শেলী সেনগুপ্তা
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
রোহান আজ দু’মেয়েকে নিয়েশিশু পার্কে বেড়াতে এসেছে। ওদের পরীক্ষা শেষ, খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছে, তাই আবদার করেছে শিশু পার্কে যাবে। ওদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রোহান আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। আজ ওরা বাইরে খাবে। অফিসের কাজের চাপে ওদের সময় দিতে পারেনা।
এশা আর অন্বেষা রেলগাড়িতে চড়ে বসেছে। রোহান দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেয়েদের হাসি হাসি মুখ দেখতে খুব ভাল লাগছে।ভাবছে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে ওদের নিয়ে বেড়াতে বের হবে। ওদের সময় দেবে। মেয়ে দুটো বড় লক্ষ্মী। বাবার বড়ো নেওটা।
একে একে সবক’টা রাইড চড়া শেষ, মেয়ে দুটোও ক্লান্ত এখন বাড়ি ফিরবে। বের হওয়ার সময় গেটের কাছে পিঠে বিক্রি হচ্ছে। ছোট মেয়েটা খুব চঞ্চল। একছুটে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। সে পিঠে খাবে। ওর দেখাদেখি বড়টাও। রোহান ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। বড় মেয়ে ডেকে বলে-
- আন্টি, আমাদের ভাপা পিঠে দেন।
- খাড়াও, দিতাছি- বলেই পিঠেওয়ালি মুখ তুললো। দ্রুততার সাথে পিঠে বানাচ্ছে। ছোট্ট বাটিতে চালের গুঁড়ো নিলো, তার উপরে নারিকেল আর গুড় দিয়ে আবার চালের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে কাপড়ের মধ্যে নিয়ে ছিদ্রওয়ালা হাঁড়ির মধ্যে উপুড় করে দিলো। কেরোসিন চুলার গনগনে আগুনের আলোতে দেখা যাচ্ছে ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে, সারা অবয়বে একটা কাঠিন্যের ভাব। মাথার সব চুল একসাথে জড়ো করে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। পরনে বেগুনী রঙের শাড়ি, আঁচলটা কোমরে জড়ানো।চমকে উঠলো রোহান। আরে, এতো বকুলী। মিরপুর বেনারশি পল্লীর বকুলী। রোহান নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো। তার আগেই বকুলীর সাথে কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেলো। ওর দৃষ্টিতে চেনার কোনো লক্ষণই নেই। রোহান নিজের টাকে হাত বুলিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস আগের মতো একমাথা কোঁকড়ানো চুলে নেই। মেয়ের হাতে টাকা দিয়ে একপা দু’পা করে পিছু হটে সোজা গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাহিজা মেয়েদের নিয়ে আসুক। অনেকদিন পর বকুলীকে দেখে থমকে গেলো রোহান। বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
২.
রোহান বেশ কয়েক বছর আগে বাংলায় এমএ পাস করে বসে আছে। এখনও চাকরি-বাকরি জোটাতে পারেনি। আজকাল তা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়, মাঝে মাঝে রেডিওতে ফিচার পড়ে, লেখালেখিকরে সামান্য দক্ষিণা পায়। তাতে চলে যায়। মেস ভাড়াটা হয়ে গেলে খুব একটা ভাবে না, খাওয়াটা কেমন কেমন করে যেন হয়ে যায়। ছোটবেলায় পড়াশোনা না করলে বাবা খুব বকতো, সে তখন দাদির পানের গন্ধমাখা আঁচলের নিচে আশ্রয় নিতো। দাদি তাকে অভয় দিতো আর বাবার উদ্দেশ্যে বলতো, ‘ছওলডারে আর বকিস না বাপ, মুখ দিছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি’। বাবার বকুনী একসময় গজগজানিতে পরিণত হতো, আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতো। বাবার ভাগ্য নিয়ে রোহান খুব একটা ভাবে না, কিন্তু নিজের খাদ্য-ভাগ্য যে খুব ভালো তা বুঝতে পারে। কারণে অকারণে সময়মতো ও খাদ্যের কাছে পৌঁছে যায় অথবা খাদ্য ওর কাছে। এইতো সেদিন মেসভাড়া যোগাড় করে বাড়িওয়ালার হাতে দিয়ে ফিরে আসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শোনা গেলো। আবার ছুটে গিয়ে দেখে বাড়িওয়ালা বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, বাড়িওয়ালি আর ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। বাড়িওয়ালি ওকে পেয়ে যেন স্বর্গ হাতে পেলো। বাবা, সোনা ডেকে সাহায্য চাইলো। ও দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সেখানে এক ডাক্তারবন্ধু ছিলো, খুব সহযোগিতা করেছে, ওর মাধ্যমে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে কেবিনে ভর্তি করলো।তারপর আরও তিনদিন সেখানে ছিলেন তিনি। অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন। সেদিন থেকে রোহান যেন ওঁদের কাছে দেবদূত। সপ্তাহে বেশ কয়েকবেলা ওঁদের সাথে রাতের খাবার খেতে হয়। তাছাড়া ভালো রান্না হলেই বাড়িওয়ালি ওকে ডেকে নিয়ে খেতে দেয়। প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো। আজকাল মনে হয় এটা যেন ওর অধিকার। এখন খেতে ডাকলে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যায়।
রোহান সারাদিন পরে মেসে ফিরে এলো। বেশ কয়েকটা পত্রিকাতে কথা হলো, এখন লেখার প্রস্তুতি নিতে হবে। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে রান্নার সুবাস ভেসে আসছে, বেশ সুন্দর। বোঝা যাচ্ছে বিরানি রান্না হচ্ছে। ওর খুব পছন্দের খাবার। চোখ বন্ধ করে গন্ধটা বুকের মধ্যে টেনে নিলো। বুঝতে পারেনি পাশের বিছানার আসগর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ জ্বলুনীধরা কণ্ঠে বললো, ‘নাক টানো ক্যান, একটু পরেই তো ডাক আইবো, জামাই আদরে খাওয়াইবো’। আসগরের দিকে তাকিয়ে কঠিন কিছু বলতে যাবে, এমন সময় বাড়িওয়ালার চাকর দরজার কাছে এসে একগাল হাসি দিলো। রোহানের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। কড়া করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে, হাসছিস কেন?’ একইভাবে হেসে জবাব দিলো‘আপনেরে বোলাইছে আম্মাহুজুর’। সে মাথা নিচু করে ফেললো। কিছুক্ষণ পরে বলে, ‘যা, আমি আসছি’। ‘আম্মাহুজুর লগে কইরা লইয়া যাইতে হুকুম দিছে’। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রোহান ওর সাথে চলে গেলো। পেছনে আসগরের খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেলো।
ওরা সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে ওর জন্য। বাড়িওয়ালি দ্রুত ধোঁয়াওঠা বিরানি পরিবেশন করলো। চমৎকার দেখতে হয়েছে। হাত ধুয়ে খেতে বসার তর সইছে না ওর। চমৎকার খেতে হয়েছে। গরম বিরানি অনেকটা মুখের মধ্যে পুরে নিতেই বিষম খেলো। গরমে জিভ পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে বকুলী দ্রুত একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। ওর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু শেষ করে হাঁফাচ্ছে। বকুলী একটা হাত পাখা এনে বাতাস করতে শুরু করলো। সেদিন খুব লজ্জা লাগলেও প্রচুর বিরানী খেলেও, আবার ভালোও লাগছিলো বকুলীর সেবা পেতে।
সেদিন থেকে বকুলী যেন অলিখিতভাবে ওর দায়িত্ব নিয়ে নিলো। সকাল বিকাল ওর খোঁজখবর নেয়া, ওর ওপর খবরদারি করা শুরু করলো। মাঝে মাঝে বেশ ভালোই লাগছিলো। নিজেকে সুখি সুখি ভাবতে ভালই লাগছে। এর মধ্যে চলছে ওর মজার মজার খাওয়া-দাওয়া।
বকুলী ওর কাছে আসতে চায় সবসময়। দুপুরে ঘুমালে জানালা দিয়ে ফুল ছুঁড়ে দৌড়ে পালাতো। ও জেগে দরজায় দাঁড়ালে বকুলী চৌকাটের পাশ থেকে গল্প করতো। ওর মুখ থেকে ঢাকাইয়া ভাষা শুনতে ভাল লাগতো।
