alt

সাময়িকী

মিত্র

শাহীন কামাল
অনুবাদ হাইকেল হাশমী

: বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বিয়ের পরে আমাদের অলিখিত একটি নিয়ম ছিল মাসের যে কোনো এক রবিবারে আমরা রাতের খাবার বাইরে খাবো। সন্তান আসার পরে মাঝে তাদের শরীর খারাপ থাকার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে এই নিয়মের ব্যাঘাত ঘটেছে কিন্তু আমাদের চেষ্টা থেকেছে নিয়মটা যেন চালু থাকে। হোটেল বাছাই পকেটের অবস্থার উপর নির্ভর করতো। তাই জীবনের ঊর্ধ্বগামী অবস্থা আর অধোগামী অবস্থা বুঝে অভিজাত হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ হোটেলে খেয়েছি। কিন্তু আমাদের নিয়ম অটুট থেকেছে।

এখন তো আমাদের নীড়ের সব পাখিরা নতুন দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য নীড় ছেড়ে উড়ে গেছে, পিছনে রয়ে গেছি আমরা দুইজন আর আমাদের একটি বিড়াল। রাব্বানির অবসরের কাগজগুলোও জীর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু আমাদের সম্পর্ক সতেজ রয়েছে। আজ মাসের দ্বিতীয় রবিবার আর পকেটে পেনশানের নতুন টাকা আছে কিন্তু জীবন যাপনের খরচ এত বেড়ে গেছে যে আমরা শহরে অবাঞ্ছিত একটি মাঝারি ধরনের হোটেল বেছে নিয়েছি ডিনারের জন্য। আমি রাব্বানির অনুরোধে খুব যতœ সহকারে রাখা সোনালি বর্ডারের নীল শাড়ি পরলাম। রাব্বানির নিভু চোখের উজ্জ্বল আলো দেখে আমার আবার বিশ্বাস হলো যে এখনো আমি তার চোখে মধুবালাই আছি। বিয়ের পর থেকে রাব্বানি আমাকে মধু নামেই ডাকে। এখন লোকজন যখন আমাকে আমার নিজের নাম রাহাত বলে ডাকে তখন আমার ভালো লাগে না।

আমিও না কি বলতে শুরু করে দেই। হ্যাঁ বলতে ভুলে গেলাম এখন ডায়াবেটিসের সাথে আমার আর একটি রোগ নির্ণয় হয়েছে যাকে একটি অদ্ভুত নামে ডাকা হয় ডিমেনশিয়া, এখন তোমরা বলো এটা কোনো নাম হলো? এই সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সে মানুষ তো এমনি অনেক কিছু ভুলে যায়। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো এই রোগটা আল্লাহর অনেক বড় কৃপা। আমি তো এখন দিনের হিসাবও মনে রাখতে পারি না তাই বাচ্চারা কত দিন ধরে ফোন করেনি তা মনে পড়ে না। যখনই রাব্বানিকে বলি যে,“বাচ্চাদের অনেক দিন ধরে কোনো ফোন আসেনি”। তখন সে অনেক আদরের সাথে উত্তর দেয়, “কি বলো মধু, গতসপ্তাহে তো জামিলের ফোন এসেছিল। আর দশ দিন আগে সামিরা একটি লম্বা চিঠি লিখেছিল আর বাচ্চাদের নতুন ছবিও পাঠিয়েছে”। আল্লাহরশুকরিয়া এখন আমার জীবন থেকে অপেক্ষা নামের জিনিসটি বিদায় নিয়েছে। আমি তো ভুলে যাওয়াকে প্রভুর একটি আশীর্বাদ মনে করি। দেখো আমি আবার আমার কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি সোনালি বর্ডারের নীল শাড়ি পরে আমার মনের মিত্রের সাথে আগে থেকে ঠিক করা হোটেলে গেলাম। করাচীর সন্ধ্যা এমনিতেই যাদুর মতো হয় তার উপর রাব্বানির সঙ্গ, আমার স্বর্গ তো মাটিতেই পেয়ে গেছি। আজও সে ভেস্পা চালানোর আগে নিজে সন্তুষ্ট হয়ে নেয় যে, আমি ভালোভাবে ভেস্পায় বসেছি। আমার জন্য হোটেলের দরজা টেনে ধরে রাখে, বসার জন্য চেয়ারটা টেনে দেয়। সভ্যতার অপর নাম আমার মিত্রের। তার অভ্যাসের মতো আজও খাবারের মেন্যু আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবে বলো?”

