত মানুষ ছাড়া সৃষ্টির আর কোনো প্রাণীর নেই। স্বপ্ন-কল্পনার সৌন্দর্য দিয়ে শোভিত এই জগতের পাশাপাশি মানুষের রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এই জীবন দ্বন্দ্বমুখর। নৈরাজ্যবাদী।

আজকের সমাজে ভোগ্যপণ্যের তুমুল আলোড়ন চলছে পৃথিবীজুড়ে। তার অভিনব সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ক্রমাগত চেষ্টা করছে মানুষের বাসনাকে উসকে দিতে এবং বড় বাজার তৈরি করতে। এরা বিশেষভাবে চেষ্টা করে যৌনবাসনাকে কাজে লাগাতে। এর জন্য আর্থসামাজিক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে সেই পরিস্থিতি একদিকে অপূরিত আকাক্সক্ষার জন্য হতাশার জন্ম দিচ্ছে, আরদিকে বাড়ছে বিভেদ, দুর্নীতি ও হিংসা। ফলে আজকের সময়ের বেশিরভাগ মানুষ ভোগকেই জীবনের মানে বলে জানে। অথচ জীবনের মানে হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা। যে যত বেশি জ্ঞান অর্জন করবে বিশ^ব্রহ্মা-ের রহস্য সে তত বেশি উদ্ঘাটন করবে পারে। বিশ^-প্রকৃতির সাথে নিজের অস্তিত্বের যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় পৌঁছতে পারে ¯্রষ্টার অস্তিত্বের উপলব্ধিতে। অথচ মানুষ এখন অস্থির। ছুটছে। পাগলের মতো ছুটছে। স্থিরতার ভেতর দিয়েই যে পরমবোধ অন্তজর্গতে উপলব্ধি হয়, সেই গূঢ়সত্য মানুষের এখন অজ্ঞেয়।

জীবিকার অন্বেষণে ছুটতে ছুটতে মানুষ আজ ভুলেই গেছে সে কেবল শরীরই নয়, তার আরও একটি অংশ রয়েছে। শরীরের মতো সেই আত্মারও খিদে পায়। তৃষ্ণা পায়। আত্মার গহনে সৌন্দর্যের পাপড়ি মেলে প্রতিমুহূর্তে ফোটে মানসপদ্ম। যাপিত-বাস্তবতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট প্রতিটি ঘটনার অভিঘাতে এখন মানুষের অন্তর্চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ফলে, মানুষ এখন আর সেই মানসপদ্মের সৌন্দর্য দেখতে পায় না। আরেকজনকে ঠকিয়ে নিজে ভালো থাকবো, এই হচ্ছে এখন মানুষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আজকের পৃথিবী তাই সংঘাতময়, হত্যার উল্লাসে রক্তাক্ত। যাপিত-সময় যেন নৈরাজ্যবাদী। যাপিত-বাস্তবতার প্রতিটি ঘটনা যেন ঝোড়ো বাতাসের মতো আমাদেরকে তাড়িয়ে নিচ্ছে চূড়ান্ত অধঃপতনের দিকে। নৈরাজ্যবাদী হাওয়ায় ভেসে যেতে-যেতে এখনো কিছু মানুষ সভ্য হয়ে ওঠার স্বপ্ন দ্যাখে। নৈরাজ্যের বিরুদ্ধ হাওয়ার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে আশ্রয় খোঁজে শান্তি ও সমৃদ্ধির। অন্তর্গহনের ছন্দিত অনুভূতিকে স্পর্শ করতে কারো কারো ভেতর কাতরতা গুমরে ওঠে। সেইসব কাতরতার ভাষাচিত্র শৈল্পিক কারুকাজে চিত্রিত হয়েছে নব্বইয়ের দশকের ধীমান কবি শাহেদ কায়েসের কবিতার বই ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’য়। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা ‘বৈভব’।

শাহেদ কায়েসের চারদিকে নৈরাজ্যের হাওয়ার প্রহারে জীবনের ¯্রােত বয়ে চলেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সিস্টেমে বসবাস করে কবি নিজেও সেই ¯্রােতে ভেসে চলেছেন। তবু তার ভেতর সত্য ও সুন্দরের আর্তি বারবার ধ্বনিত হয়ে উঠছে। সেই ধ্বনি তিনি ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন কবিতার প্রতিটি শব্দের ভাঁজে-ভাঁজে। ‘বিস্মরণের নদী’ কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

বাইরে ঝড়, ভেতরেও...