একদিন বাড়িওয়ালা ওকে ডেকে পাশে বসালো, তারপর ওর হাত ধরে অনুরোধ করলো বকুলীর দায়িত্ব নেয়ার জন্য। সেদিনই রোহানের টনক নড়লো। এতো দিন যে সম্পর্কটাকে সে মজা হিসেবে নিয়েছিলো সেটা আর মজা রইলো না। ওর কাঁধে দায়িত্ব হিসেবে উঠে বসতে চাইছে। বাড়িওয়ালার কাছে ভাবার সময় চেয়ে নিয়ে চলে এলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে বকুলী ওদের কথা শুনছিলো, ও সময় চাইতেই পর্দা সরিয়ে অপলক তাকিয়েছিলো। সে চাউনিতে কী ছিলো সে জানে না, নিজের অজান্তেই ঘেমে নেয়ে উঠেছিলো।
রুমে ফিরে এসে চুপ করে নিজের বিছানায় বসে আছে, মুখটা কাগজের মতো সাদা। ভাবছে কী জবাব দেবে বাবাকে, যদি প্রশ্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে কেন সে ফাইভ পর্যন্তও না পড়া একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে। সব বন্ধুরা যখন শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করবে তখন সে ঢাকাইয়া দস্যি ও অসংস্কৃত একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করবে। ভাবতেই পারছে না, এতো দিনের আনন্দ যে ওর জীবনে বুমেরাং হয়ে আসবে তা সে ভাবতেও পারে নি।
বেশ কিছুদিন খুব সকালে বের হয়ে যায় ফিরে আসে অনেক রাতে। যতটুকু সম্ভব ওদের এড়িয়ে চলে। ওদের সামনে পড়তে চায় না। ও যখন ফিরে আসে তখন বাড়িওয়ালার তিনতলার ঘর থেকে কারো ছায়া দেখতে পায়। মেসে বারান্দায় লম্বাভাবে পড়ে থাকা ছায়াটা যে বকুলীর তা কেউকে বলে দিতে হয় না।
সেভাবেই সবকিছু চলছিলো। প্রতি বৃহস্পতিবার মেসের সবাই বাড়ি চলে যায়। শুধু রোহান থাকে। তেমনি এক বৃহস্পতিবার রাতে ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকে পড়লো। অন্ধকার ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দরজার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকুলী। জানালা দিয়ে আসা রাস্তায় আলোতে ওকে ফণা তোলা সাপের মতো লাগছে। ফোঁস ফোঁস করছে করে নিশ্বাস ফেলছে। একপা একপা করে ওর দিকে এগোচ্ছে, রোহান পিছিয়ে যাচ্ছে। পিছোতে পিছোতে একেবারে নিজের চৌকির কাছে পৌঁছে গেলো। পাপোশে লেগে চিৎ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। বকুলীও ওর বুকের উপর শুয়ে হিস হিস করে বললো,
- এক্কেরে চোপ, আওয়াজ করলে কইয়া দিমু তুমি আমার ইজ্জত লুটছো, ছব্দ কইরবা না। কী ক্ষতি করছিলাম, আমারে লইয়া খেল্লা ক্যান, আমার নরম দিলডা লইয়া ফুটবল খেইচো? মাগর, আমি ভি তোমারে ছারমু না। কইলজাডা পোড়াইয়া দিয়া যামু।
- আমি কী করেছি?
- আমার লগে প্রেম প্রেম খেলছো, আমারে লাইলী বানাইছো, মাগার তুমি মিয়া মজনু অও নাইক্কা।
- আমি বুঝিনি তুমি লাইলী হয়েছো।
- এইবার হালায় তুমি বুজবা, আইজকা তোমার কইলজা পুইড়া দাগ দিয়া যামু।
বলেই রোহানের ঠোঁটদুটো নিজের মুখের মধ্যে সজোরে কামড়ে ধরলো। এতো জোরে যে মনে হচ্ছে দাঁত বসে যাচ্ছে। কামড় আরো বাড়লো, আরো। রোহানের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ব্যথায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা, চোখে জল এসে গেছে।
বকুলী ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে দম নিয়ে উঠে বসলো, তারপর দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। রোহানের জিভে নোনতা স্বাদ লাগলো, ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছে। হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে একটুকরো বিষণœ আলো।
পরদিন সকালে সবাই জানলো বকুলী পালিয়ে গেছে, ওদের বেনারসী কারখানার সামান্য একজন কর্মচারির সাথে। বকুলীর বাবা আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলো, এবার ওরা রোহানের সাহায্য নিলো না।
পরের মাসেই একটা পত্রিকা অফিসে সাব এডিটরের চাকরি পেয়ে মেস ছেড়ে দিলো রোহান। বাবা-মা’র পছন্দে বিয়ে করলো। বাসর ঘরে রাহিজা জানতে চেয়েছিলো ওর ঠোঁটের ওপরে কাটাদাগটা কী করে হলো?