“তুমি পড় রাব্বানি আমি তো চশমা বাসায় ভুলে রেখে এসেছি”, আমি পার্স হাতড়াতে বললাম।

রাব্বানি তার নাকের ডগায়, ট্যারা মোটা চশমা এঁটে মেন্যু পড়তে লাগলো।

“কতবার বলেছি মিত্র যে তোমার চশমাটা বদলাও কিন্তু তুমি সব সময় আগামী পেনশেনের কথা বলে পিছিয়ে দাও”, আমি একটু রেগে বললাম।

“কোথায় ট্যারা, একটু বেঁকে গেছে। ঠিক আছে কাল আমি এটা কামাল অপটিক্সে দিয়ে আসবো মেরামত করার জন্য, এখন তো খুশি?”

“রাব্বানি, আজ মাটন কড়াই খেতে ইচ্ছে করছে যেন মাংসটা খুব নরম হয়, এখন তো মুখে কয়েকটা দাঁতই অবশিষ্ট আছে”।

“কড়াই?” রাব্বানির চিন্তিত প্রশ্ন আমি বুঝতে পেরেছি।

“না থাক মিত্তু। আমি কি এখন আর চিবুতে পারবো এই মাংস? আর আজ আমার বাম চোয়ালের শেষ দাঁতে একটু ব্যাথাও আছে”।

“ঠিক আছে থাক, আগামী মাসে আমাদের বিয়ের ঊনচল্লিশ বার্ষিকী আছে। ইনশাল্লাহ ওই দিন এই বিলাসিতাটা করে নিব”।

জানি না বিবাহবার্ষিকীর আর কত দিন বাকি আছে অথবা দিনটা এসে চলেও গেছে? কে বলবে আমাকে? রাব্বানি কখন গেল?

দেখো আমি সব কিছু এলোমেলো করে দেই। আমার তো মনেও পড়ছে না রাব্বানি কত দিন ধরে আমার সাথে নেই কিন্তু যখন থেকে আমার মিত্র গেছে আমার মনের দুনিয়াটা মরুভূমি হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীটা নির্জন হয়ে গেছে আর বাসাতেও ভয়ঙ্কর নীরবতা ঘর বেঁধেছে। পাখিগুলো তো আর আমার বাসার উঠানে আসে না, তারা কেন রাস্তা ভুলে গেছে? তাদেরও কি ডিমেনশিয়া হয়েছে? আমি কখন থেকে সন্ধ্যার ঝাপসা আলোতে রাব্বানির ট্যারা চশমা হাতে নিয়ে চিন্তা করছি।

“কেউ কি আমায় বলবে রাব্বানি কখন চলে গেল?”

লেখক পরিচিতি:

শাহীন কামাল একজন উর্দু গল্পকার। তার জন্ম ঢাকায় কিন্তু তিনি অল্প বয়সে তার মা-বাবার সাথে করাচী চলে গিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ক্যালগেরি, কানাডায় বসবাস করছেন।

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

মননশস্যের অমৃত মন্থন

ছবি

অনুবাদ ও ভূমিকা : আলী সিদ্দিকী

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বড়শি

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

এ মুখর বরষায়

ছবি

রক্তে লেখা প্রেম: রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর বিপ্লব

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

শঙ্খজীবন: যাপিত জীবনের অন্তর্গূঢ় প্রতিকথা

ছবি

ওসামা অ্যালোমার এক ঝুড়ি খুদে গল্প

ছবি

প্রযুক্তির আলোয় বিশ্বব্যাপী বইবাণিজ্য

সাময়িকী কবিতা

ছবি

ব্রেশায় উড়োজাহাজ

ছবি

কাফকার কাছে আমাদের ঋণ স্বীকার

ছবি

কাফকাকে পড়া, কাফকাকে পড়ানো

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

সূর্যের দেশ

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

লড়াই

সাময়িকী কবিতা

ছবি

প্রচলিত সাহিত্যধারার মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিলেন মধুসূদন

ছবি

মেধাসম্পদের ছন্দে মাতুন

ছবি

উত্তর-মানবতাবাদ ও শিল্প-সাহিত্যে তার প্রভাব

ছবি

আমজাদ হোসেনের ‘ভিন্ন ভাষার কবিতা’

