ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৫
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
(পূর্ব প্রকাশের পর)
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর বেল টাওয়ারটি ভোরের সূর্যালোক ও হালকা কুয়াশায় দেখাচ্ছে রহস্যময়, যেন বেবিলনের টাওয়ার।টাওয়ার থেকে কানে ভেসে এল ক্ষীণ ঘণ্টাধ্বনি। একদিন এটি ছিল একটি মিনার, যা থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি।
জ্যোৎস্নার আলোয় পৃথিবীর প্রদীপগুলি যেমনি ঢাকা পড়ে যায়, আলহাম্বরা-র বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে গ্রানাদার অন্যান্য স্থাপত্যগুলি তেমনি চোখ এড়িয়ে যায়।
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। এটি অনেকের চোখে পড়ে না, যদিও অনুপম এ স্থাপত্য স্পেনীয় রেঁনেসার প্রথম ক্যাথেড্রাল এবং এ শহরের এক বড় আকর্ষণ। ১৫২৩ সালে গ্রানাদার প্রধান মসজিদ এর স্থানে গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৮১ বছর পরে, ১৭০৪ সালে।
ক্যাথেড্রাল-এ প্রবেশ করলাম সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি অপরূপ এক তোরণ দিয়ে- যা একটি প্রধান খিলান ও ছোট তিনটি খিলানে সমন্বিত। ভেতরে রয়েছে অনেক চ্যাপেল বা উপাসনা কক্ষ, যার প্রতিটিতে শোভিত বাইবেলের কাহিনীর উপর নির্মিত চমৎকার সব ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম। সব দেখতে দেখতে আমাদের চোখ আটকে গেল কাপিয়া মেয়র বা প্রধান চ্যাপেলে। নকশাদার রঙিন কাচ, চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য দিয়ে এর সুবিশাল গম্বুজ অলঙ্কৃত। সবকিছুর মাঝে বিশিষ্ট হয়ে আছে শিল্পী এলেনসো কেনোর আঁকা সাতটি সুন্দর, সুবৃহৎ চিত্রকর্ম- এতে বর্ণিত কুমারী মেরির জীবন বৃত্তান্ত। নাবিল ও নাতাশা চারদিকের দেয়ালে, থামে, সিলিংয়ে অনুপম সব শিল্পসৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আমরা আর একটু ভেতরে দেখলাম গ্রানাদার বীর নারী মারিয়ানা পিনাদা-র সমাধি প্রস্তর, যেখানে ১৮৫৬ সালে তাঁর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করা হয়। লোরকা তাঁর নাটক মারিয়ানা পিনাদা লিখে এ মহিয়সী নারীকে পরিচিত করান সারা বিশ্বে। আমি নাবিল ও নাতাশাকে বললাম, নামটি প্রথম শুনেছি লোরকার নাটকে, এখানে দেখলাম তাঁর সমাধি। এটি তোমরা মনে রেখ, এ নারীর ট্র্যাজিক কাহিনী তোমাদেরকে পরে বলব।
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল দেখে বের হয়ে আসার পর নাতাশা বলল, বাবা, এখানে ছিল প্রধান মসজিদ, তার জায়গায় করল প্রধান ক্যাথেড্রাল। ইটস নট ফেয়ার, ইটস ফ্যানাটিসিজম। আমি বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ, এটি শুধু ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, এটি ইতিহাসের প্রতিও অবিচার।
পাশেই রয়েল চ্যাপেল, গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল থেকে বের হয়ে গেলাম সেখানে। গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-র আগে এটি নির্মিত হয়েছে। এখন রয়েল চ্যাপেল-এর ইতিহাসে একটু ফেরা যাক।
একটি বিয়ে- ইতিহাসে কী গভীর তার প্রভাব! এটি বদলে দেয় স্পেনের ইতিহাস, সূচনা করে একক স্পেন রাষ্ট্রের, সূত্রপাত ঘটায় কলম্বাসের সমুদ্র যাত্রার আর আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশের- যা স্পেনকে এনে দেয় অঢেল সম্পদ ও অনেক ক্ষমতা। সে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯ অক্টোবর ১৪৬৯ সালে- আরাগন রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ ও কাস্তিয়া রাজ্যের রাণী ইসাবেলা-এর মাঝে- মূলত এক রাজনৈতিক বিয়ে। এ দম্পতিকে বলা হয় ক্যাথলিক মনার্ক, যারা যৌথভাবে ১৪৯২ সালে গ্রানাডা জয় করেন।
১৩ সেপ্টম্বর ১৫০৪ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা স্বাক্ষর করেন এক উইল- মৃত্যুর পর গ্রানাদাতেই রাজদম্পতিকে সমাহিত করা হবে। সে লক্ষ্যে স্থপতি এনরিক এগাজ-এর গথিক নকশায় রয়েল চ্যাপেল-এর নির্মাণ কাজ শুরু হবে- এর মাঝেই ২৬ নভেম্বর ১৫০৪ সালে রাণী ইসাবেলা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় আলহাম্বরার কনভেন্ট অফ সান ফ্রান্সিসকোর চ্যাপেলে। ২৩ জানুয়ারি ১৫১৬ সালে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ মৃত্যুবরণ করলে তাঁকেও একই স্থানে সমাহিত করা হয়। ১৫০৫ সালে রয়েল চ্যাপেল-এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫১৭ সালে। পঞ্চম কার্লোস ১৫২১ সালে তাঁর পিতামহ ফার্দিনান্দ ও পিতামহী ইসাবেলার দেহাবশেষ নতুন নির্মিত রয়েল চ্যাপেলে সমাধিস্থ করেন।