রোহান নীরব ছিলো।
রাহিজা অনেক আবেগে ওকে চুমু খেতে এলে রোহান ওর মুখটা ভালো করে দেখে নেয়। সেই রাতে বকুলীর মুখটা এখনো ভুলতে পারে না।
এখনও অন্ধকার ঘরে রাস্তার আলো এসে পড়লে ওর বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বের হয়। নিজের অজান্তে বকুলী সত্যিই ওকে মজনু বানিয়ে দিয়ে গেছে।
শেলী সেনগুপ্তা
শিল্পী : সঞ্জয় দে রিপন
বৃহস্পতিবার, ০১ মে ২০২৫
রোহান আজ দু’মেয়েকে নিয়েশিশু পার্কে বেড়াতে এসেছে। ওদের পরীক্ষা শেষ, খুব ভাল পরীক্ষা দিয়েছে, তাই আবদার করেছে শিশু পার্কে যাবে। ওদের নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার জন্য রোহান আজ অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি এসেছে। আজ ওরা বাইরে খাবে। অফিসের কাজের চাপে ওদের সময় দিতে পারেনা।
এশা আর অন্বেষা রেলগাড়িতে চড়ে বসেছে। রোহান দূরে দাঁড়িয়ে দেখছে। মেয়েদের হাসি হাসি মুখ দেখতে খুব ভাল লাগছে।ভাবছে এখন থেকে প্রতি সপ্তাহে ওদের নিয়ে বেড়াতে বের হবে। ওদের সময় দেবে। মেয়ে দুটো বড় লক্ষ্মী। বাবার বড়ো নেওটা।
একে একে সবক’টা রাইড চড়া শেষ, মেয়ে দুটোও ক্লান্ত এখন বাড়ি ফিরবে। বের হওয়ার সময় গেটের কাছে পিঠে বিক্রি হচ্ছে। ছোট মেয়েটা খুব চঞ্চল। একছুটে সেখানে গিয়ে দাঁড়ালো। সে পিঠে খাবে। ওর দেখাদেখি বড়টাও। রোহান ওদের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। বড় মেয়ে ডেকে বলে-
- আন্টি, আমাদের ভাপা পিঠে দেন।
- খাড়াও, দিতাছি- বলেই পিঠেওয়ালি মুখ তুললো। দ্রুততার সাথে পিঠে বানাচ্ছে। ছোট্ট বাটিতে চালের গুঁড়ো নিলো, তার উপরে নারিকেল আর গুড় দিয়ে আবার চালের গুঁড়ো দিয়ে ঢেকে কাপড়ের মধ্যে নিয়ে ছিদ্রওয়ালা হাঁড়ির মধ্যে উপুড় করে দিলো। কেরোসিন চুলার গনগনে আগুনের আলোতে দেখা যাচ্ছে ওর মুখটা লাল হয়ে গেছে, সারা অবয়বে একটা কাঠিন্যের ভাব। মাথার সব চুল একসাথে জড়ো করে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। পরনে বেগুনী রঙের শাড়ি, আঁচলটা কোমরে জড়ানো।চমকে উঠলো রোহান। আরে, এতো বকুলী। মিরপুর বেনারশি পল্লীর বকুলী। রোহান নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো। তার আগেই বকুলীর সাথে কয়েকবার চোখাচোখি হয়ে গেলো। ওর দৃষ্টিতে চেনার কোনো লক্ষণই নেই। রোহান নিজের টাকে হাত বুলিয়ে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। ভাগ্যিস আগের মতো একমাথা কোঁকড়ানো চুলে নেই। মেয়ের হাতে টাকা দিয়ে একপা দু’পা করে পিছু হটে সোজা গাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাহিজা মেয়েদের নিয়ে আসুক। অনেকদিন পর বকুলীকে দেখে থমকে গেলো রোহান। বুকের মধ্যে রক্তক্ষরণ শুরু হলো।
২.
