alt

সাময়িকী

আজ লাবণ্যর বিয়ে

: বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

[উৎসর্গ : লাবণ্য অদিতিকে; তোমার বিয়েতে যেতে পারলে এমন অনাসৃষ্টির মুখ দেখতে হতো না!]

আজ লাবণ্য অদিতির বিয়ে। কত জনেরই তো বিয়ে হয় রোজ। কিন্তু লাবণ্যর বিয়ে নিয়ে এতো ভাবনা কিসের! লাবণ্য আমার কে?

: কেন লাবণ্য কি তোমার কেউ না?

-ঠিক তা নয়। একবাক্যে না করে দেয়া যাবে না।

: তাহলে?

-আসলে আমন্ত্রণ পেয়েও তার বিয়েতে যেতে না পারার অক্ষমতা আমাকে সারাজীবন কাঁদাবে।

: সেটা কেমন?

-সেটা বলতে গেলে তো ছোটখাটো উপন্যাস লিখতে হবে।

: দূর উপন্যাস রাখো; বিষয়টা কী সেটা আগে বলো।

নিজের ছায়ার সঙ্গে কথোপকথনে এভাবে আটকে যাবো ভাবিনি। আটকে যেহেতু গেছি; একটু পেছন থেকে শুরু না করলে ব্যাপারটা পরিষ্কার করাও মুশকিল। ৯০ দশকের কথা; লাবণ্য অদিতির বাবা লুৎফর রহমানকে তখনও চিনি না; মানে তখন তো লাবণ্যর জন্মও হয়নি। আর তার মা কবিরুন নেছাকে চিনি-জানি; যদিও তখন তিনি লাবণ্যর মা হয়ে ওঠেননি। চৈত্র মাসের কোনো এক ভরা পূর্ণিমা রাতে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে হয়ে গেল কবিরুন নেছা-লুৎফর রহমানের। আমি কবিরুন নেছার ছোটভাই কাজলের বন্ধু; একই আত্মা যেন। সেসময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে আমরা আইএসসি পড়ি।

‘আমার বাড়ি আমার বাড়ি; তোমার বাড়িও আমার বাড়ি’র মতো যাতায়াত কাজলের বাড়িতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার মেজো আপা কবিরুন নেছা আমারও মেজো আপা। বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর-সর্বত্র অবাধ যাতায়াত। পরিবারের সবার সাথে সম্পর্কটাও আত্মিক। একেকটা সম্পর্ক ধরে ছড়ানো ডালপালার বিস্তৃতিতে চাইলে ‘মহাভারত’ লেখা যাবে।

গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে যেমন হয় আর কী! সেই রকম চরম আনন্দ হলো মেজো আপার বিয়েতে। রাতে কে কোথায় ঘুমাবে? ঘরের চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি; তাই সিদ্ধান্ত হলো-ছেলেরা অর্থাৎ কাজলের বন্ধুরা দুই ঘরের খাটে, মেঝেতে ঘুমাবে। দরকার পড়লে বারান্দার চৌকিতেও। তবে বিয়ের রাতে এতো ঘুমানোর সময় কোথায়! গ্রীষ্মকালের জোৎস্না রাত, উঠানে বসে গল্প-গানেই কেটে যাবে অর্ধেকের বেশি।

সত্যি সত্যি বরকনে বিদায় হবার পর শুরু হলো নানান কিসিমের গল্প। কাজল এতো সুন্দর করে গল্প বলে যেন সেটা জীবনের চেয়ে সত্য। গল্পও তো কোনো না কোনো জীবনের রসদই। তার উপস্থাপনের ঢংয়ে মনে দাগ কাটে; যেমন পায়ে হাঁটা পথে ভোরের শিশির আলতো ছোঁয়ায় পুরো শরীরকে নাড়িয়ে দেয়। কিংবা হাসির রোল উঠে যখন কানা-খোড়ার অঙ্গভঙ্গি নিপুণ বাস্তবতায় ‘অভিনেতা’ কাজল ফুটিয়ে তোলে। অন্যরাও মাঝে মধ্যে দু’একটি গল্প বলল। এভাবেই হাসি আর গল্পে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল, বাড়ির বয়স্ক মেয়েরা খাওয়াদাওয়া শেষ করার তাগাদা দিলেন। বয়স্ক ও শিশুদের খাওয়ানোর পর এলো আমাদের পালা।

কাজল নিজে খাওয়ার পাশাপাশি আমার প্লেটেও এটা-ওটা তুলে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আশপাশের অন্যদের খাওয়া শেষ হলো; আমার তখনও চলছে। খাবার টেবিলে নতুন করে এক গামলা ভাত এসেছে। ওখান থেকে এক চামচ তুলে দিতে দিতে কাজল বলল, ‘সবগুলো ভাত খেতে পারবে তুমি?’

অন্যরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল, ‘না; কোনোমতেই পারবে না।’

কাজলের বাবাআমাকে বললেন, ‘তুমি আস্তে ধীরে খাও তো বাবা। যতদূর পারো খাও। সব খেতে হবে কেন।’ এসব কথার তোড়ে আমার জিদ গেল বেড়ে। বললাম, ‘যদি সব ভাত খেতে পারি; তাহলে আমাকে কে কী দেবে বলো?’

কাজলের চাচাতো ভাই রফিকুল ফোঁস করে বলল; ‘তুমিই বলো; খেতে না পারলে কী দেবে? আমরাও তাই দেবো।’ চারদিকে তাকিয়ে জনসংখ্যা বোঝার চেষ্টা করলাম; এরপর বললাম, ‘খেতে পারলে ১৪টা সেভেনআপ দিতে হবে। আর যদি না পারি; আমি ১৪টা সেভেনআপ কিনে দেবো তোমাদের।’

‘ঠিক আছে; ঠিক আছে।’-বলে সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। এবার আমার যেন একটু ভয়ই লাগল, ‘পারবো তো এত্তোগুলা ভাত খেতে!’