রয়েল চ্যাপেলের ইতিহাস থেকে এখন তার বর্তমানে আসা যাক। রয়েল চ্যাপেলে ঢুকে মনে হলো এটি এক আর্ট গ্যালারি- সবদিকে নানা ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম, কারুকার্য খচিত আধারে রাখা মণিমুক্তা ও অলঙ্কার- বেশিরভাগই রাণী ইসাবেলার, কিছু আছে প্রাপ্ত উপহার। মাঝে দেখি দু’টি সমাধি প্রস্তর পাশাপাশি- যার একটিতে সমাহিত আছেন রাজা ফার্দিনান্দ ও অপরটিতে রাণী ইসাবেলা। এখানে রয়েছে স্পেনীয় ও ইতালীয় শিল্পীদের পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন চিত্রকর্ম। তবে আমাদের সবারমুগ্ধতার কেন্দ্র ছিল একটি চিত্র-এগোনি ইন দ্য গার্ডেন- প্রায় পাঁচশ বছর আগের, এখনো কি জীবন্ত! চিত্রকর্মটি এক কাহিনী বলছে, যা মূর্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীর আঁকার দক্ষতায়। পরে পাশের একজন বলল ছবির প্রেক্ষাপটের গল্প। অনুপম এ চিত্রকর্মে শিল্পী তুলে ধরেছেন বাইবেলের এক কাহিনী- ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের রাতে গেথশিমানী বাগানের এক টিলায় যিশু বিষণœ মনে প্রার্থনা করছেন, তাঁকে এক পানপাত্র দিচ্ছেন দেবদূত।আর টিলার নিচে ঘুমাচ্ছেন তিন শিষ্য, যাদেরকে যিশু তাঁর সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে বলেছিলেন। ছবিটি এঁকেছেন ইতালীর বিখ্যাত রেঁনেসা শিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লি। এটি ইতালি থেকে বত্তিচেল্লি বেঁচে থাকতেই সংগ্রহ করেন রাণী ইসাবেলা, তাঁর কাছেই ছিল আমৃত্যু। রাণী উইল করে যান যেন তাঁর সমস্ত চিত্রকর্ম, অলঙ্কার ও উপহারসামগ্রী রয়েল চ্যাপেলে দান করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরেই বত্তিচেল্লির পেইন্টিংটি এখানে টাঙানো হয়।
কে যেন বলেছিলেন- মহৎ সৃষ্টি আনন্দ দেয়, সাথে দেয় সূক্ষ¥ এক বিষাদ। বত্তিচেল্লির পেইন্টিংটি দেখে এ রকম এক আনন্দ-বিষাদের অনুভূতি নিয়ে বের হয়ে আসলাম রয়েল চ্যাপেল থেকে। গেলাম অপর পাশে মাদ্রাসা দে গ্রানাদায়।
আন্দালুসিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসা দে গ্রানাদা, ১৩৪৯ সালে প্রতিণ্ঠা করেছিলেন প্রথম ইউসুফ। ইউরোপের অন্ধকার সময়ে তিনি জ্ঞানের আলো জ¦ালিয়েছিলেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে ইসলামী শিক্ষার সাথে পড়ানো হতো গণিত, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও আইন শাস্ত্র। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল একটি বিরাট লাইব্রেরি, ছাত্র ও শিক্ষকদের বাসস্থান ও একটি পরীক্ষাগার। এখানে পড়াতেন বিখ্যাত আরব কবি ইবনে আল খাতিব ও ইবনে জামরাক- যাদের কবিতা আলহাম্বরার দেয়াল, খিলান ওসিলিংকে অলঙ্কৃত করেছে।
১৪৯২ সালে ক্যাথলিকদের গ্রানাদা বিজয়ের পরও আরব ও ক্যাথলিকদের মাঝে হওয়া গ্রানাদা চুক্তি অনুসারে এ মাদ্রাসা চালু থাকে ১৪৯৯ সাল পর্যন্ত। ক্যাথলিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৪৯৯ সালে আলবাইসিনে, এর পরে গ্রানাদার বাইরে আলপুহারাছে, সংঘটিত আরব অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় গ্রানাদা চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করেন ক্যাথলিক রাজা-রাণী। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে স্পেনীয় ক্যাথলিক ধর্মীয় উম্মাদনা- ইনকুইসিছিঁও। এর সুযোগ নেন তখনকার ইনকুজিইটর জেনারেল, গনজালো হিমেনেজ দে সিসনারোজ। তিনি মাদ্রাসা দে গ্রানাদা বন্ধ করে দিয়ে এর সমৃদ্ধ লাইব্রেরীর বই-পত্র পাশের প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলা চত্বরে নিয়ে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেয়ায় নেতৃত্ব দেন।
লাইব্রেরির বই পোড়ানোর ইতিহাস শুনে নাবিল বলল, ইটস এ বার্বারিজম। আমি বললাম, ইয়েস, ইটস নট রাইট। বইয়ের বিষয় বা লেখকের সাথে দ্বিমত হতে পারে, তবে তা পোড়ানো ভয়াবহ অন্যায়।
ইতিহাসের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মাদ্রাসা দে গ্রানাদা ১৯৭৬ সাল থেকে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ হয়ে আছে।
ইতিহাস থেকে আবার ফিরে যাই বর্তমানে।
প্রধান তোরণ দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম মাদ্রাসা দে গ্রানাদা-য়। বর্তমান তোরণ তৈরি করা হয়েছে ক্যাথলিক বিজয়ের পরে বারোক শিল্পশৈলীতে, যেখানে আছে ক্যাথলিক রাজাদের ছবি ও প্রতীকচিহ্ন। সাদা মার্বেলের মূল তোরণের কিছু অংশ গ্রানাদার প্রতœতাত্ত্বিক যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
গত কয়েকশ’ বছরে মাদ্রাসার মূল ভবনের অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে, একমাত্র অপরিবর্তিত অংশ আছে এর নামাজ-ঘর। এটি এক বর্গাকার কক্ষ, যার প্রতিটি বাহু ৬.৮৪ মিটার। অশ্বক্ষুরাকৃতির এক মনোরম খিলান দিয়ে আমরা মূল কক্ষে প্রবেশ করলাম। এর সিলিং অনেক উঁচু, দেয়ালের প্রায় মাঝামাঝিতে এটি বর্গাকার থেকে আট কোনা আকৃতি ধারণ করে। দেয়ালের উপরে রয়েছে স্টাকো বা আস্তরের জটিল নকশা, আর কারুকার্যময় লতা-পাতার অলঙ্করণ, সাথে আররি ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম নকশা। দেয়ালের মাথায় রয়েছে মৌচাক আকৃতির মুকারনাস কার্নিশ। আর সবার শীর্যে আছে কারুকাজ করা কাঠের আট-কোনা গম্বুজ, যার মধ্যখানে বসানো কাঁচের এক স্কাইলাইট। কারুকার্যময় মিহরাবটি কিবলামুখী করে এ কক্ষটির এক প্রান্তে নির্মিত।
