alt

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৬

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

: বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

এ ক’দিন গ্রানাদা ঘুরেছি প্ল্যান মাফিক। ভোরে নাবিল ও নাতাশা বলল, আজ শুধু ঘুরে বেড়াব- কোনো গন্তব্য থাকবে না। পথে যেতে যেতে যা ভাল লাগবে তাই দেখব। বললাম, ‘তবে তাই হোক’। বাতাসে উড়ে বেড়ানো সুতা কাটা ঘুড়ির মতো এ রকম মুহূর্ত মাঝে মাঝে থাকা ভালো।

হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম নুড়িপাথর-মোড়া অলি-গলিতে, গাছ-গাছালি ভরা আশেপাশের চত্বরে। এখানে হাঁটা এক বড় আনন্দময় ব্যাপার। হাঁটতে গেলে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করি। এখানে পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস, আছে কাহিনী- গৌরবের বা দুঃখের।

গ্রানাদা ছোট, কিন্তু খুব ছিমছাম এক শহর। এখানে সব কিছু মনে হয় গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে, ডালাসের মতো বিশাল জায়গায় ছড়ানো নয়। ছোট বড় সব রাস্তা খুব পরিষ্কার, সব সময় কেউ না কেউ পরিষ্কার করছে রাস্তা, চত্বর, পার্ক। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে গ্রানাদা খুবই নিরাপদ। তবে এ কদিনে একটিও পুলিশ চোখে পড়েনি। ট্র্যাফিক শৃঙ্খলা দারুণ। এখানে বেশিরভাগ রাস্তা সরু। এই রাস্তাতেও গাড়ি চলছে স্বচ্ছন্দে, পাশে সামান্য ফাঁকে মানুষও হাঁটছে, তবুও শুনিনি কোসো হর্ন, দেখিনি কোনো যানজট। শহরের প্রতিটি প্রান্তে, সে কোনো ঘিঞ্জি এলাকা হোক, বা কোনো প্লাজা হোক, আধুনিক গণপরিবহন সময়মত চলছে। প্রতিটি মানুষ লাইন ধরে উঠছে, নামছে- কারো কোনো তাড়া নেই। তাড়া হয়তো আছে অফিসে বা স্কুলে যাবার, কিংবা ফ্লাইট ধরার, কিন্তু তার কোনো বহির্প্রকাশ নেই।

এলোমেলো হেঁটে দেখতে থাকি- বিভিন্ন জাতের মানুষ, নকশা-করা পথ, কারুকার্যময় ল্যাম্পপোস্ট, ঘরবাড়ি হতে রাস্তার উপর ঝোলানো ব্যালকনি- সেখান থেকে ঝোলানো টবে ফুলের বাহার, চাঁদোয়া-ঘেরা ক্যাফে-রেঁস্তোরা-বার, গিটার-কাবাব-কেক-মিষ্টি-ফুল-ফলের রকমারি দোকান, সারি সারি কমলা গাছ, যাত্রী-ভরা পর্যটন বাস, জিপসীদের নাচ-গান, আরো কত কিছু...। অগণিত স্যুভেনির শপ ও সেখানকার নিত্য ভিড় বলে দিচ্ছে পর্যটকদের কাছে গ্রানাদার জনপ্রিয়তা। এক একটি স্যুভেনির শপ যেন এক একটি মিউজিয়ম- গ্রানাদার ও স্পেনের। এখানে সবই আছে- এ পর্যন্ত যা দেখেছি, যা দেখব, বা যা দেখার সময় হবে না।

দেখি, এক প্রবীণ দম্পতি হাঁটছেন-ওভারকোট হ্যাট টাই পড়া স্বামীর দু’হাত জোড় করা, আর হালকা মেকআপে পরিপাটি পোশাক পড়া স্ত্রী, তাঁর বাম হাত সমর্পিত স্বামীর ভাঁজ করা ডান হাতে। দুজনে হাঁটছেন খুব আস্তে ধীরে, গল্প করতে করতে, হাতে আছে যেন অফুরন্ত সময়। বিকেলে পার্কে গেলে এ দৃশ্যটি প্রায়ই দেখি।

হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলাম গ্রানাদার ছোটোএক আবাসিক এলাকায়। পাইন গাছের সারি, বাগান ঘেরা গোল চত্বর, তার মাঝে বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট। রাস্তার পাশেই পার্ক করা বেশিরভাগ গাড়ি। এখানে সেখানে, চৌরাস্তায়, বাড়ির বারান্দায়, পার্কিং লটে লোকজনের আনাগোনা। মনে হয় বেশিরভাগ পরস্পরের পরিচিত- নাম ধরে ডাকে, কুশল বিনিময় করে, বসে একটু আড্ডা দেয়। মেলামেশা এদের কাছে খুবই জরুরি। ডালাসে দেখেছি একই ব্লকে বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকে, কিন্তু কারো সাথে কারো কথা খুব একটা হয় না, আড্ডা দেওয়া তো দূরে থাক। দরকার ছাড়া কথা বলা মনে করা হয় সময়ের অপচয়।