কাজল ভাত তুলে দিচ্ছে, মাংস দিচ্ছে, দিচ্ছে ডাল; আর আমি খাচ্ছি। এভাবে চলল অনেকক্ষণ। কিন্তু গামলা তো কোনোভাবেই খালি হচ্ছে না! মনে সাহস রেখে খেতে থাকলাম। এদিকে সম্ভাব্য বিজয়ের হাসিমিনমিন করে ফুটে উঠছে অন্য সবার চোখেমুখে। আমার তো ত্রাহি দশা। ‘হাল ছাড়লে তো হবে না; বলেছি যখন-শেষ করবই’-নিজেকে বললাম। তাই খাওয়া থামালাম না; চালিয়ে গেলাম। ওমা; একসময় দেখি পুরো গামলার ভাত খেয়ে ফেলেছি!

‘মিনমিনে চোখ-মুখগুলো’ শা করে উধাও; সবাই বিস্ময়ে-আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল! এরপর এলো সেভেনআপ। সব বন্ধু-বান্ধবীদের হাতে হাতে সেভেনআপের বোতল তুলে দিয়ে আমিও একটা খেলাম। রাতের তখন পাশ ফিরে শোবার সময় পেরিয়েছে; ঘড়িতে ১২টা বেজেছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই।

সারাদিনের ক্লান্তি, অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে দুচোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। বড় ঘরের বারান্দার একটি বেঞ্চে দু’হাত মাথার নিচে রেখে চিৎ হয়ে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কীভাবে সারা রাত কাটলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিষ্টি রোদের তাপেসকালে ঘুম ভাঙে। সাড়ে ৭টা বাজে। ‘ইশ; এতো বেলা হয়ে গেছে’-ভাবনায় একটু বিব্রত হলাম বৈকি; পরক্ষণেই এড়িয়ে যাওয়ার অনভ্যস্ত মুখে সোজা চলে গেলাম বাথরুমে।

‘লাবণ্যর বিয়ে ঠিক হয়েছে’; ২৯ নভেম্বর ফোনে বলল কাজল। ‘ভেড়ামারা শহরে অনুষ্ঠান, যেতেই হবে।’-প্রতিউত্তরে বললাম, ‘আমার অবস্থা তো জানো, বেকার মানুষ। যাওয়া হবে না মনে হয়।’ ইনিয়ে-বিনিয়ে অর্থ সংকটের প্রসঙ্গ তুললাম; পারলে যেন কিছু ঋণ দেয়-এমন ইঙ্গিতও করলাম। তার যে খুব ভালো দিন যাচ্ছে তাও অবশ্য নয়।

প্রায় ৫ মাস আগে ২০২৪-এর মাঝামাঝি ৩০ জুন ছিল আমার শেষ কর্মদিবস। এরপর বেকারত্ব জেঁকে বসেছে; হালকা-পাতলা সঞ্চয় যা করেছি সাংবাদিকতা পেশায়; তার সবই শেষ এ ক’মাসে। এসব বিষয় কমবেশি কাজল জানেও। তারপরও আমার ‘যাওয়া হবে না মনে হয়’ শুনে রেগে উঠল ফোনেই। মনে হলো ওপাশ থেকে বেশ জোরে ধাক্কা দিলো; সামনাসামনি থাকলে সে ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন ছিল। ‘সে কথা বললে চলবে না? আমি কিন্তু অতো ভালো মানুষ না। লাবণ্যর বিয়েতে না গেলে তোমার সাথে কোনো সম্পর্কই থাকবে না বলে রাখছি!’ বেশ কড়া গলায় বলল।

: আচ্ছা দেখা যাক, তো পাত্র কী করে? বাড়ি কোথায়?

-ডাক্তার। বাড়ি সিলেট।

: বাহ! তাহলে তো ভালোই হলো, আমরা লন্ডন যাবার টিকেট পাবো।

এ পাশে দাঁড়িয়েও আমি ওপাশে কাজলের চাপা হাসিমুখটা যেন দেখতে পেলাম। সে কারণেই হয়তো তার কণ্ঠস্বরও একটু আনন্দের শোনাল। বলল-

-তা ভালো বলেছো।

: মাস ছয়েক আগে আমি লাবণ্যর বিয়ের ঘটকালি করেছিলাম।

-আচ্ছা তাই নাকি। আমি তো কিছুই জানি না।

: তোমার ছোটবোন সুখী জানে। তার কাছ থেকেই লাবণ্যর বায়োডাটা নিয়েছিলাম। সেই কবে দেখেছি ২/৩ বছর বয়সের লাবণ্যকে।

মনে পড়ে যায় কত কথা; লাবণ্যর জন্ম; বেড়ে উঠা-তাদের বাড়িতে একসময় নিয়মিত যাতায়াতের দিনগুলো সিনেমার পর্দার মতো ভেসে যেতে থাকে মনের দরজায়। ক্ষণিকের এ ভাবনা বিস্তৃত হবার আগেই ‘কিন্তু লাবণ্যর কথা শুনলে তো মনে হয় তোমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’-বলল কাজল।

: না, সেরকম কিছু না! সর্বশেষ ফেসবুকের মন্তব্যের ঘরে আমাদের কথা হয় পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন-উত্তরে। আমার মনে হয় সুখীর কাছ থেকে আমার সম্পর্কে আপডেটও পেয়ে থাকতে পারে লাবণ্য।

-ও; তা হতে পারে। আচ্ছা শোন, শুক্রবার সময় দিও, ঢাকার বন্ধু-স্বজনদের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেবো, তুমিও যাবে আমার সাথে।

: সে কথা আর বলতে! কী যে আনন্দ লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। ঘটকালি শুরু করেছিলাম আমি; শেষ হচ্ছে অন্য কারও হাতে! আমাদের লাবণ্যর বিয়ে হচ্ছে;মামা হিসেবে এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দের! কেমন করে কীভাবে এত্তো বড় হয়ে গেল আমাদের মেয়েটা!