এরপর গেলাম উপরের তলায়, সালোন দ্য কাবায়েরোস-এ, যা এ ভবনে পরে যোগ করা হয়। এটি ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত সিটি হল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এ কক্ষের সিলিং সুদৃশ্য কারুকাজ করা কাঠের, যাকে বলা হয় আর্তেসোনাদো বা স্পেনীয় সিলিং। এখানে অনেকগুলি জ্যামিতিক প্যাটার্ন পরস্পর সংযুক্ত করা হয়েছে, যা এক জনপ্রিয় নকশা মুদেহার এর নমুনা।
মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে দেখি, সামনে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা হাম্মাম আল আন্দালুস। হাম্মাম একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ ¯œানাগার। আরবরা আন্দালুসিয়ায় তাঁদের শাসনামলে ¯œানাগার এর প্রবর্তন করেছিলেন। এখনো অনেক হাম্মাম চালু আছে। এখানে পানি ধীরে ধীরে গরম করে বাষ্পীভূত করা হয়, যা ব্যবহার করা হয় ¯œানে। সাথে আছে ঠা-া পানির ব্যবস্থা। অনুমতি নিয়ে হাম্মাম আল আন্দালুস-এর ভেতরে একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ চমৎকার সাজসজ্জা, দেয়ালে আলহাম্বরার নকশা। নাবিল বলল, সে এখানে স্টিম বাথ করবে। আমি বললাম, অযথা সময় ও পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। হোটেলে যেয়েটেম্পেরেচার একটু হাই করে বাথটাবে হট শাওয়ার নাও, সেটাই হাম্মাম। সে বুঝতে পেরে আর কথা বাড়াল না।
পথেই পড়ল প্লাজা ইসাবেল লা ক্যাথলিকা। এটি মার্বেলের সুন্দর এক মনুমেন্ট- রাণী ইসাবেলা ১৪৯২ সালে সিংহাসনে বসে হাতে অনুমতিপত্র তুলে দিচ্ছেন কলম্বাসকে, তাঁর দূর প্রাচ্যে সমুদ্রযাত্রার জন্য। ব্রোঞ্জের-এ স্থাপত্যটি রোমে তৈরি করে গ্রানাদায় পাঠানো হয়, উদ্দেশ্য ছিল ১২ই অক্টোবর ১৮৯২ সালে কলম্বাসেরসমুদ্রযাত্রা ও আমেরিকা আবিষ্কারের ৪র্থ শতবার্ষিকীতে এটি উদ্বোধন করা হবে। অবশ্য কিছু জটিলতায় আরেক তারিখে, ২ নভেম্বর ১৮৯২ সালে, এটি বসানো হয় পাসেও ডেল সালোস-এ। এরপর ১৯৬২ সালে এটি স্থানান্তরিত করা হয় বর্তমান স্থান প্লাছা ইসাবেল লা ক্যাথলিকা-য়।
প্লাজা-র কাছে আসতেই কানে ভেসে এল গিটারের মিষ্টি স্বর। রাণী ইসাবেলার মনুমেন্টের কাছে বসে এক শিল্পী বাজাচ্ছেন গিটার, নিচে রাখা আছে তাঁর হ্যাট, অনেকে এক দুই ইউরো ফেলছেন। আমরা দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম। নাবিল তো গিটার বাজায়, সে সুরগুলি বোঝার চেষ্টা করল। কিছু না বুঝেও সে সুরে তন্ময় হয়ে ছিলাম, কতক্ষণ যেন কেটে গেল। দেখি, পাশে বাজনাগুলোর সিডি রাখা আছে বিক্রির জন্য। সিডির উপর শিল্পীর নাম লিখা মার্কোস থোছকানো, শিরোনাম ‘লা গিতারা আন গ্রানাদা’, অর্থাৎ গ্রানাদার গিটার। ফারজানা বলল, একটি সিডি কিনে নাও, পরে আমরা মাঝে মাঝে শুনতে পারব, তখন গ্রানাদার কথা মনে পড়বে। সিডির মূল্য কত তা কোথাও খুঁজে পেলাম না। যাহোক, একটি সিডি নিয়ে ১০ ইউরো ফেললাম হ্যাটের ভেতর। শিল্পী গিটার বাজাতে বাজাতেই মাথা ঝুঁকে ধন্যবাদ দিলেন। আমরাও মাথা ঝুঁকে প্রত্যুত্তর দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল লোরকার ‘গিটার’ কবিতা:
কান্না শুরু হলো
গিটারের।
নিশান্তের মদপাত্র ভেঙে
চুরমার।
কান্না শুরু হলো
গিটারের।
কেন আর গলা চেপে ধরা।
আর সাধ্য নেই, গলা
চেপে ধরি ওর।
কাঁদছে একটানা
যেমন কেঁদে চলে জল, বরফপাতের
পরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থেকে থেকে
যেমন ফুঁপিয়ে কাঁদে হাওয়া।৬
নাবিলের বাছাই করা ঐতিহাসিক স্থান আলকাইসেরিয়া। একটু হেঁটে আমরা পেলাম একটি বিরাট গেট, উপরে লেখা আলকাইসেরিয়া। আলকাইসেরিয়া একটি আরবি শব্দ আল কেসারিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এটি একটি বাজার, নাম থেকেই স্পষ্ট এটি প্রতিষ্ঠিত করেছে আরবরা, পঞ্চদশ শতাব্দীতে। শুরুতে এটি ছিল সিল্ক উৎপাদন ও বিক্রির প্রধান কেন্দ্র, পরে অনেক মূল্যবান পণ্য যেমন সোনা, রূপা, সুগন্ধি দ্রব্য এখানে ক্রয়-বিক্রয় হতো। সিল্ক উৎপাদনে গ্রানাদার গ্রামাঞ্চলে চাষ হতো মালবেরি গাছের, যা রেশম কীটকে ধারণ করতো। সিল্ক ব্যবসা খুব লাভজনক হওয়ায় এর মালিকানা ছিল গ্রানাদার সুলতানদের হাতে। তাঁরা স্বয়ং বাজারটির ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে নিরাপত্তার দিকটি তদারক করতেন। বাজারটিতে অনেকগুলি গেট ছিল, যা রাতে তালাবন্ধ করে পাহারা দেয়া হতো। ক্রমে এটি হয়ে উঠে গ্রানাদার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। ১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা বিজয়ের পর রাজার কাছে এ বাজারের মালিকানা চলে আসে। তবে বাজারটি আগের মতোই চলতে থাকে। ১৮৫০ সালে এক বিশাল অগ্নিকা-ে বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। মূল নাসিরীয় নকশা অনুসরণ করে নিউ-মুরিশ স্থাপত্যে এটি আবার নির্মাণ করা হয়, তবে আকার নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। তারপরও বাজারটি তার আরব ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বাজারটিতে ঢুকে দেখি সরু সর্পিল রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দোকান। মানুষের ভিড়ও অনেক- পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকেই এখানে এসেছেন পর্যটক, সবাই দেখছেন বেশি, কিনছেন কম। এ যেন এক প্রদর্শনী। দেয়ালে আরবি লিখন, মালিক মরক্কোর, কর্মচারী মরক্কোর, সবদিকে মরক্কো ও উত্তর আফ্রিকার দ্রব্য-সামগ্রী- নকশা করা রঙিন বাতি, উটের চামড়ার ব্যাগ, টি-সেট, কাঁচের উপর কারুকাজ করা উপহার সামগ্রী, বিভিন্ন প্রকার পর্দা, রঙবেরঙের হুঁকা, বিভিন্ন নকশার ট্যাপেস্ট্রি, হাতেবোনা এমব্রয়ডারি, সিল্কের পোশাক, বিভিন্ন নকশার বোরকা, হিজাব, আবায়া, স্কার্ফ, ফ্লেমেনকো পোশাক, হাতেবোনা কার্পেট, অলংকার, প্রসাধনী, আতর, মসলা ইত্যাদি। আবার কিছু স্টোর আছে বিশেষায়িত, যেমন শুধু অলংকারের, মসলার বা আতরের। পতাকাও বাদ যাবে কেন- স্পেন, আন্দালুসিয়া, গ্রানাদা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মরক্কো- এসব দেশের পতাকার সাথে আছে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের পতাকা ও জার্সি।
মনে পড়ে গেল স্বদেশের অনেক পরিচিত এক ছবি- ঢাকা গাউসিয়া মার্কেট। স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে দেখলাম আরো কটি বাজারের দৃশ্য- কলকাতার নিউ মার্কেট, ইস্তান্বুলের গ্র্যান্ড বাজার, লন্ডনের ক্যামডেন মার্কেট- পৃথিবীর সব প্রান্তেই মানুষের জীবনের কত প্রয়োজন, কত আয়োজন, তা কত বিচিত্র ও সুন্দর। পৃথিবীর সব বাজারের দৃশ্য, শব্দ ও গন্ধ- কোথায়ও যেন এক মিল আছে।
নাবিল ও নাতাশা আলকাইসেরিয়ার অনেক কিছু পছন্দ করল। কিনতেও চাইল। অর্থ ও ওজনের সীমাবদ্ধতা, তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশি কিছু নেয়া গেল না। শুধু আলহাম্বরার একটি মডেল এবং গ্রানাদার কিছু স্যুভেনির কিনে গেলাম পাশের এক রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে। মরক্কোর রেস্তোরাঁ, তাই ফালাফেল, কাবাব, শর্মা, সাথে ডালিমের রস অর্ডার দিয়ে সবাই ভেতরে বসলাম। স্পীকারে ভেসে আসছে আরবি গান, দেয়ালে আরবি লেখা, কথাবার্তা হচ্ছে মূলত আরবিতে। নাবিল বলল, মনে হচ্ছে আমরা কোনো আরব দেশে আছি।
বাইরে বের হয়ে শুনি গির্জার ঘণ্টাধ্বনি, সবদিকে দেখি ক্যাথেড্রাল, চ্যাপেল ও বার মনে করিয়ে দিল সময় ও দৃশ্যপট অনেক বদলে গেছে। আলকাইসেরিয়ার ভেতরের জগত ও বাইরের জগত সম্পূর্ণ আলাদা।
একটু হেঁটেই দেখি কোরাল দেল কার্বন- এক সরাইখানা। ওয়াশিংটন আরভিং-র ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ বইয়ে পড়েছি গ্রানাদার সরাইখানার বিবরণ- পৃথিবীর দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা সিল্ক রোড ধরে তাদের পণ্য নিয়ে আসে, আর এখানে এসে থামে- পানাহার করে, দুয়েকদিন অবস্থান করে তাদের নিজেদের ও সাথের উট বা গাধার বিশ্রামের জন্য। ফাঁকে ফাঁকে চলে পৃথিবীর প্রত্যন্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের পরস্পরের খোঁজ-খবর নেয়া, সংবাদ আদান-প্রদান, সাথে ব্যবসার কিছু লেনদেন। তারপর তারা রওয়ানা দেয় পরবর্তী গন্তব্যে।
গ্রানাদার ১৪টি সরাইখানার মধ্যে টিকে আছে একমাত্র কোরাল দেল কার্বন। গ্রানাদার সে সময়ের প্রধান সিল্ক বাজার আলকাইসেরিয়ার পাশেই এই সরাইখানা নির্মিত হয়, যাতে ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা নিতে পারে।
লোরকা সরাইখানাকে দেখেছেন মৃত্যুর প্রতীকে, তার ভেতরে মানুষের আসা যাওয়া যেন মৃত্যুর মতই সহজ ও স্বাভাবিক:
সরাইখানায়
প্রবেশ ও প্রস্থান করে
মৃত্যু।
কাল ঘোড়া আর
উচ্ছন্ন মানুষের আসা যাওয়া।৭
সরাইখানার যুগ পার হয়ে গেছে, এসেছে তার নব সংস্করণ: হোটেল-রেঁস্তোরা। এখনো সারা পৃথিবী থেকে লোকজন আসে স্পেনে, আরো বেশি করেই আসে, তা হয়ে গেছে পর্যটকদের একটি স্বর্গ। স্পেনে মিশে আছে বিচিত্র ইতিহাস- রোমান, ইহুদি, মুসলিম, খ্রিস্টান, কালো, আরব, ফরাসি, জিপসি, আফ্রিকা, ইউরোপ, রিকনকুইস্তা-ইনকুইসিছিঁও-সিভিল ওয়ার, ফাসিস্ট-কমিউনিস্ট, প্রাচ্য-প্রতীচ্য; আর ছড়িয়ে আছে চোখজুড়ানো নিসর্গ- সাগর, নদী, পর্বতমালা, সবুজ উপত্যকা, ডালিম-জলপাই-কমলার বাগান, আর অবিরাম, অফুরন্ত রোদ। তাই পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকে এখানে লোকজন আসে- কেউ ইতিহাসের সন্ধানে, কেউবা নিসর্গের টানে। ২০২৪ সালে স্পেনে পর্যটক এসেছে ৯ কোটি ৪০ লক্ষ, ফ্রান্সের পরই পর্যটক সংখ্যায় স্পেনের অবস্থান। এখন স্পেনে দাবি উঠেছে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করার, কারণ এর ফলে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ে চাপ পড়ছে। (চলবে)
জবভ:
৫. ঞযব ফরধষড়মঁব রহঃবৎারবি নবঃবিবহ ঋবফবৎরপড় এধৎপরধ খড়ৎপধ ধহফ ঃযব লড়ঁৎহধষরংঃ ধহফ পধৎঃড়ড়হরংঃ খঁরং ইধমধৎরধ (১৮৮২-১৯৪০), ঢ়ঁনষরংযবফ রহ ঃযব হবংিঢ়ধঢ়বৎ দঊষ ঝড়ষ’ রহ ঔঁহব ১৯৩৬. ওঃ ধিং খড়ৎপধ’ং ষধংঃ রহঃবৎারবি রহ যরং ষরভব.