দরোজা, জানালা সব খুলে দিয়েছি

এমন বোতাম-খোলা ঝড়ের বুক-

দেখিনি অনেকদিন

স্বপ্নেই তো কেটেছে এতটা কাল, বাস্তবতা

সে তো দূর-সম্পর্কের নদী হয়েই রইলো।

নৈরাজ্যবাদী হাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে ঝড় তুলে দিয়েছে। নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না, একইভাবে নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার দাপট ঘরের ভেতরও কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই। কবি তাই সেই চেষ্টা না করে খুলে দিয়েছেন ঘরের দরোজা-জানালা সব খুলে দিয়েছেন। ঝড়ের এমন উন্মত্ত কম্পন তিনি অনেকদিন দেখেননি। ঝড়ের উন্মত্ততা বোঝাতে কবি চমৎকার একটি চিত্রকল্প উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, বোতাম-খোলা ঝড়ের বুক। ঝড়ের বুক এতদিন বোতাম দিয়ে আটকানো ছিল। সেই বোতাম খুলে উদোম হয়ে বেরিয়ে পড়েছে ঝড়। এই চিত্রকল্প যে অভিনব ও শৈল্পিক সুষমায় নান্দনিক, স্বীকার করতেই হবে। নৈরাজ্যের এই ঝড় বিষয়ে কবি এতদিন অজ্ঞাত ছিলেন। কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে তিনি এতদিন নিজের ভেতর ডুবে ছিলেন। যাকে আমরা বলি, স্বপ্নাচ্ছন্নতা। কিন্তু নৈরাজ্যের হাওয়া বাইরের বাস্তবতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে এখন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে, নৈরাজ্য প্রতিরোধের কোনো আগল এখন আর কবির নেই।

এই বাস্তবতায় কবি এখন আরসব মানুষের মতোই উন্মূল। বিপন্নতার আর্ত-কোলাহলে মানুষ এখন জীবন খুঁজে পাচ্ছে না। ‘সমাবর্তন’ কবিতাটি পড়া যাক:

মোরগটা ডেকে উঠলে, ভোর এসে

টোকা দিলো ঘরে-

জাগো, বিষাদ-মানুষ

ভেঙে পড়ছে পালছেঁড়া মাস্তুল

পাঠ করো বিপন্নতা, তোমার প্রভুর নামে।

জীবনের আনুগত্য পালন করে যে হেঁটে

এলো এতটা পথ- মেঘের ভাষায় কে

পাঠালো শংসা!- আজ তার সমাবর্তন

দু’হাতে মেঘ সরিয়ে আকাশে উঁকি দিই

শূন্যতায় ঝুলে আছে আমাদের জীবন...

বিষণœতার চাবুকের আঘাতে মানুষ এখন কাতরাচ্ছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনকে অনুসরণ করে মানুষ মানুষ বিপন্নতার গহ্বরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা জানি, ভোর জীবনের সম্ভাবনার প্রতীক। সেই ভোর এসে দজরায় টোকা দিয়ে বিষাদ-আক্রান্ত মানুষকে জেগে উঠতে ডাকছে। জেগে উঠে কবি জীবনের আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দেখতে পেলেন, শূন্যতার হ্যাঙারে জীবন ঝুলছে। দৃশ্যত মনে হবে, কবিই বুঝি একা দেখছেন। কিন্তু আমরা যদি আমাদের অন্তর্চোখে আমাদের জীবনের গভীরে দৃষ্টি ফেলি দেখবো যে, আমাদের জীবনও শূন্যের ওপর ঝুলে আছে। জীবনকে ঘিরে এখন প্রেতের নৃত্য। তবে মজা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ এই দৃশ্য দেখতে পায় না।

যেসব আয়োজনের ভেতর জীবন আছে বলে মানুষ ধারণা করছে এবং সেসব আয়োজন নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, সেসব আয়োজনের ভেতর মোটেও জীবন নেই। জীবন অনত্র। সেই জীবনকে রক্তমাংসসমেত স্পর্শ করতে হলে নিজের ভেতর ডুব দিয়ে গভীর থেকে গভীরতম নীরবতার ভাষা বুঝতে হয়। কোলাহলে জীবনের উপলব্ধি ঘটে না, নির্জনতার ভেতরই জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ফলে আমরা দেখি যে, প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী মানুষটিও জীবনপথে চলতে গিয়ে বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত। শাহেদ কায়েস প্রজ্ঞার চোখ দিয়ে জীবন ও জগৎকে দ্যাখেন। ফলে তিনি নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার অভিঘাতে বিধ্বস্ত হলেও ফিরে আসতে পারেন জীবনের মর্মমূলে। ‘জীবনের কাছে ফেরা’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

সত্তার গভীরে যে অনুভব শিকড় ছড়ালো, তার কি

জানা আছে কোথায় গন্তব্য! বহু রাস্তার মোড়ে-

হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো সেই বিশ^াসঘাতক জুডাস ছায়া...