রোহান বেশ কয়েক বছর আগে বাংলায় এমএ পাস করে বসে আছে। এখনও চাকরি-বাকরি জোটাতে পারেনি। আজকাল তা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। একটা কোচিং সেন্টারে পড়ায়, মাঝে মাঝে রেডিওতে ফিচার পড়ে, লেখালেখিকরে সামান্য দক্ষিণা পায়। তাতে চলে যায়। মেস ভাড়াটা হয়ে গেলে খুব একটা ভাবে না, খাওয়াটা কেমন কেমন করে যেন হয়ে যায়। ছোটবেলায় পড়াশোনা না করলে বাবা খুব বকতো, সে তখন দাদির পানের গন্ধমাখা আঁচলের নিচে আশ্রয় নিতো। দাদি তাকে অভয় দিতো আর বাবার উদ্দেশ্যে বলতো, ‘ছওলডারে আর বকিস না বাপ, মুখ দিছেন যিনি, আহার দিবেন তিনি’। বাবার বকুনী একসময় গজগজানিতে পরিণত হতো, আর নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতো। বাবার ভাগ্য নিয়ে রোহান খুব একটা ভাবে না, কিন্তু নিজের খাদ্য-ভাগ্য যে খুব ভালো তা বুঝতে পারে। কারণে অকারণে সময়মতো ও খাদ্যের কাছে পৌঁছে যায় অথবা খাদ্য ওর কাছে। এইতো সেদিন মেসভাড়া যোগাড় করে বাড়িওয়ালার হাতে দিয়ে ফিরে আসলো। কিছুক্ষণের মধ্যে সে বাড়ি থেকে কান্নার শব্দ শোনা গেলো। আবার ছুটে গিয়ে দেখে বাড়িওয়ালা বাথরুমে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, বাড়িওয়ালি আর ছেলেমেয়েরা কাঁদছে। বাড়িওয়ালি ওকে পেয়ে যেন স্বর্গ হাতে পেলো। বাবা, সোনা ডেকে সাহায্য চাইলো। ও দ্রুত এম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সেখানে এক ডাক্তারবন্ধু ছিলো, খুব সহযোগিতা করেছে, ওর মাধ্যমে দ্রুত চিকিৎসা দিয়ে কেবিনে ভর্তি করলো।তারপর আরও তিনদিন সেখানে ছিলেন তিনি। অনেকটা সুস্থ হয়ে ফিরে আসলেন। সেদিন থেকে রোহান যেন ওঁদের কাছে দেবদূত। সপ্তাহে বেশ কয়েকবেলা ওঁদের সাথে রাতের খাবার খেতে হয়। তাছাড়া ভালো রান্না হলেই বাড়িওয়ালি ওকে ডেকে নিয়ে খেতে দেয়। প্রথম প্রথম খুব লজ্জা লাগতো। আজকাল মনে হয় এটা যেন ওর অধিকার। এখন খেতে ডাকলে বিনা বাক্যব্যয়ে চলে যায়।
রোহান সারাদিন পরে মেসে ফিরে এলো। বেশ কয়েকটা পত্রিকাতে কথা হলো, এখন লেখার প্রস্তুতি নিতে হবে। বাড়িওয়ালার বাসা থেকে রান্নার সুবাস ভেসে আসছে, বেশ সুন্দর। বোঝা যাচ্ছে বিরানি রান্না হচ্ছে। ওর খুব পছন্দের খাবার। চোখ বন্ধ করে গন্ধটা বুকের মধ্যে টেনে নিলো। বুঝতে পারেনি পাশের বিছানার আসগর ওর দিকে তাকিয়ে আছে। সে বেশ জ্বলুনীধরা কণ্ঠে বললো, ‘নাক টানো ক্যান, একটু পরেই তো ডাক আইবো, জামাই আদরে খাওয়াইবো’। আসগরের দিকে তাকিয়ে কঠিন কিছু বলতে যাবে, এমন সময় বাড়িওয়ালার চাকর দরজার কাছে এসে একগাল হাসি দিলো। রোহানের মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো। কড়া করে জিজ্ঞেস করলো, ‘কিরে, হাসছিস কেন?’ একইভাবে হেসে জবাব দিলো‘আপনেরে বোলাইছে আম্মাহুজুর’। সে মাথা নিচু করে ফেললো। কিছুক্ষণ পরে বলে, ‘যা, আমি আসছি’। ‘আম্মাহুজুর লগে কইরা লইয়া যাইতে হুকুম দিছে’। দাঁত কিড়মিড় করতে করতে রোহান ওর সাথে চলে গেলো। পেছনে আসগরের খিকখিক হাসির শব্দ শোনা গেলো।