৬. খধ এঁরঃধৎৎধ, গিটার, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭,. গধষধমঁবহধ,মালাগুয়েনা, অনুবাদ: তানভীর আকন্দ
ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৫
চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ
বৃহস্পতিবার, ০৮ মে ২০২৫
(পূর্ব প্রকাশের পর)
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর বেল টাওয়ারটি ভোরের সূর্যালোক ও হালকা কুয়াশায় দেখাচ্ছে রহস্যময়, যেন বেবিলনের টাওয়ার।টাওয়ার থেকে কানে ভেসে এল ক্ষীণ ঘণ্টাধ্বনি। একদিন এটি ছিল একটি মিনার, যা থেকে ভেসে আসত আজানের ধ্বনি।
জ্যোৎস্নার আলোয় পৃথিবীর প্রদীপগুলি যেমনি ঢাকা পড়ে যায়, আলহাম্বরা-র বিশালত্ব ও সৌন্দর্যে গ্রানাদার অন্যান্য স্থাপত্যগুলি তেমনি চোখ এড়িয়ে যায়।
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর ক্ষেত্রেও ঘটেছে তাই। এটি অনেকের চোখে পড়ে না, যদিও অনুপম এ স্থাপত্য স্পেনীয় রেঁনেসার প্রথম ক্যাথেড্রাল এবং এ শহরের এক বড় আকর্ষণ। ১৫২৩ সালে গ্রানাদার প্রধান মসজিদ এর স্থানে গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-এর নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যা শেষ হয় ১৮১ বছর পরে, ১৭০৪ সালে।
ক্যাথেড্রাল-এ প্রবেশ করলাম সপ্তদশ শতাব্দীতে তৈরি অপরূপ এক তোরণ দিয়ে- যা একটি প্রধান খিলান ও ছোট তিনটি খিলানে সমন্বিত। ভেতরে রয়েছে অনেক চ্যাপেল বা উপাসনা কক্ষ, যার প্রতিটিতে শোভিত বাইবেলের কাহিনীর উপর নির্মিত চমৎকার সব ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম। সব দেখতে দেখতে আমাদের চোখ আটকে গেল কাপিয়া মেয়র বা প্রধান চ্যাপেলে। নকশাদার রঙিন কাচ, চিত্রকর্ম ও ভাস্কর্য দিয়ে এর সুবিশাল গম্বুজ অলঙ্কৃত। সবকিছুর মাঝে বিশিষ্ট হয়ে আছে শিল্পী এলেনসো কেনোর আঁকা সাতটি সুন্দর, সুবৃহৎ চিত্রকর্ম- এতে বর্ণিত কুমারী মেরির জীবন বৃত্তান্ত। নাবিল ও নাতাশা চারদিকের দেয়ালে, থামে, সিলিংয়ে অনুপম সব শিল্পসৃষ্টি মনোযোগ দিয়ে দেখছে।
আমরা আর একটু ভেতরে দেখলাম গ্রানাদার বীর নারী মারিয়ানা পিনাদা-র সমাধি প্রস্তর, যেখানে ১৮৫৬ সালে তাঁর দেহাবশেষ সমাধিস্থ করা হয়। লোরকা তাঁর নাটক মারিয়ানা পিনাদা লিখে এ মহিয়সী নারীকে পরিচিত করান সারা বিশ্বে। আমি নাবিল ও নাতাশাকে বললাম, নামটি প্রথম শুনেছি লোরকার নাটকে, এখানে দেখলাম তাঁর সমাধি। এটি তোমরা মনে রেখ, এ নারীর ট্র্যাজিক কাহিনী তোমাদেরকে পরে বলব।
গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল দেখে বের হয়ে আসার পর নাতাশা বলল, বাবা, এখানে ছিল প্রধান মসজিদ, তার জায়গায় করল প্রধান ক্যাথেড্রাল। ইটস নট ফেয়ার, ইটস ফ্যানাটিসিজম। আমি বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ, এটি শুধু ধর্মের প্রতি অশ্রদ্ধা নয়, এটি ইতিহাসের প্রতিও অবিচার।
পাশেই রয়েল চ্যাপেল, গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল থেকে বের হয়ে গেলাম সেখানে। গ্রানাদা ক্যাথেড্রাল-র আগে এটি নির্মিত হয়েছে। এখন রয়েল চ্যাপেল-এর ইতিহাসে একটু ফেরা যাক।
একটি বিয়ে- ইতিহাসে কী গভীর তার প্রভাব! এটি বদলে দেয় স্পেনের ইতিহাস, সূচনা করে একক স্পেন রাষ্ট্রের, সূত্রপাত ঘটায় কলম্বাসের সমুদ্র যাত্রার আর আমেরিকায় স্পেনের উপনিবেশের- যা স্পেনকে এনে দেয় অঢেল সম্পদ ও অনেক ক্ষমতা। সে বিয়ে অনুষ্ঠিত হয় ১৯ অক্টোবর ১৪৬৯ সালে- আরাগন রাজ্যের রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ ও কাস্তিয়া রাজ্যের রাণী ইসাবেলা-এর মাঝে- মূলত এক রাজনৈতিক বিয়ে। এ দম্পতিকে বলা হয় ক্যাথলিক মনার্ক, যারা যৌথভাবে ১৪৯২ সালে গ্রানাডা জয় করেন।
১৩ সেপ্টম্বর ১৫০৪ সালে ফার্দিনান্দ ও ইসাবেলা স্বাক্ষর করেন এক উইল- মৃত্যুর পর গ্রানাদাতেই রাজদম্পতিকে সমাহিত করা হবে। সে লক্ষ্যে স্থপতি এনরিক এগাজ-এর গথিক নকশায় রয়েল চ্যাপেল-এর নির্মাণ কাজ শুরু হবে- এর মাঝেই ২৬ নভেম্বর ১৫০৪ সালে রাণী ইসাবেলা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁকে সমাহিত করা হয় আলহাম্বরার কনভেন্ট অফ সান ফ্রান্সিসকোর চ্যাপেলে। ২৩ জানুয়ারি ১৫১৬ সালে দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ মৃত্যুবরণ করলে তাঁকেও একই স্থানে সমাহিত করা হয়। ১৫০৫ সালে রয়েল চ্যাপেল-এর নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৫১৭ সালে। পঞ্চম কার্লোস ১৫২১ সালে তাঁর পিতামহ ফার্দিনান্দ ও পিতামহী ইসাবেলার দেহাবশেষ নতুন নির্মিত রয়েল চ্যাপেলে সমাধিস্থ করেন।
