ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
লোরকা বিমানবন্দরে লেখক
গ্রানাদার মাটিতে নেমে বিমান খানিক এগুতেই চোখে পড়ল বিমান-বন্দরের নাম-ফলক: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিমানবন্দর। এক কবির নামে বিমান-বন্দর, তাও আবার স্পেনের শ্রেষ্ঠ কবি লোরকার নামে! তাহলে লোরকার দেশে চলেই আসলামÑ তা ভাবতে ভাবতেই বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে এলাম। টেক্সিতে রওয়ানা দিলাম শহরের দিকে-১০ মাইল পথে আমাদের সাথে সাথে চলল সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালার ধূসর নীল শিখর ঢেকে আছে সাদা বরফেÑ বিকেলের হালকা রোদে তা দেখাচ্ছে ঝলমলে সুন্দর। রাস্তার দু’পাশে পপলার, পাইন ও ওক গাছের সারি, মাঝেমধ্যে জলপাই বাগান, আর ছোট ছোট টিলার উপর ঘর-বাড়ি, টাইলস-এর রঙিন ছাদ।
ধীরে ধীরে গ্রানাদা শহরের দিকে যাচ্ছি। কাছে যেতেই চোখে পড়ছে সুন্দর নকশার পুরনো দালান, নুড়ি বিছানো ছোট রাস্তা, ফোয়ারা, ক্যাফে, প্লাজা, আর গাছে গাছে পাকা কমলা। অলিগলি সবদিকে বিচিত্র জন¯্রােত। শহরের মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে দোরা নদী, তার পাশেই আল-সাবিকা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আল হাম্বরা প্রাসাদ, তার ওপর সিয়ারা নেভাদা মালা, আরো ওপরে দীপ্তিময় সূর্য। আল হামরা, দোরা নদী, গ্রানাদাÑ সবকিছুকে যেন কোলে করে রেখেছে সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালা।
হোটেলে ঢোকার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হলামÑ সাথে স্ত্রী ফারজানা, ছেলে নাবিল, মেয়ে নাতাশা। বিকেলের হিম হিম হাওয়া, সূর্য ডোবার কিছুটা বাকি। হাঁটতে বেশ ভালই লাগছে। হাঁটছে বেশিরভাগ লোক, বাইসাইকেল বা মোটর সাইকেলে চড়ে যাচ্ছে অনেকে, সবচেয়ে লোক কম বাস-ট্রাম-কারে। নুড়ি পাথরের কয়েকটি সরু রাস্তা পার হয়ে আসলাম বড় রাস্তার পাশে একটি চত্বরেÑ মাঝখানে মার্বেল পাথরের ফোয়ারা, চারপাশে নকশা-করা ল্যাম্পপোস্ট, টবে ঝোলানো সারি সারি ফুলের গাছ। এখানে বসার অনেক বেঞ্চ পাতা, আর আছে বহু ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, বাইরেও চেয়ার টেবিল, ওপরে চাঁদোয়া। জীবনের ব্যস্ততা ভুলতে আসা মানুষের ভিড়, অনেকের মাঝে জমে উঠেছে আড্ডা। চারিদিকে সারি সারি কমলা গাছ, বিকেলের সোনা রোদ এসে পড়েছে পাকা কমলার ওপর- দুটি রঙ এক হয়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য সৌন্দর্য।
সূর্য ডুবতেই জ্বলে উঠল হাজারো বাতি। কাল খ্রিস্টমাস, তাই এক উৎসবের আমেজ। পুরো গ্রানাদার মানুষ যেন ঘরের বাইরে চলে এসেছে। সারারাত চলবে হৈচৈ, চারদিকে এত আনন্দ, কারো সময়ের কোনো অভাব নেই। সব বড় রাস্তায় আলোকসজ্জা, মোড়ে মোড়ে সাজানো ব্যানার ‘ফেলিজ নাভিদাদ!’ অর্থাৎ ‘শুভ বড়দিন’!
আমরা ঘুরে ঘুরে মানুষ ও আলোর উৎসব দেখতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটি নামে চোখ আটকে গেল। আল তাজÑ এটি এক রোস্তোরাঁ, সবার খিদে পেয়েছে, তাই এখানে ঢোকার কথা ভাবতেই একজন এসে সাদরে দোতলায় নিয়ে গেল। ফ্লোর, দরজা, জানালা, দেয়ালÑ সবকিছু আলহাম্বরা-র নকশার ডিজাইন করে বানানো, যেন এক মিনি আলহাম্বরা। পরে অবশ্য গ্রানাডার অনেক হোটেল, দোকান-পাট, বাসায় আলহাম্বরা-র বিভিন্ন নকশা দেখেছি। মেনু এসে গেল, দেখে বুঝলাম মরক্কো-জাতীয় খাবারের জায়গা। অর্ডার দিলাম মরক্কোর জনপ্রিয় সুপ হারিরা, আর সাথে চিকেন বিরিয়ানি। খাওয়া ভালই লাগল।
ফিরতে দেখি জন¯্রােত আরো উত্তাল হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে এ স্্েরাত পার হয়ে হোটেলে পৌঁছতে একটু সময় লাগল। সবাই ক্লান্ত, তাই ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি।
সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। আধা ঘণ্টা পড়ে হোটেলের ব্রেকফাস্ট রুম বন্ধ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাস্তা করতে গেলাম। বারান্দার টেবিলে বসে আমরা পাশের কমলা গাছের সারি দেখতে লাগলামÑ হাত বাড়ালেই যেন পাকা কমলা ছোঁয়া যাবে। কী সুন্দর দৃশ্য!