এখানে ভোর শুরু হয় একটু দেরিতে। সকাল দশটা, এখনো মোড়ের ক্যাফেতে বসে লোকজন খুব আয়েস করে ব্রেকফাস্ট সারছে- কোনো তাড়া নেই, ধীরেসুস্থে কাজে যাবে। ডালাসে প্রায়ই দেখি- লোকজন ভোরে কাজের পথে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ব্রেকফাস্ট সারছে।

এসে পড়লাম কাছের একটি চত্বরে, যা আসা যাওয়ার পথে রোজই চোখে পড়ে। গ্রানাদার প্রাণকেন্দ্র প্লাজা ন্যুয়েভা- মানে নতুন প্লাজা- যদিও এটি গ্রানাদার সবচেয়ে পুরনো প্লাজা। এটি অবশ্যই নতুন ছিল ১৫১৫ সালে, যখন ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখলের পর এই নগর চত্বর নির্মাণ করেন। শহর প্রশস্ত করার লক্ষ্যে দারো নদীর উপর এটি প্রসারিত করা হয়। এর চারপাশে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা, যার মধ্যে আছে ১৫৮৭ সালে স্থাপিত রয়্যাল চ্যান্সেলারি- স্পেনের প্রথম আদালত ভবন। চত্বরের মাঝখানে রয়েছে এক সুন্দর ফোয়ারা- ফুয়েন্টে দ্য লা প্লাজা ন্যুয়েভা- যার মাথায় বসানো রয়েছে এক ডালিম। ডালিম এর স্পেনীয় নাম গ্রানাদা, আর এই সুন্দর ফলটি গ্রানাদার প্রতীক। তাই এর নকশা শোভা পাচ্ছে গ্রানাদার বহু ফোয়ারায়, লাইট-পোস্টে, নুড়ি-বিছানো রাস্তায়, এমনকি তার পতাকায়ও। লোরকা বলেছেন: ডালিম বাইরে ‘হৃদয় আর করোটির আবছা রূপ’, আর ভেতরে ‘আহত মাটির রক্ত’।১ ডালিম ফলের রূপকে লোরকা হয়তো বুঝিয়েছেন গ্রানাদা-কে, যার রয়েছে রক্তক্ষরণের অনেক ইতিহাস।

রাজকীয় বিয়ে, ষাঁড়ের লড়াই, দ্বন্দ্বযুদ্ধ, সামরিক প্রদর্শনী, ধর্মীয় উৎসব এবং আরো অনেক উৎসবের কেন্দ্র ছিল প্লাজা ন্যুয়েভা। এখন এটি খেলার, আড্ডার, পানভোজনের এক বিরাট জায়গা। এখানে সবসময় চলছে জিপসীদের গিটার বাজনা, সাথে নাচ-গান। সন্ধ্যের পর পরই এটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে হাজারো মানুষের আনাগোনায়, তাদের হাসি-আনন্দ-গানে। তারা কি জানে এই চত্বরেই জড়িয়ে রয়েছে স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁও-এর অশ্রুসিক্ত রক্তাক্ত ইতিহাস- যখন এখানে জনসমক্ষে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হতো- কখনো অভিযুক্তকে আগুনে পুড়িয়ে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। লোরকা সম্ভবত এর কথাই বলেছেন গ্রানাদার দুই নদীর প্রতীকে, একটি নদী শোকের প্রতীক, অন্যটি রক্তের :

কমলা-জলপাইয়ের বন

মাঝ দিয়ে বয়ে যায় গুয়াদালকিবির।

বরফি চুড়োর থেকে গমের প্রান্তরে

নেমে বয়ে যায় দুই গ্রানাদার নদী।

....

গ্রানাদাদেশের দুই নদী ওরা

শোকের, রক্তের।২

প্লাজা ন্যুয়েভা ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এভিনিদা দ্য লা কনস্টিটিসিঁও সড়কে। এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক আনন্দ-বিস্ময়। নাবিল বলে উঠল, বাবা, মনে হচ্ছে তোমার মিস্টার লোরকা। আমি বললাম, আমার একার নয়, লোরকা তোমাদেরও।

চওড়া সড়কের একপাশে দেখি লোরকাকে- পায়ের ওপর পা তুলে কোলে দু’হাত রেখে বসে আছেন এক বেঞ্চিতে, সামনের দিকে অপলক দৃষ্টি, যেন কিছু বলছেন, কিছু প্রশ্ন করছেন, মনে হয়তো অভিমান- গ্রানাদার বুকে তাঁর এই প্রথম ভাস্কর্য স্থাপনে মৃত্যুর পর কেন ৭০ বছর অপেক্ষা করতে হলো? লোরকার এই সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন শিল্পী হোসে এন্টোনিও করেডর, এত দীর্ঘ সময় লেগে গেল তা প্রকাশ্যে আনতে, তা যেন গ্রানাদা তথা স্পেনের রক্তাক্ত ইতিহাসের এক ইঙ্গিত।