রয়েল চ্যাপেলের ইতিহাস থেকে এখন তার বর্তমানে আসা যাক। রয়েল চ্যাপেলে ঢুকে মনে হলো এটি এক আর্ট গ্যালারি- সবদিকে নানা ভাস্কর্য ও চিত্রকর্ম, কারুকার্য খচিত আধারে রাখা মণিমুক্তা ও অলঙ্কার- বেশিরভাগই রাণী ইসাবেলার, কিছু আছে প্রাপ্ত উপহার। মাঝে দেখি দু’টি সমাধি প্রস্তর পাশাপাশি- যার একটিতে সমাহিত আছেন রাজা ফার্দিনান্দ ও অপরটিতে রাণী ইসাবেলা। এখানে রয়েছে স্পেনীয় ও ইতালীয় শিল্পীদের পঞ্চদশ শতাব্দী থেকে অষ্টাদশ শতাব্দীর বিভিন্ন চিত্রকর্ম। তবে আমাদের সবারমুগ্ধতার কেন্দ্র ছিল একটি চিত্র-এগোনি ইন দ্য গার্ডেন- প্রায় পাঁচশ বছর আগের, এখনো কি জীবন্ত! চিত্রকর্মটি এক কাহিনী বলছে, যা মূর্ত হয়ে উঠেছে শিল্পীর আঁকার দক্ষতায়। পরে পাশের একজন বলল ছবির প্রেক্ষাপটের গল্প। অনুপম এ চিত্রকর্মে শিল্পী তুলে ধরেছেন বাইবেলের এক কাহিনী- ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার আগের রাতে গেথশিমানী বাগানের এক টিলায় যিশু বিষণœ মনে প্রার্থনা করছেন, তাঁকে এক পানপাত্র দিচ্ছেন দেবদূত।আর টিলার নিচে ঘুমাচ্ছেন তিন শিষ্য, যাদেরকে যিশু তাঁর সাথে প্রার্থনায় যোগ দিতে বলেছিলেন। ছবিটি এঁকেছেন ইতালীর বিখ্যাত রেঁনেসা শিল্পী সান্দ্রো বত্তিচেল্লি। এটি ইতালি থেকে বত্তিচেল্লি বেঁচে থাকতেই সংগ্রহ করেন রাণী ইসাবেলা, তাঁর কাছেই ছিল আমৃত্যু। রাণী উইল করে যান যেন তাঁর সমস্ত চিত্রকর্ম, অলঙ্কার ও উপহারসামগ্রী রয়েল চ্যাপেলে দান করা হয়। তাঁর মৃত্যুর পরেই বত্তিচেল্লির পেইন্টিংটি এখানে টাঙানো হয়।
কে যেন বলেছিলেন- মহৎ সৃষ্টি আনন্দ দেয়, সাথে দেয় সূক্ষ¥ এক বিষাদ। বত্তিচেল্লির পেইন্টিংটি দেখে এ রকম এক আনন্দ-বিষাদের অনুভূতি নিয়ে বের হয়ে আসলাম রয়েল চ্যাপেল থেকে। গেলাম অপর পাশে মাদ্রাসা দে গ্রানাদায়।
আন্দালুসিয়ার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় মাদ্রাসা দে গ্রানাদা, ১৩৪৯ সালে প্রতিণ্ঠা করেছিলেন প্রথম ইউসুফ। ইউরোপের অন্ধকার সময়ে তিনি জ্ঞানের আলো জ¦ালিয়েছিলেন এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, যেখানে ইসলামী শিক্ষার সাথে পড়ানো হতো গণিত, চিকিৎসা শাস্ত্র, জ্যোতির্বিজ্ঞান ও আইন শাস্ত্র। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল একটি বিরাট লাইব্রেরি, ছাত্র ও শিক্ষকদের বাসস্থান ও একটি পরীক্ষাগার। এখানে পড়াতেন বিখ্যাত আরব কবি ইবনে আল খাতিব ও ইবনে জামরাক- যাদের কবিতা আলহাম্বরার দেয়াল, খিলান ওসিলিংকে অলঙ্কৃত করেছে।
১৪৯২ সালে ক্যাথলিকদের গ্রানাদা বিজয়ের পরও আরব ও ক্যাথলিকদের মাঝে হওয়া গ্রানাদা চুক্তি অনুসারে এ মাদ্রাসা চালু থাকে ১৪৯৯ সাল পর্যন্ত। ক্যাথলিক শাসনের বিরুদ্ধে ১৪৯৯ সালে আলবাইসিনে, এর পরে গ্রানাদার বাইরে আলপুহারাছে, সংঘটিত আরব অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়ায় গ্রানাদা চুক্তি একতরফাভাবে বাতিল করেন ক্যাথলিক রাজা-রাণী। ততদিনে শুরু হয়ে গেছে স্পেনীয় ক্যাথলিক ধর্মীয় উম্মাদনা- ইনকুইসিছিঁও। এর সুযোগ নেন তখনকার ইনকুজিইটর জেনারেল, গনজালো হিমেনেজ দে সিসনারোজ। তিনি মাদ্রাসা দে গ্রানাদা বন্ধ করে দিয়ে এর সমৃদ্ধ লাইব্রেরীর বই-পত্র পাশের প্লাজা দ্য বিব-রেম্বলা চত্বরে নিয়ে প্রকাশ্যে পুড়িয়ে দেয়ায় নেতৃত্ব দেন।
লাইব্রেরির বই পোড়ানোর ইতিহাস শুনে নাবিল বলল, ইটস এ বার্বারিজম। আমি বললাম, ইয়েস, ইটস নট রাইট। বইয়ের বিষয় বা লেখকের সাথে দ্বিমত হতে পারে, তবে তা পোড়ানো ভয়াবহ অন্যায়।
ইতিহাসের অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে মাদ্রাসা দে গ্রানাদা ১৯৭৬ সাল থেকে গ্রানাদা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অংশ হয়ে আছে।
ইতিহাস থেকে আবার ফিরে যাই বর্তমানে।
প্রধান তোরণ দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম মাদ্রাসা দে গ্রানাদা-য়। বর্তমান তোরণ তৈরি করা হয়েছে ক্যাথলিক বিজয়ের পরে বারোক শিল্পশৈলীতে, যেখানে আছে ক্যাথলিক রাজাদের ছবি ও প্রতীকচিহ্ন। সাদা মার্বেলের মূল তোরণের কিছু অংশ গ্রানাদার প্রতœতাত্ত্বিক যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
গত কয়েকশ’ বছরে মাদ্রাসার মূল ভবনের অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা হয়েছে, একমাত্র অপরিবর্তিত অংশ আছে এর নামাজ-ঘর। এটি এক বর্গাকার কক্ষ, যার প্রতিটি বাহু ৬.৮৪ মিটার। অশ্বক্ষুরাকৃতির এক মনোরম খিলান দিয়ে আমরা মূল কক্ষে প্রবেশ করলাম। এর সিলিং অনেক উঁচু, দেয়ালের প্রায় মাঝামাঝিতে এটি বর্গাকার থেকে আট কোনা আকৃতি ধারণ করে। দেয়ালের উপরে রয়েছে স্টাকো বা আস্তরের জটিল নকশা, আর কারুকার্যময় লতা-পাতার অলঙ্করণ, সাথে আররি ক্যালিগ্রাফির সূক্ষ্ম নকশা। দেয়ালের মাথায় রয়েছে মৌচাক আকৃতির মুকারনাস কার্নিশ। আর সবার শীর্যে আছে কারুকাজ করা কাঠের আট-কোনা গম্বুজ, যার মধ্যখানে বসানো কাঁচের এক স্কাইলাইট। কারুকার্যময় মিহরাবটি কিবলামুখী করে এ কক্ষটির এক প্রান্তে নির্মিত।