রাস্তায় বের হতেই নাতাশা বলল, নদীর পাড়ে যাব। বললাম. কোন নদী, কতটুকু দূরে, বলেই আমার সাথে রাখা গ্রানাদার বড় ম্যাপ ও গাইড বুক বের করে দেখতে লাগলাম। নাতাশা ম্যাপটি আমার হাত থেকে নিয়ে বলল- বাবা, কাগজের এত বড় ম্যাপ লাগবে না, আমার ফোনে গুগল ম্যাপ আছে, তার ডাইরেকশান মতো আমরা যাব। আমার চির পরিচিত কাগজের ম্যাপ বাদ দিয়ে গুগল ম্যাপেই আমরা যেতে থাকলাম।
শহরের বুক চিরেই বয়ে চলেছে দোরা নদী, আমরা সেখানেই যাব। হোটেলের কাছে প্লাজা নুয়েভা, সেখান থেকে শুরু করে উত্তর পূর্ব দিকে পৌঁছলাম প্লাজা দে সান্টা এনা-তে, পাশেই ১৬ শতাব্দীর চার্চ, ইগলেসিয়া দে সান্টা এনা। আর কয়েক মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম দারো নদীর পাড়ে এক বিরাট চত্বরেÑ যা জনপ্রিয় পাসেও দে লস ট্রিস্টেস নামে। ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এ ছিল বুল ফাইট ও অন্যান্য বড় উৎসবের কেন্দ্র। সময় ও ইতিহাসের বিবর্তনে এখন তা ঘুরে বেড়ানো ও মেলামেশার এক বড় জায়গা।
দারোকে নদী না বলে ঝর্না বলাই ভাল। এটি কল কল শব্দে প্রবহমান, দু’পাড় পাথর-সিমেন্টে বাঁধানো। তার এক পাশে আল-সাবিকা পাহাড়ের ওপর আলহাম্বরা, অন্য পাশে সান ক্রিস্টোবাল পাহাড়ের ওপর আলবাইসিন। আলহাম্বরা, আলবাইসিন শব্দ দু’টিতে বেশ মিল, মনে হচ্ছে আরবী শব্দ। হ্যাঁ, আরবি শব্দই, কারণ এ দু’টি স্থাপনা আরবদের তৈরি, আর তারা এখানে থাকতেন, এখনো অনেকে আছেন আলবাইসিন-এ ।
পাসেও দে লস ট্রিস্টেস-এ আছে দারো নদীর পাশে হাঁটার জন্য বাঁধানো বিরাট চত্বর, মাঝখানে ১৬০৯ সালে তৈরি সুন্দর এক ফোয়ারা, আর রয়েছে মনোরম বাগান। ঝোলানো টবে উজ্জ্বল রঙের সব ফুল, একটু পর পর বসানো চাঁদোয়া, তার উপর বিভিন্ন লতা-পাতা, তার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়েছে নিচে বসার টেবিল-চেয়ারে। ভোরের হিমেল হাওয়া আর মিষ্টি রোদ মিলে তৈরি করেছে এক ¯িœগ্ধ পরিবেশ।
পাসেও দে লস ট্রিস্টেস-এর প্রধান আকর্ষণ দারো নদী ও তার পাশে পাহাড়ের ওপর আলহাম্বরা। নদীর স্ফটিক-স্বচ্ছ জলে তলদেশের প্রতিটি নুড়ি দৃশ্যমান। বলা হয়ে থাকে, এ নদীর পলি-মাটিতে একসময় স্বর্ণ পাওয়া যেত। দূরে সিয়ারা নেভাদার শিয়রে জ্বলে উঠেছে ভোরের সূর্য, তা আলহাম্বরার গায়ে পড়ে বিচ্ছুরিত দোরা নদীর জলে, তা হয়ে উঠেছে অতীতের সে স্বর্ণরেণুর মতো। দোরা-আলহাম্বরার যুগল দৃশ্যের সাথে যোগ হয়েছে বাগান, ফোয়ারা, সেতু আর পাশের আলবাইসিন, আর সব ভরে আছে উচ্ছল সব মানুষে। এসবের সমাহারে তৈরি হয়েছে গ্রানাদার সবচেয়ে রোমান্টিক ও বোহেমিয়ান পরিবেশ।
আলহাম্বরার দৃশ্য দেখে, দোরার জল-সঙ্গীত শুনে, তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হলো এ দৃশ্যকে, এ সঙ্গীতকে ভিডিওতে ধরে রাখি। ফোনের ভিডিও অন করতেই নাতাশা বলে উঠলÑ বাবা, এটি রেকর্ড করার দরকার নেই, প্লিজ এনজয় দ্য মোমেন্ট, কিপ ইন মেমোরি। তার যুক্তি মানতেই হলো।
কাছাকাছি এলাকার একটি বাসা, ঠিকানা, ৫০ এসেরা দেল দারোÑ এখানে পরিবারের সাথে বাস করতেন লোরকাÑ ১৯০৮ থেকে ১৯১৬ সালÑ তাঁর হাইস্কুলে পড়ার পুরো আট বছর। পরের এক বছর ছিলেন ৩৪, গ্রান ভিয়াতে। দু’টিই দোরা নদীর কাছে, সহজেই দেখা যায় নদী, শোনা যায় তার কলকল ধ্বনি, যা সম্ভবত লোরকাকে উদ্বুদ্ধ করেছে লিখতে:
আমার ঘর থেকে ঝর্নার শব্দ শোনা যায়।
একটি আঙুরলতা আর সূর্যরশ্মি।
আর কিছু নয়।
আমার হৃদয়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায় তারা।১