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি: একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

দুই ঋতপার কিসসা এবং এক ন্যাকা চৈতন্য

ছবি

অন্যজীবন অন্যআগুন ছোঁয়া

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কবিজীবন, দর্শন ও কাব্যসন্ধান

ছবি

অসামান্য গদ্যশৈলীর রূপকার

ছবি

পিয়াস মজিদের ‘রূপকথার রাস্তাঘাট’

ছবি

নজরুলের নিবেদিত কবিতা : অর্ঘ্যরে শিল্পরূপ

ছবি

বাঘাডাঙা গাঁও

ছবি

বুদ্ধদেব বসুর ‘তপস্বী ও তরঙ্গিণী’ বিষয়ভাবনা

tab

সাময়িকী

মিত্র

শাহীন কামাল
অনুবাদ হাইকেল হাশমী

বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫

বিয়ের পরে আমাদের অলিখিত একটি নিয়ম ছিল মাসের যে কোনো এক রবিবারে আমরা রাতের খাবার বাইরে খাবো। সন্তান আসার পরে মাঝে তাদের শরীর খারাপ থাকার কারণে অথবা অন্য কোনো কারণে এই নিয়মের ব্যাঘাত ঘটেছে কিন্তু আমাদের চেষ্টা থেকেছে নিয়মটা যেন চালু থাকে। হোটেল বাছাই পকেটের অবস্থার উপর নির্ভর করতো। তাই জীবনের ঊর্ধ্বগামী অবস্থা আর অধোগামী অবস্থা বুঝে অভিজাত হোটেল থেকে শুরু করে সাধারণ হোটেলে খেয়েছি। কিন্তু আমাদের নিয়ম অটুট থেকেছে।

এখন তো আমাদের নীড়ের সব পাখিরা নতুন দূরত্ব অতিক্রম করার জন্য নীড় ছেড়ে উড়ে গেছে, পিছনে রয়ে গেছি আমরা দুইজন আর আমাদের একটি বিড়াল। রাব্বানির অবসরের কাগজগুলোও জীর্ণ হয়ে গেছে কিন্তু আমাদের সম্পর্ক সতেজ রয়েছে। আজ মাসের দ্বিতীয় রবিবার আর পকেটে পেনশানের নতুন টাকা আছে কিন্তু জীবন যাপনের খরচ এত বেড়ে গেছে যে আমরা শহরে অবাঞ্ছিত একটি মাঝারি ধরনের হোটেল বেছে নিয়েছি ডিনারের জন্য। আমি রাব্বানির অনুরোধে খুব যতœ সহকারে রাখা সোনালি বর্ডারের নীল শাড়ি পরলাম। রাব্বানির নিভু চোখের উজ্জ্বল আলো দেখে আমার আবার বিশ্বাস হলো যে এখনো আমি তার চোখে মধুবালাই আছি। বিয়ের পর থেকে রাব্বানি আমাকে মধু নামেই ডাকে। এখন লোকজন যখন আমাকে আমার নিজের নাম রাহাত বলে ডাকে তখন আমার ভালো লাগে না।