এর মধ্যেই দেখেছি গ্রানাদার দুটি পাহাড়- আলবারিকা, ওপরে আল হাম্বরা, এবং সান ক্রিস্টোবাল, ওপরে আলবাইসিন। এবার লক্ষ্য তৃতীয় পাহাড়- ভেলপেরেজো। পাহাড়টি মূল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য এর ওপরের জিপসি যাদুঘর। তবে যাদুঘরের কথা বলিনি নাবিল নাতাশাকে, বলেছি- চল, এক সুন্দর পাহাড় দেখতে যাব। কারণ যাদুঘরের প্রতি তাদের আগ্রহ কম। তারা বলে, অতীতকে দেখে লাভকি, বর্তমানকে এনজয় করি। তারপরও তাদের নিয়ে আসা এখানে পাহাড়ি এলাকায়, প্রকৃতি দেখবে, ভাল লাগলে যাদুঘরে যাবে। মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে, জিপসিদের জীবন ও ইতিহাসের যাদুঘর। যাদুঘরের নামই বলে দিচ্ছে এলাকার নাম সেক্রোমন্তে। এটি গ্রানাদার জিপসি এলাকা বলে পরিচিত। সরু পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে এ যাদুঘরে, যাবার পথে তাদের অনেক গুহা, পাহাড় কেটে কেটে গুহাগুলি তারা তৈরি করে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। পনের শতাব্দী থেকে জিপসিরা শহর কেন্দ্র থেকে এ এলাকায় আসতে শুরু করে। গ্রানাডার মূল জনগোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাব এর মূল কারণ। অতীতে এরা যাযাবর ছিল, যেমন ছিল আমাদের দেশের বেদেরা, তবে তারা এখনো রয়ে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বিভিন্ন কাজ শিখে নেয়। ধীরে ধীরে হস্তশিল্পের বিভিন্ন পেশায় জিপসিরা পারদর্শী হয়ে ওঠে।

জিপসিদের স্পেনীয় ভাষায় বলা হয় হিতানো- শব্দটিকে লোরকা বিশ্বব্যাপী পরিচিত করান তাঁর কাব্য রোমান্সেরো হিতানো (জিপসি লোকগাথা) দিয়ে, যা একই সাথে তাঁকেও জনপ্রিয় করে তোলে, যখন ১৯২৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়। জিপসিদের জন্য লোরকার ছিল গভীর ভালবাসা ও মমতা, যা ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় ও কথায়; তাঁর কাছে জিপসিরা ‘স্পেনের সবচেয়ে খাঁটি, সবচেয়ে অভিজাত মানুষ, আর আন্দালুসিয়ান সত্যের রক্ত-অস্থিমজ্জা, তার বর্ণমালার অভিভাবক।’ রোমান্সেরো হিতানো-তে স্পেনীয় লোক সংস্কৃতির বিষয় ও ভাব আত্মস্থ করে তিনি তুলে ধরেছেন নিজস্ব এক ভাষা ও শৈলীতে, যা হয়ে ওঠে অনন্য এক কাব্য ভাষা। কাব্যটির এক কবিতার অংশ:

বৃষ্টিজলের আধারের কাছে

জিপসি মেয়েটি খেয়ে যায় দোল।

সবুজ শরীর, সবুজ অলক,

আর চোখজোড়া ঠা-া রূপার।

চাঁদের সুচালো তুষারখ-

ধরে আছে তাকে পানির উপর।

চাঁদ হয়ে এল এতই নিবিড়

যেন তা গ্রামের চত্বর কোনো।৩

কবিতা থেকে এবার ফিরে যাই ভেলপেরেজো পাহাড়ের পথে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে তৈরি করা সাদা চুনকাম করা গুহাগুলি সৃষ্টি করেছে এক সুন্দর দৃশ্যের। এর মাঝে দেখা যাচ্ছে অনেক ফ্লেমেনকো স্টুডিও। পাহাড়ের অন্য দিকে একই ফ্রেমে- গ্রানাদা শহর, আল হাম্বরা ও সিয়েরা নেভাদা-এ তিনটি মিলে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ ছবি- অসাধারণ মুগ্ধতায় তা দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে লাগলাম- আশেপাশে, নিচে, ওপরের আরো সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে। নাবিল নাতাশাও খুব উপভোগ করছে পাহাড়ের ওপর হাঁটা- এটি তাদের মাউন্টেন হাইকিং, যেন এক এডভেঞ্চার। ওপরে উঠতেই থাকি, সবাই কিছুটা ক্লান্তও, তবে যাদুঘর আর আসে না। এক পর্যায়ে পাথরের অনেক সিঁড়ি বেয়ে এক সমতল জায়গায় এসে একটু দম ফেললাম। সামনেই দেখি পুরনো কয়েকটি বাড়ি ও অনেকগুলি বড় গুহা- সামনের এক সাইনবোর্ডে লেখা মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে, মানে সেক্রোমন্তের গুহা যাদুঘর। যেন এক আকস্মিক আবিস্কার, তার আনন্দে ছেলে মেয়েকে বললাম, ভেতরে যেয়ে এক্সপ্লোর করে দেখি কী আছে। এডভেঞ্চার ও এক্সপ্লোর করায় তাদের কোনো সময় আপত্তি থাকে না, সেদিনও ছিল না। শুরু হলো আমাদের জিপসি যাদুঘর দেখা।