মানুষ কেন তার নিজের ছায়ার কাছেই হেরে যায়!

সত্তার গভীরে প্রগাঢ় অনুভূতির নানা রঙছবি কবি দেখতে পান। সেসব রঙছবির সাথে বাস্তবতার কোনো সাদৃশ্য নেই। কারণ, যে জীবন কবি যাপন করছেন সেই জীবন তিনি যাপন করতে চান না। যাপিতজীবনে চলার পথে অসংখ্য মোড়। প্রত্যেক মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে একজন করে জুডাস। যে জুডাস ৩০টি রুপোর মুদ্রার প্রলোভনে যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল। বাস্তবতা আসলে মানুষের ছায়া। আর, মূল মানুষটি সত্তার গভীরে আত্মোপলব্ধিতে রয়ে গেছে। শাহেদ আক্ষেপ করছেন যে, ছায়ারূপী বাইরের জীবনের কাছেই আত্মরূপ মূল মানুষটি ঢাকা পড়ে যায়। এহেন উপলব্ধি মূলত দার্শনিক উপলব্ধি হলেও শাহেদ কবিতার ভেতর শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় মুদ্রিত করে তুলেছেন। ফলে, উপলব্ধিজাত সত্য দার্শনিকতার বলয় ভেঙে সাহিত্যের রসে জারিত হয়েছে। এই কৌশলটি কবি হিসেবে শাহেদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য বলেই পাঠকের মনে হবে। যা বাস্তবতা, তার ওপর তিনি শিল্পের মাধুর্য দিয়ে প্রলেপ ছড়িয়ে দেন। ফলে দৃশ্যমান বাস্তবতা শৈল্পিক বাস্তবতা হিসেবে পাঠকের চোখের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। মানে, বাস্তবতার সমান্তরাল আরেক বাস্তবতা। তবে নির্মিত বাস্তবতায় ভেতর পাঠকের নিঃশ^াস নেয়ার অবকাশ থাকে। যে সুযোগ যাপিত বাস্তবতায় পাঠকের থাকে না। কেননা, যাপিত জীবন নৈরাজ্যবাদী হাওয়ায় কম্পমান। আর শাহেদ নির্মিত বাস্তবতা প্রতীক ও উপমার সৌন্দর্যে রাঙানো। ‘রক্তাক্ত শ্রাবণ’ কবিতায় শাহেদ কায়েস লিখছেন:

রক্তজবা ভেসে যাচ্ছে অঝোর শ্রাবণে...

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে-

কিভাবে মুছে ফেলবে তরুণ জবার দাগ!

...

এই রক্তাক্ত জনপদে সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক

বন্দুকের নল একদিন ঘুরে যাবে হন্তারকের দিকে।

আমরা বুঝতে পারছি, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে জীবনের প্রাণ-স্ফুরণ উপলব্ধ হয় শাহেদ কায়েসের। আর তাই একজীবনে তার ঋণ কেবলমাত্র প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের কাছেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাকে চলতে হয় জীবনপথে। সেই পথ জটিল ও বহুধা বিভক্ত। এইখানে পাঠক হিসেবে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি নৈরাজ্যের। যে নৈরাজ্যের স্বরূপ তিনি বইয়ের শেষদিকের কয়েকটি কবিতায় উন্মোচিত করেছেন। জীবনচলার পথ সাধারণ মানুষের খোলা চোখে মনে হবে সহজ, সাদাসিধে। কিন্তু শাহেদ কায়েস যেহেতু প্রজ্ঞার চোখ দিয়ে জগৎ নিরীক্ষণ করেন, ফলে জীবনপথের বাঁকে তিনি অসংখ্য বাঁক দেখতে পান। আর তাতেই দ্বিধার থরো-থরো চিত্তে তিনি কাঁপতে থাকেন। বুঝতে পারেন না, কোনটি সহজ পথ। প্রকৃতির ঐকতানে যে পথ ছন্দিত পাখির কলতানে, নদীর কুলকুল ¯্রােতে। বৃক্ষের পত্র-পল্লবে কোন পথ ছায়া-সুনিবিড়, শাহেদ খুঁজতে থাকেন। পাঠক হিসেবে আমরাও শাহেদের সাথে দ্বিধায় কাঁপতে থাকি। আমাদের ভেতরও আবিষ্কার করে বসি প্রজ্ঞার চোখ। এরপর সেই চোখ দিয়ে নিজের জীবনপথের দিকে তাকাই। যে-কোনো উৎকৃষ্ট কবিতার কাজ হচ্ছে, কবির বোধকে পাঠকের অন্তর্গহ্বরে অনুরণিত করা। শাহেদ সেই কাজটি এখানে যথার্থ উপায়েই করেছেন, সন্দেহ নেই।