এখানে খাবারের অর্ডার দেয়া যায়, রাস্তার অপর পাশের রেস্তোরাঁ থেকে তা নিয়ে আসা হয়। বাইরে খোলা জায়গায় চাঁদোয়ার নিচে বসে খাওয়াটা স্পেনে বেশ জনপ্রিয়। ছেলে নাবিল বলল এখানে লাঞ্চ করবে। একটি টেবিলে সবাই বসে অর্ডার দিলাম খাবারÑ চিকেন ফাহিতা ও পাস্তা। রাস্তার অপর পাশের রেস্তোরাঁ থেকে খাওয়া নিয়ে এসে পরিবেশন করতে একটু সময় লাগল। আমেরিকার তুলনায় স্পেনে সবকিছু একটু ধীরে চলে। নাবিল ও নাতাশা এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতে চায় না, ঘুরে বেড়ানোতে তাদের এত উৎসাহ। আমি বারবার বলিÑ সবকিছু দেখার সময় নেই, সবকিছু দেখার দরকারও নেই, আমরা শুধু ল্যান্ডমার্কগুলো দেখব, জানব।
লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। বড় এক সুবিধাÑ গ্রানাদার বিখ্যাত জায়গাগুলি কাছাকাছি, হেঁটে যাওয়া যায়। অনেকে এখানকার হপ-অন-হপ-অফ পর্যটন বাসে করে ঘোরে, একটি জায়গায় যায়, তা দেখে আবার বাসে উঠে পরে, নেমে পড়ে পরবর্তী গন্তব্যে। তবে আমরা সবাই হাঁটাই পছন্দ করি। এতে মানুষ ও জনপদকে আরো নিবিড়ভাবে দেখা যায়, জানা যায়।
এরপর গেলাম পাশের কারেরা দেল দারো-তে, যা দোরা নদীর পাশে, আলহাম্বরার প্রেক্ষাপটে এক সুন্দর হেঁটে চলার রাস্তা। দোরা এখানে বেশ সরু হয়ে গেছে, তার চারপাশে সবুজ ঘন গাছ-পালা, ফুলের বাগান, তার মাঝে নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তা, তার উপর ইট-পাথরে তৈরি আরব স্থাপত্যের সুন্দর ভবন ও দু’টি ব্রিজ, মাঝে চার্চ অফ সান্টা এনাÑ মনে হচ্ছে নিসর্গ, স্থাপত্য ও ইতিহাস এখানে একসাথে মিশে আছে।
পাশেই সান ক্রিস্টোবাল পাহাড়ের ওপরে ছড়ানো আলবাইসিনÑ গ্রানাডার সবচেয়ে পুরনো এলাকা। তাই আলবাইসিন-এ হাঁটা মানে গ্রানাদার ইতিহাসে হাঁটা। ইতিহাসের পথে আমাদের সে হাঁটা শুরু করা যাক।
অতীতে গ্রানাদা ছিল দেয়াল ঘেরা এক শহর, যাতে ছিল প্রবেশের বিভিন্ন ফটক। পাহাড়ের পাদদেশের পুয়ের্তো দে এলভিরা ছিল তার একটি। এ ফটক দিয়েই আলবাইসিন-এ আমাদের প্রবেশ। নুড়ি পাথর বিছানো আঁকা বাঁকা সরু রাস্তা ধরে ক্রমশ উঠতে লাগলাম ওপরে। দুপাশে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আরবীয় ঐতিহ্যের সাদা চুনকাম করা অগণিত বাড়ি। অনেক বাড়িতে বারান্দায় ঝোলানো ফুলের টব, পেছনে উঠোন ও কুয়া। মাঝেমধ্যেই বড় চত্বরÑ মেলামেশা ও আড্ডা দেয়ার জায়গা, কিছু দোকানপাট, যার বেশিরভাগ উত্তর আফ্রিকার পণ্যে ভর্তি। আর আছে বহু ক্যাফে, রেঁস্তোরা ও স্যুভেনির শপ। এসব দেখে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম কুয়েসতা দে সান ক্রিস্টোবাল-এর সিঁড়ি-র পাদদেশে , বহু ধাপের এ সিঁড়ি পার হয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম মিরাদর দে সান নিকোলাস-এ, যা আলবাইসিন-র প্রাণকেন্দ্র। এটি বিখ্যাত এক লুকআউট পয়েন্ট, যেখান থেকে আলহাম্বরা-র ওপরে সূর্যাস্ত সবচেয়ে ভাল দেখা যায় । সূর্য ডুবতে আরো ঘণ্টাখানেক বাকি, তবে এর মধ্যেই দর্শনার্থীরা জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। আমরাও কোনোমতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আলহাম্বরা ও সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
চারদিকে এক উৎসবমুখর পরিবেশÑ জিপসীরা গিটার হাতে গান গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ বিক্রি করছে প্রসাধনী ও অলঙ্কার। এক চিত্রশিল্পী বিক্রি করছে হাতে আঁকা আলহাম্বরার ছবি। একসময় ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গেল, শুরু হলো চারদিকে হাত-তালি, বেড়ে গেল নাচ-গানের উত্তাপ, শোনা গেল দুরের উলুধ্বনি। আর এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেল গ্রানাদার সবচেয়ে সুন্দর ছবিÑ ডুবে যাওয়া সূর্যের রঙিম আভায় আলহাম্বরার সোনালি রূপ, পেছনে সিয়েরা নেভাদার গোলাপি রঙ। আলহাম্বরার উপর সূর্যাস্ত কি গ্রানাদায় মুসলিম গৌরব-সূর্য অস্তমিত হওয়ার ক্ষণটি মনে করিয়ে দিল। সূর্যের আভা মিলিয়ে যেতেই মনে হলো, কয়েক শতাব্দীর বিষাদ জমে আছে আলহাম্বরার বুকে।