আমিও না কি বলতে শুরু করে দেই। হ্যাঁ বলতে ভুলে গেলাম এখন ডায়াবেটিসের সাথে আমার আর একটি রোগ নির্ণয় হয়েছে যাকে একটি অদ্ভুত নামে ডাকা হয় ডিমেনশিয়া, এখন তোমরা বলো এটা কোনো নাম হলো? এই সত্তর বাহাত্তর বছর বয়সে মানুষ তো এমনি অনেক কিছু ভুলে যায়। কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করলে আমি বলবো এই রোগটা আল্লাহর অনেক বড় কৃপা। আমি তো এখন দিনের হিসাবও মনে রাখতে পারি না তাই বাচ্চারা কত দিন ধরে ফোন করেনি তা মনে পড়ে না। যখনই রাব্বানিকে বলি যে,“বাচ্চাদের অনেক দিন ধরে কোনো ফোন আসেনি”। তখন সে অনেক আদরের সাথে উত্তর দেয়, “কি বলো মধু, গতসপ্তাহে তো জামিলের ফোন এসেছিল। আর দশ দিন আগে সামিরা একটি লম্বা চিঠি লিখেছিল আর বাচ্চাদের নতুন ছবিও পাঠিয়েছে”। আল্লাহরশুকরিয়া এখন আমার জীবন থেকে অপেক্ষা নামের জিনিসটি বিদায় নিয়েছে। আমি তো ভুলে যাওয়াকে প্রভুর একটি আশীর্বাদ মনে করি। দেখো আমি আবার আমার কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি। আমি সোনালি বর্ডারের নীল শাড়ি পরে আমার মনের মিত্রের সাথে আগে থেকে ঠিক করা হোটেলে গেলাম। করাচীর সন্ধ্যা এমনিতেই যাদুর মতো হয় তার উপর রাব্বানির সঙ্গ, আমার স্বর্গ তো মাটিতেই পেয়ে গেছি। আজও সে ভেস্পা চালানোর আগে নিজে সন্তুষ্ট হয়ে নেয় যে, আমি ভালোভাবে ভেস্পায় বসেছি। আমার জন্য হোটেলের দরজা টেনে ধরে রাখে, বসার জন্য চেয়ারটা টেনে দেয়। সভ্যতার অপর নাম আমার মিত্রের। তার অভ্যাসের মতো আজও খাবারের মেন্যু আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “কী খাবে বলো?”

“তুমি পড় রাব্বানি আমি তো চশমা বাসায় ভুলে রেখে এসেছি”, আমি পার্স হাতড়াতে বললাম।

রাব্বানি তার নাকের ডগায়, ট্যারা মোটা চশমা এঁটে মেন্যু পড়তে লাগলো।

“কতবার বলেছি মিত্র যে তোমার চশমাটা বদলাও কিন্তু তুমি সব সময় আগামী পেনশেনের কথা বলে পিছিয়ে দাও”, আমি একটু রেগে বললাম।

“কোথায় ট্যারা, একটু বেঁকে গেছে। ঠিক আছে কাল আমি এটা কামাল অপটিক্সে দিয়ে আসবো মেরামত করার জন্য, এখন তো খুশি?”

“রাব্বানি, আজ মাটন কড়াই খেতে ইচ্ছে করছে যেন মাংসটা খুব নরম হয়, এখন তো মুখে কয়েকটা দাঁতই অবশিষ্ট আছে”।

“কড়াই?” রাব্বানির চিন্তিত প্রশ্ন আমি বুঝতে পেরেছি।

“না থাক মিত্তু। আমি কি এখন আর চিবুতে পারবো এই মাংস? আর আজ আমার বাম চোয়ালের শেষ দাঁতে একটু ব্যাথাও আছে”।

“ঠিক আছে থাক, আগামী মাসে আমাদের বিয়ের ঊনচল্লিশ বার্ষিকী আছে। ইনশাল্লাহ ওই দিন এই বিলাসিতাটা করে নিব”।

জানি না বিবাহবার্ষিকীর আর কত দিন বাকি আছে অথবা দিনটা এসে চলেও গেছে? কে বলবে আমাকে? রাব্বানি কখন গেল?

দেখো আমি সব কিছু এলোমেলো করে দেই। আমার তো মনেও পড়ছে না রাব্বানি কত দিন ধরে আমার সাথে নেই কিন্তু যখন থেকে আমার মিত্র গেছে আমার মনের দুনিয়াটা মরুভূমি হয়ে গেছে। সারা পৃথিবীটা নির্জন হয়ে গেছে আর বাসাতেও ভয়ঙ্কর নীরবতা ঘর বেঁধেছে। পাখিগুলো তো আর আমার বাসার উঠানে আসে না, তারা কেন রাস্তা ভুলে গেছে? তাদেরও কি ডিমেনশিয়া হয়েছে? আমি কখন থেকে সন্ধ্যার ঝাপসা আলোতে রাব্বানির ট্যারা চশমা হাতে নিয়ে চিন্তা করছি।

“কেউ কি আমায় বলবে রাব্বানি কখন চলে গেল?”

লেখক পরিচিতি:

শাহীন কামাল একজন উর্দু গল্পকার। তার জন্ম ঢাকায় কিন্তু তিনি অল্প বয়সে তার মা-বাবার সাথে করাচী চলে গিয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ক্যালগেরি, কানাডায় বসবাস করছেন।

back to top