-রাখছি তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে।

না; শুক্রবার দেখা হয়নি। এমন কী বিয়ের দিন ৬ ডিসেম্বর সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও দেখা হয়নি কাজলের সাথে। ৫ ডিসেম্বর দিনভরও তাড়না ছিল যেকোনোভাবে যাবো লাবণ্যর বিয়েতে। ৪ ডিসেম্বর রাতে ফোন করে এক জুনিয়র সাংবাদিক আনিস খান; বলল; ‘ভাই কাল সকালে চলেন একটু মাওয়া যাবো; আপনি গেলে আমার উপকার হয়।’ ‘বাসা থেকে বের হওয়ার মতো টাকা-পয়সা পকেটে নেই’-শুনে বললেন, ‘সমস্যা নাই; আমি নিয়ে যাবো আপনাকে।’

সারাদিন কাটলো তার সাথে। বেকারত্বের সাথে যোগ হয়েছে হাঁটু ব্যথা; যার কারণ নাকি ‘ওভার ওয়েট’! তাই ডাক্তারি পরামর্শে ভাত-শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ প্রায় একমাস। মাওয়াতে আনিস যার কাছে নিয়ে গেল; সে বড় ধুরন্দর! কীভাবে যেন বুঝে গেছে আমরা যাবো তার বাড়ি; আগেই সটকে পড়েছে। ভরদুপুরে গিয়ে পেলাম তার বাবাকে খাবার টেবিলে। বেচারি বিব্রত; বললেন, ‘ছেলের পাওনাদারদের কাছে মানসম্মান যাচ্ছে বাবা; তারপরও তোমরা যখন চলে আসছো খাবার সুময়, চাট্টি ভাত খাও।’ ‘না চাচা আমরা এখন খাবো না; পাওনা টাকাটার ব্যাপারে কী করবেন একটু ভেবে বলেন।’ -আনিস বলল। আর আমি ভাবছি; ভাততো চাইলেও খেতে পারব না। ‘ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা’ না মানলে কপালে শনি আছে।

আমাদের সামনেই ফোনালাপে বাবা-ছেলের তুমুল তর্ক হলো। ওপাশের ছেলেকে দেখতে না পেলেও এপাশে বাবার কথা ও মুখভঙ্গি জানান দিচ্ছিল ‘কথার রণে ভঙ্গ’ দিতে কেউ-ই রাজি নন। যখন ফোন রাখলেন; আমরা দেখলাম ‘ক্লান্ত-পরাজিত’ এক বাবাকে।একটু থেমে কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে তিনিবললেন, ‘রাত ১০টার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। আপনি বিকাশ নম্বরটা দিয়ে যান।’ এমন কথা শুনে আনিস বেশ খুশি।

বেলা ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে মাওয়া থেকে ঢাকার পথে রওনা দিলাম আমরা। পথে খোশমেজাজি আনিসের সাথে সুর মেলাতে পারছিলাম না। আমার ভাবনায় লাবণ্যর বিয়ে; আরও একটি ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছিল। সেটা হলো-আমার আরেক বন্ধু হরিহর আত্মা মহিউদ্দিন শামীমের বাবা; যিনি আমাকে সন্তানের মতো ¯েœহ-ভালোবাসায় সবসময় আগলে রাখেন; তার অসুস্থতা। বয়স ও পারকিনসন রোগের জটিলতায় মাস ছয়েক তিনি কুষ্টিয়া শহরে বিছানাগত। মাস তিনেক আগে একবার সুযোগ হয়েছিল; দেখে এসেছি। তখন কথাবার্তা বলতে পারছিলেন; আর এখন সদর হাসপাতালে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন। যেকোনোভাবে অন্তত হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা হলে সটান চলে যাবো-কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। চাচাজানকে শেষ দেখাটা অন্তত দেখতে পারব। কত কথা মনে পড়ছে-ঠোটার পাড়ার অজপাড়া গায়ের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে; উপজেলার সেরা বিদ্যাপীঠের একটি মথুরাপুর হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়ে বন্ধু হিসেবে পেলাম শামীমকে। তারপর রাত নেই; দিন নেই-হাইস্কুল-কলেজ মিলিয়ে আমরা একসাথে কাটিয়েছি অন্তত ১০ বছর। পারিবারিক সম্পর্কে একে অপরের পরিপূরক; বন্ধনও তেমনই। তার ছোট দুইবোন শেফালী-শিল্পীর সাথে হৃদ্যতা নিজের বোনের মতো। বাবা-মাকেও কখনো ভিন্ন কেউ মনে হয়নি।

ইদানিং নিজেকে অপরাধী মনে হয়-এমন বন্ধনে থেকেও শামীমের দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারছি না; ফোনেও বেশি কথা বলার সাহস পায় না। কেমন যেন নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখি; মনে হয় এভাবে হয়তো আর্থিক অনটনটাকেও লুকিয়ে রাখা যাবে। হাইস্কুলের পাশে বাড়ি হওয়ায় টিফিন পিরিয়ডে হাফ প্যান্টের দু-পকেট ভরে মুড়ি নিয়ে আসছে শামীম; দু-জনে মিলে দেবদারু তলায় বসে-দাঁড়িয়ে সে মুড়ি খাচ্ছি কিংবা কারো সাথে দুষ্টুমি করে এসে আমার পেছনে আড়াল খুঁজছে বন্ধুটি। ‘মারমুখী প্রতিপক্ষ’ বন্ধুটি আমার কারণে কাছে ঘেঁষছে না শামীমের। স্কুলের পুকুরের মাছ ধরা হয়েছে; আমতলায় ওজন চলছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই রুই-কাতলের লাফালাফি দেখছি; বেখেয়ালে পাশে দাঁড়ানো জেকের স্যারের ঘাড়ে ‘আমি ভেবে’ আয়েশে হাত রেখেছে শামীম। লম্বায় খাটো জেকের স্যার ‘কে রে’ বলার সাথে সাথে ভো দৌড়। আমিও দৌড়াচ্ছি শামীমের সাথে। স্মৃতির আয়নায় দৌড়ে আসছে অসংখ্য দিনলিপি।

আমার ভাবনা দৌড়াচ্ছে- ৫ ডিসেম্বর রাতে হলেও কুষ্টিয়া যাবো; চাচাজানকে হাসপাতালে দেখে ৬ ডিসেম্বর দুপুরে ভেড়ামারায় লাবণ্যর বিয়েতে ঢুঁ মারবো, দেখা হবে পুরনো অনেকের সাথে নতুন চেহারায়। হয়তো কাউকে কেউ চিনবো না; অন্যরা চিনিয়ে দেবে! এই তো মাত্র দিন তিনেক আগে কাজলের সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল; ঢাকা থেকে প্রাইভেট কার ভাড়ার বিষয়ে চেনাজানাদের মধ্য থেকে কাউকে ম্যানেজ করতে বলেছিল সে। তাই বাধ্য হয়েই কাঁটাবনে মনজুরুলের রাইয়্যান প্রিন্টার্সে পূর্ব রাজাবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে যাওয়া। তা না হলে ওইদিনও বাসা থেকে হয়তো বেরুনো হতো না রসদের অভাবে। তবে ভালো লাগল; যখন প্রাইভেট কার চূড়ান্ত করে দিতে পারলাম; মনে হলো-বিয়েতে তো অর্ধেক চলেই গেলাম। বাকিটাও যাবো যেকোনোভাবে।