এরপর গেলাম উপরের তলায়, সালোন দ্য কাবায়েরোস-এ, যা এ ভবনে পরে যোগ করা হয়। এটি ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত সিটি হল হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এ কক্ষের সিলিং সুদৃশ্য কারুকাজ করা কাঠের, যাকে বলা হয় আর্তেসোনাদো বা স্পেনীয় সিলিং। এখানে অনেকগুলি জ্যামিতিক প্যাটার্ন পরস্পর সংযুক্ত করা হয়েছে, যা এক জনপ্রিয় নকশা মুদেহার এর নমুনা।
মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে দেখি, সামনে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা হাম্মাম আল আন্দালুস। হাম্মাম একটি আরবি শব্দ, যার অর্থ ¯œানাগার। আরবরা আন্দালুসিয়ায় তাঁদের শাসনামলে ¯œানাগার এর প্রবর্তন করেছিলেন। এখনো অনেক হাম্মাম চালু আছে। এখানে পানি ধীরে ধীরে গরম করে বাষ্পীভূত করা হয়, যা ব্যবহার করা হয় ¯œানে। সাথে আছে ঠা-া পানির ব্যবস্থা। অনুমতি নিয়ে হাম্মাম আল আন্দালুস-এর ভেতরে একটু ঘুরে দেখলাম। বেশ চমৎকার সাজসজ্জা, দেয়ালে আলহাম্বরার নকশা। নাবিল বলল, সে এখানে স্টিম বাথ করবে। আমি বললাম, অযথা সময় ও পয়সা নষ্ট করে লাভ নেই। হোটেলে যেয়েটেম্পেরেচার একটু হাই করে বাথটাবে হট শাওয়ার নাও, সেটাই হাম্মাম। সে বুঝতে পেরে আর কথা বাড়াল না।
পথেই পড়ল প্লাজা ইসাবেল লা ক্যাথলিকা। এটি মার্বেলের সুন্দর এক মনুমেন্ট- রাণী ইসাবেলা ১৪৯২ সালে সিংহাসনে বসে হাতে অনুমতিপত্র তুলে দিচ্ছেন কলম্বাসকে, তাঁর দূর প্রাচ্যে সমুদ্রযাত্রার জন্য। ব্রোঞ্জের-এ স্থাপত্যটি রোমে তৈরি করে গ্রানাদায় পাঠানো হয়, উদ্দেশ্য ছিল ১২ই অক্টোবর ১৮৯২ সালে কলম্বাসেরসমুদ্রযাত্রা ও আমেরিকা আবিষ্কারের ৪র্থ শতবার্ষিকীতে এটি উদ্বোধন করা হবে। অবশ্য কিছু জটিলতায় আরেক তারিখে, ২ নভেম্বর ১৮৯২ সালে, এটি বসানো হয় পাসেও ডেল সালোস-এ। এরপর ১৯৬২ সালে এটি স্থানান্তরিত করা হয় বর্তমান স্থান প্লাছা ইসাবেল লা ক্যাথলিকা-য়।
প্লাজা-র কাছে আসতেই কানে ভেসে এল গিটারের মিষ্টি স্বর। রাণী ইসাবেলার মনুমেন্টের কাছে বসে এক শিল্পী বাজাচ্ছেন গিটার, নিচে রাখা আছে তাঁর হ্যাট, অনেকে এক দুই ইউরো ফেলছেন। আমরা দাঁড়িয়ে শুনতে লাগলাম। নাবিল তো গিটার বাজায়, সে সুরগুলি বোঝার চেষ্টা করল। কিছু না বুঝেও সে সুরে তন্ময় হয়ে ছিলাম, কতক্ষণ যেন কেটে গেল। দেখি, পাশে বাজনাগুলোর সিডি রাখা আছে বিক্রির জন্য। সিডির উপর শিল্পীর নাম লিখা মার্কোস থোছকানো, শিরোনাম ‘লা গিতারা আন গ্রানাদা’, অর্থাৎ গ্রানাদার গিটার। ফারজানা বলল, একটি সিডি কিনে নাও, পরে আমরা মাঝে মাঝে শুনতে পারব, তখন গ্রানাদার কথা মনে পড়বে। সিডির মূল্য কত তা কোথাও খুঁজে পেলাম না। যাহোক, একটি সিডি নিয়ে ১০ ইউরো ফেললাম হ্যাটের ভেতর। শিল্পী গিটার বাজাতে বাজাতেই মাথা ঝুঁকে ধন্যবাদ দিলেন। আমরাও মাথা ঝুঁকে প্রত্যুত্তর দিয়ে আবার হাঁটা শুরু করলাম।
হাঁটতে হাঁটতে মনে পড়ে গেল লোরকার ‘গিটার’ কবিতা:
কান্না শুরু হলো
গিটারের।
নিশান্তের মদপাত্র ভেঙে
চুরমার।
কান্না শুরু হলো
গিটারের।
কেন আর গলা চেপে ধরা।
আর সাধ্য নেই, গলা
চেপে ধরি ওর।
কাঁদছে একটানা
যেমন কেঁদে চলে জল, বরফপাতের
পরে ছুঁয়ে ছুঁয়ে থেকে থেকে
যেমন ফুঁপিয়ে কাঁদে হাওয়া।৬
নাবিলের বাছাই করা ঐতিহাসিক স্থান আলকাইসেরিয়া। একটু হেঁটে আমরা পেলাম একটি বিরাট গেট, উপরে লেখা আলকাইসেরিয়া। আলকাইসেরিয়া একটি আরবি শব্দ আল কেসারিয়া থেকে এসেছে, যার অর্থ ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এটি একটি বাজার, নাম থেকেই স্পষ্ট এটি প্রতিষ্ঠিত করেছে আরবরা, পঞ্চদশ শতাব্দীতে। শুরুতে এটি ছিল সিল্ক উৎপাদন ও বিক্রির প্রধান কেন্দ্র, পরে অনেক মূল্যবান পণ্য যেমন সোনা, রূপা, সুগন্ধি দ্রব্য এখানে ক্রয়-বিক্রয় হতো। সিল্ক উৎপাদনে গ্রানাদার গ্রামাঞ্চলে চাষ হতো মালবেরি গাছের, যা রেশম কীটকে ধারণ করতো। সিল্ক ব্যবসা খুব লাভজনক হওয়ায় এর মালিকানা ছিল গ্রানাদার সুলতানদের হাতে। তাঁরা স্বয়ং বাজারটির ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে নিরাপত্তার দিকটি তদারক করতেন। বাজারটিতে অনেকগুলি গেট ছিল, যা রাতে তালাবন্ধ করে পাহারা দেয়া হতো। ক্রমে এটি হয়ে উঠে গ্রানাদার প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র। ১৪৯২ সালে ক্যাথলিকরা গ্রানাদা বিজয়ের পর রাজার কাছে এ বাজারের মালিকানা চলে আসে। তবে বাজারটি আগের মতোই চলতে থাকে। ১৮৫০ সালে এক বিশাল অগ্নিকা-ে বাজারটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। মূল নাসিরীয় নকশা অনুসরণ করে নিউ-মুরিশ স্থাপত্যে এটি আবার নির্মাণ করা হয়, তবে আকার নেমে আসে প্রায় অর্ধেকে। তারপরও বাজারটি তার আরব ঐতিহ্য ধরে রেখে আরো জাঁকজমকপূর্ণ হয়ে ওঠে।