এ রকম আরেকটি মোহনীয় দৃশ্য মনে পড়ে গেল। তবে তা ছিল সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত নয়।
প্রায় ৩০ বছর আগে গিয়েছিলাম দার্জিলিং, টাটা টি-এর আমন্ত্রণে, দার্জিলিং-এ তাদের চা বাগান ঘুরে দেখতে। আমার সাথে ছিলেন শফিক ভাইÑ জেমস ফিনলে চা বাগান-এ আমার বস, খুব মিশুক ও আমুদে লোক। কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ খুব ভোরে হোটেলে পাশের রুম থেকে এসে শফিক ভাই দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। শফিক ভাই হাসতে হাসতে বললেন, জীবনে তো অনেক ঘুমিয়েছ, এবার একটু বেড়াও। তাগাদা দিলেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে, টাইগার হিলে যেতে হবে সূর্য ওঠার আগেই। তৈরি হয়ে লবিতে আসতেই শফিক ভাই বললেন, তোমার এই খানদানি জ্যাকেটে কাজ হবে না, রুম থেকে কম্বল এনে গায়ে জড়িয়ে নাও। দেখি উনি তাই করেছেন। দু’জনে গায়ে কম্বল জড়িয়ে হাঁটতে থাকলাম টাইগার পয়েন্টের দিকে, পথে হাজার হাজার লোক, গন্তব্য একই। বিশ পঁচিশ মিনিট হাঁটার পর আমরা দু’জন পৌঁছলাম ৮০০০ ফিট উপরে টাইগার পয়েন্টে। ইতিমধ্যেই এটি পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে, সবাই সূর্যোদয় দেখতে চায়, যা সামনের কাঞ্চনজঙ্ঘা গিরিশৃঙ্গের ওপরেই হবে। ভাগ্য ভালো, আকাশে মেঘ নেই, তাই সূর্য ও কাঞ্চনজঙ্ঘা বেশ পরিষ্কার দেখা যাবে। তবে হাড়হিম করা ঠা-া, তখন তো সেলসিয়াস বা ফারেনহাইটে তাপমাত্রা বলা তেমন হতো না। ঠা-া, বেশ ঠা-া, ভীষণ ঠা-াÑ এরকমই বলতাম। তবে ভীষণ ঠা-ার নিচে যদি কিছু থাকে, সেদিন সেরকম ছিল। আর চারদিক এখনো হালকা অন্ধকার, সূর্য উঠলেই তো আলোর দেখা মিলবে, সে সূর্যের অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে।
সূর্য উঠতে শুরু করল আস্তে আস্তে, মনে হলো তার কোনো তাড়া নেই, প্রকৃতির নিয়মে সে উঠবে, ডুববে। সূর্য আরো ওপরে উঠতেই আলো ফুটতে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘার সারা অবয়বে, আর পুরো পৃথিবীতে। আলোর এ রূপ আগে কখনো দেখিনি। মনে পড়ে গেল কবিগুরুর কটি লাইন: ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা,/ আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা’। আশ্বর্য, এ গানটিই কাছে এক মেয়ে গুন গুন করে গাইছিল। আগে এ গান অনেকবার শুনেছি, তবে শুনতে সেদিনের মতো এত ভালো কখনো লাগেনি। আলোর উৎসের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙ দেখতে দেখতে এ গান নতুন ভাব, নতুন অর্থ নিয়ে এল। তাইতো ‘আলো হৃদয়-হরা’। সূর্য পুরো উঠে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে উঠল আগুনে পোড়া সোনার মতো। এ এক স্বর্গীয় ছবি, যা আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে।
ফিরে আসি বর্তমানে- মিরাদর দে সান নিকোলাস-এ। এখন রাতেরবেলায় সব আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ছে। অনেকে নিচের রেঁস্তোরায় যাচ্ছেÑ আড্ডা দেবে, বিয়ার খাবে, ফ্লেমেনকো গান শুনবে। আমরা সেসব হৈ হুল্লোড়ে যোগ দেব না, সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে বেশ ক্লান্ত। পাশের এক রেঁস্তোরায় হালকা ডিনার সেরে চললাম হোটেলের দিকে। ফেরার পথে পাহাড় থেকে ঢালুর দিকে নামাÑ কাজেই হাঁটতে একটু সহজ হলো, হোটেলে ফিরলাম তাড়াতাড়ি।
আলহাম্বরা-কে আজ দেখলাম অনেক দূর থেকে, মিরাদর দে সান নিকোলাস থেকে, কাল আলহাম্বরা-র ভেতরে যাবার প্রত্যাশায় দিলাম আরামের ঘুম।
Ref:
১. Granada y 1850, গ্রানাদা ও ১৮৫০. অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-১
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
লোরকা বিমানবন্দরে লেখক
শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫
গ্রানাদার মাটিতে নেমে বিমান খানিক এগুতেই চোখে পড়ল বিমান-বন্দরের নাম-ফলক: ফেদেরিকো গার্সিয়া লোরকা বিমানবন্দর। এক কবির নামে বিমান-বন্দর, তাও আবার স্পেনের শ্রেষ্ঠ কবি লোরকার নামে! তাহলে লোরকার দেশে চলেই আসলামÑ তা ভাবতে ভাবতেই বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে এলাম। টেক্সিতে রওয়ানা দিলাম শহরের দিকে-১০ মাইল পথে আমাদের সাথে সাথে চলল সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালার ধূসর নীল শিখর ঢেকে আছে সাদা বরফেÑ বিকেলের হালকা রোদে তা দেখাচ্ছে ঝলমলে সুন্দর। রাস্তার দু’পাশে পপলার, পাইন ও ওক গাছের সারি, মাঝেমধ্যে জলপাই বাগান, আর ছোট ছোট টিলার উপর ঘর-বাড়ি, টাইলস-এর রঙিন ছাদ।
ধীরে ধীরে গ্রানাদা শহরের দিকে যাচ্ছি। কাছে যেতেই চোখে পড়ছে সুন্দর নকশার পুরনো দালান, নুড়ি বিছানো ছোট রাস্তা, ফোয়ারা, ক্যাফে, প্লাজা, আর গাছে গাছে পাকা কমলা। অলিগলি সবদিকে বিচিত্র জন¯্রােত। শহরের মাঝখানে বয়ে যাচ্ছে দোরা নদী, তার পাশেই আল-সাবিকা পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছে আল হাম্বরা প্রাসাদ, তার ওপর সিয়ারা নেভাদা মালা, আরো ওপরে দীপ্তিময় সূর্য। আল হামরা, দোরা নদী, গ্রানাদাÑ সবকিছুকে যেন কোলে করে রেখেছে সিয়ারা নেভাদা পর্বতমালা।
হোটেলে ঢোকার পর একটু বিশ্রাম নিয়ে ঘুরতে বের হলামÑ সাথে স্ত্রী ফারজানা, ছেলে নাবিল, মেয়ে নাতাশা। বিকেলের হিম হিম হাওয়া, সূর্য ডোবার কিছুটা বাকি। হাঁটতে বেশ ভালই লাগছে। হাঁটছে বেশিরভাগ লোক, বাইসাইকেল বা মোটর সাইকেলে চড়ে যাচ্ছে অনেকে, সবচেয়ে লোক কম বাস-ট্রাম-কারে। নুড়ি পাথরের কয়েকটি সরু রাস্তা পার হয়ে আসলাম বড় রাস্তার পাশে একটি চত্বরেÑ মাঝখানে মার্বেল পাথরের ফোয়ারা, চারপাশে নকশা-করা ল্যাম্পপোস্ট, টবে ঝোলানো সারি সারি ফুলের গাছ। এখানে বসার অনেক বেঞ্চ পাতা, আর আছে বহু ক্যাফে-রেস্তোরাঁ, বাইরেও চেয়ার টেবিল, ওপরে চাঁদোয়া। জীবনের ব্যস্ততা ভুলতে আসা মানুষের ভিড়, অনেকের মাঝে জমে উঠেছে আড্ডা। চারিদিকে সারি সারি কমলা গাছ, বিকেলের সোনা রোদ এসে পড়েছে পাকা কমলার ওপর- দুটি রঙ এক হয়ে সৃষ্টি করেছে এক অনন্য সৌন্দর্য।
সূর্য ডুবতেই জ্বলে উঠল হাজারো বাতি। কাল খ্রিস্টমাস, তাই এক উৎসবের আমেজ। পুরো গ্রানাদার মানুষ যেন ঘরের বাইরে চলে এসেছে। সারারাত চলবে হৈচৈ, চারদিকে এত আনন্দ, কারো সময়ের কোনো অভাব নেই। সব বড় রাস্তায় আলোকসজ্জা, মোড়ে মোড়ে সাজানো ব্যানার ‘ফেলিজ নাভিদাদ!’ অর্থাৎ ‘শুভ বড়দিন’!
আমরা ঘুরে ঘুরে মানুষ ও আলোর উৎসব দেখতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে একটি নামে চোখ আটকে গেল। আল তাজÑ এটি এক রোস্তোরাঁ, সবার খিদে পেয়েছে, তাই এখানে ঢোকার কথা ভাবতেই একজন এসে সাদরে দোতলায় নিয়ে গেল। ফ্লোর, দরজা, জানালা, দেয়ালÑ সবকিছু আলহাম্বরা-র নকশার ডিজাইন করে বানানো, যেন এক মিনি আলহাম্বরা। পরে অবশ্য গ্রানাডার অনেক হোটেল, দোকান-পাট, বাসায় আলহাম্বরা-র বিভিন্ন নকশা দেখেছি। মেনু এসে গেল, দেখে বুঝলাম মরক্কো-জাতীয় খাবারের জায়গা। অর্ডার দিলাম মরক্কোর জনপ্রিয় সুপ হারিরা, আর সাথে চিকেন বিরিয়ানি। খাওয়া ভালই লাগল।
ফিরতে দেখি জন¯্রােত আরো উত্তাল হয়ে উঠেছে। ধীরে ধীরে এ স্্েরাত পার হয়ে হোটেলে পৌঁছতে একটু সময় লাগল। সবাই ক্লান্ত, তাই ঘুমিয়ে পড়লাম তাড়াতাড়ি।
সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। আধা ঘণ্টা পড়ে হোটেলের ব্রেকফাস্ট রুম বন্ধ হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাস্তা করতে গেলাম। বারান্দার টেবিলে বসে আমরা পাশের কমলা গাছের সারি দেখতে লাগলামÑ হাত বাড়ালেই যেন পাকা কমলা ছোঁয়া যাবে। কী সুন্দর দৃশ্য!