এসব ভাবনার মধ্যেই আনিস বলে উঠল, ‘ভাই রাতে টাকা পেয়েই আপনাকে জানাবো।’ আরও অনেক কথা-ই হয়তো বলল আনিস। কিছু আমার কানে গেল; কিছু বাতাসে ভেসে গেল! বাসার গেটের কাছে রিকশা থেকে নামার সময় বলল; ‘এই একশ টাকা রাখেন।’ খালি পকেটের কথা ভেবে নিলাম ওই টাকাটাও। মনে মনে তখনও প্রত্যাশা রাত ১০টায় ১০ হাজার টাকা আনিস বিকাশে পেলে অন্তত তাকে বলে হাজার পাঁচেক ধার নেবো। এরপর কাটাকাটা হলেও কুষ্টিয়ার পথে বাস ধরবো। বাসায় ফিরে ঠিক দশটায় মেসেজ পেলাম; ‘ভাই মাওয়া থেকে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে।’ সামনাসামনি যা বলা যায় না, ফোনে-মেসেজে তা বলা যায় অতি সহজে; ‘আমার অবস্থা তো জানেন, ৫ হাজার টাকা বিকাশ করেন, খুব দ্রুতই ব্যবস্থা হলে ফেরত পেয়ে যাবেন।’-এমন মেসেজের সাথে বিকাশ নম্বরটাও লিখে দিলাম; যেটা আনিস আগে থেকেই জানে। প্রত্যাশার পারদ সটান ভূপাতিত হতে সময় লাগল না;খুব অল্প সময়েই নানা অজুহাত দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘না’ করে দিলেন আনিস। টাকাটা পাওয়া হলো না। রণে ভঙ্গ দিলাম; মায়ের বিয়ে খেয়েছি বলে মেয়েরটাও খেতে হবে এমনতো কোনো কথা নাই।

৬ ডিসেম্বর দুপুরে লাবণ্যর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার খবর মোবাইল ফোনে বাসায় এলো। লাবণ্যর প্রাথমিকের শিক্ষক আমার বড় আপা জানাল; ‘অনেক দিন পর কাজলের সাথে দেখা হলো; বেশ মুটিয়ে গেছে!’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা এলো-আজকের আধার চারপাশকে যেন ভিন্ন কোনো বার্তা দিতে উদগ্রীব। রাতে ঘুমানোর আগে হাত গেল মোবাইলে। কোনো মেসেজ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস হলো কিনা দেখার নিয়মিত অভ্যাস। ফেসবুক নোটিফিকেশন মহিউদ্দিন শামীমের। বুকটা ছ্যাত করে উঠল; ‘চাচাজানের কিছু হলো?’ ‘বাবা, বাবা গো পুরোপুরি এতিম করে কোথায় হারিয়ে গেলে...।’-রাত ৯টা ৪৭ মিনিটে শামীমের ফেসবুক স্ট্যাটাস! চোখ ফেটে পানি বেরুনোর প্রাক্কালে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে তাওহীদা জুন অজ্ঞাত কারণে গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়েছে মশারির ভেতর। একটু দূরেই মোবাইল হাতে আমি। ধাতস্থ হলাম, জুনকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রীতা আমাকে ডাকল। সারাদিন মায়ের প্রযত্নে থাকলেও রাতে মেয়েটি আমার ন্যাওটা হয়ে যায়। আমিও ঢুকলাম মশারির ভেতরে। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে বুকের ওপর উপুড় করে শুইয়ে পিঠে হালকা থাবা দিতে দিতে চোখের কোণটা মুছলাম; এরপর মেয়ের সাথে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম কিংবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলাম!

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ফিলিস্তিনের তিনটি কবিতা

ছবি

এক বিস্ময় প্রতিভা

ছবি

দিওয়ান-ই-মাখফি : জেব-উন-নিশা

ছবি

বৈচিত্র্যে ভরা ‘যদিও উত্তরমেঘ’

ছবি

রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের কথা

ছবি

মোহ কাঠের নৌকা : জীবন-সংগ্রামের এক বাস্তব প্রতিচ্ছবি

ছবি

শাঁকচুন্নি

ছবি

মেঘনাদবধ, এক নতুন দৃশ্যভাষা

ছবি

নতুন কবিতার সন্ধানে

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

গণহত্যার বিরুদ্ধে কবিতা

ছবি

আবদুল মান্নান সৈয়দের ‘ভাঙানৌকা’

ছবি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বায়োস্কোপ

ছবি

জরিনা আখতারের কবিতা আত্ম-আবিষ্কার ও মুক্তি

ছবি

শহীদ সাবেরের সাহিত্য চিন্তা ও জীবনের সমন্বয়

ছবি

বাংলা ছোটগল্পের অনন্য রূপকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র

ছবি

প্রেম, দর্শন ও অখণ্ডতা

ছবি

প্রতিবাদী চেতনার উর্বর ময়দান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের আদি পুরুষের শেকড়

ছবি

ভেঙে পড়ে অন্তর্গহনের প্রগাঢ় অনুভূতি

সাময়িকী কবিতা

ছবি

রহস্যময় পাহাড়ী মানব

ছবি

ফ্রিদা কাহলো : আত্মপ্রকাশের রঙিন ক্যানভাস

ছবি

জ্যাজ সংঙ্গীতের তাৎক্ষণিক সৃষ্টিশীলতা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

নক্ষত্রের ধ্রুবতারা অধ্যাপক শুভাগত চৌধুরী

ছবি

নজরুল ও তাঁর সুন্দর

ছবি

নতুন বইয়ের খবর

ছবি

‘আমার চোখ যখন আমাকেই দেখে’- প্রেম ও প্রকৃতির সেতুবন্ধ

ছবি

পূষন ও বৃষ্টির গল্প

ছবি

নিরামিষ চর্চার বিরল আখ্যান

tab

সাময়িকী

আজ লাবণ্যর বিয়ে

বৃহস্পতিবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৫

[উৎসর্গ : লাবণ্য অদিতিকে; তোমার বিয়েতে যেতে পারলে এমন অনাসৃষ্টির মুখ দেখতে হতো না!]