শত বছরের দশটি জিপসি গুহা সংষ্কার করে তৈরি করা হয়েছে যাদুঘর-মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে। এক একটি গুহায় জিপসিদের ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিস রাখা, সাথে সাঁটা বর্ণনা। তাঁতের বুনন, বেতের কাজ, কাঠের নকশা, ধাতুর কাজ, মাটির তৈজসপত্র তৈরি- এসব কাজে তারা ছিল দক্ষ- বিভিন্ন গুহায় এসবের নিদর্শন রয়েছে। তাদের বিভিন্ন কারুকাজে রয়েছে শিল্পনৈপুণ্যের ছাপ। এক গুহায় দেখলাম পাথরের থালা, বাটি, গ্লাস এবং আরো অন্যান্য জিনিস। সবই সুন্দর রঙ দিয়ে নকশা করা। আর কয়েকটি গুহায় আছে জিপসিদের বসার ঘর, থাকার ঘর, রান্নার ঘর- সাথে আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রী।

জিপসিদের রক্তে মিশে আছে নাচ আর গান। একটি বিশেষ গুহায় ধারণ করা আছে জিপসিদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য- নৃত্য-গীত ফ্লেমেনকো-র ইতিহাস ও বিবর্তন। বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে ফ্লেমেনকোতে। ঐতিহ্যবাহী ফ্লেমেনকোতে আরবদের বেলি ড্যান্স ও স্পেনের অন্যান্য লোকগীতির উপাদান মিশিয়ে জিপসিরা ফ্লেমেনকোর বিবর্তনে অবদান রেখেছে।

জিপসি যাদুঘর দেখা শেষ করে আমরা বসলাম বাইরে এক খোলা চত্বরে। আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কার কেমন লাগল। ফারজানা বলল, বেশ সুন্দর, অনেক কিছু জানা হলো। নাবিল বলল, ইটস ওকে। নাতাশা বলল, জিপসিরা অনেক গরিব। তাদের হেল্প করা দরকার। আমি বললাম, জিপসিদের সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের অনেক মিল আছে। নাতাশা বলল, বাবা, তুমি রেসিস্ট। আমি বুঝে উঠলাম না এখানে রেসিজমের কী আছে! আমার প্রশ্নবোধক ভাব দেখে নাতাশা বলল, রেড ইন্ডিয়ান শব্দটি অফেন্সিভ, বলতে হবে নেটিভ আমেরিকান। আমি আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলাম।

জিপসি, ফ্লেমেনকো ও আন্দালুসিয়া- একই সূত্রে বাঁধা। তবে ফ্লেমেনকো শুধু গ্রানাদা, বা আন্দালুসিয়ায় নয়, সারা স্পেনেও খুব জনপ্রিয়। আন্দালুসিয়ার ত্রিভুজের তিনটি শহর- গ্রানাদা, সেভিয়া ও কর্ডোভা- তার দু’টি, গ্রানাদা ও সেভিয়া, দাবি করে তাদের এলাকায় ফ্লেমেনকো-র জন্ম ও বিকাশ। তবে জন্ম যেখানেই হোক, ফ্লেমেনকোকে বিশ্বময় জনপ্রিয় করতে এ দুই শহর বিশেষ অবদান রেখেছে। (চলবে)

Ref:

১. অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

২. Baladilla de los tres rios, তিন নদীর বালাদিকা, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়

৩. Romance sonámbulo, তন্দ্রাচারী গাথা, অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ

সাময়িকী কবিতা

ছবি

দাউদ হায়দার: স্বকীয় ও নির্বাসিত

ছবি

অটোগ্রাফ

ছবি

বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতি : একটি পর্যবেক্ষণ

ছবি

আলবেয়ার কামুর গল্পে অস্তিত্বের নিষ্ঠুরতা

ছবি

উপন্যাসের জন্মবীক্ষা

সাময়িকী কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

কানাগলি

ছবি

পার্ল এস বাক-এর কবিতা

ছবি

হোসে এচেগারাই স্প্যানিশ আলোকবর্তিকা

ছবি

নববীণায় বাজে নতুনের জয়গান

ছবি

রবীন্দ্রনাথের ‘করুণা’ ঘিরে কিছু কথা

ছবি

গীতাঞ্জলির ইতিবৃত্ত ও বেদনাহত রবীন্দ্রনাথ

ছবি

রবীন্দ্রনাথ, শিলাইদহ ও ‘ছিন্নপত্র’

ছবি

নিউ নেদারল্যান্ডস: জার্র্সি এবং লেনাপি জনগোষ্ঠী

সাময়িকী কবিতা

ছবি

বকুলীর সেইরাত

ছবি

আকাশের প্রান্ত

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

মুখ

ছবি

বাংলাদেশের প্রথম নির্বাসিত কবি

ছবি

অগ্রজ দাউদ হায়দারের মহাপ্রয়াণ

ছবি

নারী যখন পাঠক নারী যখন লেখক

সাময়িকী কবিতা

মিত্র

ছবি

মৃত্যুর মৃদু উত্তাপ : পথের শেষ কোথায়

ছবি

লোরকার দেশে

ছবি

বেলাল চৌধুরীর কবিতা

ছবি

পাঠের আগ্রহ থাকলে বইয়ের অভাব হয় না

ছবি

রবীন্দ্রগানে শঙ্খ ঘোষের মন

ছবি

ফার্স্ট টিউসডে’স : আমার প্রথম মঙ্গলবার সন্ধ্যার গন্তব্য

ছবি

আজ লাবণ্যর বিয়ে

ছবি

সংস্কৃতির পরম্পরা, অভিঘাত-অভিজ্ঞান ইতিহাস বিচার-বিশ্লেষণ

ছবি

তুষার গায়েন-এর কবিতা

ছবি

লোরকার দেশে

tab

সাময়িকী

ধারাবাহিক ভ্রমণ কাহিনী-৬

লোরকার দেশে

চৌধুরী সালাহউদ্দীন মাহমুদ

বৃহস্পতিবার, ১৫ মে ২০২৫

(পূর্ব প্রকাশের পর)