রাস্তায় বের হতেই নাতাশা বলল, নদীর পাড়ে যাব। বললাম. কোন নদী, কতটুকু দূরে, বলেই আমার সাথে রাখা গ্রানাদার বড় ম্যাপ ও গাইড বুক বের করে দেখতে লাগলাম। নাতাশা ম্যাপটি আমার হাত থেকে নিয়ে বলল- বাবা, কাগজের এত বড় ম্যাপ লাগবে না, আমার ফোনে গুগল ম্যাপ আছে, তার ডাইরেকশান মতো আমরা যাব। আমার চির পরিচিত কাগজের ম্যাপ বাদ দিয়ে গুগল ম্যাপেই আমরা যেতে থাকলাম।
শহরের বুক চিরেই বয়ে চলেছে দোরা নদী, আমরা সেখানেই যাব। হোটেলের কাছে প্লাজা নুয়েভা, সেখান থেকে শুরু করে উত্তর পূর্ব দিকে পৌঁছলাম প্লাজা দে সান্টা এনা-তে, পাশেই ১৬ শতাব্দীর চার্চ, ইগলেসিয়া দে সান্টা এনা। আর কয়েক মিনিট হেঁটে পৌঁছলাম দারো নদীর পাড়ে এক বিরাট চত্বরেÑ যা জনপ্রিয় পাসেও দে লস ট্রিস্টেস নামে। ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত এ ছিল বুল ফাইট ও অন্যান্য বড় উৎসবের কেন্দ্র। সময় ও ইতিহাসের বিবর্তনে এখন তা ঘুরে বেড়ানো ও মেলামেশার এক বড় জায়গা।
দারোকে নদী না বলে ঝর্না বলাই ভাল। এটি কল কল শব্দে প্রবহমান, দু’পাড় পাথর-সিমেন্টে বাঁধানো। তার এক পাশে আল-সাবিকা পাহাড়ের ওপর আলহাম্বরা, অন্য পাশে সান ক্রিস্টোবাল পাহাড়ের ওপর আলবাইসিন। আলহাম্বরা, আলবাইসিন শব্দ দু’টিতে বেশ মিল, মনে হচ্ছে আরবী শব্দ। হ্যাঁ, আরবি শব্দই, কারণ এ দু’টি স্থাপনা আরবদের তৈরি, আর তারা এখানে থাকতেন, এখনো অনেকে আছেন আলবাইসিন-এ ।
পাসেও দে লস ট্রিস্টেস-এ আছে দারো নদীর পাশে হাঁটার জন্য বাঁধানো বিরাট চত্বর, মাঝখানে ১৬০৯ সালে তৈরি সুন্দর এক ফোয়ারা, আর রয়েছে মনোরম বাগান। ঝোলানো টবে উজ্জ্বল রঙের সব ফুল, একটু পর পর বসানো চাঁদোয়া, তার উপর বিভিন্ন লতা-পাতা, তার ফাঁক দিয়ে হালকা রোদ এসে পড়েছে নিচে বসার টেবিল-চেয়ারে। ভোরের হিমেল হাওয়া আর মিষ্টি রোদ মিলে তৈরি করেছে এক ¯িœগ্ধ পরিবেশ।
পাসেও দে লস ট্রিস্টেস-এর প্রধান আকর্ষণ দারো নদী ও তার পাশে পাহাড়ের ওপর আলহাম্বরা। নদীর স্ফটিক-স্বচ্ছ জলে তলদেশের প্রতিটি নুড়ি দৃশ্যমান। বলা হয়ে থাকে, এ নদীর পলি-মাটিতে একসময় স্বর্ণ পাওয়া যেত। দূরে সিয়ারা নেভাদার শিয়রে জ্বলে উঠেছে ভোরের সূর্য, তা আলহাম্বরার গায়ে পড়ে বিচ্ছুরিত দোরা নদীর জলে, তা হয়ে উঠেছে অতীতের সে স্বর্ণরেণুর মতো। দোরা-আলহাম্বরার যুগল দৃশ্যের সাথে যোগ হয়েছে বাগান, ফোয়ারা, সেতু আর পাশের আলবাইসিন, আর সব ভরে আছে উচ্ছল সব মানুষে। এসবের সমাহারে তৈরি হয়েছে গ্রানাদার সবচেয়ে রোমান্টিক ও বোহেমিয়ান পরিবেশ।
আলহাম্বরার দৃশ্য দেখে, দোরার জল-সঙ্গীত শুনে, তন্ময় হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হলো এ দৃশ্যকে, এ সঙ্গীতকে ভিডিওতে ধরে রাখি। ফোনের ভিডিও অন করতেই নাতাশা বলে উঠলÑ বাবা, এটি রেকর্ড করার দরকার নেই, প্লিজ এনজয় দ্য মোমেন্ট, কিপ ইন মেমোরি। তার যুক্তি মানতেই হলো।
কাছাকাছি এলাকার একটি বাসা, ঠিকানা, ৫০ এসেরা দেল দারোÑ এখানে পরিবারের সাথে বাস করতেন লোরকাÑ ১৯০৮ থেকে ১৯১৬ সালÑ তাঁর হাইস্কুলে পড়ার পুরো আট বছর। পরের এক বছর ছিলেন ৩৪, গ্রান ভিয়াতে। দু’টিই দোরা নদীর কাছে, সহজেই দেখা যায় নদী, শোনা যায় তার কলকল ধ্বনি, যা সম্ভবত লোরকাকে উদ্বুদ্ধ করেছে লিখতে:
আমার ঘর থেকে ঝর্নার শব্দ শোনা যায়।
একটি আঙুরলতা আর সূর্যরশ্মি।
আর কিছু নয়।
আমার হৃদয়ের দিকে আঙুল উঁচিয়ে দেখায় তারা।১