আজ লাবণ্য অদিতির বিয়ে। কত জনেরই তো বিয়ে হয় রোজ। কিন্তু লাবণ্যর বিয়ে নিয়ে এতো ভাবনা কিসের! লাবণ্য আমার কে?

: কেন লাবণ্য কি তোমার কেউ না?

-ঠিক তা নয়। একবাক্যে না করে দেয়া যাবে না।

: তাহলে?

-আসলে আমন্ত্রণ পেয়েও তার বিয়েতে যেতে না পারার অক্ষমতা আমাকে সারাজীবন কাঁদাবে।

: সেটা কেমন?

-সেটা বলতে গেলে তো ছোটখাটো উপন্যাস লিখতে হবে।

: দূর উপন্যাস রাখো; বিষয়টা কী সেটা আগে বলো।

নিজের ছায়ার সঙ্গে কথোপকথনে এভাবে আটকে যাবো ভাবিনি। আটকে যেহেতু গেছি; একটু পেছন থেকে শুরু না করলে ব্যাপারটা পরিষ্কার করাও মুশকিল। ৯০ দশকের কথা; লাবণ্য অদিতির বাবা লুৎফর রহমানকে তখনও চিনি না; মানে তখন তো লাবণ্যর জন্মও হয়নি। আর তার মা কবিরুন নেছাকে চিনি-জানি; যদিও তখন তিনি লাবণ্যর মা হয়ে ওঠেননি। চৈত্র মাসের কোনো এক ভরা পূর্ণিমা রাতে জাঁকজমকপূর্ণ বিয়ে হয়ে গেল কবিরুন নেছা-লুৎফর রহমানের। আমি কবিরুন নেছার ছোটভাই কাজলের বন্ধু; একই আত্মা যেন। সেসময় কুষ্টিয়া সরকারি কলেজে আমরা আইএসসি পড়ি।

‘আমার বাড়ি আমার বাড়ি; তোমার বাড়িও আমার বাড়ি’র মতো যাতায়াত কাজলের বাড়িতে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তার মেজো আপা কবিরুন নেছা আমারও মেজো আপা। বসার ঘর, শোবার ঘর, রান্নাঘর-সর্বত্র অবাধ যাতায়াত। পরিবারের সবার সাথে সম্পর্কটাও আত্মিক। একেকটা সম্পর্ক ধরে ছড়ানো ডালপালার বিস্তৃতিতে চাইলে ‘মহাভারত’ লেখা যাবে।

গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান ঘিরে যেমন হয় আর কী! সেই রকম চরম আনন্দ হলো মেজো আপার বিয়েতে। রাতে কে কোথায় ঘুমাবে? ঘরের চেয়ে মানুষের সংখ্যা বেশি; তাই সিদ্ধান্ত হলো-ছেলেরা অর্থাৎ কাজলের বন্ধুরা দুই ঘরের খাটে, মেঝেতে ঘুমাবে। দরকার পড়লে বারান্দার চৌকিতেও। তবে বিয়ের রাতে এতো ঘুমানোর সময় কোথায়! গ্রীষ্মকালের জোৎস্না রাত, উঠানে বসে গল্প-গানেই কেটে যাবে অর্ধেকের বেশি।

সত্যি সত্যি বরকনে বিদায় হবার পর শুরু হলো নানান কিসিমের গল্প। কাজল এতো সুন্দর করে গল্প বলে যেন সেটা জীবনের চেয়ে সত্য। গল্পও তো কোনো না কোনো জীবনের রসদই। তার উপস্থাপনের ঢংয়ে মনে দাগ কাটে; যেমন পায়ে হাঁটা পথে ভোরের শিশির আলতো ছোঁয়ায় পুরো শরীরকে নাড়িয়ে দেয়। কিংবা হাসির রোল উঠে যখন কানা-খোড়ার অঙ্গভঙ্গি নিপুণ বাস্তবতায় ‘অভিনেতা’ কাজল ফুটিয়ে তোলে। অন্যরাও মাঝে মধ্যে দু’একটি গল্প বলল। এভাবেই হাসি আর গল্পে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেল, বাড়ির বয়স্ক মেয়েরা খাওয়াদাওয়া শেষ করার তাগাদা দিলেন। বয়স্ক ও শিশুদের খাওয়ানোর পর এলো আমাদের পালা।

কাজল নিজে খাওয়ার পাশাপাশি আমার প্লেটেও এটা-ওটা তুলে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে আশপাশের অন্যদের খাওয়া শেষ হলো; আমার তখনও চলছে। খাবার টেবিলে নতুন করে এক গামলা ভাত এসেছে। ওখান থেকে এক চামচ তুলে দিতে দিতে কাজল বলল, ‘সবগুলো ভাত খেতে পারবে তুমি?’

অন্যরা সবাই হৈ হৈ করে উঠল, ‘না; কোনোমতেই পারবে না।’

কাজলের বাবাআমাকে বললেন, ‘তুমি আস্তে ধীরে খাও তো বাবা। যতদূর পারো খাও। সব খেতে হবে কেন।’ এসব কথার তোড়ে আমার জিদ গেল বেড়ে। বললাম, ‘যদি সব ভাত খেতে পারি; তাহলে আমাকে কে কী দেবে বলো?’

কাজলের চাচাতো ভাই রফিকুল ফোঁস করে বলল; ‘তুমিই বলো; খেতে না পারলে কী দেবে? আমরাও তাই দেবো।’ চারদিকে তাকিয়ে জনসংখ্যা বোঝার চেষ্টা করলাম; এরপর বললাম, ‘খেতে পারলে ১৪টা সেভেনআপ দিতে হবে। আর যদি না পারি; আমি ১৪টা সেভেনআপ কিনে দেবো তোমাদের।’

‘ঠিক আছে; ঠিক আছে।’-বলে সবাই একবাক্যে রাজি হয়ে গেল। এবার আমার যেন একটু ভয়ই লাগল, ‘পারবো তো এত্তোগুলা ভাত খেতে!’