শাহেদের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সীমিত বাক্যবন্ধনির ভেতর সীমাহীন অনুভূতির স্ফুরণ ছড়িয়ে দেয়া। এই বইয়ের কবিতা পড়তে পড়তে এই সত্য পাঠক উপলব্ধি করবেন। তার কবিতার শব্দ ছন্দিত নয়, শব্দের বুনন কাট-কাট। শাহেদের অন্তর্জগতের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করতে যে-যে শব্দ দরকার সেই-সেই শব্দ নিজের থেকেই বসে যাচ্ছে সার-দিয়ে। আর, প্রতিটি শব্দের শরীরে রাঙানো রয়েছে শাহেদের অন্তর্গহনের আলোকচ্ছটা। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কবি হিসেবে এটাও শাহেদের আরেকটি শিল্প-কৌশল। মাত্রাভিত্তিক পর্ববিন্যাসে শব্দগুলো বিন্যাস্ত হলে কবিতার শরীরে ছন্দিত ঘূর্ণি থাকতো। কিন্তু তাতে শাহেদের কবিতার নিজস্ব কৌশলটি আর থাকতো না। মানে, শব্দের কাট-কাট দৃঢ়তা ভেঙে পেলবতা তৈরি হতো।

বলা দরকার, শাহেদ কায়েস মূলত চিত্রকল্পের কবি। শৈল্পিক সুষমায় রাঙানো এক-একটি চিত্রকল্প তার কবিতার শরীরজুড়ে নক্ষত্রের মতো জ¦লজ¦ল জ¦লতে থাকে। ‘শরৎ এলো’ কবিতা থেকে কয়েক পঙ্ক্তি পড়া যাক, ‘নাকে মেঘের নোলক, শরৎ এলো/নীল শাড়ি পরে- কোমর দুলিয়ে।’ কবিতায় শরতের সৌন্দর্য চিত্রিত করতে গিয়ে যুগে-যুগে নানা কবি নানা চিত্রকল্প এঁকেছেন। সেসবের ধারাবাহিকতায় শাহেদের এই চিত্রকল্প যে অনবদ্য, মেধাবী পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। শরৎ যেন ছিপছিপে গড়নের তন্বী কিশোরী। নাকে মেঘের নোলক পরে গায়ে নীল শাড়ি জড়িয়ে কোমর দুলিয়ে হেঁটে আসছে। মহাজাগতিক প্ররোচনায় শাহেদ কায়েস এভাবেই আত্মরূপ ধ্যানের ছবি ভাষাচিত্রে এঁকে রেখেছেন ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’য়।

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

ছবি

‘আমি বাংলায় দেখি স্বপ্ন’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ভ্রম

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

রফিক আজাদের কবিতা

ছবি

ধূসর পাণ্ডুলিপি পরিবহন

ছবি

চৈত্রের কোনো এক মধ্যরাতে

ছবি

দেশভাগের বিপর্যয় ও ‘জলপাইহাটি’র জীবনানন্দ দাশ

ছবি

সামান্য ভুল

সাময়িকী কবিতা

ছবি

আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথাভাঙা মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত

ছবি

ধুলোময় জীবনের মেটাফর

ছবি

স্কুলটি ছোট্ট বটে

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

পালকের চিহ্নগুলো

ছবি

আদোনিসের কবিতা

ছবি

আড়াই লেনের কৃষ্ণচূড়া

ছবি

গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাটক ইতিহাস ও দেশপ্রেম

ছবি

নিজস্বতার অনন্য প্রমাণ

ছবি

বইমেলায় আসছে নতুন বই

ছবি

সরল প্রাণের সোপান

ছবি

হাসান আজিজুল হকের দর্শনচিন্তা

ছবি

শীতের পদাবলি

tab

সাময়িকী

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

আবু তাহের সরফরাজ

বৃহস্পতিবার, ০৬ মার্চ ২০২৫

মহাবিশ্বের অনন্ত বিস্তৃতির মতোই মানুষের অন্তর্জগৎ। প্রতিমুহূর্তে সেই জগতে বিচিত্র অনুভূতি অন্তর্লীন ¯্রােতের মতো উঠছে, আবার ভেঙে পড়ছে। ভাঙা-গড়ার এই দোলাচালেই ছন্দিত মানুষের জীবন। এই জীবন মানুষের আকাক্সক্ষার বহুবর্ণিল সৌন্দর্যে রাঙানো। এই জীবন মানুষের অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি দ্বারা নির্মিত। এই জীবনে প্রত্যেক মানুষই তার নিজের জগতের স¤্রাট। স্বপ্ন-কল্পনার বিচিত্র এই জগৎ সম্ভবত মানুষ ছাড়া সৃষ্টির আর কোনো প্রাণীর নেই। স্বপ্ন-কল্পনার সৌন্দর্য দিয়ে শোভিত এই জগতের পাশাপাশি মানুষের রয়েছে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন। এই জীবন দ্বন্দ্বমুখর। নৈরাজ্যবাদী।