এ ক’দিন গ্রানাদা ঘুরেছি প্ল্যান মাফিক। ভোরে নাবিল ও নাতাশা বলল, আজ শুধু ঘুরে বেড়াব- কোনো গন্তব্য থাকবে না। পথে যেতে যেতে যা ভাল লাগবে তাই দেখব। বললাম, ‘তবে তাই হোক’। বাতাসে উড়ে বেড়ানো সুতা কাটা ঘুড়ির মতো এ রকম মুহূর্ত মাঝে মাঝে থাকা ভালো।

হোটেল থেকে বেরিয়ে হাঁটতে থাকলাম নুড়িপাথর-মোড়া অলি-গলিতে, গাছ-গাছালি ভরা আশেপাশের চত্বরে। এখানে হাঁটা এক বড় আনন্দময় ব্যাপার। হাঁটতে গেলে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখি, ইতিহাস খোঁজার চেষ্টা করি। এখানে পথে প্রান্তরে ছড়িয়ে আছে ইতিহাস, আছে কাহিনী- গৌরবের বা দুঃখের।

গ্রানাদা ছোট, কিন্তু খুব ছিমছাম এক শহর। এখানে সব কিছু মনে হয় গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে, ডালাসের মতো বিশাল জায়গায় ছড়ানো নয়। ছোট বড় সব রাস্তা খুব পরিষ্কার, সব সময় কেউ না কেউ পরিষ্কার করছে রাস্তা, চত্বর, পার্ক। আর সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে গ্রানাদা খুবই নিরাপদ। তবে এ কদিনে একটিও পুলিশ চোখে পড়েনি। ট্র্যাফিক শৃঙ্খলা দারুণ। এখানে বেশিরভাগ রাস্তা সরু। এই রাস্তাতেও গাড়ি চলছে স্বচ্ছন্দে, পাশে সামান্য ফাঁকে মানুষও হাঁটছে, তবুও শুনিনি কোসো হর্ন, দেখিনি কোনো যানজট। শহরের প্রতিটি প্রান্তে, সে কোনো ঘিঞ্জি এলাকা হোক, বা কোনো প্লাজা হোক, আধুনিক গণপরিবহন সময়মত চলছে। প্রতিটি মানুষ লাইন ধরে উঠছে, নামছে- কারো কোনো তাড়া নেই। তাড়া হয়তো আছে অফিসে বা স্কুলে যাবার, কিংবা ফ্লাইট ধরার, কিন্তু তার কোনো বহির্প্রকাশ নেই।

এলোমেলো হেঁটে দেখতে থাকি- বিভিন্ন জাতের মানুষ, নকশা-করা পথ, কারুকার্যময় ল্যাম্পপোস্ট, ঘরবাড়ি হতে রাস্তার উপর ঝোলানো ব্যালকনি- সেখান থেকে ঝোলানো টবে ফুলের বাহার, চাঁদোয়া-ঘেরা ক্যাফে-রেঁস্তোরা-বার, গিটার-কাবাব-কেক-মিষ্টি-ফুল-ফলের রকমারি দোকান, সারি সারি কমলা গাছ, যাত্রী-ভরা পর্যটন বাস, জিপসীদের নাচ-গান, আরো কত কিছু...। অগণিত স্যুভেনির শপ ও সেখানকার নিত্য ভিড় বলে দিচ্ছে পর্যটকদের কাছে গ্রানাদার জনপ্রিয়তা। এক একটি স্যুভেনির শপ যেন এক একটি মিউজিয়ম- গ্রানাদার ও স্পেনের। এখানে সবই আছে- এ পর্যন্ত যা দেখেছি, যা দেখব, বা যা দেখার সময় হবে না।

দেখি, এক প্রবীণ দম্পতি হাঁটছেন-ওভারকোট হ্যাট টাই পড়া স্বামীর দু’হাত জোড় করা, আর হালকা মেকআপে পরিপাটি পোশাক পড়া স্ত্রী, তাঁর বাম হাত সমর্পিত স্বামীর ভাঁজ করা ডান হাতে। দুজনে হাঁটছেন খুব আস্তে ধীরে, গল্প করতে করতে, হাতে আছে যেন অফুরন্ত সময়। বিকেলে পার্কে গেলে এ দৃশ্যটি প্রায়ই দেখি।