কাজল ভাত তুলে দিচ্ছে, মাংস দিচ্ছে, দিচ্ছে ডাল; আর আমি খাচ্ছি। এভাবে চলল অনেকক্ষণ। কিন্তু গামলা তো কোনোভাবেই খালি হচ্ছে না! মনে সাহস রেখে খেতে থাকলাম। এদিকে সম্ভাব্য বিজয়ের হাসিমিনমিন করে ফুটে উঠছে অন্য সবার চোখেমুখে। আমার তো ত্রাহি দশা। ‘হাল ছাড়লে তো হবে না; বলেছি যখন-শেষ করবই’-নিজেকে বললাম। তাই খাওয়া থামালাম না; চালিয়ে গেলাম। ওমা; একসময় দেখি পুরো গামলার ভাত খেয়ে ফেলেছি!

‘মিনমিনে চোখ-মুখগুলো’ শা করে উধাও; সবাই বিস্ময়ে-আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল! এরপর এলো সেভেনআপ। সব বন্ধু-বান্ধবীদের হাতে হাতে সেভেনআপের বোতল তুলে দিয়ে আমিও একটা খেলাম। রাতের তখন পাশ ফিরে শোবার সময় পেরিয়েছে; ঘড়িতে ১২টা বেজেছে বেশ অনেকক্ষণ আগেই।

সারাদিনের ক্লান্তি, অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে দুচোখে নেমে এলো রাজ্যের ঘুম। বড় ঘরের বারান্দার একটি বেঞ্চে দু’হাত মাথার নিচে রেখে চিৎ হয়ে শুতে না শুতেই ঘুমিয়ে পড়লাম। কীভাবে সারা রাত কাটলো কিছুই বুঝতে পারলাম না। মিষ্টি রোদের তাপেসকালে ঘুম ভাঙে। সাড়ে ৭টা বাজে। ‘ইশ; এতো বেলা হয়ে গেছে’-ভাবনায় একটু বিব্রত হলাম বৈকি; পরক্ষণেই এড়িয়ে যাওয়ার অনভ্যস্ত মুখে সোজা চলে গেলাম বাথরুমে।

‘লাবণ্যর বিয়ে ঠিক হয়েছে’; ২৯ নভেম্বর ফোনে বলল কাজল। ‘ভেড়ামারা শহরে অনুষ্ঠান, যেতেই হবে।’-প্রতিউত্তরে বললাম, ‘আমার অবস্থা তো জানো, বেকার মানুষ। যাওয়া হবে না মনে হয়।’ ইনিয়ে-বিনিয়ে অর্থ সংকটের প্রসঙ্গ তুললাম; পারলে যেন কিছু ঋণ দেয়-এমন ইঙ্গিতও করলাম। তার যে খুব ভালো দিন যাচ্ছে তাও অবশ্য নয়।

প্রায় ৫ মাস আগে ২০২৪-এর মাঝামাঝি ৩০ জুন ছিল আমার শেষ কর্মদিবস। এরপর বেকারত্ব জেঁকে বসেছে; হালকা-পাতলা সঞ্চয় যা করেছি সাংবাদিকতা পেশায়; তার সবই শেষ এ ক’মাসে। এসব বিষয় কমবেশি কাজল জানেও। তারপরও আমার ‘যাওয়া হবে না মনে হয়’ শুনে রেগে উঠল ফোনেই। মনে হলো ওপাশ থেকে বেশ জোরে ধাক্কা দিলো; সামনাসামনি থাকলে সে ধাক্কা সামলানো বেশ কঠিন ছিল। ‘সে কথা বললে চলবে না? আমি কিন্তু অতো ভালো মানুষ না। লাবণ্যর বিয়েতে না গেলে তোমার সাথে কোনো সম্পর্কই থাকবে না বলে রাখছি!’ বেশ কড়া গলায় বলল।

: আচ্ছা দেখা যাক, তো পাত্র কী করে? বাড়ি কোথায়?

-ডাক্তার। বাড়ি সিলেট।

: বাহ! তাহলে তো ভালোই হলো, আমরা লন্ডন যাবার টিকেট পাবো।

এ পাশে দাঁড়িয়েও আমি ওপাশে কাজলের চাপা হাসিমুখটা যেন দেখতে পেলাম। সে কারণেই হয়তো তার কণ্ঠস্বরও একটু আনন্দের শোনাল। বলল-

-তা ভালো বলেছো।

: মাস ছয়েক আগে আমি লাবণ্যর বিয়ের ঘটকালি করেছিলাম।

-আচ্ছা তাই নাকি। আমি তো কিছুই জানি না।

: তোমার ছোটবোন সুখী জানে। তার কাছ থেকেই লাবণ্যর বায়োডাটা নিয়েছিলাম। সেই কবে দেখেছি ২/৩ বছর বয়সের লাবণ্যকে।

মনে পড়ে যায় কত কথা; লাবণ্যর জন্ম; বেড়ে উঠা-তাদের বাড়িতে একসময় নিয়মিত যাতায়াতের দিনগুলো সিনেমার পর্দার মতো ভেসে যেতে থাকে মনের দরজায়। ক্ষণিকের এ ভাবনা বিস্তৃত হবার আগেই ‘কিন্তু লাবণ্যর কথা শুনলে তো মনে হয় তোমার সাথে নিয়মিত যোগাযোগ আছে।’-বলল কাজল।

: না, সেরকম কিছু না! সর্বশেষ ফেসবুকের মন্তব্যের ঘরে আমাদের কথা হয় পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন-উত্তরে। আমার মনে হয় সুখীর কাছ থেকে আমার সম্পর্কে আপডেটও পেয়ে থাকতে পারে লাবণ্য।

-ও; তা হতে পারে। আচ্ছা শোন, শুক্রবার সময় দিও, ঢাকার বন্ধু-স্বজনদের আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দেবো, তুমিও যাবে আমার সাথে।

: সে কথা আর বলতে! কী যে আনন্দ লাগছে বলে বোঝাতে পারবো না। ঘটকালি শুরু করেছিলাম আমি; শেষ হচ্ছে অন্য কারও হাতে! আমাদের লাবণ্যর বিয়ে হচ্ছে;মামা হিসেবে এটাই সবচেয়ে বড় আনন্দের! কেমন করে কীভাবে এত্তো বড় হয়ে গেল আমাদের মেয়েটা!