আজকের সমাজে ভোগ্যপণ্যের তুমুল আলোড়ন চলছে পৃথিবীজুড়ে। তার অভিনব সংস্কৃতি ও বিজ্ঞাপন পদ্ধতি ক্রমাগত চেষ্টা করছে মানুষের বাসনাকে উসকে দিতে এবং বড় বাজার তৈরি করতে। এরা বিশেষভাবে চেষ্টা করে যৌনবাসনাকে কাজে লাগাতে। এর জন্য আর্থসামাজিক যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে সেই পরিস্থিতি একদিকে অপূরিত আকাক্সক্ষার জন্য হতাশার জন্ম দিচ্ছে, আরদিকে বাড়ছে বিভেদ, দুর্নীতি ও হিংসা। ফলে আজকের সময়ের বেশিরভাগ মানুষ ভোগকেই জীবনের মানে বলে জানে। অথচ জীবনের মানে হচ্ছে জ্ঞান অর্জন করা। যে যত বেশি জ্ঞান অর্জন করবে বিশ^ব্রহ্মা-ের রহস্য সে তত বেশি উদ্ঘাটন করবে পারে। বিশ^-প্রকৃতির সাথে নিজের অস্তিত্বের যোগসূত্র আবিষ্কার করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় পৌঁছতে পারে ¯্রষ্টার অস্তিত্বের উপলব্ধিতে। অথচ মানুষ এখন অস্থির। ছুটছে। পাগলের মতো ছুটছে। স্থিরতার ভেতর দিয়েই যে পরমবোধ অন্তজর্গতে উপলব্ধি হয়, সেই গূঢ়সত্য মানুষের এখন অজ্ঞেয়।

জীবিকার অন্বেষণে ছুটতে ছুটতে মানুষ আজ ভুলেই গেছে সে কেবল শরীরই নয়, তার আরও একটি অংশ রয়েছে। শরীরের মতো সেই আত্মারও খিদে পায়। তৃষ্ণা পায়। আত্মার গহনে সৌন্দর্যের পাপড়ি মেলে প্রতিমুহূর্তে ফোটে মানসপদ্ম। যাপিত-বাস্তবতার যন্ত্রণাক্লিষ্ট প্রতিটি ঘটনার অভিঘাতে এখন মানুষের অন্তর্চোখ অন্ধ হয়ে গেছে। ফলে, মানুষ এখন আর সেই মানসপদ্মের সৌন্দর্য দেখতে পায় না। আরেকজনকে ঠকিয়ে নিজে ভালো থাকবো, এই হচ্ছে এখন মানুষের দৃঢ় প্রতিজ্ঞা। আজকের পৃথিবী তাই সংঘাতময়, হত্যার উল্লাসে রক্তাক্ত। যাপিত-সময় যেন নৈরাজ্যবাদী। যাপিত-বাস্তবতার প্রতিটি ঘটনা যেন ঝোড়ো বাতাসের মতো আমাদেরকে তাড়িয়ে নিচ্ছে চূড়ান্ত অধঃপতনের দিকে। নৈরাজ্যবাদী হাওয়ায় ভেসে যেতে-যেতে এখনো কিছু মানুষ সভ্য হয়ে ওঠার স্বপ্ন দ্যাখে। নৈরাজ্যের বিরুদ্ধ হাওয়ার প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে আশ্রয় খোঁজে শান্তি ও সমৃদ্ধির। অন্তর্গহনের ছন্দিত অনুভূতিকে স্পর্শ করতে কারো কারো ভেতর কাতরতা গুমরে ওঠে। সেইসব কাতরতার ভাষাচিত্র শৈল্পিক কারুকাজে চিত্রিত হয়েছে নব্বইয়ের দশকের ধীমান কবি শাহেদ কায়েসের কবিতার বই ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’য়। এবার অমর একুশে গ্রন্থমেলায় বইটি প্রকাশ করেছে প্রকাশনা সংস্থা ‘বৈভব’।

শাহেদ কায়েসের চারদিকে নৈরাজ্যের হাওয়ার প্রহারে জীবনের ¯্রােত বয়ে চলেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সিস্টেমে বসবাস করে কবি নিজেও সেই ¯্রােতে ভেসে চলেছেন। তবু তার ভেতর সত্য ও সুন্দরের আর্তি বারবার ধ্বনিত হয়ে উঠছে। সেই ধ্বনি তিনি ছড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছেন কবিতার প্রতিটি শব্দের ভাঁজে-ভাঁজে। ‘বিস্মরণের নদী’ কবিতা থেকে কয়েক পঙক্তি পড়া যাক:

বাইরে ঝড়, ভেতরেও...