ওরা সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে ওর জন্য। বাড়িওয়ালি দ্রুত ধোঁয়াওঠা বিরানি পরিবেশন করলো। চমৎকার দেখতে হয়েছে। হাত ধুয়ে খেতে বসার তর সইছে না ওর। চমৎকার খেতে হয়েছে। গরম বিরানি অনেকটা মুখের মধ্যে পুরে নিতেই বিষম খেলো। গরমে জিভ পুড়ে যাওয়ার অবস্থা। বাড়িওয়ালার বড় মেয়ে বকুলী দ্রুত একগ্লাস পানি এগিয়ে দিলো। ওর হাত থেকে গ্লাস নিয়ে এক চুমুকে সবটুকু শেষ করে হাঁফাচ্ছে। বকুলী একটা হাত পাখা এনে বাতাস করতে শুরু করলো। সেদিন খুব লজ্জা লাগলেও প্রচুর বিরানী খেলেও, আবার ভালোও লাগছিলো বকুলীর সেবা পেতে।
সেদিন থেকে বকুলী যেন অলিখিতভাবে ওর দায়িত্ব নিয়ে নিলো। সকাল বিকাল ওর খোঁজখবর নেয়া, ওর ওপর খবরদারি করা শুরু করলো। মাঝে মাঝে বেশ ভালোই লাগছিলো। নিজেকে সুখি সুখি ভাবতে ভালই লাগছে। এর মধ্যে চলছে ওর মজার মজার খাওয়া-দাওয়া।
বকুলী ওর কাছে আসতে চায় সবসময়। দুপুরে ঘুমালে জানালা দিয়ে ফুল ছুঁড়ে দৌড়ে পালাতো। ও জেগে দরজায় দাঁড়ালে বকুলী চৌকাটের পাশ থেকে গল্প করতো। ওর মুখ থেকে ঢাকাইয়া ভাষা শুনতে ভাল লাগতো।
একদিন বাড়িওয়ালা ওকে ডেকে পাশে বসালো, তারপর ওর হাত ধরে অনুরোধ করলো বকুলীর দায়িত্ব নেয়ার জন্য। সেদিনই রোহানের টনক নড়লো। এতো দিন যে সম্পর্কটাকে সে মজা হিসেবে নিয়েছিলো সেটা আর মজা রইলো না। ওর কাঁধে দায়িত্ব হিসেবে উঠে বসতে চাইছে। বাড়িওয়ালার কাছে ভাবার সময় চেয়ে নিয়ে চলে এলো। আড়ালে দাঁড়িয়ে বকুলী ওদের কথা শুনছিলো, ও সময় চাইতেই পর্দা সরিয়ে অপলক তাকিয়েছিলো। সে চাউনিতে কী ছিলো সে জানে না, নিজের অজান্তেই ঘেমে নেয়ে উঠেছিলো।
রুমে ফিরে এসে চুপ করে নিজের বিছানায় বসে আছে, মুখটা কাগজের মতো সাদা। ভাবছে কী জবাব দেবে বাবাকে, যদি প্রশ্ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে কেন সে ফাইভ পর্যন্তও না পড়া একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চাইছে। সব বন্ধুরা যখন শিক্ষিত মেয়ে বিয়ে করবে তখন সে ঢাকাইয়া দস্যি ও অসংস্কৃত একটা মেয়েকে বিয়ে করে সংসার করবে। ভাবতেই পারছে না, এতো দিনের আনন্দ যে ওর জীবনে বুমেরাং হয়ে আসবে তা সে ভাবতেও পারে নি।
বেশ কিছুদিন খুব সকালে বের হয়ে যায় ফিরে আসে অনেক রাতে। যতটুকু সম্ভব ওদের এড়িয়ে চলে। ওদের সামনে পড়তে চায় না। ও যখন ফিরে আসে তখন বাড়িওয়ালার তিনতলার ঘর থেকে কারো ছায়া দেখতে পায়। মেসে বারান্দায় লম্বাভাবে পড়ে থাকা ছায়াটা যে বকুলীর তা কেউকে বলে দিতে হয় না।