হাঁটতে হাঁটতে ঢুকলাম গ্রানাদার ছোটোএক আবাসিক এলাকায়। পাইন গাছের সারি, বাগান ঘেরা গোল চত্বর, তার মাঝে বহুতল এ্যাপার্টমেন্ট। রাস্তার পাশেই পার্ক করা বেশিরভাগ গাড়ি। এখানে সেখানে, চৌরাস্তায়, বাড়ির বারান্দায়, পার্কিং লটে লোকজনের আনাগোনা। মনে হয় বেশিরভাগ পরস্পরের পরিচিত- নাম ধরে ডাকে, কুশল বিনিময় করে, বসে একটু আড্ডা দেয়। মেলামেশা এদের কাছে খুবই জরুরি। ডালাসে দেখেছি একই ব্লকে বছরের পর বছর পাশাপাশি থাকে, কিন্তু কারো সাথে কারো কথা খুব একটা হয় না, আড্ডা দেওয়া তো দূরে থাক। দরকার ছাড়া কথা বলা মনে করা হয় সময়ের অপচয়।

এখানে ভোর শুরু হয় একটু দেরিতে। সকাল দশটা, এখনো মোড়ের ক্যাফেতে বসে লোকজন খুব আয়েস করে ব্রেকফাস্ট সারছে- কোনো তাড়া নেই, ধীরেসুস্থে কাজে যাবে। ডালাসে প্রায়ই দেখি- লোকজন ভোরে কাজের পথে গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে ব্রেকফাস্ট সারছে।

এসে পড়লাম কাছের একটি চত্বরে, যা আসা যাওয়ার পথে রোজই চোখে পড়ে। গ্রানাদার প্রাণকেন্দ্র প্লাজা ন্যুয়েভা- মানে নতুন প্লাজা- যদিও এটি গ্রানাদার সবচেয়ে পুরনো প্লাজা। এটি অবশ্যই নতুন ছিল ১৫১৫ সালে, যখন ক্যাথলিকরা গ্রানাদা দখলের পর এই নগর চত্বর নির্মাণ করেন। শহর প্রশস্ত করার লক্ষ্যে দারো নদীর উপর এটি প্রসারিত করা হয়। এর চারপাশে রয়েছে অনেক ঐতিহাসিক স্থাপনা, যার মধ্যে আছে ১৫৮৭ সালে স্থাপিত রয়্যাল চ্যান্সেলারি- স্পেনের প্রথম আদালত ভবন। চত্বরের মাঝখানে রয়েছে এক সুন্দর ফোয়ারা- ফুয়েন্টে দ্য লা প্লাজা ন্যুয়েভা- যার মাথায় বসানো রয়েছে এক ডালিম। ডালিম এর স্পেনীয় নাম গ্রানাদা, আর এই সুন্দর ফলটি গ্রানাদার প্রতীক। তাই এর নকশা শোভা পাচ্ছে গ্রানাদার বহু ফোয়ারায়, লাইট-পোস্টে, নুড়ি-বিছানো রাস্তায়, এমনকি তার পতাকায়ও। লোরকা বলেছেন: ডালিম বাইরে ‘হৃদয় আর করোটির আবছা রূপ’, আর ভেতরে ‘আহত মাটির রক্ত’।১ ডালিম ফলের রূপকে লোরকা হয়তো বুঝিয়েছেন গ্রানাদা-কে, যার রয়েছে রক্তক্ষরণের অনেক ইতিহাস।

রাজকীয় বিয়ে, ষাঁড়ের লড়াই, দ্বন্দ্বযুদ্ধ, সামরিক প্রদর্শনী, ধর্মীয় উৎসব এবং আরো অনেক উৎসবের কেন্দ্র ছিল প্লাজা ন্যুয়েভা। এখন এটি খেলার, আড্ডার, পানভোজনের এক বিরাট জায়গা। এখানে সবসময় চলছে জিপসীদের গিটার বাজনা, সাথে নাচ-গান। সন্ধ্যের পর পরই এটি প্রাণবন্ত হয়ে উঠে হাজারো মানুষের আনাগোনায়, তাদের হাসি-আনন্দ-গানে। তারা কি জানে এই চত্বরেই জড়িয়ে রয়েছে স্পেনীয় ইনকুইসিছিঁও-এর অশ্রুসিক্ত রক্তাক্ত ইতিহাস- যখন এখানে জনসমক্ষে মৃত্যুদ- কার্যকর করা হতো- কখনো অভিযুক্তকে আগুনে পুড়িয়ে বা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। লোরকা সম্ভবত এর কথাই বলেছেন গ্রানাদার দুই নদীর প্রতীকে, একটি নদী শোকের প্রতীক, অন্যটি রক্তের :

কমলা-জলপাইয়ের বন

মাঝ দিয়ে বয়ে যায় গুয়াদালকিবির।

বরফি চুড়োর থেকে গমের প্রান্তরে

নেমে বয়ে যায় দুই গ্রানাদার নদী।

....