-রাখছি তাহলে, শুক্রবার দেখা হচ্ছে।

না; শুক্রবার দেখা হয়নি। এমন কী বিয়ের দিন ৬ ডিসেম্বর সমূহ সম্ভাবনা থাকলেও দেখা হয়নি কাজলের সাথে। ৫ ডিসেম্বর দিনভরও তাড়না ছিল যেকোনোভাবে যাবো লাবণ্যর বিয়েতে। ৪ ডিসেম্বর রাতে ফোন করে এক জুনিয়র সাংবাদিক আনিস খান; বলল; ‘ভাই কাল সকালে চলেন একটু মাওয়া যাবো; আপনি গেলে আমার উপকার হয়।’ ‘বাসা থেকে বের হওয়ার মতো টাকা-পয়সা পকেটে নেই’-শুনে বললেন, ‘সমস্যা নাই; আমি নিয়ে যাবো আপনাকে।’

সারাদিন কাটলো তার সাথে। বেকারত্বের সাথে যোগ হয়েছে হাঁটু ব্যথা; যার কারণ নাকি ‘ওভার ওয়েট’! তাই ডাক্তারি পরামর্শে ভাত-শর্করা জাতীয় খাবার খাওয়া বন্ধ প্রায় একমাস। মাওয়াতে আনিস যার কাছে নিয়ে গেল; সে বড় ধুরন্দর! কীভাবে যেন বুঝে গেছে আমরা যাবো তার বাড়ি; আগেই সটকে পড়েছে। ভরদুপুরে গিয়ে পেলাম তার বাবাকে খাবার টেবিলে। বেচারি বিব্রত; বললেন, ‘ছেলের পাওনাদারদের কাছে মানসম্মান যাচ্ছে বাবা; তারপরও তোমরা যখন চলে আসছো খাবার সুময়, চাট্টি ভাত খাও।’ ‘না চাচা আমরা এখন খাবো না; পাওনা টাকাটার ব্যাপারে কী করবেন একটু ভেবে বলেন।’ -আনিস বলল। আর আমি ভাবছি; ভাততো চাইলেও খেতে পারব না। ‘ডাক্তারি নিষেধাজ্ঞা’ না মানলে কপালে শনি আছে।

আমাদের সামনেই ফোনালাপে বাবা-ছেলের তুমুল তর্ক হলো। ওপাশের ছেলেকে দেখতে না পেলেও এপাশে বাবার কথা ও মুখভঙ্গি জানান দিচ্ছিল ‘কথার রণে ভঙ্গ’ দিতে কেউ-ই রাজি নন। যখন ফোন রাখলেন; আমরা দেখলাম ‘ক্লান্ত-পরাজিত’ এক বাবাকে।একটু থেমে কিছুটা জিরিয়ে নিয়ে তিনিবললেন, ‘রাত ১০টার মধ্যে অন্তত ১০ হাজার টাকা বিকাশে পাঠানোর ব্যবস্থা করবো। আপনি বিকাশ নম্বরটা দিয়ে যান।’ এমন কথা শুনে আনিস বেশ খুশি।

বেলা ৩টা সাড়ে ৩টার দিকে মাওয়া থেকে ঢাকার পথে রওনা দিলাম আমরা। পথে খোশমেজাজি আনিসের সাথে সুর মেলাতে পারছিলাম না। আমার ভাবনায় লাবণ্যর বিয়ে; আরও একটি ভাবনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছিল। সেটা হলো-আমার আরেক বন্ধু হরিহর আত্মা মহিউদ্দিন শামীমের বাবা; যিনি আমাকে সন্তানের মতো ¯েœহ-ভালোবাসায় সবসময় আগলে রাখেন; তার অসুস্থতা। বয়স ও পারকিনসন রোগের জটিলতায় মাস ছয়েক তিনি কুষ্টিয়া শহরে বিছানাগত। মাস তিনেক আগে একবার সুযোগ হয়েছিল; দেখে এসেছি। তখন কথাবার্তা বলতে পারছিলেন; আর এখন সদর হাসপাতালে আইসিইউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন। যেকোনোভাবে অন্তত হাজার পাঁচেক টাকার ব্যবস্থা হলে সটান চলে যাবো-কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে। চাচাজানকে শেষ দেখাটা অন্তত দেখতে পারব। কত কথা মনে পড়ছে-ঠোটার পাড়ার অজপাড়া গায়ের প্রাইমারি স্কুলে পড়ে; উপজেলার সেরা বিদ্যাপীঠের একটি মথুরাপুর হাই স্কুলে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হয়ে বন্ধু হিসেবে পেলাম শামীমকে। তারপর রাত নেই; দিন নেই-হাইস্কুল-কলেজ মিলিয়ে আমরা একসাথে কাটিয়েছি অন্তত ১০ বছর। পারিবারিক সম্পর্কে একে অপরের পরিপূরক; বন্ধনও তেমনই। তার ছোট দুইবোন শেফালী-শিল্পীর সাথে হৃদ্যতা নিজের বোনের মতো। বাবা-মাকেও কখনো ভিন্ন কেউ মনে হয়নি।

ইদানিং নিজেকে অপরাধী মনে হয়-এমন বন্ধনে থেকেও শামীমের দুঃসময়ে তার পাশে দাঁড়াতে পারছি না; ফোনেও বেশি কথা বলার সাহস পায় না। কেমন যেন নিজেকে লুকিয়ে লুকিয়ে রাখি; মনে হয় এভাবে হয়তো আর্থিক অনটনটাকেও লুকিয়ে রাখা যাবে। হাইস্কুলের পাশে বাড়ি হওয়ায় টিফিন পিরিয়ডে হাফ প্যান্টের দু-পকেট ভরে মুড়ি নিয়ে আসছে শামীম; দু-জনে মিলে দেবদারু তলায় বসে-দাঁড়িয়ে সে মুড়ি খাচ্ছি কিংবা কারো সাথে দুষ্টুমি করে এসে আমার পেছনে আড়াল খুঁজছে বন্ধুটি। ‘মারমুখী প্রতিপক্ষ’ বন্ধুটি আমার কারণে কাছে ঘেঁষছে না শামীমের। স্কুলের পুকুরের মাছ ধরা হয়েছে; আমতলায় ওজন চলছে। গোল হয়ে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই রুই-কাতলের লাফালাফি দেখছি; বেখেয়ালে পাশে দাঁড়ানো জেকের স্যারের ঘাড়ে ‘আমি ভেবে’ আয়েশে হাত রেখেছে শামীম। লম্বায় খাটো জেকের স্যার ‘কে রে’ বলার সাথে সাথে ভো দৌড়। আমিও দৌড়াচ্ছি শামীমের সাথে। স্মৃতির আয়নায় দৌড়ে আসছে অসংখ্য দিনলিপি।