এখানে খাবারের অর্ডার দেয়া যায়, রাস্তার অপর পাশের রেস্তোরাঁ থেকে তা নিয়ে আসা হয়। বাইরে খোলা জায়গায় চাঁদোয়ার নিচে বসে খাওয়াটা স্পেনে বেশ জনপ্রিয়। ছেলে নাবিল বলল এখানে লাঞ্চ করবে। একটি টেবিলে সবাই বসে অর্ডার দিলাম খাবারÑ চিকেন ফাহিতা ও পাস্তা। রাস্তার অপর পাশের রেস্তোরাঁ থেকে খাওয়া নিয়ে এসে পরিবেশন করতে একটু সময় লাগল। আমেরিকার তুলনায় স্পেনে সবকিছু একটু ধীরে চলে। নাবিল ও নাতাশা এক মুহূর্ত সময়ও নষ্ট করতে চায় না, ঘুরে বেড়ানোতে তাদের এত উৎসাহ। আমি বারবার বলিÑ সবকিছু দেখার সময় নেই, সবকিছু দেখার দরকারও নেই, আমরা শুধু ল্যান্ডমার্কগুলো দেখব, জানব।
লাঞ্চ সেরে আবার হাঁটা শুরু করলাম। বড় এক সুবিধাÑ গ্রানাদার বিখ্যাত জায়গাগুলি কাছাকাছি, হেঁটে যাওয়া যায়। অনেকে এখানকার হপ-অন-হপ-অফ পর্যটন বাসে করে ঘোরে, একটি জায়গায় যায়, তা দেখে আবার বাসে উঠে পরে, নেমে পড়ে পরবর্তী গন্তব্যে। তবে আমরা সবাই হাঁটাই পছন্দ করি। এতে মানুষ ও জনপদকে আরো নিবিড়ভাবে দেখা যায়, জানা যায়।
এরপর গেলাম পাশের কারেরা দেল দারো-তে, যা দোরা নদীর পাশে, আলহাম্বরার প্রেক্ষাপটে এক সুন্দর হেঁটে চলার রাস্তা। দোরা এখানে বেশ সরু হয়ে গেছে, তার চারপাশে সবুজ ঘন গাছ-পালা, ফুলের বাগান, তার মাঝে নুড়ি-পাথর বিছানো রাস্তা, তার উপর ইট-পাথরে তৈরি আরব স্থাপত্যের সুন্দর ভবন ও দু’টি ব্রিজ, মাঝে চার্চ অফ সান্টা এনাÑ মনে হচ্ছে নিসর্গ, স্থাপত্য ও ইতিহাস এখানে একসাথে মিশে আছে।
পাশেই সান ক্রিস্টোবাল পাহাড়ের ওপরে ছড়ানো আলবাইসিনÑ গ্রানাডার সবচেয়ে পুরনো এলাকা। তাই আলবাইসিন-এ হাঁটা মানে গ্রানাদার ইতিহাসে হাঁটা। ইতিহাসের পথে আমাদের সে হাঁটা শুরু করা যাক।
অতীতে গ্রানাদা ছিল দেয়াল ঘেরা এক শহর, যাতে ছিল প্রবেশের বিভিন্ন ফটক। পাহাড়ের পাদদেশের পুয়ের্তো দে এলভিরা ছিল তার একটি। এ ফটক দিয়েই আলবাইসিন-এ আমাদের প্রবেশ। নুড়ি পাথর বিছানো আঁকা বাঁকা সরু রাস্তা ধরে ক্রমশ উঠতে লাগলাম ওপরে। দুপাশে গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে আছে আরবীয় ঐতিহ্যের সাদা চুনকাম করা অগণিত বাড়ি। অনেক বাড়িতে বারান্দায় ঝোলানো ফুলের টব, পেছনে উঠোন ও কুয়া। মাঝেমধ্যেই বড় চত্বরÑ মেলামেশা ও আড্ডা দেয়ার জায়গা, কিছু দোকানপাট, যার বেশিরভাগ উত্তর আফ্রিকার পণ্যে ভর্তি। আর আছে বহু ক্যাফে, রেঁস্তোরা ও স্যুভেনির শপ। এসব দেখে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম কুয়েসতা দে সান ক্রিস্টোবাল-এর সিঁড়ি-র পাদদেশে , বহু ধাপের এ সিঁড়ি পার হয়ে অবশেষে পৌঁছে গেলাম মিরাদর দে সান নিকোলাস-এ, যা আলবাইসিন-র প্রাণকেন্দ্র। এটি বিখ্যাত এক লুকআউট পয়েন্ট, যেখান থেকে আলহাম্বরা-র ওপরে সূর্যাস্ত সবচেয়ে ভাল দেখা যায় । সূর্য ডুবতে আরো ঘণ্টাখানেক বাকি, তবে এর মধ্যেই দর্শনার্থীরা জায়গাটি দখল করে নিয়েছে। আমরাও কোনোমতে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আলহাম্বরা ও সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।
চারদিকে এক উৎসবমুখর পরিবেশÑ জিপসীরা গিটার হাতে গান গাইছে, কেউ নাচছে, কেউ বিক্রি করছে প্রসাধনী ও অলঙ্কার। এক চিত্রশিল্পী বিক্রি করছে হাতে আঁকা আলহাম্বরার ছবি। একসময় ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গেল, শুরু হলো চারদিকে হাত-তালি, বেড়ে গেল নাচ-গানের উত্তাপ, শোনা গেল দুরের উলুধ্বনি। আর এর মধ্যেই সৃষ্টি হয়ে গেল গ্রানাদার সবচেয়ে সুন্দর ছবিÑ ডুবে যাওয়া সূর্যের রঙিম আভায় আলহাম্বরার সোনালি রূপ, পেছনে সিয়েরা নেভাদার গোলাপি রঙ। আলহাম্বরার উপর সূর্যাস্ত কি গ্রানাদায় মুসলিম গৌরব-সূর্য অস্তমিত হওয়ার ক্ষণটি মনে করিয়ে দিল। সূর্যের আভা মিলিয়ে যেতেই মনে হলো, কয়েক শতাব্দীর বিষাদ জমে আছে আলহাম্বরার বুকে।