গ্রানাদাদেশের দুই নদী ওরা

শোকের, রক্তের।২

প্লাজা ন্যুয়েভা ঘুরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে গেলাম এভিনিদা দ্য লা কনস্টিটিসিঁও সড়কে। এখানে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল এক আনন্দ-বিস্ময়। নাবিল বলে উঠল, বাবা, মনে হচ্ছে তোমার মিস্টার লোরকা। আমি বললাম, আমার একার নয়, লোরকা তোমাদেরও।

চওড়া সড়কের একপাশে দেখি লোরকাকে- পায়ের ওপর পা তুলে কোলে দু’হাত রেখে বসে আছেন এক বেঞ্চিতে, সামনের দিকে অপলক দৃষ্টি, যেন কিছু বলছেন, কিছু প্রশ্ন করছেন, মনে হয়তো অভিমান- গ্রানাদার বুকে তাঁর এই প্রথম ভাস্কর্য স্থাপনে মৃত্যুর পর কেন ৭০ বছর অপেক্ষা করতে হলো? লোরকার এই সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন শিল্পী হোসে এন্টোনিও করেডর, এত দীর্ঘ সময় লেগে গেল তা প্রকাশ্যে আনতে, তা যেন গ্রানাদা তথা স্পেনের রক্তাক্ত ইতিহাসের এক ইঙ্গিত।

এর মধ্যেই দেখেছি গ্রানাদার দুটি পাহাড়- আলবারিকা, ওপরে আল হাম্বরা, এবং সান ক্রিস্টোবাল, ওপরে আলবাইসিন। এবার লক্ষ্য তৃতীয় পাহাড়- ভেলপেরেজো। পাহাড়টি মূল লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য এর ওপরের জিপসি যাদুঘর। তবে যাদুঘরের কথা বলিনি নাবিল নাতাশাকে, বলেছি- চল, এক সুন্দর পাহাড় দেখতে যাব। কারণ যাদুঘরের প্রতি তাদের আগ্রহ কম। তারা বলে, অতীতকে দেখে লাভকি, বর্তমানকে এনজয় করি। তারপরও তাদের নিয়ে আসা এখানে পাহাড়ি এলাকায়, প্রকৃতি দেখবে, ভাল লাগলে যাদুঘরে যাবে। মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে, জিপসিদের জীবন ও ইতিহাসের যাদুঘর। যাদুঘরের নামই বলে দিচ্ছে এলাকার নাম সেক্রোমন্তে। এটি গ্রানাদার জিপসি এলাকা বলে পরিচিত। সরু পাহাড়ি রাস্তা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে এ যাদুঘরে, যাবার পথে তাদের অনেক গুহা, পাহাড় কেটে কেটে গুহাগুলি তারা তৈরি করে স্থায়ীভাবে থাকার জন্য। পনের শতাব্দী থেকে জিপসিরা শহর কেন্দ্র থেকে এ এলাকায় আসতে শুরু করে। গ্রানাডার মূল জনগোষ্ঠীর বিরূপ মনোভাব এর মূল কারণ। অতীতে এরা যাযাবর ছিল, যেমন ছিল আমাদের দেশের বেদেরা, তবে তারা এখনো রয়ে গেছে প্রান্তিক জনগোষ্ঠি। বেঁচে থাকার তাগিদে তারা বিভিন্ন কাজ শিখে নেয়। ধীরে ধীরে হস্তশিল্পের বিভিন্ন পেশায় জিপসিরা পারদর্শী হয়ে ওঠে।

জিপসিদের স্পেনীয় ভাষায় বলা হয় হিতানো- শব্দটিকে লোরকা বিশ্বব্যাপী পরিচিত করান তাঁর কাব্য রোমান্সেরো হিতানো (জিপসি লোকগাথা) দিয়ে, যা একই সাথে তাঁকেও জনপ্রিয় করে তোলে, যখন ১৯২৮ সালে এটি প্রকাশিত হয়। জিপসিদের জন্য লোরকার ছিল গভীর ভালবাসা ও মমতা, যা ফুটে ওঠে তাঁর কবিতায় ও কথায়; তাঁর কাছে জিপসিরা ‘স্পেনের সবচেয়ে খাঁটি, সবচেয়ে অভিজাত মানুষ, আর আন্দালুসিয়ান সত্যের রক্ত-অস্থিমজ্জা, তার বর্ণমালার অভিভাবক।’ রোমান্সেরো হিতানো-তে স্পেনীয় লোক সংস্কৃতির বিষয় ও ভাব আত্মস্থ করে তিনি তুলে ধরেছেন নিজস্ব এক ভাষা ও শৈলীতে, যা হয়ে ওঠে অনন্য এক কাব্য ভাষা। কাব্যটির এক কবিতার অংশ:

বৃষ্টিজলের আধারের কাছে

জিপসি মেয়েটি খেয়ে যায় দোল।

সবুজ শরীর, সবুজ অলক,

আর চোখজোড়া ঠা-া রূপার।

চাঁদের সুচালো তুষারখ-

ধরে আছে তাকে পানির উপর।

চাঁদ হয়ে এল এতই নিবিড়

যেন তা গ্রামের চত্বর কোনো।৩

কবিতা থেকে এবার ফিরে যাই ভেলপেরেজো পাহাড়ের পথে। পাহাড়ের গায়ে গায়ে তৈরি করা সাদা চুনকাম করা গুহাগুলি সৃষ্টি করেছে এক সুন্দর দৃশ্যের। এর মাঝে দেখা যাচ্ছে অনেক ফ্লেমেনকো স্টুডিও। পাহাড়ের অন্য দিকে একই ফ্রেমে- গ্রানাদা শহর, আল হাম্বরা ও সিয়েরা নেভাদা-এ তিনটি মিলে সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ ছবি- অসাধারণ মুগ্ধতায় তা দেখতে দেখতে ওপরে উঠতে লাগলাম- আশেপাশে, নিচে, ওপরের আরো সুন্দর দৃশ্য দেখতে দেখতে। নাবিল নাতাশাও খুব উপভোগ করছে পাহাড়ের ওপর হাঁটা- এটি তাদের মাউন্টেন হাইকিং, যেন এক এডভেঞ্চার। ওপরে উঠতেই থাকি, সবাই কিছুটা ক্লান্তও, তবে যাদুঘর আর আসে না। এক পর্যায়ে পাথরের অনেক সিঁড়ি বেয়ে এক সমতল জায়গায় এসে একটু দম ফেললাম। সামনেই দেখি পুরনো কয়েকটি বাড়ি ও অনেকগুলি বড় গুহা- সামনের এক সাইনবোর্ডে লেখা মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে, মানে সেক্রোমন্তের গুহা যাদুঘর। যেন এক আকস্মিক আবিস্কার, তার আনন্দে ছেলে মেয়েকে বললাম, ভেতরে যেয়ে এক্সপ্লোর করে দেখি কী আছে। এডভেঞ্চার ও এক্সপ্লোর করায় তাদের কোনো সময় আপত্তি থাকে না, সেদিনও ছিল না। শুরু হলো আমাদের জিপসি যাদুঘর দেখা।

শত বছরের দশটি জিপসি গুহা সংষ্কার করে তৈরি করা হয়েছে যাদুঘর-মুজেও কুয়েবাছ দেল সেক্রোমন্তে। এক একটি গুহায় জিপসিদের ব্যবহারের বিভিন্ন জিনিস রাখা, সাথে সাঁটা বর্ণনা। তাঁতের বুনন, বেতের কাজ, কাঠের নকশা, ধাতুর কাজ, মাটির তৈজসপত্র তৈরি- এসব কাজে তারা ছিল দক্ষ- বিভিন্ন গুহায় এসবের নিদর্শন রয়েছে। তাদের বিভিন্ন কারুকাজে রয়েছে শিল্পনৈপুণ্যের ছাপ। এক গুহায় দেখলাম পাথরের থালা, বাটি, গ্লাস এবং আরো অন্যান্য জিনিস। সবই সুন্দর রঙ দিয়ে নকশা করা। আর কয়েকটি গুহায় আছে জিপসিদের বসার ঘর, থাকার ঘর, রান্নার ঘর- সাথে আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য সামগ্রী।

জিপসিদের রক্তে মিশে আছে নাচ আর গান। একটি বিশেষ গুহায় ধারণ করা আছে জিপসিদের সবচেয়ে বড় ঐতিহ্য- নৃত্য-গীত ফ্লেমেনকো-র ইতিহাস ও বিবর্তন। বিভিন্ন সংস্কৃতির প্রভাব রয়েছে ফ্লেমেনকোতে। ঐতিহ্যবাহী ফ্লেমেনকোতে আরবদের বেলি ড্যান্স ও স্পেনের অন্যান্য লোকগীতির উপাদান মিশিয়ে জিপসিরা ফ্লেমেনকোর বিবর্তনে অবদান রেখেছে।

জিপসি যাদুঘর দেখা শেষ করে আমরা বসলাম বাইরে এক খোলা চত্বরে। আমি সবাইকে জিজ্ঞেস করলাম কার কেমন লাগল। ফারজানা বলল, বেশ সুন্দর, অনেক কিছু জানা হলো। নাবিল বলল, ইটস ওকে। নাতাশা বলল, জিপসিরা অনেক গরিব। তাদের হেল্প করা দরকার। আমি বললাম, জিপসিদের সাথে রেড ইন্ডিয়ানদের অনেক মিল আছে। নাতাশা বলল, বাবা, তুমি রেসিস্ট। আমি বুঝে উঠলাম না এখানে রেসিজমের কী আছে! আমার প্রশ্নবোধক ভাব দেখে নাতাশা বলল, রেড ইন্ডিয়ান শব্দটি অফেন্সিভ, বলতে হবে নেটিভ আমেরিকান। আমি আমার জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিলাম।

জিপসি, ফ্লেমেনকো ও আন্দালুসিয়া- একই সূত্রে বাঁধা। তবে ফ্লেমেনকো শুধু গ্রানাদা, বা আন্দালুসিয়ায় নয়, সারা স্পেনেও খুব জনপ্রিয়। আন্দালুসিয়ার ত্রিভুজের তিনটি শহর- গ্রানাদা, সেভিয়া ও কর্ডোভা- তার দু’টি, গ্রানাদা ও সেভিয়া, দাবি করে তাদের এলাকায় ফ্লেমেনকো-র জন্ম ও বিকাশ। তবে জন্ম যেখানেই হোক, ফ্লেমেনকোকে বিশ্বময় জনপ্রিয় করতে এ দুই শহর বিশেষ অবদান রেখেছে। (চলবে)

Ref:

১. অনুবাদ: রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী

২. Baladilla de los tres rios, তিন নদীর বালাদিকা, অনুবাদ: দেবীপ্রসাদ বন্দোপাধ্যায়

৩. Romance sonámbulo, তন্দ্রাচারী গাথা, অনুবাদ: সাজ্জাদ শরিফ

back to top