দরোজা, জানালা সব খুলে দিয়েছি

এমন বোতাম-খোলা ঝড়ের বুক-

দেখিনি অনেকদিন

স্বপ্নেই তো কেটেছে এতটা কাল, বাস্তবতা

সে তো দূর-সম্পর্কের নদী হয়েই রইলো।

নৈরাজ্যবাদী হাওয়া সমাজ ও রাষ্ট্রে ঝড় তুলে দিয়েছে। নগরে আগুন লাগলে যেমন দেবালয় রক্ষা পায় না, একইভাবে নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার দাপট ঘরের ভেতরও কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। সমাজবিচ্ছিন্ন হয়ে ঘরের ভেতর চুপচাপ বসে থাকার উপায় নেই। কবি তাই সেই চেষ্টা না করে খুলে দিয়েছেন ঘরের দরোজা-জানালা সব খুলে দিয়েছেন। ঝড়ের এমন উন্মত্ত কম্পন তিনি অনেকদিন দেখেননি। ঝড়ের উন্মত্ততা বোঝাতে কবি চমৎকার একটি চিত্রকল্প উল্লেখ করেছেন। সেটি হচ্ছে, বোতাম-খোলা ঝড়ের বুক। ঝড়ের বুক এতদিন বোতাম দিয়ে আটকানো ছিল। সেই বোতাম খুলে উদোম হয়ে বেরিয়ে পড়েছে ঝড়। এই চিত্রকল্প যে অভিনব ও শৈল্পিক সুষমায় নান্দনিক, স্বীকার করতেই হবে। নৈরাজ্যের এই ঝড় বিষয়ে কবি এতদিন অজ্ঞাত ছিলেন। কারণ, সমাজ ও রাষ্ট্রের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে তিনি এতদিন নিজের ভেতর ডুবে ছিলেন। যাকে আমরা বলি, স্বপ্নাচ্ছন্নতা। কিন্তু নৈরাজ্যের হাওয়া বাইরের বাস্তবতাকে কাঁপিয়ে দিয়ে এখন ঘরের ভেতর ঢুকে পড়েছে। ফলে, নৈরাজ্য প্রতিরোধের কোনো আগল এখন আর কবির নেই।

এই বাস্তবতায় কবি এখন আরসব মানুষের মতোই উন্মূল। বিপন্নতার আর্ত-কোলাহলে মানুষ এখন জীবন খুঁজে পাচ্ছে না। ‘সমাবর্তন’ কবিতাটি পড়া যাক:

মোরগটা ডেকে উঠলে, ভোর এসে

টোকা দিলো ঘরে-

জাগো, বিষাদ-মানুষ

ভেঙে পড়ছে পালছেঁড়া মাস্তুল

পাঠ করো বিপন্নতা, তোমার প্রভুর নামে।

জীবনের আনুগত্য পালন করে যে হেঁটে

এলো এতটা পথ- মেঘের ভাষায় কে

পাঠালো শংসা!- আজ তার সমাবর্তন

দু’হাতে মেঘ সরিয়ে আকাশে উঁকি দিই

শূন্যতায় ঝুলে আছে আমাদের জীবন...

বিষণœতার চাবুকের আঘাতে মানুষ এখন কাতরাচ্ছে। যন্ত্রণাক্লিষ্ট জীবনকে অনুসরণ করে মানুষ মানুষ বিপন্নতার গহ্বরে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা জানি, ভোর জীবনের সম্ভাবনার প্রতীক। সেই ভোর এসে দজরায় টোকা দিয়ে বিষাদ-আক্রান্ত মানুষকে জেগে উঠতে ডাকছে। জেগে উঠে কবি জীবনের আকাশ থেকে মেঘ সরিয়ে দেখতে পেলেন, শূন্যতার হ্যাঙারে জীবন ঝুলছে। দৃশ্যত মনে হবে, কবিই বুঝি একা দেখছেন। কিন্তু আমরা যদি আমাদের অন্তর্চোখে আমাদের জীবনের গভীরে দৃষ্টি ফেলি দেখবো যে, আমাদের জীবনও শূন্যের ওপর ঝুলে আছে। জীবনকে ঘিরে এখন প্রেতের নৃত্য। তবে মজা হচ্ছে, বেশিরভাগ মানুষ এই দৃশ্য দেখতে পায় না।