আমার ভাবনা দৌড়াচ্ছে- ৫ ডিসেম্বর রাতে হলেও কুষ্টিয়া যাবো; চাচাজানকে হাসপাতালে দেখে ৬ ডিসেম্বর দুপুরে ভেড়ামারায় লাবণ্যর বিয়েতে ঢুঁ মারবো, দেখা হবে পুরনো অনেকের সাথে নতুন চেহারায়। হয়তো কাউকে কেউ চিনবো না; অন্যরা চিনিয়ে দেবে! এই তো মাত্র দিন তিনেক আগে কাজলের সাথে আরেকবার দেখা হয়েছিল; ঢাকা থেকে প্রাইভেট কার ভাড়ার বিষয়ে চেনাজানাদের মধ্য থেকে কাউকে ম্যানেজ করতে বলেছিল সে। তাই বাধ্য হয়েই কাঁটাবনে মনজুরুলের রাইয়্যান প্রিন্টার্সে পূর্ব রাজাবাজার থেকে হেঁটে হেঁটে যাওয়া। তা না হলে ওইদিনও বাসা থেকে হয়তো বেরুনো হতো না রসদের অভাবে। তবে ভালো লাগল; যখন প্রাইভেট কার চূড়ান্ত করে দিতে পারলাম; মনে হলো-বিয়েতে তো অর্ধেক চলেই গেলাম। বাকিটাও যাবো যেকোনোভাবে।

এসব ভাবনার মধ্যেই আনিস বলে উঠল, ‘ভাই রাতে টাকা পেয়েই আপনাকে জানাবো।’ আরও অনেক কথা-ই হয়তো বলল আনিস। কিছু আমার কানে গেল; কিছু বাতাসে ভেসে গেল! বাসার গেটের কাছে রিকশা থেকে নামার সময় বলল; ‘এই একশ টাকা রাখেন।’ খালি পকেটের কথা ভেবে নিলাম ওই টাকাটাও। মনে মনে তখনও প্রত্যাশা রাত ১০টায় ১০ হাজার টাকা আনিস বিকাশে পেলে অন্তত তাকে বলে হাজার পাঁচেক ধার নেবো। এরপর কাটাকাটা হলেও কুষ্টিয়ার পথে বাস ধরবো। বাসায় ফিরে ঠিক দশটায় মেসেজ পেলাম; ‘ভাই মাওয়া থেকে ১০ হাজার টাকা পাঠিয়েছে।’ সামনাসামনি যা বলা যায় না, ফোনে-মেসেজে তা বলা যায় অতি সহজে; ‘আমার অবস্থা তো জানেন, ৫ হাজার টাকা বিকাশ করেন, খুব দ্রুতই ব্যবস্থা হলে ফেরত পেয়ে যাবেন।’-এমন মেসেজের সাথে বিকাশ নম্বরটাও লিখে দিলাম; যেটা আনিস আগে থেকেই জানে। প্রত্যাশার পারদ সটান ভূপাতিত হতে সময় লাগল না;খুব অল্প সময়েই নানা অজুহাত দেখিয়ে শেষ পর্যন্ত ‘না’ করে দিলেন আনিস। টাকাটা পাওয়া হলো না। রণে ভঙ্গ দিলাম; মায়ের বিয়ে খেয়েছি বলে মেয়েরটাও খেতে হবে এমনতো কোনো কথা নাই।

৬ ডিসেম্বর দুপুরে লাবণ্যর বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার খবর মোবাইল ফোনে বাসায় এলো। লাবণ্যর প্রাথমিকের শিক্ষক আমার বড় আপা জানাল; ‘অনেক দিন পর কাজলের সাথে দেখা হলো; বেশ মুটিয়ে গেছে!’

দুপুর গড়িয়ে বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা এলো-আজকের আধার চারপাশকে যেন ভিন্ন কোনো বার্তা দিতে উদগ্রীব। রাতে ঘুমানোর আগে হাত গেল মোবাইলে। কোনো মেসেজ কিংবা গুরুত্বপূর্ণ কিছু মিস হলো কিনা দেখার নিয়মিত অভ্যাস। ফেসবুক নোটিফিকেশন মহিউদ্দিন শামীমের। বুকটা ছ্যাত করে উঠল; ‘চাচাজানের কিছু হলো?’ ‘বাবা, বাবা গো পুরোপুরি এতিম করে কোথায় হারিয়ে গেলে...।’-রাত ৯টা ৪৭ মিনিটে শামীমের ফেসবুক স্ট্যাটাস! চোখ ফেটে পানি বেরুনোর প্রাক্কালে সাড়ে তিন বছরের মেয়ে তাওহীদা জুন অজ্ঞাত কারণে গলা ফাটিয়ে কান্না জুড়েছে মশারির ভেতর। একটু দূরেই মোবাইল হাতে আমি। ধাতস্থ হলাম, জুনকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে রীতা আমাকে ডাকল। সারাদিন মায়ের প্রযত্নে থাকলেও রাতে মেয়েটি আমার ন্যাওটা হয়ে যায়। আমিও ঢুকলাম মশারির ভেতরে। মেয়েকে ঘুম পাড়াতে বুকের ওপর উপুড় করে শুইয়ে পিঠে হালকা থাবা দিতে দিতে চোখের কোণটা মুছলাম; এরপর মেয়ের সাথে নিজেও ঘুমিয়ে পড়লাম কিংবা ঘুমিয়ে পড়ার ভান করলাম!

back to top