বাজারটিতে ঢুকে দেখি সরু সর্পিল রাস্তার দুই পাশে সারি সারি দোকান। মানুষের ভিড়ও অনেক- পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকেই এখানে এসেছেন পর্যটক, সবাই দেখছেন বেশি, কিনছেন কম। এ যেন এক প্রদর্শনী। দেয়ালে আরবি লিখন, মালিক মরক্কোর, কর্মচারী মরক্কোর, সবদিকে মরক্কো ও উত্তর আফ্রিকার দ্রব্য-সামগ্রী- নকশা করা রঙিন বাতি, উটের চামড়ার ব্যাগ, টি-সেট, কাঁচের উপর কারুকাজ করা উপহার সামগ্রী, বিভিন্ন প্রকার পর্দা, রঙবেরঙের হুঁকা, বিভিন্ন নকশার ট্যাপেস্ট্রি, হাতেবোনা এমব্রয়ডারি, সিল্কের পোশাক, বিভিন্ন নকশার বোরকা, হিজাব, আবায়া, স্কার্ফ, ফ্লেমেনকো পোশাক, হাতেবোনা কার্পেট, অলংকার, প্রসাধনী, আতর, মসলা ইত্যাদি। আবার কিছু স্টোর আছে বিশেষায়িত, যেমন শুধু অলংকারের, মসলার বা আতরের। পতাকাও বাদ যাবে কেন- স্পেন, আন্দালুসিয়া, গ্রানাদা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, মরক্কো- এসব দেশের পতাকার সাথে আছে রিয়াল মাদ্রিদ ও বার্সেলোনা ফুটবল ক্লাবের পতাকা ও জার্সি।
মনে পড়ে গেল স্বদেশের অনেক পরিচিত এক ছবি- ঢাকা গাউসিয়া মার্কেট। স্মৃতির ঝুলি হাতড়ে দেখলাম আরো কটি বাজারের দৃশ্য- কলকাতার নিউ মার্কেট, ইস্তান্বুলের গ্র্যান্ড বাজার, লন্ডনের ক্যামডেন মার্কেট- পৃথিবীর সব প্রান্তেই মানুষের জীবনের কত প্রয়োজন, কত আয়োজন, তা কত বিচিত্র ও সুন্দর। পৃথিবীর সব বাজারের দৃশ্য, শব্দ ও গন্ধ- কোথায়ও যেন এক মিল আছে।
নাবিল ও নাতাশা আলকাইসেরিয়ার অনেক কিছু পছন্দ করল। কিনতেও চাইল। অর্থ ও ওজনের সীমাবদ্ধতা, তাই ইচ্ছে থাকলেও বেশি কিছু নেয়া গেল না। শুধু আলহাম্বরার একটি মডেল এবং গ্রানাদার কিছু স্যুভেনির কিনে গেলাম পাশের এক রেস্তোরাঁয় ডিনার খেতে। মরক্কোর রেস্তোরাঁ, তাই ফালাফেল, কাবাব, শর্মা, সাথে ডালিমের রস অর্ডার দিয়ে সবাই ভেতরে বসলাম। স্পীকারে ভেসে আসছে আরবি গান, দেয়ালে আরবি লেখা, কথাবার্তা হচ্ছে মূলত আরবিতে। নাবিল বলল, মনে হচ্ছে আমরা কোনো আরব দেশে আছি।
বাইরে বের হয়ে শুনি গির্জার ঘণ্টাধ্বনি, সবদিকে দেখি ক্যাথেড্রাল, চ্যাপেল ও বার মনে করিয়ে দিল সময় ও দৃশ্যপট অনেক বদলে গেছে। আলকাইসেরিয়ার ভেতরের জগত ও বাইরের জগত সম্পূর্ণ আলাদা।
একটু হেঁটেই দেখি কোরাল দেল কার্বন- এক সরাইখানা। ওয়াশিংটন আরভিং-র ঞধষবং ড়ভ ঃযব অষযধসনৎধ বইয়ে পড়েছি গ্রানাদার সরাইখানার বিবরণ- পৃথিবীর দূর-দূরান্তের ব্যবসায়ীরা সিল্ক রোড ধরে তাদের পণ্য নিয়ে আসে, আর এখানে এসে থামে- পানাহার করে, দুয়েকদিন অবস্থান করে তাদের নিজেদের ও সাথের উট বা গাধার বিশ্রামের জন্য। ফাঁকে ফাঁকে চলে পৃথিবীর প্রত্যন্ত থেকে আসা ব্যবসায়ীদের পরস্পরের খোঁজ-খবর নেয়া, সংবাদ আদান-প্রদান, সাথে ব্যবসার কিছু লেনদেন। তারপর তারা রওয়ানা দেয় পরবর্তী গন্তব্যে।
গ্রানাদার ১৪টি সরাইখানার মধ্যে টিকে আছে একমাত্র কোরাল দেল কার্বন। গ্রানাদার সে সময়ের প্রধান সিল্ক বাজার আলকাইসেরিয়ার পাশেই এই সরাইখানা নির্মিত হয়, যাতে ব্যবসায়ীরা এর সুবিধা নিতে পারে।
লোরকা সরাইখানাকে দেখেছেন মৃত্যুর প্রতীকে, তার ভেতরে মানুষের আসা যাওয়া যেন মৃত্যুর মতই সহজ ও স্বাভাবিক:
সরাইখানায়
প্রবেশ ও প্রস্থান করে
মৃত্যু।
কাল ঘোড়া আর
উচ্ছন্ন মানুষের আসা যাওয়া।৭
সরাইখানার যুগ পার হয়ে গেছে, এসেছে তার নব সংস্করণ: হোটেল-রেঁস্তোরা। এখনো সারা পৃথিবী থেকে লোকজন আসে স্পেনে, আরো বেশি করেই আসে, তা হয়ে গেছে পর্যটকদের একটি স্বর্গ। স্পেনে মিশে আছে বিচিত্র ইতিহাস- রোমান, ইহুদি, মুসলিম, খ্রিস্টান, কালো, আরব, ফরাসি, জিপসি, আফ্রিকা, ইউরোপ, রিকনকুইস্তা-ইনকুইসিছিঁও-সিভিল ওয়ার, ফাসিস্ট-কমিউনিস্ট, প্রাচ্য-প্রতীচ্য; আর ছড়িয়ে আছে চোখজুড়ানো নিসর্গ- সাগর, নদী, পর্বতমালা, সবুজ উপত্যকা, ডালিম-জলপাই-কমলার বাগান, আর অবিরাম, অফুরন্ত রোদ। তাই পৃথিবীর প্রতিটি কোণ থেকে এখানে লোকজন আসে- কেউ ইতিহাসের সন্ধানে, কেউবা নিসর্গের টানে। ২০২৪ সালে স্পেনে পর্যটক এসেছে ৯ কোটি ৪০ লক্ষ, ফ্রান্সের পরই পর্যটক সংখ্যায় স্পেনের অবস্থান। এখন স্পেনে দাবি উঠেছে পর্যটন নিয়ন্ত্রণ করার, কারণ এর ফলে স্থানীয়দের জীবনযাত্রার মান ও ব্যয়ে চাপ পড়ছে। (চলবে)
জবভ:
৫. ঞযব ফরধষড়মঁব রহঃবৎারবি নবঃবিবহ ঋবফবৎরপড় এধৎপরধ খড়ৎপধ ধহফ ঃযব লড়ঁৎহধষরংঃ ধহফ পধৎঃড়ড়হরংঃ খঁরং ইধমধৎরধ (১৮৮২-১৯৪০), ঢ়ঁনষরংযবফ রহ ঃযব হবংিঢ়ধঢ়বৎ দঊষ ঝড়ষ’ রহ ঔঁহব ১৯৩৬. ওঃ ধিং খড়ৎপধ’ং ষধংঃ রহঃবৎারবি রহ যরং ষরভব.
৬. খধ এঁরঃধৎৎধ, গিটার, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
৭,. গধষধমঁবহধ,মালাগুয়েনা, অনুবাদ: তানভীর আকন্দ