যেসব আয়োজনের ভেতর জীবন আছে বলে মানুষ ধারণা করছে এবং সেসব আয়োজন নিয়েই জীবন কাটিয়ে দিচ্ছে, সেসব আয়োজনের ভেতর মোটেও জীবন নেই। জীবন অনত্র। সেই জীবনকে রক্তমাংসসমেত স্পর্শ করতে হলে নিজের ভেতর ডুব দিয়ে গভীর থেকে গভীরতম নীরবতার ভাষা বুঝতে হয়। কোলাহলে জীবনের উপলব্ধি ঘটে না, নির্জনতার ভেতরই জীবনের প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচিত হয়। ফলে আমরা দেখি যে, প্রভূত সম্পত্তির অধিকারী মানুষটিও জীবনপথে চলতে গিয়ে বিধ্বস্ত আর ক্লান্ত। শাহেদ কায়েস প্রজ্ঞার চোখ দিয়ে জীবন ও জগৎকে দ্যাখেন। ফলে তিনি নৈরাজ্যবাদী হাওয়ার অভিঘাতে বিধ্বস্ত হলেও ফিরে আসতে পারেন জীবনের মর্মমূলে। ‘জীবনের কাছে ফেরা’ কবিতায় তিনি লিখছেন:

সত্তার গভীরে যে অনুভব শিকড় ছড়ালো, তার কি

জানা আছে কোথায় গন্তব্য! বহু রাস্তার মোড়ে-

হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো সেই বিশ^াসঘাতক জুডাস ছায়া...

মানুষ কেন তার নিজের ছায়ার কাছেই হেরে যায়!

সত্তার গভীরে প্রগাঢ় অনুভূতির নানা রঙছবি কবি দেখতে পান। সেসব রঙছবির সাথে বাস্তবতার কোনো সাদৃশ্য নেই। কারণ, যে জীবন কবি যাপন করছেন সেই জীবন তিনি যাপন করতে চান না। যাপিতজীবনে চলার পথে অসংখ্য মোড়। প্রত্যেক মোড়েই দাঁড়িয়ে আছে একজন করে জুডাস। যে জুডাস ৩০টি রুপোর মুদ্রার প্রলোভনে যিশুকে ধরিয়ে দিয়েছিল। বাস্তবতা আসলে মানুষের ছায়া। আর, মূল মানুষটি সত্তার গভীরে আত্মোপলব্ধিতে রয়ে গেছে। শাহেদ আক্ষেপ করছেন যে, ছায়ারূপী বাইরের জীবনের কাছেই আত্মরূপ মূল মানুষটি ঢাকা পড়ে যায়। এহেন উপলব্ধি মূলত দার্শনিক উপলব্ধি হলেও শাহেদ কবিতার ভেতর শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় মুদ্রিত করে তুলেছেন। ফলে, উপলব্ধিজাত সত্য দার্শনিকতার বলয় ভেঙে সাহিত্যের রসে জারিত হয়েছে। এই কৌশলটি কবি হিসেবে শাহেদের বিশেষ একটি বৈশিষ্ট্য বলেই পাঠকের মনে হবে। যা বাস্তবতা, তার ওপর তিনি শিল্পের মাধুর্য দিয়ে প্রলেপ ছড়িয়ে দেন। ফলে দৃশ্যমান বাস্তবতা শৈল্পিক বাস্তবতা হিসেবে পাঠকের চোখের সামনে প্রতিভাত হয়ে ওঠে। মানে, বাস্তবতার সমান্তরাল আরেক বাস্তবতা। তবে নির্মিত বাস্তবতায় ভেতর পাঠকের নিঃশ^াস নেয়ার অবকাশ থাকে। যে সুযোগ যাপিত বাস্তবতায় পাঠকের থাকে না। কেননা, যাপিত জীবন নৈরাজ্যবাদী হাওয়ায় কম্পমান। আর শাহেদ নির্মিত বাস্তবতা প্রতীক ও উপমার সৌন্দর্যে রাঙানো। ‘রক্তাক্ত শ্রাবণ’ কবিতায় শাহেদ কায়েস লিখছেন:

রক্তজবা ভেসে যাচ্ছে অঝোর শ্রাবণে...

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে-

কিভাবে মুছে ফেলবে তরুণ জবার দাগ!

...