এ রকম আরেকটি মোহনীয় দৃশ্য মনে পড়ে গেল। তবে তা ছিল সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত নয়।
প্রায় ৩০ বছর আগে গিয়েছিলাম দার্জিলিং, টাটা টি-এর আমন্ত্রণে, দার্জিলিং-এ তাদের চা বাগান ঘুরে দেখতে। আমার সাথে ছিলেন শফিক ভাইÑ জেমস ফিনলে চা বাগান-এ আমার বস, খুব মিশুক ও আমুদে লোক। কথা নাই বার্তা নাই, হঠাৎ খুব ভোরে হোটেলে পাশের রুম থেকে এসে শফিক ভাই দরজা ধাক্কা দিতে লাগলেন। একটু ভয় পেয়ে গেলাম। শফিক ভাই হাসতে হাসতে বললেন, জীবনে তো অনেক ঘুমিয়েছ, এবার একটু বেড়াও। তাগাদা দিলেন তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে, টাইগার হিলে যেতে হবে সূর্য ওঠার আগেই। তৈরি হয়ে লবিতে আসতেই শফিক ভাই বললেন, তোমার এই খানদানি জ্যাকেটে কাজ হবে না, রুম থেকে কম্বল এনে গায়ে জড়িয়ে নাও। দেখি উনি তাই করেছেন। দু’জনে গায়ে কম্বল জড়িয়ে হাঁটতে থাকলাম টাইগার পয়েন্টের দিকে, পথে হাজার হাজার লোক, গন্তব্য একই। বিশ পঁচিশ মিনিট হাঁটার পর আমরা দু’জন পৌঁছলাম ৮০০০ ফিট উপরে টাইগার পয়েন্টে। ইতিমধ্যেই এটি পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে, সবাই সূর্যোদয় দেখতে চায়, যা সামনের কাঞ্চনজঙ্ঘা গিরিশৃঙ্গের ওপরেই হবে। ভাগ্য ভালো, আকাশে মেঘ নেই, তাই সূর্য ও কাঞ্চনজঙ্ঘা বেশ পরিষ্কার দেখা যাবে। তবে হাড়হিম করা ঠা-া, তখন তো সেলসিয়াস বা ফারেনহাইটে তাপমাত্রা বলা তেমন হতো না। ঠা-া, বেশ ঠা-া, ভীষণ ঠা-াÑ এরকমই বলতাম। তবে ভীষণ ঠা-ার নিচে যদি কিছু থাকে, সেদিন সেরকম ছিল। আর চারদিক এখনো হালকা অন্ধকার, সূর্য উঠলেই তো আলোর দেখা মিলবে, সে সূর্যের অপেক্ষায় আছি আমরা সবাই কাঞ্চনজঙ্ঘার দিকে তাকিয়ে।
সূর্য উঠতে শুরু করল আস্তে আস্তে, মনে হলো তার কোনো তাড়া নেই, প্রকৃতির নিয়মে সে উঠবে, ডুববে। সূর্য আরো ওপরে উঠতেই আলো ফুটতে থাকল কাঞ্চনজঙ্ঘার সারা অবয়বে, আর পুরো পৃথিবীতে। আলোর এ রূপ আগে কখনো দেখিনি। মনে পড়ে গেল কবিগুরুর কটি লাইন: ‘আলো আমার, আলো ওগো, আলো ভুবন-ভরা,/ আলো নয়ন-ধোওয়া আমার, আলো হৃদয়-হরা’। আশ্বর্য, এ গানটিই কাছে এক মেয়ে গুন গুন করে গাইছিল। আগে এ গান অনেকবার শুনেছি, তবে শুনতে সেদিনের মতো এত ভালো কখনো লাগেনি। আলোর উৎসের সামনে কাঞ্চনজঙ্ঘার রঙ দেখতে দেখতে এ গান নতুন ভাব, নতুন অর্থ নিয়ে এল। তাইতো ‘আলো হৃদয়-হরা’। সূর্য পুরো উঠে গেলে কাঞ্চনজঙ্ঘা হয়ে উঠল আগুনে পোড়া সোনার মতো। এ এক স্বর্গীয় ছবি, যা আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে।
ফিরে আসি বর্তমানে- মিরাদর দে সান নিকোলাস-এ। এখন রাতেরবেলায় সব আস্তে আস্তে ঝিমিয়ে পড়ছে। অনেকে নিচের রেঁস্তোরায় যাচ্ছেÑ আড্ডা দেবে, বিয়ার খাবে, ফ্লেমেনকো গান শুনবে। আমরা সেসব হৈ হুল্লোড়ে যোগ দেব না, সারাদিনের ঘোরাঘুরিতে বেশ ক্লান্ত। পাশের এক রেঁস্তোরায় হালকা ডিনার সেরে চললাম হোটেলের দিকে। ফেরার পথে পাহাড় থেকে ঢালুর দিকে নামাÑ কাজেই হাঁটতে একটু সহজ হলো, হোটেলে ফিরলাম তাড়াতাড়ি।
আলহাম্বরা-কে আজ দেখলাম অনেক দূর থেকে, মিরাদর দে সান নিকোলাস থেকে, কাল আলহাম্বরা-র ভেতরে যাবার প্রত্যাশায় দিলাম আরামের ঘুম।
Ref:
১. Granada y 1850, গ্রানাদা ও ১৮৫০. অনুবাদ: অমিতাভ দাশগুপ্ত