সেভাবেই সবকিছু চলছিলো। প্রতি বৃহস্পতিবার মেসের সবাই বাড়ি চলে যায়। শুধু রোহান থাকে। তেমনি এক বৃহস্পতিবার রাতে ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দরজা ঠেলে কেউ একজন ভেতরে ঢুকে পড়লো। অন্ধকার ঘরে ঢুকেই দরজাটা বন্ধ করে দরজার দিকে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বকুলী। জানালা দিয়ে আসা রাস্তায় আলোতে ওকে ফণা তোলা সাপের মতো লাগছে। ফোঁস ফোঁস করছে করে নিশ্বাস ফেলছে। একপা একপা করে ওর দিকে এগোচ্ছে, রোহান পিছিয়ে যাচ্ছে। পিছোতে পিছোতে একেবারে নিজের চৌকির কাছে পৌঁছে গেলো। পাপোশে লেগে চিৎ হয়ে বিছানায় পড়ে গেলো। বকুলীও ওর বুকের উপর শুয়ে হিস হিস করে বললো,
- এক্কেরে চোপ, আওয়াজ করলে কইয়া দিমু তুমি আমার ইজ্জত লুটছো, ছব্দ কইরবা না। কী ক্ষতি করছিলাম, আমারে লইয়া খেল্লা ক্যান, আমার নরম দিলডা লইয়া ফুটবল খেইচো? মাগর, আমি ভি তোমারে ছারমু না। কইলজাডা পোড়াইয়া দিয়া যামু।
- আমি কী করেছি?
- আমার লগে প্রেম প্রেম খেলছো, আমারে লাইলী বানাইছো, মাগার তুমি মিয়া মজনু অও নাইক্কা।
- আমি বুঝিনি তুমি লাইলী হয়েছো।
- এইবার হালায় তুমি বুজবা, আইজকা তোমার কইলজা পুইড়া দাগ দিয়া যামু।
বলেই রোহানের ঠোঁটদুটো নিজের মুখের মধ্যে সজোরে কামড়ে ধরলো। এতো জোরে যে মনে হচ্ছে দাঁত বসে যাচ্ছে। কামড় আরো বাড়লো, আরো। রোহানের দম বন্ধ হয়ে আসছে। ব্যথায় অজ্ঞান হওয়ার অবস্থা, চোখে জল এসে গেছে।
বকুলী ছেড়ে দিলো। ধীরে ধীরে দম নিয়ে উঠে বসলো, তারপর দরজা খুলে বের হয়ে গেলো। রোহানের জিভে নোনতা স্বাদ লাগলো, ঠোঁট বেয়ে রক্ত পড়ছে। হাতের তালু দিয়ে চেপে ধরে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা করছে।
ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে একটুকরো বিষণœ আলো।
পরদিন সকালে সবাই জানলো বকুলী পালিয়ে গেছে, ওদের বেনারসী কারখানার সামান্য একজন কর্মচারির সাথে। বকুলীর বাবা আবার অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে গেলো, এবার ওরা রোহানের সাহায্য নিলো না।
পরের মাসেই একটা পত্রিকা অফিসে সাব এডিটরের চাকরি পেয়ে মেস ছেড়ে দিলো রোহান। বাবা-মা’র পছন্দে বিয়ে করলো। বাসর ঘরে রাহিজা জানতে চেয়েছিলো ওর ঠোঁটের ওপরে কাটাদাগটা কী করে হলো?
রোহান নীরব ছিলো।
রাহিজা অনেক আবেগে ওকে চুমু খেতে এলে রোহান ওর মুখটা ভালো করে দেখে নেয়। সেই রাতে বকুলীর মুখটা এখনো ভুলতে পারে না।
এখনও অন্ধকার ঘরে রাস্তার আলো এসে পড়লে ওর বুক কাঁপানো দীর্ঘশ্বাস বের হয়। নিজের অজান্তে বকুলী সত্যিই ওকে মজনু বানিয়ে দিয়ে গেছে।