এই রক্তাক্ত জনপদে সময়ই সবচেয়ে বড় বিচারক

বন্দুকের নল একদিন ঘুরে যাবে হন্তারকের দিকে।

আমরা বুঝতে পারছি, প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে জীবনের প্রাণ-স্ফুরণ উপলব্ধ হয় শাহেদ কায়েসের। আর তাই একজীবনে তার ঋণ কেবলমাত্র প্রকৃতির প্রতিটি উপাদানের কাছেই। কিন্তু মানুষ হিসেবে তাকে চলতে হয় জীবনপথে। সেই পথ জটিল ও বহুধা বিভক্ত। এইখানে পাঠক হিসেবে আমরা ইঙ্গিত পাচ্ছি নৈরাজ্যের। যে নৈরাজ্যের স্বরূপ তিনি বইয়ের শেষদিকের কয়েকটি কবিতায় উন্মোচিত করেছেন। জীবনচলার পথ সাধারণ মানুষের খোলা চোখে মনে হবে সহজ, সাদাসিধে। কিন্তু শাহেদ কায়েস যেহেতু প্রজ্ঞার চোখ দিয়ে জগৎ নিরীক্ষণ করেন, ফলে জীবনপথের বাঁকে তিনি অসংখ্য বাঁক দেখতে পান। আর তাতেই দ্বিধার থরো-থরো চিত্তে তিনি কাঁপতে থাকেন। বুঝতে পারেন না, কোনটি সহজ পথ। প্রকৃতির ঐকতানে যে পথ ছন্দিত পাখির কলতানে, নদীর কুলকুল ¯্রােতে। বৃক্ষের পত্র-পল্লবে কোন পথ ছায়া-সুনিবিড়, শাহেদ খুঁজতে থাকেন। পাঠক হিসেবে আমরাও শাহেদের সাথে দ্বিধায় কাঁপতে থাকি। আমাদের ভেতরও আবিষ্কার করে বসি প্রজ্ঞার চোখ। এরপর সেই চোখ দিয়ে নিজের জীবনপথের দিকে তাকাই। যে-কোনো উৎকৃষ্ট কবিতার কাজ হচ্ছে, কবির বোধকে পাঠকের অন্তর্গহ্বরে অনুরণিত করা। শাহেদ সেই কাজটি এখানে যথার্থ উপায়েই করেছেন, সন্দেহ নেই।

শাহেদের কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, সীমিত বাক্যবন্ধনির ভেতর সীমাহীন অনুভূতির স্ফুরণ ছড়িয়ে দেয়া। এই বইয়ের কবিতা পড়তে পড়তে এই সত্য পাঠক উপলব্ধি করবেন। তার কবিতার শব্দ ছন্দিত নয়, শব্দের বুনন কাট-কাট। শাহেদের অন্তর্জগতের সৌন্দর্য ভাষায় প্রকাশ করতে যে-যে শব্দ দরকার সেই-সেই শব্দ নিজের থেকেই বসে যাচ্ছে সার-দিয়ে। আর, প্রতিটি শব্দের শরীরে রাঙানো রয়েছে শাহেদের অন্তর্গহনের আলোকচ্ছটা। আমাদের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, কবি হিসেবে এটাও শাহেদের আরেকটি শিল্প-কৌশল। মাত্রাভিত্তিক পর্ববিন্যাসে শব্দগুলো বিন্যাস্ত হলে কবিতার শরীরে ছন্দিত ঘূর্ণি থাকতো। কিন্তু তাতে শাহেদের কবিতার নিজস্ব কৌশলটি আর থাকতো না। মানে, শব্দের কাট-কাট দৃঢ়তা ভেঙে পেলবতা তৈরি হতো।

বলা দরকার, শাহেদ কায়েস মূলত চিত্রকল্পের কবি। শৈল্পিক সুষমায় রাঙানো এক-একটি চিত্রকল্প তার কবিতার শরীরজুড়ে নক্ষত্রের মতো জ¦লজ¦ল জ¦লতে থাকে। ‘শরৎ এলো’ কবিতা থেকে কয়েক পঙ্ক্তি পড়া যাক, ‘নাকে মেঘের নোলক, শরৎ এলো/নীল শাড়ি পরে- কোমর দুলিয়ে।’ কবিতায় শরতের সৌন্দর্য চিত্রিত করতে গিয়ে যুগে-যুগে নানা কবি নানা চিত্রকল্প এঁকেছেন। সেসবের ধারাবাহিকতায় শাহেদের এই চিত্রকল্প যে অনবদ্য, মেধাবী পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। শরৎ যেন ছিপছিপে গড়নের তন্বী কিশোরী। নাকে মেঘের নোলক পরে গায়ে নীল শাড়ি জড়িয়ে কোমর দুলিয়ে হেঁটে আসছে। মহাজাগতিক প্ররোচনায় শাহেদ কায়েস এভাবেই আত্মরূপ ধ্যানের ছবি ভাষাচিত্রে এঁকে রেখেছেন ‘নৈরাজ্যবাদী হাওয়া’য়।

back to top